মানুষ ভয়হীন, অশান্তিহীন, নিরাপদ সমাজে বাস করতে চায়। আসলে চূড়ান্ত সুখ-শান্তি (Ultimate happiness and peace) এখানে সম্ভব নয়। পরিপূর্ণ সুখ হলো জান্নাতে। এখানে অর্থাৎ পৃথিবী হলো মর্যাদা অর্জনের প্রতিযোগিতার স্থান, পরীক্ষাস্থল। মর্যাদা কীসে?
.
মর্যাদা হলো আত্মার সংর্ঘষে। আপনি যত বেশি সংর্ঘষে লিপ্ত হবেন তত বেশি মর্যাদাবান হবেন। যত বেশি নির্বিবাদী জীবনযাপন করবেন তত কম মর্যাদাবান হবেন।
.
এটা দু’রকমের হতে পারে। একটা হলো ইচ্ছা করে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হওয়া, এটার আমি বিরোধিতা করি। ইচ্ছা করে আত্মাকে সংর্ঘষে নেয়ার দরকার নেই। ইচ্ছা করে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া নিষেধ, আল্লাহর নীতিমালা পরিপন্থী। বরং কোরআনে আল্লাহ পরীক্ষা থেকে পানাহ চাওয়ার, ক্ষমা চাওয়ার দোয়া দিয়েছেন।
.
আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহের মাঝেই যে পর্বগুলো আসে সেগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। এটাই যথেষ্ট আপনার মর্যাদা অর্জনের জন্য। টেনে টেনে বিপদ ডেকে আনার দরকার নাই।
.
প্রশ্ন হলো- সমস্যা নিবেন কি নিবেন না, মোকাবিলা করবেন কি করবেন না। প্রকৃতপক্ষে মোকাবেলা আপনাকে করতেই হবে। কারণ সময় এবং ঘটনা দুইটা একসঙ্গে লাগানো। সময় এবং ঘটনা দু’টি নিয়েই সৃষ্টি। সময় অতিবাহিত হচ্ছে মানেই ঘটনা ঘটবে। কারো জীবনই সরলরেখায় পথ চলবে না।
.
জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই। তিতা-মিঠা, রাত-দিন, আলো-আধাঁর, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সব মিলিয়েই জীবন। এর মাঝে থেকে সে আত্মাই বেশি মর্যাদাবান হবে যে আত্মা ক্রমাগতভাবে আসা সংঘাতগুলোকে সবরের সাথে মোকাবেলা করেছে। সংঘাতে না জড়ানো পর্যন্ত আত্মা মর্যাদা লাভ করবে না। পরীক্ষাটা হলো এখানেই। পরীক্ষা দিবেন কি না দিবেন সে ব্যাপারে জোরাজুরি নেই, আপনি স্বাধীন। কিন্তু পরীক্ষা না দিয়ে মর্যাদা লাভ হবে না।
.
যেই না আপনার সামনে কোনো সংকট আসলো সংকটের মোকাবেলা করলে আপনি মর্যাদাবান হবেন। সময় ও ঘটনা স্বাভাবিক গতিতেই চলতে থাকবে। অতিক্রান্ত সময় ও অতিক্রান্ত ঘটনা শত চেষ্টা করলেও আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এটা একেবারে নির্ধারিত, হবেই হবে, এরই নাম ‘কদর’। সূর্য উঠছে, ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, ১টা, ২টা, ৩টা আর থামবেনা চলবেই। ঘটনাও ঘটবেই।
.
কাজেই যে কোনো ঘটনাতেই হইচই করার বা হতাশ হবার কারণ নেই। আল্লাহর নির্দেশনা মতো সবর করেন, আপনি মর্যাদাবান হবেন। আর যে ব্যক্তি সবর করতে পারে নি, সে মর্যাদাও লাভ করতে পারে নি। এক সময় হয়তো দেখা গেল যে, ঘটনাও নেই, সময়ও নেই, মর্যাদাবান হবার সুযোগও নেই। অর্থাৎ প্রত্যেক ঘটনা, প্রত্যেক সময় প্রত্যেক মো’মেন বান্দার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সুযোগ।
.
এই হলো মানুষের মর্যাদার সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। সে দৃষ্টিতে মো’মেনদের কোনো ঘটনাই হতাশার নয়, দুঃখের নয়, কষ্টের নয়। যদিও আপনার দুই হাতের কামাই আর কদর, দুটো মিলিয়ে ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আপনার এ কামাইটাকে আপনি পরবর্তীতে সুখময় করতে পারবেন এখনকার সবরের কারণে।
.
হেযবুত তওহীদের পথ চলায় বহু ঘটনা ঘটছে এবং একইসাথে সময়ও চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কেউ মর্যাদায় উপরে উঠে যাচ্ছে, কেউ নিচে নেমে যাচ্ছে। এই যে সময়টা, এটা কিন্তু প্রত্যেকেই ব্যয় করছে। কেউ সেটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছে কেউ পারছে না।
.
যারা এ সময়ের প্রত্যেকটি ঘটনাকে মোকাবেলা করে চলেছে, সংঘাত থেকে পলায়ন করে নি, তারা ক্রমাগত মর্যাদার সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। আর যারা সংঘাত থেকে পলায়নপর হয়েছে তারা মানব ইতিহাসের অনেক বড় সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছে।
.
সুতরাং বোঝা গেল, মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় সংঘাতে। ভাল-মন্দের সংঘাত, ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত, গ্রহণ-বর্জনের সংঘাত। কাজেই সংঘাতপূর্ণ কাজ, অপ্রত্যাশিত কাজ, কষ্টের কাজ মো’মেনের জন্য দুঃখের নয়, এটা মর্যাদা বৃদ্ধির একটা উপায়।
.
সংঘাত কীভাবে মর্যাদা বৃদ্ধি করে? একটি উদাহরণ দেই। একজন দাবি করল- সে লোভী নয়। অর্থ-সম্পদের উপর তার কোনো লোভ নেই। এখন তার নির্লোভিতার কোনো পরীক্ষা না দিয়েই কি সে মর্যাদাবান হতে পারবে? না, পরীক্ষা তাকে দিতেই হবে। কারণ তার আত্মা তখনও সংঘাতে জড়ায় নি। যত ভালো ছাত্রই হোক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে সার্টিফিকেট পায় না।
.
ধরা যাক, জনগণের এক লক্ষ টাকা ওই নির্লোভ ব্যক্তির কাছে আমানত রাখা হলো। শুরু হলো তার সংঘাতের পালা, অর্থাৎ পরীক্ষা। এখন বোঝা যাবে সে লোভী না নির্লোভ। আবার যদি সে জনগণের ওই টাকা আমানত হিসেবে রাখতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে তার মানে সে মুত্তাকী বটে, কিন্তু আল্লাহ সংঘাত বা পরীক্ষা থেকে পলায়নমুখী মুত্তাকীকে পছন্দ করেন না।
.
আর যদি সে অন্তরের লোভকে দমন করে শেষ পর্যন্ত যথাযথভাবে সেই আমানত রক্ষা করতে পারে তাহলে ওই এক লক্ষ টাকা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিল। সে ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠিতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। সময়ের নিরন্তর প্রবাহে একটি ঘটনাকে সে তার মর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারল। কিন্তু যদি সে এই ঘটনা থেকে পলায়ন করত, তাতে তার মর্যাদা বাড়ত না, আর যদি পরীক্ষায় ব্যর্থ হতো তাহলে মর্যাদাহানি ঘটত।
.
সংঘর্ষ থেকে পলায়নমুখী সবসময় কাপুরুষ। তার দ্বারা না নিজের উপকার হবে, না মানবজাতির উপকার হবে। যারা বলে বেশি সম্পত্তির দরকার নাই, বেশি সম্পত্তি হলে বিপদ, সংঘাত, পরীক্ষা; সে হলো কাপুরুষ। অবশ্যই সম্পদ দরকার আছে। নিজের জন্য দরকার নেই তো কী হয়েছে, মানবতার কল্যাণের জন্য সম্পদ দরকার আছে।
.
সুতরাং মানুষের জীবন প্রবাহ যে কত মূল্যবান, কত অর্থবহ, তা কল্পনাও করা যায় না। এ জীবনপ্রবাহ পাওয়া বিশাল এক ভাগ্যের ব্যাপার। কোটি কোটি টাকার বিনিময়েও এ জীবনপ্রবাহ পাওয়া যাবে না। এ জীবনকে কি আপনি অভিশাপ হিসেবে নিয়েছেন? মরে গেলে ভাল হতো এমন ভাবছেন? তাহলে আপনি জীবনের অর্থই বুঝেন নি।
.
জীবনের বিশাল অর্থ। হাশরের দিন দেখবেন কত মর্যাদা। প্রকৃত মো’মেনরা সংঘাত দেখলে পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণ ওখানেই মরতবা, মর্যাদা। যারা আধ্যাত্মিক সাধনা করে, হুজরা খানকার বাইরে বের হয় না, তার চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকে, পৃথিবীর যাবতীয় সংঘাত, সংঘর্ষ থেকে গা বাঁচিয়ে থাকে তাদের তো আত্মাই নাই। তাদের আত্মা মরে গেছে।
.
যে আত্মা ক্রমাগত ন্যায়-অন্যায়ের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আসছে এবং তার মোকাবেলা করছে সে আত্মাই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মা। মাহাত্মটাই হলো সংঘাতমুখী, জীবনটা নির্ধারিত হয়েছে সংঘাতের দিকে, মর্যাদা নির্ধারিত সংঘাতের মধ্যে, অথচ তারা সেখানে যায়ই নি। যত বেশি ছাত্র তত বেশি প্রতিযোগিতা। সেখানে ভাল করলে মর্যাদাও বেশি। যে ক্লাসে একজন মাত্র ছাত্র পড়ে, তাতে রোল নং এক হওয়ায় কোনো মর্যাদা আছে কি?
.
প্রতিযোগিতা যত কঠিন হবে ততই আপনার মর্যাদা বাড়বে। পৃথিবীতে যত বিকৃত সুফীবাদ আছে কখনই তা প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা নয়। প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা হলো মো’মেনদের জীবনে যেটা ঘটে। দুনিয়াতে লোভ, কাম, ক্রোধ, ঈর্ষা, অহংকার যা আছে এগুলোর কেন্দ্রে দু’টি বিষয়। জান ও মাল এ দু’টোই যখন মো’মেনরা আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ মানবতার কল্যাণে অন্য মানুষের শান্তির জন্য বিলিয়ে দেবে তখন তার মর্যাদা কত উপরে উঠে যাবে কল্পনাও করা যায় না।
.
আমাদের পারিবারিক সংকট আসলে, ব্যক্তিগত সংকট আসলে আমরা মুষড়ে পড়ি। এটা ঠিক না। সংকট আসলো মানে মর্যাদা বাড়ার একটা সুযোগ তৈরি হলো। এটা বিরাট একটা সুযোগ। এগুলো মোকাবেলা করব সব আল্লাহর হুকুম মোতাবেক। এই মাপকাঠি (standard) নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্যই নবী-রসুলগণের আগমন ঘটেছিল। কারণ মাপকাঠি লাগবে। কতটুকু পর্যন্ত কাজ করবে, কতটুকু পর্যন্ত যাওয়া যাবে, এগুলোর মাপকাঠি।
ট্যাগ আর্কাইভঃ ধর্ম
মগজের জট খুলি: মনু ও নূহ (আ.)
মহাভারত ও মৎস্যপুরাণে বৈবস্বত মনু নামে একজন মহর্ষীর উল্লেখ রয়েছে। বাংলা মনুষ্য শব্দটির উৎপত্তি এই মনু শব্দ থেকেই। কেন তা বলছি। বিষ্ণুর দশজন অবতারের মধ্যে মৎস্য অবতার অন্যতম। তিনি মলায়চলের একদেশে গিয়ে বিপুল তপস্যা করেন।
বহু বর্ষ অতীত হলে ব্রহ্মা তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রদান করতে চাইলেন। প্রণিপাত করে মনু বললেন, ‘হে পিতামহ! আমি আপনার নিকট একটিমাত্র বর ইচ্ছা করি। যখন প্রলয়কাল উপস্থিত হবে, তখন আমি যেন জীবসকলসহ সমগ্র জগতের রক্ষা করতে সমর্থ হই।’ ব্রহ্মা ‘তথাস্তু’ বলে অদৃশ্য হলেন।
কিছুদিন পর ভগবান বিষ্ণু মাছের রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়ে বলেন ‘হে নিষ্পাপ! শুনুন, এখন একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটার সময় উপস্থিত। পাহাড়, বনসহ সমস্ত পৃথিবী অচিরেই জলমগ্ন হবে। আপনি সুদৃঢ় একখানি নৌকা নির্মাণ করাবেন আর সপ্তর্ষীগণসহ যাবতীয় জীবের বীজ নিয়ে ঐ নৌকায় আরোহণ করে আমার জন্য প্রতীক্ষা করবেন।”
এরপর শুরু হোল শতবর্ষব্যাপী প্রবল খরা। দারুণ দাবদাহে পৃথিবী ছাইবর্ণ হয়ে গেল। কোথাও এক ফোটা পানি নেই। এরপর এলো সেই প্রচণ্ড ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতসহ মহাপ্লাবন। বিশ্বচরাচর প্লাবিত হয়ে এক মহাসমুদ্রের রূপ নিল।
শিংবিশিষ্ট মৎস্যরূপে ভগবান বিষ্ণু আসলেন। মনু তাঁর শৃঙ্গে রজ্জু বন্ধন করলেন। তিনি তখন মহাবেগে নৌকাকে টেনে নিয়ে সমুদ্রে বিচরণ করতে লাগলেন। মহাপ্লাবনে সকল মানুষে বিলীন হোয়ে গেল, কেবল সপ্তর্ষিগণ, মনু ও মৎস্যই দৃশ্যমান থাকলেন।
মৎস্য এইভাবে অনেক বৎসর সাগরসলিলে নৌকাসহ বিচরণ করতে লাগলেন। অতঃপর একটি পর্বতের চূড়া দৃশ্যমান হলে মৎস্য সেদিকে নৌকা নিয়ে চললেন। সেখানে নৌকা বাঁধা হল।
.
এরপর মৎস্য নৌকারোহীদের বললেন, ‘হে মহর্ষিগণ! আমি মৎস্যরূপ নিয়ে এই বিপদ থেকে তোমাদেরকে উদ্ধার করলাম। এখন এই বৈবস্বত মনু সকল প্রকার জীবজন্তু ও মানুষ সৃষ্টি করবেন।’ বন্যার পানি কমতে লাগলো। পৃথিবী পুনর্ণিমাণের জন্য মনু ও তাঁর পরিবার পাহাড় থেকে ভূমিতে নেমে এলেন এবং পুনরায় পৃথিবীতে বংশবিস্তারের মাধ্যমে মানব প্রজাতি টিকিয়ে রাখলেন।
নূহ (আ.) এর জীবনের সঙ্গে মৎস্যপুরাণের এই ঘটনাটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাম্য দেখা যায়। যেমন:
১। স্রষ্টার নির্দেশে বিরাট নৌকা নির্মাণ।
২। স্রষ্টার পূর্বঘোষিত মহাপ্লাবনে ও বারিবর্ষণে সমগ্র পৃথিবী প্লাবিত হওয়া।
৩। নৌকায় চোড়ে স্রষ্টার সহায়তায় মনু ও ঋষিদের উদ্ধার পাওয়া। উদ্ধারপ্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল অতি অল্প।
৪। সকল প্রাণীর প্রজাতি (বীজ) নৌকায় তোলা ও বন্যার পরে আবার সেসব প্রজাতির বিস্তার ঘটানো।
৫। সকল মানুষ ধ্বংস হওয়ার পর কয়েকজন থেকে আবার মানবজাতির বংশবিস্তার ঘটানো।
প্রশ্ন হলো, অধিকাংশ মুসলিম মনে করেন হিন্দু ধর্ম কাল্পনিক। তাহলে কোর’আনের হাজার হাজার বছর আগের এই পুরাণে প্রায় হুবহু ঘটনার বিবরণ কীভাবে ঠাঁই পেল? এই বৈবস্বত মনু আসলে কে?
কেন মুসলিমরা জাহান্নামের জ্বালানী হবে?
একটি হাদীস শেষের অংশ থেকে শুরু করি। রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, যারা এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও দূরে সরে যাবে, তাদের গলদেশ থেকে ইসলামের বন্ধন খুলে যাবে যদি না সে তওবা করে ফিরে আসে। আর যে জাহেলিয়াতের কোনো কিছুর দিকে আহ্বান করে সে জাহান্নামের জ্বালানি পাথরে পরিণত হবে, যদিও সে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এমন কি নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাসও করে [হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিজি, বাব-উল-ইমারত, মেশকাত]।
এই যে ভয়ঙ্কর কথাটি রসুলাল্লাহ বললেন, “নামাজ রোজা করলেও, মুসলিম বলে মনে করলেও জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে” – কেন?
প্রথমেই ঐক্য। তারপরে শৃঙ্খলা। তারপর আনুগত্য। তারপর হিজরত (যাবতীয় অন্যায়, অসত্য, শেরক, কুফরকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান)। তারপর জেহাদ (ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা)।
এখন ১৫০ কোটি মুসলমান নামক এই জাতির ঐক্যের কী পরিস্থিতি সেটা আশা করি সবাই দেখতে পাচ্ছেন। শৃঙ্খলা তো প্রশ্নই আসে না, কোথাও নেই। আর আনুগত্য? কার আনুগত্য করবে? জাতির নেতা কে? গত কয়েক শতাব্দী থেকে কি জাতির নেতা আছে কোন? যে যার মতো ফতোয়া দিচ্ছে, যার ইচ্ছা মানছে যার ইচ্ছা নাই মানছে না, ভিন্ন ফতোয়া বের করছে, জাতির কোনো লক্ষ্য নাই, উদ্দেশ্য নাই। আর অন্যায়ের থেকে হিজরত? প্রশ্নই আসে না। দুনিয়ার সমস্ত পাপাচার, অন্যায়, অবিচার, শিরক, কুফরকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে নামধারী মুসলিম জাতি।
সুদ, ঘুষ, সন্ত্রাস ইত্যাদির কথা বাদ দিলাম, সামান্য ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বললাম তাতেই জবাই করে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই যাবতীয় অন্যায়কে এরা আলিঙ্গন করে নিয়েছে বহু শতাব্দী আগে থেকেই।
জেহাদ তো বাদ দিয়েছে ১৩০০ বছর আগেই। তারপর থেকে তথাকথিত সুলতানরা সাম্রাজ্যবিস্তারের যুদ্ধ করেছে, লুটপাট চালিয়েছে এবং সেটাকেই জেহাদের নামে চালিয়ে দিয়েছে। আর বর্তমানে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দাজ্জালীয় শক্তির ক্রীড়নক হিসাবে কিছু লোক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে আর সেটাকে জেহাদ নাম দিয়ে ইসলামকে কলঙ্কিত করছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মানবতার কল্যাণে নিঃস্বার্থ নির্মোহ সংগ্রাম হারিয়ে গেছে বহু আগেই। মুসলিম এখন মরা, নির্জীব, নিবীর্য হয়ে সবার মার খাচ্ছে। তার দুনিয়ার জীবনটাই তো জাহান্নাম। তারা আখেরাতে জাহান্নামের জ্বালানী হবে না তো কী হবে?
সামানান কালীলা
পবিত্র কোর’আনে আল্লাহর বাণীকে, সত্যকে গোপন (conceal) করার ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যবহার করেছেন ‘তাক্তুমু, ইয়াকতুমুনা’ এই শব্দগুচ্ছ। আর ধর্মের কাজ করে মানুষের কাছ থেকে তার বিনিময়ে তুচ্ছ পার্থিব মূল্য, বৈষয়িক স্বার্থ small price, a gain) হাসিল করার ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যবহার করেছেন ‘সামানান কালিলান’। এই শব্দ দুটো কোর’আনে বার বার এসেছে। এ কাজটি যে কেবল হারামই নয়, এটা যে কুফর, যারা এ কাজ করবে তারা যে আগুন খাচ্ছে, পরকালেও তারা যে জাহান্নামে যাবে, তারা যে আলেম নয় পথভ্রষ্ট, পবিত্র কোর’আনের সুরা বাকারার ১৭৪-১৭৫ নম্বর আয়াতে এই সবগুলো কথা আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ও সরল ভাষায় উল্লেখ করেছেন যা বোঝার জন্য কোনো তাফসির বা ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না, সরল অনুবাদই যথেষ্ট। এ আয়াতে আল্লাহ বলেন,“বস্তুত, যারা আল্লাহ কেতাবে যা অবতীর্ণ করেছেন তা গোপন করে এবং এর বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করে, তারা তাদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ঢুকায় না। এবং আল্লাহ হাশরের দিন তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না। এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। এরাই হচ্ছে সেই সমস্ত মানুষ যারা সঠিক পথের (হেদায়াহ) পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা (দালালাহ) এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করে নিয়েছে। আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল।”
এই দীনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি এই আয়াতে ঘোষিত হয়েছে। যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কেতাবের বিধিবিধান ও শিক্ষাকে গোপন করে এবং দীনের বিনিময়ে অর্থ বা স্বার্থ হাসিল করে তারা-
১। “আগুন ছাড়া কিছুই খায় না।” অর্থাৎ তারা যা কিছু খায় তা সমস্তই জাহান্নামের আগুন। তাদের এই অপকর্ম, গর্হিত কাজ তাদের ভক্ষিত সকল হালাল বস্তুকেও হারামে পরিণত করে, যেভাবে আগুন সব কিছুকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।
২। “হাশরের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না”। এ থেকে বোঝা যায় আল্লাহ তাদের উপর কতটা ক্রোধান্বিত। আল্লাহ যার সাথে কথাও বলবেন না তার সেই মহাবিপদের দিন কী দুর্দশা হবে কল্পনা করা যায়?
৩। “তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না।” মানুষ মাত্রই পাপী, আল্লাহর ক্ষমার সরোবরে স্নান করেই মানুষ পাপমুক্ত হয়ে জান্নাতে যেতে পারে। আল্লাহর এই ক্ষমার হকদার হচ্ছে মো’মেনগণ। কিন্তু যারা ধর্মব্যবসায়ী তারা গাফুরুর রহিম, আফওয়ান গফুর, গাফুরুন ওয়াদুদ, সেই অসীম প্রেমময় ক্ষমাশীল আল্লাহর ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত হবে। আল্লাহ তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না।
৪। “তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব”। এ হচ্ছে চূড়ান্ত কথা যা সব অস্পষ্টতাকে নস্যাৎ করে দেয়। ধর্মের কাজ করে স্বার্থহাসিলকারীরা জাহান্নামী এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহের বা দ্বিমত পোষণের অবকাশ থাকে না।
৫। “তারা হেদায়াতের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে”। খুবই দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য। আমরা আলেম সমাজের কাছে কেন যাই, কেন তাদের ওয়াজ, খোতবা নসিহত শ্রবণ করি? নিশ্চয়ই পরকালীন মুক্তির পথ জানার জন্য? হেদায়াহ শব্দের মানেই হচ্ছে সঠিক পথনির্দেশ। আল্লাহ বলেই দিচ্ছেন, যারা ধর্মের কাজের বিনিময় গ্রহণ করে তারা নিজেরাই পথভ্রষ্ট।
একজন পথভ্রষ্ট মানুষ কী করে আরেক ব্যক্তিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে? এ কি সম্ভব?
এত ধর্ম-কর্ম! তবু কেন অশান্তিতে সমাজ?
এ বিষয়টি বুঝতে পণ্ডিত হবার দরকার নেই যে, রাষ্ট্র অরাজক হলে অশান্তি পোহাতে হয় জনগণকে। তাই সবার আগে রাষ্ট্রকে ন্যায়ের দণ্ড ধারণ করতে হয়, তবেই জনগণ শান্তিপূর্ণ সমাজ পায়। কোনো আদর্শ যদি এমন হয় যে, তাতে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপরিচালক নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই, তাহলে ঐ আদর্শ আর যাই হোক সমাজে শান্তি আনার জন্য যথেষ্ট নয়। ঐ আদর্শ পূর্ণাঙ্গ আদর্শ নয়। এজন্য গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি সমস্ত মতাদর্শই কিন্তু রাষ্ট্রকে নিয়ে কথা বলে, রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট সিস্টেমের মধ্যে ফেলে সমাজে শান্তি আনয়নের চেষ্টা করে। কোনো মতাদর্শই রাষ্ট্রকে এড়িয়ে সমাজে শান্তি আনার অলীক কল্পনা করে না।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র না হয়ে যখনই ইসলামের প্রসঙ্গ আসে, আমাদের মধ্যে একটি শ্রেণি সেই অযৌক্তিক কল্পনাটিই করে থাকেন। তারা চান ইসলাম মানুষকে শান্তি এনে দিক, সমাজে ন্যায়, সাম্য প্রতিষ্ঠা করুক, কিন্তু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথা না বলুক। এই স্ববিরোধী ও অযৌক্তিক দাবি তারা কীভাবে করেন? আজ যদি কোনো সমাজতন্ত্রীকে নসিহত করা হয়, ভাই, তোমরা আর্তপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করছো কর, কেবল একটাই অনুরোধ- রাষ্ট্র নিয়ে, রাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থা নিয়ে কোনো কথা বল না, এ বাদে অন্য যে কোনো বিষয়ে বলতে পারো আপত্তি নাই। তাহলে ঐ সমাজতন্ত্রী কি তা মেনে নিবেন? যদি কোনো গণতান্ত্রিক মতাদর্শীকে নসিহত করা হয়, তোমরা সমাজ, পরিবার, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি সকল বিষয়ে কথা বলো, শুধু রাষ্ট্র নিয়ে কোনো কথা বলো না, তাহলে কথাটি কেমন শোনাবে?
শিকারীকে বাঘ শিকার করতে হয় বনে গিয়ে। যদি আপনি তাকে বনেই যেতে না দেন, বনে না গিয়ে অন্য যে কোনো স্থান থেকে বাঘ শিকার করে আনতে বলেন সেটা শিকারীর পক্ষে সম্ভব হবে কি? জেলে কি পারবেন জলাধারে না গিয়ে মাছ ধরে আনতে? না। কিন্তু আমরা ওটাই চাচ্ছি ইসলামের বেলায়। তারপর যখন সমাজে খুব ধর্মকর্ম থাকার পরও, লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা থাকার পরও, লক্ষ মানুষের ইজতেমা হবার পরও, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর হজ্ব করতে যাওয়ার পরও এবং রমজান মাসে ভাব-গাম্ভীর্যের সাথে রোজা পালনের পরও সমাজ অন্যায়, অবিচার, খুনোখুনি, ধর্ষণ, রক্তারক্তি, দুর্নীতি ইত্যাদিতে ভরপুর হয়ে থাকে, তখন তাচ্ছিল্যের সুরে বলা হয়- এই কি তবে ইসলামের শান্তির নমুনা? কী হাস্যকর মূল্যায়ন!
আমাদের কথা হচ্ছে, তারা যদি সত্যিকার অর্থেই ইসলামের শান্তির নমুনা দেখতে চান তবে বলতে হয়, সে সময় এখনও আসে নি। যে এখনও পরীক্ষাতেই বসল না, তার পাস বা ফেল হবার প্রসঙ্গ আসে কি? তাকে আগে পরীক্ষায় বসতে দিন, জেলেকে জলাধারে যেতে দিন, শিকারীকে বনে যেতে দিন, তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার সময় আসবে। আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলামকে সর্বপ্রথম একটি জনগোষ্ঠী তাদের সামষ্টিক জীবনে গ্রহণ ও কার্যকর করেছিল। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজজীবন নয় কেবল, ঐ ইসলামকে অধিকার দেওয়া হয়েছিল তাদের জাতীয় জীবন নিয়ে কথা বলার, পরিবর্তন ও সংস্কারসাধন করার। তবেই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচাইতে বড় রেনেসাঁটি সংঘটিত হয়েছিল।
যদি আরবরা আল্লাহর রসুলকে শর্ত জুড়ে দিতেন যে, ‘আপনি আমাদের ব্যক্তি ও সমাজজীবন নিয়ে কথা বলুন, কীভাবে ভালো হয়ে চলা যায়, কীভাবে সত্য কথা বলা যায়, কীভাবে হালাল কাজ করা যায়- এসব বলুন, কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবন নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। ওটা আমরা যেভাবে রেখেছি সেভাবেই থাকবে। জাতীয় জীবনে আমাদের গোত্রপতিরা যা বলবেন আমরা তাই করব, তবে চিন্তা করবেন না, ব্যক্তিজীবনে আমরা খুব ভালো মুসলিম হব, আপনার আনিত ইসলামের সমস্ত হুকুম আহকাম মেনে চলব।’ এই শর্ত মেনে সেই ইসলাম কি পারত আরবদের দাঙ্গা-হাঙ্গামাপূর্ণ অনিরাপদ সমাজকে পাল্টিয়ে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার ও নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে?
আমাদের ঈদ উদযাপনের বাস্তবতা
আনন্দ ও বেদনা আত্মার ভেতর থেকে আসতে হয়, জোর করে এটি করা যায় না। একটা মানুষ আত্মা থেকে তখনই আনন্দ অনুভব করে যখন তার কোনো আকাক্ষা, স্বপ্ন পূরণ হয়, যেমন পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করা, চাকরিতে পদোন্নতি পাওয়া, যে কোনো প্রতিযোগিতায় ভাল করা ইত্যাদি। ঠিক একইভাবে একজন আত্মা থেকে বেদনা, কষ্ট অনুভব করে তখনই যখন সে তার কোন আকাক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। যদি কোনো ব্যক্তি সকল বিষয়ে সফল হতে থাকে তবে ছোট খাট ব্যর্থতা তাকে কষ্ট দিতে পারে না, একইভাবে আজন্ম ব্যর্থ ব্যক্তি দু’-একটা সফলতায় খুব বেশি আনন্দিত হতে পারে না। শোকে, কষ্টে তার চেহারা হয়ে যায় নিরানন্দ, করুণ, তার চেহারায় আনন্দ যেন বেমানান।
সে আনন্দ করলেও লোকে দেখে ঠাট্টা করবে, তাছাড়া ব্যর্থতার সমুদ্রে নাকানি-চুবানি খাওয়া অবস্থায় বিশেষ কোনো দিনে ঘটা করে মহা আনন্দিত হওয়া নিতান্তই বোকামী। এটা গেল ব্যক্তি পর্যায়ের আনন্দের ও বেদনার কথা কিন্তু একটা জাতি কখন আনন্দিত হতে পারে? এক্ষেত্রেও আনন্দিত ও বেদনার্ত হওয়ার সূত্র একই, অর্থাৎ কোনো জাতি যখন জাতিগতভাবে বিশেষ কিছু অর্জন করে, কোনো আকাক্ষা বা লক্ষ্য সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে পূরণ করে তখন ঐ জাতির প্রত্যেকেই অত্যন্ত আনন্দিত হয় এবং এর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে উৎসবের আয়োজন করাও যুক্তিযুক্ত হবে।
কিন্তু কোনো জাতি যদি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরাজিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত, নিষ্পেষিত হতে থাকে অনবরত তবে সেই জাতির অন্তত জাতিগতভাবে লাঞ্ছনার জীবনের অবসান না হওয়া পর্যন্ত আনন্দ উৎসব করা যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমি মনে করি না। যাদের বিন্দুমাত্র কোনো প্রাপ্তি নেই, জাতিগতভাবে অপমান আর লাঞ্ছনা যাদের নিত্যসঙ্গী তাদের আনন্দ উৎসব করার ইচ্ছা জাগে কী করে? অবশ্য যাদের অপমান বোধই নেই তাদের পক্ষে সবই সম্ভব। জাতির লক্ষ্য সম্পর্কেই যারা অজ্ঞাত তাদের আবার লক্ষ্য অর্জন করতে না পারার বেদনা কোথায়! যে পরীক্ষাই দেয় না তার তো অকৃতকার্য হবার কিছু নেই। যাই হোক, একটা জাতির মধ্যে অনেক ধরনের মানুষ থাকে সুতরাং আমি বিশ্বাস করি এই মুসলিম নামক জনসংখ্যার অতি অল্প সংখ্যক মানুষ হলেও আছে যারা এই জাতিকে নিয়ে ভাবে, তাই তাদের উদ্দেশ্যেই কিছু কথা বলা দরকার।
রসুলাল্লাহ মক্কার ১৩ বছরে ঈদ উদযাপন করেন নাই, তিনি সর্বপ্রথম ঈদ উদযাপন করেন দ্বিতীয় হেজরী অর্থাৎ সমাজে আল্লাহর হুকুমত, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পর। কারণ তখন মদীনায় ইসলামের বিজয়কেতন পতপত করে উড়ছে, ইসলামের যে লক্ষ্য, যে উদ্দেশ্য (সমস্ত পৃথিবীব্যাপী আল্লাহর সত্যদীন তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে শান্তি আনয়ন) তা বাস্তবায়িত হওয়া শুরু হয়েছিল এবং রসুলাল্লাহর ওফাতের পর ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। এরপর জাতি তার আকীদা, তার উদ্দেশ্য ভুলে গেল, তারা ভুলে গেল তাদের কেন সৃষ্টি করা হয়েছে কিন্তু ততোদিনে তারা অর্ধপৃথিবীর শাসনকর্তা, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, অর্থ-সম্পদে সকল দিক দিয়ে সর্বোচ্চ আসনে আসীন। শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে তারা পরবর্তী প্রায় সাত/আটশ’ বছর পর্যন্ত ছিল তবে বিভিন্ন দিক দিয়ে তাদের পরাজয়, অধঃপতন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখন পর্যন্তও তাদের জন্য ঈদ উদযাপন যুক্তিযুক্ত ছিল কিন্তু যখন থেকে তারা ইউরোপীয় শক্তির দাসে পরিণত হলো, জাতিগতভাবে পরাজয়, অপমান, লাঞ্ছনা যখন পিছু নিল তখন থেকে আর ঈদ উদযাপন যুক্তিযুক্ত রইল না।
আর বর্তমানের অবস্থা তো আরও ভয়ঙ্কর, পৃথিবীর অন্য সব জাতিগুলি এই জনসংখ্যাকে পৃথিবীর সর্বত্র ও সর্বক্ষেত্রে পরাজিত করছে, হত্যা করছে, অপমানিত করছে, লাঞ্ছিত করছে, তাদের মসজিদগুলি ভেংগে চুরমার করে দিচ্ছে অথবা সেগুলিকে অফিস বা ক্লাবে পরিণত করছে। এই জাতির মা-বোনদের তারা ধর্ষণ করে হত্যা করছে। কয়েক শতাব্দী আগে আল্লাহ ইউরোপের খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলিকে দিয়ে মুসলিম বলে পরিচিত এই জাতিটিকে সামরিকভাবে পরাজিত করে তাদের গোলাম, দাস বানিয়ে দিয়েছেন। এটা ছিল আল্লাহর শাস্তি।
আর বর্তমানেও পৃথিবীর কোথাও আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত নেই, অধিকাংশ জায়গাতে মুসলিম নামক এই জাতি অন্য জাতির হাতে মার খাচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, পরাজিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে, একটার পর একটা ভূখ- ধ্বংস ও দখল করে নিচ্ছে অন্য জাতি, দুর্ভিক্ষে পতিত হয়ে মারা যাচ্ছে, সাড়ে ছয় কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু। আবার এ জাতির সদস্যরা নিজেরা নিজেরাও শিয়া-সুন্নি, ফেরকা-মাজহাব, দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে মারামারি করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। জাতির মধ্যে কোনো ঐক্য চেতনা নেই। এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে তো জাতি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কাজেই আমাদের উচিত হবে রসুলাল্লাহ (সা.) এর ঈদ উদযাপন ও এর লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সচেতন হওয়া ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া। এবারের ঈদ যেন আমাদের মধ্যে জাতিগত এই ঐক্যচেতনা সৃষ্টি করে, আমীন।
পবিত্র কোর’আনটা কি?
কোর’আনের আইন, শরীয়াহ আইন ইত্যাদি পরিভাষা দেখে দয়া করে কেউ প্রতারিত হবেন না। মনে রাখবেন কোর’আন কোনো আইনের বই না। আবার কোর’আনকে সংবিধান হিসেবে পরিচিত করার যে প্রবণতা লক্ষ করা যায় সেটাও একটা ফাঁদমাত্র।
মূলত কোর’আন কোনো সংবিধান নয়। অনুরূপ কোর’আনকে দণ্ডবিধির বইও বলা চলে না। তবে হ্যা, কোর’আনে কিছু আয়াত আছে যা অনেকটা আইনের মত শোনায়, কিছু আয়াত সংবিধানের মত শোনায়, কিছু আয়াত দণ্ডবিধির মধ্যেই পড়ে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সর্বসাকুল্যে কোর’আন ওসবের একটাও নয়।
কোর’আনে বিশ্বপ্রকৃতি ও মহাকাশ সংক্রান্ত বহু আয়াত আছে যা বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক সত্যে পূর্ণ কিন্তু তাই বলে কি কোর’আন বিজ্ঞানের বই না কোর’আন কোনো ইতিহাসের বইও নয়, যদিও কোর’আনে অতীতের বহু জাতির ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।
কোর’আন কী সে প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ স্বয়ং দিয়েছেন। বলেছেন এটা উপদেশগ্রন্থ। আবার কোর’আনকে বলো হয়েছে ‘ফেরকান’ অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা পার্থক্যকারী গ্রন্থ। বলা হয়েছে কোর’আনুল কারীম অর্থাৎ যেটা পুনঃপুনঃ পাঠ করা হয়। কারণ যেন মানুষ কোর’আনের মূল্যবোধকে সদাসর্বদা স্মরণে রেখে কাজ করতে পারে। কাজেই আল্লাহ যেটুকু বলেছেন আমরা কোর’আনকে আধুনিকতার মোড়ক পরাতে গিয়ে যেন তার বাড়াবাড়ি না করে ফেলি। কোর’আনের আইন নিয়ে যদি কেউ কথা বলতে আসে তাদেরকে সোজা প্রশ্ন করবেন, কোর’আনে কয়টা আইনের কথা আছে? কোর’আনে কয়টা রাষ্ট্র পরিচালনার ধারা-উপধারা, নীতিমালা ইত্যাদি আছে? কোর’আনে কয়টা দণ্ডবিধি আছে?
চুরি, ব্যাভিচার আর হত্যার বাইরে সমাজে হাজার হাজার অপরাধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেগুলোর শাস্তি কী হবে? আবার চুরির বিধান হাত কাটাই ধরুন। বাপের মানিব্যাগ থেকে ছেলের দশ টাকা চুরিও চুরি, রিজার্ভের আটশ’ কোটি টাকা চুরিও চুরি, উভয়ের শাস্তিই কি হাত কাটা? এবার তারা শরীয়তের বই হাজির করবে। অথচ আপনি হয়ত জানেন না সেই শরীয়তের বই আল্লাহর নাজেলকৃত গ্রন্থ নয়। সেটা আজ থেকে শত শত বছর পূর্বের একদল আলেমের রচিত গ্রন্থ, যারা তাদের পারিপার্শিক অবস্থা, স্থান, কাল ইত্যাদি বিবেচনা করে সেই সময়ের মানুষের জন্য প্রযোজ্য বিধি-বিধান রচনা করেছিলেন। সেটা কী করে কোর’আনের আইন হয়? সেটা বড়জোর আলেমদের আইন হতে পারে।
বর্তমানের এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে, বিশ্ব যখন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখী হচ্ছে, তখন হাজার বছর আগের মুফতি-ফকিহদের ঐ বিধান কতটুকু প্রযোজ্য হতে পারে? কিন্তু কোর’আনের আইনের ধুয়া তুলে সেই পুরোনো আমলের শরীয়তের বইটাকেই জাতির উপর চাপানোর চেষ্টা চালানো হয়, আর তা দেখে যুগসচেতন মানুষরা ইসলামকেই ভুল বোঝেন। সত্য হচ্ছে কোর’আন ন্যায় ও অন্যায়কে বুঝতে শেখায়। সত্য থেকে মিথ্যাকে পৃথক করে দেয়। ব্যস, এবার মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে সে তার সামগ্রিক জীবনে সর্বাবস্থায় সত্য ও ন্যায়কে প্রাধান্য দেবে। কোনো বিধান সেটা প্রয়োগের ফলে আলটিমেটলি মানুষ ন্যায় পাচ্ছে নাকি অন্যায় পাচ্ছে? যদি ন্যায় পেয়ে থাকে তাহলে সেটাই ইসলামের আইন। আর যদি সে আইনের দ্বারা অন্যায়ের বিজয় হয় তাহলে সেটা তাগুতের আইন।
কোনো রাষ্ট্র, সেটার গঠন যদি এমন হয় যে তার দ্বারা আলটিমেটলি ন্যায় ও সত্যের প্রকাশ ঘটে, রাষ্ট্র পরিচালকরা ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান থাকেন এবং জনগণ ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি পায় তাহলে সেটাই ইসলামী রাষ্ট্র। অপরাধীকে দণ্ডবিধির যে ধারায় শাস্তি দিলে ন্যায়ের বিজয় হয় সেটাই ইসলামী দণ্ডবিধি। আল্লাহ কেবল বড় বড় কয়েকটা অপরাধ- যেমন, চুরি, ব্যভিচার, হত্যা ইত্যাদির শাস্তি দানের ক্ষেত্রে সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যে, ওই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ওই পর্যন্তই। চুরির শাস্তি বড়জোর হাত কাটা পর্যন্তই। তার বেশি নয়। তবে নিম্নে যতদূর ইচ্ছা শাস্তি কমিয়ে দেওয়া যায় অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে, এমনকি ক্ষমাও করা যায়।
এই সীমারেখা নির্ধারিত না থাকলে কী হতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজেই তো আছে। সামান্য চুরির দায়ে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। যেখানে কোর’আনের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠত থাকবে, সেখানে কস্মিনকালেও এমন হবার নয়।
একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ নিজে সত্য, আর সত্য থেকেই আসে ন্যায়। কাজেই ন্যায়ের স্থাপনা হওয়া মানেই আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়া, কোর’আনের শাসন কায়েম হওয়া।
এ লেখার বিষয়ে কারো কোন অভিযোগ থাকলে বা পরামর্শ থাকলে সরাসরি মুঠোফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন – 01787 682096
ইসলাম ধর্ম ও সনাতন (হিন্দু) ধর্ম – পর্ব শেষ
প্রথম পর্ব পড়ে না থাকলে এইখানে ক্লিক করুন, ২য় পর্ব পড়ে না থাকলে এইখানে ক্লিক করুন,
যে ধর্ম মানবসমাজে শান্তি দিতে পারে না, সেটা প্রকৃত ধর্ম নয়, সেটা ধর্মের লাশ। আজ সারা বিশ্বে যে ধর্মগুলি চালু আছে সেগুলোকে প্রাণহীন লাশ বানিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেই লাশকে নিয়েই ব্যবসা করছেন কথিত আলেম ও পুরোহিত গোষ্ঠী। মানুষের পেটে যখন ভাত নেই, উপাসনালয় থেকেও যখন জুতা চুরি হয়, যেখানে চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হয় তখন সেই অন্যায় অবিচার বন্ধ না করে, তার ন্যূনতম প্রতিবাদও না করে যারা মসজিদে-মক্কায় গিয়ে মনে করছেন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট, মন্দিরে গিয়ে দুধ-কলা দিয়ে, গয়া-কাশিতে গিয়ে মনে করছেন দেবতা বুঝি স্বর্গ থেকে তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করছেন, তারা ঘোর ভ্রান্তির মধ্যে আছেন। চলমান …
পর্ব তিন শুরু…
আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, কোন মানুষের ঈমান সঠিক হতে পারবে না যতক্ষণ না সে সৎ ও বিশ্বাসী হয়। আমি তোমাদেরকে হেদায়েত করছি যে তোমরা কোন ব্যক্তির অধিক নামাজ ও অধিক রোজা দেখে ভুল করো না, বরং লক্ষ্য করো সে যখন কথা বলে সত্য বলে কি না, তার কাছে রাখা আমানত বিশ্বস্ততার সাথে ফিরিয়ে দেয় কিনা এবং নিজের পরিবার পরিজনের জন্য হালাল উপায়ে রোজগার করে কিনা।’ (সিরাত বিশ্বকোষ – ইসলামিক ফাউন্ডেশন)।
একই শিক্ষার প্রতিধ্বনী করে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “কেহ ধার্মিক কি অধার্মিক পরীক্ষা করিতে হইলে দেখিতে হইবে, সে ব্যক্তি কতদূর নিঃস্বার্থ। যে অধিক নিঃস্বার্থ সে অধিক ধার্মিক। সে পণ্ডিতই হউক, মূর্খই হউক, সে শিবের বিষয় জানুক বা না জানুক সে অপর ব্যক্তি অপেক্ষা শিবের অধিকতর নিকটবর্তী। আর যদি কেহ স্বার্থপর হয়, সে যদি পৃথিবীতে যত দেবমন্দির আছে, সব দেখিয়া থাকে, সব তীর্থ দর্শন করিয়া থকে, সে যদি চিতা বাঘের মতো সাজিয়া বসিয়া থাকে, তাহা হইলেও সে শিব হইতে অনেক দূরে অবস্থিত (রামেশ্বর-মন্দিরে প্রদত্ত বক্তৃতা)।
আমাদের এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বলতে কিছু ছিল না। ব্রিটিশদের শাসনযুগের আগে এখানে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা একটিও হয় নি। হ্যাঁ, রাজনৈতিক সংঘাত অনেক হয়েছে, তবে সাম্প্রদায়িক সংঘাত একটাও নয়। ব্রিটিশ বেনিয়ারা ভারত দখল করার পরই চালিয়ে দিল Divide and rule নীতি। তারা হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য আলাদা স্কুল-কলেজ বানালো, আলাদা রাজনৈতিক দল বানালো, আলাদা হোটেল বানালো, কলেজে আলাদা হোস্টেল বানালো। তারা হিন্দুদেরকে শেখালো মুসলিমরা বিদেশী আগ্রাসনকারী জাতি, তারা এ মাটির সন্তান নয়। এতদিন যে দেশে হিন্দু মুসলিম শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করেছে, একই বাজারে সদাই করেছে, একই পুকুরের পানি খেয়েছে, হিন্দু ডাক্তার মুসলমান রোগীর চিকিৎসা করেছে, মুসলমানদের চাষ করা ফসল হিন্দুরা খেয়েছে সেই দেশেই সৃষ্টি হলো জাতিগত দাঙ্গার। রায়টে লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমানের লাশ পড়ল, বাড়ি পুড়ল, উদ্বাস্তু হলো। শেষতক এক দেশে থাকাও তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না, তারা দুই জাতির জন্য দেশ ভাগ করে ফেলল। এ সবই হলো ব্রিটিশদের কূটবুদ্ধির ফল। আজ হিন্দুদের উগ্রবাদী একটি গোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের মহামানবদেরকে, কেতাবকে গালি দেয়, মুসলমানদের উগ্রবাদী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী হিন্দুদের উপাস্যদেরকে, অবতারগণকে গালি দেয়। তাদের এই পারস্পরিক বিদ্বেষ সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের মধ্যে ছড়ায়। তখন সৃষ্টি হয় দাঙ্গা। এই দাঙ্গার পরিণতি কী তা ভারতবাসী গত দেড়শ বছরে প্রত্যক্ষ করেছে, সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। ব্রিটিশরা এভাবে দুই ভাইকে শত্রুতে পরিণত করে দিয়ে গেছে। এইসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে ধান্ধাবাজ রাজনৈতিক গোষ্ঠী কীভাবে কাজে লাগায় সে তথ্যও সকলের জানা।
কিন্তু এই শত্রুতা আর কতদিন? এখনও কি সময় হয় নি শত্রুতা ভুলে নিজেদের সত্যিকার পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে আবার ভাই ভাই হয়ে যাওয়ার? এটা করার জন্য প্রয়োজন কেবল মানসিকতার পরিবর্তনের, প্রয়োজন সত্য সম্পর্কে জানার। আমরা এই দুটো জাতির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি, তাদের উভয়ের ধর্মের মূল সত্য যে এক সেটাকে উভয়ের ধর্মগ্রন্থ থেকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আমরা বলছি, ধর্ম কোনো আচার অনুষ্ঠানের নাম নয়, ধর্ম হচ্ছে একটি বৈশিষ্ট যা কোনো বস্তু ধারণ করে। আগুনের ধর্ম হলো পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো, চুম্বকের ধর্ম আকর্ষণ করা। আগুন যদি না পোড়ায়, পানি যদি না ভেজায়, চুম্বক যদি না টানে তাহলে সে তার ধর্ম হারালো। তেমনি মানুষের প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে মানবতা। এই মানবতাবোধে মানুষকে জাগ্রত করার জন্যই নবী-রসুল-অবতারগণ যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন। তারা সত্য নিয়ে এসেছেন, যারা সেই সত্যকে ধারণ করেছেন তারাই হয়েছে ধার্মিক। যদি মানুষ সত্যকেই ধারণ না করে, মানবতাবোধে পূর্ণ না হয়, সে যতই উপাসনা করুক সে ধর্মহীন। ইসলামের একটি নাম হচ্ছে দীনুল হক যার অর্থ সত্য জীবনব্যবস্থা। যে জীবনব্যবস্থা মানবজাতিকে সত্যে পূর্ণ করবে সেটাই তো প্রকৃত ধর্ম। শেষ নবী আরবে এসেছেন, তাই কোর’আনও এসেছে আরবিতে। কিন্তু ভারতবর্ষের অবতারগণ কথা বলেছেন সংস্কৃতিতে বা এ অঞ্চলের কোনো ভাষায়। তাঁদের উপর যে শাস্ত্রবাণী এসেছে সেগুলো এ অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত ভাষাতেই এসেছে। ভাষার পার্থক্য থাকলেও সত্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। খালের পানি, নদীর পানি, সাগরের পানি, বৃষ্টির পানি সব পানিরই আণবিক গঠন অভিন্ন।
মুসলমানেরা যদি মনে করে আরবভূমি তাদের, হিন্দুরা যদি মনে করে ভারত কেবল তাদের, খ্রিষ্টানরা যদি মনে করে ইউরোপ শুধু তাদের, ইহুদিরা যদি মনে করে ফিলিস্তিন কেবল তাদের, বৌদ্ধরা যদি মনে করে মিয়ানমার কেবল তাদের তাহলে সেটা হবে চরম মূর্খতা। কারণ পৃথিবী আল্লাহর, সমস্ত ভূমি আল্লাহর। মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, মাটিতেই আবার তাকে ফিরে যেতে হবে। তাই এই মাটির উপর অধিকার রয়েছে প্রত্যেক বনি আদমের। কোর’আন মোতাবেক মাটির মানুষের ভিতরে আল্লাহর রূহ রয়েছে (সুরা হিজর -৯)। সনাতন ধর্মমতে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই পরমাত্মার অংশ রয়েছে। প্রতিটি মানুষ স্রষ্টার প্রতিভূ। সেই মানুষের অধিকারকে অস্বীকার করে কেউ আল্লাহর, পরমাত্মার, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবে না।
একই ভাবে খ্রিষ্টধর্ম, ইহুদিধর্ম, জরোথুস্ত্রীয় ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মও একই স্রষ্টা থেকে আগত, যদিও তাদের ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। এদের সকলকেই তাদের স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে এক মহাজাতিতে পরিণত করা সম্ভব। সেটা কীভাবে তা পরবর্তী কোনো এক সময় আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। তবে সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে একটা কথা উপলব্ধি করতে হবে যে, আল্লাহ, ঈশ্বর, গড, এলি, ভগবান, পরমব্রহ্ম চান মানবজাতির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব। আর ইবলিস, শয়তান, এভিল স্পিরিট, ডেভিল, লুসিফার, আসুরিক শক্তি চায় মানুষে মানুষে অনৈক্য, শত্রুতা, বিদ্বেষ। প্রকৃত যারা ধার্মিক তারা বিশ্বাস করেন, আল্লাহর এই চাওয়াকে পূরণ করাই হলো ধর্ম।
এত কথা, এত লেখার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য পরিষ্কার, তা হলো এই- এ অঞ্চলে অন্তত মধ্যপ্রাচ্যের মতো জঙ্গিবাদী তা-ব সেভাবে এখনও বিস্তার লাভ করে নি, তবে সেই ষড়যন্ত্র চলছে। আর এই তা-বকে রুখে দিতে হলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে পরস্পরের দিকে ঐক্যের হাত প্রসারিত করতে হবে। কেবল ঈদের দিনে মুসলমানে মুসলমানে কোলাকুলি আর পূজার দিনে হিন্দুতে হিন্দুতে আলিঙ্গন করলে হবে না। তাদের উভয়ের সঙ্গে উভয়েরই কোলাকুলি ও আলিঙ্গন করতে হবে। এতে কারো জাত যাবে না। এজন্যই নজরুল লিখেছিলেন,
ছুঁলেই তোর জাত যাবে?
জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।
সমস্ত বনি আদমকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রাণের তাগিদে, সেই তীব্র আকুতি নিয়ে দেশজুড়ে সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে আমরা হাজার হাজার সভা-সমাবেশ, সেমিনার, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, সর্বধর্মীয় সম্মেলন করেছি। ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়াবাজি, নিন্দাবাদ, অপপ্রচার আর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, শত নির্যাতন সহ্য করে, নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে আমরা এই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। আমাকে এজন্য ভয়াবহ মাশুল দিয়ে হয়েছে। আমার নিজ বাড়িতে বহুবার হামলা চালানো হয়েছে, বাড়ি ঘর আগুনে ভস্মীভূত করে ফেলা হয়েছে, সবকিছু লুটপাট করা হয়েছে, আমাদের দুই ভাইকে গরু জবাই করা ছুরি দিয়ে জবাই করেছে ধর্মব্যবসায়ীদের অনুসারীরা। হামলা হয়েছে হেযবুত তওহীদের আরো বহু সদস্য-সদস্যার উপরও। জানি না কবে আমরা ধর্মের নামে দাঁড়িয়ে থাকা অধর্মের এই প্রাচীরকে ভাঙতে পারবো, তবে এটা জানি সত্যের মোহনায় একদিন সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণের মানুষ এসে মিলিত হবেই হবে ইনশাল্লাহ। সেদিন পরাজিত হবে ইবলিস শয়তান, সেদিন আল্লাহর বিজয় হবে। আল্লাহর বিজয় মানেই মানবতার বিজয়।
ইসলাম ধর্ম ও সনাতন (হিন্দু) ধর্ম – পর্ব দুই
প্রথম পর্বের পর -নূহ (আ.) ও রাজা মনুহ্: মহর্ষী মনুই হচ্ছেন বৈদিক ধর্মের মূল প্রবর্তক। তিনিই হচ্ছেন কোর’আনে বর্ণিত নূহ (আ.)। পুরাণে মহাভারতে তাকে বৈবস্বত্ব মনু, রাজা ন্যূহ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর উপরই নাযেল হয় বেদের মূল অংশ। তাঁর সময়ে এক মহাপ্লাবন হয় যাতে কেবল তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা একটি বড় নৌকায় আরোহণ করে জীবনরক্ষা করেন। তাদের সঙ্গে প্রতিটি প্রাণীর এক জোড়া করে রক্ষা পায়। তাঁদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে আবার মানবজাতির বিস্তার ঘটে। এজন্যই হাদিসে নূহ (আ.) কে দ্বিতীয় আদম বলা হয়। হিন্দু ধর্মের মৎস্যপুরাণ গ্রন্থে এবং মহাভারতেও একই ঘটনার বিবরণ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে বৈবস্বত মনুর জীবনে এমনটিই ঘটেছিল। সেই মহাপ্লাবনের পর এই মনু থেকেই মনুষ্যপ্রজাতির বিস্তার ঘটে। এজন্য সনাতন ধর্মে কেউ কেউ মনুকেও মানবজাতির আদিপিতা বলে থাকেন।
সনাতন ধর্ম ও দীনুল কাইয়্যেমাহ: ইসলামের এক নাম দীনুল কাইয়্যেমা। শব্দটি এসেছে কায়েম থেকে যার অর্থ শাশ্বত, সুপ্রতিষ্ঠিত, চিরন্তন জীবনব্যবস্থা। সনাতন অর্থও তাই। যে নীতি বা ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবে সেটাই হচ্ছে সনাতন বা কাইয়্যেমাহ।
দুই জীবন: উভয় ধর্মেই ইহকাল ও পরকালের ধারণা রয়েছে। মো’মেনদের জন্য জান্নাত আর কাফেরদের জন্য জাহান্নাম। সনাতন ধর্মেও রয়েছে ধার্মিকদের জন্য স্বর্গ ও অধার্মিকদের জন্য নরক। ইসলাম বলছে জান্নাতে যাওয়ার আগে প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুলসিরাত পার হতে হবে, আর সনাতন ধর্ম বলছে বৈতরণী নদী পার হয়ে বৈকুণ্ঠে যেতে হবে।
উপাসনা পদ্ধতি: উভয় ধর্মের উপাসনা পদ্ধতির মধ্যেও অনেক মিল। কোরবানি ও বলিদান, সিয়াম পালন ও উপবাস, সুরা ও মন্ত্রপাঠ, যিকির ও যপতপ, হজ্ব ও তীর্থযাত্রা, সেজদা ও প্রণিপাত, তসবিহ ও যপমালা, উপাসনার ওয়াক্ত ও তিথি বা ত্রিসন্ধা ইত্যাদি বহুকিছু একই রকম।
মালায়েক ও দেবদেবী: ইসলামে সৃষ্টিজগৎ পরিচালনার জন্য অসংখ্য ফেরেশতার কথা বলা হয়েছে তেমনি হিন্দু ধর্মে আছে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। এই ফেরেশতা ও দেবদেবী এক বিষয় কিনা এ নিয়ে ইসলামের আলেমদের মধ্যে অবশ্য মতভেদ রয়েছে, যেমনটা অধিকাংশ বিষয়েই তারা করে থাকেন।
এরকম উদাহরণ দিতে থাকলে হাজার হাজার দেওয়া যাবে। বেদ ও কোর’আনের যে আয়াত ও শ্লোকগুলো হুবহু একার্থবোধক তার তালিকা এত দীর্ঘ হবে যে এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। এত মিল থাকা সত্ত্বেও এই দুটো সম্প্রদায় একত্রে থাকতে পারছে না যে বিষয়গুলো নিয়ে সেগুলো হচ্ছে নিতান্তই ধর্মের গৌণ বিষয় যেমন খাদ্যাভ্যাস, উপাসনা পদ্ধতি, পোশাক-আশাক ইত্যাদি নিয়ে। এক সময় এদেশের মুসলমানেরাও ধুতি পরত, কিন্তু ধুতিকে হিন্দুর পোশাক বলা হচ্ছে। এসব অতি তুচ্ছ বিষয়। অমিলের বিষয়গুলো খুবই দুর্বল, কিন্তু মিলের বিষয়গুলো খুবই মৌলিক। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখা উচিত মুসলমানদেরকেই। কেন সেটা বলছি।
আমরা জানি, আমাদের নবী কেবল আরবের নবী নন, তিনি বিশ্বনবী। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি আদিষ্ট হয়েছি সমগ্র পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে। আল্লাহ নিজেও পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, হে নবী আপনি বলুন, আমি তোমাদের সকলের জন্য (জামিয়া) আল্লাহর রসুল (সুরা আরাফ ১৫৮)। তাঁর টাইটেল হচ্ছে রহমাতাল্লিল আলামীন, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কোনো ভেদাভেদ রাখা হয় নি। এক সাহাবির উপর নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, তুমি দেখবে অচিরেই এমন সময় আসবে যখন একা একটা সুন্দরী মেয়ে সর্বাঙ্গে অলঙ্কারপরিহিত অবস্থায় রাতের অন্ধকারে সা’না থেকে হাদরামাউত চলে যাবে, তার মনে আল্লাহ ও বন্য পশুর ভয় ছাড়া কোনো ভয় থাকবে না। এখানে বলা হয় নি যে সেই নারী হিন্দু, নাকি মুসলমান, নাকি খ্রিষ্টান বা ইহুদি। কাজেই এটি পরিষ্কার যে, নবী এসেছেন সমগ্র মানবজাতির অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এ দায়িত্ব আল্লাহই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমরাই সেরা জাতি। তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে মানবজাতিকে (নাস) ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখবে (সুরা ইমরান ১১০)। আল্লাহ ও তাঁর রসুল কর্তৃক উম্মাহর উপর অর্পিত সুস্পষ্ট দায়িত্ব এটি, এ থেকে পলায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। তাই সকল জাতি, ধর্মের মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বনী আদমকে এক কাতারে নিয়ে আসা উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব। এজন্যই এ দীনের অন্যতম একটি নীতি আল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন যে, লা ইকরাহা ফিদ্দীন অর্থাৎ দীন নিয়ে জবরদস্তি চলবে না। দীন নিয়ে বাড়াবাড়িও চলবে না।
তাছাড়া মুসলমান হওয়ার অন্যতম শর্ত সকল নবী-রসুলদের প্রতি এবং আল্লাহর নাজেল করা সকল ধর্মগ্রন্থের প্রতি ঈমান রাখা। পবিত্র কোর’আনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি প্রত্যেকটি জনপদে, প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষের জন্য নবী পাঠিয়েছেন। তাহলে এত বিরাট ও প্রাচীন জনপদ ভারতবর্ষে কি কোনো নবী আসেন নি, কোনো কেতাব আসে নি? অবশ্যই এসেছেন, তবে কালের আঘাতে তাদের শিক্ষাও বিকৃত হয়ে গেছে। তাদের প্রতিও মুসলমানদের বিশ্বাস রাখা বাধ্যতামূলক। আল্লাহ নবী-রসুল পাঠিয়েছেন এক লক্ষ চব্বিশ হাজার অথবা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার। তার মধ্যে কোর’আনে এসেছে মাত্র সাতাশ/আটাশ জনের নাম। বাকিদের অনুসারীরাও তো পৃথিবীতে আছেন, তাদেরকেও হেদায়াতের পথে আনার দায়িত্ব মুসলমানদের উপরই আল্লাহ অর্পণ করেছেন। কারণ তাদের কাছেই আছে শেষ কেতাব যেটা কেউ বিকৃত করতে পারে নি এবং শেষ নবীর আদর্শ। সেই আদর্শ উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় আজও মানবজাতির আকাশে জাজ্বল্যমান। শেষনবী বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে অন্যসব জাতিধর্মের মানুষকে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা যায়।
কাজেই আমাদেরকে ছাড় দিতে হবে বেশি, আমাদেরকে উদার ও সহনশীল হতে হবে বেশি। আল্লাহর এই দীনের ঘরের দরজা অনেক বড়। এখানে গোটা মানবজাতি প্রবেশ করবে। ঐ দরজায় খিল লাগিয়ে তা সংকীর্ণ করা হবে আত্মঘাতী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত কয়েক শতাব্দী থেকে তা-ই করা হয়েছে। আজকের মুসলিম জাতির এই হীনতার কারণ ঐ দায়িত্ব থেকে পলায়ন করে শরিয়ার টুকিটাকি বিষয় নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি আর জবরদস্তি।
হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুসলিম জাতির ভূমিকা অগ্রণী হলেও হিন্দু সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব কম নয়। এটা চরম মূর্খতার পরিচয় যে আমরা এক স্রষ্টা থেকে আগত, এক জাতি, এক বাবা মায়ের সন্তান হয়েও এভাবে একে অপরকে বিধর্মী মনে করে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরে চলেছি। আমরা এক ভাই আরেক ভাইকে অশুচি অপবিত্র মনে করি। আচারের নামে এইসব অনাচার ধর্মের সৃষ্টি নয়, ধর্মব্যবসায়ীদের সৃষ্টি। আমাদেরকে বুঝতে হবে, স্রষ্টা শুধু মসজিদে মন্দিরে চার্চে প্যাগোডায় থাকেন না। স্রষ্টা আর্ত-পীড়িত, নির্যাতিত মানুষের আর্তচিৎকারে ব্যথিত হন। অথচ ধর্মব্যবসায়ীরা এই নির্যাতিত মানুষের দায়িত্ব শয়তান, অত্যাচারী, ডেভিল, দুর্বৃত্তদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য মসজিদ, মন্দির, গির্জায়, প্যগোডায় ঢুকেছেন। তারা ধর্মকে বাস্তবজীবনের সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে না দেখে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা, উৎসব, উপাসনা, পূজা-প্রার্থনার বস্তুতে পরিণত করেছেন। তারা নবী-রসুল ও অবতারদের প্রাণান্তকর সংগ্রামকে অবজ্ঞা করে চলেছেন। তারা ধর্ম ত্যাগ করে লেবাস ধরেছেন। তারা মানুষকে জানতে দিচ্ছেন না যে, সকল ধর্মেই ধর্মব্যবসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আমরা যারা প্রকৃতপক্ষেই স্রষ্টার সান্নিধ্য চাই, তাদেরকে বুঝতে হবে যে, নামাজ, রোজা, উপবাস, উপাসনা, পূজা অর্চনা ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। মানুষের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাই সকল ধর্মের লক্ষ্য, সকল ধর্মের আত্মা। তাইতো ওঙ্কার ধ্বনীর অর্থ শান্তি, ইসলাম শব্দের অর্থও শান্তি। এজন্য মানুষের কল্যাণসাধনই প্রকৃত এবাদত। যে ধর্ম মানবসমাজে শান্তি দিতে পারে না, সেটা প্রকৃত ধর্ম নয়, সেটা ধর্মের লাশ। আজ সারা বিশ্বে যে ধর্মগুলি চালু আছে সেগুলোকে প্রাণহীন লাশ বানিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেই লাশকে নিয়েই ব্যবসা করছেন কথিত আলেম ও পুরোহিত গোষ্ঠী। মানুষের পেটে যখন ভাত নেই, উপাসনালয় থেকেও যখন জুতা চুরি হয়, যেখানে চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হয় তখন সেই অন্যায় অবিচার বন্ধ না করে, তার ন্যূনতম প্রতিবাদও না করে যারা মসজিদে-মক্কায় গিয়ে মনে করছেন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট, মন্দিরে গিয়ে দুধ-কলা দিয়ে, গয়া-কাশিতে গিয়ে মনে করছেন দেবতা বুঝি স্বর্গ থেকে তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করছেন, তারা ঘোর ভ্রান্তির মধ্যে আছেন। চলমান … পর্ব তিন
ইসলাম ধর্ম ও সনাতন (হিন্দু) ধর্ম – পর্ব এক
এ কথা সকল তথ্যাভিজ্ঞ মানুষই স্বীকার করবেন যে, বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখন ধর্ম এক নম্বর ইস্যু। পাঁচ শতাব্দী আগে ইউরোপে বস্তুবাদী ধর্মহীন একটি সভ্যতার উন্মেষ ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে তারা যখন বিশ্বের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয় তখন তাদের তৈরি ব্যবস্থাগুলোকে দুনিয়াজুড়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে চর্চিত বস্তুবাদী ধর্মহীন পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’র প্রভাবে পৃথিবীর মানুষ এখন এতটাই মানবতাবোধহীন, আত্মাহীন, জড়বাদী, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিকে পরিণত হয়েছে যে সকল চিন্তাশীল, সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই এখন একবাক্যে স্বীকার করছেন যে, যদিও ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ও পৈশাচিকতা রুখতে ধর্মকে বাদ দিয়েই জাতীয় জীবন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত ইউরোপে গৃহীত হয়েছিল কিন্তু সেটার ফল আশানুরূপ হয় নি, মানুষ শান্তি পায় নি। যেটা পেয়েছে সেটা হলো যান্ত্রিক প্রগতি (Technological advancement)। তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, বাস্তবে কোথাও ধর্মকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয় নি। শত সহস্র বছর থেকে মানুষের মনে লালিত ধর্মবিশ্বাস দূর করা যায় নি। এ কারণে তারা নীতি পাল্টিয়ে ধর্মকে ব্যক্তিগত উপাসনার সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করে। কিন্তু একটা পর্যায়ে রাষ্ট্র যখন কল্যাণ রাষ্ট্র (Welfare state) উপাধি ধারণ করে ব্যাপকভাবে জনসম্পৃক্ত হওয়া শুরু করল, মানুষও রাষ্ট্রের নানা কাজে অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পেল, তখন সেই ধর্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে গণ্ডিবদ্ধ থাকে নি। নানা ইস্যুতে, নানা প্রেক্ষাপটে, ঘটনাপ্রবাহের নানা বাঁকে সেই ধর্মবিশ্বাস রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই ধর্মব্যবসায়ী একটি গোষ্ঠী নানা ইস্যুতে মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে। তখন রাষ্ট্রকে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ধর্ম দিনশেষে ব্যক্তিগত গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে নি। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দখলদারিত্ব নিয়ে এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের ইস্যুকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে মানবজাতি। এ পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ধর্ম এখন বিশ্বরাজনীতির এক নম্বর ইস্যু। ইউরোপে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার সেক্যুলার দলগুলো রাজনীতির মাঠ দখল করেছিল সেই মাঠ এখন ডানপন্থী খ্রিস্টান প্রভাবাধীন দলগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নী ইস্যুতে এবং জঙ্গিবাদ ইস্যুতে যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। সেখানে বিশ্বের বড় বড় পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো জড়িত হয়ে গেছে। আর এই ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ক্রমশ উত্থান কীভাবে রাজনীতির অঙ্গনে কলকাঠি নাড়ছে সেটা সবাই জানেন।
ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ভারতবর্ষেও চেষ্টা করা হয়েছে ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়ার। ব্রিটিশ যুগের পূর্বে এ অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান এই দুটো ধর্মের অনুসারীই ছিল সংখ্যাগুরু। তার আগে বৌদ্ধরা ছিল বড় জনগোষ্ঠী। মুসলমানদের আগমনের পর কোটি কোটি ভারতবাসী ইসলামের শৃঙ্খলা, ন্যায়, সুবিচার, সাম্য ও উন্নত আদর্শের পরিচয় পেয়ে মুসলিম হয়। এখনও হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ এই পাক-ভারত উপমহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমান বাস্তবতায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যগঠন করা, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজিত তাদের পারস্পরিক মনোমালিন্য ও মানসিক দূরত্ব দূর করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা নির্যাতন চালিয়ে প্রায়ই নির্মমভাবে ধর্মীয় উগ্রতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এখানে করা হচ্ছে হিন্দুদের উপর আর ভারতে করা হচ্ছে মুসলমানদের উপর।
এই দাঙ্গা, হামলার প্রেক্ষিতে উভয় ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে আরো সন্দেহ, আরো দূরত্ব, আরো বিদ্বেষ সৃষ্টি হচ্ছে। এই শত্রুতামূলক মনোবৃত্তি যতদিন তাদের মধ্যে বজায় রাখা যায় ততই সাম্রাজ্যবাদী, অস্ত্রব্যবসায়ী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর জন্য সুবিধা; তারা এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করতে পারবে। মধ্যপ্রাচ্যে তারা শিয়া সুন্নীর দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে তেলসম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলো দখল করে নিচ্ছে। আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বটিকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমাদের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, যদি আমরা সত্যিই আমাদের দেশটিকে ভালোবাসি, আমরা উপলব্ধি করি যে এ দেশের মাটিতে আমাদের পূর্বপুরুষের অস্থিমজ্জা মিশে আছে, এই মাটি দিয়ে হিন্দুরা মূর্তি বানিয়ে পূজা করে আর মুসলমানেরা এই মাটি দিয়েই ইটের মসজিদ গড়ে নামাজ পড়ে। এই মাটির ফল-ফসল খেয়েই হিন্দু – মুসলমান উভয় জাতির মানুষ পুষ্ট হয়। আমাদের এই অঞ্চলে হিন্দু মুসলমানের ভিতরে বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব এখন প্রবল যা অবিলম্বে দূর করা জরুরি। যখন কোনো লোকালয়ে অগ্নিকা- হয় তখন কারো ভবনই রক্ষা পায় না, দেবালয় মসজিদ কিছুই এড়ায় না। যখন ইরাক আক্রান্ত হলো তখন সিরিয়ার লোকজন বারে গিয়ে ফুর্তি করেছে। কিন্তু কয়দিন পরে দেখা গেল সেই আগুন সিরিয়াকেও ছাড়ল না, এখন সিরিয়ার মানুষ ইউরোপে ভিক্ষা করে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা সহজ কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করা অত সহজ নয়। ওটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সরকারগুলো চেষ্টা করে আইন দিয়ে, শক্তি দিয়ে, অর্থ দিয়ে কারণ সরকারের কাছে ওগুলোই আছে। সরকারের প্রতিনিধিরা আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ান, ক্রন্দনরত মানুষের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত¦না দেন, ভাঙা উপাসনালয় সংস্কার করে দেন, ভাঙা মূর্তি জোড়া লাগিয়ে দেন, আর্থিক ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মানুষের মন যখন ভেঙে যায় তখন সেটা জোড়া লাগানো সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। সেজন্য এখন দুই সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্ম এক নম্বর ইস্যু, ধর্মকে ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে, বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই বিদ্বেষ বিভক্তি দূর করতে হলে উভয় সম্প্রদায়কে মুক্ত মন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটা করার জন্য তাদের উভয়কেই বুঝতে হবে তাদের গোড়া কোথায়, তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি কিনা, তারা আদৌ ঐক্যবদ্ধ হতে চায় কিনা। ঐক্যবদ্ধ হতে হলে উভয়পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। তারা তাদের উভয়ের লালিত ধ্যানধারণা, সংস্কার থেকে কতটুকু ছাড় দিতে রাজি হবে। যেহেতু বিষয়টি ধর্মীয় তাই ধর্মবিশ্বাসের মধ্য থেকে কতটুকু তারা বিসর্জন দিতে পারবে, কতটুকু গ্রহণ করতে পারবে, ঐক্যের স্বার্থে তারা কতটুকু উদারতা নিজেদের মধ্যে আনয়ন করতে পারবে এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
আমরা দেখব হিন্দু ও মুসলমানের বিশ্বাসগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে হাজার হাজার সম্ভাবনা রয়েছে। এই দুটো ধর্মদর্শনের মৌলিক বহু বিষয়ের গোড়া এক জায়গায়, দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কেবল ডালপালা নিয়ে। এখন এই দুটো ধর্মের মধ্যে কী কী বিষয় সামঞ্জস্যপূর্ণ সেদিকে আলোকপাত করব।
একেশ্বরবাদ: ওয়াহদানিয়াত বা একত্ববাদ। ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহকে একমাত্র হুকুমদাতা হিসাবে মানা, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা। সনাতন ধর্মেরও মর্মবাণী একমেবাদ্বীতিয়ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬:২:১), একমব্রহ্ম দ্বৈত্ব নাস্তি। যার অর্থ হচ্ছে প্রভু ব্রহ্ম একজন। তাঁর কোনো শরিক নাই।
এক বাবা-মা: এক পিতামাতা থেকে সমগ্র মানবজাতির উদ্ভব হয়েছে। এই বিশ্বাস সনাতন ও ইসলাম উভয় ধর্মের অনুসারীরাই লালন করেন। ইসলামে বলা হচ্ছে তাঁরা হচ্ছেন বাবা আদম ও মা হাওয়া। সনাতন ধর্মে তাঁদেরকে বলা হচ্ছে আদম ও হব্যবতী (ভবিষ্যপুরাণ)। চলমান … পর্ব দুই
সওম (রোজা) কাদের জন্য?
মহান আল্লাহ বলেন- হে মো’মেনগণ, তোমাদের উপর সওম (রোজা) ফরদ করা হয়েছে, যেরূপ ফরদ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। [সুরা বাকারা- ১৮৩]
এই আয়াত নাজেলের মাধ্যমেই দ্বিতীয় হিজরিতে মো’মেনদের জন্য সওম ফরদ ঘোষিত হয়। এই নির্দেশ মেনেই আমরা প্রতি বছর দীর্ঘ এক মাস (রমজান মাস) সওম পালন করি। কাজেই এই আয়াতটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এই আয়াত নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
এই আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে সওম ফরদ করা হয়েছে কেবল মো’মেনদের জন্য। যে মো’মেন নয় তার জন্য সওম পালন নিরর্থক। তাহলে মো’মেন কাকে বলে সেটা একটু বুঝে নেওয়া দরকার।
আমরা সাধারণ অর্থে জানি যে, কলেমা পড়ে ঈমান আনলে সে মো’মেন হয়। অন্য ধর্ম থেকে কেউ যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তখন প্রথমেই সে বলে আশহাদু (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি), অর্থাৎ একজন মো’মেন হয় একটা সাক্ষ্য দিয়ে বা শপথবাক্য পাঠ করে। শপথ করলে সেখান থেকে আর সরে আসা যায় না। সেই শপথবাক্যটা হলো- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ” অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই, মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল।” এই শপথবাক্য পাঠ করার সাথে সাথে জীবনের সকল অঙ্গনে আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করা ফরদ হয়ে গেল। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, আমাদের সামাজিক জীবন, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, জাতীয় জীবন এবং আন্তর্জাতিক জীবন এক কথায় সকল অঙ্গনেই আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য (ফরদ) হয়ে গেল। যদি কোনো একটা অঙ্গনেও আল্লাহর হুকুমকে অস্বীকার করি তবে আর আমি মো’মেন থাকতে পারলাম না, আমার শপথ থেকে আমি সরে গেলাম, বিচ্যুত হলাম।
যদি কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে এক ওয়াক্ত নামাজ আপনি পড়তে না পারেন, একটা রোজা যদি করতে না পারেন তবে আপনি গোনাহগার হবেন কিন্তু মো’মেনের খাতা থেকে আপনার নামটা কাটা পড়বে না কিন্তু যদি আপনি সিদ্ধান্ত নেন যে, এখন থেকে আপনি আর নামাজ পড়বেন না বা রোজা রাখবেন না তাহলে আপনি আর মো’মেন রইলেন না। আপনি সত্য প্রত্যাখ্যানকারী, সত্য অস্বীকারকারী তথা কাফের হয়ে গেলেন। তখন আপনার অন্য সকল আমল নিরর্থক হয়ে যাবে।
একইভাবে আপনার সমাজ যদি এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, এ সমাজে আর নামাজ চলবে না, রোজা চলবে না তাহলে ঐ সমাজটা কুফরি সমাজ বলেই গণ্য হবে, সেই সমাজের একজন হিসাবে আপনিও কাফের বলেই গণ্য হবেন যদি না আপনি তওবা করে ঐ সমাজ থেকে হেযরত করে সত্যের পক্ষে চলে আসেন। রসুলাল্লাহ (সা.) এর ইন্তেকালের পর অনেক গোত্র এভাবে জাকাত না দেবার সিদ্ধান্ত নিল ফলে খলিফা আবু বকর (রা.) তাদেরকে স্বধর্মত্যাগী ঘোষণা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন যাকে ইতিহাসে রিদ্দার যুদ্ধ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। একটু ভেবে দেখুন তো, যে গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করলেন সেই গোত্রগুলোর প্রতিটা ব্যক্তিই কি অপরাধী ছিল? প্রতিটা ব্যক্তিই কি কাফের হয়ে গিয়েছিল? হ্যাঁ, কারণ তারা সমাজের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে সত্যের পক্ষ অবলম্বন করতে পারেনি।
এখন আমার প্রশ্ন- বর্তমান মুসলিম বিশ্ব কি আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে? আমরা কেবল যাকাতভিত্তিক অর্থনীতিই প্রত্যাখ্যান করিনি, আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি সুদভিত্তিক অর্থনীতি। আমরা আল্লাহর দেওয়া আইন, দণ্ডবিধি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মনীতি, আন্তর্জাতিক নীতি, যুদ্ধনীতি এক কথায় সমস্ত কিছু বাদ দিয়ে গ্রহণ করেছি পাশ্চাত্য বস্তুবাদী ইহুদি-খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’রটা। তাহলে আমরা কীভাবে মো’মেন থাকলাম? আর আমরা যদি মো’মেনই না থাকি তাহলে তো আমাদের সমস্ত আমলও নিরর্থক হবে। এখন যদি আবু বকর (রা.) বা অন্য যে কোনো আসহাব পৃথিবীতে আসতেন তবে অবশ্যই আমাদের বিরুদ্ধে রিদ্দার যুদ্ধ করতেন।
তাহলে এখন আমাদের করণীয় কী? কীভাবে আমরা মো’মেন হবো? আমরা তো চাইলেই এখনই আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারছি না। এখন উপায় কী?
মহান আল্লাহ বলেন, “মো’মেন শুধুমাত্র তারা যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনে, পরে কোনো সন্দেহ পোষণ করে না, জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ [সুরা হুজরাত- ১৫]। এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের করণীয় হলো-আল্লাহকে হুকুমদাতা, মোহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহর রসুল বলে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে (এটাই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান, আমানু বিল্লাহি ওয়া রসুলিহি)। কোনো সন্দেহ পোষণ করা যাবে না (ছুম্মা লাম ইয়ারতাবু) অর্থাৎ এই স্বীকৃতি বা প্রতিজ্ঞা থেকে পিছপা হওয়া যাবে না, বিচ্যুত হওয়া যাবে না। জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় (জীবনের সকল অঙ্গনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য) জেহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা) করতে হবে।
এই তিনটি শর্ত মানলে আমরা মো’মেন হতে পারব, অন্যথায় আমাদের সকল আমল নিরর্থক হবে। আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যদি প্রচেষ্টা করতে চাই, সংগ্রাম করতে চাই তাহলে প্রথমেই এই স্বীকৃতিপ্রদানকারীদেরকে (মো’মেনদাবীদার) ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রচেষ্টার প্রথম অংশ হলো- যতভাবে পারা যায় মানুষকে এটা বোঝানো যে, কেন আমাদের সমাজে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। এই কাজটিই করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ। এই সত্যের উপর সকলকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান করছি আমরা। মো’মেন হবার যে শর্ত আল্লাহ দিয়েছেন সেটা পূর্ণ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা।
লা ইকরা ফি দ্বীন – ধর্মবিশ্বাসে জোর জবরদস্তি চলে না
ইসলামের বিরুদ্ধে বহুল উত্থাপিত একটি অভিযোগ হচ্ছে- ‘ইসলাম বিকশিত হয়েছে তলোয়ারের জোরে’। পশ্চিমা ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়া, লেখক, সাহিত্যিক এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত ও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত গোষ্ঠী এই অভিযোগটিকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তাদের প্রচারণায় অনেকে বিভ্রান্তও হচ্ছে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের প্রতি অনেকের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি ইসলাম প্রচারে জোর-জবরদস্তির কোনো স্থান আছে? রসুলাল্লাহ ও তাঁর হাতে গড়া উম্মতে মোহাম্মদী জাতির ইতিহাস কী বলে?
ইসলাম প্রতিষ্ঠার নীতিমালা আল কোর’আন থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়। এই দীনে কোনো জোর জবরদস্তির স্থান আল্লাহ রাখেন নি। তিনি বলেছেন- দীনের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই, কারণ সত্য থেকে মিথ্যা পৃথক হয়ে গেছে (সুরা বাকারা, ২৫৬)। অন্যত্র তিনি বলছেন-আল্লাহ কখনও কাউকেই তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না (সুরা বাকারা, ২৮৬)। কোর’আনে রসুলাল্লাহর যে দায়িত্ব আল্লাহ সুনির্দিষ্ট করে দিলেন সেখানেও জোর জবরদস্তির কোনো স্থান রাখলেন না। কোর’আনে আল্লাহ রসুলকে বলছেন, তুমি তোমার মালিকের পথে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশ সহকারে উৎকৃষ্ট পন্থায় আহ্বান করো। (সুরা নাহল, ১২৫) তোমার কাজ হচ্ছে শুধু ঠিক ঠিক মতো পৌঁছে দেওয়া। (সুরা আন নুর, ৫৪; সুরা ইয়াসীন, ১৭)। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে- আল্লাহ কারও ধর্মবিশ্বাসের ওপর জোর-জবরদস্তি চালিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করছেন না। আল্লাহর নীতি হলো বুঝিয়ে, যুক্তি দিয়ে, বলে-লিখে, বক্তৃতা করে ইত্যাদি যত শান্তিপূর্ণ উপায়ে সম্ভব মানুষের সামনে সত্যকে উপস্থাপন করা, হক্বের পথে আহ্বান করা, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিবে মানুষ। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া আল্লাহর হুকুম অমান্য করার শামিল। ধর্মবিশ্বাস নিয়ে, সত্য গ্রহণ বা বর্জন করা নিয়ে, আল্লাহর প্রতি, রসুলের প্রতি, কেতাবের প্রতি ঈমান আনা নিয়ে কোনো জবরদস্তি চলে না। সত্যকে দেখে যারা গ্রহণ করে নেবে তারা আলোকিত হবে, আর যারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তারা অন্ধকারেই রয়ে যাবে। সত্যের বার্তাবাহকদের এ ক্ষেত্রে একটি মাত্রই কাজ, সত্য উপস্থাপন করা। এমনভাবে উপস্থাপন করা যার বিরোধিতা করার মতো বা ত্রুটি বের করার মতো কোনো সুযোগ না থাকে। যার সংস্পর্শে আসলেই মানুষ সত্যকে চিনতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু আজ ইসলামের নাম করে নিজেদের মনগড়া মতামতকে অন্যের বিশ্বাস ও মতের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটা ইসলাম নয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঠিক প্রক্রিয়াও নয়।
জবরদস্তি বিভিন্ন প্রকারের আছে। শুধু ইসলাম নয়, যারা আজ ইসলামের সমালোচনা করেন, সেই পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত কথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের ইতিহাসও জোর-জবরদস্তিমূলক ইতিহাস। দেশে দেশে গণতন্ত্রকে গেলানোর জন্য কত কিছুই না করা হচ্ছে। পৃথিবীতে সাড়ে সাতশ’ কোটি মানুষের বসবাস। এই সাড়ে সাতশ’ কোটি মানুষের রুচি-অভিরুচি, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার, মননশীলতা, স্বভাব, পছন্দ-অপছন্দ এক নয়। একেক দেশের মানুষের চরিত্র একেক ধরনের। যে গণতন্ত্র ইউরোপের মানুষকে কিছুটা সাফল্যের ভাগী করতে পেরেছে সেই গণতন্ত্র এশিয়া বা আফ্রিকার মানুষকে সাফল্য নাও দিতে পারে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে যে সিস্টেম ফলপ্রসূ সেটা আমেরিকার জনজীবনে হয়তো খাপ খাওয়ানো মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। বড় কথা হচ্ছে- এসব সিস্টেম মানবসৃষ্ট হওয়ায় এবং মানুষের শক্তি-ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় মানুষের তৈরি এসব সিস্টেম পৃথিবীর কোনো এক ক্ষুদ্র অংশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও সারা পৃথিবীতে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য, যেমন আজ হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতা ও তার তল্পিবাহক মিডিয়া এই প্রাকৃতিক সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা যে কোনো উপায়ে সারা পৃথিবীতে কথিত গণতন্ত্র কায়েম করার প্রচেষ্টায় মত্ত। এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে, বিভিন্ন জাতির বিশ্বাসপ্রসূত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, শক্তি প্রয়োগ করছে। যারা তাদের মতবাদ মানতে চায় না তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, আর তাতেও ফল না হলে সামরিক হামলা করে দেশ দখল করছে, ঘর-বাড়ি, স্থাপনা ধ্বংস করছে। এখানে মানবতার কোনো বালাই নেই, জনগণের মতামতের কোনো জায়গা নেই। বৈধ-অবৈধ’র কোনো মানদ- নেই। যার যে বিশ্বাসই থাকুক, যে জাতি যে মতবাদই পছন্দ করুক পশ্চিমা সভ্যতার কাছে তার কোনো দাম নেই। পুঁজিবাদী গণতন্ত্র সবাইকে মানতে হবে, সব জাতিতে কার্যকর করতে হবে এটাই যেন শেষ কথা। প্রশ্ন হচ্ছে- যারা দু’বেলা ‘তলোয়ারের জোরে ইসলাম প্রচার হয়েছে’ বুলি আউড়িয়ে সত্যের উপর মিথ্যার প্রলেপ লাগাচ্ছে তারাই আবার কোন যুক্তিতে একটি নির্দিষ্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্বাধীন দেশের মাটিতে বোমা ফেলছে?
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আল্লাহর রসুল মক্কা জীবনে বহু জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু প্রতিপক্ষকে কোনো আঘাত করেন নি। দৃষ্টান্তহীন নির্যাতনের শিকার হয়েও তিনি তাঁর অনুসারীদের বলতেন- আসবের আসবের, সবর কর। তিনি কারও উপর ক্রুদ্ধ হন নি, অভিশাপ দেন নি, বরং ওই নির্যাতনকারী মানুষগুলোর পক্ষ নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেছেন। তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করেছেন। এরপর যখন তারা ঈমান আনলো, সত্যকে আলিঙ্গন করল তখন ওই মানুষগুলোই রসুলাল্লাহকে তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে শুরু করল। উমর (রা.) রসুলকে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে হত্যা করতে ছুটে গেলেন, কিন্তু অচিরেই রসুলের চরণতলে নিজেকে নিবেদন করলেন- এই পরিবর্তন কি তলোয়ারের শক্তিতে হয়েছিল?
ইতিহাস মতে রসুলাল্লাহ ও তাঁর জাতি যে যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছিল এবং রক্তপাত ঘটিয়েছিল সেটা কারও ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে ছিল না। আসলে ওই যুদ্ধ-বিগ্রহগুলো হয়েছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। এই জাতির ইতিহাস পড়লে খুব সহজেই বোঝা যায় যে, রসুলের হাতে গড়া ওই উম্মতে মোহাম্মদী জাতি কোনোদিন কোনোজাতির ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করে নি। মুসলিম শাসনের অধীনে থেকে অন্যান্য ধর্মের মানুষ অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করে গেছে। এমনকি তাদের কেউ কোনো অপরাধ করলে তার শাস্তি কোন ধর্মের বিধান থেকে দেওয়া হবে সেটাও বেছে নিয়েছে ওই অপরাধীই, উম্মতে মোহাম্মদী তা কার্যকর করেছে মাত্র। শুধু তাই নয়, ওই জাতি ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও কতটা সচেতন ছিল তা বোঝা যায় ওমর (রা.) এর একটি ঘটনা থেকে। ওমর (রা.) তখন আমিরুল মু’মিনিন, জাতির ইমাম বা নেতা। পবিত্র জেরুজালেম শহর মুজাহিদ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার পর খলিফা ওমর বিন খাত্তাব (রা.) ঘুরে ঘুরে শহরের দর্শনীয় বস্তুগুলি দেখার সময় যখন খ্রিস্টানদের একটি অতি প্রসিদ্ধ গীর্জা দেখছিলেন তখন নামাজের সময় হওয়ায় তিনি গীর্জার বাইরে যেতে চাইলেন। জেরুজালেম তখন সবেমাত্র মুসলিমদের অধিকারে এসেছে, তখনও কোন মসজিদ তৈরিই হয় নি, কাজেই নামাজ খোলা ময়দানেই পড়তে হতো। জেরুজালেমের প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ বিশপ সোফ্রোনিয়াস ওমরকে (রা.) অনুরোধ করলেন ঐ গীর্জার মধ্যেই তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নামাজ পড়তে। ভদ্রভাবে ঐ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ওমর (রা.) গীর্জার বাইরে যেয়ে নামাজ পড়লেন। কারণ কি বললেন তা লক্ষ্য করুন। বললেন- আমি যদি ঐ গীর্জার মধ্যে নামাজ পড়তাম তবে ভবিষ্যতে মুসলিমরা সম্ভবতঃ একে মসজিদে পরিণত করে ফেলত।
আজকে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার ছাতা ধরে আছেন, প্রচলিত পুঁজিবাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকেই উৎকৃষ্ট পন্থা বিবেচনা করেন, ইসলামকে মনে করেন প্রগতিবিরোধী, বাকস্বাধীনতা-বিরোধী, তাদের প্রতি প্রশ্ন- প্রকৃত ইসলাম মানুষকে যে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছিল, নিরাপত্তা দিয়েছিল আজকের কথিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র কি তার এক ভগ্নাংশও দিতে পেরেছে? এটা ঠিক যে, কূপমন্ডক সংকীর্ণমনা ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে ইসলামের প্রকৃত রূপ আজ হারিয়ে গেছে। তাদের অতি বিশ্লেষণ, বাড়াবাড়ী আর সত্যকে অস্বীকার করার কারণে ইসলাম আজ আর আল্লাহ রসুলের সেই ইসলাম নেই। কিন্তু প্রকৃত ইসলামের বিপরীতমুখী এই বিকৃত ইসলাম দেখে ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ ধারণা করা নিশ্চয়ই বোকামি। আল্লাহর অসীম করুণা যে, প্রকৃত ইসলামের জ্ঞান তিনি হেযবুত তওহীদকে দান করেছেন। সেই প্রকৃত ইসলামের অনাবিল রূপটি আমরা সর্বস্তরের মানুষের সামনে উপস্থাপন করছি।
ঈশ্বর বিশ্বাস
********প্রাককথন*******
যে কোনো বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই আমাদের মধ্যে জন্ম দেয় ঐ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের! অর্থাৎ বিষয়টি সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞানের অভাব থাকলেই হয় আমরা সেটির সম্বন্ধে মনগড়া প্রচলিত ধারণাকে বিশ্বাস করি! অথবা সেই ধারণাটিকে অবিশ্বাস করি!
আর এইভাবেই সীমিত বুদ্ধিতে বিষয়টিকে বুঝে নেবার প্রয়াসে নিজেদের সান্ত্বনা জোগাই!
যতদিন প্রমাণ হয়নি পৃথিবী সূর্য্যের চারিধারে ঘুরছে ততদিন শুধুমাত্র সত্য জ্ঞানের অভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে আমরা বিশ্বাস করতাম সূর্য্যই পৃথিবীর চারধারে ঘুরছে! বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্বন্ধে এই হল শাশ্বত বাস্তব চিত্র! অর্থাৎ প্রকৃষ্ট জ্ঞানের ভিত্তিতে যখন কোনো সত্যকে জানি, অনুধাবন করতে পারি; তখন কিন্তু আর, কোনো বিশ্বাসের কিংবা অবিশ্বাসের ওপর আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় না! তাই ঈশ্বর আছেন কি নেই, থাকলে তিনি সাকার না নিরাকার এই বিষয়ে আমাদের ধারণাও সেই মনগড়া বিশ্বাস অবিশ্বাসের ওপরেই নির্ভরশীল! অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও রূপ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা সেই বিশ্বাস অবিশ্বাসের গণ্ডীতেই অন্ধের মত ঘুরপাক খায়! কারণ বিজ্ঞান বা দর্শন আজও অভ্রান্ত ভাবে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেনি! যদিও বিশ্বের সব দর্শন চিন্তার আদি উৎসই হল বিশ্বসত্যের রহস্যকে কেন্দ্র করে! এবং বিজ্ঞানও সেই রহস্য উন্মোচনে সদা সক্রিয়!
*********(এক)*********
জীবজগতে স্বপ্রাণ বিভিন্ন সত্ত্বার মধ্যে একমাত্র মানব মনই বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা দিয়ে প্রশ্ন করতে জানে! অন্যান্য কোনো প্রাণীই প্রশ্ন করতে জানে না! তারা প্রাপ্ত জীবনকে বিনা প্রশ্নেই গ্রহণ করে! কারণ তাদের চেতনায় কোনো বিস্ময় বোধ নেই! কিন্তু মানুষ তাঁর চেতনা উন্মেষের ঊষা লগ্ন থেকেই জগতের দিকে চোখ মেলে ছোটো বড়ো বিভিন্ন বিষয়ে বিস্মিত হতে থাকল! যত তার বিস্ময় তত তার প্রশ্ন তত তার নতুন নতুন জিজ্ঞাস্য! কিন্তু যত প্রশ্ন ততই তো হাতের কাছে চট জলদি উত্তর নেই! এক একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে লেগে গেছে কত প্রজন্ম! কত অণ্বেষন! কত পরীক্ষা নিরীক্ষা! কত ভুলের পাহাড় পেড়িয়ে এক একটি উত্তর!জীবনযাপন ও জীবন রক্ষার প্রয়োজনে মানুষ দেখল এই বিশাল জগতে প্রবল প্রকৃতির অসীম শক্তির কাছে সে কত অসহায়! কতই দূর্বল তার সমস্ত প্রয়াস! প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সামনে তার উপলব্ধি হল কোনো বিরাট শক্তি রয়েছে এর পেছনে! সেই অদৃশ্য অপ্রত্যক্ষ কিন্তু প্রবল শক্তির তুলনায় তার ক্ষুদ্রতা অসহায়তা তাকে বাধ্য করল উত্তরহীন এই প্রশ্নের কাছে বিনীত হতে! সেই অজানা শক্তির কাছে সে সমস্ত জাগতিক বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাবার প্রার্থনা নিয়ে উপস্থিত হলো! এই ভাবে প্রকৃতির বিশালতায় প্রবল শক্তির মহিমায় তার মধ্যে ধীরে ধীরে এই শক্তির প্রতি জেগে উঠল বিস্ময়! এবং শ্রদ্ধা! শুরু হল এই শক্তির পূজা! জন্ম হল ঈশ্বরের! মানুষের বিশ্বাসে!
**********(দুই)*********
সভ্যতার সেই আদি যুগে ঈশ্বর ভাবনা ছিল মূলত প্রাকৃতিক শক্তিকে সন্তুষ্ট রাখার একান্ত প্রয়াস যাতে প্রতিদিনের জীবনযাপন ও জীবন রক্ষা সহজ সাধ্য হয়! সাধারণ মানুষ চিরকালই শান্তিতে থাকতে পছন্দ করে! এবং অজানা আশঙ্কার ভয় তাকে সব সময়ে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়! কারণ তার অধিকাংশ প্রশ্নেরই উত্তর ছিল না হাতের কাছে! তাই বিভিন্ন সাম্ভব্য অসাম্ভব্য বিপদ আপদ থেকে উদ্ধারের আর্জি নিয়ে সে প্রাকৃতিক বিভিন্ন শক্তির কাছে উপস্থিত হলো! এই ভাবেই সৃষ্টি হতে থাকল এক এক প্রাকৃতিক দেবদেবীর! গড়ে উঠল পূজার নানাবিধ উপাচার! যা জাতি ধর্ম বিশেষে স্বভাবতই বিভিন্ন! কিন্তু উদ্দেশ্য ও মূল ভাবনায় সাযুয্য সম্পন্ন!চিন্তা ভাবনার ব্যাপ্তীর সাথে স্বভাবতই মানুষের মনে হতে থাকল এই সব প্রবল প্রাকৃতিক শক্তির অন্তরে নিশ্চয়ই কোনো অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাক্তিসত্ত্বা আছে! যার সচেতন ইচ্ছার সৃষ্টি এই জগত সংসার! এবং যার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল সমস্ত মানব জীবন! ফলত মানুষের মনে হতে থাকল এই ব্যাক্তিসত্ত্বাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে বিভিন্ন ইচ্ছাপূরণ সম্ভব! শুরু হল ঈশ্বরবন্দনা ঈশ্বর পূজো! বিভিন্ন জনগোষ্ঠিতে বিভক্ত মানব সভ্যতায় এই ভাবে গড়ে উঠল ঈশ্বরতত্ব! চিন্তাশীল মানব তার বুদ্ধিবৃত্তিতে খুঁজতে থাকল এই জগত সৃষ্টির রহস্য! শুরু হল দর্শন চর্চা! এবং তার পর বিজ্ঞানের হাত ধরেও আজও চলেছে বিশ্বতত্ব রহস্য উন্মোচনের সাধনা!
*********(তিন)*********
একদিকে কাল্পনিক ঈশ্বরকে খুশী রেখে জাগতিক জীবনে সুখে থাকা আর অন্য দিকে বিশ্বরহস্য উদ্ধারে চিন্তা শক্তি নিয়োগ করা, এই দুই পথেই চলতে থাকল মানুষ! কিন্তু তবু মানব জীবনে প্রার্থিত সুখ শান্তি আসল না! সমাজ জীবন হতে থাকল কলুষিত! তখন, যারা এর কারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হলেন তারা অনুধাবন করলেন মানুষের স্বভাব প্রবৃত্তিতে এমন অনেক কু-প্রবৃত্তি আছে যেগুলি সংযমের শৃঙ্খলে না বাঁধলে সমাজ জীবন সুস্থ হতে পারে না! সেই প্রবৃত্তিগুলিকে শাসনে রেখে পারস্পরিক উন্নতির ও শান্তির জন্য তাঁরা চালু করলেন কিছু অনুশাসন! কালক্রমে এই সব অনুশাসনে জনগণকে শৃঙ্খলিত করার জন্য যোগ করা হলো ঈশ্বর ভাবনাসাধারণ মানুষকে বোঝানো হল অনুশাসনগুলি না মানলে ঈশ্বর রুষ্ট হবেন! মানলে তিনি হবেন সন্তুষ্ট! জীবনে যদি প্রার্থিত সুখ নাও আসে পরলোকে স্বর্গবাস সুনিশ্চিত! কিংবা পরজন্মে থাকা যাবে রাজার হালে! জীবন যাপনের জন্য সৃষ্টি হল বিভিন্ন নিয়ম নীতি! বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে এই বিষয়গুলি নিয়ে গড়ে উঠল নানা লোকাচার! অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত ধীশক্তি সম্পন্ন এক এক জন মানব বিশ্বসত্য সম্বন্ধে তাঁদের মতবাদ প্রচার করলেন! কেউ কেউ এগিয়ে এলেন সমাজ সংস্কারে! গড়ে উঠল তাঁদেরকে কেন্দ্র করে এক একটি শিষ্য সম্প্রদায়! কালক্রমে এই সব সম্রদায়ের বিস্তারে গড়ে উঠল এক একটি ধর্ম গোষ্ঠী! ঈশ্বর ভাবনা বদ্ধ হল গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত মতবাদে!
**********(চার)********
ফলে কালক্রমে আমাদের ঈশ্বর ভাবনা সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে গেল! শৃঙ্খলিত হল ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন ভাবনা– সাম্প্রদায়িক সমষ্টি বদ্ধতার বেড়াজালে! এবং সৃষ্টি হল বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের ঈশ্বর ভাবনার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব! এবং প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের ধ্যান থেকে দূরে সরে এসে, বিশ্বতত্বের রহস্য অনুসন্ধান ছেড়ে আমরা সাম্প্রদায়িক ধর্মের কূটকাচালিতে নিমগ্ন হলাম! ঈশ্বরের সম্বন্ধে আমাদের ব্যস্ততা পড়ে থাকল শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত সুখ কামনার চৌহদ্দিতেই! আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থখরচ করে পূজো দিই আর ঈশ্বরের কাছে প্রাথনা করি নিজের সুখ সাচ্ছন্দের!সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল প্রত্যেক সম্প্রদায়ের বিশ্বাসে তাদের ঈশ্বরই শ্রেষ্ঠ! এবং মহৎ! এবং অন্য সম্প্রদায়ের ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছেই মহাপাপ! ভাবতে অবাক লাগে, কাল্পনিক এক ঈশ্বর নিয়ে এই মানব বিশ্বে মানুষের পরস্পরের মধ্যে কত হানাহানি রক্তপাত! কত রাজনীতি! কত সাম্রাজ্যর উত্থান পতন! কত প্রাণ বলি হল অকালে! অথচ আজও মানুষের কল্পিত ঈশ্বর মানুষের কাছেই রয়ে গেল অধরা! আজও প্রমানিত নয় তার অস্তিত্ব! আজও জানা গেল না তিনি সাকার না নিরাকার? এবং এই না জানার কারণেই বিভিন্ন কল্পিত মতবাদের খাঁচায় তাকে আবদ্ধ রাখতে হয়! পাছে তাকে নিয়ে কল্পনার ফানুসটি ফুটো হয়ে যায়! তাইতো কল্পিত বিশ্বাসেই তার অস্তিত্ব!
শ্রীশুভ্র।
স্বার্থপর মুত্তাকির পরিণতি
বর্তমানে ধর্মহীন পশ্চিমা বস্তুবাদী দর্শনের প্রভাবে মানবজাতি এতটাই স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে যে তাদের কাছে উন্নত জীবনযাপন মানেই হয়ে দাঁড়িয়েছে আরাম আয়েশ, ভোগবিলাস, বস্তুগত সমৃদ্ধি। যে এটা হাসিল করতে পারে তাকে বলা হয়ে থাকে যে, সে বড় মানুষ হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জীবনে সফল হয়েছে অর্থাৎ তার জীবন স্বার্থক। কিন্তু এটা তো স্বার্থকতা নয়। মানদ- পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষ বুঝতেই পারছে না যে তাদের মানবজীবনের স্বার্থকতা হলো নিজের জীবন এবং সম্পদকে অন্য মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা। মো’মেনের সংজ্ঞার মধ্যেই এই বিষয়টিই আছে যে জীবন এবং সম্পদ দান করে দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করা (সুরা হুজরাত ১৫)। আবার সুরা তওবার ১১১ নং আয়াতে এই কথাটাই লেখা আছে যে আল্লাহ মো’মেনদের জান মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।
আল্লাহ জান মাল নিয়ে কী করবেন?
আসলে কিছুই করবেন না, তিনি চান সেই জান ও মাল আল্লাহর অভিপ্রায় মোতাবেক মানুষের কল্যাণে ব্যয়িত হোক। সুতরাং পরিষ্কার হয়ে গেল মো’মেন হওয়ার শর্ত হলো আপনাকে আগে জীবন-সম্পদ কোরবান করতে হবে। আর নামাজ রোজা হজ্জ যাকাত যাবতীয় আমল সব মো’মেনদের জন্য। মো’মেন না হলে সব আমলই অর্থহীন। আল্লাহ বলছেন, ‘আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদের স্বীয় কর্ম ও শ্রমে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের কথা জানিয়ে দেব?- পার্থিব জগতে কৃত সমস্ত আমলই যাদের পন্ড শ্রম হয়েছে। অথচ তাদের ধারণা, খুব ভালো কাজই করে যাচ্ছে তারা।’ (কাহাফ : ১০৩-১০৪)
তাদের এই আমল বিনষ্ট হওয়ার কারণ তাদের তাকওয়া আছে কিন্তু তারা হেদায়াতে নেই আর হেদায়াহ বিহীন ব্যক্তিগত তাকওয়ার মূল্য নেই। অন্যের জন্য জীবন সম্পদ কোরবান না করলে ব্যক্তির তাকওয়ার কোন মূল্য নেই। আরও পরিষ্কার করে বলা যায় ব্যক্তিগতভাবে আপনি যত ভালো মানুষই হওয়া চেষ্টা করুন না কেন, যদি ভাবেন যে আমি একা ভালো মানুষ হয়ে থাকব, সমাজ, দেশ, মানবজাতির কী হয় না হয় সেটা দেখার দায়িত্ব আমার না, আমি চোখ নাক কান বন্ধ করে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লাম, কারো ক্ষতি করলাম না মিথ্যা কথা বললাম না, কারো হক নষ্ট করলাম না, টাখনুর উপর পায়জামা পরলাম, দাড়ি রাখলাম আমি ব্যক্তিগতভাবে ভালো মানুষ হলাম কিন্তু সমাজের অশান্তি দূর করার কোনো প্রচেষ্টা করলাম না, এটা চরম স্বার্থপরতা। এই স্বার্থপরতা আত্মকেন্দ্রিক ভালো মানুষের কোন জান্নাত নাই।
আল্লাহ বলছেন, ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে অপর কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে। যারা নিজেরাও কার্পণ্য করে এবং অন্যকেও কৃপণতা শিক্ষা দেয় আর গোপন করে সে সব বিষয় যা আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে দান করেছেন স্বীয় অনুগ্রহে। বস্তুত তৈরি করে রেখেছি কাফেরদের জন্য অপমানজনক আযাব (সুরা নিসা: ৩৭)।
সুতরাং কৃপণতা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি মো’মেন হওয়ার শর্তের বিপরীত এবং কাফেরের বৈশিষ্ট্য। বর্তমানের পশ্চিমা বস্তুবাদী শিক্ষার প্রভাবে উপরোক্ত আয়াতের প্রতিটি কথা মানবচরিত্র বাস্তবায়িত করে। যেমন এই শিক্ষা ও সম্পদ মানুষকে গর্বিত ও দাম্ভিক করে তোলে, বিনয়ী করে না। পিতা-মাতা, আত্মীয় পরিজন, প্রার্থী, এতিম, অধীন ব্যক্তিদের প্রতি সৎ ও সদয় আচরণে প্রবৃত্ত করে না, কৃপণতা শিক্ষা দেয়, নিজের সম্পদকে গোপন করা শিক্ষা দেয়। আল্লাহ এই ব্যক্তিকে কাফের আখ্যা দিয়ে অপমানজনক জাহান্নামের শাস্তির সতর্কবার্তা জানিয়েছেন।
ব্যক্তি ভালোমানুষি দিয়ে কেউ জান্নাতে যাবে না, কারণ জান্নাত সামষ্টিক। ইসলাম মানে শান্তি, তাই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করলে জান্নাতে ঠাঁই পাওয়া যাবে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা একটি সামষ্টিক কাজ সুতরাং জান্নাতও একটি সামষ্টিক কাজের ফল। এর অর্থ কি আপনি ভালো মানুষ হবেন না? সত্যবাদী হবেন না? হ্যাঁ, ভালো হবেন সমাজকে ভালো করার জন্য। অন্য মানুষকে ভালো করার জন্য আপনাকে ভালো হতেই হবে। ব্যক্তি তাকওয়ার কোন মূল্য নেই। সামষ্টিক তাকওয়াই হলো জান্নাতে যাবার পূর্বশর্ত। যেমন আপনার উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য আপনাকে সুশৃঙ্খল হতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, আত্মিক দিক দিয়ে আপনাকে অনেক দৃঢ় হতে হবে, অনেক দানশীল হতে হবে। আপনাকে সালাহ করতে হবে, সওম করতে হবে এইজন্য যেন আপনি শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করতে পারেন। অ র্থাৎ আপনি দুনিয়ার সমাজের মানুষের ভালো করার জন্য আমল করবেন। সেটা আমল হবে। আর দুনিয়ার মানুষ ধ্বংস হয়ে যাক তাতে কিছু যায় আসে না, আমি ভালো হলেই চলবে, এ জাতীয় স্বার্থান্ধ দৃষ্টিভঙ্গির লোক কোনদিন জান্নাতে যেতে পারবে না।
এই পোস্টির বিষয়ে আপনার কোন মতামত থাকলে – 01722 – 606045