২০৫৭ সাল। চোখে ঠিকমত দেখতে পাই না। শরীরেও আগের মত বল নেই। ১৩ বছরের নাতি আব্দুল্লাহ তার মোবাইলে কি যেন করছে। এখনকার মোবাইলগুলো আমাদের যুগের মত আদ্যিকালের নয়, চোখের ইশারায় চলে, ফাংশানগুলো আমি ঠিক করে বুঝিও না বাপু! উঁকি দিয়ে দেখলাম ফেসবুক ব্যবহার করছে। খুব শখ হলো নিজের আইডিতে একবার লগিন করি, বহুবছর ফেসবুকে ঢোকা হয় নি। নাতিকে সে কথা বলতেই ও লগিন করিয়ে দিল। ভাগ্যিস শেষবার নিজের জন্ম তারিখকে পাসওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম! না হলে এ বয়েসে এসব ছাঁইপাস মনে থাকতো না।
ফেসবুকে ঢুকে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আগে আমার চ্যাটলিস্টে পাঁচ-ছয়শ জনকে অনলাইনে দেখতাম। আজ দেখি মাত্র ১১ জন, কিন্তু পরিচিত কাউকে দেখলাম না, অনেকের নামটাও ভুলে গেছি। হঠাৎ করে মনে পড়লো ফ্রেন্ডলিষ্টটা একটু চেক করি। ফ্রেন্ডলিষ্ট থেকে প্রথমে সিদ্দিকি ভাই’র প্রোফাইলে ঢুকলাম। ঢুকেই দেখলাম তার নামের পাশে একটা শব্দ লেখা- ”Remembering”. যাষ্ট ফ্রিজ হয়ে গেলাম…। আমার মৃত্যুর পরও হয়তো আমার কোন এক নাতি অনেকটা শখ করেই ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে রিকোয়েষ্ট করে, আমার একাউন্টটিও “মেমোরাইজড” প্রোফাইল করে দিবে। অনেক স্মৃতি দু’চোখের কোনে এসে ভীড় করলো এবং দু’ফোটা অশ্রু হয়ে ঝরে গেল।
পাগলা সাইফের কথা মনে পড়লো। অনেকদিন ধরে যোগাযোগ নেই। বছর তিনেক আগে একবার ওর ছোট ছেলেটার সাথে দেখা হয়েছিল, বলেছিল- বুড়োর শরীরটা তেমন ভালো নেই, সারাদিন চুপচাপ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে। যাইহোক ওর প্রোফাইলেও উঁকি দিলাম। দেখলাম- শেষ পোষ্টটা ৯ বছর আগের। ওর হাতের তোলা একটা ছবি দেয়া- জানালার ভেতর থেকে তোলা একটা ফুলের ছবি। ছবিটা ঠিক করে তুলতে পারেনি, একটু বেঁকে গেছে। বয়স বেশী হলে যা হয় আর কি! পাগলাটা ফটোগ্রাফির শখটা এতদিন জিঁইয়ে রেখেছিল! এখন কোথায় আছে, কে জানে!
এরপর রবিন ভাইয়ের প্রোফাইলে ঢুকলাম। তার শেষ পোষ্টটাও ১২ বছর আগের! জীবন নিয়ে লেখা বেশ কয়টি রিয়ালিষ্টিক পোষ্ট দেখলাম, তাতে কিশোরদের কিছু কমেন্ট- “খুব ভালো লিখেছো দাদু”। লেখার হাইলাইটসগুলো স্ক্রল করতে করতে অনেক বছর আগের একটা পোষ্টে নজর আটকে গেল, খুব সযতনে লেখা ছোট্ট একটা লাইন- “প্রতিটা গল্পের একটা সমাপ্তি রয়েছে, কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে, প্রতিটা সমাপ্তির অর্থ হলো একটা নতুন শুরু।” ভাবলাম… বেঁচে থাকাকালীন কথাটা হয়তো সত্যি, কিন্তু জীবনের শেষ সমাপ্তির (মৃত্যু) পর, এই জগতে আর নতুন করে শুরু করা যাবে না। ভাবনাটা আমাকে অসুস্থ করে দিলো, খুব খারাপ লাগলো… খুউব। যখন তরুণ ছিলাম, তখন তার রিয়ালিষ্টিক কথাগুলো প্রেরণা যোগাতো। বুড়োটা এখন কোথায় আছি জানি না, শেষবার শুনেছিলাম খুব অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি। আসলে আমাদের বুড়োদের দুনিয়াটা খুব ছোট, তাই ইচ্ছে করলেই সবার সাথে যোগাযোগ হয় না…।
আরো অনেকের কথা মনে পড়ছে, কিন্তু কারো প্রোফাইলে ঢুকতে ভয় পাচ্ছি। যদি আরও একটি “মেমোরাইজড” প্রোফাইল দেখি! বুড়ো মানুষ, খুব ভয় পাই, মৃত্যুর ভয়! শেষবারের মত মেঘাদ্র নীল ভাইয়ের প্রোফাইলে ঢুকলাম। ভরা যৌবনে বুড়োটা প্রচুর লিখতো, কিন্তু গত ১৭ বছর ধরে তার কোন লেখা নেই! তার কিছু কিছু লেখা আমার বেশ ভালো লাগতো। এই যেমন কয়েক যুগ আগের একটা লেখা এইমাত্র চোখে পড়লো- “গভীর চিন্তা… জীবনবোধ, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ও মৃত্যু নিয়ে।” খুব জানতে ইচ্ছে করছে- চিন্তিত লেখক জীবনবোধ নিয়ে এখনো কি চিন্তাই করছেন, নাকি মৃত্যুর করাল গ্রাস তাকে সেই চিন্তা হতে মুক্তি দিয়েছে! বিশ্বাস করুন, জানার কোন উপায় নেই। ঐ যে বলেছিলাম- বুড়োদের দুনিয়াটা খুব ছোট, এখানে ইচ্ছে করলেই সবকিছু করা যায় না।
অনেক কাজিন এবং শুভাকাংক্ষীদের এই মুহূর্তে মনে পড়ছে…। কিন্তু হাতেগোনা ক’জন ছাড়া বাকীদের সাথে এখন আর যোগযোগই নেই। জীবনের টানে কে কোথায় হারিয়ে গেছে! ইচ্ছে করলো কয়েক জনকে ম্যাসেজ দেই, কিন্তু ছেলেমানুষি করে কি লাভ? জানি ম্যাসেজগুলো সীন হবে না। হয়তো ম্যাসেজ সীন করার লোকগুলোই আজ বেঁচে নেই। শুধু তাদের প্রোফাইলগুলোই কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে…। কে বেঁচে আছে, আর কে বেঁচে নেই- সে হিসেবটুকুও রাখতে পারি নি। ইনবক্সে রয়ে যাওয়া চ্যাটগুলোও পড়তে ইচ্ছে করছে না, বেঁচে থাকতে চাই পুরনো স্মৃতিগুলো হতে।
লগআউট করার আগে ভাবলাম, একটা ষ্ট্যাটাস লিখি- “বেঁচে আছি…।” কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল হলো- আমার বেঁচে থাকায় কার কি আসে যায়, শুধু বুড়িটা ছাড়া। অনেক্ষণ হলো বুড়িটাকে রুমে দেখছি না, গেলো কোথায়! বুড়িটার জন্যে খুব চিন্তা হয়। জানি, কেউ আমাকে ভালোবাসুক আর নাইবা বাসুক, বুড়িটা ঠিকই এখনো আমাকে ভালোবাসে। খুুউব ভালোবাসে…।বাসার সামনের লনে দেখছি একটা গোলাপ ফুটে আছে! যাই নাতিকে দিয়ে গোলাপটা আনিয়ে রাখি। উঁহু… আমার জন্যে নয়, বুড়িটার জন্যে।
কামাল উদ্দিন মেহেদী
[প্রথম লেখা কল্প গল্প]
গল্পটা ভালো লেগেছে। ক্যারি অন….
2057 সালেও ফেসবুক থাকবে! আমি তো ভাবছি, তখন নতুন কিছু তার জায়গা দখল করবে। তখন হয়তো লগইন করতে পাসওয়ার্ডও লাগবে না। গলার স্বর/ফেস ডিটেকশন… এর মাধ্যমে অটোম্যাটিক লগইন হবে। টাইপের ঝামেলাও থাকবে না। কথা বললে ডিভাইস সেটা টেক্সে কনভার্ট করে দেবে।
Dhonnobad vaia.
কল্প গল্প নয় যেন বাস্তবতাই প্রতিভাত হয়েছে লিখাটিতে। আপনি ২০৫৭ সালের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন, আমি তো আর বছর দশের ভাবনাই ভাবতে পারিনা। ভয় হয়। যদি না দেখি।
অসাধারণ কল্প গল্প পড়লাম। সুদূর প্রসারী গল্পটি চিন্তার খোরাক হলো বৈকি।
অভিনন্দন কামাল উদ্দিন মেহেদী। ভালো লিখেছেন।
দূরদর্শী লেখা। বেঁচে থাকলে এমন সত্যতাই পাবো মনে হয়।
চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম।
২০৫৭ সাল। আমাদের ভবিতব্যই জানেন আমাদের ভবিষ্যত কেমন থাকবে।
শুভেচ্ছা ভাইজান।