সেদিন সকালটা বেশ আলসে ছিলো। দেরী করে উঠে বাসি মুখেই ব্লগে আসি, কমেন্টের রিপ্লাইগুলো দেই। মোবাইলটা রাতে কোথায় ফেলে ঘুমিয়েছি মনে নেই। নতুন প্রজেক্ট নিয়ে এলোমেলো আরকি। বাথরুম চাপলে মোবাইল খুজতে গিয়ে দেখি অনেক গুলো ম্যাসেজ, কল। ফ্রেশ হয়েই জানতে পারলাম বাংলাদেশ সময় দুপুর দুটোয় মা মারা গেছেন। কিছুক্ষন স্তব্ধ, নিথর হয়ে বসেছিলাম। দিনটা স্পস্ট মনে আছে, জুলাইয়ের ২৬ তারিখ; তাপমাত্রা ২৮ হলেও উত্তর পুর্ব দিকে মৃদুমন্দ হাওয়ায় পরক্ষনেই শরীর জুড়িয়ে যায়, আকাশটা ছিলো নীল ক্যানভাস। জানালা বেয়ে হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকে উড়িয়ে নেবার তোড়জোড়।
ডায়ালাইসিস নেবার পর মাসল ক্রাম্প সহ নানা রকম যন্ত্রনায় মা কাতরাতেন। একবার এমন হলো তার প্রেসার নেমে গেলো ৪০/৮০ যেখানে একজন মানুষের স্বাভাবিক প্রেসার থাকে ৮০/১২০। সবাই ভেবেছিলো বাঁচবে না। সেবার ঠিকই উতরে গেলেন হাসপাতালে। কিন্তু সেদিন ব্যাথা উঠতেই বাবাকে বলে নিজেই নীচে নামলেন, গাড়ীতে উঠলেন। হাসপাতালে গিয়ে যন্ত্রনা নিয়েই নার্সকে সব বললেন। নার্স ব্যাথানাশক ওষুধ সহ স্যালাইন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। কে জানতো এটাই তার শেষ ঘুম! শেষ ডায়ালাইসিস করাবার আগের দিন ঘন্টাখানেক কথা বললাম। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, হাসিনা-খালেদা নিয়ে তর্ক, আমার বিয়ের জন্য কেমন পাত্রী হওয়া উচিত এসব নিয়েই চললো কিছুক্ষন। আব্বার দাড়ি নিয়ে হাসাহাসি করলাম। বাবা পাশে বসে শুনছিলেন।
বোনের জামাই তার মৃত্যুসংবাদ ম্যাসেজ করেছিলাম। বাবা বোন কারো সাথেই ফোনে কথা হলো না, কথা বলার মতো পরিস্থিতি নেই। লিসবনে ফোন দিয়ে টিকেটের খোঁজ নিয়ে জানলাম ১ সপ্তাহের মধ্যে ইকোনমি ক্লাসে কোনো টিকেট নেই, সব বিজনেস ক্লাস খালি। চাইলে যেতে পারি। স্টকহোমে ফোন দিতেই টিকেট পেয়ে গেলাম, বেশ সস্তাতেই। শর্ত একটা পরের দিন দুপুরের ফ্লাইট ধরতে হলে রাতেই স্টকহোমে যেতে হবে, এবং সেটা করতে হলে আমাকে সন্ধ্যার আগে লিসবন এয়ারপোর্টে পৌছাতে হবে। তাও অনেক ঝামেলা, ট্রানজিট হবে দুটো জায়গায়: জার্মানী ও তুর্কি।৩০ ঘন্টার জার্নি।
অনেক শখ ছিলো দেশে গিয়ে মা কে নিয়ে ভারত ঘুরে আসবো। সেভাবেই সব প্লান ছিলো। মা এর অপারেশনটা হলে রামপাল, রূপপুর গিয়ে ওখানকার পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখে আসবো। তার সাথে দিনাজপুরের যে অববাহিকায় ইউরোনিয়াম পাওয়া গিয়েছিলো, খনিজ মন্ত্রনালয়ের অফিসেও একটু ঘুরে আসবো ডিটেইল কিছু তথ্যের জন্য। কিন্তু এভাবে যে যেতে হবে বুঝতে পারিনি। যখন বাসায় পৌছালাম তখন ফরিদপুর, মুন্সিগন্জ, রংপুর, নারায়ন গন্জ থেকে আগত আত্মীয় স্বজন ফিরে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে আরেকবার কান্নাকাটির রোল শুরু হলো। তখন ছিলো আছরের সময়। কাকা বললেন ইমামতি করতে। ইসলামী তরিকা অনুযায়ী আমার ফরজ গোসল দরকার, নতুবা অজু হবে না। ফরজ গোসলও যে শেষ কবে করেছি খেয়াল নেই। মন থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে অনেক আগেই কিন্তূ এই পরিস্থিতিতে বিনা অজুতেই ইমামতি করতে হলো। মা এর কবর জিয়ারত বেশ সহী ভাবেই করলাম। কাকা ভেবেছিলেন আমি সব ভুলে গেছি হয়তো। কিন্তু আমার তেলাওয়াত শুনে বেশ অবাক হলেন। বললেন তার ছেলে হাফেজী পাশ করেছে কিছুদিন আগে। মৌলানাতে ভর্তি হয়েছে। পরীক্ষা সামনে বলে ফরিদপুর চলে গেছে। যাবার আগে মা এর জন্য কোরান খতম দিয়েছে। তার হাতে গড়া মাদ্রাসাটা ঘুরে দেখার আমন্ত্রন জানালো। যদিও তাকে বলেছিলাম দেশে আসলে একটা কম্পিউটার ল্যাব দেবো ওদের, কিন্তু সেটা নিয়ে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না।
আম্মা মারা যাবার আগে কিছু কাজ দিয়ে গেছেন। প্রতি সন্ধ্যায় “রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বি ই্যানি ছগীরা” পড়তে হবে। বিয়ে করতে হবে, পছন্দ হোক বা না হোক, সংসারী এ বেলায় হতেই হবে।আমাকে দেশে ফিরতে বারন করেছেন আর আমি যেনো কোনো অপরাধবোধে না ভুগি।
ইসলাম নিয়ে লেখালেখির কারনে বাসায় নানা রকম লোকজন আসতো, বাইরে ভীড় করতো। তিনি অসুস্থ থাকা সত্বেও জঙ্গিদের নির্যাতন বেশ চরমেই ছিলো ধরা যায়। একবার বাসায় এক মহিলা এসে মাকে সরাসরি বলেন আমি যেনো লেখালেখি বন্ধ করি নতুবা তিনি পুলিশ কেস করবেন। তার পরের দিন ডায়ালাইসিস করাবার ডেট ছিলো। স্বভাবতই সেদিনটা ছিলো কস্টের। আম্মা তাকে সরাসরি বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। আব্বাকে থানায় পাঠান। আব্বা থানায় গিয়ে ঐ মহিলার ব্যাপারে জিডি করতে চাইলে দারুস সালাম থানার ওসি তাকে শান্ত করেন। বললেন নেক্সট টাইম এমন করলে শুধু ফোন করলেই চলবে। সাধারন ডায়েরী করে চলে আসেন।
আব্বা যখন এ কথাগুলো বলছিলেন, বুকের ভেতর বড্ড শূন্যতা কাজ করছিলো। আম্মাকে বাড়ীর কাছেই কবর দেয়া হয়েছে। আব্বা আর এখান থেকে যাবেন না। বোনকে বললাম বোঝাতে, সে শুনলো না।
মামা তাবলীগ করেন প্রায় ১ যুগ ধরে। তিনি বললেন,”তুমি কি সত্যি তার জন্য মন থেকে দোয়া করবা না? তার আত্মা শান্তি পেতো।”
তার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থাকলাম। তার সাথে আমি অনেক কিছুই শেয়ার করি,”মামা, আমাদের আত্মার মধ্যে কি এমন গুন আছে যে মৃত্যুর পর তারা এমন উড়ে উড়ে বেড়াবে? আমাকে একটা কারন বলেন!”
সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আমি বলতে থাকলাম,”পর্তুগীজ দার্শনিক ইউরি ডি কস্তা ক্যাথলিক পরিবারে জন্মালেও দর্শনের সংস্পর্শে এসে তিনিও এমন প্রশ্ন করলেন। আত্মা এমন কি জিনিস, যেটা আমাদের মৃত্যু হলে দেহ ছেড়ে উড়ে যাবে। সে একসময় রাব্বিনিক ইহুদী মতাদর্শে বিশ্বাস করা শুরু করেন যারা মনে করতেন মানুষের আত্মা বলে কিছু নেই। মানুষ মরে গেলে তার সত্বারও মৃত্যু হয় এবং সে তখন বেচে থাকে তার কর্মে, গুনে, মানুষের স্মৃতিতে। যদিও পরে তিনি সেই ইহুদী ধর্মও ত্যাগ করেন দর্শনের খাতিরে।”
মামা মাথার টুপি খুলে হাত বুলালেন,”কিন্তু এত দিনের বিশ্বাস, এক দুইজনের কথায় তো ভুল হতে পারে না।” আমি হাসলাম,”জরূরী নয় যে সবাই এক পথে চললে আপনাকেও সে পথে চলতে হবে। মা মারা গেছেন, সত্যি বলতে সে হারিয়ে গেছে। তার কাছে অনেক কিছু বলার ছিলো, সে অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলেন। সেগুলো আর বলা হবে না, শোনা হবে না। যেটা শিক্ষা হলো, যারা বেঁচে আছেন, তাদের প্রতি আমার কর্তব্যটুকু পরিপূর্নভাবে পালন করা, তাদের সেবা করা। ভালোবাসা মন থেকে। আমার শরীরটা মায়েরই দেহের একটা অংশ। ৯ মাস তার দেহের একটা অংশ ছিলাম, তারপর পৃথিবীর আলো দেখেছি, এত বড় হয়েছি। মা এর একটা অংশ আমার মধ্যেই এখনো বেঁচে আছে। যদি কোনো অনৈতিক বা অযৌক্তিক কাজ করি, তাহলে মাকেই অসম্মান করা হবে। এই যে এত মানুষের ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, সবাইকেই অপমান করা হবে।”
মামা আর কিছু বললেন না। আমি বাসা থেকে বের হলাম। তিলোত্তমা ঢাকা শহর কিভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে সেটা অনুধাবন করার চেস্টা করলাম। অট্টালিকার অরন্যে আমরা নিজেদেরকে শেকল বন্দী করে মৃত্যুকেই ডেকে আনছি এটা সবাই জানে, বুঝে, তবুও মানুষ সে কাজগুলো করেই চলেছে। দেশের মানুষ এমন গোয়াড় রকমের আত্মঘাতী কেন ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
অদ্ভুত দমবন্ধ পরিবেশ অস হ্য লাগতে শুরু করলো। মোবাইলটা বের করে নেক্সট ফ্লাইট ঘাটতে লাগলাম….।
কথাগুলোর মধ্যে যুক্তি আছে ।
দীর্ঘ একটা সময় আপনার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। আশা করবো এখন ভালো আছেন।
চমৎকার উপলব্ধি আপনার। এমন ভাবনা অনেকের মনের মাঝে নেই। এখন আপনার লেখা পড়ে মা'কে মনে পড়ে গেল।
স্মৃতিচারণ পড়লাম ভাই। বেশ অনেকদিন আপনাকে মিস করেছি।
"শেষ ডায়ালাইসিস করাবার আগের দিন ঘন্টাখানেক কথা বললাম। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, হাসিনা-খালেদা নিয়ে তর্ক, আমার বিয়ের জন্য কেমন পাত্রী হওয়া উচিত এসব নিয়েই চললো কিছুক্ষণ। আব্বার দাড়ি নিয়ে হাসাহাসি করলাম। বাবা পাশে বসে শুনছিলেন।"
আজ শুধু ই স্মৃতি।
ভালো থাকুন উদাসী স্বপ্ন ভাই।
আপনার জন্য শুভেচ্ছা।