নক্ষত্রের গোধূলি-১৯

৩১।
রাশেদ আর ফিরোজ একই স্কুলে পড়েছে। স্কুল ছাড়ার পর এই প্রথম দেখা। লন্ডন আসার দিন ঠিক হবার পর কামরুলের কাছ থেকে ফিরোজের ফোন নম্বর, মেইল ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করেছিলো। প্রায় ত্রিশ বছর পর দেখা। খেতে বসে আরও আলাপ হলো। শেফালি ভাবী একটা ড্রাইভিং স্কুল চালায়। মনিরা যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। মনিরা জানে ওর সব বন্ধুরাই এমন। একেক জনের সাথে বিশ, পঁচিশ বা ত্রিশ বৎসর পরে দেখা হলেও কারো ভাব দেখে বোঝার উপায় নেই যে এতো দিন পর দেখা হয়েছে, এমনকি এর মধ্যে এদের কারো সাথে কোন যোগাযোগও নেই তবুও কেও কাউকে কোন অবহেলা করে না ভুলে যায় না। সবাই একই রকম, আন্তরিকতায় কেও কম না। আনন্দে, কৃতজ্ঞতায়, পাগল স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় মনিরার চোখ ভিজে উঠলো।
-সত্যিই ভাবী আমি যে এখানে এসে এমনটা পাব তা কল্পনাও করতে পারিনি। মনে হচ্ছে আপনি আমার কত দিনের চেনা, কত আপন, বলেই শেফালিকে জড়িয়ে ধরল।
-না ভাবী আপনার ভাই শুধু বলেছে ওর অনেক দিনের পুরনো এক বন্ধু বৌ নিয়ে আসছে। আমাকে আর কিছু বলেনি।
-মনিরা বলে উঠলো তাহলে দুইজনে একই রকম?
-শেফালি বললো তা না হলে বন্ধুত্ব হবে কি করে?
মনিরার চোখ এর পরে আর পানি সামলাতে পারেনি ফোটা ফোটা করে গড়িয়ে পরছে।
তাই দেখে ফিরোজের মা বললো
-ওকি মা তুমি কাঁদছ কেন? আমি তো জানতাম না যে তুমি আমাদের আপন জন। ফিরোজ আমাকেও কিছু বলেনি। আমি জিজ্ঞেস করাতে শুধু বলেছিলো তোমাদের পাশের গ্রামেই।
-তা বলত মা গ্রামের কি অবস্থা, কে কেমন আছে, কোথায় কি হচ্ছে, কৌড়ির ব্রিজটা কি হয়েছে, ঢাকা থেকে ঝিটকা যেতে এখন রাস্তার কি অবস্থা? এরকম আরও নানা কৌতূহল। তোমার ছেলে মেয়ে কজন, বাড়িতে কে কে আছে, তোমার বাবা চাচার কি অবস্থা?
-আমার বাবা তো অনেক আগেই চলে গেছেন ফুফু, চাচাও এইতো কয়েক বৎসর হলো। কাসেম চাচাকে কিছু দিন আগে দেখেছিলাম, আমাদের বাড়ি এসেছিলো। আমিও ফুফু আম্মা আপনার মতই প্রায়, দেশে থেকেও গ্রামে খুব একটা যেতে পারি না
-আচ্ছা চলো শুয়ে পর আজ আর না কাল গল্প করব, এতদিন পর গ্রামের মেয়ে পেলাম আমার যে কি ভালো লাগছে মা। আজ তোমরা ক্লান্ত, যাও বিশ্রাম নাও।
-ভাবী চলেন। এখানে কিন্তু আপনাদের ঢাকার মত বড় বড় ঘর নেই। ছোট ঘর, শীতের দেশে ঘর গরম রাখতে গেলে বড় ঘরে অনেক খরচ হয় তাই সবাই ছোট ছোট ঘর বানায়।
-কি যে বলেন ভাবী, ছোট আর বড়। আমি যে কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় থাকবো আমি তো আসতেই চাইছিলাম না। শুধু ওর পাগলামির জন্য আসা।
-এসে ভালো করেছেন, এর পরে আপনি যে কোন সময় আসতে পারবেন।

৩২।
মনিরা আর রাশেদ সাহেব আপাতত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে তাদের ঘরে চলে এলো। ছোট্ট একটা ঘর, সিঙ্গেল একটা খাট। এর মধ্যেই তাদের দুজনকে থাকতে হবে। রাশেদ সাহেব বাঙ্গালির স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে একটু বেশি লম্বা বলে দেশের বাজারে যে মাপের খাট তৈরি হয় তাতে শুতে পারে না। নিজে কাঠ কিনে এনে বাড়িতে মিস্ত্রী ডেকে তার নিজের মাপ মত খাট বানিয়ে নিয়েছেন। আজ এই ছোট্ট খাটে দুজনকে শুতে হবে। মনির দিকে চেয়ে হেসে বললেন কি করবে, এর মধ্যেই শুয়ে পর। লম্বা জার্নি করেছ তুমি ক্লান্ত। খাটের দিকে চেয়ে লাভ নেই। এখানে যা পেয়েছ তাতেই শোকর কর। না হলে এতক্ষণে ভিক্টোরিয়া স্টেশনের কাছা কাছি বা হোয়াইট চ্যাপেলের কাছে কম দামের ‘বেড এন্ড ব্রেক ফাস্ট’ খুঁজতে হতো। অনেক পেয়েছি এখানে।
দেখেছ, ফিরোজের বোন, বোন জামাই আমাদের জন্য এই ঘর ছেড়ে অন্য বাসায় গিয়ে থাকছে। এদেশে যার যার নিজের যতটুক দরকার ততটাই ঘর কিনে। এতো বড় ঘর দিয়ে কি করবে? এটাই এই লন্ডনের জীবন। দেশের মানুষ যেমন ভাবে যারা লন্ডন থাকে তারা না জানি কত সুখে আছে আসলে তা নয়। হ্যাঁ রোজগার ভাল কিন্তু জীবনের অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় এখানে। ক’দিন থাক দেখবে, এখানকার জীবন কেমন।
এই যে এই জানালা দেখছ দেখ এতে মোটা দুইটা কাঁচ লাগানো রয়েছে, এর নাম হচ্ছে ডাবল গ্লেজিং যাতে শীতের তাণ্ডব দ্বিতীয় কাঁচ ভেদ করে ঘরে ঢুকতে না পারে। শীত বল আর গরম বল কখনোই জানালা খুলে রাখতে পারবে না। আমাদের দেশের মত বারান্দায় বসা কাকে বলে এরা জানেই না। কাল দিনে দেখবে বাড়ি ঘর একেকটা একেক দিকে মুখ করা। দক্ষিণ মুখী হতে হবে নয়তো একান্ত পূর্ব মুখী না হলে বাতাস এসে দেহ মন জুড়িয়ে দিবে এদের এমন ভাবনা নেই। আরও দেখবে, এখানে কেও কারো নয়। কেও কাউকে এক কাপ চাও খেতে বলে না নিতান্ত কোন উদ্দেশ্য না থাকলে। তবুও যা করেছে আমি ভাবতেও পারিনি। সেই কবে স্কুল ছেড়ে আসার পর আর দেখা হয়নি, জানা না থাকলে ওকে দেখে হয় তো চিনতেও পারতাম না। ও যা করেছে সে ঋণ আমি কোন দিন শোধ করতে পারব কিনা জানি না। ওর বৌ যদি এমন না হতো তাহলে হয়ত ফিরোজের পক্ষে এতটা সম্ভব হতো না।

সবই আল্লাহর ইচ্ছা নয়তো এমন জামাই আদর? অসম্ভব। আমি তো ভাবতেই পারিনি, শুনেছি এদেশের মেয়ে তাই ভেবেই নিয়েছিলাম সাদা কেও হবে, এতো দিন তাই মনে করেছি। নিজের আপন ভাই তো রয়েছে তাকে তো জানাতেও পারিনি। যাক কাল থেকেই সব দেখতে পাবে। এখন শুয়ে পর, আমরা তো আর হানিমুন করতে আসিনি বা সখ করে বেড়াতে আসিনি। আমাদের ভাগ্য টেনে নিয়ে এসেছে এখানে।
ভোরে সেহরি খাবার জন্য উঠেছিলো, কোন রকম সেহরি খেয়েই আবার ঘুম। সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক দেরীতে। ভাবী বা ফিরোজ কেও ইচ্ছা করেই ডাকেনি।
মনিরার সাড়া পেয়ে ভাবী উপরে এসে জিজ্ঞেস করলেন -কি ভাবী ঘুম হয়েছে?
-হ্যাঁ ভাবী দুই দিন পথে থেকে ভীষণ টায়ার্ড ছিলাম শোবার সাথে সাথেই ঘুম কোথা দিয়ে এত বেলা হয়েছে বুঝতেই পারিনি।

নিচে নেমে সবাই গল্প করছে। চলো দেখি তোমাদের জায়গাটা কেমন দেখায়। ঘরের বাইরে বের হলো, প্রচণ্ড শীত, গরম কাপড় গায়ে তবুও কাঁপুনি লাগছে। ওর বাড়িটা বেশ সুন্দর। সামনে একটু ফুলের বাগান, এখন শীত বলে কোন ফুল নেই শুধু গাছ গুলি দাঁড়িয়ে আছে। তারপরেই বাচ্চাদের খেলাধুলার একটু জায়গা। আবার তার পরেই রাস্তা। কাল যে গাড়িতে করে এসেছে সেটা রাস্তার পাশেই ওর বাড়ির সামনে রেখেছে। ফিরোজ বললো ওটা শেফালির।
-তোমার কোনটা?
-ওই তো ওর পিছনের টা।
শীত সহ্য করতে না পেরে মনি ভিতরে চলে এলো। বাড়ির পিছনে শাক সবজি করার মত খানিকটা মাটি, চারদিকে কাঠের বেড়া দেয়া। এক কোনায় একটা আপেল গাছ। নীচ তলায় বসার ঘর, রান্না ঘরে আবার ছোট একটা খাবার টেবিল পাতা আছে, ছোট একটা টয়লেট আর একটা ঘর যেখানে ওর মা থাকে। উপরে দোতলায় দুইটা ঘর, বাথরুম টয়লেট, তিনতলায় চিলে কোঠার মত একটা ঘর। বেশ ছিম ছাম করে সাজানো। সারা বাড়িতে মোটা কার্পেট বিছানো। এমনকি বাথরুমেও। বাথরুমের এক পাশে পর্দা ঘেরা বাথ টাব। এখানে আমাদের দেশের মত ঘরে ঘরে জনে জনে একটা করে বাথরুম নেই। অতিরিক্ত কোন ঘর নেই। এখানে একটা বাড়ি আছে এই যথেষ্ট। বিলাসিতা করার মত বা অনর্থক খরচের বোঝা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। শীত কালে বাড়ি গরম রাখার জন্য যথেষ্ট গ্যাস বিজলী খরচ হয়ে যায়। এর নাম লন্ডন শহর। সারা দিন কাজ আর কাজ, বাড়িতে কতক্ষণই থাকার সুযোগ পায়। রাতে কোন রকমে শরীরটাকে একটু বিছানায় ফেলে দেয়া।
বাড়িতে সেন্ট্রাল হিটিং চলছে তবুও বসার ঘরে আলাদা একটা হিটার চলছে। নভেম্বরের প্রথম, এর মধ্যে লন্ডন শহরে আর কেও জায়গা পাক আর না পাক শীত মহোদয় তার আসন পেতে নিয়েছে। ফিরোজের মা মনিকে ডেকে পাশের রান্না ঘরে গেলো।

12 thoughts on “নক্ষত্রের গোধূলি-১৯

  1. ভালো মন্দ রান্না হলে এই ভর দুপুরে আর > বাসায় গিয়ে খাওয়া লাগতো না।  https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Razz.gif.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।