ট্যাগ আর্কাইভঃ মেগা সিরিয়াল

নক্ষত্রে গোধূলি-৬৫/২৫০

৮৬।
রাশেদ সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে তার অজান্তে দুচোখ টলমল করে উঠল। এইটুকু ছেলে বলে কি? তার কণ্ঠ চেপে আসল। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। মনি দেখ, এইটুক ছেলে বলে কি? মনে মনে মনিকে ডেকে এনে দেখিয়ে বললো দেখ এই ছেলে আমাকে কিভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছে, আশার আলো দেখাচ্ছে, কি সব কথা বলছে! তার চেতনার মনি তার সাধনার মনি তার হৃদয়ের মনি। যে মনি বুক ভরা প্রশান্ত মহাসাগরের সমান নিস্তব্ধ ভালোবাসা নিয়ে তার পথ চেয়ে আছে। দেখ মনি এই এতটুকু ছেলে যখন বলছে তখন নিশ্চয়ই আমাদের একদিন এই অন্ধকার শেষ হয়ে আলোয় ভরা দিন আসবে। আমাদের সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি।

-কিছু মনে করবেন না, আপকা আসু দেখকে মালুম হোতায় আপ ভাবীজীকো বহোত পিয়ার করতায়।
-চোখের পানি যে সেই জন্যে তা কি করে বুঝলে?
-কেন বুঝব না? যখনই ভাবীজীর কথা বলেছি তখনই আপনার চোখে পানি চলে এসেছে। রাশেদ সাহেব একটু লজ্জা পেয়ে ঘটনা আড়াল করার জন্যে বললেন-
-আরে না চোখে পানি এসেছে তোমার জ্ঞানের কথা ভেবে। দেখ প্রবীণ তুমি আমার সন্তানের চেয়েও বয়সে ছোট হবে তোমার মত এতটুকু ছেলের মুখে আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা শুনে আমি অবাক হয়েছি। তোমার প্রতি আমার মন ভীষণ রকম আবেগময় হয়েছে তাই চোখে পানি এসেছে। অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত তোমার দৃষ্টি, তুমি অনেক বড় হবে, তুমি মানুষের ভালোবাসা পাবে তোমার ঈশ্বর তোমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবেন।
-আপনি এতো সুন্দর করে কথা বলেন এই জন্যে আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে, আপনার এই চাওয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা আমি যদি আপনার সাথে একটু কথা বলি আপনি কি বিরক্ত হবেন?
-আরে না না কি যে বল! বল কি বলবে।
-না তেমন কিছু না এই প্রেজেন্ট ওয়ার্ল্ড সিচুএশন নিয়ে একটু আলাপ করতাম।
-হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।

-এই যে দেখেন আমাদের দেশে বলেন আর আপনাদের দেশে বলেন অর্থাৎ সারা পৃথিবীতেই আজকাল সবাই কেমন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে কেও নিজের কথা ছাড়া অন্যের কথা ভাবে না।
-তুমি যে আজকালের কথা বলছ, তুমি কি আগের দিন দেখেছ? তুমি তার সাথে তুলনা করছ কি ভাবে?
-না দেখিনি, তবে এটা তো অনুমান করতে পারি যে আগে এরকম ছিলো না। আমি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, পড়েছি, কৃষণ চন্দ্র পড়েছি। আমাদের সাহিত্য পড়েছি। বাবা মার কাছে শুনেছি, দাদার কাছে শুনেছি সেই যুগ আর এই যুগের ব্যবধান। সাহিত্য তো সবসময় সেই সময়ের বর্তমানের প্রেক্ষাপটে রচিত হয় কাজেই এই ডিফারেন্স থেকেই অনুমান করা যায়। তাই না?
-হ্যাঁ তা যায় কিন্তু তুমি যাদের কথা বলছ তারা কেও বাঙ্গালি, কেও পাঞ্জাবি, কেও তামিল। তুমি কিভাবে পড়েছ?
-কেন হিন্দি, নেপালি।
-ও আচ্ছা।
-হ্যাঁ যা বলছিলাম, আজকাল প্রতিযোগিতা এতো বেশি যে কেও কারো দিকে তাকাবার সুযোগ পায়না। জনসংখ্যা বেশি হয়েছে, সেই সাথে চাহিদা বেশি হয়েছে। চাহিদার ধরন, মাত্রা, প্রকার সবই বেশি হয়েছে। এমনকি বাবা মাও তার নিজের সন্তানের চাহিদা বুঝতে পারে না। যেমন আজকাল বাবা মা তাদের সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারছে না। সে শিক্ষার জন্যেই হোক বা রোজগারের জন্যেই হোক, তাকে বিদেশে নয়তো দূরে কোথাও পাঠাতে হচ্ছে। সেখানে যাবার পর সে জায়গায় থাকতে থাকতে সেখানকার আবহাওয়া পরিবেশ, সে দেশের রীতিনীতি, সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন কিছুর প্রেক্ষাপটে তার রুচির পরিবর্তন হচ্ছে, দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে, ছেলের চাওয়া পাওয়ার ধরন বদলে যাচ্ছে, বিরাট ব্যবধান তৈরি হচ্ছে যা তার বাবা মা কিছু জানতে এমনকি কিছু বুঝতেও পারছে না। এই ছেলে যখন তার মায়ের কাছে ফিরে যাবে তখন মা তার চেনা ছেলেকে ফেরত পায়না। যা পায় তা হলো এক নতুন ছেলে। কয়েক বছর আগে যে ছেলে মায়ের চেনা ছিলো সে এখন অচেনা মনে হয়। এ তো গেলো মা আর বাবা। তারা একে জন্ম দিয়েছে কাজেই তারা মেনে নেবার চেষ্টা করবে। কিন্তু বাইরের মানুষ? তারা এটা কেন মেনে নিবে? তৈরি হবে দ্বন্দ্ব, সংঘাত আর প্রতিযোগিতা। শুধু এই না, আরও অনেক কারণ আছে এরকম।

এই পর্যন্ত বলে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে আবার শুরু করল-
-একটু দেখেন চারিদিকে, কারণগুলি খুঁজে পাবেন। এইযে দেখেন আমি যখন নেপালে ছিলাম তখন কিন্তু আমি ড্রিঙ্ক করতাম না। কিন্তু এখন সপ্তাহে অন্তত একদিন ড্রিঙ্ক করতেই হয়। পাবে যাই, ড্রিঙ্ক করি নাচি। ভালো লাগে, বাবা মার কথা মনে হয়না, দেশের কথা মনে হয়না বেশ ভালো আছি। যখন দেশে যাব একদিন ড্রিঙ্ক করে এলেই মা কি সেটা মেনে নিবে? কিংবা ধরেন বিয়ে হলে আমাদের দেশের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা বৌ কি সেটা মানতে পারবে? অথচ দেখেন এখানে স্বামী স্ত্রী একসাথে পাবে যাচ্ছে, ড্রিঙ্ক করছে, নাচছে তারপর ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরছে। আবার মদের ঘোড়ে ঝগড়াঝাঁটি করে দুই জনে দুই দিকেও চলে যাচ্ছে।
-না আমাদের দেশের কোন মেয়ে এটা মেনে নিতে পারবে না।
-এইতো অবস্থা তখন আমি কি করবো? এই যে দেখেন আপনি আপনার বাবা মাকে যা দিচ্ছিলেন তাতে আপনি সুখী ছিলেন। ভাবছিলেন আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী কর্তব্য ঠিক ভাবে পালন করে যাচ্ছেন কিন্তু তারা আপনার কাছে যেভাবে যা চাচ্ছিলেন তা তারা পাননি বলেই সংঘাতের সৃষ্টি এবং আপনার বিপদের দিনে তারা আপনাকে সাহায্য করেনি। এই যে আপনি আপনার স্ত্রী সন্তানদের ছেড়ে এখানে থাকছেন এজন্যে কি তারা কেও দায়ী নয় ভেবেছেন? এতে যে আপনার কত ক্ষতি হচ্ছে তা কি তারা জানে না? আপনার সন্তানদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া কিভাবে পড়বে তা কি লক্ষ করেছেন? আজকাল বাবা কাছে থেকেও সন্তান মানুষ করতে পারে না, সেখানে আপনি কি ভাবে আশা করেন আপনার সন্তানেরা আপনার অবর্তমানে ঠিক ভাবে মানুষ হবে? আমি অবশ্য জানি না আপনি কোথায় কি ভাবে কি করেছেন বা এখানে কেন এসেছেন এটা আমার অনুমান থেকে বলছি।
-প্রবীণ তুমি যখন এত কথা বলেই ফেললে তাহলে শোন আমি সংক্ষেপে বলছি।
আমার বাবা চাচা যখন খুবই ছোট তখন আমার দাদা হঠাৎ করে মারা যান এবং খুবই স্বাভাবিক ভাবে আমার দাদি আধা ডোবা নৌকার মত দিশা হারা হয়ে পরেন। আর তখন আমার দাদার অন্য ভাইয়েরা আমার দাদিকে তাদের ইচ্ছা মত সামান্য কিছু দিয়ে বুঝিয়ে দেন। আমার দাদি ছিলেন খুবই উচ্চ বংশের মেয়ে তাই সে এভাবে ঘটনার শিকার হওয়া মেনে নিতে পারেনি। তার দুই ছেলেকে যেমন তেমন করে বড় করতে পারেননি। তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। তিনি দেখলেন তার কাছে রেখে ছেলেদের মানুষ করতে পারবেনা। তাই তার ছেলেরা একটু বড় হলে তার দূরে দূরে থাকা দুই বোনের কাছে পাঠিয়ে দেন। এতিম অনাথ দুটি ছেলে অবহেলা অনাদরে অনেক কষ্ট সহ্য করে সেখানে বেড়ে উঠে এবং লেখা পড়া শিখে। এই জন্যে আমি চেয়েছিলাম এমন কিছু করবো এমন একটা অবস্থানে যাবো যেখানে আমার বাবা এবং চাচা তাদের হারান গৌরব ফিরে পান। তারা তাদের মুখের নিভে যাওয়া হাসি ফিরে পান। মানে আমার সম্পূর্ণ পরিবারটাকে তার হারান সম্মান ফিরিয়ে এনে একটা গুরুত্ব পূর্ণ অবস্থানে দাঁড় করাতে এবং তা যেন কোন অবস্থাতেই অন্যের গ্রাস কেড়ে নিয়ে না হয় সেই ভাবে। যেটা আমার, আমি যেটুক করেছি শুধু সেইটাই আমার হবে, আমারটাই যেন চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে পারি। আশেপাশে সবাইকে নিয়ে চলতে পারি, পরিবারের সবাই মিলে সুখে শান্তিতে সম্মান নিয়ে, গৌরবজনক পরিচয় নিয়ে বসবাস করি, এই ছিলো আমার ইচ্ছা। এজন্যে চেষ্টা বল আর পরিশ্রম বল কোনটাই কম করিনি। ধৈর্যও আমার কম ছিলোনা।

কিন্তু আমার জন্মের সময় যে অগ্নিবীণা তার মধুর সুর ঝরিয়ে আমার আগমন বার্তা ঘোষণা করতে চাইছিলো কেমন করে যেন সেই তার ছিঁড়ে গিয়েছিলো। সেই ছেড়া তারের সুর আমার ভাগ্যের রিমোট কন্ট্রোল অপারেটরের রেজিস্টারে এন্ট্রি হয়নি। সে সংবাদ আমি জানতে পারিনি। ছেড়া তার দিয়ে কি করে আমি রাগিণীর সুর তুলি বল? শুধু বৃথা চেষ্টা করে গেছি। প্রচণ্ড ঝড়ে বিক্ষুব্ধ নদীর বুকে টলমল ভাসমান নৌকা যেমন তীরে ভিড়তে পারেনা বারবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে ঠিক তেমন করে আমিও ফিরে ফিরে এসেছি। যখন ধরে দাঁড়াবার মত কোন আশ্রয় অবশিষ্ট ছিলো না, আমার সব থাকতেও আমার দিকে আমার মত করে কেও তাকায়নি তখন এই যে আমি আজ তোমার সামনে বসে আছি।

রাসেদ সাহেব অনেকক্ষণ এক নাগারে কথা বলে একটু থামলেন।
-তুমি বস আমি একটু চা নিয়ে আসি।
-চলেন আমিও আসছি।
নিচে এসে দুই কাপ চা নিয়ে আবার উপরে আসলেন।
-এবার বল তুমি কি বলতে চাইছিলে।
-তাহলে দেখেন আমি যেরকম ভেবেছিলাম প্রায় সেরকম, আপনি এতদিন বাড়ির বাইরে থেকে কিংবা দেশের বাইরে থেকে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছেন যা শিখেছেন যা দেখেছেন আপনার জীবনে তাই কাজে লাগাতে চেয়েছেন। আপনার ভিতরে হারানোর গ্লানি আপনাকে শান্তি দেয়নি, অস্থির করে রেখেছিলো। এটা আপনি ইচ্ছা করে না করতে চাইলেও আপনার অবচেতন মন থেকে আপনাকে সেই ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ঠিক সেই রকম করে সাজাতে চেয়েছে। আপনার স্ত্রীকে যেরকম করে পেতে চেয়েছেন, আপনার সন্তানদেরকে যে ভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন, আপনার পরিবারের জন্য হারান গৌরব উদ্ধার করতে চেয়েছেন। এটা আপনি ইচ্ছা করে করেননি। এটা আপনার দৃষ্টি ভঙ্গি পরিবর্তনের সাথে সাথে এধরনের মানসিকতা তৈরি হয়েছে। আপনার বাবা আপনার মাকে নিয়ে যেভাবে চলেছেন তিনি ভেবেছিলেন আপনিও সেইরকম হবেন। আপনার বাবা আপনাকে যেভাবে বড় করেছেন তিনি চাচ্ছিলেন আপনিও আপনার সন্তানকে সেইভাবে বড় করবেন। তিনি যেভাবে এতকাল চলে এসেছেন যা দেখে এসেছেন তার ধারনা ছিলো আপনিও সেইরকম হবেন। তার মনে হারানোর কোন গ্লানি জমেনি। সেদিকটা তিনি চোখ মেলে দেখেননি। তিনি অনেক অযত্ন অবহেলা বিড়ম্বনা পেয়েছেন। তিনি স্বাভাবিক জীবন পাননি। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার শক্তি সে পায়নি। কারণ তার মনে সেটা কোন দাগ কাটেনি। এসব কারণে তার মানসিকতা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে, দৃষ্টি ভঙ্গি প্রসারিত হয়নি অথচ তিনি কিন্তু তা টের পাননি। অর্থাৎ এগুলি সব তার অজান্তে হয়ে গেছে। তাকে টিকে থাকার জন্যে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে তাই জীবনে টিকে থাকাই তার কাছে কঠিন মনে হয়েছে। দেখেন পৃথিবী এর মধ্যে অনেক বয়স বাড়িয়ে ফেলেছে এবং ক্রমে ক্রমে তা বেড়েই চলেছে।

পৃথিবী সূর্য থেকে অনেক তাপ গ্রহণ করেছে। তার পেটের ভিতরে অনেক আগুন জ্বলেছে। কত বৃষ্টিতে ভিজেছে, কত বজ্রপাতে বিদ্ধ হয়েছে আবার কত তুষারপাতে জমেছে। তার বুকের উপর দিয়ে কত নদী সাগরে গিয়ে মিশেছে, সে কারো জন্যে থেমে নেই। তার উপরে এই যে মানব সন্তানেরা রয়েছে তারা অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে। কত মারামারি, কাটাকাটি, রক্তারক্তি করেছে। কত উড়ো জাহাজ উড়েছে, কত রেল গাড়ি পৃথিবীর বুকের উপর দিয়ে ঘরঘর করে মাটি কাঁপিয়ে চলে গেছে, কত তেল জ্বলেছে, তেলের খনি গুলি শেষ হবার পথে। তেল ফুরিয়ে গেলে কিভাবে চলবে তাই নিয়ে গবেষণা চলছে, কত রেডিয়েশন হয়েছে, কত ঝড় বয়ে গেছে। গ্রিন হাউজ এফেক্টের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ফুটো হয়ে গেছে, সেখান দিয়ে সূর্য থেকে বিপদজনক রশ্মি আসছে। দয়া মায়া স্নেহ মমতা ভালোবাসা সূক্ষ্ম আবেগ অনুভূতি হাজার হাজার কোটি ভাগ হয়ে এখন প্রায় শেষ হবার পথে। যারা এই পৃথিবীতে নতুন আসছে তাদের ভাগে এগুলি ক্রমেই কমে আসছে। আবার ওদিকে অহংকার, হিংসা, ক্রোধ, লোভ এগুলি চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ এগুলি হলো কালো শক্তি। মানুষ ক্রমেই কালো শক্তির ভক্ত হয়ে উঠছে, এর চর্চা চলছে বলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সহজেই মানুষের মাথার ভিতরে ঢুকে পড়ছে। কোটি কোটি মানুষ জায়গা বদল করেছে সে হিসাব কিন্তু তিনি মিলিয়ে দেখেননি। তার বাস্তব তার মনোমত হয়নি কারণ সে এগুলি বিবেচনা করেনি।

এইযে পার্থক্য, এই দূরত্বটাই সংঘাতের সৃষ্টি করেছে। আপনি হলেন পরিস্থিতির শিকার। আপনি বিদ্রোহের আগুন জ্বেলেছেন কিন্তু সে আগুনে আপনি নিজেই পুরেছেন। আপনার সঙ্গতি নেই, আপনি দুর্বল। সমস্ত দায়ভার আপনাকেই বহন করতে হবে। আপনার হৃদয়ে ভাঙ্গাচুরা যাই হোক তাতে কারো কিছু আসে যায়না, আপনার বাবা মারও না। আপনার সন্তানেরা গোল্লায় যাক তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তারা তাদের অহংকার, জেদ আর তাদের চির চেনার কালো চশমা পরে বসে আছে এবং থাকবে। তারা এক জায়গায় এসে থেমে গেছে। সেখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসা কঠিন, তা তারা চাইবেও না। তারা চাইবে আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে কিন্তু আপনি তা পারবেন না। এখন কি হবে? সংঘাত আরও জোরদার হবে যার পরিণতি ভয়াবহ। এখন আপনি যা করছেন এটা কিন্তু এই সংঘাতের জের। আপনি কষ্ট পাচ্ছেন, আপনার স্ত্রী কষ্ট পাচ্ছে, সে আপনার ভালোবাসা পাচ্ছেনা আপনাকেও তার ভালোবাসা দিতে পারছেনা। আপনার সন্তানেরা কষ্ট পাচ্ছে, তারা বাবার আদর সোহাগ শাসন সব কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাতে কার কি হচ্ছে? এই বিশাল পৃথিবীর কে কার কি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সে খবর কে রাখে? আপনার নিজের আপন জনেরাই যখন তা দেখছে না আর কে দেখবে?

-আচ্ছা, তুমি যে বললে নেপালে থাকতে ড্রিঙ্ক করতে না তো এখন কর কেন? কি এমন প্রয়োজন?
-বুঝেন না? এটা হলো এদেশের পরিবেশ। পাবে না গেলে মেয়ে বন্ধু পাওয়া যায়না আর ড্রিঙ্ক না করলে পাবে গেলে কেমন দেখায়? এদিকে আবার মেয়ে বন্ধু না থাকলে মানুষে অন্যরকম ভাবে। কিছুদিন থাকেন এদেশে বুঝতে পারবেন। এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কিভাবে বোঝাব আপনি আমার বাবার বয়সী কাজেই বাদ দেন এসব। চা খাবেন? চলেন আর একটু চা নিয়ে আসি।
-হ্যাঁ।
-তাহলে চলেন নীচে যাই।
সুইট্যাক্সের টিউবটা নিয়ে রাশেদ সাহেব বললেন-
-চলো। হ্যাঁ প্রবীণ, তুমি যা বললে এতক্ষণ সে সব কথাই সঠিক।
কথা বলতে বলতে নিচে নেমে আসছিলো। দোতলায় পৌঁছেই নুরুল ইসলামের সাথে দেখা।
-কি খবর ভাই সাব নতুন দোস্ত পাইছেন?
-না নতুন আর কি, আপনি চলে গেলেন।
-কোথায় যান, নিচে?
-হ্যাঁ একটু চা খেতে চাই আপনি খাবেন চলেন একসাথে খাই।
-না আপনারা খান।
নিচে এসে ইলেকট্রিক জগে পানি গরম দিল প্রবীণ। রাশেদ সাহেব দুইটা কাপ আর চা পাতা বের করে ওপাশের ফ্রিজ থেকে দুধের কন্টেইনার বের করে এনে টেবিলের উপরে রেখে আবার শুরু করলেন।
-হ্যাঁ প্রবীণ দেখ আমি তোমার কথার সাথে একমত। এই যে আমরা সিনেমা নাটক কিংবা উপন্যাসে দেখি নায়ক নায়িকার সমস্যা যেভাবে সমাধান হয় বাস্তবে যদি সেভাবে হোত তাহলে কিন্তু আমাদের জীবন অন্যরকম হোত।
-হ্যাঁ সেতো ঠিকই।
-কারণ এইসব ঘটনা লেখক বা পরিচালক কিংবা প্রযোজক এরা যেভাবে চায় সেই ভাবে হয় এবং তারা এই সব সমস্যার সমাধান আগে থেকে বের করে পরে সমস্যা তৈরি করে, কিন্তু আমাদের জীবন এদের দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় না। আমাদের জীবনের লেখক বা পরিচালক তো ভিন্ন। সে যে ভাবে চায় আমাদের তাই হয়। সিনেমার চরিত্রের সংলাপ গুলি কেমন হবে লেখক দীর্ঘ দিন সে কথা ভাবে। সে ভাবার সুযোগ পায়। ভেবে ভেবে সে এগুলি সাজিয়ে নেয় যার জন্যে আমরা মনে করি বাহ! সুন্দর কথা বলেছে! কিন্তু বাস্তবে কি আমরা সেরকম সুযোগ বা সময় পাই? সেখানে আমরা পাই সামান্য কয়েক মুহূর্ত। তারপরে দেখ সিনেমাতে চরিত্রগুলি যে ধরনের সমস্যায় পড়ে সেগুলিও সেই ভাবেই সমাধান হয়। হয়তো দেখা যাবে নায়কের চাকরি চলে গিয়েছিলো কিছুদিন পরে আবার সে একটা ভালো চাকরি পেয়ে যায়। নয়তো বস তার ভুল বুঝতে পেরে তাকে আবার পুনর্বহাল করে নেয়। নয়ত সে একটা লটারি পেয়ে যায়। নয়তো কোথাও থেকে একটা সুযোগ পেয়ে যায়, বাস্তব কি এমন হয়? বাস্তবে আমাদের নিয়তি যেমন করে সাজিয়ে রেখেছেন তেমনটাই হয়।
-হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। দেখেন এই যে আপনার জীবনে যা ঘটেছে সেটা যদি উপন্যাস হোত তাহলে আপনি যা ভাবছেন তাই হোত।
-মানে?
-মানে বুঝলেন না, হ্যাঁ আমি বলছি যে এখন আপনি সমস্যায় পরে আপনার স্ত্রী সন্তান সংসার ছেড়ে নিজের দেশ ছেড়ে এখানে এসেছেন। এখানে আসার আগে কি আপনি কম চেষ্টা করেছেন টিকে থাকার জন্যে? হয়তো আপনার বাবা কিংবা ভাই নয়তো অন্য কোন আত্মীয়ের কাছে সাহায্য চেয়েছেন কিন্তু পাননি। সিনেমা হলে এমন হোত না, কোন না কোন ভাবে কেও না কেও আপনাকে সাহায্যের হাত বারিয়ে দিত। হয়তো বা কোন শর্ত থাকতে পারতো। তবে যাই হোক আপনার কাজ চলে যেত। ঠিক এরকমই আপনি ভাবছিলেন কিন্তু তা পাননি। ফলে একান্ত নিরুপায় হয়ে এখানে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এখানে আপনি কত দিন থাকবেন বা থাকতে হবে তার কোন সীমানা আপনার জানা নেই। এর ফল কি হবে? আপনার সন্তানেরা ঠিক ভাবে আপনার আদর্শ মত বড় হবে না, এর থেকে বঞ্চিত হতে থাকবে। আপনার আর তাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাবে যা আপনি ধরে রাখতে পারবেন না। নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তারা আপনার সম্পূর্ণ স্নেহ মমতা পাবে না। আপনার কাছে আবদার আহ্লাদ করতে পাবে না আপনার হাতের স্পর্শ পাবেনা। সারা জীবনে তাদের মনে একটা অতৃপ্তি, একটা অভাব থেকেই যাবে যা কেওই আর কোন দিন পূরণ করতে পারবে না। ঠিক এর বিপরীতে আপনিও তাদের এভাবে পাবেন না। আপনার মনেও একটা হাহাকার থেকে যাবে যা আর কোন অবস্থায় ফিরে পাবেন না। যেমন আপনি এইযে এখন চা খেতে এখানে এসেছেন, এখন যদি আপনার সন্তানেরা বা ভাবীজী থাকতো তাহলে কি আপনি এখানে এসে চা বানাতেন? না তা বানাতে হোত না। নেক্সট ফেস্টিভ্যালের সময় কি আপনার সন্তানেরা আপনাকে বলবে পিতাজী আমাকে এইরকম ড্রেস বানিয়ে দিতে হবে? আপনি কি তাদের সাথে নিয়ে ফেস্টিভ্যাল শপিং করতে যেতে পারবেন? পারবেন না। ফেস্টিভ্যালের সময় আপন জনের হাতে তার পছন্দের জিনিষ তুলে দেবার পর তার হাসিমুখ দেখে যে আনন্দ হয় সেটা আপনি পাবেন না। আপনি নিজে এবং আপনার স্ত্রী একটা হতাশা আর অস্থিরতায় ভুগতে থাকবেন। আপনারা উভয়েই উভয়ের অভাব ফিল করবেন। কোন কিছু ভালো লাগবে না। নিজেকে একটা মেশিনের মত মনে হবে, সব কিছু অসহ্য মনে হবে। এখানে কাজে মন বসাতে পারবেন না, মনের মধ্যে একটা ছটফট ভাব অনুভব করবেন, কোথাও স্থির হতে পারবেন না। আমিতো ছোট মানুষ যখন যেখানে খুশী চলে যেতে পারি এখানে ভালো লাগে না চলে গেলাম অন্য কোথাও। অফের দিনে পাবে যাই ড্রিঙ্ক করি নাচি গাই হৈচৈ করি ভুলে থাকার চেষ্টা করি। না পারলেও অভিনয় করি, না আমি ভালো আছি কিন্তু আপনি আমার মত এখান থেকে ওখানে যেতে পারবেন না। পাবেও যেতে পারবেন না। কি ভয়ানক কষ্ট ভেবেছেন? যত দিন থাকবেন এই কষ্ট, যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হবে। কাউকে মন খুলে কিছু বলে হালকা হতে পারবেন না, নিজেও সইতে পারবেন না। কারণ এখানে আপনার মাপের মনের মত মানুষ পাবেন না যার সাথে মন খুলে কথা বলতে পারবেন। ভুল বললাম কিছু?

-না ঠিক বলেছ, তবে তোমার আবার কিসের কষ্ট তোমার ছেলে মেয়ে নেই তাদের উপর কোন দায় দায়িত্বও নেই, কোন দেনাও নেই, তাহলে?
-আছে আছে, সবার দায় কি এক রকম? একেক জনের একেক রকম।
-সেটা কি রকম বলা যাবে আমাকে? তবে তুমি বলতে না চাইলে শুনতে চাই না।
-বলা যাবে তবে চলেন উপরে যাই,
-হাতের খালি কাপটা ধুয়ে রেখে বললো চলেন রাত অনেক হয়েছে শুয়ে পরি। কাল আবার কথা হবে,
-হ্যাঁ চলো।

নক্ষত্রে গোধূলি-৬৪/২৫০

৮৫।
কাজের শেষে উপরে এসে দেখে প্রবীণ বসে সিগারেট টানছে। নেপালি বলে ওরা কেও যেমন একে কাছে টানে না তেমনি এও ওদের সাথে তেমন মিশতে চায় না। কাজের শেষে কখনও নিচে যায় শুধু টিভি দেখার জন্যে। কিছুক্ষণের জন্যে যায়, খবর দেখেই চলে আসে।
-আরে ভাইয়া আইয়ে আইয়ে বলিয়ে কিয়া খবর হ্যায়, আমিতো আপনার জন্যে বসে আছি নিচে যাচ্ছি না। ভাইয়া লন্ডন থেকে কি খবর নিয়ে এলো তাই জানার জন্যে বসে আছি। রাশেদ সাহেব সব কিছু খুলে বললেন।
-বাহ! বহুত আচ্ছা হুয়া ঠিক কাম কিয়া। আমিও নোটিশ দিয়েছি থাকব না এখানে।
-কেন তুমি কেন থাকবে না?
-না আমারও ভালো লাগছে না, জায়গাটা খুবই নীরব। তাছাড়া এখানকার মানুষ গুলিও কেমন যেন কথা বলতে চায় না, আশেপাশে একটা পাবও নেই।
-কেন ওইতো পাব, আর ওদিকে রাস্তার মোড়েও আছে দুইটা।
-আরে না না এগুলি কি পাব? জানেন, একটাতেও ডান্স হয়না। ডান্স না হলে কি পাব হয়? এর চেয়ে একটু বড় শহরে থাকে ওইসব পাবে ডান্স করা যায়। ডান্সের জন্যে বারের পাশে আলাদা ফ্লোর থাকে। এরকম ছোট শহরেও থাকে কোথাও, কিন্তু এখানে নেই। এছাড়া আরও আছে যেখানে টিকেট করে ঢুকতে হয়। আবার কোথাও আছে যেখানে আপনাকে আগে থেকে মেম্বার হতে হবে। মেম্বার কার্ড ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিবে না। আমি সব অফ ডেতে পাবে যাই। ড্রিঙ্ক করি ডান্স করি কিন্তু এখানে একদিনও যাইনি। না ভুল হলো, একদিন গিয়েছিলাম শুধু তিন পাইন্ট বিয়ার খেয়ে চলে এসেছি। ডান্স নেই কে যায় এখানে? এই পাব বুড়োদের জন্যে। বড় বড় পাবে দেখবেন গেটে দুই তিন জন বাউন্সার থাকে। কেও যদি বেশি গিলে মাতলামি করে তখন বাউন্সারেরা ধরে বের করে দেয়।
-মাতলামি করে কেও?
-কি যে বলেন! মাতলামি মানে যা করে না দেখলে বুঝবেন না। টানাটানি মারামারি থেকে শুরু করে ভাঙ্গাচুরা সবই হয়। তখন বাউন্সারে কুলায় না রীতিমত পুলিশ ডাকতে হয়। আপনিও চলে যাচ্ছেন আমিও চলে যাচ্ছি নয়তো আপনাকে একদিন অক্সফোর্ড নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনতাম তখন বুঝতেন।
-হ্যাঁ এতক্ষণে বুঝলাম কেন থাকবে না, কাজ পাবে?
-আরে, কি বলেন ভাইয়া, কত কাজ! জানেন এদেশে এই রকম পনের থেকে বিশ হাজার রেস্টুরেন্ট আছে। তার মধ্যে থেকে লন্ডন সিটিতে অথবা আশেপাশে যে কোন একটায় কাজ পেয়ে যাব। হয়তো দুই একদিন বসে থাকতে হবে। আমার জন্যে ভাববেন না। আমি কোথাও স্থির হতে পারি না, কোথাও দুই তিন মাসের বেশি থাকতে পারি না। তবে ভাইয়া আমি যেখানেই যাই আপনার কথা আমার মনে থাকবে। আপনি ফোন নেননি তাহলে নম্বর নিয়ে আপনার সাথে যোগাযোগ রাখতাম। আচ্ছা আচ্ছা এক কাজ করেন আমার নম্বর রাখেন যোগাযোগ রাখবেন।
-হ্যাঁ প্রবীণ তোমার কথাও আমার মনে থাকবে অন্তত যতদিন এদেশে থাকবো তত দিনতো মনে থাকবেই।
-প্রবীণ উঠে এসে বললো দেন আপনার নোট বইটা দেন।
-নোট বই মানে?
-মানে ঐ যে আপনি যে কাল রঙের ছোট্ট বই দেখে ফোন করেন যার মধ্যে সব কিছু লেখা। আমি দেখেছি, ওটা দেন।
পকেট থেকে ঠিকানা আর ফোন নম্বরের ছোট্ট বইটা এগিয়ে দিল। প্রবীণ তার নিজের ফোন নম্বর সহ নেপালের কাঠমুন্ডুর বাড়ির ঠিকানা ফোন নম্বর সব লিখে বইটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো –
-আমি আশা করি অতি অল্প দিনেই আপনার সব সমস্যার সমাধান হলে দেশে ফিরে যাবেন। সেখান থেকে একবার ভাবীজীকে সাথে নিয়ে নেপালে আমার বাড়ি যাবেন। আশা করি তত দিনে আমিও দেশে ফিরে যাব। আবার দেখা হবে আমাদের, সবারই ভালো লাগবে। আপনাকে কাঠমুন্ডুর বিখ্যাত তাতো পানি নিয়ে যাব সেখানে মাটির নিচে থেকে গরম পানি বের হয়, সেখান থেকে চিন দেখা যায়, দেখবেন। এখানে যে যন্ত্রণা সহ্য করছেন দেশে ফিরে ভাবীজীকে সাথে নিয়ে কিছুদিন দূরে কোথাও বেড়ালে সেটা ভুলে যাবেন। আপনার কাল রাত্রি শেষ হয়ে আবার নতুন করে সানরাইজ হবে আপনি আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করবেন, আমার বাবা যেমন করেছিলো। এখান থেকে ফিরে আমার মাকে নিয়ে আপনাদের কক্সবাজার গিয়েছিলো। আমরা তখন ছোট, তবুও আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমরা দাদার কাছে ছিলাম।

নক্ষত্রে গোধূলি-৬৩/২৫০

৮৩।
পরের অফ ডেতে সকালে উঠে নাস্তা সেরে দেরি না করে বেরিয়ে পরলেন অক্সফোর্ডের উদ্দেশ্যে। চেনা পথ, সেদিন যেখান থেকে গিয়েছিলেন সেই ভাবে এসে অক্সফোর্ড থেকে লন্ডনের রিটার্ন টিকেট কিনলেন। ফিরবেন আগামীকাল। গত সপ্তাহে ফিরোজের সাথে কথা হয়েছে। ও বলেছে সরাসরি ব্রিকলেন যেতে। ওখান থেকে কাজ সেরে তারপর বাসায় আসবে। রাতে ওখানে থাকবে পরদিন সকালে অক্সফোর্ড চলে আসবেন।
বেকার স্ট্রিটে নেমে গেলেন কোচ থেকে। টিউব স্টেশন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কূল কিনারা না পেয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলে সে দেখিয়ে দিল। ঐ যে সামনে দেখা যাচ্ছে, ডানদিকে রাস্তার ওই পাশে। টিউব স্টেশনে পৌঁছে প্রথমে একটা ম্যাপ নিয়ে দেখে নিলেন ব্রিকলেন যেতে হলে এখান থেকে হ্যামারস্মিথ লাইন ধরে অল্ডগেট ইস্টে নামলেই হবে। হিসেব করে জোন এক এবং দুই এর একটা ডে টিকেট নিয়ে নিলেন।
ব্রিকলেন পৌঁছেই সোজা চলে গেলেন চেনা সেই জব সেন্টারের কাছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন আরও কয়েকটা জব সেন্টার আছে। তার কাছে সবই সমান। এর আগে যেটায় গিয়েছিলেন সেখানে গেলেন না। অন্য আর একটায় ঢুকলেন। সামনে কয়েকজন দাঁড়ানো। একটু পরেই টেবিলে বসে যে এতক্ষণ অন্যদের সাথে কথা বলছিলো, সে এবারে তাকে বললো-
-বলেন ভাই কি করতে পারি।
-একটা কাজ দরকার।
-সামনে না পিছনে?
-সামনে।
-আগে করেছেন কখনো?
একটু থতমত খেয়ে গেলেন হঠাৎ করে ডাহা একটা মিথ্যা মুখ দিয়ে বের হতে চাইল না। জীবনে যা কখনও করেননি যা তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করেন আজ তাই বলতে হবে। সারা জীবন ভরে ন্যায় নীতির বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়িয়েছেন। মিথ্যাই যদি বলতে হবে তাহলে এদেশে কেন এলাম? নিজের দেশে যেখানে ছিলাম সেখানে প্রমোশন হোত, বেতনের বাইরেও বেশ কিছু পেতে পারতাম। না, যা চাওয়া যায় তা পাওয়া যায় না। সবাই যেভাবে চলতে চায় সেভাবে চলতে পারে না। এজন্যে চেষ্টার সাথে আরও কিছু প্রয়োজন আর সম্ভবত তা হচ্ছে সাহস, এমন সাহস রাশেদ সাহেবের নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্রবীণের কথা মনে পরে গেলো। মিথ্যা কথা চকচকে হয় তাই সবাই পছন্দ করে। হ্যাঁ, সে তো একথা মেনে নিয়েই এসেছে। মিথ্যা কথা বলবে।
এখন দ্বিধা করার কি দরকার?
-হ্যাঁ করেছি দুই মাস।
-আচ্ছা একটু বসেন।
আশে পাশে দেখলেন বসার কোন জায়গা নেই, একটু সরে দাঁড়ালেন। এবারে অন্যদের কথাবার্তা শুনতে লাগলেন কে কিভাবে কি বলছে। তিন চার জনের সাথে আলাপ সেরে টেবিলের ওপাশে বসা লোকটা এবারে টেলিফোন ধরে কার সাথে যেন আলাপ শুরু করলো। মাঝে মাঝে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে। এবারে তাকেই উদ্দেশ্য করে বললো-
-এই যে ভাই স্কটল্যান্ডে যাবেন?
রাশেদ সাহেব বুঝতে পারলেন না। পাশে দাঁড়ানো এক জন জিজ্ঞেস করলেন আপনার ফ্যামিলি কি এখানে, মানে লন্ডনে?
-না এখানে আমার কেও নেই।
-তাহলে আপনার জন্য কাছে আর দূরের মধ্যে কোন তফাত নেই রাজী হয়ে যান, ওখানে ভালো পয়সা দেয় তবে শীত বেশী।
টেবিলের ওপাশের লোক আবার বললেন -কি বলেন ভাই, যাবেন?
-হ্যাঁ যেতে পারি।
-তাহলে এই যে নেন মালিকের সাথে কথা বলেন।
টেলিফোনের রিসিভার এগিয়ে দিল।
-হ্যালো,
ওপাশ থেকে প্রশ্ন, -আপনি কতদিন এই কাজ করেছেন?
-বেশি দিন না মাত্র দুই মাস।
-আচ্ছা, কবে আসতে পারবেন?
-আমি অক্সফোর্ডে এক জায়গায় কাজ করছি তাদেরকে তো এক সপ্তাহ সময় দিতে হবে, আগামী মঙ্গল বারের আগে পারা যাবে না।
-আচ্ছা ঠিক আছে আপনি মঙ্গলবারেই আসেন।
-ঠিক আছে আসতে পারব।
এমন সময় টেবিলের ওপাশের লোকটা বলে দিল বেতনের কথা জিজ্ঞেস করেন।
-আচ্ছা বেতনের ব্যাপারটা বলা যাবে?
-হ্যাঁ, দেখেন আপনি নতুন মানুষই বলা যায়, কাজেই আমি একশ চল্লিশ পাউন্ডের বেশি দিতে পারব না আপাতত।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-তাহলে এই কথাই রইলো আগামী মঙ্গল বারে আসবেন।
-হ্যাঁ ঠিক আছে, তবে কি ভাবে যাবো ওখানে?
-ভিক্টোরিয়া থেকে ওবান এর টিকেট করবেন। দশ বারো ঘণ্টা লাগবে। সন্ধ্যায় যাত্রা করলে সকালে এসে পৌঁছবেন। এখানে এসে ফোন দিবেন। ঠিকানা ফোন নম্বর সামাদ ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে নিবেন, আচ্ছা সামাদ ভাইকে দেন একটু আমি বলে দেই।
-এই যে নেন
বলে রিসিভারটা লোকটার হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সামাদ ভাই কথা শেষ করে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো-
-এই যে ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে নেন।
এক টুকরো কাগজ আর কলম এগিয়ে দিল। ওগুলি লেখা হলে বললো দেন বিশ পাউন্ড দেন। রাশেদ সাহেব ঠিকানা লেখা কাগজ পকেটে রেখে ওয়ালেট বের করে দশ পাউন্ডের দুইটা নোট বের করে এগিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলেন। বাইরে এসে মনে হলো মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছেন। একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললেন। দেলু মিয়ার গালাগালির হাত থেকে মনে হচ্ছে এবারে রেহাই পাবেন। কোন রকমে এই কয়টা দিন কাটাতে পারলেই হলো। হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে অফিসের নিচে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট বানিয়ে আরাম করে টানলেন। তারপরেও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলেন। মুক্তির আনন্দে যেন শীত লাগছে না তবে মনে হচ্ছে ক্ষুধা লেগেছে। হা্তের ঘড়ি দেখে ভাবল ক্ষুধা লাগবেই অন্ধকার হয়ে গেছে, চারটা বাজে। এতক্ষণ নিষ্কৃতির একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি। কি খাবো, কি পাওয়া যায় এখানে? এইবার দেখতে পেলেন আশেপাশে অনেক রেস্তোরা আর ফাস্টফুডের দোকান। আগেও ছিলো তখন চোখে পড়েনি। মেইন রোডের দিকে এগিয়ে গেলেন। এবারে হাতের ডানে একটা ফাস্টফুডের দোকানের সামনে এসে একটা চিকেন এন্ড চিপস আর এক ক্যান ডায়েট কোক নিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে আরাম করে নিশ্চিন্তায় আস্তে আস্তে খেলেন। কোন তারা হুড়ো নেই। খেতে খেতে মনে হলো বাসায় যাবার আগে ফিরোজকে একটা ফোন করে যাই যদি আরও কিছু করতে বলে। খাওয়া শেষ হলো। কোকের ক্যানে শেষ চুমুক দিয়ে বিনে ফেলে দিয়ে আবার একটা সিগারেট বানালেন। রাস্তার পাশে একটা ভাঙ্গা বেঞ্চের পাশে বসলেন। মনের আনন্দে অনেকক্ষণ ভরে সিগারেট টানলেন।

৮৪।
এদেশের প্রথম কর্মজীবনে রেস্টুরেন্টের বিভীষিকাময় দিন গুলো থেকে মুক্তির উল্লাস। প্রাচীন যুগের ক্রীতদাসদের কথা মনে হলো। অনেক দূরে চলে গেলেন, অনেক দূরে! ক্রমে মনটা আনন্দ থেকে আবার বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। ওহ! ফোন করা হয়নি এখনও। উঠে ফোন বুথ খুঁজে পেলেন।
-হ্যালো,
-ভাবী, আমি এখন ব্রিকলেনে একটু পরেই আসছি। ফিরোজ কোথায়?
-এইতো, বাসায় আছে দিচ্ছি, আপনি চলে আসেন তাড়াতাড়ি।
-হ্যাঁ ফিরোজ, তোমার কথা মত আজ সকালে এসেছি।
-কাজ পেয়েছ?
-হ্যাঁ।
-কোথায়?
-স্কটল্যান্ডে।
-বেশ ভালো, তুমি কোথায় এখন?
-ব্রিকলেনেই আছি।
-চলে আস।
-আসছিলাম, হঠাৎ মনে হলো তুমি যদি আর কিছু করতে বল তাই জানার জন্যে ফোন করে নিলাম।
-না আর কিছু করতে হবে না, তুমি চলে আস আমি বাসায় আছি।
বাসায় আসতে আসতে মনে হলো রাত গভীর হয়ে গেছে অথচ রাত এখন মাত্র ছয়টা। প্রচণ্ড শীত। ফিরোজ বসেই ছিলো, সব কিছু শুনে বললো –
-তুমি আজ এখনই ফোন করে নোটিস দিয়ে দাও।
-হ্যালো, ওসমান ভাই, আমি রাশেদ বলছি।
-হ্যাঁ ভাই, বলেন কি খবর?
-ভাই আমি আগামী রবিবারের পর আর কাজ করব না আপনারা মানুষ দেখেন।
-কেন কি ব্যাপার, কি হয়েছে?
-না কিছু হয়নি এমনিই আমার ভালো লাগছে না তাই।
-আপনি কবে আসবেন?
-কাল বিকেলে।
-ঠিক আছে আসেন তারপর দেখা যাবে।
-তাহলে তুমি সামনের সোম বারে আসছ?
-হ্যাঁ, তাই আসছি তবে ঐ দিনেই আমাকে রওয়ানা হতে হবে।
-হ্যাঁ তাই কর।

রেস্টুরেন্টে ফিরে এসে সন্ধ্যায় যথারীতি কাজের জন্যে নিচে নেমে এলেন। হাতের কাজ গুছিয়ে নেবার আগেই লন্ডন থেকে সেফ এসে কিচেনে ঢুকেই সরাসরি রাশেদ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-কি ব্যাপার বেয়াই, আপনে নাকি চলে যাবেন?
-হ্যাঁ ভাই।
-কেন কি হয়েছে, আমরা কি করেছি, কেন যাবেন?
-না কিছুই হয়নি এমনিই আমার ভালো লাগছে না তাই, অন্য কিছু না।
-না আপনাকে তো আমরা যেতে দিব না, কেন যাবেন, সামনে কাজ করবেন, কিচেনে কষ্ট হচ্ছে? তাহলে বলেন কাল থেকেই আপনাকে সামনে পাঠিয়ে দিব।
এমন সময় আনোয়ার এসে হাজির।
-কি ব্যাপার কি হয়েছে?
-আরে দেখেন না বেয়াই সাহেব থাকবে না চলে যাবে।
-কেন, কি ব্যাপার ভাইসাব কি হইছে যাইবেন কেন?
-না ভাই তেমন কিছু না উনাকে বলেছি আমার ভালো লাগছে না তাই।
-আরে না, বললেই হইলো আপনাকে ছাড়া হবেনা, কি ভাবে যাইবেন?
-না ভাই একথা বলবেন না, আমি কাজ কর্ম পারছি না। আমারও কষ্ট হচ্ছে আপনাদেরও অসুবিধা হচ্ছে। আমি চলে গেলে ভালো লোক পাবেন।
-না তা হবে না, আমাদের তো ভালো লোকের দরকার নেই, আমাদের চাই আপনাকে।
-না ভাই আমি পারছি না।
-তাইলে যাইবেনই?
-জি ভাই।
-কবে যাইবেন?
-এইতো সামনের রবিবার পর্যন্ত আছি।
-আচ্ছা, এর মধ্যে দেখেন যদি মনের পরিবর্তন করতে পারেন তাইলে এইখানেই থাইকেন, আসলে আপনারে আমাদের ভালো লাগছে তাই ছাড়তে চাইনা।
রাশেদ সাহেব মনে মনে ভাবলেন এই কথাটা আগে থেকে ভাবলেই হোত। তাহলে এত গালাগালি কেন? এখন আর সম্ভব নয়, আমি যে ওখানে কথা দিয়েছি ওই লোক অপেক্ষা করবে।

নক্ষত্রে গোধূলি-৬২/২৫০

৮২।
এর মধ্যে আসাদ সাহেব চলে গেছে। তার জায়গায় প্রবীণ নামে নেপালি এক ছেলে এসেছে। প্রবীণ আসাতে নুরুল ইসলাম নিচের রুমে চলে গেছে। এখন তার রুম মেট প্রবীণ। অল্প বয়সের ছেলে। লেখাপড়ার নাম করে এদেশে এসেছে কিন্তু কলেজে নাম লিখিয়ে রেখে কাজ করে যাচ্ছে দুই বছর ধরে। মাসে একবার যেয়ে কলেজে হাজিরা দিয়ে আসে। রাশেদ সাহেবের সাথে বেশ আলাপ জমে উঠেছে। কখনো মন খারাপ দেখলেই এগিয়ে আসে, হিন্দিতে কথা বলে।
-ভাইয়া আপনি প্রায় আমার বাবার বয়সের, আপনি এই বয়সে এখানে কেন এসেছেন তা আমি বুঝি। আমার বাবার ব্যবসা যখন খারাপ যাচ্ছিল তখন সেও এখানে এসেছিলো, কয়েক বছর থেকে গেছে। তখন নেপালিদের এখানে আসতে ভিসার প্রয়োজন হোত না। যাই হোক এখন কাঠমুন্ডুতে কাঠের আড়ত করেছে,
স মিল সহ ভালই চলছে। আপনি বেশি চিন্তা করবেন না, চিন্তা করলে শুধু মন খারাপ থাকবে, কাজে মন বসাতে পারবেন না। আর কোন লাভ হবে না। তার চেয়ে হাসি খুশি থাকেন, মন ভালো রাখেন, সুস্থ ভাবে কাজ করেন। আমি আপনাকে বলে দিব কিভাবে কাজ সহজে করতে হয়। আমিও কিচেনে কাজ করেছি প্রথম দিকে। কিচেনে কাজ কষ্টের কাজ, সবচেয়ে ভাল হয় আপনি যদি সামনের কাজ করেন। মাঝে মাঝে সামনে আসবেন, আমি আপনাকে সামনের কাজের কিছু ধারনা দিয়ে দিব শিখে নিবেন। জব সেন্টারে গিয়ে বলবেন আমি সামনের কাজ করি, দুই এক মাস করেছি। ওখানে থাকার সমস্যা তাই অন্য কাজ খুঁজছি। এদেশে মিথ্যা না বললে চলে না, সবাই মিথ্যা পছন্দ করে কারণ মিথ্যা চকচকে হয়। আর সত্য মিথ্যার মত চকচকে হয়না তাই কেও পছন্দ করে না। আপনি যত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারবেন তত আকর্ষণীয় হবেন। এক সপ্তাহ আমার কাছে দেখেন, তারপর নেক্সট অফ ডেতে লন্ডন গিয়ে জব সেন্টারে সামনের কাজ খুঁজেন ভাল হবে। আপনাকে দেখেই বুঝেছি আপনি এই ধরনের কাজে অভ্যস্ত নন। আপনি কোন বড় ধরনের কাজ করতেন। আপনার চশমা দেখেই বুঝেছি সাধারণ লোকেরা এতো দামি চশমা ব্যাবহার করে না। সেদিন সেফ আর ওসমান আপনার ব্যাপারে আলাপ করছিলো। বলছিলো এই লোকের চশমার দাম বাংলাদেশে দশ হাজার টাকা হবে, এই লোক নিজের পরিচয় গোপন করছে। আমি তখন বারে কাজ করছিলাম ওরা মনে করেছিল আমি বাংলা বুঝি না কিন্তু আমি বংলা বলতে না পারলেও বুঝি। আসলে আমি গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে কাজ করছি। কোথাও কিন্তু আপনার মত কাওকে পাইনি। আপনার কথাবার্তা আচার ব্যাবহার সবই অন্যদের চেয়ে আলাদা, সত্যি করে বলেনতো আপনি কি করতেন ওখানে?

-তা শুনে আর কি করবে ভাই। আচ্ছা দেখি তুমি আমাকে কিছু শিখিয়ে দাও, আমি তোমার কথা মতই করব আমার বন্ধুও তাই বলেছে। আমি কোন কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না তাই কিছু করতে পারছি না। তুমি যখন বলছ একটা পথ পাবো বলে মনে হচ্ছে। নেক্সট উইকে লন্ডন যাব। আচ্ছা মনে কর কাজ পেলাম, তারপর কি করবো? মানে, এখান থেকে ছুটবো কি ভাবে?
-সেজন্যে ভাববেন না, সেটা আমি বলে দিব কি করতে হবে। আপনি আগে কাজ নিয়ে আসেন তখন দেখব।
-নাও একটু তামাক নাও।
-বানিয়ে দেন আমিতো পারিনা।
সত্যি সত্যি এর পরদিন থেকেই প্রবীণের কাছে তালিম নেয়া শুরু করলেন রাশেদ সাহেব। কয়েক দিনের মধ্যে বেশ যত্ন করেই প্রবীণ তাকে খুঁটিনাটি সহ মোটামুটি একটা তালিম দিয়ে দিল। সাথে বলে দিল-
-যা শিখিয়ে দিলাম আপনি যদি মনে রাখতে পারেন কেও বুঝতে পারবে না যে আপনি কখনো সামনে কাজ করেননি। শুধু মনে সাহস রাখবেন অসুবিধে নেই। আপনি ইংলিশ জানেন আপনার ইংলিশ ভালোই আমি লক্ষ করেছি, আর কি? বেতনের জন্যে ভাববেন না এখানে যা পাচ্ছেন ওখানেও তাই পাবেন।

নক্ষত্রে গোধূলি-৬১/২৫০

৮১।
এর মধ্যে তিন দিন অফ গেছে। অপেক্ষায় থেকেছে পরবর্তী অফের দিন মেইল পাবে। তার নয়ন মনিরা সবাই চিঠি লিখবে, তার মনি লিখবে। প্রতি অফের দিনে সাত দিনের প্রতীক্ষিত মেইলের আশায় লাইবেরিতে গেছে। বাড়ি থেকে পাঠানো মেইল মন দিয়ে পড়েছ। এক বার, দুই বার, কয়েক বার পরেছে। মনে হয়েছে কতদিন মনির চিঠি পড়া হয়নি। সেই যে বিয়ের পর মনিকে রেখে বিদেশে চলে গিয়েছিলো তখন। তা প্রায় পঁচিশ বছর তো হবেই। সেই দিনগুলির কথা মনে পরে। মনির চিঠি পেলে কেমন যেন হয়ে যেত। কতবার করে যে পড়েছে প্রতিটা চিঠি। পড়তে পড়তে প্রতিটা অক্ষর তার মুখস্থ হয়ে যেত। তাকে লেখা মনির প্রথম চিঠির কথা স্পষ্ট মনে আছে। তাকে সম্বোধন করতে গিয়ে কয়েকবার কেটে শেষ পর্যন্ত লিখেছিলো। তার মনের মত একটা সম্বোধন লিখেছিলো, এখনও মনে পড়ে। মনি লিখত খুব সুন্দর করে, গুছিয়ে অনেক কিছু লিখত। অনেক বড় হোত চিঠি গুলি। সে নিজেও লিখত। তার লেখা দীর্ঘ চিঠি হয়েছিলো একুশ পাতা। মনির ছোঁয়া বয়ে নিয়ে এসেছে যে চিঠি তা সে ফেলতে পারত না, মনির হাতের গন্ধ মাখা ছোঁয়া পাবার জন্য বালিশের পাশে রাখতো। এখন ঘরে ঘরে ফোন, ইন্টারনেট, হাতে হাতে মোবাইল কত কি! তখন শুধু চিঠির অপেক্ষা। কি ভাবে যে দিন গুলি গেছে পরের চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত, সে যারা ভুক্ত ভুগি তারা ছাড়া কে বুঝবে?

মেয়ে আর মনির লেখা অনুরোধ উপদেশের ঝুড়ি খুলে দেখেছে। তার নিজের রোজ বিবরণী পাঠিয়েছে। কবে কি দিয়ে ভাত খেয়েছে, কি দেখেছে, এদেশের মানুষেরা কি ভাবে কথা বলে, থাকার জায়গা কেমন, কোথায় কি ভাবে কি করতে হয় সব কিছু খুলে লিখেছে। তবুও মনে হয়েছে মনি আর মেয়েদের হাজার প্রশ্নের জবাব দেয়া হলো না। ঘুরে ঘুরে লাইবেরি দেখেছে। এর মধ্যে লাইবেরির স্টাফদের সাথে খাতির হয়ে গেছে। এখন ফাঁকা থাকলে তাকে নির্দিষ্ট এক ঘণ্টা সময়ের চেয়ে বেশী সময় দেয়। একদিন কেও ছিলো না বলে তাকে দুই ঘণ্টা দিয়েছিলো। দুপুরে সময় মত এসে রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে গেছে। একদিন ভেবেছিলো অক্সফোর্ড যাবে। বিশ্বের সেরা ইউনিভার্সিটি দেখে আসবে। কিন্তু কে যেন বললো অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি নিজের গাড়ি ছাড়া দেখা কঠিন ব্যাপার, কারণ এটা এক জায়গায় না। এক ফ্যাকাল্টি থেকে অনেক দূরে অন্য ফ্যাকাল্টি। সারা অক্সফোর্ড জুড়ে এই ইউনিভার্সিটি। তাই এমনি এক জায়গায় গিয়ে কি দেখবেন? আর যাওয়া হয়নি। এই শহরেই ঘুরে ফিরে দেখেছে। ছোট্ট শহর, তেমন কিছু নেই কিছু দোকান পাট আর দুইটা ব্যাংক ছাড়া। সেদিন দুপুরে কাজ সেরে উপরে আসার সময় বাড়িতে ফোন করেছিলো। অস্থির মেয়েদের আর তাদের অস্থির মাকে নিশ্চিন্ত করার জন্য। অল্পই কথা হয়েছে। কেমন আছ, তোমাদের পরীক্ষা কেমন হয়েছে, আমি ভালো আছি, চিন্তা করবে না। আব্বু তুমি সময় মত খাবে, ঠাণ্ডা লাগাবে না, ওষুধ খাবে মনে করে, আমাদের জন্যে চিন্তা করবে না। এই ধরনের।

নক্ষত্রে গোধূলি-৬০/২৫০

৮০।
আজ শুক্রবার। বিকেলে রেস্টুরেন্ট খোলার পর থেকেই শুরু হলো সেফ এর চিৎকার চেঁচামেচি। রাশেদ সাহেব রীতিমত ভয় পেয়ে গেলেন, এ কয়দিন তবুও কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু আজ সবই কেন যেন ভুল হচ্ছে। এখানে ভুল ওখানে ভুল, আর সেই সুযোগে সেফ এর অশ্লীল গালাগালি। রাশেদ সাহেব অবাক, এই কি সেই লোক যাকে এ ক’দিন দেখেছে? কেমন যেন গুলিয়ে গেলো সব কিছু। দৌড়া দৌড়ী ছুটা ছুটিও বেশি হচ্ছে। রাত প্রায় দশটার দিকে আর পারছিলেন না। কি করবেন, কাকে বলবেন? আমি আর পারছি না। মারুফকে ডেকে বলবেন সে উপায় নেই, তার পাশেই সেফ। না, আর কুলাচ্ছে না। কবিরকে বললে কবির বললো –
-ভাই এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না মারুফকে বলেন।
-মারুফের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সেফ চ্যাঁচিয়ে বললো –
-কি, এখানে কি?
সাথে যোগ করলেন …………………বাংলা ভাষার অনুচ্চারণ যোগ্য অশ্লীল কিছু শব্দ যা শুধু এক শ্রেণীর লোকদের মুখেই শোনা যায়, কখনো কাগজে লেখা যায় না। রাশেদ সাহেব মারুফের কানে কানে বললেন ভাই আমি আর পারছি না।
মারুফ বললো –
-দেখেন, এখন কি ভাবে কি করা যাবে, এগুলি তো শেষ করতে হবে, এখন কাকে পাবো বলেন? আচ্ছা আমি কবিরকে বলছি সে আপনাকে সাহায্য করবে।

সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, ব্যথায় কোমর টনটন করছে, হাতের কাটা গুলিতে ভীষণ জ্বালা হচ্ছে, কিছু ধরতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। কি আর করবে, ওই ভাবেই বাকি কাজ শেষ করে রাত সাড়ে বারোটার কিছু পর উপরে গিয়ে কাপড় বদলেই শুয়ে পরলেন। তার পরের দিনও একই রকম ব্যস্ততা। আজ রবিবার, কাজের চাপ কম। রাতের কাজের শেষে সেফ বললো-
-বেয়াই কাল সোম বার আপনার অফ।

নক্ষত্রে গোধূলি-৫৯/২৫০

৭৮।
রাশেদ সাহেব উপরে এসে এবারে কাপর বদলিয়ে বিছানায় বসে একটা সিগারেট জ্বালালেন। আবার টেলিফোনের কথা মনে হলো। এখানে কাল ঈদ আমাদের দেশে পরশু ঈদ। মেয়েদের কথা মনে হলো। ভাগ্যের অন্বেষণে অনিশ্চয়তার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা বাবাকে ছাড়া কি ভাবে ওরা ঈদ করবে? ওরা বড় হয়েছে সবই বুঝে। ওদের মা কিভাবে ওদের নিয়ে বাড়ি ভরা আর সবার সাথে একটা বিরূপ পরিবেশে দিনটা কাটাবে? কেওতো ওদের মানসিক অবস্থা বুঝবে না, বুঝতে চাইবে না। ওদের মনে যে কি ঝড় বইবে তা কি কেও বোঝার চেষ্টা করবে? এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে একটা জটিল রকমের ছন্নছাড়া বিষণ্ণতায় ভরে উঠলো মন। ঘুমের কোন ভাব নেই চোখে মনে। আবার আর একটা সিগারেট বানালেন। বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পায়ের উপর লেপটা টেনে নিলেন, ঠাণ্ডা লাগছে একটু। কেন এমন হলো? গণ্ডগোলটা কোথায় খোঁজার চেষ্টা করছেন। ফেলে আসা জীবনসাগর মন্থন করেও কোন কূল কিনারা পেলেন না। বার বার মনে হচ্ছিল ভাই হয়তো বলেনি কাল লন্ডন যাবার পথে আপনাকে নিয়ে যাব। কিন্তু যাবার পথে সে ঠিকই আসবে, না এসে পারবেনা। সে এখানে থাকবে আর বিদেশে এই প্রথম ভাই একা ঈদ করবে, তাই কি হয়?

ছোট বেলায় স্কুল থেকে ফেরার পথে মায়ের দেয়া টিফিন বাবদ দুই পয়সা দিয়ে দুইটা কমলা কিনে একটা নিজে খেয়ে আর একটা পকেটে করে নিয়ে আসত। ছোট্ট পকেটের মধ্যে এতো বড় কমলা ধরত না, কোন রকমে ঠেলে একটুখানি ঢুকিয়ে এক হাতে বইয়ের ব্যাগ আর অন্য হাতে কমলা চেপে ধরে রাখতে হোত। বাগানে ঘেরা ঝোপের আড়াল থেকে গেট দিয়ে ঢুকেই দেখত ছোট ভাই দরজার সামনে ঘরে উঠার সিঁড়িতে বসে আছে। তার হাতে কমলাটা দিতেই কি যে খুশী! মনে হোত পূর্ণিমার সমস্ত জ্যোৎস্না যেন তার মুখে এসে পড়েছে। আজও মনে পরে সে দৃশ্য, আম্মা আম্মা ভাইজান আছছে বলেই উঠে ভাইজানকে জড়িয়ে ধরত। দুই ভাই এক সাথে ঘরে ঢুকত, এ যে সেই ভাই!

নক্ষত্রে গোধূলি-৫৮/২৫০

৭৭।
রাশেদ সাহেব উপরে এসে ফোন ধরলেন।
-হ্যালো
ওপাশ থেকে মেঝো ভাইয়ের কণ্ঠ-
-সালামালেকুম, কেমন আছেন?
-হ্যাঁ চলছে একরকম।
-কাজকর্ম কেমন?
-খুব কষ্ট, জীবনে অনেক কষ্টের কাজ করেছি কিন্তু এই কষ্ট তার কাছে কিছুই না। এখন বয়সও হয়েছে পারছি না। যা আছে তাও যদি একটু ধীরে সুস্থে হোত করা যেত, তাহলে চলতো কিন্তু সবাই চায় বলার আগেই যেন রেডি হয়। কিচেনের সবাই অর্ডার করে তার মধ্যে মালিক হলো তিন জন। একজন সেফ অন্য দুজন সামনে। সামনে থেকে এসে ওয়েটাররাও এটা ওটা করতে বলে। সবারই এক কথা ‘কুইক। তখন বিশ্রী ভাবে আজেবাজে কথা বলে। কাজ যেমন তেমন কথাগুলিই বেশি কষ্টের। কেও সহজ করে কথা বলে না, সাধারণ কথা গুলিই বাঁকা করে বলবে অশ্লীল ভাবে। এদিকে হাত কেটে কুটে অবস্থা খারাপ।
-হ্যাঁ, এটাই এদের স্বভাব। ওখানে গ্লোভস নেই?
-না গ্লোভস দেখি না।
-বলবেন গ্লোভসের কথা।
-হ্যাঁ, ফিরোজও বলেছে বলতে, বলা হয়নি। ভয় করে আবার কী বলে না বলে তাই আর বলিনি।
-এমনি অন্য সময় কথাবার্তা আচার ব্যাবহার কেমন, গালাগালি করে?
-এমনি অন্য সময় যা তা মেনে নেয়া যায় তবে শুনেছি বিজির সময় সেফ নাকি গালাগালি করে। আমি যেদিন এসেছি সেই শুক্র শনিবার সেফ ছিলো না তাই দেখিনি কেমন, এখনও দেখছি ভালোই।
-আচ্ছা চলুক এভাবে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে আর বিশেষ করে আপনি অনেকদিন শুধু অর্ডার করেই এসেছেন এধরনের কাজের সাথে তো আপনার পরিচয় নেই, সামনে কাজ পেলেন না, না?
-না, পেলাম না অবশ্য খুঁজতেও পারিনি তেমন করে। প্রথমেই যা পেয়েছি তাতেই চলে এসেছি। সামনের একটা কাজ পেয়েছিলাম কিন্তু সেটা আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে। ফিরোজ ওখানে যেতে নিষেধ করলো বললো অত দূরে গিয়ে দরকার নেই এদিকে আসা যাওয়াতে অসুবিধা হবে তুমি মেইন ল্যান্ডেই থাকো। তাই আর গেলাম না। ও হ্যাঁ, ব্রিস্টলেও একটা পেয়েছিলাম কিন্তু বেতন কম। এখন মনে হচ্ছে ওখানে গেলেই ভালো হোত। বেতন কম বলে ফিরোজ ওখানেও নিষেধ করেছে।
-আচ্ছা যাই হোক, আপাতত একটা দাঁড়াবার জায়গা তো হয়েছে পরে সুযোগ মত খুঁজে নিতে হবে। কিচেনের কাজ আপনি পারবেন না। আমি জানি এখানকার এসব কাজ হলো অল্প বয়সীদের জন্যে। দেখা যাক কিছু দিন থাকেন এভাবে। কাল ঈদ জানেন?
-হ্যাঁ, এইমাত্র শুনলাম।
-নামাজ কোথায় পড়বেন, কিছু শুনেছেন?
-না তেমন আলাপ হয়নি শুধু জানলাম যে সবাই লন্ডন অক্সফোর্ড চলে যাবে, মাত্র একজন থাকবে এখানে। কোথায় মসজিদ কিছু জানি না, শুনিনি এখনও।
-আমরা লন্ডন যাবো।
-কোথায়, কখন?
-ওর বোনের বাসায়, সকালেই যাব। সাথে কাজলও যাবে।
-ও আচ্ছা।
ভাইয়ের কথা শুনে রাশেদ সাহেব মনে মনে ভাবছিলেন হয়ত বলবে যাবার সময় আপনাকে নিয়ে যাব। এই কথা বলার জন্যেই হয়তো ফোন করেছে কিন্তু সেরকম কিছু শোনার আগেই ওপাশ থেকে বললো –
-তো ঠিক আছে তাহলে রাখি, কি আর করবেন কষ্ট করতে এসেছেন আর একটু করেন। সামনের কাজে এতো কষ্ট না। পেলে চলে যাবেন, আচ্ছা সালামালেকুম।

খট করে লাইন কাটার শব্দ পেয়েও রিসিভার হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন আরও কিছু শোনার আশায়। না, ওপাশ থেকে আর কোন কথা এলো না। রিসিভার নামিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। সেদিনের সেই কথা মনে হলো। মনি বলে গেছে দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলে যাবার চেষ্টা করতে। ভুলতে চেয়েছিলো আবার কেন এই আঘাত? ওরা লন্ডন যেয়ে ঈদ করবে এই খবর শোনার জন্যে কি সে অস্থির হয়েছিলো, না কি এটা ওর জানা খুব জরুরি? তাহলে কেন, কেন আবার মনে করিয়ে দেয়া? ওখানে যা হয়েছে তা কি যথেষ্ট নয়? সেই ক্ষত সেরে উঠার মত সময় কি সে সারা জীবনে পাবে? তার পরেও আবার কেন? এ কি শুরু হলো তার জীবনে, কোন খেলা এটা? সেতো কখনো কারো সাথে এমন করেনি! কারো মনে আঘাত দেয়া তো দুরের কথা কারো সাথে উঁচু স্বরে কথাও বলেনি। কারো অমঙ্গল চিন্তা করতে পারে না সে, তার মনই সে ধাঁচে গড়া নয়, এসব তার ভাবনায়ই আসে না। এ কোন পরীক্ষায় পড়েছে, কি ভাবে এর থেকে বেরিয়ে আসবে?
মনে আছে ছোট বেলায় তার এক মামা তার এই নরম স্বভাব আর কোমল মন দেখে আফসোস করে বলেছিলো তোকে তো বড় কঠিন ভাবে জীবন পাড় করতে হবেরে ব্যাটা। এই কঠিন দুনিয়াতে এতো নরম হলে কি চলে? এদিকে আয় তোকে শক্ত হবার ট্রেনিং দেই আয়। এক কাজ কর ওই যে একটা ছেলে দেখছিস ওকে একটা ধমক দিতে পারবি? যদি তোর ধমক শুনে ও ভয় পায় তাহলে এক আনা পাবি।
-না মামা আমি পারব না।
-আরে যা না দিয়েই দেখ পারবি, পারবি যা।
ধমক দিয়েছিলো কিন্তু ওই এক আনা পাবার মত হয়নি। কোথাও মারামারি দেখলেই তার বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করত। দৌড়ে বাসায় এসে মায়ের আঁচলের তলায় লুকাতো। তার হাঁপানি দেখে মা বুঝতেন কোথাও কিছু হয়েছে আর বকতেন এমন ছেলে কি করে চলবে এই দুনিয়াতে! সেই রাশেদ সাহেবের জীবনে এসব কি ঘটছে, কী, হচ্ছে কি এসব? আমি কী করেছি? কী করেছি? ভাবতে ভাবতে রুমে এসে জ্যাকেটটা খুলে হুকে ঝুলিয়ে রেখে বিছানায় বসলেন। কতক্ষণ বসে ছিলেন মনে নেই। ভিড় কম বলে আজ একটু তাড়াতাড়িই রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে সবাই যার যার উৎসবে মেতে উঠার আনন্দে বাড়ির দিকে ছুটে যাবার পথে বের হয়ে গেলো। নুরু এলো রুমে।
-কি ভাই, কি ব্যাপার মন খারাপ নাকি?
-কাছে এসে কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে আবার বললো ।
-আরে কাল ঈদ আর আপনি এখন মন খারাপ করে অন্ধকারে এভাবে বসে আছেন কেন? ও! বাড়ির কথা মনে পরছে? না না ভাববেন না এতো ভাবার কি আছে? বিদেশে এতো মন খারাপ করে থাকবেন না এখানে তো আর কেও নেই যে এসে দেখবে। উঠেন যান খেয়ে দেয়ে এসে নিচে কবিরের সাথে টিভি দেখেন বসে। আমি চললাম, ঈদ মোবারক।
নুরু চলে গেলো। রাশেদ সাহেব একটা সিগারেট বানালেন। হাত দুইটাই টেবিলের উপরে এক হাতে সিগারেটটা ধরা। কবির এলো রুমে।
-কি খবর নয়া ভাইসাব একলা কি করেন খাবেন না আজতো সেহেরি নাই আসেন খেয়ে আসি।
রাশেদ সাহেবের মুখে কথা নেই। কবির পাশে বসলো। মুখের দিকে তাকিয়ে বললো –
-কি ব্যাপার ভাই মন খারাপ?
-না এমনিই।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললো –
-তামাক খাবেন?
-আমি বানাতে পারি না।
-নেন আমি দেখিয়ে দেই।
-কি তামাক এটা?
-এরিনমোর।
-বেশ ভালো, একটু কড়া তবে গন্ধটা সুন্দর, এটা কি এখান থেকে নিয়েছেন?
-না দেশ থেকে এনেছি, এখনও এখান থেকে কেনার দরকার হয়নি, আরও কিছুদিন চলবে।
তামাকের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে নিচে থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে উপরে এসে কবির বললো –
-চলেন টিভি দেখি
-না ভাই আমার ভালো লাগছে না আমি শুয়ে পরবো আপনি দেখেন। আচ্ছা ভালো কথা কাল ঈদের নামাজ, কোথায়, কখন যাবেন?
-হ্যাঁ, যাবো। সকালে নয়টায় বের হয়ে অক্সফোর্ডে যেতে হবে, জামাত হবে দশটায়।
-তাহলে আমাকে নিয়ে যাবেন।
-হ্যাঁ, আমি আর আপনেই যাব। তাহলে এই কথাই রইলো আমি চলি এখন।

নক্ষত্রে গোধূলি-৫৭/২৫০

৭৬।
এখানে বসে আরও কয়েকটা পাব দেখা যাচ্ছে ভিতরে মৃদু বাজনার শব্দ আসছে। আজ মঙ্গল বার তাই ভিড় নেই। হাতের সিগারেটটা শেষ হলে ফেলে দিয়ে এবারে উঠে দাঁড়ালেন। রেস্টুরেন্টে ঢুকার পথে কিচেনের ভিতর দিয়ে ঢুকতে হয়। তাকে দেখেই বলে উঠলো কি ভাই সাহেব কোথায় গেছিলেন? রাশেদ সাহেব সারা দিনের ফিরিস্তি দিলেন। এখানে এসে ইফতার করে যেতে পারতেন, ক্ষুধা লেগেছে কিছু খাবেন? আমতা আমতা করে বললেন-
-হ্যাঁ দিবেন কিছু?
-কি খাবেন?
-যা দিবেন তাই।
-তাহলে একটা নান খান।
মারুফ একটা নান বানিয়ে তন্দুরির ভিতরে ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করল-
-কি দিয়ে খাবেন?
-যা দিবেন তাতেই হবে ঘরের বাইরে যখন এসেছি তখন আর কোন চাহিদা নেই যা দিবেন তাই আলহামদুলিল্লাহ।
সেই সেদ্ধ করা ভেড়ার কিমা দিয়ে তাদের এই বিলাতি কায়দায় একটু নেড়ে চেড়ে কি একটা করে বললো—–নেন খান।
-এটা কি দিলেন?
-এটা হলো কিমা ভুনা।
-ও আচ্ছা তা আসেন আপনারাও আসেন!
-না আপনে খান আমরা খাইছি
-বেয়াই সাহেব শুনছেন কাল ঈদ!
-তাই নাকি? বেশ তা হলে ঈদ মোবারক সবাইকে।
-কোথায় যাবেন ঈদের দিন?
-কেন কাল কি বন্ধ নাকি?
-হ্যাঁ দিনের বেলা বন্ধ তবে রাতে খুলবো।
-না ভাই আমি কোথায় যাব এখানেই ঘুরা ঘুরি করবো আজকের মত, আপনারা কি করবেন?
-আজকে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে আমরা সবাই লন্ডন চলে যাব, আসাদ মিয়া যাবে অক্সফোর্ড তার ভাইয়ের কাছে শুধু কবির থাকবে।
-কেন কবিরও কি আমার মত নাকি?
-না ওর অনেকেই আছে তা উনি কোথাও যাবেনা, আপনের জন্যে ভালো হবে একা একা থাকার চেয়ে।
-আপনাদের তো সবার গাড়ি আছে কিন্তু নুরুল ইসলাম আর আসাদ ভাই কেমনে যাবে এতো রাতে বাস পাবে কোথায়? বাস বন্ধ হয়ে গেছে দেখে আসলাম!
-নুরু যাবে আমার সাথে, আসাদ যাবে ওসমানের সাথে। ওসমানের বাসাও অক্সফোর্ডে।
এমন সময় সামনে থেকে খবর এলো রাশেদ সাহেবের ফোন।

নক্ষত্রে গোধূলি-৫৬/২৫০

৭৫।
চারদিকে দেখতে দেখতে হেঁটে সমারফিল্ডে ঢুকলেন। এক পাশে লাইন ধরে সাজানো ট্রলি রয়েছে যে বেশি বাজার করবে সে এখান থেকে একটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এখানেও সিকিউরিটি গেট এবং অটোমেটিক দরজার সামনে আসতেই দরজা খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকেই গরমের ছোঁয়া। গেটের ভিতরেই প্লাস্টিকের ঝুরি সাজানো রয়েছে যে কম কেনাকাটা করবে সে এখান থেকে একটা নিয়ে নিচ্ছে। ঢোকার পর ডাইনে কাস্টমার সার্ভিসের কাউন্টার বায়ে সিকিউরিটির সিসি ক্যামেরা মনিটর করার ডেস্ক। তার পাশে ফুলের সেকশন। নানান রকমের ফুল সাজানো রয়েছে বিক্রির জন্যে। সামনে এক মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত অনেকগুলি চেক ইন কাউন্টারের উপরে নম্বর লেখা। সব গুলিতেই স্ক্যানার এবং টিল। সিসি ক্যামেরার মনিটর করা দেখে অবাক হলো, এখানেও তাহলে চুরি হয়!
ভেতরে ঢোকার পথ আর বের হবার পথ সবুজ আর লাল রঙ দিয়ে লেখা। হ্যাঁ সুপার স্টোরই বটে, বিশাল, কত হাজার রকমের মালামাল রয়েছে কে জানে, ফুল থেকে টেলিভিশন সবই আছে। কোথায় কী আছে, কি কি আছে এতো খুঁজে বের করা কঠিন ব্যাপার। রাশেদ সাহেব ভেতরে ঢুকলেন। হেঁটে এগিয়ে যেয়ে চেক ইন কাউন্টারে যেখান থেকে নম্বর শুরু হয়েছে সেখান থেকে দেখা শুরু করলেন। প্রতিটা রো এর উপরে রো নম্বর আর ঐ রোতে কি আছে তার নাম লেখা। তাই দেখে দেখে এক দিক থেকে দেখতে শুরু করলেন। হাতে ঘড়িটা দেখে নিলেন। না ঠিক আছে তিনটা বাজে। ইফতারের দেরি আছে, আজ এখান থেকেই কিছু কিনে ইফতার করে নিব এজন্যে আর ফিরে যাব না। কত জিনিষ তার হিসাব করা কঠিন। স্কিম, সেমি স্কিম, নন স্কিম দুধ, বিভিন্ন ডেইরি ফারমের উৎপাদিত সাদা প্লাস্টিকের গ্যালনের কন্টেইনার তিন লি:, দুই লি:, এক লি:, আধা লিটারের বোতল লাল সবুজ নীল ঢাকনা আর লেবেল দিয়ে ফ্যাটের পরিমাণ চিহ্নিত করা। লাল ঢাকনায় থাকে সবচেয়ে কম ফ্যাট, সবুজ ঢাকনায় থাকে অর্ধেক ফ্যাট, আর নীল ঢাকনায় থাকে ফুল ফ্যাট। আরও আছে ল্যাক্টোজ ফ্রি, লঙ লাইফ অনেক রকম এতো দেখার সময় নেই।
এরপরে দৈ, সেও নানান রকম আধা লি: প্লাস্টিকের গ্লাসে বিভিন্ন স্বাদের বিভিন্ন ফল মেশানো স্বাদের। তারপরে পনীর। এই পনীর যে কত রকমের তা যেমন দেখাও কঠিন লেখাও কঠিন। রান্নার জন্যে সূর্যমুখী তেল, তিলের তেল, চিনাবাদামের তেল, ভেজিটেবল তেল, আলমন্ড বাদাম তেল, আঙ্গুর বীজের তেল, তুলা বীজের তেল, অলিভ তেল। হাজার রকমের সস। এমনি খাওয়ার সস, রান্নার সস, সালাদ ড্রেসিঙের সস, প্যাকেট সুপ, নুডলস, চিনি, লবণ, চিপস, ক্র্যাকারস অর্থাৎ আমরা যা ব্যাবহার করি তার সব কিছুরই অনেক অনেক প্রকার যা আমাদের দেশে আমরা জানিই না। তবে সবজির সেকশনে গিয়ে একটু হতাশ হলেন। ফুলকপি, পাতা কফি, গাজর, পারস্নিপ নামের সাদা গাজর, শালগম, স্পিনাস নামের আমাদের পালং শাক, ছোট পাতা কফির মত দেখতে স্প্রাউট যা এক বারে একটা মুখে দেয়া যায়, ব্রকলি, সিম, বরবটি, লাল হলুদ সবুজ রঙের ক্যাপসিকাম, লিক, এস্পারাগাস এই হলো সবজি, মটর সুটি আছে তবে ফ্রোজেন তবে আলু আর পিঁয়াজের অনেক প্রকার তার মধ্যে সালাদের জন্যে লাল পিঁয়াজ তার খুব ভালো লাগলো।
হরেক রকমের টমাটো সাথে লম্বা চিচিঙ্গার মত শসা। লেটুস যে কত রকমের হতে পারে তা তার ধারনাতেই ছিলোনা বিভিন্ন রকমের লেটুস, রেস্টুরেন্টে আলু খেয়েছে বেশ সুস্বাদু। অনেক রকম তৈরি খাবার ফ্রিজে রয়েছে কোনটা এনে কিছুক্ষণ রান্না করতে হবে, কোনটা শুধু মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিলেই হবে। সবজির ওখানে দেখছে অনেক তাজা সবজি আছে যেগুলি চুলায় দেয়ার জন্যে রেডি করা প্যাকেট।

স্টোরের ভিতরে কিছু খাওয়া নিষেধ এদিকে ইফতারের সময় হয়ে এসেছে। পানীয়ের কাছে গেলেন এক ক্যান ডায়েট কোক নিয়ে আবার হালকা খাবারের কাছে এসে দুইটা ভেজিটেবল পেটিসের মত নিলেন। চেক ইন পয়েন্টে দাম দিয়ে বের হবার পথে মনে করলেন দেখি কোন ফুলের কেমন গন্ধ! কাছে এসে শুঁকে দেখে হতাশ হলেন কি ব্যাপার দেখতে কি সুন্দর অথচ কোন ফুলেই গন্ধ নেই? অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। আচ্ছা এব্যাপারে পরে ভাবব। বাইরে এসে কার পার্কিঙের কাছে বসার বেঞ্চ দেখে এসেছে ঢোকার আগে, ওখানে বসলেন। ঘড়ি দেখে আস্তে আস্তে ইফতার করলেন। পেটিসটা গরম করা দরকার ছিলো কিন্তু কোথায় করবে তাই গরম না করেই খেয়ে ফেললেন।

ইফতারের পরে কিছুক্ষণ বেঞ্চেই বসে রইলেন। একটা সিগারেট বানিয়ে অনেকক্ষণ ধরে টানলেন। এতক্ষণ মাথায় কোন চিন্তা আসার সুযোগ আসেনি। এখন মনি আর মেয়েরা কখন যে এসে মাথায় ভিড় করেছে টের পায়নি। শীত লাগছে তবুও উঠছে না। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে আবার গ্লোভস পরে নিলেন। ঠাণ্ডার মধ্যে বসা যাচ্ছে না কিন্তু রুমে গিয়ে কি করবেন সময় তো কাটতে চাইবে না। ওহ! ভালো কথা ফিরোজকে একটা ফোন করবে। উঠে দাঁড়ালেন। এদিক ওদিক দেখে ফোন বক্স পেয়ে কাছে গিয়ে ফিরোজকে পেয়ে কিছু কথা বার্তা হলো। তেমন কিছুনা, কেমন আছ কেমন লাগছে এই সব। এতেই চল্লিশ পেনি লেগে গেলো। ফোনটা ছেড়ে রাস্তার দিকে হেঁটে এলেন। বাসস্ট্যান্ডের পাশে বেঞ্চ আছে তারই একটাতে বসলেন। এখন কি করবে? অন্ধকার হয়ে গেছে, যদিও দিনের মত আলো জ্বলছে কিন্তু শত হলেও রাত। এদিকে ভালোই ঠাণ্ডা লাগছে আর কিছু দেখা হলো না। থাক আছিই তো পরে দেখা যাবে কত দিন থাকতে হবে কে জানে তখন কি করবো আস্তে আস্তেই দেখা যাবে। না এখন ফেরা যাক। তবুও বসে রইলেন, ঠাণ্ডা লাগছে তবুও উঠতে মন চাইছে না। আবার একটা সিগারেট বানিয়ে জ্বালালেন।

রাস্তায় মানুষ জন নেই। সে যেখানে বসেছে তার চতুর্দিকে রাস্তার পাশে আরও কয়েকটা বেঞ্চ আছে কিন্তু সবই খালি তার মত শীতের মধ্যে রাতের বেলা কেও বসে নেই। এখান থেকে রাস্তাটা যে দিকে বেরিয়ে গেছে তার একটা দিয়ে সে অক্সফোর্ড থেকে এসেছে, একটা গেলো লাইবেরির দিকে আর একটা রেস্টুরেন্টের দিকে জর্জ স্ট্রিট বাকি দুইটার কোনটা কোথায় গেছে কে জানে! সব রাস্তার মাথায় ফোনবুথ আছে, আর আছে আবর্জনা ফেলার বিন, উপরে ঢাকনা দেয়া এতে কোন ভুল নেই। জ্বলন্ত সিগারেট নিভিয়ে ফেলার জন্যে ঢাকনার উপরে আলাদা ব্যবস্থা। কয়েকটা দোকানের সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। কোনটা কিসের দোকান সব বোঝা যাচ্ছে না। সবই প্রায় বন্ধ তবে কাঁচের দেয়াল থাকাতে সবই দেখা যেত যদি ভেতরে আলো থাকতো। একটা ব্যাংক, বারকলেজ ব্যাংক। একটা মনে হলো বাচ্চাদের খেলনার দোকান কাঁচের দেয়ালের বাইরে থেকে রাস্তার আলোতে ভিতরে যা দেখা যাচ্ছে তাতে সেইরকম মনে হলো, একটা মোবাইল ফোনের দোকান, একটা চুল কাটার সেলুন পরিষ্কার লেখা “কোলিনস বারবার শপ” একটা ফিস এন্ড চিপসের দোকানের সামনে দুই একজন দাঁড়িয়ে।

নক্ষত্রে গোধূলি-৫৫/২৫০

৭৪।
ফোন রেখে রাশেদ সাহেব রুমে এসে বাইরে যাবার শীতের কাপর পরে হ্যান্ড গ্লোভস পকেটে নিয়ে নিচে এসে সেদিন কবিরের দেখিয়ে দেয়া গোপন জায়গা থেকে চাবি নিয়ে বাইরে বের হয়ে দরজায় তালা দিয়ে আবার গোপন জায়গায় চাবিটা রেখে কবিরের দেখানো পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। বেশ ঠাণ্ডা, হ্যান্ড গ্লোভসটা হাতে পরে নিলেন। মাফলারটা আনা দরকার ছিলো কানে ঠাণ্ডা লাগছে।
আকাশ ভরা রোদ, বিলাতে এরকম আকাশ দেখা নাকি ভাগ্যের ব্যাপার, তবুও কি ঠাণ্ডা। একটু এগিয়ে যেতেই দেখে সেদিন বাস থেকে যেখানে নেমেছি্লেন সেই জায়গা। বায়ে ঘুরে দেখে একটা দশ বারো ফুট উঁচু পিলারের মাথায় বিভিন্ন জায়গার নাম লেখা দিকনির্দেশনা। লাইবেরি লেখা বোর্ডটা যেদিকে তীর চিহ্ন দিয়ে ঘুরানো রয়েছে সেদিকে হেঁটে কিছুদূর যেতেই দেখে কবির যেভাবে বলেছে সেই রকমই ডানে সমারফিল্ড সুপারস্টোর বায়ে লাইবেরি। সমারফিল্ডে পরে যাব আগে লাইবেরিতে যাই। সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখলো অনেক পুরানা বিল্ডিং, আশে পাশে অনেক গাছপালা কিন্তু কোনটায় পাতা নেই সব পাতা শীতে ঝরে ন্যাড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকে পড়লো। নিচ তলায় এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে প্রায় সব দরজাই বন্ধ। পাশেই উপরে যাবার কাঠের সিঁড়ি, উপরে উঠেই বাইরের শীতের চেয়ে এখানে উষ্ণতা অনুভব করলেন। এখানে হিটার চলছে। হাতের গ্লোভস খুলে জ্যাকেটের পকেটে রাখলেন। সিকিউরিটি গেট পেরিয়ে বাম পাশে রিসিপশন। সমস্ত ঘরটাই নীরব সুধু রিসিপশনের একজন তার মত অন্য একজনের সাথে ফিস ফিস করে কথা বলছে। একজন বিরাট এক কম্পিউটারে কাজ করছে আর একজনে কম্পিউটারের মনিটর দেখে কিসব গুছিয়ে রাখছে। পাশে দাঁড়াতেই একজন মহিলা যিনি গুছিয়ে রাখছিলেন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো-
-আমি কি ভাবে সাহায্য করতে পারি?
-আমি একটু ইন্টারনেট ব্যাবহার করবো।
-আগে বুকিং করেছ?
-না।
-কার্ড আছে?
-না।
মহিলা একটা ফরম দিয়ে পূরণ করতে বললো । একটা কলম বের করে দিলো সাথে। ফরম পূরণ করে দিতেই সেটা নিয়ে কম্পিউটারে কি কি এন্ট্রি করে জিজ্ঞেস করল-
-কতক্ষণ ব্যাবহার করবে?
-কতক্ষণ করা যায়?
-একদিনে এক ঘণ্টা, এর বেশী করতে হলে ঘণ্টা প্রতি এক পাউন্ড।
-ঠিক আছে তাহলে এক ঘণ্টা।
-আচ্ছা ওই যে তিন নম্বর কম্পিউটার আর এই হলো তোমার পিন নম্বর।
একটা ছোট্ট কাগজ এগিয়ে দিলো। কাগজটা নিয়ে ওখান থেকে সরে এলো। এতক্ষণে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে বেশ বড় হল রুম, অনেক পুরাতন অনেক কিছু আছে। দেখবো সব কিছু ঘুরে দেখবো আগে মেইলটা পাঠিয়ে নেই। বাড়িতে সবাই ভাবছে। টেবিলে বসে পিন নম্বর দিয়ে লগ ইন করেই সরাসরি ইয়াহু পেজ পেয়ে সাইন অন করে মেইল লিখতে শুরু করলেন।
মনির দেশে ফিরে যাবার সময় পথের বিবরণ শুনে তার মনের অবস্থা কি সেসব লিখে সেদিন হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত সব কিছু প্রায় দুই পাতা ভরে সংক্ষেপে লিখলো। ঘড়িতে দেখে মাত্র দশ মিনিট বাকি রয়েছে। এবার রেস্টুরেন্টের ঠিকানাটা লিখেই শেষ করলো। মেইল পাঠিয়ে দিয়ে রিসিপসনে এসে জানালো আমার শেষ কিন্তু আমি কি লাইবেরিতে অন্য কিছু দেখতে পারি?
ধন্যবাদ জানিয়ে বললোক-
-হ্যাঁ তুমি ইচ্ছা করলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত থাকতে পারো কোন নিষেধ নেই।
দৈনিক সংবাদপত্র, কয়েকটা সাময়িকী এবং এই শহরের পত্তন কাহিনী সহ বর্তমান বিবরণ, শহরের ম্যাপ, বাসের শিডিউল এই শহরে কোথায় কি ঘটছে ঘটবে এধরনের যাবতীয় তথ্য, বিভিন্ন রকমের বই, কয়েকটা হাই স্পিড ব্রডব্যান্ড লাইন সংযুক্ত কম্পিউটার ইত্যাদি নানান কিছুতে ভরা এই লাইবেরি। এদেশের ছোট বড় সব শহরেই নাকি এই রকম একটা লাইবেরি থাকে। কার কোথায় কি প্রয়োজন জানো না, যাও লাইবেরি থেকে জেনে আস। কে কোন কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চাও সেখানে কি আছে কি নেই জানো না, জানতে চাও তবে যাও লাইবেরি থেকে জেনে আস। বর্তমান প্রজন্মকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্যে যা প্রয়োজন তার সবই পাবে এখানে। শুধু বর্তমান প্রজন্ম নয় আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই এখানে আসতে পারে। কোথাও কোথাও লাইবেরিই তাদের মিলন কেন্দ্র। দিনের বেলা লাইবেরি আর রাতে পাব এদের সামাজিক মিলন কেন্দ্র।
হায়রে অর্থ! হায়রে পাউন্ড! তুমি এদেশের জন্যে কি করেছ আর আমাদের দেশের জন্যে কি করছ? এরকম একটা লাইবেরির সুযোগ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা পেলে কোথায় এগিয়ে যেতো! এদেশে এখনকার প্রজন্ম তাদের পূর্ব পুরুষদের কৃত কর্মের ফল ভোগ করছে। তারা ছিলো কর্মঠ, উচ্চাভিলাষী, সুদূর প্রসারী দৃষ্টি সম্পন্ন। ওরা সারা বিশ্ব জুরে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, সারা বিশ্বের সম্পদ এনে নিজের দেশ গড়েছে। এদের বাড়িঘরের কাঠামো, চলাচলের রাস্তা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আয়োজন দেখেই বোঝা যায়। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে যেখানে বৎসরের অর্ধেকই থাকে সংকুচিত হয়ে, কোন কাজ করা যায়না তার মধ্যেও ওরা কিভাবে এসব গড়ে তুলেছে কি ধরনের পরিকল্পনা করেছে কি রকম গঠন মূলক চিন্তাভাবনা ছিলো তা না দেখলে বোঝা কঠিন। আর আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ছিলো আয়েশি, ভোগ বিলাসী, অলস, কোন রকম মাছে ভাতে দিন গেলেই খুশী। সাথে যদি একটু নাচ গানের আয়োজন থাকে তাহলেতো কথাই নেই, আর কিচ্ছু চাইনা।

কিন্তু আশ্চর্য হলো মাত্র কয়েকজন মানুষ এই এতো বড় লাইবেরি ব্যাবহার করছে। দুই তিন জন বুড়া বুড়ি পত্রিকা পড়ছে, একজন কম্পিউটারে রয়েছে আর একজন মধ্যবয়সী মহিলা বই পড়ছে। এখানে ইংলিশ শেখার জন্যে অডিও ক্যাসেট, ভিডিও ক্যাসেট, বই, গানের সিডি এবং সিনেমার ডিভিডি নানান কিছু রয়েছে যা নাম মাত্র ভাড়া দিয়ে দুই সপ্তাহের জন্যে বাসায় নেয়া যায়। যাদের মাতৃভাষা ইংলিশ তারাও শিখছে আবার যাদের মাতৃভাষা ইংলিশ নয় তারাও শিখছে। এই লাইবেরি দেখে মনে হয় সত্যিই জ্ঞানের ভাণ্ডার। জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার এখানে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জ্ঞানের মশাল জ্বেলে তার এলাকা আলোকিত করে রেখেছে অনেক দিন ধরে। তার এলাকার নাগরিকদেরকে মানুষ করে গড়ে তোলার জন্যে, সুপথে চলতে শেখানোর জন্য। এগুলি আর একদিনে হয়নি। রাশেদ সাহেব অবাক হয়ে দেখেন আর ভাবেন এ কোথায় এলাম! এখানে না এলে এসবের কিছুই জানতে পারতাম না কিছুই দেখতে পেতাম না! আমার দেশের সাথে তুলনা করতে পারতাম না। টাকা আর পাউন্ডের তফাত কি তা জানতে পারতাম না। গোলা ভরা ধান গোয়াল ভরা গরু আর এই লাইবেরির তফাতটা কোথায় কিছুক্ষণ ভাবলেন। না এক দিনে এই লাইবেরি দেখা সম্ভব না পরের অফ ডেতে আবার আসব। একটু আফসোস করলেন একটু পরে যদি মেইলটা পাঠাতাম তাহলেতো এ সম্পর্কে কিছু লেখা যেতো! পরের বার যখন আসব তখন লিখবো মনে মনে ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলেন।

নক্ষত্রে গোধূলি-৫৪/২৫০

৭৩।
একটু বেশিক্ষণ ঘুমাতে চাইলেও হলো না। সারে এগারোটায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে নামাজ পড়ে রাতে ভিজিয়ে রাখা কাপর গুলি ধুয়ে শুকাতে দিয়ে রুমে এসে বসলেন। আজ বাসায় ফোন করতে হবে। মনি পৌঁছার পরে মনির সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি। ঘড়িতে প্রায় একটা বেজে গেছে। আর দেরি না করে কার্ডটা নিয়ে ফোনের কাছে গেলেন। ওপাশে রিং হচ্ছে মনির কণ্ঠ-
-হ্যালো,
-হ্যাঁ আমি, কেমন আছ তোমরা?
-এ কয়দিন ফোন করনি কেন? এখানে ভালো আছি সবাই তুমি কেমন আছ?
-আমিও ভালো, সেদিন যেতে পেরেছিলে ঠিক মত?
-তোমার কাজ কেমন চলছে কি অবস্থা খাওয়া দাওয়া কেমন? কেমন লাগছে কি কাজ করতে হয় পারো কিনা?
এক নিশ্বাসে সব প্রশ্ন করে একটু থামল।
-তোমার এতো প্রশ্নের জবাব দিতে সময় লাগবে তার চেয়ে আমি এখন লাইবেরিতে যাবো ওখান থেকে মেইলে সব কিছু লিখে পাঠাবো দেখে নিও এবারে বল তুমি কেমন করে গেলে রাস্তায় কি কোন অসুবিধা হয়েছিলো কায়সার বেয়াই সাহায্য করেছে?
-কায়সার বেয়াই নাকি তোমাকে এয়ারপোর্টে দাঁড়াতে বলেছিলো?
-কই না তো আমিতো তেমন কিছু শুনিনি আমিতো তাকে বলেই আসলাম বেয়াই আমি চললাম আমাকে অক্সফোর্ড যেতে হবে।
-না সেতো বললো আমি চেক ইন করতে যাবার আগে বেয়াইকে বলে গেলাম একটু দাঁড়ান আমি এসে খুঁজে আর তাকে পাইনা উনি নেই চলে গেছে আমাকে একটু বলে গেলে কি হোত। মনে হয় সেই রাগে সারা পথে আমার সাথে একটা কথাও বলেনি এমনকি কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টেও হোটেল নিয়ে ঝামেলা হয়েছিলো সেখানেও কোন সাহায্য করেনি তারটা সেরে দূরে গিয়ে বসে ছিলো আমি কাছে গিয়ে বলতে চাইলাম সে অন্য দিকে ঘুরে বসলো এদিকে আমি কিছু বুঝাতে পারছিনা কি একটা বিপদ পড়েছিলাম। হিথরোতে ওই যে তাল তলার যে লোকটাকে পরিচয় করে দিয়েছিলে সে তো এক বদমাইশ, বলে কিনা চলেন ভাবী আমরা হোটেলে এক রুমেই থাকতে পারি। আমি বললাম হ্যাঁ তাইতো, তাই হবে একটু অপেক্ষা করেন। আবার কিউতে দাঁড়ালাম হঠাৎ এক বাঙ্গালি ভাইকে পেলাম ওখানেই ক্লিনারের কাজ করে, হাতে ব্রাশ ট্রলি নিয়ে পাশে দিয়ে যাচ্ছিলো তাকে বললাম ভাই আমার হোটেলের ব্যাপারটা একটু ঠিক করে দেন, আমার সাথে কেও নেই, ওরা কি বলছে আমিতো কিছু বুঝি না আমার কথাও মনে হয় ওরা বুঝে না। তখন ওই লোক কাউন্টারে গিয়ে ওদের ভাষায় কি কি সব বলে দেয় তারপরে ওরা আমার ব্যবস্থা করে। উনি বললো আপনি এই লোকের সাথে যান বলে এক লোকের সামনে নিয়ে গেলো। আমাকে দেখে বললো আমি তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দিব চিন্তা করবেনা। ইনি হোটেলে পৌঁছে দিবে আর ওখান থেকে ভোর চারটায় তুলে আনবে এখন এখানে বাজে রাত বারোটা আপনার ঘড়ি মিলিয়ে নেন। আমি বলেছি আপনার সাথে কেও নেই তাই আপনার সাথে আর কথা বলবে না আপনাকে হোটেলের রুমে পৌঁছে দিয়ে আসবে আপনি শুধু ভোরে সময়মত রেডি হয়ে থাকবেন যাতে করে এদের লোক হোটেলে গিয়ে আপনাকে ডাকলেই পায়। যাইহোক তখনকার মত তো বের হয়ে মাইক্রো বাসে উঠলাম সাথে আরও কয়েকজন ছিলো দশ পনেরো মিনিটের মধ্যে একটা হোটেলে পৌঁছে হোটেলের রিসিপশনের সামনে নিয়ে গেলো ওখানে পাসপোর্ট রেখে একটা রেজিস্টারে সই নিয়ে বয়ের হাতে একটা চাবি দিয়ে আমাকে ওর সাথে যেতে বললো । শেষ পর্যন্ত এই বয় আমাকে এনে রুমে দিয়ে গেলো। ঢুকেই দরজা বন্ধ করে কাপর বদলে হাত মুখ ধুয়ে বসে রইলাম তখন প্রায় একটা বাজে। ওরা আমার সাথে এই গাড়িতে আসেনি মনে হয় ওদের অন্য হোটেলে পড়েছিলো অনেক প্যাসেঞ্জার তো। যাইহোক ভাগ্য ভালো বলতে হবে প্লেন থেকে নামার আগে খাবার দিয়েছিলো ক্ষুধা টুধা লাগেনি। রুমে টিভি ছিলো তাই চালিয়ে বসে রইলাম। সারারাত বিছানায় শুইনি একা একা ভয় করছিলো।

এভাবেই রাত কেটে গেলো। চারটার আগেই উঠে রুমের মধ্যেই একটু হাঁটা হাঁটি করলাম চারটা বাজার দশ মিনিট আগেই ফোন, মনে হয় ইন্টার কম বেজে উঠলে ধরলাম রিসিপশনিস্ট বললো নিচে যেতে। ব্যাগটা নিয়ে রিসিপশনিস্টের সামনে দাঁড়িয়ে নাম বললাম পাসপোর্ট বের করে দিল। এখন দেখি এয়ারলাইনের অন্য লোক, ইউনিফরম দেখে চিনলাম রিসিপশনিস্ট মেয়েটাও দেখিয়ে দিলো, মেয়েটা বেশ ভালো তোমার খুকুর মত হ্যাংলা লম্বা মালয়েশিয়ান। যাই হোক গাড়িতে উঠলাম, এয়ারপোর্টে নামলাম ড্রাইভারই বলে দিল সাথের লোকজনের সাথে যেতে। ওদের সাথে এসে লাউঞ্জে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই চেক ইন হলো। তারপর প্লেনে বসে সারা পথ যা ভেবেছি ঢাকা নেমে কি করবো, এখানেও কায়সার সেই একই ব্যাবহার। যাই হোক এখন কি আর করবো, বললাম বেয়াই আপনি কিভাবে যাবেন?
-আমি ট্যাক্সি নিব।
-তাহলে আমাকে কল্যাণপুরে নামিয়ে দিবেন?
– না তা পারবো না আপনি এক কাজ করতে পারেন আমার সাথে চলেন ওখানে আমি বাসায় নেমে গেলে ওই ট্যাক্সিতেই আপনি যেতে পারেন।
আর কি করি নিজের শহরে পৌঁছেছি, এখন আর ভয় নেই তাই মেনে নিয়ে তার সাথে উঠলাম। এই যে আজিমপুর পর্যন্ত আসলাম সারা রাস্তায় একটা কথাও না এমনকি লাগেজটা ধরে উঠাতেও একটু সাহায্য করেনি। উনি আজিমপুর পর্যন্ত ভাড়া দিয়ে তার বাসায় নেমে গেলো, যাবার সময় কিচ্ছু বলে গেল না। আমি ট্যাক্সির ড্রাইভারকে বললাম ভাই আমাকে একটু কল্যাণপুর বাস ডিপোর সামনে নামিয়ে দিবেন, ড্রাইভারটা ভালো ছিলো সে আর কোন কথা বললো না এসে জিজ্ঞেস করলো এয়ারপোর্টে আপনার কেও যায় নাই?
-না আমিতো হঠাৎ করে এসেছি তাই কাউকে জানাতে পারিনি।
-বাসা কোথায় যেতে পারবেন না কি দিয়ে আসব?
-না না এইতো কাছেই বাসা আপনি যেতে পারবেন না কষ্ট হবে চাপা রাস্তা আমি একটা রিকশা নিয়ে যেতে পারবো।
লোকটা রাস্তার মুখে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে একটা রিকশা ডেকে বললো ম্যাডামকে নিয়ে যাও এই যে লাগেজটা উঠাও। আমি অবাক হয়ে গেলাম ড্রাইভারের কাণ্ড দেখে আমাদের বেয়াইর চেয়ে লক্ষ গুনে ভালো মানুষ এই লোক। ভাড়া যা এসেছে তার সাথে আমি বিশটা টাকা বেশি দিলাম খুশি হয়ে সালাম দিয়ে চলে গেলো।
বাসায় এসে শুনি শাহেদ এয়ারপোর্টে গেছে। কতক্ষণ পরে ও এসেই হৈ চৈ একা চলে এলাম বলে। বাসায় এসেই মনে হলো আজ বুঝি আমার পুনর্জন্ম হলো আমি যে এপর্যন্ত পৌঁছতে পারব আশা করিনি সারাটা পথ কি টেনশনে গেছে। একে তো তোমার চিন্তা কোথায় গেলে কিভাবে গেলে কি করছ তারপরে নিজে কি করবো সাথে তো দুইটা অমানুষ রয়েছে ওই দুইটা যদি মানুষ হোত তাহলে আমার এতো কষ্ট হোত না। যাক আল্লাহর কাছে হাজার শোকর সহি সালামতে পৌঁছেছি। বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই তিন মেয়ে এক সাথে এইযে জড়িয়ে ধরলো আর ছাড়ে না।
এই পর্যন্ত এক নিশ্বাসে বলে মনি থামলো।

-তোমাকে বলে দিয়েছিলাম ঢাকায় নেমে বাসায় ফোন করবে যাইহোক যা হবার হয়ে গেছে। আচ্ছা মনি শোন প্রায় আধা ঘণ্টা হয়েছে লাইনে আছি আমার কার্ড প্রায় শেষ। এখন রাখি আজ আমার ছুটি এখন লাইবেরিতে যাচ্ছি ওখান থেকে আমি আমার কথা মেইলে পাঠাচ্ছি তুমি দেখে নিও।

নক্ষত্রে গোধূলি-৫৩/২৫০

৭১।
নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিসমিল্লা বলে টাকাটা পকেটে ভরে উপরে উঠে আসলেন। এসেই আবার নিঃসঙ্গ একা। টাকাটা পকেট থেকে বের করে দেখলো। টাকা নয় পাউন্ড, পাউন্ড স্টার্লিং। ব্রিটেনের রানীর মাথার ছবি আঁকা ব্রিটিশ পাউন্ড। বিশ্বের সবচেয়ে দামি নোট। যার এক পাউন্ডের মূল্য বর্তমানে বাংলাদেশের বিরানব্বই টাকা। হায়রে টাকা! তোমার জন্যে আমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে, আমাকে আমার মা মনিদেরকে ছেড়ে আসতে হয়েছে, আমার মনিকে আমাকে এখানে একা রেখে দেশে ফিরে যেতে হয়েছে হাতে ধরে নোট গুলি বার বার নাড়া চাড়া করছেন। হায়রে অর্থ! তোমার মূল্য কত? মানুষের প্রেম মায়া মমতা ভালোবাসা এর চেয়ে কত বেশি, কত বেশি তোমার মূল্য?
সিঁড়িতে কার যেন পায়ের শব্দ পেলেন। টাকা গুলি পকেটে রাখার আগেই কবির রুমে ঢুকে হাতে টাকা দেখে জিজ্ঞেস করলো-
-কি, টাকা দিছে?
-হ্যাঁ দিলো, এইতো।
-রেখে দেন, সাবধানে রাখবেন।
-সাবধান আর কি কোন লকার তো নেই।
-সাথে রাখবেন, সবসময় সাথে রাখবেন ভাববেন না এদেশে চোর নাই। এদেশেও চোর আছে পকেটমার ছিনতাইকারি আছে। আপনে একা একা থাকতে চান কেন? একা একা থাকবেন না। একা থাকলে মন খারাপ হবে, নানান রকম চিন্তা এসে মাথায় ঢুকবে, থাকতে পারবেন না। তাস খেলতে পারেন?
-জানি তবে একমাত্র ব্রিজ, তাও বেশীক্ষণ খেলতে পারি না মথা ঘুড়ে।
-আর কিছু পারেন না?
-না আর কিছু পারিনা। কেন আপনারা কি খেলেন?
-আমরা খেলি টুয়েন্টি নাইন।
-না আমি ওটা পারিনা।
-আপনার অফের কথা কিছু বলেছে?
-অফ মানে?
-অফ মানে ছুটি, যেদিন কাজ করবেন না।
-না তা কিছু বলেনি।
-বুঝেছি আপনার অফ দেলু ভাই এসে দিবে।
-দেলু ভাই কে?
-দেলু ভাই আমাদের কিচেনের সেফ এবং এই রেস্টুরেন্টের আর এক জন পার্টনার।
-ও আচ্ছা, ওনার নামও কি দেলোয়ার?
-হ্যাঁ আমরা দেলু ভাই বলি।
-কবির ভাই আপনি এখানে কতদিন যাবত আছেন?
-অনেক দিন প্রায় এক বৎসর।
-আমাকে একটু অফ সম্পর্কে বলেন তো!
-কি বলবো, সাধারণ ব্যাপার। রাতে ডিউটি শেষ হলেই আপনার অফ শুরু। আপনি ইচ্ছা করলে তখনই কোথাও যেতে পারেন। তারপর দিন সারা দিন ছুটি। যেখানে ইচ্ছা যাবেন, লন্ডন যান বারমিংহাম যান, অক্সফোর্ড যান যেখানে খুশি, তারপর দিন সন্ধ্যায় এসে ডিউটিতে হাজির হবেন। ব্যাস আর কি?
-আমার বাইরে যাবার জায়গা নেই তাহলে আমি কি করবো?
-কেন, অক্সফোর্ড যাবেন না হলে এই টাউনেই ঘোরাঘুরি করবেন। ভালো কথা, এখানে লাইবেরি আছে ওখানে যেতে পারবেন, কেনা কাটার দরকার হলে করবেন কাপর চোপর ধুবেন।
-আর খাওয়া দাওয়া?
-কেন সময়মতো এসে খেয়ে যাবেন।
-কেও কিছু বলবে না?
-আরে না, কে কি বলবে? সবাই তাই করে।
-হ্যাঁ আমার বন্ধু বলেছে লাইবেরিতে যেতে। ওটা কোথায়?
-আসেন দেখিয়ে দেই।
জানালার কাছে গিয়ে-
-এই যে রাস্তা এটা যেখানে শেষ হয়েছে ওখান থেকে বায়ে যাবেন একটু এগিয়েই দেখবেন বায়ে আবিংডন লাইবেরি, ডানে সমারফিল্ড সুপারস্টোর। ফল টল কিছু খাইতে চাইলে ওখান থেকে কিনবেন।
-আপনারা কাপর চোপর কোথায় কিভাবে ধুয়ে থাকেন?
-কেন বাথরুমে ইয়েলো বাকেট আছে না?
-মানে তাজমহল ডালডার বাকেট?
-হ্যাঁ ওতে কাপর ভিজিয়ে রাখবেন, সকালে উঠে গোসলের সময় ধুয়ে বাথরুমের পাশে যে রুম ওটার বাইরে একটা বারান্দার মত আছে ওখানে শুকাতে দিবেন তবে কাপর ভালো করে আটকাবেন নয়তো বাতাসে নিয়ে যাবে। রশিতে ক্লিপ আছে দেখবেন, হ্যাঙ্গারও আছে।
নুরু ভাইয়ের বেডের ওপাশে দেখে বললো –
-হ্যাঁ এইযে ইস্ত্রি আপনের রুমেই আছে চাইলে কাপর ইস্ত্রি করে নিবেন। আপনের কিছু ধুইতে হলে পাউডার আছে? না থাকলে আমার আছে নিয়ে নিবেন।
-না এখন ধুতে হবে না আর পাউডার নেই কিনতে হবে।
-দেখেন কবে অফ দেয় সে দিন বাইরে যাবেন।
-আর একটা কথা, আমি যে বাইরে যাব ফেরার সময় চাবির কি ব্যবস্থা?
-সবই আছে কাল দেখিয়ে দিব। আজও কি আগেই সেহেরি খাবেন?
-হ্যাঁ তাহলে যান আপনের সেহেরি খাবার সময় হয়ে গেছে।
-যাক ভাই আপনার সাথে কথা বলে সময়টা ভালোই কাটল।
-হ্যাঁ তাইতো বলি একা থাকবেন না একা থাকলেই বিপদ।
-হ্যাঁ কবির ভাই, ঠিকই বলেছেন। চলেন সেহেরি খেয়ে আসি।
-আমাদের সাথে খান আমরা সালাদ বানাই খেতে পারবেন।
-আসলে ভাই আমার একটু আগে সেহেরি খাবার অভ্যাস তাই আর কি।
-ঠিক আছে যার যাতে সুবিধা খান আপনার যেভাবে সুবিধা, জানেন তো কোথায় কি থাকে ইচ্ছা হলে সালাদ বানিয়ে নিতে পারেন। তারপর রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকতে ডান পাশে সেলফ দেখেছেন ওতে আচার আছে খেতে পারেন। যা খাইতে ইচ্ছা হয় এখানে যা আছে খাবেন কেও কিছু বলবে না।

নক্ষত্রে গোধূলি-৫২/২৫০

৭০।
মনে আর কত থাকবে? তুমি তো জান না মারুফ আমার মনে কত বোঝা বয়ে বেড়াই। এতো বোঝা মাথায় রেখে আর কত মনে রাখা যায়? এই যে কথায় কথায় ভুলে যাই আমি এমন ছিলাম না। আমার মা বাজার থেকে কখনো কিছু আনার কথা বললে সে কথা আমার এক মাস পরেও মনে থাকতো। বাজার থেকে নিয়ে আসতাম মা বলতেন বাব্বাহ! সেই কবে বলেছিলাম এখনও মনে রেখেছিস কিন্তু এই দিন তো সেই দিন নয়। এখান থেকে শুনছি আর ওখানে যাবার আগেই ভুলে যাচ্ছি। এজন্যে যে কত বিড়ম্বনা হচ্ছে তা কাকে বলি? মাংস রান্না হয়ে গেছে। এই ফাঁকে কিচেন ব্রাশ করা হয়েছে। মারুফকে দেখল ইফতারের জন্যে কাবলি ছোলা ভুনতে। সাড়ে চারশো গ্রামের ছোট টিনের মধ্যে সেদ্ধ কাবলি ছোলা এখানে যার নাম চিক পিজ। ফ্রাই প্যানে তেল পিঁয়াজ মশলা গরম করে তার মধ্যে দুইটা টিনের মুখ খুলে পানি ফেলে দিয়ে ছোলা ছেড়ে দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করেই ছোলা ভুনা। মারুফ জিগ্যেস করেছিলো-
-ইফতারির জন্যে আর কিছু বানাবেন? আপনি খিচুরি খান না।
-না আমি পারিই বা কি আর বানাবোই বা কি যা আছে এতেই চলবে। আচ্ছা এখানে তো বেসন আছে দেখলাম আপনারা অনিওন ভাজি বানান তা ওরকম করে কিছু পাকোরা বানানো যায় না?
-হ্যাঁ যাবে না কেন বানান সব কিছুই আছে যা লাগে নিয়ে নেন বানান নিজেও খান আমরাও খাই।
-ঠিক আছে তবে আজ না কাল বানাবো কিন্তু কথা হলো আমার কোন আন্দাজ অনুমান নেই আমাকে লবণ দিয়ে দিবেন।
-আচ্ছা আচ্ছা তা দেয়া যাবে। বেশ কালই বানাবেন।
এখনকার মত কাজ শেষ। এপ্রণটা খুলে তিন লিটারের একটা দুধের বোতল খালি হয়েছিলো সেটা রেখে দিয়েছিলো ওটা ভরে পানি নিয়ে উপরে চলে গেলো।
আজ রাতে তেমন ভারি কিছু মনে হলো না। গত দুই দিনের তুলনায় এ যেন কিছুই না। অনেক হালকা, বেশ নীরবে চলেছে সব কিছু। কোন হাঙ্গামা নেই, ভুল ভ্রান্তি নেই। হৈ চৈ চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই নেই। এর মধ্যে মালিকরা এসে গল্প করেছে অনেকক্ষণ। দেশের কি অবস্থা, রাজনীতির অবস্থা কেমন, লোকজন কেমন আছে এখানে কেমন লাগছে এইসব। এরকম হলে চলে কিন্তু তাই কি আর হয়? এভাবে চললে মালিকের ব্যবসা হবে কি করে? এইযে এতো গুলো মানুষের বেতন দেয়া, মালিকরা তিন জন, বাইরের ছয় জন এদের বেতন, ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল, কাউন্সিল ট্যাক্স কত কি! নাহ তবুও এভাবে এই কাজ করা যাবে না সামনে যেতেই হবে। ডিউটি শেষ হয়ে আসছে এমন সময় আনোয়ার এসে বললো-
-ভাইছাব আপনার ফোন, যান উপরে যেয়ে ধরেন।
উপরে উঠে ফোন ধরতেই কাজলের কণ্ঠ-
-কে, মামা?
-হ্যাঁ মামা, তা কি মনে করে, নম্বর কোথায় পেলে?
-কেন ফিরোজ মামার থেকে নিয়েছি।
-ও আচ্ছা, বল কি খবর!
-না এমনিই, মামা বললো আপনার খোঁজ খবর কি কোথায় গেলেন কি করছেন জানার জন্যে তাই ফোন করলাম।
-ঠিক আছে, এইতো আসলাম। আজ মাত্র তিন দিন, এর মধ্যে গত দুই দিনের অবস্থা দেখে ভাবছিলাম এ কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। তা আজ একটু সহজ মনে হচ্ছে।
-মামা আসল কথা হলো প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে তবে আপনি সামনে কাজ পেলেন না?
-না পাইনি।
-ঠিক আছে করতে থাকেন দেখা যাক আর কখন কোথায় থাকেন ঠিকানাটা অন্তত ফোন নম্বরটা জানাবেন। তাহলে রাখি মামা পরে আবার ফোন করব।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-ওহ ভালো কথা! কখনো দরকার হলে রাস্তার মোরে মোরে দেখবেন ফোন বক্স আছে সেখান থেকে ফোন করবেন বিশ পেনি লাগে।
-আচ্ছা।
নিচে আসতেই সবাই এক সাথে বললো-
-আপনে না বলেছেন আপনার কেও নেই তাহলে এতো ফোন করে কে?
-না এমনিই পরিচিত চেনা মানুষ।
কাজ কর্ম শেষ করে উপরে আসবে এমন সময় ওসমান দৌড়ে এসে বললো-
-ভাইছাব একটু দাঁড়ান এই যে নেন এটা রাখেন।
-কি এটা?
-আপনে কাজ করলেন এই তিন দিনের পয়সা।
-ও, মানে কি আমার কাজ ঠিক হচ্ছেনা তাই বিদায়?
-আরে না না বিদায় কেন এটা আমাদের নিয়ম আমরা প্রতি রবিবারে যার যার বেতন দিয়ে দেই। এখানে আপনার সাথে জব সেন্টারে যে ভাবে কথা হয়েছিলো সেই হিসাবে তিন দিনের পয়সা আছে।
-ও তাই? তাহলে দেন।

নক্ষত্রে গোধূলি-৫১

৬৯।
নিচে চেঁচামেচির শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ালো। লোকজন উঠছে। বারোটা বাজার দশ মিনিট বাকি। কাজের পোষাক পরে নিচে নেমে এলো। কিচেনের লাইট জ্বালিয়ে গত দুই দিনের অভিজ্ঞতায় যা যা করতে হবে তা করতে করতে কবির নেমে এলো।
-ভাইছাব ঐ মাঝারি ডেকচিটায় চার পট চাউল আনেন।
-আচ্ছা আনছি, এই যে চাউল।
-এবারে এই তাজমহল মার্কা ডালডার বাকেট থেকে এই চামচ দিয়ে সাত আট চামচ ডালডা নেন। লবণ, গরম মশলা দেন, তেজপাতা দেন। এবারে আঙ্গুলের কড় দেখিয়ে বললো এই পরিমাণ পানি দেন।
-আচ্ছা দিলাম।
-এবারে ঢাকনা দিয়ে এই চুলায় বসিয়ে দেন। আজকের পোলাও আপনেই রান্না করলেন। এবারে লক্ষ রাখবেন চালটা ফুটে উঠলেই এই যে ওভেন এইটা জালিয়ে দেন, হ্যাঁ এটা গরম হোক। এইখানে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিবেন দশ থেকে পনের মিনিট। ব্যাস পোলাও শেষ। এরপর ওভেন থেকে বের করে নামিয়ে এইখানে রাখবেন। আজ বেশি কাজ নেই যা আছে ধীরে সুস্থে করা যাবে চিন্তা নাই।
বলে সে নিজেই বাইরে বের হয়ে গেলো বাইরের স্টোরের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে আদা রসুন নিয়ে ফিরে এলো।
-এবারে ঐ কেটলিতে এক কেটলি পানি গরম দেন। পানি গরম হলে এই রসুনগুলি এই বাকেটে ভিজিয়ে দিবেন। গরম পানিতে রসুনের খোসা ছাড়াতে সুবিধা। এবারে বসে বসে ছুরি দিয়ে আদা গুলি ছিলে এই বাকেটে রাখেন।
দুইজনের আদা রসুন ছেলা হলে একটা ব্লেন্ডার বের করে এনে বললো-
-এবারে এইগুলি পেস্ট বানিয়ে এইরকম কন্টেইনারে রাখবেন। তারপরে ব্লেন্ডারটা ধুয়ে পানি ঝরিয়ে ওখানে রেখে দিবেন। কিচেন ছেড়ে যাবার আগে ঐ যে কুরুনি ওটা দিয়ে পোলাওগুলি এই যে এই ভাবে কুরিয়ে রেখে যাবেন। কুরিয়ে রাখলে পোলাও ঝরঝরে থাকে, দেখবেন সারাদিন লাগাবেন না। দুপুর দুইটার মধ্যে সব শেষ করবেন।
এর মধ্যে মারুফ এলে তাকে বললো-
-আজকে ভাইছাবকে দিয়ে পোলাও রান্না করিয়েছি।
-বাহ! এইতো দেখলেন তিন দিনেই আপনি কুক হয়ে গেছেন। রাতে কি খাবেন বের করেছেন?
-না ভুলে গেছি।
-ঠিক আছে এবারে নিয়ে আসেন।
-সেহেরিরটা?
-হ্যাঁ ওটাও আনেন।
এক প্যাকেট ল্যাম্ব আর এক প্যাকেট মাছ এনে ভিজিয়ে রাখলেন।
মারুফ বললো –
-ভাইছাব আজকের ল্যাম্বটা আপনে রান্না করেন আমি বলে দেই।
-বলেন।
-একটু পরে বলি মাংসের বরফ গলতে দেন আগে।
আজকে বেশ নিরিবিলি মনে হলো, কোন তারা হুড়ো নেই। হাঁক ডাক নেই, সবার মন একটু ভিন্ন রকমের। বেশ গল্পে গল্পে চলছে কাজ কর্ম। প্রায় একটার দিকে মারুফ বললো-
-ভাইছাব এবারে মাংস ধুয়ে একটু পানি দিয়ে সেদ্ধ দেন এখানকার মাংস আমাদের দেশের মত না। এগুলি আগে সেদ্ধ করে রান্না করতে হয়।
একটু সেদ্ধ হলে মশলা দেখিয়ে বললো-
-চামচ নেন, এখান থেকে আমি যেমনে বলি তেমন পরিমাণ মশলা দেন, পিঁয়াজ নেন ওখান থেকে গরম মশলা তেজপাতা এগুলি দিয়ে এই চুলায় বসিয়ে দেন। সবসময় এই চুলাটা ব্যাবহার করবেন এটা ছোটতো তাই।
-আচ্ছা মারুফ ভাই, আপনারা জায়ফল জৈত্রি ব্যাবহার করেন না?
-না আমরা এখানে এগুলি করি না তবে আমি জানি ঢাকাইয়ারা মাংসে জায়ফল জৈত্রি দেয়। আচ্ছা যা যা বললাম তা মনে থাকবে?
-হ্যাঁ থাকতে পারে।