পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান অষ্টম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
অষ্টম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

কেমন করে করা হয় এই টুসু পুজো? ধানের তুষ দিয়ে টুসু পাতা হয়। গুঁড়িগোলা জলে গাবানো হয় একটি নতুন সরা। পাঁচটি বা সাতটি সিঁদুরের লম্বা দাগ টানা হয়। কাড়ুলী বাছুরের গোবরের গুলি রাখা হয়। রাখা হয় আকন্দ ও গাঁদা ফুলের মালা। পরিষ্কার ঘরে বা চালায় পিঁড়ির উপর রেখে টুসুকে বন্দনা করা হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর প্রদীপ জ্বালিয়ে, ফুল দিয়ে পুজো করা হয় সরাটিকে। গাওয়া হয় টুসুর গান। নারী জীবনের গোপন অব্যক্ত কামনা বাসনা, দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, জীবনের নানা চলমান ঘটনাপ্রবাহ – এসব কিছুই ফুটে ওঠে টুসু গানে।

টুসু যেন তখন আর দেবী নন। তিনি আমাদের ঘরের মেয়ে। পুজোর আসন থেকে নেমে এসে মিশে যান প্রতিটি নারীর সঙ্গে। টুসুর গানের মধ্য দিয়ে পুরুলিয়ার রুখা শুখা মানুষগুলির দুঃখ বেদনা যেন আনন্দের ফল্গুধারার মাঝে প্রবাহিত হতে থাকে। শত অভাব অনটন সত্ত্বেও এত গান, এত প্রেরণা, এত প্রাণের স্পন্দন এরা পায় কোথা থেকে – এটাই ভাবতে অবাক লাগে! সারা পৌষ মাস মেয়েরা টুসু পুজো করে আর পৌষ সংক্রান্তির দিন চৌডোল করে টুসুর বিসর্জন দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও বিশেষ করে দক্ষিণ মানভূম ও ধলভূমে টুসুর প্রতিমা করা হয়।

‘ছোবড়ি লো লবড়ি আরো তিল ছাঁই
বাটিতে করে ঘি গুড় দিব খাও টুসালে মাঈ।
টুসু সিনাছেন, গা দুলাছে হাতে তেলের বাটি
নুয়ে নুয়ে চুল ঝাড়ছেন, গলায় সোনার কাঁটি’।।

এমনি অজস্র টুসু গান –
‘পৌষ পরবে মকর পরবে
টুসুর পা পড়ে না গরবে।
বাড়িনাম’য় তমালের বন
কোকিল ডাকে ঘন ঘন।
আর ডেকো না বনের কোকিল,
টুসু আমার অচেতন’।

আরও একটি প্রচলিত টুসু গান –
‘তালতলে দাঁড়ালে টুসু
তালপাতে কি জল টেকে
ধর লক্ষণ মোমের ছাতা
টুসুর অঙ্গে জল পড়ে।’

টুসু গান আসলে মানুষের মনের কথা। সাধারণ লোকজীবনের সুখদুঃখ, হাসি-কান্না টুসুর সুরে ভেসে ওঠে।

টুসুর গান —
“এমন জাড় (শীত) ভাই দেখি নাই আগে/
গেল বুড়াবুড়ির দাঁত লাইগে/
টুসু হামার জাড়ের গ্যাঁদাফুল।
মকর সিনান করে বাঁধব চুল।”

পুরুলিয়া অঞ্চলে প্রচন্ড শীতের পরিপ্রেক্ষিতে হাসি ঠাট্টায় রচনা করা এমন টুসু গান।
জনপ্রিয় টুসুর গান –
“টুসু আমার মা
যা চাইবি চা/

টুসু আমার মা দেবী মা
শুধু দেয় কিছু নেয় না/

টুসু আমার ঠাকুর মা,
সর্বদা অনন্যা/
টুসু আমার মেয়ে
সুন্দরী সবার চেয়ে/
টুসু আমার ভালবাসা,
মেটে না কভু আশা/
টুসু আমার টুসুধ্বনী,
সর্বগুনে গুনমণী/
টুসু আমার প্রেমিকা
যা চাই, পাই তা/
টুসু আমার দেবী
খুশি হয় অভাবী/
টুসু আমার জীবন,
মরেও হয় না মরণ।”

গানের ভাষা আর সে গানে কখনো তাদের টুসু একেবারে আটপৌরে মেয়ে , তাদেরই মতন –

‘টুসু সিনাচ্ছেন , গা দলাচ্ছেন
হাতে তেলের বাটি
নয়ে নয়ে চুল ঝাড়ছেন
গলায় সোনার কাঠি…’

আবার কখনো তাকে নিয়ে গ্রাম্য কোন্দল –
আমার টুসু মুড়ি ভাজে, চুড়ি ঝনঝন করে গো
উয়ার টুসু হ্যাংলা মাগি, আঁচল পাইত্যে মাগে গো।

গাঁয়ের মেয়ে যখন শহরে চলে যায় লেখা পড়া শিখতে তখন সে কিছুটা শহুরে হয়ে যায় , হয়তো তার গ্রামের প্রতি টান কমে যায় , তেমনি একটা অভিমানের জায়গা থেকে গান বেরিয়ে আসে –

‘না রহিবেন গাঁয়ে টুসু যাবেন ইবার শহরকে
আলতা চরণ জুতায় ঢেকে দিবে না পা ডহর কে
গীত গাহিবেন অবাক কলে , পান কিনিবেন দোকান লে
বছর বছর সাধ জাগিলে আসতে পারেন উখান লে
গঙ্গা সিনান , সিনেমা টকি , গড়ের মাঠ আর কালীঘাট
বতর পাইলে লেখাপড়ায় হরেক কিসিম লিবেন পাঠ ‘

আবার টুসু যেন তাদের প্রিয় সখী , তাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার আহ্বান –

‘চল টুসু খেলতে যাবো রানীগঞ্জের বটতলা
অমনি পথে দেখাই আইনব কয়লাখাদের জল তুলা
উলোট পালট ফুলুট বাঁশিতে
আমার মন মানে না ঘরেতে …’

আবার এই টুসু কে, পৌষ মার সংক্রান্তির দিন বিদায় দিতে হবে , এক মাস ধরে ঘরে ছিল। তার সঙ্গে মনের প্রাণের কথা হয়েছে , তাই তাকে বিদায় মালা গান দিয়েই পরিয়ে দেওয়া –
“২৮ দিন যে রাখলি টুসু
২৮টি ফুল দিয়ে রে
আর রাখতে লারব টুসু
মকর হইল বাদি রে”

বিসর্জনের কারনও গানের মাধ্যমে জানানো হয়

“ জল জল করে টুসু
জলে তুমার কে আছে
আপন মনে ভাবে দেখ
জলে শ্বশুর ঘর আছে”
তথ্য সহায়তায়: আনন্দবাজার পত্রিকা

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

10 thoughts on “পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান অষ্টম পর্ব

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। শুভ নববর্ষ-২০২০
      শুভ নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানাই।
      জয়গুরু!

  1. টুসু গান মানুষের মনের কথা। সাধারণ লোকজীবনের সুখদুঃখ, হাসি-কান্না টুসুর সুরে ভেসে ওঠে। সুন্দর বলেছেন মি. লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী। ইংরেজী নতুন বছরের শুভকামনা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। শুভ নববর্ষ-২০২০
      শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
      জয়গুরু!

    1. ইংরাজী শুভ নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
      বছরের প্রতিটি দিন সুন্দর কাটুক। শুভ কামনা রইলো।
      জয়গুরু!

    1. নতুন আশা! 
      নতুন রেজোলিউশন! 
      নতুন উচ্চাকাঙ্ক্ষা! 
      আপনার জীবনে প্রেমের হাসি!
      আপনার জীবনে নেমে আসুক শান্তি, সুখ আর সমৃদ্ধি!
       
      আপনার সাফল্য নতুন বছরের ভাল সময়ের অপেক্ষা রাখে
      আসুন, আমরা সকলেই সম্মিলিত ভাবে বর্ষ-বরণ-2020 এ
      আনন্দে মেতে উঠি। জয়গুরু!

  2. অনেক অনেক শুভেচ্ছা প্রিয় কবি দা। পুনরায় শুভ নববর্ষ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।