পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- পঞ্চম পর্ব।
তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
গ্রাম বাংলার লৌকিক পরবগুলি বাঙালির জীবনের এক অমূল্য সম্পদ | শহুরে সভ্যতার করাল গ্রাসে যখন আস্তে আস্তে বাংলা ও বাঙালির পূর্ব ঐতিহ্য, ইতিহাস ও গৌরব স্তিমিত হয়ে আসছে তখন গ্রামের তুলসিতলার প্রদীপের শিখায় টিম টিম করে জ্বলছে বাংলার পরবের প্রাণ |
গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত জনপ্রিয় পরব বা উত্সজব টুসু উত্স্ব | বাংলার এই দুই দীন দুঃখিনী মেয়েকে গৌরীর মত ঐশ্বর্যমন্ডিত না হলেও বাংলার বর্ষীয়সী নারীরা তাদের নিজেদের মেয়েদের মতই আদর যত্ন করে পুজো করেন |
প্রথমে বলা যাক টুসুর কথা | টুসু হলেন লৌকিক দেবী, ফসলের দেবী। আমন ধান ঘরে আসার পর অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত একমাস ধরে টুসুদেবীর পূজো করেন মহিলারা। এ অনুষ্ঠানে দরকার হয় না কোন পুরোহিতের। পুরুষতন্ত্র এখানে হার মেনেছে। মেয়েরাই এর ব্রতী।
বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে টুসুকে তোষলা দেবী বলে। তার পরণে লাল, নীল কাগজের শাড়ি। হাতে – গলায় সোনালী রাংতার গয়না। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যায় বাড়ির মেয়েরা বেদি তৈরী করে মাটির। মেয়েরা পিটুলি গোলা দিয়ে তার উপর আঁকে আলপনা। শাঁখলতা, ঝুমকো লতা, পদ্ম, চাঁদ, সূর্য, ধানের ছড়া সহ আরও বহু কিছু গ্রাম বাংলার ছোট ছোট চিহ্ন আঁকা হয়। আঁকা শেষ হলে বেদির ওপর সাজিয়ে রাখে নিজের নিজের টুসু দেবীকে, তারপর আরম্ভ করে গান।
” উঠ উঠ উঠ টুসু
উঠাতে এসেছি গো
তোমারি সেবিকা মোরা
পূজিতে বসেছি গো। ”
টুসুগানের প্রায় সবই কবি গানের মতো হঠাত্ রচনা। কোন গানই মেয়েরা আগে থেকে তালিম দিয়ে তৈরি করে আসে না। এ গানে মেয়েরা তাদের মনের কথা টুসুকে জানায়। দৈনন্দিন খবরাখবর, দেশের সাধারণ সুখ-দুঃখের কথাও উঠে আসে গানে। এই সঙ্গীতের মূল বিষয়বস্তু লৌকিক ও দেহগত প্রেম। এই গান গায়িকার কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করে।
” যমুনার জলে
বাঁশি বাজে গো রাধা বলে।
যদি আমি থাকি ঘরে বাঁশি বাজে নাম ধরে।
শাশুড়ী ননদী ঘরে, কেমনে যাব চলে।
না জানে প্রেমের মরম, যাও সখি কর বারণ।
অসময়ে বাঁশি বাজে, যাব আমি কোন ছলে। ”
টুসু উত্সব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে চালের গুঁড়ো করা হয়। বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁচি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় ভাবে এই পিঠে গড়গড়্যা পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে ও পুর পিঠা নামে পরিচিত। বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়। এই রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্কা মহিলারাও টুসু গানে অংশগ্রহণ করেন। এই রাতে টুসু দেবীর ভোগ হিসেবে নানারকম মিষ্টান্ন, ছোলাভাজা, মটরভাজা, মুড়ি, জিলিপি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।
গোটা পৌষ মাস ধরে এই ভাবে টুসুদেবীর কাছে নিজেদের সুখ-দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করে দেশের দশের খবর জানিয়ে সংক্রান্তির দিন তাকে ভাসিয়ে দেওয়ার পালাও এসে যায়। এর আগের দিন রাতেই হয় টুসু-জাগরণ। মকর সংক্রান্তির দিন ভোর হবার আগেই ব্রতী মেয়েরা যে যার টুসুকে কোলে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলতে থাকে নদীর ঘাটের দিকে। যেন সবাই তার আদরের দুলালীকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে। টুসুকে ভাসিয়ে দেওয়া হল গাঙের জলে । একে একে সকলের টুসু চলল গাঙ দিয়ে ভেসে ভেসে । ভেসে যেতে থাকে এদের সংস্কৃতি, হারিয়ে যেতে থাকে এদের গান।
তথ্য সহায়তায়: dailyhunt
আমাদের ইতিহাস ওইতিহ্য গৌরবের
শুধু এর সংরক্ষণ জরুরী।মূল্যবান পোষ্ট। শ্রদ্ধা জানুন দাদা
সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হলাম।
জয়গুরু!
জানার কোন শেষ নাই। শিক্ষার কোন বয়স নাই।
আপনার সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম।
আন্তরিক শুভেচ্ছা রইলো। জয়গুরু!