প্রচন্ড উচ্চতা ভীতি আছে আমার।
ছেলেবেলায় দেখতাম, বন্ধুরা সবাই কি অবলীলায়
আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে, তরতর করে স্টিলের সিঁড়ি বেয়ে কলোনির পানির ট্যাঙ্ক এর ছাদে চড়ে বসতো! ওদের উপহাসে যদিও কখনওবা উঠতে চাইতাম আমি, একতলা উচ্চতায় উঠতেই, পায়ের তলায় শিরশিরে অনুভবে সারা শরীর আমার অবসন্ন হয়ে যেতো। মনে হতো এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।
ওর সাথে প্রথম পরিচয়ও হয়েছিলো এরকম এক পরিবেশে। একবার পাহাড় দেখার খুব শখ হলো আমার। অনেক সাহস করে লেক সংলগ্ন এক পাহাড়ে (মাটির টিলা ও বলা যায়) অন্যদের পিছু নিয়ে উঠলাম! মাটি কেটে ধাপ ধাপ করে বানানো সিঁড়ি। কোনোদিকে না তাকিয়ে কেবলই উঠে যাচ্ছিলাম।
যাইহোক, চূড়ায় উঠলাম অবশেষে। রেলিং দিয়ে ঘেরা ওই জায়গাটুকু। রেলিং এর এপাশ থেকে নিচের শহরটা দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগলো। এরপর মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে রেলিং এর আরো কাছে গেলাম। এখানটায় পাহাড়ের শরীর থেকে মাটি কেটে নেয়া হয়েছে। ক্ষত বিক্ষত পাহাড়ের শরীর সরাসরি নেমে গেছে প্রায় ৩শো’ ফুট নিচে। কি এক আকর্ষণে একটু ঝুঁকে একদম নিচের খাদ দেখতে চাইলাম। ভুলে গেলাম আমার উচ্চতা ভীতির কথা। মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিলাম রেলিং টপকে প্রায় ৩শো’ ফুট নিচে! কেউ একজন পিছন থেকে আমার হাত আঁকড়ে ধরলো শক্তভাবে। হয়তো কিছু সময়ের জন্য চেতনা হারিয়েছিলাম আমি।
একটু স্বাভাবিক হতেই আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সেই নারী মৃদু হেসে বললো,
– এ্যাক্রোফোবিয়ার পেসেন্ট হয়ে পাহাড়ে উঠলেন কেনো?
এই ছিলো ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। প্রথম দেখা। জলতরঙ্গের মতো ওর ঠোঁট থেকে বের হওয়া কথা শুনা। আসলে কিছুই শুনছিলাম না আমি। ওর ঠোঁটের নড়াচড়াই মুগ্ধ ভাবে দেখছিলাম।
ওর নামটা না-ই বললাম। সে তার কলেজের বান্ধবীদের সাথে এসেছিলো। একটু দূরে দাঁড়ানো তারা মিটিমিটি হাসছে। একটু বিব্রত হলাম। দেখলাম ঘাসের ওপর বসা আমি। সে আমার হাত ধরে আছে। সেদিকে তাকাতেই ও আলতো করে আমার হাত ছেড়ে দিলো।
এরপর যা হলো, একটু সিনেম্যাটিকই বলা যায়। ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো! ক্রমে তার বেগ বাড়বে এটা বুঝে নিচে নেমে যাবার তাড়া অনুভব করলাম। কিন্তু নামার সময় পিচ্ছিল মাটির সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে। ভেবে ভয় পেলাম। সে ও হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝলো। আবারও আমার হাত ধরে বললো,
– একা তো নামতে পারবেন না। একসাথে নামি চলুন।
এরপর আর বলার কিছু থাকে? এক অদ্ভুত বিভ্রমের আবেশে হাঁটছিলাম আমি ওর পাশাপাশি। ঠোঁটে গোপন হাসি আর মৃদু কলরব নিয়ে ওর বান্ধবীরা আমাদের পিছু নেয়। হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম। একপলক উপরে তাকালাম। মেঘবালিকাদের কষ্টে ছেয়ে ছিলো আকাশটা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ইলশেগুঁড়ি ভালোলাগায় আমাদের দু’জনের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভালোলাগা মিশছিলো গিয়ে লেকের জলে! এমনই মনে হলো আমার। এই শহরটাকে তখন মনে হচ্ছিলো কেবলি আমার!
এভাবেই প্রথম পরিচয় আমাদের। এরপর.. অনেক সময় পার হলো। বন্ধু হয় সে আমার। একসময় বন্ধুত্ব হয়ে যায় ভালোবাসা। এক অদেখা ভালোবাসা। যা থাকে শুধু অনুভবে। যদিও আমরা কেউ কাউকে বলতে পারিনি ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসা আমাদের দু’জনকে র্যাপিং কাগজে সযত্নে মুড়ে রেখেছিলো। প্রতিটি ভরা বর্ষার দিনে চকচকে পেভমেন্ট ধরে হেঁটে চলতাম আমরা। হাতে হাত রেখে। ওর শরীরের সুরভি মেখে থাকতো সেই পথে। আমাদের দু’জনকে দেখে হয়তো সেই চকচকে পেভমেন্ট আর জন্মে মানুষ হতে চাইতো!
এর পরের গল্প অন্য রকম। বন্ধুত্বের গতি আরো বেড়ে যায়। জীবিকার তাগিদে দু’জন দুই শহরে। মোবাইল তখনো আসেনি। টেলিফোনে কাছেদূরে অনুভবে সময় কাটে। কষ্টের হাহাকার বাড়ে সময়ে না পেলে, কাজে ব্যস্ত থাকলে। অভিমানে দু’পক্ষের-ই মন ভিজে যায়।
তারপর একটা ঝড় নেমে আসে একদিন। রেল লাইন দু’দিকে বেঁকে যায়। শুধু কষ্ট আর অভিমান খেলা করে। ক্ষীন একটা যোগাযোগ ভগ্ন সম্পর্ক হয়ে টিকে থাকে। নিয়তি বলে একটা কথা রয়েছে না? পারিবারিকভাবে ওর বিয়ে ঠিক হয়। আমাকে পছন্দ করেনি ওর অভিভাবকেরা। সে ও সবাইকে কষ্ট দিয়ে একবারে আমার কাছে চলে আসতে চায় না।
আমি শেষবারের মতো ওকে দেখতে চাই।
শেষবার ওর সাথে যখন দেখা হয়, সে মেঘবতী কন্যা হয়ে সমুদ্রের তীর ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিলো। পিছন থেকে ওর এলোচুলের গোছা, কানের পাশে গন্ধরাজ গোঁজা। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সব হারানোর অশ্রুধারা আমার দু’চোখ বেয়ে নেমে এলো। ওর দিকে তাকালাম। এক জোড়া মুগ্ধ চোখ অপেক্ষা করছে দেখতে চাইলাম। মনটা ব্যকুল হলো। ভাবলাম হয়তো ভুল ভেবেছি। ওর চোখে ভালোবাসার আলো জ্বলে উঠতে দেখলাম কি? কিন্তু আমার হাতদুটো ধরে, একটু ছুঁয়ে দিয়ে, নিজের গন্তব্যে সে চলে যেতে চাইলো আবার দেখা হবে বলে।
ট্রেন স্টেশনে বিষন্ন মন নিয়ে পৌঁছালাম। কি এক হারানোর শূন্যতা ছিল মনে। জানতাম এখন ওকে চলে যেতে দিলে, আমি আর কখনোই পাবো না ওকে!! ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্যে, এই প্ল্যাটফরমে আর কোনো ট্রেণ আসবে না।
ট্রেন এসে পৌঁছালো স্টেশনে। ও চলে গেলো…
আমার উচ্চতা ভীতির কারণে আমরা কখনো আর পাহাড়ে উঠিনি। ও বলতো, ‘পাহাড় আর সমুদ্র পাশাপাশি থাকে। উপর থেকে নিচে দেখার দরকার নাই তোমার। তুমি নিচ থেকে উপরে দেখবে। আমি তোমার পাশে হাত ধরে বসে থাকবো। আমরা সোনালী ডানার চিল আর সমুদ্রের ঢেউ দেখবো পাশাপাশি বসে!’
আমি আর কখনোই উপর থেকে নিচে দেখিনি। ও আমাকে ছেড়ে এতটা উপরে চলে গেলো, নিচে থেকে দেখা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় রইলো না!
সেই থেকে একাকি সাগরপাড়ে প্রতীক্ষায় আছি ওর! পাশাপাশি বসে সোনালী ডানার চিল দেখে দেখে সাগরের গর্জণ শুনবো বলে।।
আজ ও নেই
আমারও কোনো শহর নেই।।
.
#হারানো_শহর_মামুনের_অণুগল্প_৫৫১
অণুগল্পটি পড়লাম।
অণুগল্পের যে বৈশিষ্ট অন্তত আমার জানামতে সেটা ঠিক এই রকম যে, অণু'র মধ্যেই থাকবে বিশালত্ব। কনসেন্ট্রেটেড। আপনার শুধু এই লিখাটিই নয়; অন্যান্য সব অণুগল্প আমি প্রায় সবটাই পড়ে দেখেছি। আমার কাছে অণুগল্পের সব উপদানই আপনার লিখায় রয়েছে বলে মনে হয়। অভিনন্দন মি. আল মামুন খান। নিরাপদে থাকবেন।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
অনেকদিন পর প্রিয় শব্দনীড়ে এলাম, অসাধারণ লাগছে। বিশেষ করে এর নতুন ‘ইউজার ইন্টারফেস’ খুব ভালো লাগলো।
আমার অণুগল্পে আপনার মন্তব্যে লেখার প্রেরণা পেলাম। ইনশাআল্লাহ লিখে যাবো।
গুড লাক মি. মামুন। গুড লাক।