ক্রিক নদী
যুদ্ধ নয়, শান্তি চাইভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শত্রুতার ইতিহাস দীর্ঘ, যার সূচনা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের মধ্য দিয়ে। যদিও এই বিভাজন ধর্মের ভিত্তিতে হয়েছিল, তবু পরবর্তী সময়ে যেসব যুদ্ধ, সংঘর্ষ বা উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, তার মূল কারণ ছিল ভূখণ্ডগত বিরোধ, কাশ্মীর সমস্যা, পানি সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, সীমান্ত লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াই। ধর্ম এখানে একটি আবরণ মাত্র, মূল চালিকাশক্তি নয়।
এই যুদ্ধকে কেউ কেউ ধর্মীয় যুদ্ধ হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এটি বাস্তবতার অতিসরলীকরণ ছাড়া কিছুই নয়। যুদ্ধ কখনোই শুধুমাত্র ধর্ম বা আবেগ দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না। রাষ্ট্রীয় কূটনীতি, প্রতিরক্ষা কৌশল, আঞ্চলিক স্বার্থ এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন—এসবই যুদ্ধ ও শান্তির পিছনে থাকা প্রধান প্রভাবক।
ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে প্রায় ৪০ কোটি মুসলমান সহ হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ নানা ধর্মের মানুষ সহাবস্থান করছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র, আর বাংলাদেশেও রয়েছে বিপুল মুসলমান জনগোষ্ঠী। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মিলিত মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ৩৯ কোটি, যা ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় সমান। এই পরিসংখ্যান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—যদি দ্বন্দ্ব কেবল ধর্মীয় হতো, তাহলে ভারতের এই বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা ভিন্ন হতো।
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মুসলিম, শিখ, হিন্দু, খ্রিস্টান—সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। কর্নেল সুফিয়া কোরেশীর মতো একজন মুসলিম নারী যখন যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন, অথবা একজন শিখ নারী যখন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন, তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে ধর্ম নয়, দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ এবং রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠাই আসল শক্তি। সেনাবাহিনী কখনো ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয় না, তারা রাষ্ট্রের জন্য একসঙ্গে লড়ে।
তবে দুঃখজনকভাবে, যুদ্ধ বা উত্তেজনার সময় সমাজে কিছু গোষ্ঠী ঘৃণা ছড়িয়ে রাজনৈতিক বা আদর্শিক সুবিধা আদায় করতে চায়। তারা যুদ্ধকে ‘ধর্মীয় যুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত করে মানুষের মধ্যে বিভাজন ও সন্দেহের দেয়াল গড়ে তোলে। এরা ভুলে যায়, প্রকৃত ইতিহাস বলে, যুদ্ধ যতই ভয়াবহ হোক, তা পরিচালিত হয় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা; ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা ধর্ম সেখানে গৌণ।
আজকের বিশ্বে আমরা চাই না আরেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়। আমরা চাই না এক দেশের সাধারণ মানুষের উপর আরেক দেশের ঘৃণার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হোক। একজন মুসলিম যখন ভারতের জন্য প্রাণ দেয়, বা একজন হিন্দু যখন পাকিস্তানে নির্যাতনের শিকার হন, তখন আমাদের বোঝা উচিত—যুদ্ধ ধর্ম দেখে আঘাত করে না। শান্তিও ধর্ম দেখে আসে না। শান্তি আসে ন্যায়ের ভিত্তিতে, সহানুভূতির মাধ্যমে এবং একে অপরের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করার মধ্য দিয়ে।
ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হোক শান্তি ও সহযোগিতার ভিত্তিতে। যুদ্ধ নয়—মানবতা, সৌহার্দ্য, ও সহাবস্থানই হোক আমাদের একমাত্র পথ।