এক দুখিনী মায়ের জীবনযুদ্ধ

তেঁতুলিয়া বন্দরের পাশে দক্ষিন বাড়ি গ্রাম। এই গ্রামের বড় বউ মা ছিলেন আলেমা। তিনি বিবাহিত জীবনে দুই ছেলে-চার কন্যার জননী। শ্বশুর-শাশুড়ী, দেবর-ননদ সবার মন জয় করে ভালই ছিল তাদের সংসার। সংসার পরিচালনার জন্য স্বামীর ছোট একটু চাকুরি একমাত্র ভরসা। নববধু আলেমা বুঝতে পারেন স্বামীর চাকুরির স্বল্প বেতন দিয়ে সংসার পরিচালনায় বেশ কষ্ট হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিল স্বামীর সংসারে সহায়তা করার। এজন্য প্রতিবেশী গ্রামের ধর্নাঢ্য লোকের বাড়ির থেকে তিন থেকে চার কাঠা মুড়ির ধান নিয়ে আসেন। আনায়নকৃত ধান চুলায় সিদ্ধ ও শুকায়ে ঢেঁকিতে চাউল করে মুড়ি ভাজেন। এই কাজে তার দু’এক কাঠা বাড়তি মুড়ি তা সংসারে খাবারের পর কিছু বিক্রি করেন। আলেমা এভাবে স্বামীর সংসারে খরচ যোগাতে সহায়তা করেন।

ইতোমধ্যে বড় ছেলে রবুল জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ছেলের চিকিৎসার জন্য তার পরিশ্রম আরও বাড়াল। কিন্তু দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরও ছেলের স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি হল না। আদরের ছেলের রোগাক্রান্ত দেহ দেখে নিজে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলেন। ছেলের রোগ মুক্তির জন্য যে গ্রামে কবিরাজ আর উঝা-মাহান আছে সবার কাছে ছুটে গেলেন। এত কিছুর পরও ছেলেকে বাঁচাতে পারল না। কিশোর ছেলের মৃত্যুর শোকে নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। পাড়া প্রতিবেশী লোকজনের স্বান্ত¦নায় ছেলের মৃত্যুর শোক সহ্য করে আলেমা। ছেলে হারানো শোক আর চাপা কান্নায় তার দু’চোখের নীচে কালো দাগ যেনো বহমান শুকনা নদীর সাদৃশ্য। এই শোক সামলে নিয়ে যথারীতি সংসারের কাজ করেন। আর অবকাশ পেলে ছেলের কবরের পাশে গিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। বড় ছেলেকে হারানোর পরে ছোট ছেলে রাহুলকে নিয়েও বেশ চিন্তিত। কারণ বড় ছেলের দেহের অসুখ যদি তার শরীরে দেখা দেয়..?

ইতোমধ্যে রাহুল এগারো বা বারো বছর বয়সে পৌছাল। আলেমা রাহুলের শরীর দেখে অনুভব করে; প্রতিনিয়ত ছেলের চোখ ও মুখে হলদে প্রকৃতি হয়ে উঠছে। কারো মনে সাই না দিলেও মায়ের মনে ঠিকই জানা পরে এই রোগ যেনো বড় ছেলে মরেছে। আলেমার অভিজ্ঞতা জানান দেয় রাহুলের শরীরে জন্ডিস ধরেছে। একমাত্র কলিজার টুকরা ছেলেকে বাঁচানোর জন্য পাড়া প্রতিবেশী লোকজন যত চিকিৎসা ও কবিরাজ দেখালেন পুরোপুরি তা পালন করেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যে তার কোল খালি করে রাহুলকেও নিয়ে যাবে এটাই সত্য। কিছু দিনের মধ্যে রাহুলও মারা গেলো। আলেমা পরপর দু’ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায়।

বড় কন্যা রাবিয়া মায়ের বুক চাপা কষ্টের কান্না দেখে সর্বক্ষণ পাশে থেকে স্বান্ত¦না দেন। কিন্তু সে কোন ভাবে মা’র ছেলে হারানোর শোক পূরণে করতে পারছে না। এভাবে ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বুকে চাপা কান্নায় দিন কাটে আলেমা। আবারও পাড়া প্রতিবেশী লোকজন যথারীতি স্বান্ত¦না দিয়ে সমবেদনা জানান। স্বামীও তাকে স্বান্ত¦না দেন; আল্লাহ মাল তিনি নিয়েছেন; এতে ধৈর্য রাখ। সবার সমবেদনা পেয়ে ধীরে-ধীরে দুই ছেলে হারানোর বেদনা কিছুটা সেরে উঠেন। এবার আলেমা একটি পুত্র সন্তানের আশায় পর্যায়ক্রমে তিনটি সন্তান নেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাকে সব কয়টি কন্যা সন্তান দান করেন। ইতোমধ্যে বড় কন্যা রাবিয়াকে পাত্রস্থ করেন।

স্বামীও ছেলে সন্তান পেতে খুব আগ্রহী। তাই আলেমার সাথে সলাপরামর্শ করে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। এই সতীনের ঘরে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এখন স্বামীর স্বল্প আয় দ্বারা দু’সংসারের খরচ বহন করা খুব কষ্টসাধ্য। সংসারের অভাব মিটাতে আলেমা আবারও পুরনো কাজে ফিরে যান। নাবালিকা তিন-কন্যাকে নিয়ে টানা-পরানের মাঝে তার খুব কষ্টের সংসার।

ইতোমধ্যে স্বামীর শরীরে দেখা দেয় দূরারোগ্য ব্যাধি। সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তিটিও পুরোদমে অক্ষম হয়ে গেলো। এখন তার দুঃখের সীমা অন্ত রইল না। সংসারে নাবালিকা তিন কন্যা আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে মহা বিপাকে। এ অবস্থায় সতীন তার কোলের শিশুকে নিয়ে মায়ের বাড়িতে চলে গেলো। এখন স্বামীর সুচিকিৎসার জন্য তাকে নানা জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হল। কিন্তু স্বামীকে পুরোপুরি সুস্থ করতে পারল না। বরং স্বামীর হাটা চলাও থমকে গেলো। পরে স্থানীয় হাসপাতালের দি ল্যাপরোসি মিশনের মাঠ কর্মীদের সহায়তায় ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী মিশনে চিকিৎসার সুযোগ পেল। মিশন হাসপাতালে স্বামীর শরীরে কয়েকবার অস্ত্রপচার করা হল। সম্ভবত তার স্বামীর পা ও হাতের অঙ্গুলি থেরাপির মাধ্যমে কেটে ফেলে দেন। সেখান থেকে স্বামী বাড়িতে ফিরে আসেন। স্বামী কিছুদিন ক্যারেজ সাহায্যে হালকা চলাফেরা করতে শুরু করল। কিন্তু স্বামীর পক্ষে সংসারের উপার্জনের জন্য কোন কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। অসুস্থ স্বামী কখনো সতীনের ঘরে; কখনো তার ঘরে সময় কাটেন। বছর চারেক পরে স্বামীরও মৃত্যু হল। এখন বিবাহ উপর্যুক্ত কন্যাদের নিয়ে বেশ চিন্তিত। তার মনের সাহস; চিন্তা করেই লাভ কী..? তাকে তো সংসারের ঘানি টানতেই হবে। সব কষ্ট সহ্য করে হাতের সহায় সম্বল নিয়ে মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করেন। এই কাজের উপার্জিত টাকা-পয়সা ও স্বামীর দেয়া ভিটেমাটি বিক্রি করে কন্যাদের পাত্রস্থ করেন।

দ্বিতীয় কন্যার জামাই বাবু বাড়ির ভিটেমাটি নিয়ে শাশুড়িকে ঠাঁই দেন। কিন্তু আদরের দু’ছেলে আর স্বামীকে হারানোর অকাল বেদনা যেনো তার মন থেকে সরেনি। এখন বয়স্ক শরীরটা শুকায়ে মনে হয় কংকাল সাদৃশ্য। আলেমার জীবনের বাকি সময়টুকু হয়তো কন্যা জামাইয়ের সংসারেই কেটে যাবে। #

এম এ বাসেত সম্পর্কে

সাংবাদিক এম.এ. বাসেত গত ১৯৮৫ খ্রি. তেঁতুলিয়া সদরের বারঘরিয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মো. নিজাম উদ্দিন, মাতার নাম মোছা. আয়েশা খাতুন। পরিবারে ৬ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। শৈশবে তেঁতুলিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পাসের পর কালান্দিগঞ্জ ফাযিল মাদরাসা থেকে দাখিল/এসএসসি সমান বোর্ড পরীক্ষায় ১৯৯৯ খ্রি. দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ২০০৩ খ্রি. তেঁতুলিয়া ডিগ্রী কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচ.এস.সি বোর্ড পরীক্ষায় জিপিএ ২.৫০ পেয়ে সাফল্যের সংগে উত্তীর্ণ হন। ২০০৭ খ্রি. সালে মকবুলার রহমান সরকারি কলেজ পঞ্চগড় (পঞ্চগড় এম আর কলেজ) থেকে ইতিহাস বিভাগে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় ২য় শ্রেণিতে এবং ২০০৮ খ্রি. রংপুর কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ থেকে ইতিহাস বিষয়ে মার্স্টাস ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি শৈশবে কবিতা ও ছোট গল্প লিখার মধ্যে দিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের সহযোগিতায় ২০০০ সালে দিনাজপুর জেলার পাবর্তীপুর উপজেলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক উত্তরের আলো পত্রিকার মাধ্যমে মফস্বল সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে ২০০১ সাল থেকে দৈনিক করতোয়া পত্রিকায় তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে অদ্যাবধি কাজ করে আসছেন। এছাড়া ২০০৪ সালে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বর্তমানে তিনি দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে আসছেন। তিনি দৈনিক করতোয়া পত্রিকার উপসম্পাদকীয় পাতায় বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত কলাম লিখে আসছেন। ইতোমধ্যে তাঁর অর্ধশতাধিক কলাম প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ২০১৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থ মেলায়, শিক্ষা তথ্য পাবলিকেসন্স থেকে তাঁর লিখা ‘‘ লাল সবুজের পতাকা হাতে যুদ্ধা ফিরে ঘরে” এবং ”স্মৃতির কাছে’’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ বই প্রকাশ হয়েছে। তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ঋণ সহায়তা নিয়ে ২০০১ সালে তেঁতুলিয়া উপজেলায় জেনুইন কম্পিউটার কমপ্লেক্স নামে একটি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার চালু করেন। পরবর্তীতে উক্ত ট্রেনিং সেন্টারটিকে বাংলাদেশ কম্পিউটার এডুকেশন (বিসিই) তেঁতুলিয়া শাখা হিসেবে রুপান্তর করেন এবং পরিচালক ও ট্রেইনার হিসেবে বেকার-যুবক/যুব মহিলা ও ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মনির্ভরশীল প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। তিনি ২০০৪ সালে পঞ্চগড় জেলার শ্রেষ্ঠ যুব সংগঠক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

6 thoughts on “এক দুখিনী মায়ের জীবনযুদ্ধ

  1. দুঃখিনীর মায়ের জীবন যুদ্ধের কথা জানতে পারলাম।
    আমাদের এই ধরনের আলেমাদের সংখ্যা অগনন। আপনার এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাঁদের একজনের দুঃখগাঁথা। সেই অনেক গ্রামীন বাস্তবতা আপনি তুলে ধরেছেন।

    আপনাকে ধন্যবাদ জানাই প্রতিবেদনটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।

    কিছু বানান বিভ্রাট আছে, শুধরে নিলে পড়তে আরো ভাল লাগবে। শুভেচ্ছা সতত।

  2. এই লিখা গুলোন পড়লে মন আর্দ্র হয়ে উঠে। :(

    অট: এফবি’র ইনবক্সে আপনার জন্য আমার একটি প্রশ্ন ছিলো। দেখবেন। ধন্যবাদ।

    1. জনাব আসসালামু আলাইকুম। আমি নিয়মিত লগ আউট করব। ভাল থাকবেন।

    2. আমার জানতে চাওয়াটা আপনি বোঝেন নাই।
      ফেসবুকে আপনার ইনবক্সে আমার একটি বার্তা রয়েছে। দেখবেন। :)

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।