প্রথমত: পয়লা বৈশাখ বাঙালের সার্বজনীন উৎসব ছিলো না। পয়লা বৈশাখ ছিলো বাঙালের দায়মুক্তির প্রহসন। রাজা, জমিদারদের খাজনা পরিশোধ আর মওকুফের মাধ্যমে নতুন দাসত্বের সূচনার জন্য পয়লা বৈশাখের জন্ম। পয়লা বৈশাখকে পয়দা করার ক্ষেত্রে বাঙালের ঐতিহ্য প্রাধান্য পায়নি, প্রাধান্য পেয়েছে সম্রাট আকবরের খাজনা আদায়ের সুযোগসুবিধার হিসাব নিকাশ।
দ্বিতীয়ত: বাঙালি বইলা যারা নিজেদের খুব গর্বিত ভাবেন, যারা নিজেদের আর্য রক্তের ধারক-বাহক হিসাবে আভিজাত্য প্রকাশ করেন তারা প্রকৃতপক্ষে সুবিধাবাদী দালাল। কারন ভূমিপুত্র বাঙাল থেকে বিশেষ হতে যাওয়া, বিশেষ হয়ে ওঠার কালচারেই বাঙালি গোষ্ঠীর জন্ম। বাঙাল পরিচয়ে তারা হীনমন্যতায় ভুগতো। এই কালচাঁড়াল বাঙালরা মোগল আমলে নায়েব হতে ছুটেছে আর ইংরেজ আমলে বাবু হতে চেষ্টার কসুর করেনি। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে আর নিজেদের পিঠে শিক্ষিত লেবেল এটে এরাই ভূমিপুত্র বাঙালদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এসেছে এবং আসছে। এই বাঙালিরাই লুঙ্গি আর ধূতিকে অসভ্য পোশাকে পরিণত করেছে, আবার প্যান্টুলুন আর চোস্ত পায়জামা-শেরোয়ানিকে সভ্য পোশাকের মর্যাদা দিয়েছে। গিলে করা পাঞ্জাবি ছাড়া আজও তথাকথিত বাঙালি কালচাঁড়াল বাবুর চলেই না।
তৃতীয়ত: বাঙালি নয়, একমাত্র বাঙালরা এই ভূখণ্ডের প্রকৃত ভূমিপুত্র। বাঙালের যা কিছু অর্জন এমন কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত তাতে ভাগ বসিয়েছে এই ভূইফোঁড় বাঙালি গোষ্ঠি। বঙ্গবন্ধু ৭মার্চ যে ভাষণ দিয়েছিলেন সে ভাষণের শব্দ চয়ন আর ভাষা প্রমিত ছিলোনা, ছিলো নিপাট বাঙালের ভাষা। বাঙালই অস্ত্র তুলে নিয়েছিলো, আজও তারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অবহেলিত, অপাঙ্কতেয়, রাজনীতির মাখন মালাই খাবার জন্য বাঙালি বাবুদের মত কখনো হামলে পরেন নাই।
চতুর্থত: পয়লা বৈশাখ বাঙালের দায়মুক্তির প্রহসন হিসেবে শুরু হলেও এখন তা বাংলাদেশের বাঙালের একমাত্র সার্বজনীন সামাজিক ও জাতীয় উৎসব। বাঙাল এই উৎসবকে নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে, নিজের আয়ত্তে নিয়েছে। কিন্তু বাঙালের এই সার্বজনীন উৎসবকে কালচাঁড়াল বাঙালিরা নিজেদের দখলে নিতে চেষ্টা করবে না, তা কি হয়! তাই তারা বাঙালের নিত্যদিনের পান্তাকে পরিণত করেছে উৎসবের খাবারে, বাঙাল যে মৌসুমে সচেতনভাবেই ইলিশ পরিহার করে তখন ঐতিহ্যের তকমা এটে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশের মিশেল দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে তথাকথিত ঐতিহ্য। আগে অবহেলিত বাঙালরা বিস্মিত হতো- ‘বাবুরা দেখি পান্তা খায়।’ আর এখন খলবলিয়ে হাসে আর বলে- ‘ভণ্ডামির একটা সীমা থাকা উচিত।’
পঞ্চমত: বাঙালের ঐতিহ্য হলো শুভ কিছু পালনে মিষ্টি খাওয়া ও খাওয়ানো। নববর্ষে মিষ্টি আর দইয়ের সাথে চিড়া, মুড়ি, মুড়কি, খই, বাতাসা, ওখরা, তিলের খাজা, কদমা, পিঠি খাওয়া এবং খাওয়ানো বাঙালের ঐতিহ্য। এছাড়া যে কোনো উৎসব উপলক্ষ্যে ভালো খাবার খাওয়াও বাঙালের চরিত্র। লোকগান ও যাত্রাপালাও বাঙালের একান্ত ঐতিহ্য।
ষষ্টত: কেউ যদি ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে আর বাঙালের কালচারের দোহাই দিয়ে পান্তা-ইলিশের কথা, বটতলায় রবীন্দ্রসংগীত আর কেলোয়াতি গান শুনে বাঙালি কালচার নবায়নের তথাকথিত হাজার বছরের তত্বকথা শোনায়- তাদের বোঝান সেটা বাঙালির কালচার হতে পারে, এই দেশের জনসংখ্যার ৯৯.৯৯% বাঙালের কালচার নয়। তারপরেও যদি তর্ক করে, বাঙালের ঐতিহ্যবাহী প্যাদানি দিতে ভুলবেন না।
সপ্তমত: নববর্ষ পালন করুন নিজের মত। শিকড়ে ফিরতে হলে সঠিক ঐতিহ্যে ফিরুন, ভুল ঐতিহ্যে নয়। নতুন প্রজন্মকে দেশী খাবার, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আপনার- আমার সকলের।
পুনশ্চ:
রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ, কেলোয়াতি গানও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষার নামে সাত সকালে গাছের তলায় রবীন্দ্রনাথ গাওয়া আর কেলোয়াতি গান গাওয়াকে বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা ‘শিক্ষিত না-বাবু না-বাঙাল গোষ্ঠী’র হুতাশনের বেশী কিছু নয়।
পূনর্প্রকাশ
‘নববর্ষ পালন করুন নিজের মত। শিকড়ে ফিরতে হলে সঠিক ঐতিহ্যে ফিরুন, ভুল ঐতিহ্যে নয়। নতুন প্রজন্মকে দেশী খাবার, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আপনার- আমার সকলের।’
___ অসাধারণ সপ্তব্যঞ্জন।
ধন্যবাদ আজাদ ভাই।
চমৎকার লিখা আঙ্কেল।
বন্ধু শাফি উদ্দিন। পৃথিবীতে আজ তুমি নেই। জান্নাতে ভালো থেকো। তোমার বিদেহী আত্মা শান্তিতে থাক। আমাদের সকলের দোয়া তোমার সাথে।
শাফি ভাই। আপনার স্নেহ কখনও ভুলবো না। ইন্নালিল্লাহি … রাজেউন।
শাফি ভাই। আপনাকে ভুলিনি।
ইন্নালিল্লাহ। শাফি ভাই ভালো থাকুন।
নববর্ষ পালন করুন নিজের মত। শিকড়ে ফিরতে হলে সঠিক ঐতিহ্যে ফিরুন, ভুল ঐতিহ্যে নয়। নতুন প্রজন্মকে দেশী খাবার, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আপনার- আমার সকলের।
একদম ঠিক কথাই বলছেন আনোয়ার ভাই।
অসাধারণ।
এই কথাগুলোই ব্লগে কেউ বলুক তাই চাইছিলাম।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আশা পুরণ করে দিয়েছি আপা/ভাবী। ধন্যবাদ।
পয়লা বৈশাখ বাঙালের দায়মুক্তির প্রহসন হিসেবে শুরু হলেও এখন তা বাংলাদেশের বাঙালের একমাত্র সার্বজনীন সামাজিক ও জাতীয় উৎসব। বাঙাল এই উৎসবকে নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে, নিজের আয়ত্তে নিয়েছে।
আপনি যে তথ্য দিয়েছেন তা ঐতিহাসিক সত্য —–
পয়লা বৈশাখ বাঙালের সার্বজনীন উৎসব ছিলো না। পয়লা বৈশাখ ছিলো বাঙালের দায়মুক্তির প্রহসন। রাজা, জমিদারদের খাজনা পরিশোধ আর মওকুফের মাধ্যমে নতুন দাসত্বের সূচনার জন্য পয়লা বৈশাখের জন্ম। পয়লা বৈশাখকে পয়দা করার ক্ষেত্রে বাঙালের ঐতিহ্য প্রাধান্য পায়নি, প্রাধান্য পেয়েছে সম্রাট আকবরের খাজনা আদায়ের সুযোগসুবিধার হিসাব নিকাশ।
অন্যদিকে এ তথ্যও সত্যি—-
চৈত্রসংক্রান্তি হিন্দুদের ‘চৈত্র সংক্রান্তি পূজা’ থেকে নেওয়া হয়েছে। হিন্দুরা যুগ যুগ ধরে চৈত্র মাসের শেষ দিন এটি উদযাপন করে আসছে ।
এ ছাড়া বাংলা পিডিয়াতে আরো বলা হয়েছে, “চৈত্রসংক্রান্তির দিন বাংলায় শিব কেন্দ্রিক একটি বিশেষ উৎসব পালিত হয়। এটি “চড়ক পূজা” নামে পরিচিত।
চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ দিন এ পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে।”
“চড়কপূজা উপলক্ষ্যে, আগের দিন চড়ক গাছকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। তারপর এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয় যা পূজারীদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত। পতিত ব্রাক্ষণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করে। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হল, কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির উপর লাফানো, শিবের বিয়ে, অগ্নি নৃত্য, চড়কগাছে দোলা ইত্যাদি। এইসব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের উপর বিশ্বাস। এর অনুষ্ঠানাবলী প্রাচীন কৌম সমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা “চড়ক সংক্রান্তি” বা “চৈত্র সংক্রান্তির মেলা” নামে পরিচিত।”
হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের এসব ঐতিহাসিক তথ্য যেমন সত্যি তেমনি এও সত্যি বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের উৎসব নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে।
কিছু কিছু বাড়াবাড়ি রয়ে গেছে অবশ্যই।
শুধু বাড়াবাড়ি না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে।
যে আয়োজন চারদিকে দেখা যাচ্ছে তাতে পহেলা বৈশাখ সার্বজনীন উৎসব এর বদলে বিত্তবানদের উৎসবে পরিনত হচ্ছে ধীরে ধীরে।
@ নীল সঞ্চিতা
গত বিশ বছর আগেও শহুরে মধ্যবিত্ত বাংলা নববর্ষ তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখতো না আর উচ্চবিত্তরাতো নাই ই। বাংলা সন ছিলো গ্রামের মানুষের (চাষাভূষার) সন। তাদের মহাজনের সাথে ঋনের হিসাব করা – ব্যবসায়ীদের হালখাতা করা আর কৃষকদের খাজনা দেওয়ার জন্যে অবশ্যই এই দিনটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ন ছিলো।
ছায়ানট মুলত একে টেনে এনেছে শহরে – রবীন্দ্রনাথকে ভর করে মধ্যবিত্তের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে এই নববর্ষ। ১৯৬৭ সালে প্রথম ছায়ানট রমনার বটমুলে গানের আসর করে – স্বাধীর হওয়ার পর থেকে এর পরিধি বাড়ছে। আর মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সাল থেকে – এর উদ্যোক্তার এইটাকে সার্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসাবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
গ্রামের “বছর পয়লা” শহরে এসে পহেলা বৈশাখ হওয়ার সাথে সাথে নতুন একটা উপসর্গ এসে জড়িয়ে গেছে – তা হলো পান্তা-ইলিশ। বিত্তবানদের ইলিশ কেনার প্রতিযোগীতা আর তার ছবি ফেইসবুকে দেওয়ার রেওয়াজটা যে হাজার বছরের সংস্কৃতি না এইটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিত্তবানদের সম্পদের প্রদর্শনী শুধু যে পহেলা বৈশাখেই হয় তা না -হয় ধর্মীয় উৎসবেও। যাদের অনেক আছে তারা দেখাবে – আর যাদের নাই তারা দেখবে – এইটা অবশ্য হাজার বছরের ঐতিহ্য।
রমজান, ঈদ আর শবেবরাতে এর চেয়ে অনেক বেশী অনিয়ম হয় – যা ইসলামের দৃষ্টিতে কঠিন অন্যায় – আমার মনে হয় যারা ইসলাম নিয়ে ভাবেন – তারা আগে নিজের ঘর সাফ করা উচিত।
পহেলা বৈশাখ ধর্মীয় উৎসব না – সেখানে ধর্ম পালন করতে কেউ যায় না। তার বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া মানেই হলো সীমার বাইরে যাওয়া।
বাংলাদেশের নাস্তিকে ইসলামধর্মের প্রতি এতোটাই অসহিষ্ণু যে – অনুষ্টানের আগে এরা নিশ্চিত করে এই ধর্মের অনুসারীরা যথেষ্ঠ বিরক্ত হয়েছে কিনা!
বাংলাদেশের নাস্তিকে ইসলামধর্মের প্রতি এতোটাই অসহিষ্ণু যে – অনুষ্টানের আগে এরা নিশ্চিত করে এই ধর্মের অনুসারীরা যথেষ্ঠ বিরক্ত হয়েছে কিনা! এটা খুবই দুঃখজনক আর চরম বাড়াবাড়িও বটে। আর প্রতিটি বাড়াবাড়ি নিয়ে আসে বেদনাদায়ক ঘটনা।
থার্ড আই ভাই মাথা ঠাণ্ডা রাখেন।
বাঙালরা মোগল আমলে নায়েব হতে ছুটেছে আর ইংরেজ আমলে বাবু হতে চেষ্টার কসুর করেনি। ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে আর নিজেদের পিঠে শিক্ষিত লেবেল এটে এরাই ভূমিপুত্র বাঙালদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এসেছে এবং আসছে। এই বাঙালিরাই লুঙ্গি আর ধূতিকে অসভ্য পোশাকে পরিণত করেছে, আবার প্যান্টুলুন আর চোস্ত পায়জামা-শেরোয়ানিকে সভ্য পোশাকের মর্যাদা দিয়েছে। গিলে করা পাঞ্জাবি ছাড়া আজও তথাকথিত বাঙালি কালচাঁড়াল বাবুর চলেই না। স্বীকার করি।
ধন্যবাদ।
আগে অবহেলিত বাঙালরা বিস্মিত হতো- ‘বাবুরা দেখি পান্তা খায়।’ আর এখন খলবলিয়ে হাসে আর বলে- ‘ভণ্ডামির একটা সীমা থাকা উচিত।’ ছক্কা হাঁকিয়েছেন হরবোলা ভাই।
ক্যাঁচ ধরতে পারেন নাই। ছক্কা তো যাইবোই।
নববর্ষ পালনে বা শিকড়ে ফিরতে হলে সঠিক ঐতিহ্যে ফিরুন, ভুল ঐতিহ্যে নয়। :yes:
ঠিক বলছেন আপা।
নববর্ষ ঠিক আছে আমিও মানি। শুভেচ্ছা জ্ঞাপনও করি। তারপরও মনে হয় কোথাও একটি প্রবলেম রয়ে গেছে। ভণ্ডামি। হ্যাঁ, এই কথাটিও অতিরিক্ত নয়।
ধন্যবাদ সৌমিত্র ভাই।