পিতাগোরাসের মহাউচ্চতর গণিত
অটো হইলো গিয়া ব্যাটারিচালিত টেম্পু। অটোতে চড়লে সবসময় সামনের সিটে অর্থাৎ ড্রাইভারের লগে বসি। স্বভাবদোষে তাগো লগে কথা কই, তাগো কথা শুনি, তাগোর চোখ দিয়া আরেকটা দুনিয়ার কোনাকাঞ্চিতে উকি মারি, তাগো দুনিয়াটা বুঝবার চেষ্টা করি আর নিত্যনতুন ‘চোখের আলো দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’ দেখি।
সকাল ৮টায় মফস্বলের রাস্তায় অটোতে উঠছি। যথারীতি ড্রাইভারের লগে বইছি। রাস্তার অবস্থা ভাঙাচুরা, ছালবাকলা উঠা নেড়িকুত্তার মতন। সামনে এক মালবাহী ট্রাক। শামুকের গতিতে আগাইতাছে ট্রাক, আধমরা শামুকের গতিতে পিছনে পিছনে ছুটছে অটো। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য কইরা ‘এই রাস্তা যে কবে ঠিক অইবো!’ কইতেই তিনি মৌখিকভাবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেক কিছু করলেন, ট্রাক ও ট্রাক ড্রাইভাররেও ছাড়লেন না। এই শীতের মদ্যে তারে ফরজ গোছল করতে অইবো ভাইবা খারাপই লাগলো। আচমকা তার ফোন বাইজা উঠলো, স্পীকার মুডে দিয়াও কানের লগে কমদামী মোবাইল সেটটা চাইপ্পা ধইরা হুংকার দিয়া উঠলেন-
: অই! তুই ফোন করছোস ক্যা! অই হারামির বাইচ্চা, ক ফোন করছোস ক্যা?
: ও আব্বা, তুমি চাইরশো টাকা দেওনা আব্বা। বেরাকের কিস্তি দিমু। আব্বা দাওনা, আব্বা।
: হারামির বাইচ্চা হারামি! আমার কাছে টাকা নাই। তোর পিরিতের জামাই কই!
: কামে গেছে, উই আইলেই দিয়া দিমু। ও আব্বা, দাওনা আব্বা।
: আমার কাছে টাকা নাই। থাকলেও তুই হারামীরে দিতাম না।
ওপাশে ‘আব্বা, ও আব্বা’ কাতর অনুনয় শেষ হওনের আগেই তিনি লাইন কাইটা দিলেন। ট্রাকের পিছনে থাইমা থাইমা অটো আগে বাড়তাছে। ধুলার ঠেলায় নাক ঢাইক্যা ঘটনা বুঝার চেষ্টা করতাছি। তিন চার মিনিট পরে ড্রাইভার স্পিকার চালু কইরা মোবাইল সেট কানে চাইপ্পা রাইখা ফোন দিলেন, হুংকারের মাত্রা আগের থিকা বেশী-
: অই হারামীর বাচ্চা হারামী, টাকা কহন লাগবো?
: আব্বা, বেরাকের কিসতি দিমু। ১১টায় লাগবো।
: তুই কেউরে অটো ইসটানে (স্ট্যাণ্ডে) পাডা, ১০০০টাকা দিতাছি।
: আব্বা, তুমি চাইরশো টাকা দাও, বেশী দিওনা আব্বা। তোমার গাড়ি জমার টাকায় টান পরবো।
: হারামীর বাচ্চা, আমারে লয়া চিন্তা করণের ঢং করবি না। ছয়শো টাকা দিয়া মুরগীর গোশতো কিন্যা খাইস। আর চাইরশো টাকা আইজ বিকালে শোধ না দিলে তগো দোজখ কইরা ছাড়ুম, মনে রাহিস।
ড্রাইভার লাইন কাইটা ফোনসেট পকেটে রাইখা নিজেই কইতে শুরু করলেন-
: বুঝলেন ভাই, মাইয়ার লাইগা কইলজা পোড়ায়। আবার গোস্বাও অয়।
: কেন গো ভাই!
: বহুত আদর কইরা বড় করছিলাম। পড়ালেখা শিখাইছিলাম। গালস (গার্লস) ইস্কুলের স্যারেরা কইতো মেট্টিকে (মেট্রিক/এসএসসি) গুল্ডেন জিপি ফাইব পাইবো। বড় জায়গায় সম্বন্ধ ঠিক কইরা রাখছিলাম।
: পরীক্ষা দেয় নাই?
: দুইটা পরীক্ষা দিছিলো। তারপর ভাইগ্যা গেছে। এক আকাইম্মা ব্যাডায় ভাগায় নিছিলো। অবশ্যি ব্যাডায় তিন মাস দইরা গার্মেন্টে কাম করে। গার্মেণ্টে কাম কইরা কি ছয় পেটের সংসার চলে! তার মইদ্যে মাইয়াটা পোয়াতি হইছে। অহনে পেরেম-পিরিতি চাবাইয়্যা চাবাইয়্যা খা।
অটো চলতাছে। ময়লা নীল সোয়েটার আর মাথায় রিকণ্ডিশন ময়লা মাফলার প্যাঁচানো এক মহাপুরুষ অটো চালাইতাছেন। যিনি মাইয়ার কাছ থেকা চাইরশো টাকা না পাইলে দোজখ বানায়া ফালাইবেন মাগার ছয়শো টাকা মুরগীর গোশতো খাইতে দিবেন। এইসব অংকের হিসাব দুনিয়ার কোনো স্কুল-কলেজ-ভার্সিটতে শিখায়না, এইসব সুপার হায়ার ম্যাথ অর্থাৎ মহাউচ্চতর গণিত জনকের কলিজায় থাকে। পিথাগোরাসের জ্যামিতি পিতাগোরাসের জ্যামিতির মতন সূক্ষ্ম হইবার পারবোনা কোনোদিন। অটো থেকা নাইমা আবদার করি-
: চলেন, এই ঠাণ্ডায় দুই ভাই মিলা একটু চা খাই।
: না ভাই, চা লাগবো না।
: ভাই রে, দুই অচিন মুসাফির চল্লিশ কদম একলগে হাটলে ভাই হয়া যায়, আপনের অটোর চাক্কা কতবার ঘুরছে হিসাব করেন। আমরা তো চাচাতো ভাই হয়া গেছি। লন, চা খাই!
: হেহেহেহেহে
দু’জন মিলা চা খাইতাছি। আসলে একজন মহাপুরুষের লগে কিছুটা সময় থাকা আর তারে চা খাওয়ানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইতাছিলাম না। চায়ের মাঝখানে তিনি সিগারেট ধরাইলেন, তার শস্তা দামের সিগারেটের কড়া গন্ধও কেমন মিশকাম্বার আতরের ঘ্রাণের মতন লাগে। হঠাত দেখি পোস্টারের মহাপুরুষদের মতন তার মাথার পিছনে বিশাল হলুদ আলোর বৃত্ত- উরররররেএএএ সুন্দর!
#সৌন্দর্যগ্রস্থ-৬
'এইসব অংকের হিসাব দুনিয়ার কোনো স্কুল-কলেজ-ভার্সিটতে শিখায়না, এইসব সুপার হায়ার ম্যাথ অর্থাৎ মহাউচ্চতর গণিত জনকের কলিজায় থাকে।' আহা জীবন।
মহাউচ্চতর গণিতই বটে।
ধন্যবাদ রিয়া।
জীবনধর্মী আপনার প্রত্যেকটি লেখাই অসাধারণ হরবোলা ভাই।
ধন্যবাদ সুমন ভাই।
মুগ্ধ হলাম ভাই।
ধন্যবাদ সৌমিত্র ভাই।
সুন্দর অণুগল্প।
ধন্যবাদ আপা।
এই গল্প আগেও পড়েছি। আবারও পড়লাম।
একই অনুভূতি। চোখ ভিজে ভিজে হয়ে যায়।
ধন্যবাদ।
আমার লেখা তাহলে সার্থক হয়েছে। আপনি আমার মূল্যবান পাঠক আনোয়ার ভাই।