প্রেমমোচন
১.
কলেজ ফার্স্ট ইয়ার। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। দশ দিনের ছুটি। টেলিফোনে ভিকারুনিসা-
: হ্যালো! নটরডেম! কাল বেইলী রোডে আসতে পারবে?
: কখন?
: বিকেলে। তিনটা থেকে সাড়ে তিনটায়!
: পারবো।
: ভুলে যেও না, প্লিজ।
: ঠিক আছে। তোমাকে চিনবো কিভাবে?
: আমি তোমাকে চিনি, ডেকে নিবো।
: ঠিক সোয়া তিনটায় বেইলী রোড চৌরাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবো। চারপাশে তাকিয়ে দেখব ‘ইশারায় শিস দিয়ে কে ডাকে…’
: ধ্যাত! সুইসে চলে এসো।
১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি হতে প্রতিদিন টেলিফোনে দুজনের এলেবেলে কথা হয়। মুখোমুখি দেখা হয়নি।
২.
বেইলী রোড। ফাস্টফুড শপ সুইসের কর্ণার টেবিল। স্কাই ব্লু কালার কলেজ ড্রেস, চোখে রূপালী চশমা-খলবলিয়ে হাসে ভিকারুননিসা। নেভী ব্লু টিশার্ট আর ওশেন ব্লু জিন্সে নটরডেম গম্ভীর। ছোট ছোট কামড়ে স্যান্ড্যুইচ শেষ হয়ে আসে- দুজনের কথা শুরু হয়না। অকস্মাৎ নটরডেম ব্যাগ থেকে রুপোলী রাংতায় মোড়ানো প্যাকেট ভিকারুননিসা দেয়। ভিকারুনিসা প্যাকেট খুলতে গিয়ে থমকে থামে-
: আমার জন্যে?
: না, টেপির জন্য।
: ধ্যাত, আমাকে টেপি বলবা না-
: টেপিকে অতন্দ্রিলা বলতে হবে! গোলাপবানু!!
: ধুত্তোরি! কি আছে এতে-?
: হুমায়ূনের নন্দিত নরকে, সত্যজিতের সেরা বারো, আর সুনীলের রাজার মুকুট থেকে খসে পরলো বালি।
: থ্যাংক্স।
ব্যাগ থেকে ঢাউস এক প্যাকেট বের করে ভিকারুননিসা। নটরডেমকে হাসিমুখে দেয়। নটরডেম কৌতূহল না দেখিয়ে ব্যাগে ভরে। কোক শেষ হয়ে আসে। দুজন সুইস থেকে বের হয়। ভিকারুননিসা ফিসফিসিয়ে বলে-
: তোমাকে লিফট দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু…
: কিন্তু কি?
: বাবা জানলে খুন করে ফেলবে।
: খুন হবার দরকার নেই, সামনে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা।
শাদা স্প্রিন্টারে চলে যায় ভিকারুননিসা। নটরডেম হাটতে শুরু করে। এক একটা বিকেলে তাকে হাটার নেশায় পায়। যেনো কোনোদিন আর থামবে না।
৩.
মাঝরাত। নটরডেম বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। তার সামনে প্যাকেটখুলে পাওয়া – ১. লেদার জ্যাকেটে বাধাই ভীষণ দামী ডাইরী, ২. অনেকগুলো বিভিন্ন রংয়ের জাপানি বলপয়েন্ট, ৩. টিডিকে অডিও ক্যাসেট ৪. নীল লেটার প্যাডে চিঠি-
“এয়্যাই,
তোমাকে আজীবন নিলয় নামে ডাকতে চাই।
-টেপী
পুনশ্চ:
i. প্রতিদিন ডায়রিতে এক লাইন হলেও আমাকে নিয়ে লিখবে। না লিখলে ঠিক ঠিক মরে যাব।
ii. আমাকে নিয়ে মজার কিছু লিখলে কমলা কালিতে, রাগ হলে লাল কালিতে, কবিতা সবুজ কালিতে আর লিখতে ইচ্ছে না হলে কালো কালিতে লিখবে- প্লিজ কালারগুলো মনে রাখবে। মনে না রাখলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।
iii. ক্যাসেটের একপাশে মান্নাদের ‘যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ একদিন গলেও যায়, তবুও তুমি আমার’ আর অন্যপাশে স্টিভি ওয়ান্ডরের ‘আই জাস্ট কল টু সে আই লাভ্যু’ গানদুটো বারবার রেকর্ড করা আছে। ভেবো না তোমাকে আই লাভ ইউ বলছি। পুরো ক্যাসেট শুনবে, না শুনলে আমি ঠিক ঠিক মরে যাব।
– টেপী
নটরডেম এই প্রথম এমন চিঠি পেয়েছে। বেশ কয়েকবার পড়েছে। এ এক অন্যরকম ভালোলাগা। আহ্লাদে পলে পলে মরে যাওয়া ভিকারুনিসার জন্য মনটা কেমন আনচানিয়ে ওঠে, চনমনিয়ে ওঠে।
৪.
এই গল্পের তিনটা সাদামাটা শেষ আছে-
— দুবছর দুজনের ‘তুমি বিনে মরে যাই মরে যাই.. গলে যাই গলে যাই’ টাইপের ধুন্ধুমার প্রেম চলে।
২. একদিন শাদা প্রাইভেটকার যাত্রীসমেত ভিআইপি রোডে ঢুকে পরে। সেখানে রিকশার প্রবেশাধিকার নেই। প্রাইভেটকার আর রিকশা পাশাপাশি চলে বটে, তাতে আজীবনের সাথী হয়ে যায়না, যায়নি।
৩. একুশ বছর পরে ভিকারুননিসাকে নিয়ে প্রতিদিন লেখাপূর্ণ দুটো ডাইরি পৌছে দিতে কফিশপে মুখোমুখি নটরডেম-
: তুমি এখনো ক্ষণে ক্ষণে ঠিক ঠিক মরে যাও?
: এসব জিজ্ঞেস করোনা প্লিজ, আমি ঠিক ঠিক মরে যাবো।
: কেউ কারো জন্য মরে না। নিজের জন্য মরে, নিজের জন্য বাঁচে।
: তুমি এখনো খুব রেগে আছো, তাই না? এখনো আমায় খুব ভালোবাসো?
সব প্রশ্নের উত্তর হয়না। সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। নীরবতা ভাঙে ভিকারুননিসা-
: নটরডেম, কোথায় যাবে? আজ তোমাকে লিফট দেই?
: মনসুখিয়ায় যাব, অভ্রজোনাকের কাছে। সেখানে গাড়ি যাবার পথ নেই।
ঝাঝা রোদের দুপুর। কফিশপে বিরাণ শূন্যতা। প্রথম দিনের মত দুজন নীরব। কফির ফেনা মিইয়ে আসে। ভিকারুননিসা বুঝতে পারেনা- একুশ বছর পরে এইমাত্র কেউ তার নাম মন থেকে চিরদিনের জন্য কেটে দিলো।
চুমুকে চুমুকে কফি ফুরোয়, লো ভলিয়্যুমে বেজে চলেন রবীন্দ্রনাথ–
“যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে– জানি নে জানি নে…
________________________
#গ্রন্থ : মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।
শাপমোচন দেখেছিলাম। ওটাও ছিলো প্রেমের কাহিনী নির্ভর ছায়াছবি। এবার পড়লাম প্রেমমোচন। নটরডেম বনাম ভিকারুননিসা। অতূলনীয় কথা কাব্য। বিচ্ছেদ হোক আর সন্ধি হোক এমন সব লিখা হতে পারে একটি ব্লগ আর্কাইভের জন্য দারুণ সম্পদ। অভিনন্দন মি. আবু সাঈদ আহমেদ। শুভ দিন। সুন্দর দিন।
ধন্যবাদ আজাদ ভাই।
যা ই লিখেন অসাধারণ উঠে আসে আপনার হাতে। সালাম হরবোলা ভাই।
ধন্যবাদ সুমন আহমেদ ভাই।
মুগ্ধ হয়ে পড়লাম,,!শুভেচ্ছা জানবেন
ধন্যবাদ পথিক সুজন ভাই।
ফিদা হয়ে গেলাম আবু সাঈদ আহমেদ ভাই।
ধন্যবাদ সৌমিত্র চক্রবর্তী ভাই।
অসাধারণ দাদা।
ধন্যবাদ কবি রিয়া।
ইন্টারেস্টিং।
ধন্যবাদ কবি শাকিলা তুবা।