তখনও মোবাইল ফোনের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ল্যান্ড ফোনের কানেকশনও সহজলভ্য হয়নি। বাড়ির ল্যান্ড ফোনসেট আমার ঘরে ছিলো। মাঝরাতে প্রায়শই ফোন বেজে উঠত, প্রবাসী আত্মীয় স্বজন কল করতেন, আবার পাড়া প্রতিবেশীদের কলও আসতো, মাঝরাতে তাদের ডেকে দিতে হত। এই অভিজ্ঞতা সম্ভবত ওই সময়ের ল্যান্ড ফোন ব্যবহারকারীদের প্রায় সকলেরই রয়েছে। সেদিন ফোন বেজে উঠলো রাত প্রায় তিন’টার দিকে, ফোন রিসিভ করতেই ওপাশে উদ্বিগ্ন কণ্ঠ,
– সাঈদ?
– হ্যা।
– তুই এক্ষণি বাসায় আয়, এক্ষণি, দেরী করিস না।
হালকা ঘুম থেকে জেগে বুঝতে পারছিলাম না কে কল করেছে, কৌশলে জানতে চাইলাম,
– কি হয়েছে?
– রোমেল কিছু একটা খেয়েছে, ওকে মেডিক্যালে নিয়ে যেতে হবে। জলদি আয়।
বাড়িতে ম্যানেজ করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বের হলাম, এরপর আঞ্জুমান থেকে এম্বুলেন্স নিয়ে সোজা রোমেলের বাড়ি। রোমেলের বাড়িতে কান্নার মৃদু আওয়াজ। রোমেলের বড় ভাই, আমি আর আরেক বন্ধু (বিখ্যাত এক অভিনেতার পুত্র) মিলে অচেতন রোমেলকে পাঁজাকোলা করে স্ট্রেচারে শোয়ালাম। রাতের নিরবতাকে ফালি ফালি করে এম্বুলেন্স ছুটলো ঢাকা মেডিক্যালের জরুরী বিভাগে।
রোমেল ঘুমের ওষুধ খেয়েছে ডিউটি ডাক্তারকে জানাতেই জরুরী বিভাগের দু’জন ওয়ার্ডবয় তাকে নিয়ে একটা বেডে শুইয়ে দিল। এরপর মাঝারি সাইজের প্লাস্টিকের একটা ফানেলের নল প্রায় পুরোটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। রোমেল সাড়াহীন। বড় ভাই কান্না করছে। আমরা দুই বন্ধু ঘটনা দেখে যাচ্ছি। ফানেলের মুখে অনেকখানি সাদা পাউডার ঢেলে এরপর পানি ঢালা শুরু হলো। একজন ফানেলে পানি ঢালছে, আরেক ওয়ার্ডবয় বেডের ওপর উঠে দাঁড়ালো, এরপর প্রায় সর্বশক্তি দিয়ে রোমেলের পেটে পাড়া দিতে থাকলো। কি আশ্চর্য! এই প্রথম রোমেলের নড়াচড়া দেখলাম, ও বমি করা শুরু করলো। কিন্তু বমি কোথায়, সাবানের ফেনা ফেনা পানি। প্রথমবারের পর দ্বিতীয়বার আবার ফানেল সেটের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, রোমেল চিঁচিঁ করে ওয়ার্ডবয়দের বললো,
– ভাই, একটু আস্তে হালকা করে করেন, ব্যাথা পাই।
এক ওয়ার্ডবয় চেঁচিয়ে উঠলো,
– আস্তে করুম ক্যান। আরও জোড়ে জোড়ে করুম, মরতে যাওনের সময় খেয়াল আছিলো না।
দু:খজনক সত্য হলো, দ্বিতীয়বারের ওয়াশটা হলো মর্মান্তিক। ওয়াশ তো নয় যেনো থার্ড ডিগ্রী রিমান্ড। এরপরের তিন থেকে চার মাস রোমেল পানি খেতেই ভয় পেত। আর আমি! ওই পরিবেশে রোমেলসহ আরও দু তিনজনকে ওয়াশ দিতে দেখে এবং ক্রমাগর তাদের বমি করতে দেখে ট্রমায় চলে গিয়েছিলাম, পানি খেতে নিলেই ওসব দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতো, পেট উগরে আসতো বহুদিন। এক চুমুকে পানি খেতে পারতাম না, যেনো পেট উগরে বমি না আসে তাই ছোট ছোট চুমুকে পানি পান করতাম। পানির অপর নাম জীবন হলেও তখন পানি ছিলো সাক্ষাৎ আতঙ্ক।
আজ আর বমি আসেনা, তবে ওই ছোট ছোট চুমুকে পানি খাওয়ার অভ্যেস এখনও রয়ে গেছে।
অনবদ্য নির্মাণ ।
তাইতো বলি, আবু সাইদ আহমেদ চায়ের মতো করে পানি খায় কেন?

অসাধারণ।
খুব ভালো।
দারুণ লিখেছেন, দাদা। শুভকামনা-সহ শুভেচ্ছা জানবেন।