অণুগল্প: ছায়াসত্ব

পূর্ণ চাঁদের রাতে জোছনায় দশদিক ভেসে গেলে হাঁপানির টান তুচ্ছ করে দাদি বলতেন, ‘ফকফক্কা চান্নি রাইত, কি ফকফক্কা চান্নি! আমারে দাওয়ায় শোয়াইয়া দাও..।’

মা উঠোনে মাদুর পেতে তার ওপর কয়েকপ্রস্থ সুতির চাদর বিছিয়ে আস্থায়ী জাজিম বানিয়ে দিতেন। বাবা দাদিকে কোলে তুলে এনে জাজিমে শুইয়ে দিতেন। দাদির খনখনে স্বর, শ্বাস টেনে টেনে বলতেন, ‘এত্ত চান্নি, চাইরদিকে এত্ত চান্নি!’

দাদির চোখ দুটো মরে গিয়েছিল বহু বছর আগে। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতেন– ঘুম আর জাগরণের মাঝমাঝি পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক জড় পদার্থ বিশেষ। হাঁপানির টানে বুকের দ্রুত ওঠানামা জানান দিত- বেঁচে আছেন। অথচ জোছনার মাঝ রাতে তার প্রবল অস্থিরতা- ‘এত্ত চান্নি! বাইরে এত্ত চান্নি!’

প্রতিক্রিয়াশূন্য ঘোলা চোখে চোখ রেখে আমার কৌতূহল – ‘ও দাদি, কানা চউক্ষে তুমি কি দ্যাহো?’ উত্তরে দাদি বলতেন, ‘দাদাবাই, চান্নি দেহি, এত্ত চান্নি!’ মুখের চামড়ায় সহস্র ভাজ বৃক্ষের মত স্থির, শুধু কণ্ঠে গুপ্তজ্ঞান ফাঁসের সতর্কতা– ‘ও দাদাবাই, দ্যাহতো চান্নিতে কি আমার ছায়া পড়ে? চান্নিতে মরা মাইনষের ছায়া পড়ে না।’

‘দাদি গো, চান্নিতে তোমার জ্বলজ্বইল্লা ছায়া পড়ছে’ বললেই দাদি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন- ‘আমি চউক্ষে ছায়া দেহি না ক্যান দাদাবাই?’ তার কণ্ঠে গাঢ় আতঙ্ক – ‘এত্ত চান্নিতে আমার ছায়া পড়ছে, চউক্ষে দেহিনা ক্যান!’

দাদি তার সকল ছায়া ও জোছনাপ্রীতিসমেত মারা গেছেন- বহুদিন হলো। আজ প্রখর রোদ, জুম্মার নামাজের সময় সুনসান রাস্তা, রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, আকষ্মাৎ স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসা দাদি ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘ও দাদাভাই, তোমারে কইছিলাম চান্নিতে মরা মাইনষের ছায়া পড়ে না, ভুইল্লা গেছ!’

চোখ মেলে দেই- আশ্বিনের আকাশ ঘন নীল। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো সাদা সাদা মেঘ। একটা পায়রা উত্তর হতে উড়ে গেল দক্ষিণে, সূর্যের নিচে চক্কর দিচ্ছে ক’টা চিল। নিজের ছায়ার খোঁজে মাটিতে তাকালাম- না, কোনো ছায়া নেই, রোদেও আমার ছায়া পড়ে না।

ছায়াসত্ব

2 thoughts on “অণুগল্প: ছায়াসত্ব

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।