সর্পবিদ কিংবা গুরু

নাগেশের সাথে প্রথম পরিচয় ভীতিকর ছিল। স্কুলের সীমানা দেয়াল ঘিরে যে প্রাচীন বটগাছ তার ফাঁকফোকরে সাপের আস্তানা। নাগেশ প্রায় দিন স্কুলের সামনে দিয়ে কোর্টে যায়, কোর্টের সামনে বাবার সাথে সাপের খেলা দেখায়।

বটগাছের নীচে বাদামওয়ালা, আইসক্রিমওয়ালা, আচারওয়ালা। তাদের ঘিরে আমরা। হঠাৎ এক পাতালতি গাছ থেকে নেমে আমাদের দিকে তেড়ে আসে। আমরা যারা নিজেদের বিজয়ী ভাবি, যাদের অভিধানে ভয় বলে কোন শব্দ নেই; তারা পিচ্ছি এক সাপ দেখে প্রাণের ভয়ে পালাতে থাকি।

সাপ দেখে আত্মা প্রায় খাঁচাছাড়া এমন সময় রিক্সা থেকে নেমে নাগেশ আসে, পোষা বেড়ালের মত সাপকে মুঠোবন্দী করে ঝুড়িতে ভরে। দূরত্বে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে নাগেশকে দেখি, এই প্রথম আমাদের মস্তক নত হয়ে আসে। নিজেদের নির্ভয় ভাবনায় এই প্রথম সন্দেহ লাগে, এই প্রথম মনে হয় নাগেশের সাহসের তুলনায় আমরা অতি নগন্য। তার কাছে আমাদের আত্মগরিমা খাক হয়ে যায়।

আমাদের বয়সী একটা ছেলে সাপকে কাবু করতে পারে এটা একটা বিস্ময়। আমরা নাগেশের বন্ধু হওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠি। তাকে গুরুর আসনে স্থান দিতে ব্যগ্র হয়ে উঠি। যে সাপকে জয় করতে পারে তার কাছে অজেয় কিছুই থাকবে না এই ভাবনা আমাদের উদ্বেলিত করে। তাঁর নেতৃত্বে আমরা অজেয় কে জয় করব।

নাগেশ আমাদের বন্ধু হয়ে যায়। বন্ধু না হলেই ভাল হত। যে উৎসাহ, যে উদ্দীপনা, যে আগ্রহে তাকে বন্ধু বানাই সে আগ্রহ দুদিনেই ফুটো হয়ে যায়। সাপের খেলা ছাড়া নাগেশের আর কিছু আসে না। সে অংক কষতে পারে না, দুই ভাগ হাইড্রোজেন এক ভাগ অক্সিজেনের সংমিশ্রণে কি হয় জানে না। আহ্নিক গতি কাকে বলে তাও জানে না।

তাকে নিয়ে পৃথিবী জয়ের যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম; মরে যায়। দেখা যায় সে অতি সাধারণ, সাপ বশ ছাড়া কোন বিশেষত্ব নেই। আমরা আমাদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

স্কুল থেকে কলেজ। আমাদের রাজ্যের পরিধি বেড়ে যায়। সহপাঠিনীর ওড়না কার মুখের ঘাম মুছে দেবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ি। প্রতিদিন মিছিল মিটিং নাগেশের সাথে সঙ্গ কাটানো, সাপ খেলা দেখার সময় হয় না।

তখন এরশাদের জমানা। বিশ্ব বেহায়া এখানে সেখানে লাশের বিছানা ফেলছে। আমরাও বদ্ধ পরিকর; যেকোনো মূল্যে এই বেহায়াকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।

এরশাদ বিরোধী মিছিলে গগনবিদারী স্লোগান দিচ্ছি, আজ তাকে সরে যেতে হবে। এরশাদও শেষ কামড় দিতে প্রস্তুত। তার পোষ্য পুলিশ মিছিলে গুলি চালিয়েছে, সবাই ছত্রভঙ্গ; যে যার মত পালাচ্ছে।

পালিয়ে যাব এই চিন্তা যখন মাথায় এসেছে তখনই দেখতে পেলাম একটা তপ্ত সীসার বুলেট আমার দিকে ধেয়ে আসছে, কিছু বুঝার আগেই রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কে যেন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। সীসার বুলেট নাগেশের বুক বিদীর্ণ করে গেল।

নাগেশ সাপের খেলা দেখাত। সাপকে কিভাবে পোষ মানাতে হয় জানত কিন্তু বন্ধুর প্রাণ বাঁচাতে সেই সাপের ছোবলে মারা গেল।

এরশাদ সরে গেছে কিন্তু মরে যায় নি। কিছুদিন গর্তে অবস্থান করে বিপুল বিক্রমে ফিরেছে। আহ্নিকগতির জ্ঞান রাখা অনেকে তার সঙ্গী হয়েছে। একদিন যারা তার ছবিতে থুথু ছিটাত তারাই এরশাদের থুথু ভক্ষণ করেছে।
আমরা অংক কষি, বিজ্ঞান চষি। অনেক বিষয়ে পারদর্শী কিন্তু আমাদের চরিত্র বেহায়ার চেয়েও খারাপ। নাগেশ সাপ সঙ্গ পছন্দ করেছিল, চরম অবিশ্বাসী সাপ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও আমাদের নগর সাপ তাকে লাশ বানিয়ে ছাড়লো।

আমরা তাকে নেতা হিসাবে চেয়েছিলাম, গুরু হিসাবে চেয়েছিলাম; সে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে। আমরাই যোগ্য শিষ্য হতে পারিনি…

1 thought on “সর্পবিদ কিংবা গুরু

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।