গালে_টোল_পড়া_মেয়েটি_অণুগল্প

আমার খুব প্রিয় একটি গল্প আবারো শেয়ার করছি:
_______________________________
‘আমাকে
তুমি দেখিয়েছিলে একদিন;
মস্ত বড় ময়দান — দেবদারু পামের নিবিড় মাথা — মাইলের পর মাইল;
দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়;
জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;
জানালায় জানালায় অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলে:
পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।‘

প্রচন্ড এক কালবৈশেখি ঝড় আসি আসি করছে। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। নিজেদের ফ্ল্যাটের বালকনিতে বসে আছে দুজন। শিহাব আর কণা। শিহাব চমৎকার আবৃত্তি করে। আর অসাধারণ শ্রোতার ভূমিকা পালন করে কণা। এভাবেই নিজেদের দাম্পত্য জীবনের ষোলটি বছর পার করে এসে আজও একের প্রতি অপরের অনুভব একই রয়ে গেছে। সেই প্রথম দেখা হবার দিনের মত করে ভালোলাগা কি ভালোবাসা, এই মুহুর্তেও সেই প্রথম মুহুর্তের মত মনে হয় ওদের কাছে। লতায়-পাতায় জড়ানো ভালোবাসা এক হয়ে দুজনের হৃদয়কে এক করে রেখেছে।

কালো দীঘল এলো চুল বাতাসে উড়ছে। বাইরের প্রকৃতি যেন কণার এলো চুল! তেমনই দুর্বার-অপ্রতিরোধ্য! বাতাসে সেগুলো উড়ে উড়ে ভালোবাসার ঘ্রাণে, আবৃত্তিরত শিহাবকে পলকের তরে কণার আরো কাছে নিয়ে আসতে চায়। কি এক যাদু খেলা করে কণার চোখে। শিহাব আবিষ্ট হয়.. থেমে যায়.. কণাকে কাছে টানে। ঝড় উঠে ভিতরে বাহিরে। ভেতরের ঝড় একসময় থেমেও যায়.. বাইরে তখনো তুমুল।

আজ ওদের পনেরতম বিবাহ বার্ষিকী ছিল। চা’র কাপ হাতে কণা যখন শিহাবের সামনে এসে দাঁড়ায়, শিহাব তখন ল্যাপটপে ব্যস্ত। তবুও প্রিয় বন্ধুর কাছে আসাটা অনুভবে টের পায়। ফিরে তাকায়। হাসে। হাসির উত্তরে অপরপক্ষও হাসে। এক ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ অপরাহ্নে, এক জোড়া দম্পতি নিজেদের অলস সময় কাটায় তাদের বিশেষ এক দিনে। কথায় কথা বাড়ে। স্মৃতি হৃদয়ে কড়া নাড়ে। এক পর্যায়ে কণা জিজ্ঞেস করে,
‘অ্যাই! আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল কোথায় তোমার মনে পড়ে?’
– তুমি বলো?
‘ আমিন আংকেলের বাসায়। তার ছেলের বার্থ ডে’তে!’
– হলো না।
‘ মানে? সেদিনই হয়েছিল। বাবা-মায়েরা চালাকি করে আংকেলের ছেলের বার্থ ডে’র নাম করে আমাকে এনেছিল। ভুলে গেলে এতো সহজে!!’
– নাহ! ভুলিনি। তবে তোমাকে আমি দেখেছিলাম যখন, তখন তুমি আমার সামনে ছিলে না।
‘ কি পাগলের মত কথা বলছ? আমাকে দেখেছ অথচ আমি সামনে ছিলাম না!’
– হ্যা, ঠিক এভাবেই। আর পাগল বলছ, ওটাও ঠিক। আমি তোমার প্রেমে পাগল-ই হয়ে আছি এখনো।
‘ কেন প্যাচাচ্ছ? বলো না, কোথায় আমাকে দেখেছিলে? আমি তখন কোথায় ছিলাম? কোনো মার্কেটে? ভার্সিটির ক্যাফেতে নাকি শাটল ট্রেনে?’
– এর কোথায়ও না। আমি তোমাকে দেখেছিলাম এক ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে। এক মাল্টি প্লাগের কাভারে।
‘ ফাজলামো করো না তো, সত্যি কথাটা বলো।‘
– দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমায়।

শিহাব জীবনানন্দ দাসকে টেবিলের ওপর রেখে, রুমের শেষ প্রান্তের কাবার্ডের সামনে দাঁড়ায়। নির্দিষ্ট ড্রয়ার থেকে একটা র‍্যাপিং পেপারে মোড়া প্যাকেট বের করে। দেখেই বুঝা যায়, বেশ আগের। ওটা নিয়ে কণার সামনে আসে। কণার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– এটার ভিতরে তুমি রয়েছ, নাও র‍্যাপিং খুলে দেখ।

একটু বিহ্বল কণা প্যাকেটটি হাত বাড়িয়ে নেয়। ধীরে ধীরে র‍্যাপিং এর আবরণ উন্মুক্ত করে। ভেতর থেকে বের হয় একটি মাল্টি প্লাগের প্যাকেট। এবং আশ্চর্য হয়ে কণা দেখে কাভারে ওর ছবি! হুবহু কণা!

শিহাবের দিকে অবাক হয়ে তাকায় সে। নীরবে জানতে চায় এর মানে কি? শিহাব ওর অবাক দৃষ্টিতেও মুগ্ধ হবার মত উপকরণ খুঁজে পায়। কেন জানি আবারো কাছে আসতে মন চায়। মনকে একটু চোখ রাঙ্গিয়ে শিহাব বলে,
– এখানে যার ছবি, সে তুমি নও। তবুও সে আর তুমি দেখতে একই। একদিন হালিশহরের এক ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান থেকে এই মাল্টি প্লাগটি কিনে বাসায় ফিরছিলাম রিক্সায়। আনমনে প্যাকেটটির দিকে তাকাতেই কাভারে এই মেয়েটির ছবি দেখে প্রেমে পড়ে গেলাম! না, হেসো না, আসলেই ভালোলাগা কি ভালোবাসা সব এক সাথে এসে আমাকে বিহ্বল করে তুললো। ছবির মেয়েটির গালে হাসলে টোল পড়ে তোমার মতো। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বিয়ে করলে এই ছবির মেয়েটির মত হতে হবে তাঁকে। আর আমিন আংকেলের বাসায় সেদিন তোমায় দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। ভালোও লেগেছিল.. একটা তাড়না জেগে উঠেছিল, যেভাবেই হোক তোমাকে পেতে হবে।

একটি মাল্টি প্লাগের কাভারে কণার মত একজনের হাসি মুখ.. সেদিকে তাকিয়ে থেকে কণা হাসে। ক্রমশঃ ওর হাসির বেগ বাড়তে থাকে। বাইরে ঝোড়ো বাতাস ও সমানতালে পাল্লা দিয়ে চলে। মাল্টি প্লাগের মেয়েটি আর বাস্তবের মেয়েটি- দুজনেই শিহাবের কাছে এক হয়ে যায়! রক্তমাংসের নারী হেসে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে। আর একজন শিহাব মুগ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়া নারীর গালের টোল পড়া দৃশ্য দেখতে থাকে। ধীরে ধীরে ছবির মেয়েটি অদৃশ্য হয় শিহাবের সামনে থেকে। কালো চুলে মুখ ঢাকা মেয়েটির চোখের তারা কেঁপে ওঠে! মুগ্ধতার মোড়কে আবারো একজন শিহাব নিজের ভেতর থেকে জেগে উঠে সেই চোখের তারার কাঁপন অনুভব করতে এগিয়ে আসে… কালবৈশেখি ঝড়ের এক শেষ বিকেলে!

#গালে_টোল_পড়া_মেয়েটি_অণুগল্প

★ জীবনানন্দ দাসের কবিতার লাইন।

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

2 thoughts on “গালে_টোল_পড়া_মেয়েটি_অণুগল্প

  1. কালো দীঘল এলো চুল বাতাসে উড়ছে। বাইরের প্রকৃতি যেন কণার এলো চুল! তেমনই দুর্বার-অপ্রতিরোধ্য! বাতাসে সেগুলো উড়ে উড়ে ভালোবাসার ঘ্রাণে, আবৃত্তিরত শিহাবকে পলকের তরে কণার আরো কাছে নিয়ে আসতে চায়। কি এক যাদু খেলা করে কণার চোখে। শিহাব আবিষ্ট হয়.. থেমে যায়.. কণাকে কাছে টানে। ঝড় উঠে ভিতরে বাহিরে। ভেতরের ঝড় একসময় থেমেও যায়.. বাইরে তখনো তুমুল।

    অপূর্ব লিখাhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।