তখন গাজীপুরের কোনাবাড়িতে একটা পোষাক কারখানায় চাকরগিরি করি। সপ্তাহের ৬ দিন একা থাকি একটা ছ’তলা ফ্ল্যাটের টপ-ফ্লোরের দক্ষিণমুখী সিংগেল একটা রুমে। একদিন দুপুরে শরীর খারাপ থাকায় হাফ-বেলা লিভ নিয়ে চলে এলাম। একা একা থাকি। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অসুস্থ শরীর নিয়ে দক্ষিণমুখী ব্যালকনিতে বসে রইলাম। সামনের দিকটা উন্মুক্ত। ফুরফুরে বাতাসে মন ভরে যাচ্ছিলো। একটু একটু ভালোও লাগছিলো।
.
আকাশে উড়ছিলো রঙ বেরঙের ঘুড়ি। ওগুলি দেখতে দেখতে একটা ছেলেমানুষি লেখা মাথায় ভর করলো। ওখানে বসেই লিখে ফেললাম তিন পর্বের একটা ছোটগল্প। আর লেখা শেষে ল্যাপটপের পেইন্ট প্রোগ্রামে গিয়ে আঁকলাম কয়েকটা ঘুড়ির ছবি (আমি অন্য অনেক কিছুর মতো এই অংকন বিষয়েও ডাবল জিরো টাইপের দক্ষ)। ছবি দুইটি দেখে মনে হবে কেজির বাবুরাও এর চেয়ে ভালো আঁকতে পারবে নিশ্চিত। তারপরও গল্পের সাথে মিল রেখে আমার আঁকা বলে কথা।
.
যারা টানা গল্প পড়তে ভালোবাসেন, তারা এই গল্পটি পড়বেন। আর যারা বিরক্ত হন লম্বা লেখা পড়তে, জাস্ট এখান থেকেই ভেগে যেতে পারেন। পরে আমাকে মনে মনে গালমন্দ করবেন না দয়া করে। চলুন, ৬ বছর আগে লেখা আমার ছোটগল্পটিতে…
__________________________________________________________________
১
নিজের আকাশে ফুরফুরে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছিল এক বালক ঘুড়ি। এই আকাশটা তার একান্ত নিজের। এখানে উড়ে বেড়াতে হলেও সবাইকে আকাশ লীজ নিতে হয়। ফি-বছর নিলামে অংশ নিয়ে হাড্ডা হাড্ডি লড়াই করে তবে না উড়বার মজা নেওয়া। অনেক উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া প্রতিবেশী আকাশের এক অচেনা ঘুড়ি হেডফোনে গানটি শুনতে শুনতে গাইছিল, তারই রেশ বাতাসে ভেসে ভেসে বাতাসের অনুকূলে ওরই দিকে আসাতে সুরের ঐন্দ্রজালিক আবেশে নিজের কর্ণকুহর আবিষ্ট হল। চোখ বুঝে ডানে-বামে আর মাঝে মাঝে গোত্তা খেয়ে ভূমির দিকে অলস নেমে যাওয়ার কিছুক্ষণ কসরত করল সে।
.
এমন সময় এক বালিকা বিনা অনুমতিতে ওর আকাশের প্রান্তসীমায় এসে অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যাথায় নীল হৃদয়খানি দেখা যাচ্ছে। আর ডাউনমুডে থাকাতে বালক হৃদয়ে কেন জানি এক মায়ার সঞ্চার হল। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ কে তুমি?’ উত্তরে বালিকা ঘুড়ি বলে, ‘আমার উড়বার কোনো আকাশ নেই। সব আকাশ নিলামে বিজয়ীরা দখল করে আছে।’
.
বালকঃ কি চাও তুমি?
বালিকাঃ আমি কি কিছুক্ষণ তোমার আকাশে উড়তে পারি?
একটু ভেবে বালক বলে, ‘তুমি কি একা একা উড়বার মজা নিবে? নাকি আমাকেও তোমার সাথে উড়তে হবে?’
ম্লান হেসে বালিকা বলে, ‘ আমি একাই উড়তে পছন্দ করি।’ একটু থেমে গ্রীবা বাঁকা করে বালকের দিকে তাকিয়ে আরো বলে,’তবে কেউ আমার পাশাপাশি উড়তে চাইলে আমার খারাপ লাগবে না।’
.
বালক ঘুড়ি লক্ষ্য করে যে, হাসলে বালিকার হৃদয়ের নীল ব্যাথা লালে পরিণত হয়ে যায়। সে আরো কয়েকবার এরকম কিছু মামুলি কথা বলে দেখে যে ব্যাপারটা আসলেই এরকমই।
.
এভাবেই বালকের আকাশে বালিকার প্রবেশ। দু’জনে একই আকাশে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঊড়তে থাকে…।
.
২
এভাবে অনেকদিন কেটে যায়…
একই আকাশে বালক বালিকাদের সহাবস্থান। একে অন্যের কাছাকাছি… হৃদয়ের উত্তাপে ভালোবাসার ফল্গুধারা বয়ে গিয়ে তারার জন্ম হয়। বালিকার নীল হৃদয় বালকের লাল হৃদয়ের ছোঁয়ায় একাকার! দুটি অভিন্ন হৃদয় এক হতে শুরু করে। চেনা অচেনার দুই ভিন্ন জগত নীলাকাশের নীচে স্বপ্নের নীড় খোঁজায় ব্যাকুল। বালক বালিকার হাতে হাত রেখে অনাগত ভবিষ্যতের বীজ বোনে। পরম নির্ভরতায় বালিকাও বালকের ছায়ায় মুখ লুকোয়। বালকের হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেজে উঠে ‘ভালোবাসি! ভালোবাসি!’
.
কিন্তু এতো কিছুর পরেও বালিকার মনে কিসের যেন অভাব বিরাজ করে।সে থেকে থেকে বিষন্ন বোধ করে। বালকের আকাশে সে অনাহুত অতিথির মতো এলেও এখন সে ই এই আকাশের মালিক। সে আক্ষরিক অর্থে বালকেরও সমগ্র সত্তার অধিকারিণী। বালক যেচেই তাকে সব দিয়ে দিয়েছে।
.
সেও বালককে সব কিছু দিয়ে দিতে চায়। তবে বালক কখনো তাকে জোর করেনা। ইচ্ছে করলে সে বালিকার দুর্বল মুহুর্তের সুযোগ নিতে পারে। এমন মুহুর্ত ও এসেছে বহুবার। তবে সত্যিকারের ভালোবাসায় কোনো কামনা থাকেনা… কেড়ে নেবার কিছুই যে নেই সেখানে।
বালক অপেক্ষা করে। দিনে… সোনালী বিকেলগুলোয়… চাঁদনী রাতের মায়াবী প্রহরে… ঊষার স্নিগ্ধ লিলুয়া বাতাসে!
.
কিন্তু বালিকার হৃদয়ে অন্য কোনো জগতের বাঁশরির সুরের অজানা আকর্ষন! সে থেকে থেকে এলোমেলো হয়ে যায়।
দিন পেরিয়ে বিকেল-রাত-ভোর… পায়ে পায়ে অমুল্য সময়ের পদস্খলন… কিন্তু তাকে আর বালকের পাওয়া হয়ে উঠে না। চির-পরিচিত আকাশ তার নীলাভ রুপ হারায়। বালক ধীরে ধীরে আরো মায়ায় পড়ে যায়। কিন্তু সে সীমা অতিক্রম করেনা। বালিকা তার মনের ভিতরেই থেকে যায়।
.
একদিন বালিকা আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করে, বালকের আকাশ তার কাছে খুব ছোট মনে হচ্ছে! আরো বড় কোনো ঊড়ার যায়গা তার খুব প্রয়োজন। অথচ সে এটা বেমালুম বিস্মৃত হয়, তার কোন আকাশ ছিল না… ছিলনা এমন কেউ যে তার ব্যাথাকে নিজের হৃদয়ে অনুভব করে তার মনকে- মনের অসুখকে সারিয়ে তার জগতটিকে রঙে রঙে রঙিন করে দেয়। একজন বালক তার নীল হৃদয়কে ঠিক করতে গিয়ে নিজেই যে নিজের হৃদয়কে বিদীর্ণ করেছে, দেখেও না দেখার ভান করে।
বালিকা মুক্তি পেতে চায় এই স্বল্প পরিসরের করিডোর থেকে।
.
৩
একদিন বালক ঘুড়ি ঘুম থেকে দেরী করে উঠে। উড়বার সহজাত প্রবৃত্তির বশে আকাশে উঠার প্রাক্কালে সে হোঁচট খায়। তার আকাশে অনেক চেনা অচেনা ঘুড়ির জমায়েত। তবে এই সমাবেশ নিছক আনন্দের জন্য নয়। সবাই ধীর স্থির ভাবে বালিকার কথা শুনছে। অনেকটা দূরে হলেও সে বালিকার কথা শুনতে পাচ্ছে। বালিকা সবাইকে ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। সে বলছে বালক তাকে তার আকাশে উড়বার সুযোগ দিয়েছে… এরপর তার বন্ধুত্তের সুযোগ নিয়ে তাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখানে আটকে রেখেছে… তাকে রাজ্যের নোংরা কথা বার্তা দ্বারা মাথা খারাপ করে দিচ্ছে… তার কান এইসব অশ্লীল কথায় ঝালাপালা হয়ে আছে… সে না পারছে তার থেকে চলে অন্য কোথায়ও যেতে, কারণ তার নিজের কোনো আকাশ নেই এই মুহুর্তে- যেখানে সে উড়তে পারে। সে বালক ঘুড়ির কাছে কৃতজ্ঞতার নাগপাশে আবদ্ধ থাকায় মানসিক ভাবেও বিপর্যস্ত।
.
বালকের মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে! নিমিষে মনে পরে গেলো বালিকাকে নিয়ে নীলাকাশে আগের সেই সব মধুর স্মৃতিগুলো… সে সত্যিকারের ভালোবাসা নিয়ে কামনাহীন প্রেমের ভূবনে তাকে নিয়ে বিচরণ করেছে। আর আজ সে কিনা সেই ভালোবাসাকে নোংরা-অশ্লীল নাম দিয়ে তাকে একজন কুৎসিত বন্ধুর রুপে পরিচয় করিয়ে দিলো!
.
হায় প্রেম!
হায় ভালোবাসা!!
নিজের হৃদয়কে ছিড়ে সবার সামনে একটি নাটাই বিহীন ঘুড়িতে পরিণত হতে ইচ্ছে করছে তার এই মুহুর্তে।
সে বালিকার দিকে লক্ষ্য করে দেখে বালিকার হৃদয় যা তার ভালোবাসার পরশে লাল হয়েছিল, এখন কালো হয়ে গেছে। তার ভিতরের আসল কদর্য রুপ এইমাত্র বালকের হৃদয়ের আয়নায় সত্যিকারের রুপ হয়ে দেখা দিয়েছে।
.
মুখে হাসি কিন্তু হৃদয়ে তীব্র ব্যথা নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের আকাশটি বালিকাকে দান করে অচেনা কোনো আকাশের সন্ধানে বালকটি ফিরে গেল… সকলের অগোচরে। কাউকে তার বালিকার কথার জবাব দেবার প্রয়োজন নেই। সে তো একজন বন্ধুর কদর্য রুপে অভিনয়কারী কোনো প্রেমিক নয়! সে একজন সত্যিকারের ভালোবাসার কাঙ্গাল…
তবে নিজের হৃদয়টি ও যে নীল রঙ ধারণ করেছে তা সে জানতেও পারলো না।
.
বালক ঘুড়িরা কখনো নিজের হৃদয়ের দিকে সেইভাবে তাকায় না। সে শুধু ভালোবাসতেই জানে। বালিকার ছলনা বা ঘৃণ্য অভিনয় সম্পর্কে তারা কখনো চিন্তা ও করেনা।
.
তার হৃদয়ের গোপন কোনো কুঠরি থেকে বার বার বেজে ওঠে-
‘…আজ থেকে আর ভালোবাসার
নাম নেবো না আমি…’
ভালোবাসা নিজেই লজ্জা পেলো বালিকার এহেন মিথ্যে অভিনয়ে।
.
নিজের বিষণ্ণ আকাশে এক নিঃসঙ্গ ঘুড়ি একা একা নিজের মনে আবৃত্তি করতে থাকে এক প্রেমিক কবির হৃদয় নিঙড়ানো কষ্টকর কিছু শাব্দিক যন্ত্রণা-
‘হে কিশোরী কবোষ্ণ বুকের চুড়োয়
কতোটুকু প্রেম রেখেছো লালন কোরে
কতোটুকু মান অভিমান!
.
সঞ্চয়ী এক চাষীর মতো
কতোটা বীজ জমিয়েছো হংসমিথুন
মৌশুম তো এসেই গেছে হে কিশোরী
কতোটুকু প্রেম রেখেছো!
.
কোমল হাতের ঐ আঙুলে
কতোটুকু স্নেহের পরশ আলতো লাজুক
রেখেছো হে চোখের ভেতর গভীরতায়
কতোটুকু সুখ রেখেছো!
.
ঢেউয়ের মতো ক্রমান্বয়ে
দেখেছো ঐ বুকের কিরীট যাচ্ছে বেড়েই
এর ভেতরে কতোখানি ঘুম রেখেছো
মিথুন রাতের স্বপ্নালু সুখ!
.
হে কিশোরী ঠোঁটের শাখায়
কোন সোনালি ফুলের মধু জমিয়েছো
কোন চুমুকের আশায় তুমি ঠোঁটের পাপড়ি
ব্যগ্র অমন মেলেই আছো!
.
হে কিশোরী বুকের ভেতর
কতোটুকু বিষ রেখেছো আড়াল কোরে
সোনালী ঐ প্রেমের পাশে !’
.
নীল আকাশটি মুহুর্তে কালো হয়ে বালকের কষ্টে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে… অনেকক্ষণ ধরে।।
#কতোটুকু_বিষ_রেখেছো_আড়াল_কোরে_মামুনের_ছোটগল্প
* কবিতা: কতোটুকু বিষ রেখেছো প্রেমের পাশে
** কবিঃ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
'চেনা অচেনার দুই ভিন্ন জগত নীলাকাশের নীচে স্বপ্নের নীড় খোঁজায় ব্যাকুল। বালক বালিকার হাতে হাত রেখে অনাগত ভবিষ্যতের বীজ বোনে। পরম নির্ভরতায় বালিকাও বালকের ছায়ায় মুখ লুকোয়। বালকের হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেজে উঠে ‘ভালোবাসি! ভালোবাসি!'
কী অসাধারণ এক অনুভূতির শব্দ-প্রকাশ ঘটিয়েছেন; পড়ে মুগ্ধ হলাম মি. মামুন।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
আপনার মতো অনুভবক্ষম'র পক্ষেই সহজে শব্দের সাথে শব্দের ভিতরের লুকায়িত অনুভূতি উপলব্ধি করা সম্ভব।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো আপনার জন্য।
বিলম্বিত ঈদ শুভেচ্ছা…

অদ্ভুত অসাধারণ আপনার প্রেজেন্টেশন। অসম্ভব মেধা আপনার গল্প দা।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ রিয়া দিদি।
ঈদের বিলম্বিত শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।