ফিরে এসো এই অন্তরে : অণুগল্প-৪৩২

এক শ্রাবণ মেঘের প্রচণ্ড ঘনঘটার দিন। প্রথম দেখেছিলেম তাঁরে। প্রথম দেখায়-ই সে হয়ে গেলো আমার হৃদয়ের আরাধ্য কাছের মানুষটি! এরপর আরো একটি ঘোর ঘন বরষায় ভিজে ভিজে একমাত্র কাছের মানুষে পরিণত করলাম তাঁকে!
.

কেউ কি জানো, কাউকে কাছের মানুষে পরিণত করতে কতটা সাধনা করতে হয়? কতটা অশ্রু ঝরালে তবে ভালবাসার নদী বয়ে যায়? আমার নদীটার ছিল কেবলই এক পাড়। সেখানে কেবলি ভাললাগায় ছুটে চলা.. অন্তবীহীন পথ ধরে.. প্রণয়ের উল্লাসে ফেটে পড়া.. আর প্রেয়সীর ভালবাসার নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায় ছুঁয়ে নুয়ে পড়ে মোহনার পানে ধাওয়া।
.

আমি মোহনার কাছাকাছি এসেই আমার গতি হারালাম। আমার জন্মের পূর্বের অভিশাপ ফারাক্কা হয়ে আমার প্রবাহ নিস্তেজ করে দিলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ডুবো চরের ভিতর থেকে আমার নদীটির অপর পাড়ের জেগে ওঠা। সে পাড়ে কেবলি নিরাশা, বিরহ আর কষ্টের তীব্র ফল্গুধারা! আর প্রিয় মানুষটির চলে যাবার অপেক্ষায় অপেক্ষমান এক সর্বনাশা পথ।
.

শরতের এক দিনে, বিষণ্ন বদনে সে আমায় ছেড়ে চলে গেলো সেই পথটি ধরে। আমায় জানালো না। নয় কোনো বিদায় সম্ভাষণ; কিংবা পলকের তরে ছুঁয়ে দিয়ে বলা, ‘আসি’। ‘যাই’ বললে ও মেনে নিতে কষ্ট হতো না আমার। কিন্তু সে নিরবেই চলে গেলো। কিছুই বললো না আমায়।
.

তোমরা কেউ কি কাউকে নীরবে চলে যেতে দেখেছ কখনো?
আমি দেখেছি। তাই বুঝি, কারোর নীরবে চলে যাওয়াটা- পথের মাঝে একা দাঁড়িয়ে থেকে দেখাটায় কতটা যন্ত্রণা। নিরব যন্ত্রণা সেই থেকে কুরে কুরে খেয়েছে আমায়।
.

তারপর ও নির্লজ্জের মত খুঁজেছি তাঁকে। তোমরা হলে কি করতে? খুঁজতে যেতে না? আমি প্রেমিক থেকে বিরহী, শেষে বেহায়া ও হলাম তাঁর জন্য। যদি তাঁর মন ফিরে! আমায় দেখে যদি একটু ফিরে তাকায়! মনকে এভাবে প্রবোধ দিয়ে চলেছি গত দু’টি মাস।
.

আজ হেমন্তের প্রথম প্রহর! খুঁজে খুঁজে তাঁকে পেলাম সেই মোহনার তীরে। যেখানে হারিয়েছিলাম আমার ভালবাসার প্রবল স্রোত। সে মেঘবতী কন্যা হয়ে সমুদ্রের তীর ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিল। পিছন থেকে দেখছি তার এলোচুলের গোছা- বাতাসে উড়ছে! তাঁর কানের পাশে গন্ধরাজ গোঁজা। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সব হারানোর অশ্রুধারা আমার দু’চোখ বেয়ে বয়ে বয়ে আমার শীর্ণ নদীটায় আবারো স্রোতের সৃষ্টি করল! তাঁর চুল পেছন থেকে বাতাসের দোলায় আমার চিবুক ছুঁয়ে দিয়ে গেলো! আমি দীর্ঘক্ষণ সেই ছুঁয়ে যাওয়া জায়গাটি আমার এক হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখলাম। যেন নদীর সেই নিষ্ঠুর পাড়টিতে জেগে উঠা পথ ধরে, এই পরশটুকুও মিইয়ে না যায়।
.

নিরবতার ও বিশেষ কোনো সুর থাকে। থাকে মধুর ব্যঞ্জনা। বাতাসের প্রবল শব্দের ভিতর দিয়েও আমি তাঁর হৃদয়ের ব্যকুল ধ্বনি শুনতে পেলাম। সে ফিরছে না আমার পানে। আমি কি ডাকব তাঁকে? সে কি ফিরবে?
.

দীর্ঘক্ষণ আমি তাঁর ছায়ার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিষ্প্রাণ পাথরের ভাস্কর্যের মত! সে পিছু ফিরল না। কিছুদূর সামনে এগিয়ে গেলো। এরপর ডানে মোড় নিয়ে তটরেখা ধরে হেঁটে চলল। সাগরের ঢেউ তীরে এসে ফেনা হয়ে যায়। এরপর কিছু ফিরতি টানে সাগরে হারায়। বাকিটুকু ক্রমশঃ মিলায়.. শূন্যে। সে ও তটরেখা ধরে হেঁটে হেঁটে একসময় শূন্যে মিলিয়ে গেলো!
.

আসলেই কি? কেউ শূন্যে মিলায়? আজও আমি সেখানে দাঁড়িয়ে। তাঁর আসার অপেক্ষায়। যদি সে কখনো এসে ফিরে যায়!
.

‘যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্খার ঘর!’
-বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।*

#ফিরে_এসো_এই_অন্তরে_অণুগল্প_৪৩২

* বলিল অশ্বথ সেই- জীবনানন্দ দাশ

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

5 thoughts on “ফিরে এসো এই অন্তরে : অণুগল্প-৪৩২

  1. ‘যেখানেই যাও চলে, হয়নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
    এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধুসর
    ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্খার ঘর!’
    -বলিল অশ্বত্থ সেই নড়ে-নড়ে অন্ধকারে মাথার উপর।''

    কী অসাধারণ এক লিখার মধ্য দিয়েই না লিখাটি সমাপ্তি টেনেছেন। গুড মি. মামুন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. অণুগল্পটি পড়ে আপনার অণুপ্রেরণামূলক মন্তব্য রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।

       

      শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  2. আপনার অণুগল্প গুলো আমার ভীষণ পছন্দের প্রিয় গল্প দা :)

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।