আমার অনেক আগের লেখা এই ছোটগল্পটিকে আমি একটি টেলিফিল্মে রুপ দেবো। এটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। আমাদের দেশে সমস্যা হলো গল্প এবং থিম চুরি হয়ে যায়। এই গল্পটি আমার টাইমলাইন এবং বেশ কয়েকটি বাংলা ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে। প্রিয় ব্লগ শব্দনীড়েও আজ আমার নিজের লেখা উল্লেখ করে পুনরায় প্রকাশ করছি। কেউ যদি গল্পটি এবং থিম ‘চুরি’ করে নাটক বানানোর চেষ্টা করে, তবে কপি রাইট আইনে অন্তত আমি যাতে করে ‘প্রোটেস্ট’ করতে পারিঃ-
_____________________________________________________
ইলিশের মওসুম। তহবিলের সকলে তটস্থ। মালিক এসেছেন। ম্যানেজার থেকে শুরু করে পিওন পর্যন্ত সকলে কেমন ভয়ে ভয়ে পার করছে সময়। মাসে একবার মেঘনার পাড়ের এই তহবিলে আসেন তিনি। শহুরে জীবন থেকে সামান্য সময়ের জন্য বৈচিত্রের স্বাদ পেতেই বুঝি এই আসা-যাওয়া।
.
নিজের গদিতে বসে আছেন মালিক। তহবিল বলাতেই গদির উল্লেখ করা, নচেৎ নিজের বিলাসবহুল রিডিং রুমের আরামদায়ক চেয়ারটির মত, একই আরামে ডুবে আছেন তিনি।
.
সবাই যে ভয়ে থাকবে, এটাও জানেন তিনি। ম্যানেজার ব্যাটা বড় চোর। আর ওর নিজের কুকর্ম ঢাকতে, অধীনস্থদের কে ও চোর বানিয়েছে সে। একদল চোর পালছেন তিনি। এটা ওদের সামনে ও বলেন প্রায়ই।
.
বেল চাপেন। ম্যানেজার আসে। নিরবে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ নিচের দিকে। তার কাচুমাচু ভাব দেখে মালিক বিরক্ত হন। দু’হাতে ধরা বাসি খবরের কাগজ থেকে চোখ নামান। ভাঁজ করে রাখেন টেবিলে। জিজ্ঞেস করেন, ‘ছত্রিশ বোটের মাঝি পাওয়া গেছে?’ শুধু শুধু ঢোক গিলে ম্যানেজার। গলা খাঁকারি দিয়ে জানায়, ‘ জি স্যার।’
.
চুপ থাকে সে। অতিরিক্ত কথা বলাটা, মালিক পছন্দ করেন না।
‘ কি নাম?’
– স্যার?
‘বলছি মাঝির নাম কি? কোন গ্রাম?’
– সামছু মাঝি। চর আলেকজান্ডারের।
.
এবার মালিক চুপ থাকেন। ভাবনারা ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে গান করে তার মস্তিষ্কে। জানালা দিয়ে নদীর পাড়ে সারি সারি মাছ ধরা ট্রলার। জাল শুকাতে অলস অপেক্ষমান। রঙ বে রঙয়ের এবং বিচিত্র নামের এক একটা জলযান। বেশ প্রশান্তি অনুভব করলেন। এর ভিতর তার নিজের ও অনেকগুলি। বাহাত্তুর ইঞ্জিনের সহ কয়েকটা আছে।
.
‘ফরিদ মাঝি লেনদেন চুকায়ে গেছে?’
– আপনার কাছে হিসাব দেয়া আছে, স্যার।
‘সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দেবা। বাঁকা ত্যাড়া উত্তর আমার পছন্দ না। মনে রাখবা।’
– রাখব স্যার।
.
কিছুক্ষণ অধস্তনের দিকে চেয়ে থেকে মালিক গম্ভীর হয়ে জানান,
‘তোমার চাকরি কনফার্ম করার সময় বলছিলাম, আমি খুব কড়া মানুষ। কেউ সাত লাখ টাকা নিয়ে দিতে পারবে না, মাফ চাবে আমার কাছে। মাফ করে দেবো আমি। কিন্তু কেউ আমার পাওনা এক টাকা দিতে অস্বীকার করবে, ছাড়ব না কিন্তু। সাত লাখ টাকা খরচ করব ঐ এক টাকা আদায়ের জন্য।’
.
ঘরের পরিবেশ ভারী লাগে ম্যানেজারের কাছে। সে সাহস করে মালিকের দিকে তাকায়। দেখে মালিক চেয়ে আছে ওর দিকেই। পলক পড়ে ম্যানেজারের। আর তখনই জলদগম্ভীর স্বরে মালিক জিজ্ঞেস করেন,
‘ ফরিদ মাঝির কাছে পাওনা কত আমার?’
– সাড়ে আট লাখ।
‘তো? কি করছ এই ক’দিন। শুনতে পাই সে নাকি বলে বেড়ায়, টাকা না দিলে কি করতে পারব আমি দেখবে সে!’
– আমি কয়েকবার তাগাদায় গেছি স্যার। সে ধানাই পানাই কথা বলে, না হয় সময় চায়।
‘হুমম… শোনো, বাসেতরে গিয়া জানাও, ফরিদ মাঝির চর্বি বাইড়া গেছে। বেড়ির উপর আমার দেয়া ওর ঘরগুলি ভাইঙ্গা নদীতে ফালায়ে দেবে। মারধোর করবে না। কেবল বাম হাতটা ভাঙ্গবে। ভিক্ষা চাবার জন্য ডান হাতের দরকার পড়ে। বাম হাত বাড়ানো বেয়াদবির সামিল, জানো তো?’
.
মাথা নেড়ে সায় দেয় ম্যানেজার। ভয়ে তার কলজে শুকিয়ে আসে। কিছু টাকা তো ফরিদ মাঝির নাম দিয়ে সে নিজেই মেরে দিয়েছে। মাঝি যদি মাইরধোর খেয়ে আসল হিসাব নিয়ে বসে, তবে তার ও অবস্থা খারাপ। এই বয়সে মারধোর খেতে কেমন লাগবে কে জানে।
.
‘যাও, এখন সামছু মাঝিরে পাঠাও আমার কাছে।’
-জি আচ্ছা।
.
মালিকের সামনে থেকে একরকম পালিয়েই আসে ম্যানেজার। ঘেমে গোসল করে ফেলেছে যেন। তহবিল থেকে বের হয়। সামনে একটু এগিয়ে এক দেয়ালের পাশে দাঁড়ায়। জিপারের পুলার নিম্নগতি লাভ করে ওর। পকেটের দোমড়ান স্টার সিগ্রেটের প্যাকেট থেকে এক শলা বের করে। ঘামে ভেজা হাত নিয়ে ম্যাচের কাঠির দ্বিতীয় চেষ্টায় সিগ্রেটকে জ্বালাতে পারে সে। বুক ভর্তি ধোঁয়া টেনে ফুসফুস ডুবিয়ে দেয়। মুখ দিয়ে কিছু ধোঁয়া বের হয়। তলপেটের কাছে চিনচিনে ব্যাথা। এতক্ষণের আটকে থাকা টেনশন জলের সাথে মাটিতে মিশে যায়। মুখ দিয়ে আপনাতেই বের হয়, ‘কুত্তার বাচ্চা!’
.
সামছু মাঝির দাঁড়ি আছে। কপালে নামাজের জন্য সিজদার স্থানটিতে কালো দাগ। গোল হয়ে আছে। সবুজ রঙয়ের পাঞ্জাবি পড়েছে। সবুজ লুংগি। চেহারায় বেশ সাধু সাধু ভাব। প্রথম দেখাতেই ওনারা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে ফেললেন। দু’জন শক্তিমান পুরুষ!
.
‘তোমার নাম সামছু মাঝি?’
– জি হুজুর।
‘আমাকে হুজুর বলবা না। স্যার বলবা।’
-জি হুজুর.. স্যার।
‘আমার ছত্রিশ ইঞ্জিনের বোটের দায়িত্ব তোমারে দিতে চাই। তুমি কেমন মানুষ?’
-শক্ত মানুষ, স্যার।
‘হুমম, আমার ও শক্ত মানুষ দরকার। আমার নিয়ম কানুন জানা আছে?’
– জে, জানা আছে জে।
‘তারপর ও বলি। আমার থেকে দাদন নেবা। আমার মুদির সদাই দিয়া নাও ভরবা। কমিশনে মাছ আমার তহবিলে দেবা। পথে মাছ বেচবা না। চুরি করবা না। ধরা পড়লে চাকরি যাবে, অপমান হইবা।’
– জে, ম্যানেজার সব জানাইছে জে।
‘হুমম.. যাও, ঐ তাকের উপর কোরআন শরীফ রাখা আছে, নিয়া আস। ওটা ছুঁয়ে শপথ কর, যা বলছি এইগুলা মাইনা চলবা।’
.
সময় একটু যেন থমকে যায় তহবিলের এই রুমটাতে। ধরা যায় কি যায় না। সুক্ষ্ণ একটা ভাব খেলে যায় সামছু মাঝির শুশ্রুমন্ডিত নুরানী চেহারায়। সে হেঁটে গিয়ে তাকের উপর থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে আসে। মালিকের সামনে দাঁড়ায়। ছুঁয়ে বিড়বিড় করে শপথ করে। মালিক খুশী হয়। তৃপ্তিতে তার চোখ বুজে আসে। যদিও তিনি জানেন, এই দরবেশ ব্যাটাও চোর একটা। সে ও সুযোগ বুঝে চুরি করবে। তারপরও ব্যাটার নৈতিকতার উপর একটা চাপ থাকল।
.
সামছু মাঝি ধীর পায়ে তহবিল থেকে বের হয়। কিছুদূর নদীর পাড় ধরে হেঁটে চলে। বাতাসে তার দাঁড়ি উড়তে থাকে। নদীর জলে আলোর প্রতিফলন কয়েকটি শঙ্খচিলের চোখ ধাধিয়ে দেয়। মাছ শিকারে বেড়িয়েছে ওরা।
.
সামছু মাঝি গুলের ছোট্ট একটা কৌটা বের করে। অর্ধেক গুল আংগুলে নিয়ে ঠোঁটের নিচে যত্নে রেখে দেয়। কিনারাবিহীন নদীর মাঝ দিয়ে, কয়েকটি লবণের বার্জ দূরে কোথাও চলে যায়। তাকিয়ে দেখে আর ভাবে সামছু মাঝি। নিজের ভিতরের খুনি সত্ত্বাটি এরকম নির্জনেই বের হয়ে আসে। এই তো, ছ’মাস আগের কথা। তখন কাল্লু ব্যাপারির বোটের দায়িত্ব নিয়েছিল। গভীর সমুদ্রে আরেকটি বোটকে নিরস্ত্র পেয়ে হামলা করেছিল ওরা। ঐ বোটের মাঝিকে কোমরের উপর থেকে দু’খন্ড করে সাগরের মাছদের খাইয়েছিল।পরে ইলিশ মাছ এবং জাল যতটা পারা যায় নিয়ে, মাল্লাদেরকে বোটের বরফ রাখার কম্পার্টমেন্টে গাদাগাদি করে ঢুকায়। বাইরে থেকে কাঠের দরজা পেরেক মেরে আটকে দেয়। শেষে ট্রলার ফুটো করে ডুবিয়ে মারে সবাইকে।
.
এভাবে কয়েকবার এমন করেছে সে। সমুদ্রে যাবার সময় হাতিয়ার নিয়ে যায়। মালিক দিক বা না দিক। জানুক বা না জানুক। নিরস্ত্র গেলে আজ সে ও হয়ত মাছের খোরাক হত।
বড্ড নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর সাগরের মাঝিদের জীবন। পদে পদে মৃত্যুর হাতিছানি। তাই নিজে শিকার না হয়ে শিকারি হয়েছে সে।
আর তাকেই কি না পবিত্র গ্রন্থটি ছুঁইয়ে শপথ করায়? অনেকবার ভেবেছে সে, একা একা। কখনো যদি মালিককে সাথে নেয়া যেত সাগরে মাছ ধরার সময়! বরফের প্রকোষ্ঠে দম বন্ধ হয়ে, গভীর পানির নিচে তলিয়ে যেতে মালিকের কতটা সময় লাগে, দেখবার বড় ইচ্ছে তার। এই দাদনখোর বড় মানুষগুলি, তাদেরকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করছে। শুষে নিচ্ছে ছারপোকার মত। এদের জন্যই এক একজন সামছু মাঝির ভিতর থেকে কখনো কখনো বের হয়ে আসে, এক একজন জলদস্যু কিংবা একজন খুনি! উৎপাদনের সকল উপকরণের মালিক তারা-ই থাকে জনম ভর। জীবনের আনন্দের সকল উৎস মালিকদেরকে ঘিরে রাখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আর মাঝিদের ঘরে? বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা সেই একই অভাব-অভিযোগ, দু:খ-কষ্টের মহাসম্মেলন। দিনে দিনে এগুলো বাড়তেই থাকে ক্রমশ:। বিপরীতে বাড়ে মালিকের আনন্দের উপকরণ। গড়ে উঠে সম্পদের পাহাড়!
.
এজন্যই মালিকেরা কখনো সামছু মাঝিদের সাথে গভীর সমুদ্রে খুন হতে যেতে চান না। মেঘনার পাড়ে, সবুজ লুংগি পাঞ্জাবিতে আচ্ছাদিত একজন সামছু মাঝি, তার পরবর্তী খুনের দৃশ্যকল্প ভেবে উল্লসিত হয়। তবে সেখানেও কেন জানি, তহবিলের আরাম কেদারায় বসে থাকা ক্ষমতাবান মানুষটির চেহারা ভেসে আসতে চায় না। আবার নতুন করে ভাবা শুরু করে সে।
.
এভাবে দুই বিপরীত শ্রেণির ভিতর চলে আসা টানাপোড়ন, কোনো একদিন হয়ত তাদেরকে জায়গা বদল করাবে।
‘হয়ত’ – ভাবে সামছু মাঝি। কিন্তু সে জন্য অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না।
.
গুলমিশ্রিত এক দলা থুথু প্রচন্ড গতিতে এসে পড়ে অদূরে নোঙ্গর করা ছত্রিশ ইঞ্জিনের একটি মাছ ধরার ট্রলারের বডিতে। এটার মাঝি সে। সামছু মাঝি।।
দারুণ ক্লাইমেক্স পড়লাম। সামছু মাঝি নিপীড়িতদের একজন। যে ভাবনা তার মননে খেলা করে যায়; সেটা তার হৃদয়ের গহীন এক লঅম্বা ভাবনা। লঅম্বা এবং দীর্ঘকালীন সময়ের নির্যাতনে এক প্রতিবাদী চরিত্র।
কপি রাইট আইনে আপনিই বিজয়ী হবেন মি. মামুন।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
এই একটি গল্পের চরিত্রদের সাথে আমি মিশে যাবার চেষ্টা করেছিলাম। ট্রলারে করে গভীর সমুদ্রেও যাবার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। জীবন্ত (যতটুকু সময় থাকে আর কি) ইলিশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। মোটকথা । জেলেদের খুব কাছ থেকে দেখেছি, আমার বউয়ের বাবার ইলিশ মাছ ধরার ব্যবসা রয়েছে, এজন্য ওদের জীবন সংগ্রাম দেখাটা আমার জন্য সহায়ক হয়েছিলো।
সামছু মাঝির এই চরিত্রটিতে আমি নিজেই অভিনয় করবো বলে ভাবছি। ইনশা আল্লাহ, সময় আসুক, ৪৫ মিনিটের কিংবা আরও বেশী একটি টেলিফিল্ম আপনাদেরকে উপহার দিতে পারবো।
শুভেচ্ছা…

ইনশাল্লাহ। আপনি নিশ্চয়ই সার্থক হবেন মি. মামুন।
ইনশা আল্লাহ ভাইয়া।
শুভ রাত্রি।
সামছু মাঝি'র জন্য মনটা কেমন করে উঠলো যেন। শুভেচ্ছা নিন কবি দা।
এরা আজীবন নির্যাতিত। এদেরছেলেমেয়েরা এবং বউয়েরাও এই কষ্টের ভাগীদার। এরা আসলে জীবনের কোনো অংশেই সুখ পায় না, দিদি।
ধন্যবাদ গল্পটি পড়ে আপনার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
শুভেচ্ছা…
গল্পের মাঝেই ডুব দিয়ে রইলাম, যে ঘোর এখনো কাটেনি, এটিকে চলচ্চিত্রায়ণ করতে পারলে আপনার বিজয় অবধারিত বলে ভরসা রাখা যায়। আশা করি আমি গর্বিত দর্শক হবো আপনার বিজয় নিশানার।
আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগত!
আপনার অনুভূতি প্রেরণাদায়ক।
জি, ইনশা আল্লাহ, আপনি একজন দর্শক হবেন হয়তো।
শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় অগ্রজ। বেশি বেশি লিখুন যাতে পড়ে ঋদ্ধ হতে পারি।