ট্যাগ আর্কাইভঃ মামুনের ছোটগল্প

।। ছোটগল্পঃ ইচ্ছেপূরণ ।।

।। ছোটগল্পঃ ইচ্ছেপূরণ ।।

নিজের ছোট্ট রুম থেকে বের হয়ে চারপাশটা দেখলেন। কিছুটা মুগ্ধ হয়েই। এরপর দরজায় তালা লাগালেন। প্রতিবারই এমন হয়। কিছুক্ষণ নীল আকাশ ও সাদা মেঘের উড়ে যাওয়া দেখে মনে মনে বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ!’

বহুদিনের অভ্যাস।
এখন আপনা আপনিই মন থেকে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যায়। মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিসমূহ দেখতে থাকলে মনের অগোচরেই তার পবিত্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে! এর জন্য আলাদা ভাবে মুখ দিয়ে উচ্চারণের প্রয়োজন হয় না। আর মহান আল্লাহপাক এই মনকেই দেখেন… সেখানেই বসত গড়েন। কিন্তু তার জন্য চাই সাদা…স্ফটিকের মত মন।

আজ দুই মাস হতে চলল গাজীপুরের এই এলাকার মসজিদের ইমাম হিসাবে আব্দুল জাব্বার সাহেব নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে ফেনীর একটি প্রত্যন্ত এলাকায় এক মসজিদের ইমাম ছিলেন। ইমাম-কাম-মোয়াজ্জিন… একাই তাকে এই দুটো দায়িত্ব পালন করতে হতো। সেখানের মসজিদ কমিটি কোনোমতে তাকে খাইয়ে-পরিয়ে আর মাসিক থোক কিছু টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

ভাবনায় হোঁচট খেলেন।
এইতো একটা নাফরমানী চিন্তা করে ফেলেছেন। মসজিদ কমিটির কি সাধ্য তাকে বাঁচিয়ে রাখে? আল্লাহপাক চেয়েছেন বলেই না সেখানে তার রিযিক এসেছে… সেটা পরিমাণে যাই আসুক না কেন।

মনে মনে কয়েকবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ (হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন) পড়লেন। সাথে সাথে একথাও তার মনে পড়ল, সেই গ্রামের মসজিদে আল্লাহ পাক তার জন্য যে পরিমাণে রিযিক পাঠাতেন, সেটা দিয়ে তার নিজের এবং ভোলায় তার পরিবারের প্রতি মাসের খাওয়া খরচই মিটানোই মুশকিল হয়ে যেত। অন্যান্য কিছুর কথা তো বাদই দিলেন। টাকাগুলো সব কুরিয়ারে বাড়িতে পাঠাতেন। নিজের তিনবেলা খাবার এক এক দিন এক এক বাড়িতে নির্ধারিত ছিল। ভাল-মন্দ খাওয়া হয়েই যেত। এটাও আল্লাহপাকের ইচ্ছা।

তবে প্রতিবেলায় নিজের উদরপুর্তি করে ভালো ভালো খাবার খাওয়ার সময় চোখের সামনে ভেসে উঠত ভোলায় বৃদ্ধা মা, বউ আর তিন সন্তানের অভুক্ত চেহারাগুলো। কিন্তু খাবার নষ্ট করা যাবে না ভেবে জোর করে হলেও সেগুলো গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। নিজের চোখের পানিকে মনের ভিতরের রক্তক্ষরণের সাথে মিশিয়ে ফেলতে হয়েছে। পাছে তার চোখে পানি দেখে খেতে কষ্ট হচ্ছে ভেবে যিনি খাওয়াচ্ছেন তিনি আবার কষ্ট পান!

কতটা গরিবী হালতে রয়েছে তার পরিবার যে তিনবেলা পেটভরে খাবারও খেতে পারে না। নদী ভাঙ্গনে তাদের সহায়-সম্পদ নদীর গর্ভে চলে গেছে। গুচ্ছগ্রামের বাড়ীটা পাওয়াতে তাদের মাথাগোঁজার একটা ঠাই হয়। এখানে তার কাছে যে সবাইকে এনে রাখবেন, সেই সামর্থ্যও তার নেই। নিজে কোনোমতে মসজিদের সাথের ছোট্ট খুপড়িতে থাকেন। পরিবারের বাকী ৫ জনকে এনে কোথায় রাখবেন? আল্লাহপাক সবরকারীদের সাথে থাকেন। সেই সবরই তিনি করছেন। এই অজ পাড়াগাঁ এ আজ পাঁচটি বছর ধরে পড়ে থাকা কি কম সবরের কাজ?

একদিন গাজীপুরের এই মসজিদটির ইমাম নিয়োগের খবর পান আরেক পরিচিত গ্রামবাসীর কাছ থেকে। সে গাজীপুরেই থাকে। তার কথামত দরখাস্ত করেন… ইন্টারভিয়্যু দেন এবং সিলেক্ট হয়ে আজ এখানে।

ভাবতে ভাবতে মসজিদ ছাড়িয়ে আরো অনেকটা এগিয়ে গেলেন। আজ জুম্মাবার। আজানের এখনো ঘন্টা খানিক বাকী আছে। এখান থেকেই বাজারের শুরু। এই এলাকায় বেশ বড় একটি গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে।বেশ দূরে আরো কয়েকটি। এগুলোকে কেন্দ্র করেই এই এলাকাটার গড়ে উঠা। নাহলে একসময় এই এলাকা ইটভাটার জন্য কুখ্যাত ছিল। ধীরে ধীরে ফ্যাক্টরী গড়ে উঠল, কাজের জন্য শ্রমিকেরা এলো। তাদের জন্য ঘর-বাড়ি বানানো শুরু হল… ইটের ভাটার ইট দিয়ে বাড়ী হল… একসময় ভাটা বিলুপ্ত হল… দোকান-পাট তৈরী হল। এভাবেই.. একসময় বড় বড় মার্কেটগুলো এবং ফ্ল্যাট বাড়ীগুলোও অস্তিত্ব পেল। আর এগুলোর পাশে সেলাই দিদিমনিদের জন্য টিন শেডের ‘গার্মেন্টস বসতি’ কিছুটা বেমানান হলেও এদেরকে কেন্দ্র করেই এই জমজমাট আজকের এলাকা।

কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে স্বর্ণের দোকান- সবই হয়ছে। আর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ছোট্ট মসজিদটিও বাড়তে থাকে। ফাউন্ডেশন দিয়ে একতলা শেষ করে এখন দুই তলার ছাদের ঢালাই চলছে। আর এ সবই আল্লাহ পাকের ইচ্ছেতে সবার সহযোগিতায় হয়েছে।

প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি দেহ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় আব্দুল জাব্বার সাহেব না চাইতেই সবার সমীহ আদায় করে নেন। একেতো ধর্মীয় নেতা (ইমামের অর্থ তাই), তার ওপর বিশাল দেহ… সম্মান তো আসবেই। কিন্তু তাকে যারা পরিচালনা করেন সেই মসজিদ কমিটির সদস্যদের কাছে নয়। এটাই এখন সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। যাদের ভিতর ন্যুণ্যতম ধর্মীয় জ্ঞান নেই, আজকাল এরাই বেশীরভাগ মসজিদের কমিটিতে পদ নিয়ে আছে। আর তার মত আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত ইমামদেরকে চলতে হয় কিনা এদের নির্দেশনা মত?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুদী দোকান এর পাশের চা’র দোকানের দিকে আগাতে থাকেন। এখানের এই চা বিক্রেতা নয়ন কে বেশ ভাল লেগেছে ওনার। যা বলে সরাসরি বলে ফেলে। কাউকে ডরায়ও না, ছাড় দিয়েও কথা বলে না।

তাকেকে দেখে সালাম দিয়ে বসতে বলল নয়ন। এরপর চা খাবে কিনা জানতে চাইলে আব্দুল জাব্বার সাহেব সম্মতি দেন। নয়ন চা বানায় আর পাশের খদ্দেরের সাথে কথা বলে। সময় বয়ে যায়..

মসজিদ কমিটির সভাপতি পাটোয়ারী সাহেবের বলা কথা গুলো এখনো মনে আছে। একটু বেশীই মনে আছে। কারণ কথাগুলোর ভিতরে বিশেষ কিছু ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ আপনাকে আপনার এই বিশাল দেহ দেখেই আমরা বেশী পছন্দ করেছি। কারণ ফিগার একটা বড় ফ্যাক্টর। নাহলে আপনার থেকে আরো বেশী জানেন এমন ইমাম আমরা পেয়েছিলাম।’

পাটোয়ারী সাহেব সরকারী চাকুরে। নিজের চার তলা বাড়ী আছে। সেগুলোর ভাড়া পান। আর টাকা ধার দেবার সমিতি রয়েছে। সোজা কথায় বললে ‘সুদে টাকা লাগানো’ হয় এই সমিতির মাধ্যমে। এলাকায় এরকম অনেক সমিতি রয়েছে। যে সকল শ্রমিকেরা এখানে চাকরী করে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এরাই এই সব সমিতি থেকে টাকা সুদে ধার নেয়। তাই এখানের স্থানীয় সকলেই এখন এক একটা সমিতির মালিক। এটাই অর্থ আয়ের সহজ পথ ভাবেন তারা। এদিকে আবার বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এরাই হয় মসজিদ কমিটির সদস্য!

ওনাদের বাড়ীতেই মসজিদের ইমাম হিসেবে পালাক্রমে এক একদিন এক একজনের বাসায় আব্দুল জাব্বার সাহেবকে খেতে হয়।

ইসলাম ধর্মে আছে, হালাল খাবার খেতে হবে। অথচ সুদের কারবার যারা করে মসজিদের ইমাম সাহেবকে তাদের বাড়িতেই খেতে হয়! আর এ ছাড়া কিছু করারও তো নেই। তাকে যা বেতন দেয়া হয়, সেটা একেবারে ফেলে দেবার মত না। গ্রামের বাড়ীর সবাইকে নিয়ে এখানে এনে রাখতে পারবেন এখন। কিন্তু এলাকার এটাই রেওয়াজ। তিনি যদি না করে দেন, তাতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে। নাহয় বাড়ি বাড়ি খেলেন না, কিন্তু কোনো না কোনো সময়ে তো কারো না কারো বাড়ি খেতে যেতেই হবে। তখন?

আগের ইমাম সাহেবও খুব কামেল লোক ছিলেন। এই মসজিদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে, ওয়াজ এর আয়োজন করে এই মসজিদ এতোদুর নিয়ে এসেছেন।

অথচ তাকে বাদ দিয়ে দেয়া হল।
কারণ তিনি জুমুয়ার খুতবাতে সুদের বিরুদ্ধে বলতেন। কমিটির লোকেরা ওনাকে এই ব্যাপারে না বলার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারো কথাই শুনলেন না। অবশেষে তাকে চলে যেতে হল।

চা খেয়ে বিল দিয়ে আবার ফিরতি পথ ধরলেন। আজানের আর বেশী বাকী নেই। পথে দেয়ালে দেয়ালে সিনেমার পোস্টার। অর্ধনগ্ন নারীদেহের রঙিন ছবি। এরকম কিছুদুর পরপর রয়েছে। সেদিকে চোখ চলে গেলেও দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। সাধারণ পাবলিকের সাথে এখানেই তার পার্থক্য। দীর্ঘদিনের অনুশীলন বলে কথা।

হাঁটতে হাঁটতে পাটোয়ারী সাহেবের আর একটি কথা মনে পড়ল। প্রথম দিন অনেক কিছুর সাথে তাকে এই কথাটিও বলেছিলেন, ‘আপনি ইমাম। মানুষের আখিরাতের মুক্তির জন্য কোরআন হাদিসের আলোকে বয়ান করবেন। সেটা আপনার এক্তিয়ার। কিন্তু সুদের বিষয়টি বাদ দিয়ে বয়ান করবেন। আমাদের এই এলাকার বেশীরভাগ মানুষই হয় সুদের ব্যবসা করে, না হয় সুদে টাকা ধার নিয়েছে। এখন এই বিষয়ে আলোচনা করলে সকলেরই শরীরে লাগে।’

সেই সময় একবার চিন্তা করলেন, পাটোয়ারি সাহেবকে বলেন যে, তবে এই ব্যবসা বাদ দিচ্ছেন না কেন?
কিন্তু অনেক কিছু চাইলেই আমরা বলতে পারি না।

যখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যে, না, এভাবে নিজেকে ছোট করে ইমামতি করা যায় না। তখনই ফেনীর সেই ৫ বছরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কথা মনে পড়ে… ইমাম হবার পরও তাকে জমিতে হালের বলদ নিয়ে চাষে সাহায্য করতে হয়েছে… জায়গীর থাকার মত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে দিনের পর দিন বিনা বেতনে পড়াতে হয়েছে… মসজিদের দেখাশুনা করা তো ছিলই।

আর ছিল পরিবারের সবাইকে ফেলে একা একা থাকা… দিনের পর দিন! আহ! অসহ্য যন্ত্রনাকর সেই দিনগুলোকে ফেলে এখন যখনই না একটু সুদিন আসি আসি করছে, তিনি কি নিজের বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে সেটিকে পায়ে মাড়িয়ে আবার সেই কষ্টকর দিনগুলোতে ফিরে যাবেন? মা-বউ ও তিন বাচ্চাকে এখানে সামনের মাসে নিয়ে আসবেন চিন্তা করেছেন। পাটোয়ারী সাহেব একটা দু’রুমের বাসাও তার জন্য অল্প ভাড়াতে ঠিক করে দিয়েছেন। পাশেই স্কুল আছে। সেখানে ছেলেমেয়ে তিনজনকে ভর্তি করাতে পারবেন। একটা মাদ্রাসা করার চিন্তা করেছে মসজিদ কমিটি, সেটাও তাকে চালাতে হবে। সেদিক থেকেও কিছু টাকা আসবে। আর সকালে এখন তার কাছে প্রায় ৫০-৬০ জনের মত আরবী পড়ছে। সেখান থেকেও অনেক টাকা আসছে।

এই সব কিছুকে ছেড়ে যেতে হবে একেবারে খালি হাতে, যদি কমিটির সদস্যদের কথার বাইরে নিজের বিবেকের কথা মত চলেন।

কি হবে আবার ফিরে গেলে?
মাকে ফোনে সেদিন বলেছেন, ‘চিন্তা কইরো না। আমার কাছে তোমাদের সবাইকে নিয়ে আসছি। আর কষ্ট করা লাগবে না।’

মা এর হাসিমুখ এতো দূর থেকেও তিনি দেখতে পেলেন। বউ এর খুশী অনুভব করতে পারলেন। ছেলেমেয়েদের বাবার কাছে আসার… একটু পেট ভরে খেতে পারার আনন্দকে নিজের হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারছেন।

এসবই স্রেফ উবে যাবে!
তার একটি সিদ্ধান্তের দ্বারা।

মসজিদের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জুতো জোড়া হাতে নিতে নিতে ভাবেন, একটা হাহাকার জীবনে সবসময় থেকেই যায়। সেটাকে কেউই অতিক্রম করতে পারে না।দারিদ্র্যতা জীবনের একটা অলংকারের মত তার জীবনে রয়েই গেলো। তবে যে এই দারিদ্র্যতাকে মেনে নিতে পেরেছে, তাকে কখনো শান্তির পিছনে ছুটতে হয় নাই। বরং শান্তিই তার পিছু নিয়েছে।

বড় করে শ্বাস নিয়ে মিম্বরের দিকে চলে যান। আজান দিতে হবে।

পুরো মসজিদে পিনপতন নীরবতা না থাকলেও মোটামুটি সকলেই নীরব। এই নতুন ইমাম এর কথার ভিতরে একরকম যাদু আছে। শুনতে বেশ ভালোই লাগে। খুৎবার আগে ইমাম সাহেব বাংলায় কিছু বয়ান করেন। এখন সেটাই দিতে যাচ্ছেন নতুন ইমাম আব্দুল জাব্বার সাহেব। তিনি সালাম দিয়ে শুরু করলেন,

– আল্লাহ পাক সুদকে হারাম করেছেন… যাকাতকে করেছেন ফরয।।

#মামুনের_ছোটগল্প

উত্তর দেয়নি

উত্তর দেয়নি

“তার পর স্মরণে এলো”, আগের বছরের ঘটনা। কার্তিক মাস একটু একটু শীতের মরশুম, মাস প্রায় শেষের দিকে, চলছিল কালী পূজোর হই হুল্লড়। আগের দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল পূজো, মেলারও ধর্মকর্ম। —–

“হইহুল্লড়, পটকা বাজি কালী মার বিসর্জন হবে;
তাইতো পরেরদিন সীমাহীন মাতওয়ারা সবে।”

“আশ্চর্য ব্যাপার!” ‘বাড়ির কাছে গাঁ, কিন্তু সেই গাঁয়ের আমি কেউ না।’ একথার অর্থ বুঝতে ঘাবড়ে গেলেও একথা একদিক হতে একেবারে খাঁটি। কেননা ওগাঁয়ে আমার বিপরীত সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস। এতে মাথা খারাপ করার কিছু নেই। একথা বলে কি আমি শয়তান হাসাবো, আর হাসির ছলে ঈমান ধ্বসাবো? না…না আমি সেপথ অবলম্বন করিবো না। তার সাথে আমি একথাও ভুলে যাবো না যে ওগাঁয়ে যারা বসবাস করে তারা যদি হয় মানব, তাহলে আমার ও তাদের সম্পর্ক একেবারে ঘনিষ্ঠ। আমার ও তাদের সৃষ্টির উৎস এক।

সারাদিন হইচই, দিন শেষ, সন্ধের আগমন এমন সময় আযান পড়ছে মসজিদে মসজিদে বেরিয়েছি নামাজের উদ্দেশ্যে। সাইকেলে চড়ে চলেছি। একটু এগিয়ে গেলে রাস্তার ডানে বামে পড়ে ছোটো ছোটো কয়েকটা জলাশয়। সেখানে চোখে পড়লো বিপরীত সম্প্রদায়ের মা কালীর বিসর্জন মেলা।

তারা মাকে মাথায় করে ঘরে তুলেছিল খুব যত্নের সাথে। আর দিয়েছিল পশুবলি। রাখলোও দু’তিন দিন ধূপ ধূনো দিয়ে খুব আদরযত্নে। “কিন্তু আজ অবাক কান্ড!” দেবীর মান সম্মান ও স্থান একেবারে শোচনীয়! কোথায় যাচ্ছে চলে,ভাবাই যায়না। হাজির হয়েছে জলাশয়ে। খড়গ হাতে দাঁড়িয়ে, নিরীহ রমণীর মতো, নেই কোন বাক্, পলকবিহীন চোখ তার ভক্তের দিকে চেয়ে রয়েছে। একটু পরেই তার সমাপ্তি। আছাড়ে ফেললো জলে, সঙ্গে সঙ্গে আট দশজন ছেলে তার ওপর ওঠে শুরু করেছে গুতোতে। মাথাটা তখনো ডুবেনি। সাইকেল রেখে একটু এগিয়ে গেলাম মাথাটার দিকে। তার চোখ গুলো যেন সাহায্য কামনা করে আমার দিকে চেয়ে আছে।
আমি তখন মা কালীকে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম ——-

“মা কালী মা কালী
তুই আর চুলকানি পাড়া যাবি?
তুই কি আর ওই পাঠার মুন্ডু খাবি?
উত্তর দে উত্তর!
উত্তর না দিলে এমনই শাস্তি পাবি!”

আমি বলতেই আছি এমনি সময় তার মাথায় লাফিয়ে এসে একজন দিলো জোরে এক লাথি, তখনই সঙ্গে সঙ্গে গলে গেলো মাথাটা।

সেখানেই একজন সুর করে গেয়ে উঠলো ——-

“হাতে গড়া দেবী মোর,ছিলো কালী মা।
শুধুই গেলো সময় নষ্ট, কর্ম হলো না।
শুধুই হলাম পাপে ভস্ম, ধর্ম হলো না।।
এইতো তুমি মোদের দীপা কালী মা।।”

আমি বলে উঠলাম হ্যাঁ ভাই ঠিকই। কিন্তু বোঝার চেষ্টা করিসনা কেন? কী করবো ভাই——-

“আদি হতে বহিয়াছে
বাপ দাদা সহিয়াছে
মোরা কেমনে ছাড়ি।
জানি আমি জানি
আমি যদি না মানি
তারা করিবে আড়ি।।”

ইতিমধ্যে একজন চেঁচিয়ে বললো তাকে এই তুই কি ফালতু বলছিস। আমি মাঝ থেকে বলে উঠি ও যা বলেছে তা থাক তুই আমার কথা শোন। সে আমাকে আজেবাজে বকতে লাগলো। তুই এখান থেকে গেলি। তোরা বাদিয়ারা এরকম কেন করিস? কিরে ভাই কি করি? আমাদের প্রতিমার সম্পর্কে আজেবাজে বলিস। না…..না তোদের প্রতিমার সম্পর্কে আজেবাজে কিছুই বলি না। কেননা তাতে আমার কোন অধিকার নেই আদেশও নেই। তোদের প্রতিমার সমন্ধে প্রশংসা করলে যতটুকু পাপ, নিন্দে করাতেও সমপরিমাণ পাপ। তাহলে বল তোদের প্রতিমার সমন্ধে প্রশংসায় কেন করতে যাবো আর নিন্দেই বা কেন করবো? আমার যে আদেশ ও অধিকার আছে সেটা হলো আমার ধর্ম ছাড়া আর কোন সঠিক ধর্ম নেই তা তোদের মতো লোকের কাছে তুলে ধরা।আমার ধর্ম সমন্ধে আমি যতটুকু জানবো ততটুকুই তোকে সচেতন করবো। এটা আমার রবের আদেশ ও আমার অধিকার। সে তখনো চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, কোন উত্তর দেয়নি।

*(১৩/১১/১৮)

যেতে যেতে দুয়ার হতে : ছোটগল্প


আমার ভুবনে আমি একা। বড্ড নিঃসঙ্গ! সবাই থেকেও যেন নেই। নিজের থেকে নিজেই যখন দূরে সরে যায় কেউ, তখন চেতনায় দীর্ঘশ্বাসের জমাট বাষ্পে পরিচিত ছায়াগুলোকেও কেমন ঝাপসা দেখায়! আমার বেলায়ও তাই হয়েছে।
.
আমি এখন আর আমাতে নেই। অন্য কেউ-কিছু একটা আমাকে দখল করেছে। এক মরণব্যাধি ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করে চলেছে। সবাই জানে। আমিও… অথচ অন্যরা এমন ভাব করছে যেন কিছুই হয়নি। আমিই পৃথিবীর সব থেকে সুস্থ মানুষ… একমাত্র সুস্থ মানুষ!নীরবে চোখের জল মুছে মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে আমার কাছে আসে। কিন্তু চোখের জল মুছলেই যে হৃদয়ে কান্নার দাগ লুকোনো যায় না- এই চরম সত্যটা বুকে ধারণ করে অভিনয়ের জন্য হয়তো তাঁরা অস্কারের নমিনেশন পেতে পারবে। কিন্তু ক্যান্সারের সাথে বসবাসকারী এই যুবকের সামনে ওদের মিথ্যাচারগুলো যে কত অবলীলায় ধরা পরে যায়, ওরা তা কি বুঝে?
.
ওরা বলতে খুব কাছের তিনজন মানুষ। আর একসময়ে তাঁদের থেকেও কাছে আসা… এখন অনেক দূরে সরে যাওয়া আরো একজন। কাছের তিনজন হলেন আমার বড় ভাই, ভাবি এবং ছোট বোন।
.
বাবা-মা হারা তিন ভাইবোনের এই ফ্যামিলিতে ‘ভাবি’ নামের অন্য একজন ‘আউটসাইডার’ নিজের ভিতরের মমতার ডালি খুলে দিয়ে আমাদের পিঠাপিঠি দু’ভাইবোনকে তাঁর ন্যাওটা বানিয়ে নিয়েছিলেন! বড় ভাইয়া আমার থেকে দশ বছরের বড়। আমি আর রূম্পা দুই বছরের ছোট বড়। বাবা-মা দুজনেই গত হয়েছেন আজ আট বছর হল। সেই থেকে আমাদের দুই ভাইবোনকে সহ বাবার রেখে যাওয়া হামিদ গ্রুপ এবং এর ছোট বড় কয়েকটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী ভাইয়াই শক্ত হাতে আগলে রেখেছেন। একাই সব দিক সামলিয়েছেন। আমার মাস্টার্স কমপ্লিট হবার পরে আমাদের দু’জনের জোরাজুরিতে বিয়ে করলেন। জীবনের পঁয়ত্রিশটি বসন্ত তখন ইতোমধ্যে পার করে দিয়েছেন। এমনই বাবার মতো বড় ভাই যখন আমার চোখের দিকে তাকাতে পারেন না… ভাব করেন আমার কিছুই হয়নি… তখন নিজেকে সামলাতে পারি না। কিন্তু ক্যান্সার রোগীদের আবেগ থাকতে পারবে না। নিরাবেগী হয়ে তাদেরকে সবদিক সামলে চলতে হবে!
.

ক’টা বাজে এখন?
আমার কাছে ইদানিং সময় স্থির! ঘড়ির টিক টিক শব্দ আমাকে বেঁধে দেয়া একটি নির্দিষ্ট সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই আমার এই রুমে কোনো ঘড়ি রাখতে দেইনি। আমি নিজেই। দক্ষিণ সাইডের বেডসাইড উইন্ডোটি হাল্কা নীল কার্টেনে ঘেরা। ওটা সরালেই নীল সমুদ্র দেখা যায়। হোটেলের এই স্যুইটটি আমার জন্য ভাইয়া ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর দিয়ে ‘স্পেশাল’ ভাবে সাজিয়েছিলেন। পুরো হোটেলটাই আমাদের। পৃথিবীর সব থেকে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের বেলাভূমিকে সামনে রেখে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। আমার চারিদিকে প্রাচুর্য্যের ছড়াছড়ি। নীচে হোটেলের কার পার্কে আমার টয়োটা স্পোর্টস কার’টি আমার মতো নিঃসঙ্গ পড়ে রয়েছে। ওর মসৃণ শরীরে হয়তো ধুলা জমে আছে… ওকে বিবর্ণ করেছে…আর আমাকে বিবর্ণ করছে মৃত্যুর কালো ছায়া!
.

রোগটা প্রথম যখন ধরা পড়ল, তখনই অনেক দেরী হয়ে গেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা আমাকে দেখলেন… অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। শেষে একদিন আমাকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে ভাইয়াকে একা ডেকে নিয়ে ডাক্তার কথা বললেন। কিছুক্ষণ পরে ভাইয়া আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। তবে সেদিনের ঐ মুহুর্তটা আমার আজীবন (জীবনের যতটুকু আর বাকি রয়েছে সে পর্যন্ত) মনে থাকবে। সুইং ডোর ঠেলে একজন বিধ্বস্তপ্রায় মানুষ বের হলেন… যার সম্পদের পরিমাণ তিনি নিজেই জানেন না… হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসছিলেন। আমার দিকে চোখ পড়তেই মুহুর্তে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঐ টুকু সময়ে তাঁর চোখে আমি আমার সর্বনাশ দেখে নিয়েছিলাম… দেখেছিলাম আমার ভবিষ্যৎ। ভাইয়াকে তখন একজন নিঃস্ব-কাঙ্গাল মনে হচ্ছিল।
.

আমি ডাক্তারের সামনে বসলাম। টুকটাক কথাবার্তার এক পর্যায়ে ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়ং ম্যান, তোমার শরীর এখন কেমন?’ আমি ওর মুখের ওপর হাসলাম। একেতো নমিনেশন বাদ দিয়ে সরাসরি অস্কার দিয়ে দেয়া উচিত। অভিনয়ের জন্য অবশ্য। সব জেনেও কেমন অভিনয় করছে। বললাম, ‘আমার থেকে তোমারই ভালো জানা উচিত।’ ওর মুখের হাসিটা একটুও ম্লান হলোনা। পেশাদারিত্বের চরম পরকাষ্ঠা সেদিন সেই বিশেষজ্ঞের চেম্বারে বসে দেখলাম। আমার আর এখানে কোন থাকার প্রয়োজন নেই বলে সে তাঁর ডান হাতটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। আমি স্থির থেকে ভাইয়াকে রুমের বাইরে যেতে অনুরোধ করলাম। ডাক্তারের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে ভাইয়া বের হয়ে গেলেন। এবারে আমি ডাক্তারের হাতকে নিজের হাতে নিয়ে বললাম, ‘ওয়েল ওল্ড চ্যাপ, এখন বলো আমার হাতে আর কতদিন আছে?’
.

আমার খুব পানির তেষ্টা পেয়েছে। উঠে বেডসাইড টেবিল থেকে পানি খেলাম। রুমটা অনেক অন্ধকার। এখন এভাবে থাকতেই আমার আরাম লাগে। একসময় অন্ধকারকে প্রচন্ড ঘৃনা করতাম। আলো আর আলোয় ভরা এক উচ্ছশৃংখল জীবনের মালিক ছিলাম। শরীরের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করেছি… প্রচুর সিগ্রেট টানতাম… সেখান থেকেই মরণব্যাধি আমার দেহকে বেছে নিয়েছে নিজের পুষ্টি পাবার জন্য। আমিও জীবনকে উপভোগ করার এমন কোন পথ বাকি রাখতাম না… আজন্ম এক বোহেমিয়ান লাইফ লীড করে এসেছি। আজ নির্জন একটি রুমে একাকী অন্ধকারকে পরম নির্ভরতায় সঙ্গী করেছি। আলো… রোদ এখন অসহ্য লাগে। এগুলো আমাকে আমার অক্ষমতাকেই জানান দেয়।
.

তিনমাস সময় হাতে নিয়ে দেশে এসেছিলাম। আর ক’দিন যেন বাকি আছে? সব কিছু কেমন ভুলে যাচ্ছি আজকাল। ভাইয়া আমাকে গুলশানের বাড়িতেই রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি এখানেই থাকতে চাইলাম। সমুদ্রের প্রতি আমার আগ্রহ সেই ছেলেবেলা থেকেই। সমুদ্রের নীল জলরাশির প্রতি ভালোবাসা আমাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়াতো। জীবনের শেষ দিনগুলো সেই সমুদ্রের সাথেই কাটাচ্ছি আমি। ভাইয়া-ভাবী আর রূম্পা প্রতি সপ্তাহে আসে। আমিই বলেছি এভাবে আসতে। এখানে দেখাশোনা করার লোকের অভাব নেই। বেল টিপলেই কেউ না কেউ এসে হাজির হয়।
.

আস্তে আস্তে জানালার সামনে এসে দাঁড়াই। পর্দা সরিয়ে দিতেই আলোর অসহ্য ঝলকানি আমাকে কয়েক মুহুর্ত অন্ধ করে রাখল। আলো সয়ে এলে চোখ খুলে ব্যালকনিতে যাই। এখন বিকেল। শেষ বিকেল… দিনেরও… জীবনেরও কি? এটাই হয়তো আমার দেখা শেষ বিকেল! আজকের বিকেলটি আমার কাছে তেমন কোনো অনুভূতি আনে না। বাইরে সোনাঝরা রোদ… উন্মুক্ত নীলাকাশ… নীল জলরাশি আর মুহুর্মুহু ঢেউ এর গর্জন… নীল শাড়িতে একজন নীলাম্বরী! এই একই রুমে… এই ব্যালকনিতে… ওর সাথে কাটতো সময় কত গল্প বলে… একদিন এখানেই সে আমার হাতটি ধরে বলেছিল আমাকে, ‘ভালোবাসি!’ এখন কোথায় সে? আমার ক্যান্সার হয়েছে জানার পরেও সে কয়েকবার এসেছে। তবে বিদেশ থেকে মৃত্যু পরোয়ানা জারি হবার পরে সেও আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে থাকে। এটা ওর নিজের ইচ্ছায় নাকি ওর বাবা-মায়ের ইচ্ছায় খুব জানতে ইচ্ছে করে! সে তো নিজের ইচ্ছাতেই আমাকে ভালোবেসেছিল… তবে চলে যাবার বেলায় কেন অন্যের ইচ্ছের দোহাই দেয়া?
একজন মৃত্যুপথযাত্রীকে কেই বা ভালোবাসবে!!
.

তবে সরাসরি আমাকে বললেই পারতো নীলা।
এই লুকোচুরির কোনো দরকার ছিলনা। এখন আমার কোনো কিছুতেই কিছু আসে যায় না। কে এলো কে গেলো কোনো অর্থ রাখে না। আচ্ছা, আমি কি নীলাকে মিস করছি? বোধহয়। তবে ক্যান্সার রোগীদের কাউকে মিস করার ও অধিকার নেই… কাউকে মনে করে কষ্টও পেতে হয় না তাঁদের। কারন প্রতি মুহুর্ত নিজের ভিতরে দুর্দান্ত কষ্টরা ডানা মেলে থাকে! তবে এই রোগীদের কিসের অধিকার রয়েছে, কেউ বলবে কি আমায়? অণুক্ষণ প্রচন্ড এক যন্ত্রণা… বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট কিছু সময়…আর শেষের সেই ভয়ংকর মুহুর্তের অপেক্ষা করা… একসময়ের ভালোবাসাময় চোখগুলো কীভাবে কনভার্ট হয়ে ভাষাহীন করুনাময় চোখে পরিণত হয় সেগুলো চেয়ে চেয়ে দেখার অধিকার? একজন নীলা কীভাবে একজন অপরিচিতা হয়ে ওঠে এবং চলে যায়… বিষন্ন চোখে তা দেখা আর তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা? আমিতো এগুলো চাইনি? তবে আমার সাথেই কেন?
.

সুদর্শন ছিলাম। আমার চুল সবার দৃষ্টি কেড়ে নিতো। ভার্সিটির মেয়েরা পাগল ছিল এই চুলের। নীলা বলতো , ‘একটা স্কার্ফ পড়ে থাকবে বাইরে বের হবার সময়। অন্য কোনো মেয়ে তোমার চুল দেখবে তা চাইনে।’ কেমো দেবার পরে আমার আরো অনেক কিছুর মত সেই চুলও নেই। এখন আমি পঁচিশ বছরের লোলচর্মসর্বস্ব এক কুকুরের মতো! আমার রুমে ঘড়ির মতো কোনো আয়নাও নেই। নিজেকে এখন মনের চোখ ছাড়া আমার দেখবার কোনো উপায় নেই। অবশ্য অন্যের চোখে এখনো তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় নিজেকে দেখতে পাই। তবে তা অতোটা সুখককর নয়।
.

গত সপ্তাহে বন্ধুরা আমাকে দেখতে এসেছিল। কয়েকজনকে তো নিজের দুর্বল হয়ে যাওয়া স্মরণশক্তির জন্য চিনতে পারলাম না। আর কয়েকজন তাঁদের নিজেদের দুর্বলতার জন্য তাদেরকে চিনতে দিলো না। এরাই ছিল আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী… নেশার… তাসের আড্ডার… জীবনের মানে খুঁজতে যাবার…আর আজ এদের চোখে আমার জন্য ভালোবাসাহীন এক দায়সারা আবেগ!
.

নিজের কাছে মোবাইলও রাখি না। ভাইয়া হোটেলের ম্যনেজারের নাম্বারে কল করে আমার সাথে কথা বলেন। এখন বেশীক্ষণ কথাও বলতে পারি না। দরোজা নক করে একজন মোবাইল হাতে এলো। ভাইয়ার ফোন। আমার কাছে জানতে চাইলেন কিছু লাগবে কিনা? বড্ড বলতে ইচ্ছে হল আমাকে আরো কিছুটা সময় পারলে এনে দিতে। কিন্তু বললাম, ‘কিছু লাগবে না।’ ওপাশে অনেকক্ষণ ভাইয়া চুপ করে আছেন। আমিও নীরব। বুঝতে পারছি তিনি কাঁদছেন। আমি যে ওনার কাছে ছেলের মতন। আমাদের জন্য এখনো পর্যন্ত কোনো সন্তান নেননি। স্রষ্টার কাছে এই মুহুর্তে প্রার্থনা করলাম, ‘যদি পারো আমাকে আবার অন্য কোনো জনমে ভাইয়ার সন্তান করে পাঠিয়ো।’ হঠাৎ কি হল, ভাইয়াকে বললাম, ‘একবার নীলাকে দেখতে ইচ্ছে করে।’ মোবাইলটা ফেরত দিতে বেল বাজালাম। ভাইয়ার সাথে আমার শেষ কথাই কি হয়ে গেলো?

কীভাবে দিন আসে… চলে যায়… রাত ভোর হয়… সুর্য উঠে… চাঁদ হাসে এগুলো আমার অনুভূতি থেকে বিদায় নিয়েছে। তাই দরোজা ঠেলে নীলা যখন এলো আমি বুঝতে পারলাম না এটা রাত না দিন। তবে ঘর আলো করে সে যে এসেছে তা বুঝতে পারলাম। সে এসে আমার বিছানার সামনে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো। এই নীলা আর সেই নীলা! এই আমি আর সেই আমি! মাঝখানে এক মরনব্যাধি… লুপ্তপ্রায় ভালোবাসা। ভালোবাসারা কি একদিন এভাবে মরনব্যাধির কাছে হার মেনে শেষ হয়ে যাবে?
.

নীলা এখনো আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। পাশে এসে বসলো না। আমি বললাম, ‘কি দেখছ?’ কিন্তু নিজের কাছেই নিজের আওয়াজকে অপরিচিত লাগল। নীলা এবার আমার পায়ের কাছে আসে। বসে।ওর শরীর থেকে কি ভালবাসার ঘ্রাণ বের হচ্ছিল… সে কি আমার পাশে বসে মৃত্যুর ঘ্রাণ অনুভব করছে। ওর চোখ দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে। নীলা বলল, ‘কেমন আছ?’ আমি হাসলাম। বললাম-
‘ভালো আছি।’
– কেন মিথ্যে বলছ?
‘তুমিই বা কেন মিথ্যে বলাচ্ছ?’
দু’জন চুপ করে রইলাম। কথা যেন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দু’জন মানুষ একসময়ে ভালবাসার টানে একে অপরের কাছে এসেছিল। আজ একজনের ভিতরে কি এক ব্যাধি বাসা বানাতেই সেই ভালবাসার সৌধ ভেঙ্গে গেছে। এতোই ঠুনকো ভালোবাসা!
.

ওকে বললাম, ‘তোমার গলায় সেই গানটা একবার গাইবে ?
– কোনটা?
‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে?’
একটু কি চমকায় নীলা? একটা গান কি ফেলে আসা কিছু নস্টালজিক মুহুর্তকে ফিরিয়ে আনতে পারে? মাথা নীচু করে থাকে সে। আমি অপেক্ষা করি। যেভাবে অপেক্ষা করছি শেষ সময়ের জন্য। নীলা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে গাওয়া শুরু করে… ওর হাত আমার কঙ্কালসার হাতকে ধরে রাখে… আমি কোনো অনুভূতি পাইনা… তবে ওর গান আমাকে ভালোলাগার এক সুন্দর মুহুর্ত এনে দেয়। খুব ভালো লাগে গানের কথা।
.

একসময় শেষ হয় গান… নীলা এখন চলে যাবে। যাবার বেলায় কোনো কথা হল না আর আমাদের। একেই বোধহয় নীরবে চলে যাওয়া বলে। দরজা পর্যন্ত গিয়ে নীলা একবার পিছনে ফিরে চায়! ওর চোখে ক’ফোটা জল দেখতে পেলাম। সে না ফিরলেই ভাল হতো! কি মনে করে ফিরলো কে জানে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি… সেও তাকিয়ে আছে। নীলার চোখে কি সেই আগের ভালোবাসা ফিরে এলো? নাহ! এসব আমার মনের ভুল ভাবনা। একবার চলে গেলে কেউ আর ফিরে আসেনা। একবার ভাবলাম নীলা যদি দরজার ওখান থেকে ফিরে আমার কাছে আসে, হয়তো শেষ একবার চেষ্টা করতাম! বেঁচে থাকার…
.

নীলা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে… দরজাকে সাথে নিয়ে। এক পা সামনে বাড়ালেই ওর মুক্ত জীবন… আর এক পা পিছনে আসলেই আমাকে ঘিরে ওর জন্য এক নতুন জীবনের অনিশ্চয়তা। নীলা কি ফিরবে? নীলারা কি ফিরে আদৌ? এটাই ছিল আমার চেতনায় শেষ অনুভূতি… … …।।

সামছু মাঝি : ছোটগল্প


আমার অনেক আগের লেখা এই ছোটগল্পটিকে আমি একটি টেলিফিল্মে রুপ দেবো। এটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। আমাদের দেশে সমস্যা হলো গল্প এবং থিম চুরি হয়ে যায়। এই গল্পটি আমার টাইমলাইন এবং বেশ কয়েকটি বাংলা ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে। প্রিয় ব্লগ শব্দনীড়েও আজ আমার নিজের লেখা উল্লেখ করে পুনরায় প্রকাশ করছি। কেউ যদি গল্পটি এবং থিম ‘চুরি’ করে নাটক বানানোর চেষ্টা করে, তবে কপি রাইট আইনে অন্তত আমি যাতে করে ‘প্রোটেস্ট’ করতে পারিঃ-
_____________________________________________________
ইলিশের মওসুম। তহবিলের সকলে তটস্থ। মালিক এসেছেন। ম্যানেজার থেকে শুরু করে পিওন পর্যন্ত সকলে কেমন ভয়ে ভয়ে পার করছে সময়। মাসে একবার মেঘনার পাড়ের এই তহবিলে আসেন তিনি। শহুরে জীবন থেকে সামান্য সময়ের জন্য বৈচিত্রের স্বাদ পেতেই বুঝি এই আসা-যাওয়া।
.
নিজের গদিতে বসে আছেন মালিক। তহবিল বলাতেই গদির উল্লেখ করা, নচেৎ নিজের বিলাসবহুল রিডিং রুমের আরামদায়ক চেয়ারটির মত, একই আরামে ডুবে আছেন তিনি।
.
সবাই যে ভয়ে থাকবে, এটাও জানেন তিনি। ম্যানেজার ব্যাটা বড় চোর। আর ওর নিজের কুকর্ম ঢাকতে, অধীনস্থদের কে ও চোর বানিয়েছে সে। একদল চোর পালছেন তিনি। এটা ওদের সামনে ও বলেন প্রায়ই।
.
বেল চাপেন। ম্যানেজার আসে। নিরবে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ নিচের দিকে। তার কাচুমাচু ভাব দেখে মালিক বিরক্ত হন। দু’হাতে ধরা বাসি খবরের কাগজ থেকে চোখ নামান। ভাঁজ করে রাখেন টেবিলে। জিজ্ঞেস করেন, ‘ছত্রিশ বোটের মাঝি পাওয়া গেছে?’ শুধু শুধু ঢোক গিলে ম্যানেজার। গলা খাঁকারি দিয়ে জানায়, ‘ জি স্যার।’
.
চুপ থাকে সে। অতিরিক্ত কথা বলাটা, মালিক পছন্দ করেন না।
‘ কি নাম?’
– স্যার?
‘বলছি মাঝির নাম কি? কোন গ্রাম?’
– সামছু মাঝি। চর আলেকজান্ডারের।
.
এবার মালিক চুপ থাকেন। ভাবনারা ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে গান করে তার মস্তিষ্কে। জানালা দিয়ে নদীর পাড়ে সারি সারি মাছ ধরা ট্রলার। জাল শুকাতে অলস অপেক্ষমান। রঙ বে রঙয়ের এবং বিচিত্র নামের এক একটা জলযান। বেশ প্রশান্তি অনুভব করলেন। এর ভিতর তার নিজের ও অনেকগুলি। বাহাত্তুর ইঞ্জিনের সহ কয়েকটা আছে।
.
‘ফরিদ মাঝি লেনদেন চুকায়ে গেছে?’
– আপনার কাছে হিসাব দেয়া আছে, স্যার।
‘সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দেবা। বাঁকা ত্যাড়া উত্তর আমার পছন্দ না। মনে রাখবা।’
– রাখব স্যার।
.
কিছুক্ষণ অধস্তনের দিকে চেয়ে থেকে মালিক গম্ভীর হয়ে জানান,
‘তোমার চাকরি কনফার্ম করার সময় বলছিলাম, আমি খুব কড়া মানুষ। কেউ সাত লাখ টাকা নিয়ে দিতে পারবে না, মাফ চাবে আমার কাছে। মাফ করে দেবো আমি। কিন্তু কেউ আমার পাওনা এক টাকা দিতে অস্বীকার করবে, ছাড়ব না কিন্তু। সাত লাখ টাকা খরচ করব ঐ এক টাকা আদায়ের জন্য।’
.
ঘরের পরিবেশ ভারী লাগে ম্যানেজারের কাছে। সে সাহস করে মালিকের দিকে তাকায়। দেখে মালিক চেয়ে আছে ওর দিকেই। পলক পড়ে ম্যানেজারের। আর তখনই জলদগম্ভীর স্বরে মালিক জিজ্ঞেস করেন,
‘ ফরিদ মাঝির কাছে পাওনা কত আমার?’
– সাড়ে আট লাখ।
‘তো? কি করছ এই ক’দিন। শুনতে পাই সে নাকি বলে বেড়ায়, টাকা না দিলে কি করতে পারব আমি দেখবে সে!’
– আমি কয়েকবার তাগাদায় গেছি স্যার। সে ধানাই পানাই কথা বলে, না হয় সময় চায়।
‘হুমম… শোনো, বাসেতরে গিয়া জানাও, ফরিদ মাঝির চর্বি বাইড়া গেছে। বেড়ির উপর আমার দেয়া ওর ঘরগুলি ভাইঙ্গা নদীতে ফালায়ে দেবে। মারধোর করবে না। কেবল বাম হাতটা ভাঙ্গবে। ভিক্ষা চাবার জন্য ডান হাতের দরকার পড়ে। বাম হাত বাড়ানো বেয়াদবির সামিল, জানো তো?’
.
মাথা নেড়ে সায় দেয় ম্যানেজার। ভয়ে তার কলজে শুকিয়ে আসে। কিছু টাকা তো ফরিদ মাঝির নাম দিয়ে সে নিজেই মেরে দিয়েছে। মাঝি যদি মাইরধোর খেয়ে আসল হিসাব নিয়ে বসে, তবে তার ও অবস্থা খারাপ। এই বয়সে মারধোর খেতে কেমন লাগবে কে জানে।
.
‘যাও, এখন সামছু মাঝিরে পাঠাও আমার কাছে।’
-জি আচ্ছা।
.
মালিকের সামনে থেকে একরকম পালিয়েই আসে ম্যানেজার। ঘেমে গোসল করে ফেলেছে যেন। তহবিল থেকে বের হয়। সামনে একটু এগিয়ে এক দেয়ালের পাশে দাঁড়ায়। জিপারের পুলার নিম্নগতি লাভ করে ওর। পকেটের দোমড়ান স্টার সিগ্রেটের প্যাকেট থেকে এক শলা বের করে। ঘামে ভেজা হাত নিয়ে ম্যাচের কাঠির দ্বিতীয় চেষ্টায় সিগ্রেটকে জ্বালাতে পারে সে। বুক ভর্তি ধোঁয়া টেনে ফুসফুস ডুবিয়ে দেয়। মুখ দিয়ে কিছু ধোঁয়া বের হয়। তলপেটের কাছে চিনচিনে ব্যাথা। এতক্ষণের আটকে থাকা টেনশন জলের সাথে মাটিতে মিশে যায়। মুখ দিয়ে আপনাতেই বের হয়, ‘কুত্তার বাচ্চা!’

.
সামছু মাঝির দাঁড়ি আছে। কপালে নামাজের জন্য সিজদার স্থানটিতে কালো দাগ। গোল হয়ে আছে। সবুজ রঙয়ের পাঞ্জাবি পড়েছে। সবুজ লুংগি। চেহারায় বেশ সাধু সাধু ভাব। প্রথম দেখাতেই ওনারা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে ফেললেন। দু’জন শক্তিমান পুরুষ!
.
‘তোমার নাম সামছু মাঝি?’
– জি হুজুর।
‘আমাকে হুজুর বলবা না। স্যার বলবা।’
-জি হুজুর.. স্যার।
‘আমার ছত্রিশ ইঞ্জিনের বোটের দায়িত্ব তোমারে দিতে চাই। তুমি কেমন মানুষ?’
-শক্ত মানুষ, স্যার।
‘হুমম, আমার ও শক্ত মানুষ দরকার। আমার নিয়ম কানুন জানা আছে?’
– জে, জানা আছে জে।
‘তারপর ও বলি। আমার থেকে দাদন নেবা। আমার মুদির সদাই দিয়া নাও ভরবা। কমিশনে মাছ আমার তহবিলে দেবা। পথে মাছ বেচবা না। চুরি করবা না। ধরা পড়লে চাকরি যাবে, অপমান হইবা।’
– জে, ম্যানেজার সব জানাইছে জে।
‘হুমম.. যাও, ঐ তাকের উপর কোরআন শরীফ রাখা আছে, নিয়া আস। ওটা ছুঁয়ে শপথ কর, যা বলছি এইগুলা মাইনা চলবা।’
.
সময় একটু যেন থমকে যায় তহবিলের এই রুমটাতে। ধরা যায় কি যায় না। সুক্ষ্ণ একটা ভাব খেলে যায় সামছু মাঝির শুশ্রুমন্ডিত নুরানী চেহারায়। সে হেঁটে গিয়ে তাকের উপর থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে আসে। মালিকের সামনে দাঁড়ায়। ছুঁয়ে বিড়বিড় করে শপথ করে। মালিক খুশী হয়। তৃপ্তিতে তার চোখ বুজে আসে। যদিও তিনি জানেন, এই দরবেশ ব্যাটাও চোর একটা। সে ও সুযোগ বুঝে চুরি করবে। তারপরও ব্যাটার নৈতিকতার উপর একটা চাপ থাকল।
.
সামছু মাঝি ধীর পায়ে তহবিল থেকে বের হয়। কিছুদূর নদীর পাড় ধরে হেঁটে চলে। বাতাসে তার দাঁড়ি উড়তে থাকে। নদীর জলে আলোর প্রতিফলন কয়েকটি শঙ্খচিলের চোখ ধাধিয়ে দেয়। মাছ শিকারে বেড়িয়েছে ওরা।
.
সামছু মাঝি গুলের ছোট্ট একটা কৌটা বের করে। অর্ধেক গুল আংগুলে নিয়ে ঠোঁটের নিচে যত্নে রেখে দেয়। কিনারাবিহীন নদীর মাঝ দিয়ে, কয়েকটি লবণের বার্জ দূরে কোথাও চলে যায়। তাকিয়ে দেখে আর ভাবে সামছু মাঝি। নিজের ভিতরের খুনি সত্ত্বাটি এরকম নির্জনেই বের হয়ে আসে। এই তো, ছ’মাস আগের কথা। তখন কাল্লু ব্যাপারির বোটের দায়িত্ব নিয়েছিল। গভীর সমুদ্রে আরেকটি বোটকে নিরস্ত্র পেয়ে হামলা করেছিল ওরা। ঐ বোটের মাঝিকে কোমরের উপর থেকে দু’খন্ড করে সাগরের মাছদের খাইয়েছিল।পরে ইলিশ মাছ এবং জাল যতটা পারা যায় নিয়ে, মাল্লাদেরকে বোটের বরফ রাখার কম্পার্টমেন্টে গাদাগাদি করে ঢুকায়। বাইরে থেকে কাঠের দরজা পেরেক মেরে আটকে দেয়। শেষে ট্রলার ফুটো করে ডুবিয়ে মারে সবাইকে।
.
এভাবে কয়েকবার এমন করেছে সে। সমুদ্রে যাবার সময় হাতিয়ার নিয়ে যায়। মালিক দিক বা না দিক। জানুক বা না জানুক। নিরস্ত্র গেলে আজ সে ও হয়ত মাছের খোরাক হত।
বড্ড নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর সাগরের মাঝিদের জীবন। পদে পদে মৃত্যুর হাতিছানি। তাই নিজে শিকার না হয়ে শিকারি হয়েছে সে।
আর তাকেই কি না পবিত্র গ্রন্থটি ছুঁইয়ে শপথ করায়? অনেকবার ভেবেছে সে, একা একা। কখনো যদি মালিককে সাথে নেয়া যেত সাগরে মাছ ধরার সময়! বরফের প্রকোষ্ঠে দম বন্ধ হয়ে, গভীর পানির নিচে তলিয়ে যেতে মালিকের কতটা সময় লাগে, দেখবার বড় ইচ্ছে তার। এই দাদনখোর বড় মানুষগুলি, তাদেরকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করছে। শুষে নিচ্ছে ছারপোকার মত। এদের জন্যই এক একজন সামছু মাঝির ভিতর থেকে কখনো কখনো বের হয়ে আসে, এক একজন জলদস্যু কিংবা একজন খুনি! উৎপাদনের সকল উপকরণের মালিক তারা-ই থাকে জনম ভর। জীবনের আনন্দের সকল উৎস মালিকদেরকে ঘিরে রাখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আর মাঝিদের ঘরে? বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা সেই একই অভাব-অভিযোগ, দু:খ-কষ্টের মহাসম্মেলন। দিনে দিনে এগুলো বাড়তেই থাকে ক্রমশ:। বিপরীতে বাড়ে মালিকের আনন্দের উপকরণ। গড়ে উঠে সম্পদের পাহাড়!
.

এজন্যই মালিকেরা কখনো সামছু মাঝিদের সাথে গভীর সমুদ্রে খুন হতে যেতে চান না। মেঘনার পাড়ে, সবুজ লুংগি পাঞ্জাবিতে আচ্ছাদিত একজন সামছু মাঝি, তার পরবর্তী খুনের দৃশ্যকল্প ভেবে উল্লসিত হয়। তবে সেখানেও কেন জানি, তহবিলের আরাম কেদারায় বসে থাকা ক্ষমতাবান মানুষটির চেহারা ভেসে আসতে চায় না। আবার নতুন করে ভাবা শুরু করে সে।
.
এভাবে দুই বিপরীত শ্রেণির ভিতর চলে আসা টানাপোড়ন, কোনো একদিন হয়ত তাদেরকে জায়গা বদল করাবে।
‘হয়ত’ – ভাবে সামছু মাঝি। কিন্তু সে জন্য অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না।
.
গুলমিশ্রিত এক দলা থুথু প্রচন্ড গতিতে এসে পড়ে অদূরে নোঙ্গর করা ছত্রিশ ইঞ্জিনের একটি মাছ ধরার ট্রলারের বডিতে। এটার মাঝি সে। সামছু মাঝি।।

যখন তুমি আছো আমার সনে : ছোটগল্প

জানালার পাশে একটি কাঁঠাল গাছ। সবুজ পাতা ভেদ করে সামনের দিকে তাকাতেই আরো সবুজ চোখের তৃপ্তি এনে দেয় কণার। বাউন্ডারি ওয়ালের পেছনে লম্বা এক টিনের দো’চালা সেমি-পাকা ভবন। অনেকগুলি পরিবার সেখানে বাস করে। এরপরেই বিস্তীর্ণ খোলা জমি। এর শেষ প্রান্তে সারি সারি শিরিষ গাছ। কিছু রেইন্ট্রি গাছও যার যার শাখা বিস্তার করে সাথের গ্রামটিকে সবুজে বেষ্টন করে আছে। দেখতে ভাল-ই লাগে কণার। অলস সময় দেখে দেখে কেটে যায় ওর।
.

কি দেখে সে? দোতলার এই জানালা দিয়ে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সামনের সেমি-পাকা ভবনটির বাসিন্দাদের জীবনের অণুচিত্র দেখা যায়। সেখানে মহিলাদের ঘরকন্নার নিত্য দৃশ্য। পুরুষেরা সবাই রোজগারের ধান্দায় বাইরে। ফিরে সেই অনেক রাতে। তবে অন্যের সাংসারিক জীবনযাত্রা দেখার মত রুচিহীন ও নয় সে। তবুও জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। দূরে আকাশ যেখানে গাছগুলির মাথায় চেপে বসেছে, সেদিকে তাকিয়ে থেকে যায় বেলা।
.

মেয়েরা ড্রইং রুমে টিভি দেখছে। ওদের এই বেডরুম থেকেও দু’জনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। মেয়েরা বাবার ন্যাওটা। মাকে তাদের দরকার শ্রেফ খাবার সময় হলে। কিংবা টাকার প্রয়োজন হলে। এ ছাড়া এই বাসাতে কণা নামে যে তাদের একজন মা রয়েছে, মেয়েদের হাবভাবে সেটা কখনো-ই মনে হয় না। অথচ বন্ধের দিনে শিহাব যেদিন বাসায় থাকে, ওদের তিনজনের আলাদা জগত দেখে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কণা। প্রথমদিকে একটু আধটু হিংসে হতো। এখন আর হয় না।
.

শিহাব যে চাকরি করে, তাতে ফিরতে অনেক রাত হয়। ছোট মেয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে গেলেও, বড়টি বাবার জন্য অপেক্ষা করে। বাবা এলে তবে খেয়ে সে ঘুমায়। বড় মেয়ের এই অভ্যাস পছন্দ না শিহাবের। এ নিয়ে শিহাব কত অনুযোগ করেছে। মা হিসেবে কণা ব্যর্থ, আভাসে-ইঙ্গিতে সে কথাও জানিয়েছে শিহাব। তবে শুনে কণা হেসেছে কেবল-ই। কোনো প্রতিউত্তর নেই.. কিংবা ভ্রুর সামান্য কুঁচকানো ভঙ্গিও কখনো শিহাবকে দেখতে হয়নি। এমন-ই কণা।
.

ডোরবেল বেজে ওঠে। মৃদু টুংটাং আওয়াজ প্যাসেজ হয়ে বেডরুমে ও পৌঁছায়। কিন্তু কাঁঠাল গাছে একটি ‘বউ কথা কও’ পাখি এসে বসেছে। সেদিকে তন্ময় হয়ে থাকায় কণার কানে ডোরবেলের আওয়াজ পৌঁছায় না। কি সুন্দর! অসাধারণ! কণাদের গ্রামে পাখিটি ‘হইলদা পাখি’ নামে পরিচিত। সবুজের মাঝে ক্ষুদ্র উজ্জ্বল হলুদের ঝলকের দিকে কণা নির্ণিমেষ চেয়ে থাকে। তাই মেয়েদের সাথে মৃদু খুনসুটি শেষে বেডরুমে শিহাবের প্রবেশেও ওর ঘোর কাটে না। প্রিয় মানুষটির নিঃশব্দ অনুপ্রবেশ কণা নামের এই যুবতীর তন্ময়তা কাটাতে পারে না।
.

বিছানার সাথেই জানালাটি। গ্রিলের উপর হাত রেখে শিকের সাথে নাক ঠেকানো কণাকে দেখতে পায় শিহাব। বিছানার ওপর হাঁটু ভেঙ্গে ওর দিকে পেছন ফিরে রয়েছে সে। দুই সন্তান হবার পরেও কণার দেহসৌষ্ঠব এখনো চমৎকার! যদিও প্রথম সন্তানের পরে নিজেদের ভুলে দ্বিতীয়টি এসেছে অল্প সময়ের ভেতর। এখনো কণার ফিগার দেখে শিহাব ঢোক গিলতে বাধ্য হয়। ৩৬-২৪-৩৬…বাঙালি মেয়েদের এমন ফিগার সচরাচর দেখা যায় না। একটু দুষ্টুমি জাগে শিহাবের মনে। বিড়ালের মত আলতো পায়ে পেছন থেকে কণাকে ধরতে চায় সে। কিন্তু বিছানায় ওঠার আগেই ওর শরীরের ঘ্রাণে কণা ফিরে তাকায়। শিহাবের হাসিমুখ আর চোখের গোপন দুরভিসন্ধি দেখে পলকের তরে কণার ভেতরে কোথায় যেন কিছু একটা জ্বলে ওঠে। এবার পুরোপুরি পেছনে ফিরে বিছানায় বসে। মুখে মৃদু হাসি। জিজ্ঞেস করে,
.

‘কখন এলে বাজার থেকে? কলিং বেলের আওয়াজ পেলাম না যে?’

শিহাব কণার কোলে মাথা রাখতে যেতেই কেন জানি শিউরে ওঠে কণা। একটা বালিশ টেনে ওর মাথার নিচে দিতে চাইলে মাথা নেড়ে শিহাব প্রত্যাখ্যান করে ওর প্রশ্নের উত্তর দেয়-

‘ তুমি কি আর তোমার ভেতরে ছিলে যে আওয়াজ পাবে? তুমি তো ভেসে বেড়াচ্ছিলে সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে মেঘবালকদের রাজ্যে।’
.

মুখের হাসিটুকু ধরে রেখেই কণা নীরবে শিহাবের মাথার চুলে হাত বুলাতে থাকে। শিহাবের কাছে অতি প্রিয় এই আদরটুকু। কিছুক্ষণ করলেই ওর ঘুম এসে যায়। জানে কণা। কিন্তু কণা যে জানে, এটা কি শিহাব জানে? এরকম টুকরো টুকরো অনেক জানা-অজানার মিশেলে বয়ে চলেছে ওদের এই সংসার। চলার পথ শুরু থেকে একেবারে মসৃণ ছিল না। সবার থাকে ও না। কিন্তু সেই বন্ধুর পথ চলতে গিয়ে, কণা শিহাবের ঢাল না হলেও প্রচ্ছন্ন ছায়াসঙ্গী হয়েই ছিল। এমন ছায়াসঙ্গী যে নিজের কায়া বিসর্জন দিয়েছে প্রিয় এই মানুষটির জন্য। তবে শিহাব ওর রুটিন জীবনের বাইরে গিয়ে সেটা কখনো-ই বুঝতে কিংবা জানতে চায়নি। ভাল সে বেসেছে ঠিক-ই। কিন্তু কেন জানি কণার কাছে মনে হতো, শিহাবের আচরণে আরো একটু বেশী দেখানোর প্রবণতা থাকলে বোধহয় ভাল হতো। যদিও ভালবাসায় দেখানোর প্রবণতা কম থাকবে, উপলব্ধির ব্যাপারটা বেশী থাকবে। একজন অন্যজনকে জানার জন্য বেশী ব্যকূল থাকবে। শরীর কেন্দ্র করে যে আবেগের বহিঃপ্রকাশ, সেটাকে ভালবাসা বলা যায় না। অনেকের কাছে ভালবাসা বলতে শ্রেফ কিছু শারীরিক কসরৎ। তারা মনের ধার-ই ধারে না। মন যদিও এক বিমূর্ত অবয়ব। তারপরও এই দেহকেন্দ্রিকদের নিকট, মন কেবলি এক রক্ত পাম্প করার মাংসপিণ্ড বিশেষ।
.

‘শিহাবের ব্যাপারে তোমার কি মত? সে ও কী ঐ সব দেহসর্বস্ব প্রেমিকদের মত?’ – নিজের ভেতর থেকে এই প্রশ্নে একটু থমকে যায় কণা! তবে শিহাবের মাথায় ওর হাতের বিলি কাটা বন্ধ হয় না। আনমনে নিজের প্রশ্নের উত্তর ভাবে সে। এক পর্যায়ে মনে হয়, শিহাবকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? কিন্তু পরক্ষণেই সেটা বাতিল করে দেয়। শিহাব যদি অন্য কিছু ভেবে নেয়, তখন? নিজের ভেতরের সাময়িক টানাপোড়ণে, কখন যে কণার হাত স্থির হয়ে গেছে, বুঝতেই পারেনি কণা। অবাক শিহাব যখন ওকে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি হল আবার? কোথায় হারালে?’
.

একটু লজ্জা পেলেও উত্তর দেয় না কণা। উঠে বসে শিহাব। কণার চোখে চোখ রেখে জানতে চায়-
‘সত্যি করে বলতো, কি হয়েছে?’
– তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই?
‘হ্যা, কর। এর জন্য জিজ্ঞেস করার কি দরকার!’
– তুমি আমাকে কতটা অনুভব কর?
.

এবারে একটু অবাক হয় শিহাব। কিন্তু বরাবরের মত মুহুর্তেই সেই ভাবটুকু লুকিয়ে স্বাভাবিক হয়। জানালা দিয়ে আসা দমকা বাতাসের তোড়ে কণার চুল এলোমেলো। মুখ ঢেকে থাকে চুলে। শিহাব পরম মমতায় চুল সরিয়ে এক জোড়া কালো আগুনের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলতে থাকে,
‘এতদিন পরে এই প্রশ্ন কেন আমি জানতে চাইব না। তবে কিছু একটা তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, বেশ অনুভব করছি।’
– এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হল না।
‘আমিও বলিনি এটা তোমার প্রশ্নের উত্তর। কেউ কাউকে কতটা অনুভব করে, তা মুখে বলে বুঝানো যায় কি? একজন অনুভবক্ষম-ই আরেকজনের অনুভূতি অনুভবে সক্ষম। এখন আমাকে বল, তুমি কী অনুভবক্ষম?’
– হেঁয়ালি কর না। সোজা ভাষায় বল।
‘বেশ, তাই করছি। আমাকে নিয়ে তোমার নিশ্চয়-ই অনেক অভিযোগ। তবে সেগুলি তোমার ‘একার সাথে একা’ এটাও বুঝি। কাউকে তুমি এগুলি বলবে না, তাও জানি। ঠিক আছে?’
– বলে যাও।
‘পাঁচ বছর আগের এক ঘটনায় তোমার ভেতরের এক অদৃশ্য জানালা বন্ধ হয়ে গেছে। পথের দিকে তাকিয়ে মানুষের পথ চলা দেখতে তুমি বড্ড ভালবাস। কিন্তু সেই মানুষেরা-ই তোমার সেই জানালা সহ তোমাকে উচ্ছেদ করেছে। তোমার ভেতর-বাহিরের দৃশ্যমান এক জগত হঠাৎ করেই ভেঙ্গে যায়। সেই থেকে বিগত বছরগুলি তুমি কেবলি জানালা দিয়ে আকাশ ও গাছপালা দেখ। কেন জানি পথ চলা মানুষ তুমি দেখতে চাও না ইদানিং। চাইলে ড্রয়িং রুমের জানালা দিয়ে সোজা পিচঢালা পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু তুমি সেটা কর না। ঠিক আছে?’
– আর?
‘আরো জানতে চাও? তুমি যে অনেক সুন্দর সেটা কি তুমি জান? এখন আমার স্বভাব হল, সুন্দরকে সুন্দর সেটা মুখে বলে প্রকাশ করি না। সুন্দরকে ছুঁয়ে তার সৌন্দর্য্য অনুভব করি। এজন্যই হয়ত আমাকে তোমার অন্তর্মুখী মনে হতে পারে। তবে আমি যেমন-ই হই না কেন, তোমাকে বড্ড ভালবাসি! এখন আমাকে বল, আমি যে তোমাকে অনুভব করি, এটা কি তুমি বুঝ?’
– নাহ! বুঝলে কি আর তোমাকে জিজ্ঞেস করি?
‘হুম… তাও বটে।
.

বাইরের দমকা বাতাস কেমন শীতল অনুভব হয়। আকাশ মেঘে ঢেকে আছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। একটু পরেই শুরু হবে টিপটিপ বৃষ্টি। এক জোড়া নর-নারী দু’জনের মুখোমুখী বসে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নাই। দু’জনেই যার যার মনে ভাবছে। কণার কানে বেজে চলেছে শিহাবের প্রশ্নের অনুরণন-
‘আমি যে তোমাকে অনুভব করি, এটা কি তুমি বুঝ?’
পাশাপাশি বসে ওরা দু’জন বাইরের উত্তাল পরিবেশ দেখতে থাকে। কিন্তু ওরা আসলে কিছু-ই দেখে না। শিহাবের হাতে হাত রেখে কণা নিজের মনে ভাবে… এক সময় অনুভব করে, ‘হ্যা! আমি বুঝি! তোমাকে অনুভব করছি আমি!’
.

প্রচন্ড শব্দে কাছে কোথায়ও বজ্রপাত হয়। ওদের দুই মেয়ে ভয়ে চিৎকার করে বাবা-মায়ের কাছে চলে আসে। মায়ের কোলে ঢুকে যায় ছোটজন, বড়জন মাকে জড়িয়ে ধরে। শিহাবের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে কেন জানি এই মুহুর্তে কণার নিজেকে বড্ড নিশ্চিন্ত মনে হয়। দুই মেয়ের শরীরের বাবু বাবু ঘ্রাণ… প্রিয় মানুষটির শরীরের পুরুষালী ঘ্রান.. আর বাইরের বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির ঘ্রাণ! এসব কিছু মিলে মিশে কণাকে প্রগলভ করে তোলে! সে দুই মেয়েকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে শিহাবের চোখে চোখ রেখে নিঃশব্দে নিজেকে বলে,
‘আমার মানুষটি আমাকে অনুভব করে। সে দেহকেন্দ্রিক নয়। আমার মেয়েরা ও আমাকে অনুভব করে.. আমিও কিছুক্ষণ আগে অনুভবক্ষম হয়েছি, তাই অনুভব করতে পারছি। এরা-ই আমার মানুষ… আমার জানালা।‘
.

প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ায় বাহিরের বৃষ্টির ছিটে এসে ওদেরকে ভিজিয়ে দিতেই, কণা থাই গ্লাসের সার্সি টেনে দেয়। হঠাৎ করেই রুমের ভেতরে আরামদায়ক নৈশব্দ বিরাজ করে। যদিও জানালা বন্ধ হয়ে যায়.. কিন্তু কণার ভেতরের বেশ আগে বন্ধ হওয়া মনের জানালাটি কিছুক্ষন হল খুলে গেছে। তাই এখন জানালা বন্ধ কি খোলায় ওর কিচ্ছু যায় আসে না। ওর প্রিয় মানুষেরা ওর সাথেই আছে!

কেনো দূরে থাকো? : ছোটগল্প

একজন পুরুষ গল্পকারের সবচেয়ে বেশী কষ্ট হয়, যখন তিনি নারী প্রধান কোনো চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে চান। আমার নিজেরও এক্ষত্রে সমস্যা হয়। একজন নারীর অনুভবে কল্পনায় অনুভূতিগুলি কিভাবে প্রকট হয়, একজন পুরুষ হিসেবে সেটা ফুটিয়ে তোলা অত্যন্ত ভয়াবহ। নারীর মন যেখানে সহস্র সাধনার ধন, সেখানে পুরুষ হয়ে তাকে বুঝতে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। তো এই কঠিনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম একটা ছোটগল্প লিখতে গিয়ে। জানি না গল্পের কণা চরিত্রটিকে বাস্তবিক তাঁর নিজের অনুভবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলাম কিনা। এই বিচারের ভার দিলাম ব্লগের নারী পাঠকদের ওপরঃ-
________________________________________________

সকাল থেকেই কেন জানি অস্থির লাগছে কণার। অথচ কেন বুঝতে পারছে না। ছেলে মেয়ে দু’জন বসার রুমে। শুদ্ধ পিসিতে গেমস নিয়ে ব্যস্ত। আর পিম্পি ছবি আঁকছে। স্কুলে কি একটা কম্পিটিশনে অংশ নেবে। কণা-ই থিম দিয়েছে। সেই অনুযায়ী এখন আঁকার চেষ্টা করছে। ওদের দু’জনের ভূবনে ওরা নিজেদের মতো রয়েছে।
আর সে?
.

ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি এসে এসেও আসে না। কি এক রহস্যময় অনুভবে মুহুর্তে বিলীন হয় কণা। হাসির সাথে বিষন্নতার লেজ ধরে কিছু কষ্টও কি মুহুর্তটিকে একটু হেলিয়ে দিতে চায় না?
.

কলিং বেল বেজে উঠে।
‘আসসালামু আলাইকুম… য্যারা মেহেরবানি করে দরোয়াজা খুলিয়্যে’
ইলেক্ট্রিনিক রেকর্ডেড নারী কন্ঠের জোরালো আওয়াজে কণার সামান্য ভাবনা-চিন্তার মুহুর্তটি দূর হয়। আজকাল এ দেশে বিজাতীয় সংস্কৃতির রমরমা আগ্রাসন। এই কলিং বেলটির কথা বাংলায় হলে কি হতো?
.

দরজা খুলে দেখে ওরই সহকর্মী রাহেলা ম্যাডাম। কণার পাশের বাসায় থাকে। দু’জন একই কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করে। হাসিমুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাসন্তী রঙের সাজে তাঁকে বেশ সুন্দর লাগছে।

মুহুর্তে মনে পড়ে যায় আজ পহেলা ফাল্গুন। এবং শিহাব বরাবরের মতো ওকে রেখে অফিসের কাজে চলে গেছে।
.

রাহেলা ম্যাডাম যখন কণাকে জিজ্ঞেস করলো,
– আজ ভাইকে সাথে নিয়ে কোথায় কোথায় যাবেন? ভাই কি ঘুমে নাকি এখনো? কণার ঐ মুহুর্তে প্রচন্ড রাগ হলো।

রাগ নিজের উপর থেকে শিহাবের উপর হয়ে ড্রয়িং রুম থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকা মেয়ে পিম্পির উপর গিয়ে পড়ে। ওকে একটা ছোট্ট ধমক দেয়,
– ছবি আঁকা রেখে কি দেখছ তাকিয়ে? সময় হাতে আছে আর?
.

মায়ের হঠাৎ এরকম রেগে যাওয়াতে পিম্পি অবাক হয়। ছেলে একবার মুখ ফিরিয়ে মাকে দেখে আবার গেমসের জয় স্টিক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সহকর্মী চলে যাবার পর আবারো নিজেকে ফিরে পাওয়া। একটু একটু করে মনের অতল থেকে ফিরে আসা। মুহুর্তগুলোয় পাওয়া তেঁতো স্বাদকে অতিক্রম করে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে চায় কণা।
.

শিহাবকে নিয়ে এতগুলো বছর পার করেও কোনো অভিযোগ রয়েছে ওর? তবে রাহেলার প্রশ্নের উত্তরে রেগে গেল কেনো? আজকের দিনে শিহাব সাথে নেই বলে? নাকি শিহাববিহীন বসন্তের প্রথম দিন নিঃসঙ্গ থাকবে বলে? অন্যরা দিনটিকে যার যার সঙ্গীকে নিয়ে কাটাবে। সে একা নিজের ভূবনে। আজ শিহাবকে সাথে নিয়ে পথ চলার আনন্দ মিস করবে বলে কি?

এতগুলো ‘কি’ কণাকে বিভ্রান্ত করে তোলে। উত্তর জানা নেই বলে কি বিভ্রান্ত হয়? অথবা উত্তর জানে কিন্তু মেনে নিতে পারে না বলে?
.

নিজের বেডরুমের জানালার পাশে একটি কাঁঠাল গাছ। শিকের ভিতর দিয়ে সবুজ পাতা ভেদ করে দূরের নীল আকাশ দেখা যায়। খুব একটা পছন্দের জায়গা কণার। এখানে এলেই কেন জানি মন ভালো হয়ে যায়। জানালার স্বল্প পরিসর দৃষ্টিপথ দিয়ে দূরকে কাছে বসে দেখাতেই কি এই ভালো লাগা? নাকি ওর কাছের মানুষটির ক্রমশঃ দূরে সরে যাওয়াতে দূরকে এত ভালো লাগে। ঐ দূর দিগন্তে যেখানে আকাশ মাটির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক হবার আনন্দে ভরপুর… কণাও কি ওর ভালবাসার মানুষটিকে ওখান থেকে খুঁজে পেতে চায়?
.

‘এই পথ চলাতে মোর আনন্দ’…পথিকের পথ চলাতে আনন্দ হতে পারে। তবে কণা শিহাবকে পথের বাঁকে এসে সাথে পেলে আনন্দ পায়। একা একা পথা চলাতে কি আনন্দ রয়েছে? যাকে ভালো লাগে এমন কারো হাতে হাত রেখে চলাতেই জীবনের মানে লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে হয় ওর কাছে।
.

নারীর মন নাকি শত সহস্র বছরের সাধনার ধন। শিহাব কি কখনো এই সাধনায় নামার আগ্রহ দেখিয়েছে? পুরুষের মন কেমন? তাকে কি বুঝা খুবই দুঃসাধ্য? আমাদের গড় আয়ু কত হবে? ৫৫/৬০… এই সময়সীমায় একজন নারী কি পুরুষকে বুঝতে পারে? কিংবা পুরুষ নারীকে?
.

তবে কনার এতো সময় নষ্ট করে মনের খোঁজ নিতে ইচ্ছে হয় না।
সে সাথে থেকে প্রিয় মানুষটির হাত ধরে পথটা পাড়ি দেবার কথা ভাবে। হৃদয়ের খোঁজের চেয়ে সাথে থাকাটা কি তবে অনেক জরুরী?
.

বিয়ের আগের সময়ে ফিরে যায় কণা। কতটা আবেগে প্রগলভ সময়গুলো কেটে যেতো। ঝিরঝিরে সময়গুলো ফুরফুরে বাতাসে এলোমেলো অনুভূতির ছোঁয়ায় তিরতির করে কাঁপতো! সবার বাঁধা না মেনে আগুনের দিকে দ্রুত ধাবমান পতঙ্গের মত অনিন্দ্যকে লক্ষ্য করে ছুটে চলবার সেই অনুভূতিগুলো কি নিঃশেষ হয়ে গেলো?
.

তোমার কি মনে হয়?
নিজেকে দেখে কণা। আয়নায় নিজেকে দেখার মত না। আয়নায় শুধু উপরের ছবিটা ভেসে উঠে। আসলের নকল প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আজ কণা নিজেকে নিজের চোখে আয়নাবিহীন নিজের আসল ছবি দেখতে চাইছে।

অনুভূতিগুলো কি নিঃশেষ হয়েছে! মনে হয় না। হলে শিহাবকে নিয়ে ভাববার কিংবা ওর উপর রাগ হবার প্রয়োজন পড়তো না।
.

কীভাবে যেন আনন্দের সেই সময়গুলো পার হয়ে অসময়কে রেখে গেলো। পনেরটি বছর এভাবে শেষ হয়েছে। হাসি-কান্না আনন্দ-বেদনায় মূর্ত সময়ের ভিতরের দুঃসময় হঠাৎ উঁকি মারা শুরু করেছে। এখন খুব অল্প সময়ই কণাশিহাবের সাথে থাকতে পারে। রাতটা যেতে না যেতেই শেষ হয়ে যায়। যেন ঘোড়ার পিঠে করে চলে যায়। পৌনঃপুনিক এভাবে সপ্তাহগুলো কেটে যাচ্ছে। সারাদিন পরিশ্রান্ত মানুষটি এসেই কণার সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে। একজন পুরুষ হিসেবে সে ওর কাছে আসছে বলে কেন মনে হয় আজকাল কণার? সে তো একজন বন্ধু শিহাবকে চায়। তবে মানুষটি কেন সেই আগের শিহাব হতে পারে না? অপুর্ণতাটি কোথায় ? আজকাল বড্ড ভাবে কণা।

সেই আগের মত শিহাবের ছোঁয়ায় কি ওর ভিতরে শিহরণ জাগে?
.

ভাবে। উত্তর পায় না। আসলে ঐ সময়গুলোতে শিহাবকে কেমন অন্য মানুষ মনে হয়। একটা যন্ত্র যেনো সে। রোবটমানব। সব কিছু সময় মিলিয়ে শেষ করতে হবে।

– ওহহো! বারটা বেজে গেছে। ঘুমালাম। সকাল উঠতে হবে…।

কিংবা

– আজ কোনো ভাবে আসতে পারছি না লক্ষ্মীটি। জরুরী শিপমেন্ট রয়েছে। অনেক রাত হবে। তুমি একটু ম্যানেজ করে নাও…।
.

এভাবে পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছেলেমেয়েদেরকে সাথে নিয়ে কণাকে একাই যেতে হয়েছে… হচ্ছে…। সামনেও হয়তো যেতে হবে।
হয়তো? তারমানে আশা লুকিয়ে রয়েছে মনের গভীরে কোথায়ও। শিহাবের থেকে কণা যা চাইছে তার পূর্ণতা হওয়া সম্ভব এখনো।
.

মানুষটা যে কেনো হাত ধরার সুযোগ না দিয়ে দূরে দূরে সরে থাকছে! তবে হাত ধরার সুযোগটা এখনো এক আধ বার এসে যায়। যখন শিহাবের সাথে বাসা থেকে কোথায়ও বের হয়, তখন এসে যায়। দু’জন যখন রাস্তাটা পার হতে চায়, পাশাপাশি দাঁড়ানো থাকা অবস্থায়ই কণা ওর হাত পরম নির্ভরতায় ধরে ফেলে।
.

আহ! কি শান্তি। শিহাবকে কিছু বলা লাগে না, কিংবা সে তাকিয়েও দেখে না কণার হাতটা কোথায় রয়েছে। জাস্ট একবারেই ধরে ফেলে…!

দু’জনে একসাথে রাস্তা পার হয়।
.

এতোগুলো বছর তো এভাবেই পেরিয়ে এসেছে! তারপরও কেনো অভিযোগ? কিসের অপুর্ণতা?
.

একটা দীর্ঘশ্বাস নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে। আজ সারাদিন কি শুধু শিহাব আর নিজেকে নিয়েই ভাববে? কী থেকে কী হয়ে গেলো! নিজেদের কতটুকু চিনেছে?
.

একটা স্বপ্ন কণা প্রায়ই দেখে। শিহাবকে নিয়ে। অনেক বছর পরে হঠাৎ দু’জনের দেখা একটি রেল স্টেশনে। কণার ঠোটের বাম পাশের তিলের জন্য হাসলে তাঁকে অদ্ভুত দেখায়। এতোগুলো বছর পরে ঐ হাসিটা দেখে শিহাব কনাকে চিনে ফেলে। আর মানুষটির ওকে চিনতে পারার ঐ হাসি দেখে কনাও হেসে ফেলে। একটু রোমান্টিসিজমের গভীরে যাবে এমন সময়েই প্রতিবার কনার স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে পাশে ঘুমন্ত অশিহাবকে দেখে। সে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। বড্ড মায়া লাগে। তবে ওকে জাগিয়ে পাশে বসে কথা বলে বলে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। এতো কাছে… তবুও কত দূরে মনে হয়।
.

মেয়েদের সব ইচ্ছে কি পুরণ হবার? না কি হয়?
.

কণার নিজে এবং ছেলে-মেয়ে সব কিছুর থেকে এখন শিহাবকেই বেশী দামী মনে হয় কেনো? ওকে চায় সে! কণার সব কিছুর বিনিময়ে.. শিহাবকে চাই!… নিঝুম অন্ধকারে ওকেই চাই! শেষ পর্যন্তও ওকেই চাই!
.

কণা হাসে। কিন্তু তার মন কাঁদছিলো। চোখ ও। ‘ভালোবাসা! সারা জীবন ধরে চেয়েছে যে ভালোবাসা! কেমন পাওয়া হলো এটা! সীমানার বাইরে!! কণা’র কষ্ট হচ্ছিলো। ভালো ও লাগছিলো।
.

বিয়ের আগের একটা অদ্ভুত রাতের কথা মনে পড়ল তার। রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। শিহাব বেপরোয়া ফোনের পর ফোন দিচ্ছে! এক সময় অস্থির হয়ে পাগলের মত হয়ে গেলো সে। কনা ফোন ধরছে না ইচ্ছে করে। অনেক পরে সে রাতে কণা ফোন রিসিভ করেছিল কী অদ্ভুত শোনাচ্ছিল শিহাবের স্বর! ভুতে পাওয়া মানুষের মত! ‘ I love you! Do you! Do you! Do you!………কণার অন্তরাত্মা সারা রাত চিৎকার করেছে
‘Yes, I do !… I do! …. I do!
.

কিন্তু একটা শব্দ বের হলো না সে রাতে কণার মুখ থেকে! অন্ধকারে ও সে সমাজ, সংসার, বয়স, চারপাশের সব সম্পর্কগুলি বিস্ফারিত চোখে দেখছিলো! ওর ভয় হচ্ছিলো। কেউ যদি শোনে! শিহাবের কোন ক্ষতি হয়!
.

সেই রাতের কথা ভেবে কণা মাথা নিচু করে হাসলো। সে ভীরু! ভালোবাসি বলার সাহস তার নেই! ভালোবাসলো কেনো তাহলে!?
.

অপরাধবোধের মৃদু হাসি ফুটে রইল কনার মুখে। গাছের পাতা ভেদ করে বিকেলের সোনাঝরা আলো পড়েছে ওর মুখে। তবু চোখ টানছে না। মন হারিয়ে গেছে কোথাও। কনা আবারো হাসলো। সত্যিই বদলে গেছে ওরা দু’জনেই !
.

ভাবনাগুলি স্মৃতি আর আবেগের মিলিত স্রোতে ভেসে যেতে থাকলো। কী হবে সামনের দিনে!?
.

বিবাহিত জীবনের এই পর্যায়ে এসে কণার মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়। সুখ জিনিসটা একটা আপেক্ষিক বিষয়। তাই সে সুখী কিনা সে ব্যাপারে জানতেও চায় না। শিহাবকে ওর পরিবারের কেউই পছন্দ করেনি। সে ই সবাইকে অগ্রাহ্য করে আলাদা সংসার পেতেছিলো। তাই নিজের ভালবাসাকে অপমান করা হবে আজ মানুষটিকে অবজ্ঞা করলে। সময় আজ শিহাবকে অনেক কর্কশ বানিয়ে দিয়েছে যদিও। কিন্তু একজন পুরুষ হিসাবে এইটুকু কর্কশতার প্রয়োজন ছিলো। তবে শিহাব একটু বেশীই কি হয়ে যাচ্ছে না? সংসারকে টিকিয়ে রাখতে যেটুকু স্বচ্ছলতার প্রয়োজন, সেটা আনতে সে যদিও প্রচন্ড পরিশ্রম করছে, কিন্তু তাতে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ছেলেমেয়েকে নিয়ে কনার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটা নিয়ে সে কখনো শিহাবকে চাপ দেয় নাই। বরং নিজেই আজ এতোগুলো বছর স্কুলে চাকরি করছে। বাসায় প্রাইভেট টিউশন দিচ্ছে।
.

কনার অতিরিক্ত স্বচ্ছলতার প্রয়োজন নাই। দু’জনের আয়ে যা আসছে তাতে সুন্দরভাবেই তো চলে যাচ্ছে। কিন্তু শিহাব কণার চাকরি করাটাকে বোধহয় মেনে নিতে পারেনি। অথবা সে ভেবেছে শিহাব একা কুলিয়ে উঠতে পারছে না বলেই কনার এই আয়ের পথ বেছে নেয়া।

শিহাব কি একধরণের ‘ইনফ্রেরিয়র কমপ্লেক্সে’ ভুগছে?
.

কনার চোখ পড়ল ফ্রিজের উপরে রাখা বড় মাটির ব্যাংকটির দিকে।
এরকম একটি ব্যাংক রয়েছে কণার অন্তরের অনেক গভীরে। যেখানে সে প্রতিটি মুহুর্ত শিহাবের থেকে পাওয়া ভালোবাসা জমিয়ে রাখতে চায়। সময়ে অসময়ে ভালবাসার আকাল হলে সেখান থেকে ভালোবাসা তুলে এনে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে।
কণা শিহাবের কাছ থেকে আজকাল এই ভালোবাসাটুকুই পায় না… সেই আগের মতো!
.

দুই ছেলেমেয়ের পাশ দিয়ে একজন মা অতি সন্তর্পনে মুহুর্তগুলোকে কাটিয়ে একজন অভিমানী স্ত্রীতে পরিণত হয়। সন্তানেরা একটুও বুঝতে পারে না। ওরা কেবলি ওদের মাকেই দেখে। তাই সেভাবেই ওদের জীবন আবর্তিত হয় একজন মাকে ঘিরে। একজন নারী হিসেবে কণার অসহায়ত্ব একমাত্র যে মানুষটি উপলব্ধি করতে পারতো… বারান্দায় এসে কনা তাঁকে হাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে বাসার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে।
.

মুহুর্তে দমকা বাতাসের সাথে বেগে ধেয়ে আসা ভালোলাগারা ওর হৃদয়কে ঘিরে প্রহ্লাদে নাচতে থাকে। কণা ওর চোখের আলোয় জ্বলে উঠে চোখের বাহিরে থাকা শিহাবকে কেনো জানি আজ স্পষ্টভাবে দেখতে পায়।
.

অনেকদিন পরে ব্যালকনিতে দাঁড়ানো ওর প্রেয়সীর সেই হাসিমুখ দেখে শিহাব ও নীচে থেকে অবাক হয়।
.

বাজারের ব্যাগ কনাকে বুঝিয়ে দেয় সে। কনা চলে যেতে উদ্যত হলে ওর হাত ধরে ওকে থামায়। নিঃশব্দে দু’জনের চোখের ভাষায় কথা হয়। শিহাবের হাতের প্যাকেটটির দিকে অবাক তাকিয়ে রয় কণা। প্যাকেটের ভিতর থেকে ভালোবাসা ফুলের সাথে বের হয়… কণার খোঁপায় জড়িয়ে যায় একজন হৃদয়বান পুরুষের প্রথম বাসন্তী উপহার!

বসন্তের প্রথম দিনের শেষ বিকেলে প্রিয় মানুষটির হাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে কনার মনে হয়, আজো ওর প্রিয় মানুষটি সেই একইরকম রয়েছে। সে এখনো হৃদয়বান!
.

কিন্তু ওর পাশে থাকা হৃদয়বান পুরুষটি কি সাথে থাকা নারীকে হৃদয়বতী ভাবছে?
.

এভাবেই ভাবনাগুলো হৃদয় থেকে হৃদয়ে আসা যাওয়া করতে থাকে। এরই মাঝে একদিন ফুরায় সকল লেনদেন। শেষ হয় খেলা।

কিন্তু ভালোবাসাবাসি কি শেষ হয়?

রত্তন চোরা ও একজন অরুপ রতন চক্রবর্তী

FB_IMG_1487163351541
ফাৎনা জলের নিচে ডুবে যেতেই ছিপ সজোরে পেছন দিকে নিয়ে আসে রতন। অবশ্য এলাকায় সে নিজের পরিবারের তিন সদস্যের বাইরে সবার কাছে ‘রত্তন চোরা’ হিসেবে পরিচিত। নিজের বাপ-দাদার এক রত্তি এই ভিটে সংলগ্ন পচা ডোবায় মাছ ধরছে। টাকি মাছের শরীর বড়শিতে গাঁথা অবস্থায় রোদ লেগে ওর চোখে রুপালি ঝিলিক মারে। দুই হাঁটু’র ওপর থুতনি রেখে বসে থাকা ছোট ছেলের দিকে তাকায় সে। চোখে বিজয়োল্লাস। সেই উল্লাসের কিছুটা জ্যোতি ছেলের চোখেও লাগে। সে বসা থেকে ওঠে। কচু পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা পুরনো বদনার মুখ উন্মুক্ত করে বাপের হাত থেকে মাছটি নিয়ে ভিতরে রাখে। আবার বড়শি ফেলে রতন।

নিজের চারতলা বাড়ির দু’তলার ব্যালকনিতে বসে পেপার পড়ছিলেন অরুপ রতন চক্রবর্তী। সামনে টি-টেবিল। পিরিচে ঢাকা চা’র কাপের পাশেই এস্ট্রে। সেখানে পুড়তে থাকা বেনসন এন্ড হেজেজের জ্বলন্ত অগ্রভাগ দিয়ে নীলচে ধোঁয়া বের হচ্ছে। দুষ্টু বাতাসের কারসাজিতে ধোঁয়া এসে তার বাম চোখে লাগে। চোখ জ্বালা করে ওঠে। পেপার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বাম হাতে সিগ্রেট নিয়ে কষে পাফ করেন। ঠিক তখুনি ভেতরের রুম থেকে ল্যাণ্ড ফোন বেজে ওঠার আওয়াজ পান। ভ্রুযুগল কুঁচকে ওঠে। সিগ্রেট হাতেই ভেতরে চলে যান ফোন রিসিভ করতে।

পুলিশ স্টেশন। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষে সাব-ইন্সপেক্টর প্রবেশ করেন। ওসি সাহেব সিঙ্গারা খাচ্ছিলেন। গরম বলে মুখে দিতে পারছেন না। সিঙ্গারাটি ভেঙ্গে ছড়িয়ে রেখেছেন। এক এক টুকরা ফু’ দিয়ে মুখে দিচ্ছেন। সাব-ইন্সপেক্টরকে দেখে জিজ্ঞাসু নেত্রে চাইলেন,
‘কিছু বলবে মোখলেস?’
– জি স্যার। গতকাল রাতে এলাকায় এক মারাত্বক চুরি হয়েছে। সবুজবাগের চৌধুরী পাড়ার আমিন চৌধুরীর বাড়ি। চোর একেবারে সাফ করে দিয়েছে।
‘ হুম.. কি কি নিয়েছে? সাফ বলতে তুমি কি বুঝাতে চাইছ?’
– স্যার, অভিযোগ এসেছে আলমিরার ভেতর থেকে সোনাদানা আর নগদ টাকা যা ছিল সব নিয়েছে। সব মিলিয়ে তা প্রায়..
‘ আরে রাখ মিয়া।‘ এস.আই মোখলেসকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলেন ওসি। গরম এক টুকরা শিঙ্গারা মুখে ফেলে কয়েক চাবান দিয়ে ক্যোঁৎ করে গিলে ফেলেন। ‘ চুরি হলেই সবাই সোনা-দানা আর নগদ টাকার কথাই বলে অথচ দেখ গিয়ে পুরনো কিছু লুঙ্গি-শাড়ি কাপড় কিংবা রান্না ঘর থেকে কিছু থালা-বাসন চুরি হয়েছে। মানুষ আজকাল সোনাদানা আর টাকা ব্যাংকের ভল্টে রাখে।‘
– স্যার, সমস্যা আছে এখানে।
‘মানে?’
-আমিন চৌধুরী এম.পি সাহেবের খুব কাছের লোক।
ওসি সাহেব তার প্রিয় এই এস.আই’র দিকে কয়েকমুহুর্ত তাকিয়ে থাকেন। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
‘এই দেশে সবাই-ই কারো না কারো লোক। কেবল আমরা-ই কারো লোক না। আমরা পুলিশ।’
-জি স্যার।
‘ খোঁজ নাও তো রত্তন চোরা কোথায়? কাল রাতে কই ছিল সেটাও জানবে।‘
– আপনার কি মনে হয় স্যার, রত্তন কাজটা করেছে?
একটু থামেন ওসি সাহেব। কিছু একটা ভাবেন। শেষে বলেন,
‘করেছে কি করে নাই সেটা তো পরের ব্যাপার। ওকে ধরে নাকের ভেতর গরম পানি ঢাললে-ই আসল ব্যাপার বের হয়ে যাবে।‘
– ওকে স্যার।
এটেনশন হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় এস.আই। তার পেছন দিকে তাকিয়ে থেকে সিঙ্গারার আরো একটা অংশ মুখে পুরে দেন ওসি। কিন্তু না দেখে নেয়াতে বেশ বড় একটা অংশ মুখে চলে যায়। প্রচন্ড গরমে মুখ পুড়ে যায় তার। ভয়ংকর ক্রোধে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায় ওনার। কিন্তু ক্রোধটা ঠিক কার ওপর বুঝতে না পারায় শেষে রত্তন চোরার ওপর গিয়ে রাগটা স্থির হয়।

টেলিফোন ক্রেডলে রেখে ঘুরে দাঁড়ান অরুপ রতন চক্রবর্তী। একজন শুল্ক কর্মকর্তা। দুর্ণীতির অভিযোগে কিছু দিন সাসপেন্ড ছিলেন। তার সাথে আরো কয়েকজন ছিলেন। শেষে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করে ওনারা নিজেদের সাসপেনশন ‘উইথড্রো’ করতে পেরেছেন। সেই সুখবরই ওনাদের উকিল জানালেন এইমাত্র। মুখে বিজয়ীর হাসি নিয়ে ভেতরের রুমের দিকে এগুলেন তিনি। সহধর্মিনীকে না জানালেই নয়। তাড়াহুড়ায় হাতের সিগ্রেট ফ্লোরের দামী কার্পেটে পড়ে যায়। ওটাকে স্লিপার দিয়ে পিষে দামী কার্পেট নোংরা করে ফেলেন। কিন্তু সে জন্য একটুও বিরক্ত হন না। এমন দামী কার্পেট জোগাড় করা তার জন্য মুহুর্তের ব্যাপার।

অনেকগুলো টাকি মাছ পেয়েছে রতন। সে নিজেই কিছু ছাই নিয়ে কুটতে বসে গেছে। ওর দুই ছেলে বাপের পাশে বসে অবাক হয়ে দেখছে। ওদের মা ঠিকে-ঝি’র কাজ করে। সে আজ কাজে যায়নি। গত রাতে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। রতন সারা রাত তার পাশে জেগে ছিল। সেও দাওয়ায় বসে রতনের মাছ কুটা দেখে। অসুস্থ চোখেও কেমন এক ম্লান আভায় সে পরম মমতায় তার এই ‘কথিত চোর স্বামীকে দেখতে থাকে। কাজের এক পর্যায়ে রতন বউকে বলে,
‘বেশী ঝাল দিয়া বউ, মাছের ভর্তা করিস। আর বাকিগুলান দিয়া সালুন রান্ধিস। মাহা মাহা ঝোল।‘

বউয়ের চোখে আনন্দের আলো চোখে পড়ে রতনের। আনন্দ আর দুঃখ- এরা বোধহয় হাত ধরাধরি করে থাকে মানুষের সাথে। ওদেরকে দেখা যায় এই চোখের আলোয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রতন ভাবনায় ডুবে যায়। লেখাপড়া শিখে নাই। তেমন কোনো কাজও জানে না। আর শরীরেও শক্তি বেশী নাই। কোনো ভারী কাজ করতে পারে না। তবে ওর বাপ যা রেখে গেছে, তাতেই ওর চলে যেত। কিন্তু সঙ্গ দোষে এলাকার মানুষের গাছের ফল, মুদি দোকান থেকে কলাটা কিংবা কেক-বিস্কিট এগুলো শ্রেফ আনন্দের জন্য চুরি করা শুরু করে। বন্ধুদের কাছে নিজের এই ‘চৌর্য্যবৃত্তির’ জন্য কেমন যেন গর্ব বোধ করতো সে। এভাবেই শুরু। বাবা মারা যাবার পর সে-ই আক্ষরিক অর্থে নিজের পরিবারের প্রধান হয়ে ওঠে। মা আর এক বোন। মাত্র তিনজনের এই সংসার। বোনের বিয়ে হয়। কিছুদিন পরে মা মারা যান। তবে মারা যাবার আগে এক মাত্র ছেলেকে বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। এরপর মা মারা গেলে মুরব্বি বলতে রতনের আর কেউ রইল না। এরপর ওর স্বাধীন জীবন। এবার মানুষের ঘরের বাইরের জিনিসপত্র নেয়া শুরু করল। তবে কেবল মনের আনন্দে সে চুরি করে। এ এক বিকৃত আনন্দ। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে এসেছে এই বিকৃতি। প্রথম সন্তান হবার পর একদিন বউ ওকে এই চুরি-চামারি করতে নিষেধ করে। ছেলে বড় হলে সবাই তাকে চোরের ব্যাটা বলবে। এটা কি রতনের ভাল লাগবে? সেদিন বউকে কোনও কথা না দিলেও, এরপর থেকে আর কখনো রাতে চুরি করতে সে বের হয়নি। কিন্তু ইতোমধ্যে ‘চোরা’ নাম সে অর্জন করে ফেলেছে। যে কোনো চুরি হলেই সবাই রতনকে সন্দেহ করে। থানায় ও কয়েকবার যেতে হয়েছে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে হাল্কা মাইর দিয়েই ওকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। এরকম কয়েকবার-ই হয়েছে ওর সাথে। তাই পুলিশের ‘ব্যাড-বুকে’ ওর নাম লেখা হয়ে গেছে।

ভাবনা সম্পুর্ণ করতে পারে না সে। এর আগেই এস.আই মোখলেসের নেতৃত্বে দু’জন কনস্টেবল ওর উঠানে এসে থামে। একটু অবাক হয় রতন। এস.আই সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করে সে গতকাল রাতে কোথায় ছিল। যা সত্য সে সেটা-ই বলে। কিন্তু ওরা তার কথা বিশ্বাস করে না। আসলে পুলিশেরা কেবল রুটিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আসে নাই। ওরা এসেছে ওকে থানায় নিয়ে যেতে। রতনের বউ এবং ছেলেরা যতই বলার চেষ্টা করল যে, গতরাতে রতন বাড়িতেই ছিল, ওরা সে কথা কানেই তুলল না। রতনের কোমরে দড়ি বেঁধে গাড়ি পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। দুই ছেলে কেঁদে কেঁদে বাপের পিছনে.. অসুস্থ বউ এলাকার কাউন্সিলরের বাড়ির দিকে দ্রুত পদে হেঁটে চলে। রাস্তায় পরিচিত লোকজন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে। একজন চোর আমাদের সমাজে উপভোগের উপকরণ ছাড়া অনেকের কাছে আর কিছু কি? কেউ কেউ তীর্যক মন্তব্য করে। একজন চোরের বউয়ের শরীরে সেগুলো কতটা জ্বালা ধরায়, সাধারণ মানুষ তার কতটুকু অনুভব করে?

কাউন্সিলর বাড়ির ভিতরে ছিলেন। রতনের বউয়ের ডাকে কিছু সময় পরে তিনি সামনে এলেন। সব শুনলেন। কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর নিজের অপারগতা সরাসরি জানালেন। একজন চোরের জন্য তার কিছু-ই করার নাই। রতনের বউ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নীরবে ফিরে আসে। তবে তার মাথা নিচু হয় না। ফেরার পথে কাউন্সিলরের নতুন প্রাইভেট কারটি চোখে পড়ে। এক বছরের ভেতর টিনশেড সেমি-পাকা বাড়ি তিনতলা বিল্ডিং হয়েছে। বারো লাখ টাকা দামের গাড়ি চকচক করছে। বেশ উন্নতি হয়েছে। তো এমন একজন মানুষ কেন-ই বা একজন চোরের জন্য থানায় যাবে? নিজের চোখ পাথরে পরিণত হয় ‘চোরের বউয়ের’। তবে ধীর পায়ে ফিরে চলতে চলতে সে ভাবে, কাউন্সিলর নির্বাচনের সময়ে এই ‘চোরের’ কাছেও আসতে হয়েছিল মানুষটিকে। তখন বোধহয় ওর স্বামী চোর ছিল না। নিজের বাড়ির পথটি নজরে আসে। দূর থেকে দাওয়ায় বসা দুই ছেলের আবছা অবয়ব দেখে একজন ‘চোরের বউ’.. একজন প্রিয়তমা স্ত্রী.. একজন মমতাময়ী মা।

অরুপ রতন চক্রবর্তীর বাড়িতে বেশ আলোকসজ্জা। বাড়ির ভেতরে এবং বাউন্ডারি দেয়াল ঘেঁষে আরো কয়েকটা গাড়ি পার্ক করে আছে। ভেতরে আনন্দ চলছে। ছাদে সাউন্ড সিস্টেম থেকে দ্রুত লয়ের ইংরেজী গান ভেসে আসছে। এমন সময়ে ফ্ল্যাগ উড়িয়ে প্রটোকল সহ একজন মহামান্যের আগমন ঘটে। উপর থেকে কয়েকজন ভদ্রলোক নেমে আসেন। অরুপ রতন চক্রবর্তী তো আছেন-ই। অন্যদের ভেতর একজন পুলিশ সুপার, সহকারী কমিশনার অব পুলিশ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার অব ফুড, আয়কর বিভাগের সহকারী কমিশনার, সরকারি কলেজের প্রভাষক সহ আরো অনেকে। এরা সবাই পরিচিতি এবং চাকুরির সুবাদে একত্রিত হয়েছেন। কয়েকজন অরুপ রতন চক্রবর্তীর ভার্সিটির সময়ের বন্ধু। সবাই মিলে ‘মিনিষ্টার’ সাহেবকে লাল গালিচা সম্বর্ধনা দিয়ে ওপরে নিয়ে গেলেন। আলো এবং আলোয় ভরা চারিদিক। এর ভেতরে কিছু কালো হৃদয় নিজেদের অন্ধকার বিলাতে একত্রিত হলেন। আলোর কণ্ঠরোধ হওয়াতে ধীরে ধীরে ম্লান হতে হতে একসময় আঁধারে ডুবে যায়!

নিজের চেয়ারে বসে আছেন ওসি সাহেব। বাসায় যাবার ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারছেন না। একটু আগে স্থানীয় এম.পি’র পি.এস ফোন করেছে। চৌধুরী বাড়িতে হওয়া চুরির ব্যাপারটা নিয়ে এম.পি সাহেব বেশ উদ্বিগ্ন। কেসটা যেন ‘বিশেষ বিবেচনায়’ দ্রুত সমাধা করা হয়। এতটুকু-ই বলার ছিল তার। বেশ রাগ হল ওসি মাঈনুদ্দিনের নিজের উপর। কেমন এক বিবশ অসহায় অনুভব করছেন আজ। এস.আই মোখলেস নীরবে ভিতরে আসে। বেশ পরিশ্রান্ত দেখা যাচ্ছে তাকে।
‘কি? মুখ খুললো?’
– না স্যার। এত ভাবে চেষ্টা করার পরও মুখ খুলছে না। আমার মনে হয় এ জড়িত থাকলে এরকম ডলার পরও মুখ বুজে থাকত না।
‘হুম.. এখন কী অবস্থা ওর?’
– স্যার, রক্তবমি করছে। এই অবস্থায় আর কিছু করা ঠিক হবে না।

ওসি তার প্রিয় এস.আই’র দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকেন। ভেতরে তার ভাঙ্গাচুরা চলতে থাকে। অনুভবের ভাঙাচুরা হৃদয় বিদীর্ণ করে চলে.. পোষাকধারী একজন মানুষের।

রত্তন চোরার বাড়িতে কোনো আলো জ্বলে না। ছেলেরা মাকে ঘিরে বারান্দায় বসা। বেশ ঝাল দিয়ে টাকি মাছের ভর্তা বানানো হয়েছে। আলু-বেগুন সহযোগে মাছের ঝোলও করা হয়েছে। সব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখা আছে। ছেলেরা এবং ওদের মা, তাদের প্রিয় মানুষটির আসার অপেক্ষায়।

একটি এ্যাম্বুলেন্স তীব্র সাইরেন বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রচন্ড জ্যাম রাস্তায়। এর ভেতর দিয়ে-ই যতটুকু যাওয়া যায়। তবে বাহনটির ড্রাইভার বেশ উদ্বিগ্ন। ভেতরে একজন মানুষ রয়েছে। খুব দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। পাশে বসা পুলিশটির দিকে তাকায় সে। বেশ নির্বিকার ভঙ্গিতে সে মোবাইল দিয়ে ফেসবুক চালাচ্ছে। ট্রাফিক বাড়ল কি কমল, তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। ভেতরে তো রত্তন চোরা।

জ্যামের ভেতর কোন গাড়িতে যেন নচিকেতার গান বাজছে। এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার অলস বসে বসে শোনে…

…’সে দেশে, অর্থের কারচুপিতে সিদ্ধ যিনি অর্থমন্ত্রী
দেশের শত্রু মাঝে প্রধান যিনি প্রধানমন্ত্রী’…

★ছবিঃ নেট থেকে কপি করা।

সৌরভ

FB_IMG_1485868881372
মিথিলাকে হারাবার পর, আনাম বছরগুলি পাগলের বেশে কাটিয়েছিল। আক্ষরিক অর্থেই পাগল ছিল সে। সেই সূত্রে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে। জেলায় জেলায় বন্ধু পেয়েছে।

বিচিত্র সে সব বন্ধুরা ওর।
কেউ পুলিশ কেউ মাঝি। কেউ রেলের শান্টিং মাস্টার তো কেউ ভার্সিটির প্রোফেসর। সবাই-ই বন্ধু। এদের ও আবার বিচিত্র কর্মকান্ড। বড্ড চিত্রিত হয়েছে তাতে ওর রংহীন জীবন। বিবর্ণ.. ধূসর। তাতে ধার করা রঙ লেগেছে শুধু। বর্নীল হয়েছে কি?

নেশারু বন্ধু ও আছে। যখন মন খারাপের বিকেলগুলি, আনামের অসহ্য লাগে। আনাম তখন সন্ধ্যায় প্রবেশ করে। আঁধারে নীল জোছনায় ভিজে।

এমন এক সাঁঝেরবাতি জ্বলা ছোট্ট ট্রলারে। তুরাগের মাঝবুকে। এক মধ্যরাতে। তারা ছিল আকাশে। মেলা চলছিল বোধহয় ওদের। আকাশের মেঘবালিকারা ইয়াবা সেবন করেছিল বুঝি সে রাতে। তাই নির্ঘুম। ঢেকে রাখছিল চাঁদ কে।

মাঝি আনামের বন্ধু। গাঁজায় আসক্ত। যুবক বয়স। আরও একজন। পড়ন্ত বেলার। সাদা চুল ব্যাক-ব্রাস করা। চকচকে চেহারা। শরীরে বয়সের ছাপ না থাকলে ও চোখে বয়স বসে গেছে।

যখন মেঘবালিকারা কান্না শুরু করল, তখন মাঝ নদীতে মধ্যরাতে কেবল আনামরা তিনজন। হাতে মাটির কল্কে। গোল হয়ে ঘুরছে। উপরে স্টিলের খোলা ছাদ। শীতল জলকণার ছিটকে আসার শব্দে ঘোর লাগে ওদের।

টুকটাক আলাপ থেকে পরিচিত হওয়া। দু’একটা কথায় সম্মত হওয়া। বিতর্কিত কথা এড়িয়ে যাওয়া। সব পার হয়ে নিজের কথায় প্রবেশ করা।

ব্যাক-ব্রাস করা চুলের মালিক ইতোমধ্যে পঞ্চাশ অধিক বসন্ত করেছেন পার। নিজের কথায় সাদা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিহিত সেই সাদা চুলের মালিক নিজেকে চেনালেন। এক মধ্যরাতে। ঘোর লাগা প্রহরে।

‘ আমার বউটা পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুক। আপনারা আমীন বলেন। বড্ড ভাল মহিলা ছিলেন। বড্ড ভালবাসত আমায়।’

আনাম আর মাঝি নিজের মনে আমীন বলে।
থামেন তিনি। কিছুক্ষণ ভাবেন। আনাম কথা বাড়ায়,
– আপনি ভালবাসতেন না?
– হ্যা! বাসতাম। অনেক বাসতাম। সে জানত এটা। এজন্যই যাবার বেলায় হাত ধরে কেঁদেছিল। মৃত্যু ভয়ে না। সে চলে গেলে কে দেখবে আমাকে এই ভেবে!

একটু জোরেই হেসে ফেলেন তিনি। বাইরের বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে ও আনামের কানে বাজে। বেশ জোরালো।
– একবার ভাবুন তো, সারাজীবন ছোট্ট চড়ুই বাবুর মত তাকে আগলে রাখলাম আমি! এমনই ভাবতাম আমি সারা জীবন। অথচ যাবার সময় কাঁদলো কিনা, কে আমাকে দেখে রাখবে ভেবে? কে ভালবাসবে তার মত! আমি-ই চড়ুই বাবু ছিলাম তার কাছে। সে-ই আগলে রাখত আমাকে। বুঝলাম আমি। সে চলে যাবার বেলায়।

নিরবে জল গড়িয়ে নামে। নদীর জলে দু:খগুলি ভেসে যায় বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধুয়ে। আনামের এমন মনে হয়। নি:শব্দের মাঝে নিরব তিন পুরুষ। একজনের কষ্টগুলি অনুভব করতে চায় বাকী দু’জন। পারে কি?
কারও কষ্ট তার মত করে অন্য কেউ অনুভব করতে পারে কখনো?

আনাম নিরবতায় আঘাত হানে আবারও।
– আপনার কে কে আছেন?
– এক ছেলে। তার বউ। নাতি একজন। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন তিনি।
– আপনার ছেলে-ই তো আছে আপনাকে দেখে রাখবার। ভালবাসবার। কি করে ছেলে?
– আমি আমার এলাকার সব চেয়ে ধনী। বলতে গেলে পুরা একটা মহল্লার মালিক। সব জায়গা বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দেয়া। গার্মেন্টসের স্টাফ ওয়ার্কাররা ভাড়া থাকে। ছেলের কিছু করা লাগে না। তারপর ও গার্মেন্টস ফ্লোর করে দিয়েছি আমি। সাব-কন্টাক্টের কাজ করে।

মাঝি নিরবে শুনছে। কল্কে পরিষ্কার করছে। অখন্ড মনযোগ দু’দিকেই। আনাম মন্তব্য করে,
– সবই তো তাহলে ঠিক আছে। সমস্যা তো কোথাও নাই।
– হ্যা, সবই ঠিক ছিল। আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি দিতে চেয়েছিলাম আমার সম্পদকে। কিন্তু ছেলে সম্পদ হতে চাইল না।
– কি রকম?
– ওর মা থাকতেই তার বিয়ে দিয়েছিল। নিজের পছন্দ করা মেয়ে এনেছিল ওর মা। লক্ষী। গুণবতী।
চেহারা বেশ সুন্দর আমার ছেলের। একটু বেশী-ই সুন্দর ছেলে। সেই হিসাবে তার চরিত্র সুন্দর হল না। পরনারীর বড্ড নেশা তার।

আবারও কিছুক্ষণ চুপ থাকেন তিনি। কুপির আলোয় এক রহস্যময় রাতে, ট্রলারে মাঝনদীতে এক মধ্যরাতে-আনামদের ছায়াগুলি দীর্ঘ প্রলম্বিত দেখায়। স্বপ্ন গুলির মতই দীর্ঘ হতে চায় বুঝি!
রহস্যময় সাদা পোশাক পরিহিত মানুষটি কথার খেই ধরেন,
– মাসে ঘর ভাড়াই আসে আমার পাঁচ লাখের উপরে। আরও মার্কেট, ইটের ভাটা- সব মিলিয়ে আরও অনেক আসে। সব আমি ছেলের জন্য দিয়েছি। সে কি দিচ্ছে আমাকে?

আনাম এবং মাঝি চোখে চোখ রাখে ওনার। দীর্ঘক্ষণ পলক পড়ে না। কারো চোখের।
– আমি কি চেয়েছি। ছেলে বুঝে না। ছেলে যা চায়। আমার পছন্দ না। সমস্যা না, এটা?
আনামের একটু আগের প্রশ্নের উত্তর দিলেন এবার।

– আমি তেমন লেখাপড়া করি নাই। দুনিয়া আমাকে শিখিয়েছে। ছেলের মা চাইলেন ছেলে অনেক পড়াশুনা করুক। প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে এমবিএ করালাম। দেখুন শিক্ষিত ছেলের কেমন অশিক্ষিত কাজকারবার!
– সে কি তার মা বেঁচে থাকতে ও এসব করতো?
– হ্যা, স্বভাব তো আর একদিনে নষ্ট হয় না। বদলায় ও না একদিনে। নষ্টের আলাদা ঘ্রাণ আছে। অনেকে পায় না। আমি পাই। ওর মা পেতেন না। আর আমিও আমার সব শক্তি দিয়ে ওনাকে পেতে ও দিতাম না। এসব খবর বাতাসে ছড়ায়। আমি বাতাসকে ও আটকে রাখার চেষ্টা করেছি।

আবার নিরব। দূর থেকে আর একটি নৌযানের আলো এসে পড়ে। আনামদের ট্রলারে। তীব্র আলোয় ভেসে যায় আনামরা-ট্রলার-মাঝনদী সব। মাঝি বিচলিত হলে তিনি হাসেন।
– আমার ট্রলার। আমাকে নিতে এসেছে।

বড় ট্রলারটি ওদের ছোট ট্রলারটির পাশেই নিরবে অন্ধকারে ভুতের মতন দাঁড়িয়ে থাকে।

– আমি চেয়েছি আমার ছেলে সুগন্ধী হয়ে উঠবে। সে রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যাবে, সৌরভ ছড়াবে। অনেকক্ষণ সেই ঘ্রাণে রাস্তা মৌ মৌ করবে। সবাই বলবে, ঐ যে, আমার ছেলে যায়। আমার সিনা গর্বে চওড়া হয়ে যাবে। ও নিজের ঘ্রাণের সাথে সাথে আমার ঘ্রান ও ছড়িয়ে যাবে। সুগন্ধী গোলাপ না হয়ে নর্দমার নোংরা হয়েছে ছেলে। এটাই সমস্যা আমার।

তিনি নি:শব্দে উঠে চলে যান। বাইরে তখনো একটানা বৃষ্টি। তাঁকে নিয়ে আধারের বুক চিরে সার্চলাইটের তীব্র আলোয় পথ খুঁজে ফেরে দীর্ঘ ট্রলারটি।

পথ খুঁজে ফিরেন একজন বাবা ও। ছেলেকে সুগন্ধী ফুল বানাবার মিশনে ব্যর্থ তিনি। যার প্রিয় মানুষটি তাকে ছেড়ে চলে যাবার আগে হাত ধরে কেঁদেছিল। বড্ড ভালবাসতেন তাকে তিনি। বাতাসকে ও আটকে রাখার মত ক্ষমতাধর একজন স্বামী হয়েও, নিজের ছেলের সৌরভে মেতে উঠার আনন্দে মগ্ন একজন বাবা হতে পারলেন না তিনি।।

★ Photo Credit: Akm Azad

সামছু মাঝি: ছোটগল্প

FB_IMG_1485806141201
ইলিশের মওসুম। তহবিলের সকলে তটস্থ। মালিক এসেছেন। ম্যানেজার থেকে শুরু করে পিওন পর্যন্ত সকলে কেমন ভয়ে ভয়ে পার করছে সময়। মাসে একবার মেঘনার পাড়ের এই তহবিলে আসেন তিনি। শহুরে জীবন থেকে সামান্য সময়ের জন্য বৈচিত্রের স্বাদ পেতেই বুঝি এই আসা-যাওয়া।

নিজের গদিতে বসে আছেন মালিক। তহবিল বলাতেই গদির উল্লেখ করা, নচেৎ নিজের বিলাসবহুল রিডিং রুমের আরামদায়ক চেয়ারটির মত, একই আরামে ডুবে আছেন তিনি।

সবাই যে ভয়ে থাকবে, এটাও জানেন তিনি। ম্যানেজার ব্যাটা বড় চোর। আর ওর নিজের কুকর্ম ঢাকতে, অধীনস্থদের কে ও চোর বানিয়েছে সে। একদল চোর পালছেন তিনি। এটা ওদের সামনে ও বলেন প্রায়ই।

বেল চাপেন। ম্যানেজার আসে। নিরবে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ নিচের দিকে। তার কাচুমাচু ভাব দেখে মালিক বিরক্ত হন। দু’হাতে ধরা বাসি খবরের কাগজ থেকে চোখ নামান। ভাঁজ করে রাখেন টেবিলে। জিজ্ঞেস করেন, ‘ছত্রিশ বোটের মাঝি পাওয়া গেছে?’ শুধু শুধু ঢোক গিলে ম্যানেজার। গলা খাঁকারি দিয়ে জানায়, ‘ জি স্যার।’

চুপ থাকে সে। অতিরিক্ত কথা বলাটা, মালিক পছন্দ করেন না।
‘ কি নাম?’
– স্যার?
‘বলছি মাঝির নাম কি? কোন গ্রাম?’
– সামছু মাঝি। চর আলেকজান্ডারের।

এবার মালিক চুপ থাকেন। ভাবনারা ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে গান করে তার মস্তিষ্কে। জানালা দিয়ে নদীর পাড়ে সারি সারি মাছ ধরা ট্রলার। জাল শুকাতে অলস অপেক্ষমান। রঙ বে রঙয়ের এবং বিচিত্র নামের এক একটা জলযান। বেশ প্রশান্তি অনুভব করলেন। এর ভিতর তার নিজের ও অনেকগুলি। বাহাত্তুর ইঞ্জিনের সহ কয়েকটা আছে।

‘ফরিদ মাঝি লেনদেন চুকায়ে গেছে?’
– আপনার কাছে হিসাব দেয়া আছে, স্যার।
‘সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দেবা। বাঁকা ত্যাড়া উত্তর আমার পছন্দ না। মনে রাখবা।’
– রাখব স্যার।

কিছুক্ষণ অধস্তনের দিকে চেয়ে থেকে মালিক গম্ভীর হয়ে জানান,
‘তোমার চাকরি কনফার্ম করার সময় বলছিলাম, আমি খুব কড়া মানুষ। কেউ সাত লাখ টাকা নিয়ে দিতে পারবে না, মাফ চাবে আমার কাছে। মাফ করে দেবো আমি। কিন্তু কেউ আমার পাওনা এক টাকা দিতে অস্বীকার করবে, ছাড়ব না কিন্তু। সাত লাখ টাকা খরচ করব ঐ এক টাকা আদায়ের জন্য।’

ঘরের পরিবেশ ভারী লাগে ম্যানেজারের কাছে। সে সাহস করে মালিকের দিকে তাকায়। দেখে মালিক চেয়ে আছে ওর দিকেই। পলক পড়ে ম্যানেজারের। আর তখনই জলদগম্ভীর স্বরে মালিক জিজ্ঞেস করেন,
‘ ফরিদ মাঝির কাছে পাওনা কত আমার?’
– সাড়ে আট লাখ।
‘তো? কি করছ এই ক’দিন। শুনতে পাই সে নাকি বলে বেড়ায়, টাকা না দিলে কি করতে পারব আমি দেখবে সে!’
– আমি কয়েকবার তাগাদায় গেছি স্যার। সে ধানাই পানাই কথা বলে, না হয় সময় চায়।
‘হুমম… শোনো, বাসেতরে গিয়া জানাও, ফরিদ মাঝির চর্বি বাইড়া গেছে। বেড়ির উপর আমার দেয়া ওর ঘরগুলি ভাইঙ্গা নদীতে ফালায়ে দেবে। মারধোর করবে না। কেবল বাম হাতটা ভাঙ্গবে। ভিক্ষা চাবার জন্য ডান হাতের দরকার পড়ে। বাম হাত বাড়ানো বেয়াদবির সামিল, জানো তো?’

মাথা নেড়ে সায় দেয় ম্যানেজার। ভয়ে তার কলজে শুকিয়ে আসে। কিছু টাকা তো ফরিদ মাঝির নাম দিয়ে সে নিজেই মেরে দিয়েছে। মাঝি যদি মাইরধোর খেয়ে আসল হিসাব নিয়ে বসে, তবে তার ও অবস্থা খারাপ। এই বয়সে মারধোর খেতে কেমন লাগবে কে জানে।

‘যাও, এখন সামছু মাঝিরে পাঠাও আমার কাছে।’
-জি আচ্ছা।

মালিকের সামনে থেকে একরকম পালিয়েই আসে ম্যানেজার। ঘেমে গোসল করে ফেলেছে যেন। তহবিল থেকে বের হয়। সামনে একটু এগিয়ে এক দেয়ালের পাশে দাঁড়ায়। জিপারের পুলার নিম্নগতি লাভ করে ওর। পকেটের দোমড়ান স্টার সিগ্রেটের প্যাকেট থেকে এক শলা বের করে। ঘামে ভেজা হাত নিয়ে ম্যাচের কাঠির দ্বিতীয় চেষ্টায় সিগ্রেটকে জ্বালাতে পারে সে। বুক ভর্তি ধোঁয়া টেনে ফুসফুস ডুবিয়ে দেয়। মুখ দিয়ে কিছু ধোঁয়া বের হয়। তলপেটের কাছে চিনচিনে ব্যাথা। এতক্ষণের আটকে থাকা টেনশন জলের সাথে মাটিতে মিশে যায়। মুখ দিয়ে আপনাতেই বের হয়, ‘কুত্তার বাচ্চা!’

সামছু মাঝির দাঁড়ি আছে। কপালে নামাজের জন্য সিজদার স্থানটিতে কালো দাগ। গোল হয়ে আছে। সবুজ রঙয়ের পাঞ্জাবি পড়েছে। সবুজ লুংগি। চেহারায় বেশ সাধু সাধু ভাব। প্রথম দেখাতেই ওনারা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে ফেললেন। দু’জন শক্তিমান পুরুষ!

‘তোমার নাম সামছু মাঝি?’
– জি হুজুর।
‘আমাকে হুজুর বলবা না। স্যার বলবা।’
-জি হুজুর.. স্যার।
‘আমার ছত্রিশ ইঞ্জিনের বোটের দায়িত্ব তোমারে দিতে চাই। তুমি কেমন মানুষ?’
-শক্ত মানুষ, স্যার।
‘হুমম, আমার ও শক্ত মানুষ দরকার। আমার নিয়ম কানুন জানা আছে?’
– জে, জানা আছে জে।
‘তারপর ও বলি। আমার থেকে দাদন নেবা। আমার মুদির সদাই দিয়া নাও ভরবা। কমিশনে মাছ আমার তহবিলে দেবা। পথে মাছ বেচবা না। চুরি করবা না। ধরা পড়লে চাকরি যাবে, অপমান হইবা।’
– জে, ম্যানেজার সব জানাইছে জে।
‘হুমম.. যাও, ঐ তাকের উপর কোরআন শরীফ রাখা আছে, নিয়া আস। ওটা ছুঁয়ে শপথ কর, যা বলছি এইগুলা মাইনা চলবা।’

সময় একটু যেন থমকে যায় তহবিলের এই রুমটাতে। ধরা যায় কি যায় না। সুক্ষ্ণ একটা ভাব খেলে যায় সামছু মাঝির শুশ্রুমন্ডিত নুরানী চেহারায়। সে হেঁটে গিয়ে তাকের উপর থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে আসে। মালিকের সামনে দাঁড়ায়। ছুঁয়ে বিড়বিড় করে শপথ করে। মালিক খুশী হয়। তৃপ্তিতে তার চোখ বুজে আসে। যদিও তিনি জানেন, এই দরবেশ ব্যাটাও চোর একটা। সে ও সুযোগ বুঝে চুরি করবে। তারপরও ব্যাটার নৈতিকতার উপর একটা চাপ থাকল।

সামছু মাঝি ধীর পায়ে তহবিল থেকে বের হয়। কিছুদূর নদীর পাড় ধরে হেঁটে চলে। বাতাসে তার দাঁড়ি উড়তে থাকে। নদীর জলে আলোর প্রতিফলন কয়েকটি শঙ্খচিলের চোখ ধাধিয়ে দেয়। মাছ শিকারে বেড়িয়েছে ওরা।

সামছু মাঝি গুলের ছোট্ট একটা কৌটা বের করে। অর্ধেক গুল আংগুলে নিয়ে ঠোঁটের নিচে যত্নে রেখে দেয়। কিনারাবিহীন নদীর মাঝ দিয়ে, কয়েকটি লবণের বার্জ দূরে কোথাও চলে যায়। তাকিয়ে দেখে আর ভাবে সামছু মাঝি। নিজের ভিতরের খুনি সত্ত্বাটি এরকম নির্জনেই বের হয়ে আসে। এই তো, ছ’মাস আগের কথা। তখন কাল্লু ব্যাপারির বোটের দায়িত্ব নিয়েছিল। গভীর সমুদ্রে আরেকটি বোটকে নিরস্ত্র পেয়ে হামলা করেছিল ওরা। ঐ বোটের মাঝিকে কোমরের উপর থেকে দু’খন্ড করে সাগরের মাছদের খাইয়েছিল।পরে ইলিশ মাছ এবং জাল যতটা পারা যায় নিয়ে, মাল্লাদেরকে বোটের বরফ রাখার কম্পার্টমেন্টে গাদাগাদি করে ঢুকায়। বাইরে থেকে কাঠের দরজা পেরেক মেরে আটকে দেয়। শেষে ট্রলার ফুটো করে ডুবিয়ে মারে সবাইকে।

এভাবে কয়েকবার এমন করেছে সে। সমুদ্রে যাবার সময় হাতিয়ার নিয়ে যায়। মালিক দিক বা না দিক। জানুক বা না জানুক। নিরস্ত্র গেলে আজ সে ও হয়ত মাছের খোরাক হত।

বড্ড নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর সাগরের মাঝিদের জীবন। পদে পদে মৃত্যুর হাতিছানি। তাই নিজে শিকার না হয়ে শিকারি হয়েছে সে।

আর তাকেই কি না পবিত্র গ্রন্থটি ছুঁইয়ে শপথ করায়? অনেকবার ভেবেছে সে, একা একা। কখনো যদি মালিককে সাথে নেয়া যেত সাগরে মাছ ধরার সময়! বরফের প্রকোষ্ঠে দম বন্ধ হয়ে, গভীর পানির নিচে তলিয়ে যেতে মালিকের কতটা সময় লাগে, দেখবার বড় ইচ্ছে তার। এই দাদনখোর বড় মানুষগুলি, তাদেরকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করছে। শুষে নিচ্ছে ছারপোকার মত। এদের জন্যই এক একজন সামছু মাঝির ভিতর থেকে কখনো কখনো বের হয়ে আসে, এক একজন জলদস্যু কিংবা একজন খুনি! উৎপাদনের সকল উপকরণের মালিক তারা-ই থাকে জনম ভর। জীবনের আনন্দের সকল উৎস মালিকদেরকে ঘিরে রাখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আর মাঝিদের ঘরে? বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা সেই একই অভাব-অভিযোগ, দু:খ-কষ্টের মহাসম্মেলন। দিনে দিনে এগুলো বাড়তেই থাকে ক্রমশ:। বিপরীতে বাড়ে মালিকের আনন্দের উপকরণ। গড়ে উঠে সম্পদের পাহাড়!

এজন্যই মালিকেরা কখনো সামছু মাঝিদের সাথে গভীর সমুদ্রে খুন হতে যেতে চান না। মেঘনার পাড়ে, সবুজ লুংগি পাঞ্জাবিতে আচ্ছাদিত একজন সামছু মাঝি, তার পরবর্তী খুনের দৃশ্যকল্প ভেবে উল্লসিত হয়। তবে সেখানেও কেন জানি, তহবিলের আরাম কেদারায় বসে থাকা ক্ষমতাবান মানুষটির চেহারা ভেসে আসতে চায় না। আবার নতুন করে ভাবা শুরু করে সে।

এভাবে দুই বিপরীত শ্রেণির ভিতর চলে আসা টানাপোড়ন, কোনো একদিন হয়ত তাদেরকে জায়গা বদল করাবে।
‘হয়ত’ – ভাবে সামছু মাঝি। কিন্তু সে জন্য অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না।

গুলমিশ্রিত এক দলা থুথু প্রচন্ড গতিতে এসে পড়ে অদূরে নোঙ্গর করা ছত্রিশ ইঞ্জিনের একটি মাছ ধরার ট্রলারের বডিতে। এটার মাঝি সে। সামছু মাঝি।।

★ছবি: Akm Azad

নীলার আপন আধার

FB_IMG_1484642276269
প্রায় দুপুর হয়ে গেলো । নীলা কিছুটা বিষণ্ণ বোধ করলো । হয়তো আসবে না। এতো বছর পর । নীলা কি ওকে চিনবে ? ছবিতে যেমন দেখায় সামনাসামনি তেমন হবে ? যদি এসে থাকে আর নীলা না চিনে থাকে ! কাউকে কি জিজ্ঞেস করা যায় ? ওদের কাছে ডিপার্টমেন্ট ভিত্তিক লিস্ট আছে । কে কে আসবে ।
নীলা টেবিল ছেড়ে দরজার সামনের ডেস্কটায় গিয়ে দাঁড়ালো ।
একটু নার্ভাস লাগছে ।
হাসলো ।
রিসেপশন এর দায়িত্বে কিছু স্কাউট আছে। স্কাউটরা বেশ আত্মবিশ্বাসী হয় । স্কাউট দের মধ্যে একজন স্বাভাবিক দৃপ্ততায় নীলার সামনে টেবিলের ঠিক ওপাশে হাসিমুখে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো , ” কিছু করতে পারি আপনার জন্য ?
নীলা মৃদু হাসলো ।
‘যারা আসবে তাঁদের নামের লিস্ট দেখতে পারি ?’
ছেলেটা মাথা খানিকটা নোয়ালো , ‘জ্বী , অবশ্যই … ‘
নীলা রেজিস্ট্রেশন করা নামগুলি পড়তে থাকলো ।

পরিচিত দুই একটা নাম পড়া হতেই একটা চেনা গালায় নিজের নাম শুনে ঘুরে দাঁড়ালো … নাম মনে আসছে না … হাসতে লাগলো নীলা … বান্ধবী হাসতে হাসতে এসে নীলার হাত ধরল , ‘ নীলা , আমি মিমি , মনে নাই একদমই ! কেমন আছিস? আমার সাথে আমার দুই বাচ্চা আছে । একজন অসুস্থ , আনি নাই । তোর ছেলেমেয়ে আসে নাই ? …’ প্রশ্নের স্রোতে ভাসতে ভাসতে নীলার মেমোরি মিমির ইতিহাস খুঁজে পেলো । উচ্ছ্বল হয়ে উঠলো দুজন । কথার ফাঁকে ফাঁকে নীলার চোখ অন্য সব বন্ধুদের মধ্যে শিহাবকে খুঁজতে থাকলো । ‘ সত্যিই আসেনি !’
মিমি নীলার চোখের দিকে খেয়াল করলো , ‘কাকে খুঁজিস?’
নীলার মুখ বন্ধ হয়ে কান লাল হয়ে গেলো । মিমি হেসে উঠলো।
‘ আয়’
নীলার হাত ধরে প্রায় টেনে নিয়ে গেলো স্টেজের পিছনে । মিলন , রেখা , শিহাব । নীলার রক্ত চলাচল ধীর হয়ে গেলো। হাসছিল তখনো । যার দিকে তাকিয়ে আছে তাকে দেখছে কিনা সন্দেহ । বাকিরা হাসছে তাও দেখছে না।

শিহাব স্বভাবসুলভ মৃদু স্বরে জানতে চাইলো ,’ ভালো আছো?’
নীলা ও প্রায় একই সাথে জিজ্ঞেস করলো ,’ কেমন আছো ‘
প্রায় থেমে থাকা সময় থেকে তাদের ভাবনার স্রোত বয়ে গেছে অনেক বছর আগের কোন সময়ে …
যে যার স্মৃতির ভিতর কোন অনুভূতিকে খুঁজতে খুঁজতে টুকিটাকি দু একটা কুশল বিনিময় হতে থাকলো ।
আর কোনো কথা খুঁজে পায় না ওরা… কি বলবে … কি বলা উচিত এই সময়গুলোতে?
লিখে ভাষা যত সহজে প্রকাশ করা যায়, সামনে এলে কেন যায় না?
দৃষ্টি কি অনেক বেশি কিছুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় মানুষকে ?
কি ভাবছে আধো আনমনা দুজন !

সারাটা দিন শিহাবের সাথে সাথে রইলো নীলা। আরো অনেক বন্ধু-বান্ধব থাকার পরেও শিহাবও নীলার সাথে সাথে। বন্ধুদের নীরব হাসি এবং কারো কারো স্পষ্ট অন্য ইঙ্গিত- কোনোটারই পরোয়া না করে দুজন সকলের ভিতর থেকেও একান্তে অনেকক্ষণ কাটালো।

সময়গুলো যেন সুপারসনিক জেটে করে চলে গেল।
এরকমই হয়। ভালো সময়গুলো থাকতেই চায় না… বেশীক্ষণ। দুঃসময় যেতে চায় না… যেন থাকে চীরকাল।
স্টেজে উঠে নীলা গাইলো-
‘রোদন ভরা এ বসন্ত…’ সখি কখনো বুঝিনি আমি আগে…’
শিহাবের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়… পুরনো স্মৃতিগুলো ওকে বড় বেশী এলোমেলো করে দিয়ে যায়। নস্টালজিক ভাবনায় বুদ হয়ে থাকে। বিএল কলেজের পিছন দিকের খেয়া ঘাটে একদিনের কথা মনে পড়ে। নৌকায় সে আর নীলা… পরিচিত মাঝি… ফুরফুরে বাতাস… নদীর জলের মন মাতাল করা গন্ধের সাথে ছলাৎ ছলাৎ ছল… বৈঠার একই তালে আওয়াজ … এসব কিছুকে ছাপিয়ে যায় নীলার কণ্ঠের রবীন্দ্র সঙ্গীত। নদী যেখানটায় এসে ভৈরব থেকে রূপসায় নাম নিয়েছে, সেখানে এসে একবার মনে হল নীলাকে মনের কথাটা বলেই দেয়। কিন্তু প্রকৃতি-নীলা আর ওর মাঝে এমন এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিলো যে, না বলা কথাটা আর বলাই হল না।

শিহাবকে কয়েকবার মাইকে ডাকা হল। কিন্তু ভাবনায় এমন বুদ হয়েছিল যে শুনলোই না। নীলা এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই চমকে তাকায়।
একটু লজ্জা ও পায়। সকলে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আরো একটু অবাক হয়।
আবারও মাইকে ওর নাম ভেসে আসে। কলেজ জীবনে সে খুব ভাল গান গাইতো। এখন আর চর্চা না থাকায় কোনো অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়ে উঠে না। জেসমিনের অনুরোধে বাচ্চাদের জন্মদিনে তাও একেবারে নিজস্ব মানুষদের সামনে সে গায়। আজ একটু লজ্জা এবং কেমন এক বিব্রত ভাব জাগা মন নিয়ে স্টেজে উঠে সে।

নীলার সারা তনুমন কেমন এক ভাললাগার আবেশে জড়িয়ে আছে… শিহাবের সাথে আজ সারাটা দিন থাকার ফলে এই ভাললাগা! আর এখন ওর গলার গান সেটাকে আরো গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। নীলার খুব প্রিয় একটা গান সে গাচ্ছে-
‘আবার এলো যে সন্ধ্যা… শুধু দুজনে’
নীলাও শিহাবের প্রিয় একটা গান ইচ্ছে করেই গেয়েছিল। ও কি সেটা বুঝেছে? তার প্রমাণ দিতেই কি নীলার পছন্দের গানটি গাইছে?

সব কিছুরই শেষ বলে একটা কিছু থাকে। কিন্তু শেষ হইয়াও হইলো না শেষ… এরকম অনুভুতিতে আচ্ছন্ন নীলা … কষ্ট পাচ্ছে… একটু পরেই শিহাবকে ছেড়ে যেতে হবে। ইকবাল আসবে ওকে তুলে নিতে। সকালে সে ই তো ওকে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে। দুজনেরই মিলনমেলায় আসার কথা ছিল। কিন্তু ইকবাল সোজা না করে দিয়েছে। তবে ওকে দিয়ে যাবার এবং নিয়ে যাবার ব্যাপারে মুখ গোমড়া করে রাজী হয়েছিল।

শিহাব এখন নীলার কাছেই আসছিল। এই মাত্র গান শেষ করে স্টেজ থেকে নেমেছে। বাদলের ডাকে একটু থামল। কিন্তু চোখ আর মন রয়ে গেছে নীলার দিকে। বাদলের মোবাইল নাম্বার নিয়ে হাল্কা দু’একটা কথা বলে দূরে একা বসে থাকা নীলার দিকে তাকায়।
নীলা!
ওর জীবনের এক সময়ের বহু আকাংক্ষিত এক নারী… একজন প্রেমিকা… একজন ছলনাময়ী… এমন এক ছলনাময়ী যাকে পাবার জন্য সমস্ত পৃথিবীটাকে লন্ড-ভণ্ড করে দিতে পারত! মনটা একই সাথে ভাল এবং খারাপ হয়ে গেল। মিশ্র একটা অনুভুতি নিয়ে নীলার সামনে দাঁড়ালো।
নীলা বসে থেকেই ওর দিকে তাকায়।
চোখে চোখে কথা হয়…
নীলার একটা হাত ধরতে ভীষণ ইচ্ছে হয় শিহাবের।
কত কাছে… এইতো পাশে… তবুও…

নীলা বুঝতে চেষ্টা করে শিহাবের মনে কি চলছে। একসময় ওর দিকে তাকালেই সে বুঝতো শিহাব কি চায়। টেলিপ্যাথি জাতীয় কিছু একটা পাওয়ার ছিল নীলার ভিতরে… ভালবাসার উদ্দাম সেই দিনগুলোতে।
কিন্তু শিহাবের সাথে ওর চরম বিশ্বাসঘাতকতা আজ ওর সেই পাওয়ার কেড়ে নিয়েছে। আজ ওর চোখে সে কেবলি এক বোবা ভাষা ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না।
ভালবাসা!
একটু ও কি নেই ঐ চোখে?
ওর জন্য…
কেন অতি পরিচিত সেই চোখ দুটিকে আজ গ্রানাইট পাথরের মত লাগছে? ভালবাসা সেখানে আজও রয়ে গেছে… তবে তা ভিন্ন কারো জন্য।
শিহাবের চোখে এখন শুধুই জেসমিন… বিরাজমান… এমনটাই মনে হল নীলার।

আরো আধা ঘন্টা একান্তে কাটায় ওরা দু’জন। নীলা ওর বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব ওকে জানায়। শিহাবও ওর এখনকার জীবনের টুকরো কিছু কিছু নীলাকে বলে। একসময় নীলার মোবাইল বেজে উঠে। ইকবালের ফোন। রিসিভ করে… বলে, ‘ আসছি’।

শিহাব নীলার মোবাইল নাম্বার সেভ করে নেয়। ওরটা নীলাকে দেয়। উঠে দাঁড়ায় মুখোমুখি।
নীলা জিজ্ঞেস করে,
: আবার কি দেখা হবে?
: হওয়া কি উচিত?
: তুমি বল!
: জানি না! সময় ই বলে দিবে…
: আসি তাহলে!?
কিছু বলে না শিহাব। কি বলবে এই কথার উত্তরে… যদি বলে যেও না , নীলা কি থেকে যাবে? আর নীলা থেকে গেলে সে কি ওকে রাখতে পারবে?
অনেক দিনের একটা ইচ্ছে এবং না বলা সেই কথাটি প্রায় মুখ দিয়ে বের হয়েই যাচ্ছিল… নীলার মুখের একটা পাশ আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল-
: কেন নীলা?…
যে কথাটি এতোদিন ধরে হৃদয়ে পাক খাচ্ছিল আজও সেটা পুরোপুরি ওকে বলতে পারলো না। কিন্তু নীলা ঠিকই বুঝে নিলো শিহাব কি বলতে চায়।

ইকবালের গাড়ীর হর্ণ বেজে উঠছে… সামনে দাঁড়িয়ে অটল পর্বতের মত শিহাব… নীলার একসময়ের ভালবাসা যাকে সে ইচ্ছে করে ছেড়ে গেছে…কি বলবে সে ওর প্রশ্নের উত্তরে? নিজেও কি সে জানে কেন সে ছেড়ে গেছে সেই সময় শিহাবকে!
একবুক ভালবাসা নতুন করে উথলে উঠে নীলাকে কাঁদিয়ে দিতে চাইছে… অনেক কষ্টে সেটা দমিয়ে একবারও শিহাবের দিকে না তাকিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলো। ইকবাল সেখানে অপেক্ষা করছে।

একটা অতীত বর্তমানে এসে শিহাবকে নস্টালজিক করে দিয়ে গেলো । ওরই সামনে দিয়ে সেই আগেরবারের মতো নীলা ইকবালের সাথে চলে যায়। অনেকক্ষণ শিহাব চেয়ে থাকল ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া ওদের গাড়ীর টেইললাইট এর দিকে… একসময় ঝাপসা হয়ে গেল সামনেটা…

নীলা ওর আনন্দের সেই একমাত্র জায়গা বারান্দায় বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে শিহাবকে ফোন করেছিল। দায়সারাভাবে উত্তর দিয়ে সে ফোন রেখে দিয়েছে। ওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও অ্যাক্সেপ্ট করে নাই। করলে এতক্ষণে করেই দিতো। একটা প্রচন্ড কষ্ট বুকের ভিতর থেকে উঠে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে আবার বুকের ভিতরেই ফিরে গেল।
একটু হাসল নীলা…
সেই বা কি অদ্ভুত ভাবে শিহাবের কাছে কিছু একটা চায়?
আজ যে কষ্ট সে অনুভব করছে এর সবটুকুই কি তার নিজের তৈরী নয়?
কেন তবে শিহাবকে দোষ দিবে?
নাহ! সে শিহাবকে দোষ দিচ্ছে না। সে কাউকেই এখন আর দোষী মনে করে না। সবাই ই যার যার জায়গায় ঠিক আছে।
একবার প্রিয় জায়গাটি ভালভাবে দেখে… বাইরের আকাশ এবং সেখানে থালার মতো চাঁদকেও মন ভরে দেখে নিলো। একটা সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে সে নিয়ে নিয়েছে… মুখে একটু মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।
ধীর পায়ে ইকবালের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
এই প্রথম মনে হয় অনেক বছর পরে ইকবালের রুমের দিকে আনন্দ নিয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে সে। নিজের ভূবনে… আপন আঁধারে। যেখানে এক চিলতে আলো ছিল এতোদিন। আশার জানালা দিয়ে আসতো সেই আলো। কিন্তু আজ তাও শেষ হয়ে গেছে।।