।। লোভ // মামুনের অণুগল্প ।।

কসাইয়ের দোকানটা মাছ বাজারের সাথেই। দুটি গোশতের দোকান পাশাপাশি। একই মালিকের। গরুর দুইটা রান ঝুলছে। এর বিপরীত দিকে রাস্তার ওপারে, এক বুড়ো কুকুর দুপায়ের উপর মাথা রেখে চুপচাপ হামাগুড়ি দিয়ে আছে। তবে দৃষ্টি গোশতের দিকে নিবদ্ধ। ওর হাত পাঁচেক তফাতে, এক পঙ্গু বৃদ্ধ ভিক্ষুক। সামনে ‘অ্যালুমিনিয়ামের’ পুরনো থালা নিয়ে বসে আছে। কিছু মলিন নোট আর খুচরা পয়সা দেখা যাচ্ছে।

একটা সাদা প্রাইভেট কার এসে রাস্তার পাশে থামে। মালিক মধ্যবয়ষ্ক। জুলফির কাছে কিছু শুভ্র কেশের উপস্থিতি তাকে কেমন আলাদা ভাবগাম্ভীর্যে ভারিক্কী করে তুলেছে। তিনি ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে মাছ বাজারে ইলিশ বিক্রেতার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। দরদাম করে মূল্য পরিশোধ করেন। এক হালি বড় সাইজের ইলিশ নিয়ে ওনার ড্রাইভার গাড়ির ‘বুটে’ রেখে দেয়। পঙ্গু ভিক্ষুকের নির্ণিমেষ দৃষ্টির সামনে মাছগুলি ‘বুটের’ ভেতর চালান হয়ে যায়। মুখটা লোভের লালায় ভরে উঠে ভিক্ষুকটির।

প্রাইভেট কারে বসে, ইলিশের ক্রেতা বিষয়টি লক্ষ্য করেন। পরক্ষণেই মানিব্যাগ থেকে দুটি বঙ্গবন্ধুর ছবিওয়ালা পাঁচ টাকার কয়েন, ভিক্ষুকের থালা লক্ষ্য করে ছুড়ে দেন। নির্ভুল লক্ষ্য!

ঝনঝন শব্দে সে দুটি থালায় গিয়ে পড়ে। এরকম গাড়িওয়ালাদের লক্ষ্য সবসময়েই নির্ভুল হয়। কয়েন দুটির যথাস্থানে পড়াতে, গাড়ির মালিকের চোখ দুটি আত্মতৃপ্তিতে বুজে আসে। তাকে নিয়ে সাদা গাড়িটি রাস্তার ধুলা উড়িয়ে সগর্বে চলে যায়।

ধুলার ভিতর আরো কিছু ধুলা মেখে বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি কুকুরটির দিকে চেয়ে থাকে। এই মাত্র গোশতের দোকান থেকে এক টুকরা বাতিল হাড্ডি কুকুরটির সামনে ছুড়ে দিয়েছে কসাই লোকটা। কুকুরটি মুহুর্তে সজাগ হয়ে কান খাড়া করে। এগিয়ে হাড্ডিটা মুখে নিয়ে নিজের আগের জায়গায় ফিরে আসে। এরই ভিতর একবার কসাইয়ের দিকে তাকায়। সেই চোখে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি। দেখে কসাই ও আত্মতৃপ্তিতে ভোগে।

বৃদ্ধ ভিক্ষুকের চোখে জিঘাংসা! না পাওয়ার ক্ষোভ। সেই অকৃতজ্ঞ দৃষ্টি নিয়ে সে কুকুরটির দিকে চেয়ে থাকে। কল্পনায় ওর এক হালি ইলিশ। এই মাছগুলি ওর মুখে যে লোভের লালা তৈরী করেছে, সেগুলি একত্রীত করে সে। অদৃশ্য সাদা প্রাইভেট কারটির মালিককে উদ্দেশ্য করে এক দলা থুথু নিক্ষেপ করে। যদিও একটু আগে, সেই মানুষটি তাকে দশটি টাকা দান করেছে! কিন্তু কল্পনায় ভাজা ইলিশের সুঘ্রাণ তাকে সেটা বিস্মৃত করায়।

ওদিকে শুকনা গোশত বিহীন একটা হাড্ডি মুখে নিয়ে কুকুরটি লেজ নাড়ে… আর কিছুক্ষণ পর পর কসাইয়ের দিকে কৃতজ্ঞ চোখে চেয়ে থাকে।।

#মামুনের_অণুগল্প

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

6 thoughts on “।। লোভ // মামুনের অণুগল্প ।।

  1. আমাদের বাস্তবতা শুধু নিজের সাথে নিজের নয়; আশেপাশের বাস্তবতাও যে নিজ জীবনের সাথেও মিল রেখে চলে সহজে তা বোঝা যায়। শুভ সকাল মি. মামুন।

  2. মামুন ভাইয়ের অণুগল্প গুলোন অনেক সুন্দর হয়। জীবনের কথোকথা। চেনা।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।