যখন লেখালেখির জগতে পা বাড়িয়েছিলাম, টানা লিখে যেতে পারতাম, নিচের গল্পটি সেই সময়ের। ছবির মানুষটিও আমি তখনকার।
_________________
‘ওই যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি,
তুমি কি তাদের মতো সত্য নও
হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি’ *
– গানের কলিগুলো ইথারে ভেসে আসা, পাতা ঝরার দিনের মৃদু নিরবতার বুকে জমে থাকা- শুকনো পাতাদের মর্মর ধ্বনির মতো ঘুমপাড়ানিয়া আবেশ যেন! শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন পালকের প্রচন্ড মধ্যাকর্ষণ টানকে উপেক্ষা করে,অসহ্য অলস গতিতে ভেসে বেড়ানোর অনুভূতিতে, একটু বেশীই প্রগলভ যেন আজ আমি!
নিজের ছায়াজীবনে এক রিক্ত প্রচ্ছায়া।
দিগন্তের ওপারে এক প্রচন্ড হাহাকার! নেই হয়ে যাবার অনুভূতি কখন শেষ হয়? আসলেই হয় কী? কিছু একটা আমাকে ঘিরে ধরে। বোধের আকাশ জুড়ে নি:সঙ্গ এক শংখচিল! নিরবতার শ্যেণ দৃষ্টির ধারালো ফলা, আমার অনুভূতির মগজে চরম কর্কশ-কেটে ছিড়ে ফালাফালা-পাপবিদ্ধ অনুভবের ইমেজ এনে দেয়।
মহাসাগরের গভীরতম এলাকার তীব্র সাইনাস পেইন কিংবা আগ্নেয়গিরির দীর্ঘ জ্বালামুখ দিয়ে পতন মুহুর্তের নেই হবার অনুভবে স্থবির হওয়া অথবা লাভায় গলে গলে ক্ষয়ে যাওয়া-এর থেকেও তীব্র কষ্টকর এক অনুভব ইদানিং আমাকে দগ্ধ করছে।
জীবনকণার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝিনুকের ভেতর মুক্তো থাকা সত্তেও কেবল অভিমান আর অবহেলায় সব উলুবনে ছড়িয়ে গেছে।
আমার কি সম্পর্কগুলোর আরো একটু বেশী যত্ন নেয়া প্রয়োজন ছিল? সময়ের পালক হয়ে থাকা পুরনো সম্পর্কেরা কি আবার আগের মতো কাছে থাকবে?নিঃশ্বাস দূরত্বে বিশ্বাসের অনুরণন বেজে ওঠা দূরত্বে। কাছে-দূরের অনুভূতির একটুও কি এখনো রয়ে গেছে, পলাতক সময়ের বুকে?
আকাশ যেখানে সবুজ ঘাসের ওড়না হতে দিগন্তে নেমেছে, সেখানে এক রংধনুর নিজের সাত রংয়ের আণবিক বিক্ষেপণ- আমার বোধের গভীর থেকে দুর্বোধ্য কিছু একটা বের করে আনে।
একা
একজন আমি।
অনুভূতির কারিগর। সূক্ষ্ণ ব্যবচ্ছেদকারী। ইচ্ছেমত ভাঙ্গি-গড়ি, বোধের সীমানা পেরিয়ে দুর্বোধ্য জগতে হারাতে চাই।
একজন অনুভূতির কারিগর। চেতনার নীলাকাশে নিঃসঙ্গ শংখচিলের বেদনাপ্লুত অনুভবে বিদীর্ণ হই। নিজের ভিতরে পারু হারানোর বেদনার তীব্রতায় অবাক হই, ক্ষয়ে যাই,গলে যাই। আবার জমাট বরফ হই পুনরায় গলে যাওয়ার জন্য।
নিঃশেষ হতে চাই।
কিন্তু পারি কি?
বিষন্ন বাতাসে বেলা শেষের অবেলায়, এক ছায়ামানব তার প্রচ্ছায়া থেকে বের হতে চায়। তার উদাত্ত আওয়াজ বেদনার সুদর্শণ পোকাদের সাথে নিয়ে ভেসে বেড়ায়-
‘ আমার চলার পথে কিংবা
বাড়ি ফেরার সময়, কয়েদী বহনকারী
নীল গাড়িটি আমি প্রায়ই দেখি। শিকের ওপারে
একচিলতে আকাশ ছুঁতে চাওয়া
অসহায় কতগুলো হাত।
নিঃস্ব কাব্যকলার এক বোবা ভাস্কর্য!
ইদানিং আরো এক জোড়া হাত
আয়তাকার শিকের উপর অসহায়,
নির্ণিমেষ চেয়ে চেয়ে
আকাশ ছুঁতে না পারার অক্ষমতায় স্থবির!
অতি পরিচিত সেই হাত।’
সেই হাত আমার। এক ছায়ামানবের।
বড় রাস্তাটি কিছুদূর পশ্চিমে গিয়ে ঠিক যেখানটায় ডানে মোড় নিয়েছে, আমি ওখানেই থাকি। একজন নবীন লেখক। নিজের মত করে নিজের অনুভূতির প্রকাশক। কিন্তু সেই সাথে আশেপাশের মানুষের অনুভূতি নিয়েও তাড়িত হই। একজন লেখকের হৃদয়ে এক অনুপম চিত্র অংকনের তাড়না কেন জানি আমার থেকেই যায়। বোধের মর্মে নাড়া দেয় এমন অনুভূতিতে প্রলুব্ধ হতে কে না চায়?
দুটো লোহার পাতের আয়তাকার ইন্টারফেসে দৃশ্যমান পাথরজীবন আঁধারেও প্রকট এক দানব যেন!
লেখালেখির জগতের একজন শিক্ষানবীশ আমি একজন লেখককে নিয়ে ভাবনার জগতে ডুব দেই। কেউ একজনকে দেখতে পাই। একজন শান্ত মানুষ কি মায়া নিয়েই না অশান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি সেই ধারালো পথ বেয়ে গভীর শান্ত জলের পরমশীতল অনুভূতিতে শান্ত হতে থাকি… একসময় কোমল হই… চেতনার আরো গভীরে ডুবে যাই। একটা অন্ধকার টানেলের ও মাথার দৃশ্যমান আলো , একসময় আমাকে নিজের সেলে ফিরিয়ে আনে।
একজন লেখককে কতগুলো ভূমিকায় নিজেকে দেখতে হয়? কতগুলো হৃদয় ব্যবচ্ছেদ করে অনুভূতির ‘ফাইন টিউনিং’ করতে হয়?
এই সময়ে একজন লেখক ডিজিটাল জকির ভূমিকা পালন করলে ভালো হবে। পাঠকের ভিতরে অনুভূতি ঠিক কতটুকু ওঠা নামা করবে, এই স্কেল অনুভবকারী দক্ষ এক অনুভূতির কারিগরের মত আচরণ করবেন একজন লেখক।
পাঠক হৃদয় নিয়ে লেখক ভাববেন, পাঠককে যে ভাবতে হবে- প্রথমে এটা শিখাবেন। ক্রমান্বয়ে ভাবের গভীর থেকে গভীরতর অংশে যাবার রাস্তাটিতে কিভাবে পথ চলতে হবে, তাও শিখাবেন। এভাবে উভয়পক্ষের মনোজগতে এক যোগাযোগ রয়ে যাবে। লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ ম্যাসেজগুলো পাঠকের মনোজগতে আলোড়ন তুলবে, তাকে ভাবাবে, ভাবনাগুলোকে ‘ইমপ্লিমেন্ট’ করাতে প্ররোচিত করবে। তবেই না ভালো কিছু একটা হবে। এদিক দিয়ে একজন লেখক, একজন ম্যাসেঞ্জারও বটে।
বাইরের পৃথিবী আঁধারের ঘোমটায় যেন আরো বেশী অন্ধকার দেখায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়াই আমি। ভাবনাদেরকে কয়েকমুহুর্তের জন্য হলেও নির্বাসনে পাঠাতে ইচ্ছে করছে।
“নির্বাসনে! চলে গেছে সব প্রজাপতি” …
ভাবনারা কি তাহলে সব প্রজাপতি! নিজের মনে হাসি। নিজেকে ব্যংগ করলাম কি? একজন লেখক কি নিজেকে কখনো ব্যংগ করেন?
চিন্তাজগতে একজন লেখককে বর্ণীল করায় ঠিক যেখানে রেখে এসেছিলাম, ওখান থেকেই একজন আল মামুন খান একাধারে একজন লেখক এবং একজন পাঠকের দুই ভিন্ন সত্তার অনুভূতিতে প্রবল হয়। একই হৃদয়ে দুই ভিন্ন হৃদয়। বোধের উপরে বোধ…ওপারে বোধ। এক দুর্বোধ্য জগত। আরাধ্য জগত?
একজন লেখকের জগত ঠিক কতোটা বড়? একজন লেখক কত বড়?
ঠিক কতোটা বড় হলে একজন লেখকের মৃত্যু হয়? এক রক্তাক্ত জনপদে নির্বাক পড়ে থাকা এক লেখক নিজের শেষ অণুগল্পটি লিখে যেতে না পারার বেদনায় কি নীল হন?
চিন্তা জগতের সরল রাস্তাটি ধরে একজন পাঠক আল মামুন খান একাই যেন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, এজন্য লেখক আল মামুন খান হাত ধরে রাস্তা পার করানোর নিমিত্ত হন। এইটুই দরকার পাঠকের। তবেই সে পথের শেষে যেতে পারবে। লেখকের আলোয় পথ চলে পাঠক এক পরিণত স্বত্বায় রুপ নেবে। পাঠক লেখকে পরিণত হবে। তিনি নতুন পাঠক কে হাত ধরে রাস্তা পার করাবেন… সে নতুন অন্যজনকে… … এভাবেই চেতনার পথগুলো সমৃদ্ধ হবে।
এমন যদি না হয়, তবে চেতনা উন্মেষের এই প্ল্যাটফর্মটি পাঠকমনে নিছকই এক দিবস উদযাপনের মত দায়সারা মনোভাবের জন্ম দিবে। মনের খোরাকই যেখানে নেই, সেই প্ল্যাটফর্মের লেখকেরা কালক্রমে সুবর্ণ অতীত হবেন…হারিয়ে যাবেন! ওখানের বাতাস- বিলুপ্তপ্রায় লেখকদের দীর্ঘশ্বাসে ভারী, গতিতে মন্থর, স্থবির হয়ে থাকবে!
এজন্য পাঠকের মনকে অনুভব করাতে হবে, তার মনের গোপন দরোজাগুলো এখন ধীরে ধীরে খুলে দেবার সময় এসে গেছে। জনপ্রিয়তার লোভের চেয়ে পাঠক প্রীতিতে লেখক হৃদয় পুর্ণ থাকবে। ভালোবাসা শিখাবেন- পাঠক হৃদয়কে এলোমেলো করবেন, কিভাবে ভালোবাসতে হয়-অনুভব করাবেন নিজের লেখনির সাবলিলতায়-পরম দক্ষতায়।
লেখকের মনোজগতের সিঁড়ি পাঠকের মূল লক্ষ্য। লেখক ওপারে শেষ ধাপে পাঠকের পথের শেষে সফল প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকবেন। একজন দক্ষ গাইডও একজন লেখক। নিজের মনোজগতে বিচরণকারী পাঠকের নিজেকে, সমাজের লক্ষ-কোটি ‘সিংগেল ইউনিট’ পাঠকের অন্যতম হয়ে সঠিক পথ চলতে হবে। এ যাত্রায় আঁধার কোনো প্রতিবন্ধকতারই সৃষ্টি করতে পারবে না। আঁধারে পথ চলার মত আলো পাঠক ইতোমধ্যেই অর্জন করেছেন।
আলো বিতরণকারী একজন লেখককে আলো হতে হয়। কঠিন সাধনায় নামতে হয়।
আলো হবার সাধনায় নেমে একজন আমি, এই মুহুর্তে নিজের সেলের একচিলতে ইন্টারফেসে আঁধারের পিছু ধাওয়া এক উল্কার পতন দেখতে থাকি।
নক্ষত্রগুলোর পতন কেমন? অনুভবে এক নক্ষত্রের পতনের নিম্নগতি, উপলব্ধিতে আল মামুন খানকে বিহ্বল করে তোলে।।
#আমার_আমি_মামুনের_অণুগল্প
* কবিগুরুর গানের লাইন
আকাশ যেখানে সবুজ ঘাসের ওড়না হতে দিগন্তে নেমেছে, সেখানে এক রংধনুর নিজের সাত রংয়ের আণবিক বিক্ষেপণ- আমার বোধের গভীর থেকে দুর্বোধ্য কিছু একটা বের করে আনে।
একা একজন আমি। অনুভূতির কারিগর। সূক্ষ্ণ ব্যবচ্ছেদকারী। ইচ্ছেমত ভাঙ্গি-গড়ি, বোধের সীমানা পেরিয়ে দুর্বোধ্য জগতে হারাতে চাই। ___ অসাধারণ।
মুগ্ধ হলাম কবি এবং প্রিয় গল্প দা।
আপনার লেখার ভীষণ ভক্ত আমি মামুন ভাই। কেন জানি সেইভাবে আপনাকে আর শব্দনীড়ে দেখা হয় না। ব্যাটে বলে ম্যাচও হয় না। কেমন আছেন ?
নিজের লেখায় আত্মসমালোচনা করতে গেলে প্রচুর সততা থাকতে হয়।
অভিনন্দন মহ. আল মামুন ভাই।
নিজের ছায়াজীবনে এক রিক্ত প্রচ্ছায়া।