মামুন এর সকল পোস্ট

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

ভালোবাসার পনেরশ সেকেন্ড

নারীকে আমি নারী হিসেবে দেখি না- মানুষ মনে করি। কিন্তু আমাদের সমাজে একজন নারীকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হয়? আমি পারিবারিক বন্ধনে সম্পর্কের বেড়াজালে আবদ্ধ নারীর কথা বলছি। কিন্তু যে সকল নারী সম্পর্কহীন সম্পর্কের মাঝে বন্দী? যাদের পরিবার নেই- বিভিন্ন বিশেষণে আমরা তাদের অভিহিত করি; তারা মানুষ তো দূরে থাকুক, নারী হিসেবেও কি এই সমাজ তাদের মেনে নেয়?

এমন এক নারীকে নিয়েই দুই পর্বের ছোটগল্পটির ১ম পর্ব আজ শেয়ার করছি:-
_____________________________

সিনেমা হলটি নবীনগর থেকে ঢাকা যেতে রাস্তার বামে পড়েছে।
‘সেনা অডিটোরিয়াম’। বিশাল ডিসপ্লেতে ছবির নাম আর অভিনেতা-অভিনেত্রীর বিশাল ছবি দেখা যাচ্ছে। ছবির নাম ‘চোরের রাণী’। আর ‘আসিতেছে’ শীর্ষক পোষ্টারে আছে ‘ ডেয়ারিং লাভার’।

সবে ছ’টার শো দেড় ঘন্টা মত শেষ হয়েছে। এখন সাড়ে সাত বাজে। শো শেষ হতে এখনো এক ঘন্টা বাকি। সিনেমা হলটির সাথেই একটি রেস্তোরা রয়েছে। একবার ভাবে সেখানে কি ঢু মেরে দেখবে নাকি? যদি কাউকে পাওয়া যায়। ভালবাসার অন্তত একজন মানুষ খুবই দরকার ওর।
ও হল…

কি পরিচয় দেবে নিজের? মানুষ বললেই হবে, না কি তাঁর বুকের সামনের স্ফীত অংশ দুটো থাকায় মেয়ে মানুষ বলবে? তাতেও তাঁর পরিচয় সম্পুর্ণ হবে না। তবে থাক। আচ্ছা নাম বলবে কি… নাম তো কতগুলোই হয়েছে ওর। কোনটা বলবে? রেখা, ময়না, কাজল নাকি শিরিন? নামের বড়াই করো নাকো নাম দিয়ে কি হয়, নামের মাঝে পাবে নাকো সবার পরিচয়।

চিকন লাল পাড়ের সাদা শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা ব্লাউজ। হাতের লাল চুড়ির সাথে ম্যাচ করা টিপ… ঠোট টি ও রক্ত লাল। হাঁটার সাথে সাথে চুড়ির ঝনঝন শব্দে পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। আকর্ষণ করার জন্যই তো এগুলো পড়া। তবে ওর কমনীয় মুখে জোড়া ভ্রু’র নীচে কাজল দেয়া কালো চোখ… সেখানে দর্শকের প্রতি যদি শুধু মাত্র মদির আহ্বানটুকু না থাকত- তবে এক পাশে ছেড়ে দেয়া এলো চুলে এখন ওকে যা লাগছে তা যে কোনো পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে যথেষ্ট।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে নবীনগর বাস-কাউন্টারগুলোর দিকে হেঁটে যেতে থাকে মেয়েটি। ওভার ব্রীজের আশেপাশে প্রায়ই ভালবাসার মানুষ পাওয়া যায়। যারা টাকা দিয়ে ওর কাছ থেকে ভালোবাসা কিনে নেয়।
হ্যা, সে একজন বারবনিতা!
লেখকদের বইয়ে মানুষভেদে ওদের নাম ও ভিন্ন হয়ে থাকে। সে পতিতা থেকে শুরু করে দেহপসারিনী, বেশ্যা, মক্ষীরানী ইত্যাদি নামে ভূষিত হয়। তবে ছেলে-ছোকড়ারা নিজেদের ভিতর কথা বলার সময় এমন একটি শব্দে ওকে সম্বোধন করে যে তখন নিজের কাছে খুবই খারাপ লাগে। জগতের সব চেয়ে মধুর শব্দটির সাথে আর একটি বর্ণ লাগিয়ে সেকি হৃদয়চেরা অনুভূতি এনে দেয় ওরা!

ওভারব্রীজের ফুটপাতের ফলের দোকানের সামনে দাঁড়াতে হল বেশ খানিকটা সময়। অনেকগুলো অনুসন্ধানী চোখ ওকে দেখে গেলো… ওর সারাটা দেহকে চাটলো মনে হল ওর কাছে। এখন এসব অভ্যেস হয়ে গেছে। তারপরও নিজের ভিতরে কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি… একটু রুচিবোধের লঙ্ঘন সে টের পায়।
রুচিবোধ! তাও ওর মতো মেয়ে মানুষের? তাঁর আবার লঙ্ঘন? প্রচন্ড হাসি পায় ওর। একটু শব্দ করে হেসেও ফেলে। পাশ দিয়ে যাওয়া দুজন যুবক ওর হাসির শব্দে ওর দিকে তাকায়। প্রথমে একটু চমকায়… ফিরে যায় এবং দ্বিতীয়বার আবার তাকায়… চিনে ফেলে।আসলে ওদেরকে সহজেই চিনে ফেলা যায়। প্রকৃতি-ই এই সহজে চিনিয়ে দেবার কাজটি করে থাকে। না হলে তো ওরা না খেয়ে মরে ভুত হতো এতোদিনে।ছেলেটি হেঁটে যেতে যেতে অন্যজনকে বলে, ‘ দ্যাখ, মাগি একা একা হাসে।’ অন্যজন এটা শুনে খিক খিক করে হাসে এবং ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ কি যাইবি নাকি?’ তাঁরা থামে না। এক সাথে আরো মজার কিছু একটা বলতে বলতে চলে যায়।

ইচ্ছে করলে একটা প্রচন্ড খারাপ ভাষায় ছেলে দুটোকে গালি দিতে পারত… তাতে হয়ত মনের ভিতরে সৃষ্ট রাগ…ক্ষোভের সাময়িক উপশম হতো। কিন্তু দিন-রাত ২৪ ঘন্টা হৃদয়ে যে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে… সে এবং তাঁর মত আরো অনেক মেয়ে; তাঁদের এটা তো নিত্যকার পাওনা। সমাজের কাছ থেকে পাওয়া উপহার। গিফট ফ্রম দ্য সিভিল সোসাইটি। না হলে তাদেরকে ২ নাম্বার বলে উল্লেখ করত না কেউ। তাঁরা তো সভ্য সমাজের চোখে এ দেশের দ্বিতীয় সারির নাগরিক। যাদেরকে রাখা হয়েছে ১ম সারির মানুষের বিশেষ করে পুরুষদেরকে মনোরঞ্জন করার জন্য।

আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। ফিরে যাবে নাকি ভাবে একবার। কিন্তু টাকাও তো প্রয়োজন। হাত একেবারে খালি। ঘাটে ঘাটে দিতে হবে অনেক টাকা। টাকার ক্ষাক্কষের মতো একটা জটিল সিস্টেম ধাপে ধাপে হা করে আছে ওর… ওদের দিকে। ওর এভাবে ওপেন ‘ভালবাসার মানুষ’ খোঁজায় টাকা পেলে কেউই বাঁধা দেবে না। নবীনগর থেকে সেই শ্রীপুর সিনেমা হলটি পর্যন্ত ওর এরিয়া। এই দু’টি সিনেমা হল এবং তাঁর আশে পাশে ওরা চিহ্নিত কয়েকজন সেবাদাসী রয়েছে।

আচ্ছা ওদেরকে হেরেমের বাসিন্দা বললে কেমন হয়? রাজা-বাদশাহরা তো শুনেছে এভাবে হেরেমে যুবতী মেয়েদেরকে ভোগ করার জন্য রেখে দেয়। সেখানেও কি ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয় ওনাদের? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, ইস! যদি কোনোভাবে হেরেমের বাসিন্দা হতে পারত!! পরক্ষণেই ভাবে, ‘আরে! আমার দেশটাই তো একটা প্রকান্ড হেরেম। যেখানে আমি ও একজন সেবাদাসী… তবে আমি স্বাধীন। আর মরুর ওরা পরাধীন।’

এক ভ্রাম্যমান পান-সিগ্রেটওয়ালার কাছ থেকে জর্দা দিয়ে একটা পান কিনে। এই লোকটাও ওকে চেনে। টুকটাক কথা-বার্তা বলে। একটা সিগ্রেট টানবে কিনা ওকে জিজ্ঞেস করলে কৃত্তিম চোখ পাকিয়ে ওকে ভয় দেখায়। সে-ও ভয় পাবার মিথ্যে অভিনয় করে। এই সামান্য সময়ে দু’জন ভিন্ন পেশার মানুষের ভিতরের এই খুনসুটি টুকু আসলেই সুপার্ব! কারন এ যেন সম্পর্কহীনতার মাঝে সম্পর্কের পায়ে পায়ে কাছে আসা। কতগুলো মুখোশধারী মানুষের ভিতরে মুখোশহীন চিরচেনা অবয়ব! সবাই তো ওর কাছে আসে দেহটাকে খুবলে ছিন্ন-ভিন্ন করবে বলে। সেদিক থেকে পান-বিড়ি ওয়ালা নিম্নশ্রেনীর পশুর মত কাছে আসলেও সেখানে মমতা রয়েছে… রয়েছে নিজেদের ভিতরে একই শ্রেনীবোধ।

জাতীয় স্মৃতিসৌধের মেইন গেটের সামনে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। ওর পাশ দিয়ে ছেলে-মেয়েরা একে অপরের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। কি সুন্দরই না লাগছে দেখতে! মেয়েটির খোঁপায় গোঁজা ফুল… ছেলেটির হাতে কয়েকটি ব্রেসলেট। কি স্বাভাবিক ভাবেই না কথা বলছে, একজন অপরজনের চোখে তাকিয়ে হাসছে… দু’একটা কি কথায় যেন মেয়েটি হেসে গড়িয়ে ছেলেটির গায়ে পড়ছে।

খুব সুন্দর একটি দৃশ্য! সে অপলক চেয়ে থাকে… ওর দৃষ্টির সামনে দিয়ে দু’জনের সুখী জুটিটি অদৃশ্য হয়ে যায়… অনেকদূর পর্যন্ত সে চেয়ে থাকে। স্মৃতির পর্দায় নবীনগর বিস্মৃত হয়! স্মৃতিসৌধ… ওভারব্রীজ…সেনা অডিটোরিয়াম সব কিছু এমনকি সে নিজেও হারিয়ে যায়। একটি গ্রাম দেখা দেয়… দুপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ নিয়ে ছোট্ট লম্বা একটি পায়ে চলা পথ! আকাশে কালো মেঘ! দু’পাশে বেনী করা চুল নিয়ে এক কিশোরির দ্রুত ছুটে চলা…এরপরের দৃশ্যগুলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসে… নিজের চোখের জল-ই যে এর জন্য দায়ী সেটা বুঝতে পারে না। সে যে এইমাত্র নিজেকেও বিস্মৃত হয়েছে!!

জাতীয় স্মৃতিসৌধের একেবারে প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে একজন বারবনিতা নিজের বিগত জীবনে ফিরে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাঁর চোখের জলে মুখের প্রসাধনী ধুয়ে মুছে যায়। সে পরিণত হয় এক সাধারন নারীতে। প্রতিটি বারবনিতা-ই তো প্রথমে একজন নারী। ধীরে ধীরে আমরা-ই তাঁকে পতিত এই সমাজে একজন পতিতা হয়ে উঠতে বাধ্য করি।

(দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য)

#ভালোবাসার_পনেরশ_সেকেন্ড_ছোটগল্প_অপেক্ষা_গল্পগ্রন্থ

ছবি: নেট থেকে কপি করা।

মামুনের অণুগল্পঃ হৃদয়ের জোছনায় বসে থাকা

251934_n

দাম্পত্য জীবনের অতি পরিচিত টুকটাক অণুমুহুর্তগুলো আসলেই অনেক দামী। অনেক আগে নিচের অণুগল্পটি লিখেছিলাম। এরপর অনেক সময় পার হয়েছে। আমিও বদলে গেছি- পেশা এবং বাহ্যিক অবয়বে। কিন্তু ভিতরের অনুভবক্ষম আমি তো সেই একই রয়েছি। যদিও এখনকার অনুভব আর আগের মতো লেখা হয় না। এখন লেখালেখি কেবলি পেশার কারণে। মফস্বল সাংবাদিকের আড়ালে আমি হারিয়ে গেছি।

আমার অনেক প্রিয় অণুগল্পটি আরও একবার শেয়ার করলাম..


‘নিজেকে নিজের মতো স্বার্থক করে নাও, সফলতার মাপকাঠি যেহেতু আপেক্ষিক তাই সবার ক্ষেত্রে সফলতা সম্ভব নয়। জীবনের গল্প সুখ-দুঃখের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এটাই তো জীবন।’

খুব প্রিয় এবং কাছের একজন মানুষ বলেছিলেন কথাগুলো। বাসায় এলে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলেই দুনিয়ার চিন্তা-ভাবনা মাথায় জুড়ে বসে শাহেদের। পাশের সোফায় এবং ডিভানে বসে হিন্দী সিরিয়ালে মগ্ন ওর পরিবারের অন্যরা।

ওর কাছের মানুষদের চিন্তাগুলো কি তাদের নিজ নিজ ভূবন গড়ে নেয়ায়, সেখানে শাহেদের অবাধ যাতায়াত নেই দেখেই বোধহয়, ডাইনিং টেবিলে বসলেই তাঁর নিজ চিন্তাগুলি ওকে সঙ্গ দেয়? বন্ধুর মত!
চিন্তাবন্ধু নাম দেয়া যায় কি একে?

একবার বউয়ের দিকে তাকায়। সে তখন টিভির পর্দায়। বড় মেয়ে মোবাইলে ব্যস্ত। তবে এর ভিতর দিয়ে পর্দার চরিত্রগুলিতে মনোনিবেশ, কি মা’র সাথে টুকরো আলাপ- সিরিয়াল সংক্রান্তই বেশীরভাগ। এরা এক একজন ‘সিরিয়াল বিশেষজ্ঞ’। মেয়ে যে আসলে মোবাইলে কি দেখে বা চালায়, শাহেদ আজকাল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।

ছোট ছেলেও ব্যস্ত। এরা দু’ভাইবোন সারাদিন ইংরেজি f আকৃতির মত ডিসপ্লের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকে। অফিস যাওয়া আসার পথে, এমন বাসভর্তি f দের চোখে পড়ে আজকাল শাহেদের।

ছেলে এখন গেমস খেলছে।
ওদের সবার একটা আলাদা জগত গড়ে উঠেছে। শাহেদের জগত কোনটা? সে তো এদেরকে নিয়েই এক জগতের সন্ধানে জীবন পার করছে। ওরা কি ভিন্ন জগতের বাসিন্দা? ওদের প্রবেশ পথে কি শাহেদের জন্য এমন সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকে ‘No Tresspassing’?

অফিস দিনের প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা খেয়ে ফেলে যাওয়া আসা মিলিয়ে। বাকিটুকুতে যা সময় দেয়া সবাইকে। হাতে থাকে বন্ধের দিন। ঘুমকাতুরে শাহেদ আবার বন্ধের দিনে ঘুমে কাটায় প্রায় দিনের অর্ধেক।

‘এই সাইনবোর্ডের দায় তোমার কি নেই একটু ও?’

নিরবে ভাতের দলা নাড়াচাড়া করছে দেখে টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মিলি জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো? রান্না ভাল হয়নি নাকি?

শাহেদ নিরুত্তর থেকে মাখানো ভাতের এক দলা মুখে দেয়। উত্তরের অপেক্ষায় থাকে মিলি। একটু কি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে সে? সিরিয়ালের ‘ক্রুশিয়াল মোমেন্ট’ চলে যাচ্ছে? ভ্রুর হাল্কা কুঁঞ্চন কেন তবে? অবশ্য আজকাল শাহেদ অনেক ভুলভাল দেখে। বকে এবং ভাবেও সেভাবে নিজের মনে।

এত ভুল কেন জীবনে? মস্তিষ্কের প্রশ্নের উত্তর দেয় না মন। মিলি কিছু জিজ্ঞেস করায় মন আর সে, দু’জনেই ওর দিকে ফিরে তাকায়,
– অফিসের হোটেলের রান্না খেয়ে খেয়ে এখন আমার রান্না ভাল লাগছে না আর?

ভাতের প্লেট একটু দূরে ঠেলে দেয় শাহেদ। বাউলে পানি ঢেলে হাত ধোয়। প্লাস্টিকের বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি পান করে। তৃষ্ণা মেটে?

এরপর মিলির দিকে তাকিয়ে বলে,
– সিরিয়ালগুলিতে আজকাল এসবও শিখাচ্ছে নাকি?
– মানে?

নাকের উপরটা গিরগিটির শরীরের মত লাল হয়ে উঠে মিলির। এক্ষুনি রেগে যাবে। শাহেদ সামাল দেয় এই বলে,
– তুমি ভাল করেই জানো যে তোমার রান্নার সামনে আর কেউ দাঁড়াতে পারে না আমার কাছে। তারপরও আউল ফাউল কথা কেন বলো?

আগের রঙ ফিরে পায় নাকটি। তবে ওখানেই সব শেষ হয় না। সিরিয়াল গুরুত্ব হারিয়েছে নারীর কাছে! সে এখন আবেগী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যখন মিলি জানায়,
– দেখলাম তো, কখনো তোমার খাবার হোটেল থেকে কিছু এনেছ আমাদের জন্য?

‘আমাদের জন্য’ শব্দ দুটি বলা কি ছেলেমেয়েদেরকেও নিজের দিকে টানার অপচেষ্টা?

তবে সে সফল হয়। ওর দুই বাচ্চার কান হরিণের মত। সবসময় খাড়া এবং সজাগ থাকে। তবে এদের সাথে হরিণের পার্থক্য এক জায়গায়, হরিণ যে কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ শব্দের উৎস খুঁজে বের করতে সজাগ হয়। ছেলে আর মেয়ে, তাদের বাবার বিপক্ষে যায় এমন সব কথায় f পজিশন থেকে I অবস্থানে চলে আসে।

এদিকে, দুই ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে আক্রমনে নামে মিলি,
– বৃহস্পতিবার দুপুরে খাও না তো, তরকারিটা আমাদের জন্য নিয়ে এলেও তো পারো? বিল তো দেয়াই লাগে।

এবার অসহ্য লাগে শাহেদের মিলির কথাবার্তাগুলো। মস্তিষ্ক বিপদ সংকেত দেয়। ক্রোধ বিপদজনক সীমার দিকে এগিয়ে চলেছে। শাহেদের ইচ্ছে করে মিলিকে এগুলি বলতে,
– তুই আর তোর মা হলি খয়রাতির জাত। জীবনে খাওয়া ছাড়া কিছু বুঝলি না?

বউয়ের মা’কে এক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়েই অহেতুক টেনে আনা হয়। যঅদিও ভদ্রমহিলারা বেশীরভাগ সময়েই আরোপিত অভিযোগের সাথে সামান্যটুকুরও সংশ্রব রাখেন না। তারপরও বউকে কথার আঘাতে তীব্রভাবে ঘায়েল করতেই ওনাদেরকে আনার লোভটুকু স্বামীরা কেন জানি সম্বরণ করতে পারে না।

কিন্তু মিলির দিকে তাকাতেই সব ভুলে যায় শাহেদ । নাকের নিচটা ঘেমে ভিজে আছে মিলির। তীক্ষ্ণ চোখে শাহেদকে দেখছে সে। ফ্যানের বাতাসে চুল উড়ছে তাঁর। অবাধ্য দু’একটা চুল চোখের উপর পড়েই সরে যাচ্ছে। ডান গালের তিল! এসব কিছু মিলিয়ে মিলিকে দেখে শাহেদের রাগ পড়ে যায়.. ধীরে ধীরে। সেই অদৃশ্য সাইনবোর্ডটির অস্তিত্ব এই মুহুর্তে আর অনুভব করে না সে একটুও!

মিলিও কি শাহেদের এখনকার পরিবর্তনটুকু লক্ষ্য করছে?
মিলিকে ধরে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে শাহেদের। আপনাতেই শাহেদের টোন চেঞ্জ হয়ে যায়, নিজেও টের পায়না কিভাবে কি বলছে সে,
– আসলে টানাটানির ভয়ে আনি না আমি। অন্য কিছু না।

মিলি অবাক হয়! লোকটা একটুও গালাগাল করলো না আজ! কিন্তু ক্রোধের শুরুটার সকল উপসর্গ শুরু হয়েছিল। দেখেছেও সে। আবার কেন জানি তীক্ষ্ণ রেখাগুলো সমান হয়ে মিলিয়েও যায়। ঐ দু’টি চোখে সেই প্রথম দিনের ভাললাগার চমক এই কিছুক্ষণ আগে দেখেছে সে। শাহেদের চোখে।
চোখ?
কোন চোখ?
একজন পুরুষের কতগুলি চোখ থাকে?

তবে শাহেদের চোখে তাকালে সেই প্রথম থেকেই নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবার ইচ্ছে হতো মিলির! আজ বহুদিন পর সেই ইচ্ছেটার জন্ম হচ্ছে দেখে মিলিও অবাক হয়। ওর পুড়ে যেতে ইচ্ছে করে!

‘নাহ! আমার মানুষটা আমাকে এখনো আগের মত ফিল করে! আমিও করি। ওকে আমার আরো সময় দেয়া দরকার।’
নিজের খোলস বদলে এক অতিপরিচিত মিলি উঠে দাঁড়ায়। শাহেদকে জিজ্ঞেস করে,
– চলো, হাঁটতে বের হই। তুমিই তো বলো সবসময়- after dinner walk half a mile, কি? বলো না?

মেয়ে এবং ছেলের অবাক চাহনির সামনে শাহেদ দাঁড়িয়ে মিলির প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– হ্যা 🙂 বলেছি অনেকবার আমি। চলো, বের হই।

রাতের প্রথম প্রহরে নির্জন পিচ ঢালা পথে, এক জোড়া নব-দম্পতি হাত ধরে হেঁটে চলে। কিছুক্ষণ আগে ওদের খোলস বদল হয়েছে। হৃদয়ের পলেস্তারা খসে খসে- হৃদয়গুলো নতুন হৃদয়ে পরিণত হয়।

হৃদয়ের পুনর্গঠন!
পুনর্জনম বললে ভুল হবে কি?

অণুগল্প-৫৫৩ // কে এই কাশেম??

90

প্রচন্ড বৃষ্টি। আপাদমস্তক রেইনকোটে আবৃত শিহাব। বাইক নিয়ে একটা মার্কেটের সামনে আরো কয়েকজন বাইক রাইডারদের সাথে ভিজছে। বাধ্য হয়েই সবাইকে ভিজতে হচ্ছে। মার্কেটের ভিতরে এত পরিমান মানুষ, আর কেউ ঢুকতে পারছে না। বাতাসের বেগও অনেক, তাই সামনে না এগিয়ে বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় খোলা আকাশের নিচে ভিজতে থাকে শিহাব।

একটা সিগারেট টানতে পারলে ভালো লাগতো। ভাবতেই বড্ড ‘ধুমপানের তেষ্টা’ জাগলেও নীরব থাকে সে। মফস্বল সাংবাদিকদের কখনো কখনো নীরব থাকতে হয়।

দ্রুত বেগে একটা সিএনজি অটোরিকশা রাস্তার জমা জল ছিটিয়ে শিহাবকে পাশ কাটায়। ভিজিয়ে দেয় শিহাবকে। কিছু ছিটা চোখে পড়ে, জ্বলে উঠে বাম পাশের চোখ। আপনাতেই অশ্রাব্য একটা গালি এসে যায়। কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দে পরিণত হবার আগেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে।

মফস্বল সাংবাদিকেরা একটু মন খুলে, ইচ্ছামত কাউকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিও দিতে পারে না। প্রকাশ্যে তো নয়ই। সবসময় একটা নিয়ন্ত্রণের ভিতরে থাকতে হয় তাদেরকে।

শিহাব যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার ঠিক ওপাশেই সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। সেদিকে চোখ যায় শিহাবের। কেন জানি কাশেমের কথা মনে পড়ে। এই অফিসের পিওন। তবে পিওন হলেও খুব ক্ষমতাশালী। মূলত অফিসটির সার্বিক কার্যক্রম সে-ই আসলে নিয়ন্ত্রণ করে। কয়েকটা বাড়ির মালিক এবং নামে বেনামে ওর আরও অনেক সম্পত্তির কথা শুনেছে শিহাব।

কাশেমের এই অবৈধ প্রভাবের জন্য এই এলাকা এবং পাশের এলাকার মফস্বল সাংবাদিকদের কি কোনো ভূমিকা নেই? এরা প্রায় প্রতিদিন কিংবা যখন ইচ্ছা হলো অথবা কেউ কেউ মাসের নির্দিষ্ট কোনো দিনে কাশেমের সাথে ‘চা পান’ করতে আসে। চলে বন্ধুত্বপূর্ণ গল্পগুজব, চায়ের সাথে সিগারেট আর যাবার সময় খাম। এই তিন এর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটা ‘সাইক্লিক অর্ডার’। তা থেকে মফস্বল সাংবাদিকেরা কেনো জানি আর সহজে বের-ই হতে পারেন না।

জমির শ্রেণি পরিবর্তন সহ নানারকম অবৈধ কাজে আসে প্রচুর অবৈধ টাকা। এই টাকা দিয়েই সিস্টেমের ভিতরে থেকে কাশেমরা নিজেদের জন্য এক আলাদা রাজত্ব তৈরী করে। সবাইকে ম্যানেজ করেই অবশ্য। মফস্বলে আবার সবাই কেনো জানি দ্রুত ম্যানেজ ও হতে পছন্দ করেন।

তবে কি কোনো সাংবাদিক এই কাশেমদের বিরুদ্ধে লেখেন না? সিস্টেমের এই অনিয়ম তুলে ধরেন না তাদের প্রতিবেদনে?

এরকম প্রশ্নে একটু বিব্রত হয় শিহাব। নিজের ভিতরের শিহাব আর মফস্বল সাংবাদিক শিহাবের ভিতরে চলে ক্ষণিকের টানাপোড়েন। শেষে ভিতরের শিহাবই উত্তর দেয় মফস্বল সাংবাদিকের পক্ষ হয়ে,

– হ্যা, নিউজ হয়তো। কেউ কেউ করে। এরা হলো যারা বছর ধরে প্রতিমাসে কাশেমের থেকে খাম নেয়। এভাবে জানুয়ারী থেকে অক্টোবর পর্যন্ত লাগাতার খাম গ্রহন শেষে, কোনো কারণে যদি নভেম্বর মাসে কাঙ্খিত খাম দেয়া বন্ধ করে কাশেম..

ঠিক এর পরের দিনই পত্রিকায় বক্স করে বিশাল নিউজ! শিরোনাম?

” সাবরেজিষ্ট্রি অফিসে সর্বময় ক্ষমতাধর কে এই কাশেম??”

বাইনচোত!! কে এই কাশেম?
এখন কাশেমকে আর চেনো না? মুফতে চা-সিগারেট খাওয়া আর মাসে মাসে খাম নেবার সময়তো কাশেমই ছিলো ধ্যান-জ্ঞান। এখন আর চেনো না?

ভিতরের শিহাবের গালিতে কিছুটা ম্রিয়মান হলেও নিজেকে সামলে নেয় মফস্বল সাংবাদিক শিহাব। কারণ ভিতরের দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিক শিহাবেরই জিত হবে। সবসময় ভিতরের মানুষটার কথামতো চলে মফস্বল সাংবাদিকতা করা যায়না।

#মামুনের_অণুগল্প_৫৫৩

শৃঙ্খলিত বাংলাদেশ!

5399592567

আমার চলার পথে কিংবা
বাড়ি ফেরার সময়, কয়েদী বহনকারী
নীল গাড়িটি আমি প্রায়ই দেখি। শিকের ওপারে
একচিলতে আকাশ ছুঁতে চাওয়া
অসহায় কতগুলো হাত, যেন
নিঃস্ব কাব্যকলার এক বোবা ভাস্কর্য!

আজ আরো একজোড়া হাত দেখলাম
আয়তাকার শিকের ওপারে অসহায়
নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা সেই হাত
আকাশ ছুঁতে না পারার অক্ষমতায় স্থবির
অতি পরিচিত ওই হাত জাতির বিবেকের!

শিকের ঘেরাটোপে রোজিনা ইসলাম
মুক্ত স্বদেশে বন্দী বিবেক, যেন শৃঙ্খলিত
একচিলতে বাংলাদেশ!
শিকের ওপারে থেকে যার হাত, আকাশ ছুঁতে চেয়ে
নিঃশব্দে লিখে চলে, আকাশ ছুঁতে না পারার
স্বপ্নভঙ্গের গোপন ইতিহাস!

অপেক্ষায় আছি..
কয়েদী বহনকারী নীল গাড়িটি আমাকে পাশ কাটাবে
শিকের ওপাশে তখন নেই ‘শৃঙ্খলিত বাংলাদেশ!’

#মামুনের_কবিতা_শৃঙ্খলিত_বাংলাদেশ

কবিতাঃ এখন দুঃসময়

inb43764

আঁধারের বুক চিরে ধুমকেতু হবে বলে জন্ম যার
স্বেচ্ছায় শৃংখলিত সেই গণমাধ্যম
বেঁচে আছে এক নিষিদ্ধ নগরীতে।

নতুন দিনের সূচনা সংগীতের কম্পমান লহরী হতে জন্ম যার
নতজানু হয়ে সেই গণমাধ্যম
জেগে থাকে এক ধর্ষিত পরবাসে।

মুক্ত স্বদেশে এখন দুঃসময়!
সাংবাদিকের এক একটি অক্ষর
বলপয়েন্টের প্রসবপথ থেকে বের হতেও ভয় পায়।

এখন লিখতে গেলেই
কে যেন ডেকে বলে, ‘ঠিক লিখছ তো?’
ঠিক বেঠিকের গোলকধাঁধায় অস্থির এই সময়!

সাংবাদিকতা এখন আর সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপায় না
দুঃস্বপ্নে আঁতকে উঠে সাংবাদিক নিজেই খুঁজে ফেরেন
শৃংখলিত এক একটি ব্ল্যাকহোল!

কামরুজ্জামান থেকে মুজাক্কিরের রক্তাক্ত লাশ মাড়িয়ে
কোটি টাকার প্রণোদনার প্রহ্লাদ নৃত্যে উদ্বেলিত যখন সাংবাদিক নেতারা
রোজিনা ইসলাম! তোমার কলম দিয়ে কি লিখতে চাও?

এখন লিখতে গেলেই থামতে হবে
ভাবতে হবে, চাটতে হবে
এখন দুঃসময়!

সুসময়গুলো গণমাধ্যমকে একলা রেখে
বারান্দার চড়ুইগুলোর মত পালিয়েছে
চড়ুইদের ফিরে আসার গল্প লিখো আগে।

দুঃস্বপ্নের এই শহরের প্রতিটি সন্ধ্যা এখন
বিবর্ণ, বিষণ্ন, বিরক্ত আর
বিবশ অনুভবে রিক্ত!

রাতের আঁধার থেকে আরও অন্ধকার চুরি করে
জীবিত হাজারো লাশদের ভিড়ে
নিজের হৃদস্পন্দন শুনবে তুমি অবাহ্নিত এই নগরে।

বিষণ্ন সন্ধ্যাগুলো অবহেলায় গড়িয়ে দিয়ে
এই স্বৈরিণী জনপদে বাস করবে তুমি
এক বোবা শয়তান হয়ে।

নিষিদ্ধ এই নগরীতে লিখতে গেলেই থামতে হবে
ভাবতে হবে, চাটতে হবে
এখন দুঃসময়!

#মামুনের_কবিতা_এখন_দুঃসময়

মামুনের অণুগল্প: রাজ ভিক্ষুক

608620

২৮ রমজান। ভোর সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বের হয় শিহাব। সেহরি খেয়ে মাত্র দু’ঘন্টা ঘুমুতে পেরেছে। ঠিক ছ’টায় সহকর্মীর ফোন,
– ভাই, চেয়ারম্যান এর বাসায় সাতটায় যাবার কথা না? বের হলাম আমি।

ঘুম জড়ানো কন্ঠে ‘আচ্ছা’ বলেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে শিহাব। কিন্তু দশ মিনিট যেতেই আরেক সহকর্মীর ফোন। অগত্যা উঠতেই হয়। দ্রুত রেডি হয়ে বেরও হয়।

তিনজন মফস্বল সাংবাদিক যখন ঘুম জড়ানো চোখে মহাসড়ক ধরে বাইক নিয়ে তুমুল বেগে ছুটছে, ঘড়ির কাটায় সময় তখন ছ’টা পঞ্চাশ।

স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান এর বাসার সামনে তিনজনের বাইক এসে থামে। ইতোমধ্যে সাতটা দশ পার হয়েছে। চেয়ারম্যান এর বাড়ির সদর দরোজা বন্ধ। দরজার সামনে কিছু ‘জেনারেল ভিক্ষুক’ অপেক্ষা করছে। ঈদ উপলক্ষে তাদের চেয়ারম্যানের থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য নিতে এরা অপেক্ষা করছে সেই ভোরবেলা থেকে।

গেটের দারোয়ানকে তাদের আগমনের কারণ জানায় শিহাব। উত্তরে দারোয়ান জানায় চেয়ারম্যান ঘুম থেকে ন’টায় উঠবেন। এখন গেট খোলা যাবে না। নিজেদের ‘সাংবাদিক’ পরিচয় দেবার পরও গেটম্যান জানায় তার কিছু করার নেই।

অপেক্ষমান বাকি দুই সহকর্মীর কাছে এসে একটু রাগ হয় শিহাব। নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতে জানায়,
– কামালের কথা শুনে এই ভোরবেলায় আসলাম। এখন নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে?

যে সহকর্মী ফোন দিয়ে শিহাবের ঘুম ভাঙ্গিয়েছিলো, বিব্রত কন্ঠে সে উত্তর দেয়,
– সাতটার পরে নাকি চেয়ারম্যানকে আর বাড়িতে পাওয়া যাবেনা, কামালই তো বললে আসতে।

‘ঘোৎ’ জাতীয় শব্দ এবং আরও কয়েকটি ‘চো’ মিশ্রিত শব্দ মিলিয়ে নিজের রাগ প্রকাশ করে শিহাব। এদিক ওদিক তাকায়। রোদ বেড়ে গেছে। ছায়া আছে এমন জায়গার খোঁজ করে সে। প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। বসার কোনো জায়গাই নেই। সদর দরজার শেডে কিছু ছায়া আছে, সেখানে ভিক্ষুকদের সারিবদ্ধ অবস্থান। ওখানে অপেক্ষা করার প্রশ্নই আসেনা।

ইউপি চেয়ারম্যান এর বাড়ির চারপাশে সিসি ক্যামেরা। সেদিক তাকিয়ে সামনের দিকে হেঁটে চলে শিহাব। ওর পিছু নেয় বাকি দুই সহকর্মী। বাড়ি পার হলে একটা মুদির দোকান। বন্ধ। সামনে দুইটা বেঞ্চ পাতা। সহকর্মী দু’জন বাইক নিয়ে সেখানে ‘স্ট্যান্ড’ করায়। শিহাব আগেই বেঞ্চে বসে গেছে। ঘুমে চোখ জ্বালা করছে তার।

জ্বলছে বুকের ভেতরেও। সামান্য ক’টা টাকার জন্য এত ভোরে এসে এখন কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। চাইলে দারোয়ান বিশাল বাড়ির ভিতরের ‘ওয়েটিং রুমে ‘ ওদের বসাতে পারতো। সেটা না করাতেই অপমানের তীক্ষ্ণ খোঁচা অনুভব করে শিহাব। মোবাইল বের করে চেয়ারম্যান এর নাম্বারে কল করে। মোবাইল ‘সুইচড অফ’।

বাকি দুই সহকর্মী নিজেদের মোবাইলে মগ্ন। মাথা নিচু করে f আকৃতি নিয়ে ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। মুদি দোকানের বেঞ্চে বসে অদূরে অপেক্ষমান ভিক্ষুকদের সারির দিকে তাকিয়ে থাকে শিহাব। ওদের তাড়া নেই। ওদের নিস্প্রভ চোখে হয়তো ঘুম না হওয়ায় জ্বালা ধরানো অনুভবও নেই। নেই হয়তো বুকের ভিতরে ‘অপমানের তীক্ষ্ণ খোঁচা। ওরা এভাবেই অপেক্ষা করতে অভ্যস্ত। ওরা ভিক্ষুক।

‘তুমি কি? ওরা যদি ভিক্ষুক হয়, তাহলে তুমিও তো ভিক্ষুক!’

নিজের মনের এই মন্তব্যে মৃদু হেসে মনকে শিহাব জানায়,
– না, আমি ‘রাজ ভিক্ষুক’।

আমাদের দেশে ঈদ এলেই মফস্বল সাংবাদিকেরা ভিক্ষুকে পরিণত হয়। ঈদকে সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং জনপ্রতিনিধিদের থেকে ‘ঈদ সালামি’ গ্রহনের হিড়িক পড়ে যায়। যে যেভাবে পারে ‘ঈদ শুভেচ্ছা’ প্রদানের ছদ্মবেশে আসলে থাকে নগদ টাকা সংগ্রহের প্রচেষ্টা। এটা এখনকার মফস্বল সাংবাদিকতার এক ‘ট্রেন্ড’ এ পরিণত হয়েছে। এছাড়া আর করারই বা কী রয়েছে? সব মফস্বল সাংবাদিকেরা তো তাদের ‘হাউস’ থেকে বেতন পান না। নিজের টাকার তেল পুড়িয়ে সারা বছর সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে তারা। তাদের সংসার কীভাবে চলে? কিংবা ঈদ সহ অন্যান্য পার্বনে মফস্বল সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আনন্দ কীভাবে উদযাপন করে তারা? এই খবর যেমন তাদের কর্মস্থলের মালিক সম্পাদকগণও নেন না, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও সেসবের খোঁজ নেবার কোনো প্রয়োজন মনে করেন না। এক একসময় শিহাবের মনে হয়, ‘আদৌ মফস্বল সাংবাদিকেরা’ মানুষ কিনা?’

ঠিক পৌণে ন’টায় ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে শোরগোল শুনে সেদিকে আগায় শিহাব। এর ভিতরে মুদি দোকানদার এসে তার দোকান খুলেছে। দোকানের চারপাশে কাপড়ের পর্দা টানিয়ে দিয়েছে। এটা মুদি দোকান হলেও এখানে চা বিক্রী হয়। পর্দার আড়ালে ইতোমধ্যে কয়েকজন এসে চা ও সিগারেট পান করেছে শিহাবদের পাশে বসে। পর্দার ভিতরে থেকে তারা রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করেছে।

হট্টগোলের জায়গায় এসে শিহাব দেখে, একজনকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে অনেক নারী-পুরুষ লাগাতার চেচামেচি করে যাচ্ছে। বিশাল ভুঁড়িওয়ালা একজনের হাতে লাঠি। সে বেঁধে রাখা লোকটিকে মারতে গিয়েও মারছেনা। কেবল ভয় দেখাচ্ছে। এই লোক নাকি রিক্সা চুরি করেছিলো। আজ তাকে হাতেনাতে ধরতে পেরে এই বিচারের আয়োজন।

শোরগোল শুনে নিজের বাড়ির দো’তলার বারান্দায় আসেন ইউপি চেয়ারম্যান। কি হয়েছে জানতে চান। রিক্সা চোর ধরা পড়েছে শুনেই আগ্রহ হারান তিনি। তাঁর কাছে হয়তো এটা কোনো চুরিই না। আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই তো অনেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চাউল, গম এবং সর্বশেষ করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ চুরির অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজনকে তো এই অভিযোগে শাস্তিও দেয়া হয়েছে।

চেয়ারম্যানকে দেখে সদর দরজার সামনে গিয়ে উপরে তাকিয়ে তাকে সালাম দেয় শিহাব। মাস্কে ঢাকা নিজের চেহারা দেখায় মাস্ক থুতনিতে নামিয়ে দিয়ে। সালামের উত্তর দিয়ে চেয়ারম্যান অন্দরমহলে প্রবেশ করেন। দুই সহকর্মীকে নিয়ে শিহাব দারোয়ানের সাথে আবার কথা বলে এবং ভিতরে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু দারোয়ান এবারও তার অনীহা প্রকাশ করে। সে জানায় চেয়ারম্যান যতক্ষণ নিচে না নামবেন ততক্ষণ এই গেট খোলা হবেনা।

এবারও বিড়বিড় করে শিহাব মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে সদর দরজা থেকে সরে আসে। তবে এবার ‘চো’ শব্দের পরিবর্তে শিহাব ‘মা’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে।

সাড়ে ন’টার সময় দুইটা মটরবাইক গেটের সামনে আসে। এদের দেখেই দারোয়ান দরজা খুলে দেয়। এরা চেয়ারম্যান এর খাস লোক। এদেরকে সাধারণত ‘ভাইলোক’ বলা হয়। এই ‘ভাইলোক’দের একজন শিহাবের পরিচিত। মফস্বল সাংবাদিকদের সাথে ইউপি চেয়ারম্যানদের ‘টক-ঝাল-মিষ্টি’ জাতীয় সম্পর্ক। যদিও সাংবাদিকের কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে নেই, তারপরও অনেক সাংবাদিকই কোনো না কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। তবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং জনপ্রতিনিধিদের কুকর্ম কিংবা কোনো ‘ফাঁক’ খুঁজে পেলে, সেখানে ‘ভরে দেবার লোভ’ অধিকাংশ সাংবাদিকেরাই সম্বরণ করতে পারেন না। আর এইসব ক্ষেত্রে ইউপি চেয়ারম্যানদের রক্ষা করতে সাংবাদিক ও ইউপি চেয়ারম্যানের মাঝে ‘মিডল ম্যান’ হিসেবে কাজ করেন এসব ‘ভাইলোক’।

পরিচিত সেই ‘ভাইলোক’ এর কল্যাণে শিহাবরা চেয়ারম্যান এর বাড়ির একতলার ‘ওয়াটিং রুমে’ বসার সুজোগ পায়। ঘড়ির কাটা তখন কাটায় কাটায় সকাল দশটার ঘরে।

ওয়েটিং রুমে বেশ বড় সোফাটায় শরীর এলিয়ে বসে পড়ে শিহাব। বাকি দু’জনও ওকে অনুসরণ করে। ভিতরে আরো অনেক লোক দেখতে পায় শিহাব। এরা কখন যেন ভিতরে প্রবেশ করেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ভিক্ষুকদের দল আরো অনেক বড় হয়েছে। ভিতরে এবং বাহিরে উভয় ‘ভিক্ষুক’ দলই চেয়ারম্যানের অপেক্ষায়।

সাড়ে দশটায় তিনি উপরমহল থেকে নেমে এলেন। ওয়েটিং রুমের সাথেই তার অফিস রুম। সেখানে ঢুকে যান তিনি। যাবার আগে শিহাবদের দেখে হাত দিয়ে বসার ইশারা করেন। তার পিছনে ‘ভাইলোক’রা অফিসে প্রবেশ করে দরোজা বন্ধ করে দেয়।

এভাবে অপেক্ষার প্রহর বাড়তেই থাকে। এর ভিতরে RAB এর ভেস্ট পরা এক কনস্টেবল পিছনে ব্যাগ হাতে এক ‘মুন্সি’কে নিয়ে চেয়ারম্যান এর অফিস দরোজায় নক করেন। দরজা খুলে যায়। ওনারা দু’জন প্রবেশ করতেই সব ‘ভাইলোক’রা বের হয়ে আসে। শিহাবদের সামনে প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে সেখানে বসে গল্পে মেতে ওঠে তারা।

একটু পরে স্থানীয় থানার গাড়ি এসে থামে চেয়ারম্যান এর সদর দরোজায়। এক এস আই সাথে একজন কনস্টেবলকে নিয়ে অফিস রুমে প্রবেশ করে। দরোজা বন্ধ হয়।

এরপর ঘড়ির কাটা ঘুরতে থাকে। RAB এবং পুলিশ সদস্যগণও বের হন না। শিহাবদেরও ভিতরে প্রবেশ করা হয়না। সোয়া এগারোটার সময় চেয়ারম্যান একা বের হন। শিহাব এবার এগিয়ে গিয়ে চেয়ারম্যানকে সালাম দেয়। চেয়ারম্যান বলেন,
– একটু বসেন ভাই। পুলিশ বিদায় করে আপনাদের ডাকতেছি।
একথা বলেই অফিস রুমের বাইরের বাথরুমে ঢুকে যান চেয়ারম্যান।

আবার সোফায় শরীর এলিয়ে দেয়া। শিহাবের ভ্রুর কুঞ্চন আরো গভীর হয়। সাথের এক সহকর্মী জানায়,
– বাথরুমে কয় ঘন্টা লাগায় এবার কে জানে?
– আরে, নোট আলাদা করতে গেছে টয়লেটে। আলাদা আলাদা খামে ভরতে যতক্ষণ। বেশীক্ষণ লাগবেনা।
দ্বিতীয় সহকর্মী উত্তর দেয়।

একবার ভাবে শিহাব যে চলেই যায়। কিন্তু সাথের এক সহকর্মীকে বলতেই সে জানায়,
– এতক্ষণ অপেক্ষা করলাম, খালি হাতে যাবোনা আজ। পরে যা করার করা যাবে। পুরা দিনটাই মাটি হবে আজ এখন এভাবে চলে গেলে।

সাড়ে এগারোটায় RAB কনস্টেবল তার মুন্সিকে নিয়ে বের হয়। এরপর এস আই তার কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে। এবার শিহাবদের অফিস রুমে ডাক পড়ে। কিন্তু দরজার কাছে যেতেই পরিচিত ‘ভাইলোক’ এসে জানতে চায়,
– কয়জন আপনারা?
শিহাবের সাথের সহকর্মী উত্তর দেয়,
-তিনজন।

শুনে ‘ভাইলোক’ আবার ভিতরে যায় শিহাবদের দরোজায় দাঁড়া করিয়ে রেখে। একমিনিট পরে বের হয় সে। এক হাজার টাকার তিনটা নোট হাতে নিয়ে এক এক করে শিহাবদের হাতে গুঁজে দেয়। ‘ওয়েটিং রুমে’ অপেক্ষমাণ সকল মানুষের সামনে হাতের মুঠোতে এক ইউপি চেয়ারম্যান এর ‘ঈদ সালামি’ এক হাজার টাকার নোট নিয়ে বিব্রত হয় শিহাব। এভাবে খাম ছাড়া টাকা দেয়ায় নিজেকে কেমন উলঙ্গ মনে হয় শিহাবের। একবার ভাবে টাকাটা ছুড়ে ফেলে দেয় ‘ভাইলোক’ এর মুখের উপর। কিন্তু সবসময় মন যা চায় আমরা কি তা করতে পারি?

কোনোমতে দরজায় রেখে আসা জুতো জোড়া পায়ে দেয় শিহাব। মানিব্যাগে নোটটা রাখে। সদর দরোজা দিয়ে বের হবার সময় আবারও বাইরে অপেক্ষমান ‘জেনারেল ভিক্ষুকদের’ দিকে তাকায় শিহাব নামের এক ‘রাজ ভিক্ষুক’। এরা এখনও অপেক্ষা করছে। হয়তো সারাদিনই অপেক্ষা করবে এরা। কিছু পাক বা না পাক।

নিজেদের বাইক স্টার্ট দেবার সময় থানার গাড়িটি শিহাবদের অতিক্রম করে। ড্রাইভারের পাশে বসা পরিচিত এস আই’র সাথে শিহাবের চোখাচোখি হয়। সে নির্লজ্জ হাসি হাসে। শিহাবের কাছে মনে হয় যেন ভেংচি কাটলো তাকে।

নিজের বর্তমান পেশাকে ঘিরে সামগ্রিক কর্মকান্ডে নানাবিধ ভাবের উদয় হয় শিহাবের মনে। অক্ষম ক্রোধ, আর্থিক অস্বচ্ছলতায় ঈদকে ঘিরে ভিক্ষাবৃত্তি, সত্য প্রকাশে মানসিক টানাপোড়েন সহ সদ্য প্রায় পাঁচ ঘন্টা অপেক্ষার পর সবার সামনে হাজার টাকার একটি নোট প্রাপ্তি- এসব কিছু মিলিয়ে মহাসড়ক ধরে ৮০ কি.মি. বেগে দ্রুত ছুটে চলা শিহাবের মনে হয় বাইক নিয়ে সোজা আইল্যান্ডে গিয়ে ধাক্কা দেয়। এই ‘রাজ ভিক্ষুক’ এর জীবন আর ভালো লাগেনা।

এবার ‘চো’ এবং ‘মা’ গোত্রের সাথে ‘খা’ জাতীয় শব্দের মিশেলে এক মফস্বল সাংবাদিকের নিজের ভিতরের ক্রোধ ও হতাশা বের হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু তাতে ঈদ ‘কালেকশনে’ বের হওয়া শিহাব নামের এক ‘রাজ ভিক্ষুক’ এর ভিতরের জ্বলুনি কি একটুও কমে?

#রাজ_ভিক্ষুক_মামুনের_অণুগল্প_৫৫৩

মামুনের অণুগল্প: একটা শুকরই যথেষ্ট

1841955

শিহাব একজন গণমাধ্যমকর্মী। একজন মফস্বল সাংবাদিক। একদিন কোনো কারণ ছাড়াই ভাবনাবিলাসের উদভ্রান্তিতে আপ্লুত হয়। একার সাথে একা কথা বলে এবং ভাবলাবিলাসের শেষ প্রান্তে গিয়ে ভাবতে থাকে…

একজন সাংবাদিক তাঁর দৃষ্টি দিয়ে সব কিছুকে দেখেন। শুধু দেখেই ক্ষান্ত হন না, দেখার বাইরেও যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সেগুলোও পর্যবেক্ষকের চোখ দিয়ে নিরীক্ষা করেন। সর্বশেষে সমাজের ভিতরে তাঁর পরীক্ষালব্ধ উপাত্তগুলির ফলাফল প্রকাশ পায় তার প্রতিবেদনে। এদিক থেকে, সাংবাদিকও বুদ্ধিজীবীদের অন্তর্ভুক্ত।

এখন এই কাজটি করতে গিয়ে তাঁর কয়েকটি জিনিস অবশ্যই নিজের ভিতরে থাকতে হয়। কারণ একটি সমাজ তাঁর লেখনীর ভিতর দিয়ে উঠে আসবে। অতএব, সাংবাদিককে একটি আদর্শ মেইনটেইন করতেই হবে। তাঁর দেখার স্বচ্ছতা থাকতে হবে এবং তাঁকে সত্যবাদী হতে হবে। এই দু’টো থাকলেই তাঁর দ্বারা অন্যরা উপকৃত হবে।

কিন্তু আজ শিহাব নিজের চারপাশে এ কি দেখতে পাচ্ছে? ঐতিহাসিক বিকৃতিতে অংশ নেয়া এবং ভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের পদলেহনমূলক মনোভাবাপন্ন হয়ে সত্যকে গোপন করে অনেককেই হলুদ সাংবাদিকতায় নিজেদের নিয়োজিত করা! শুধু সাংবাদিকগণ কেনো, অন্যসব জ্ঞানী-গুণি ও বুদ্ধিজীবি শ্রেণির অনেকেরই একই মনোবৃত্তি। নিজ নিজ জায়গায় নিজ পেশার দায়িত্বশীলতার দিকটি ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্রাহ্য করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন সবাই!

বাম-ডান কিংবা সাদা-গোলাপী প্যানেলে বিভক্ত হবার ট্রাডিশন তো শিহাব সেই তার কলেজ জীবন থেকেই দেখে আসছে। দুই পরিবার কেন্দ্রিক আমাদের দেশীয় রাজনীতির প্ল্যাটফর্মে আমাদের জ্ঞানী-গুণীরা ভাগ হয়ে তাঁদের কলম ধরছেন। কিন্তু সব বিভেদ ভুলে গিয়ে দেশের পক্ষে এক হয়ে তাঁদের কলম ধরা হয় না। এজন্যই সুন্দরবন রক্ষা করার আন্দোলনে পক্ষে-বিপক্ষে বুদ্ধিজীবিদেরকে দেখা গেছে। দেখা গেছে তেল-গ্যাস রক্ষা করার ক্ষেত্রেও! অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করার আন্দোলনের যৌক্তিকতা খুঁজতে গিয়েও পক্ষে-বিপক্ষের দল ভারী হয়। মোট কথা দলীয় লেজুড়বৃত্তি যেন আমাদের এইসকল বুদ্ধিজীবিদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে।

এ থেকে উত্তরণের পথ কোথায়??
ভেবে কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে স্বভাবগত ভাবেই শিহাব ক্রুদ্ধ হয়।

ক্রোধ নিজের প্রতি। নিজের পেশাগত দায়বদ্ধতা সঠিকভাবে পালন করতে না পারায় নিজের প্রতি ক্ষোভ এই ক্রোধের কারণ। ক্রোধ অন্যদের প্রতিও। সিস্টেমের প্রতি। নিজের পেশারসাথে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ‘ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত অক্ষমতার’ প্রতিও।

ক্রোধান্বিত হয়ে শিহাব ভাবে, ‘আমার চারপাশে গ্রুপিং, নষ্ট রাজনীতি আর মানুষের সীমাহীন ইর্ষায় দমবন্ধ করা এক অনুভুতিতে আচ্ছন্ন হয়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। চেনা মানুষগুলোর অচেনা মুখ মানুষের আকৃতি থেকে সরে গিয়ে কেবলি শয়তানের রূপ লাভ করেছে। শয়তানের রূপ কিরকম? শয়তান শুকরের আকৃতির, গলায় একটা লানতের ঘন্টা বাঁধা থাকে।’

অবাক বিস্ময়ে চমকে উঠে শিহাব!
একটা শুকরই যথেষ্ট তাঁর ভয়াবহতা নিয়ে আশেপাশে থাকা। শিহাবের চারপাশে তো অগুনতি। সেগুলোর ভিতরে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকা অবস্থায় রয়েছে সে!

ভাবনাবিলাসের ভ্রান্তিজালে থেকে শিহাব আশা করে, এই দুঃস্বপ্ন খুব দ্রুত কেটে যাবে…

.
#মামুনের_অণুগল্প_একটা_শুকরই_যথেষ্ট

মামুনের ছোটগল্প: আমি এবং সেই মহিলা

8399_n মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার হলো ‘বিশ্ব মা দিবস’। পৃথিবীর সবচেয়ে দৃঢ় সম্পর্কের নাম ‘মা’। সবচেয়ে পবিত্র ও মধুর শব্দের নাম ‘মা’। যদিও মাকে ভালোবাসা-শ্রদ্ধা জানানোর কোন দিনক্ষণ ঠিক করে হয় না। তবুও মাকে গভীর মমতায় স্মরণ করার দিন আজ। জগতে মায়ের মতো এমন আপনজন আর কে আছেন! তাই প্রতি বছর এই দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় প্রিয় মমতাময়ী মায়ের মর্যাদার কথা।

মাকে ভালোবাসা আর তার প্রতি হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধার বিষয়টি পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিশ্ব মা দিবসের ইতিহাস শতবর্ষের পুরনো। যুক্তরাষ্ট্রে আনা জারভিস নামের এক নারী মায়েদের অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

১৯০৫ সালে আনা জারভিস মারা গেলে তার মেয়ে আনা মারিয়া রিভস জারভিস মায়ের কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সচেষ্ট হন। ওই বছর তিনি তার সান ডে স্কুলে প্রথম এ দিনটি মাতৃ-দিবস হিসেবে পালন করেন। ১৯০৭ সালের এক রোববার আনা মারিয়া স্কুলের বক্তব্যে মায়ের জন্য একটি দিবসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবেই শুরু হয় মা দিবসের যাত্রা।

আমার জন্য প্রতিটি দিবসই আমার মায়ের জন্য শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। বাবাকে নিয়ে আমার অনেক গল্প-কবিতা লেখা থাকলেও ‘মা’কে নিয়ে তেমন লেখা হয়নি। তবে কয়েক বছর আগে একটি ইংরেজী গল্প ‘My mom only had one eye’ এর ছায়া অবলম্বনে আমার নিজের মতো করে তিন পর্বের একটি ছোটগল্প এ দেশীয় প্রেক্ষাপটে লিখেছিলাম। আক্ষরিক অনুবাদ না করে কল্পনায় নিজের থেকে কাহিনীর প্রয়োজনে কিছু সংযোজন করেছি। আজ সকল মায়েদের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানিয়ে তিন পর্বের ছোটগল্পটি আরও একবার শেয়ার করলামঃ-
________________
১.
প্যাকেটটা একটু আগে গেট থেকে দিয়ে গেলো। আমার মেয়েদের পাঠানো ভালোবাসা। হ্যাঁ। ভালোবাসা যখন অনুভবের বিষয় থাকে না, তখন সেটা দেখানোর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধাশ্রমের আপাত নিরাপদ কক্ষে বসে ভাবছি আমি শিহাব। জীবনের এই মোড়টিতে এসে ফেলে আসা পেছনের জীবন, ছানি পড়া ডান চোখের ঝাপসা জীবনের মত অস্পষ্ট.. অবোধ্য অনুভবে অসার অনুভূত হয়। যে চোখটি আমার নিজের নয়, সেটি দিয়েই সব কিছু দেখি আজকাল। আর দেখারই বা রয়েছে কি? এই যে, দুই মেয়ে বিশেষ বিশেষ দিনে ভালোবাসা পাঠায়.. সাত সমুদ্র আর তের নদী পার হয়ে প্যাকেটবন্দী ভালোবাসা বাসি হয়ে কাছে আসে আমার!
আদৌ কাছে আসে কী?
নাহ! কেবলি সামনে আসে।
সামনের আয়নায় নিজেকে দেখি। যার যার জীবনে অভ্যস্ত মেয়েরা নিজেদের কাছের মানুষদের নিয়ে সুখী হতে চাইল। দেশের বাইরে তাদের আলাদা ভূবনে, ওদের মা চলে যাবার পর, কেন জানি নিজেকে ওদের সাথে মানাতে চাইলাম না। একজন মহিলা আর একটি চোখ, আক্ষরিক অর্থেই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল, সেই ছেলেবেলা থেকেই। তখন তাড়না ছিল অবচেতন মনে। তবে এর আসল অনুভব হলো বিয়ের আরো অনেক পরে। সবকিছু মিলিয়ে বউটা একা রেখে যাবার পর, মেয়েদের কাছে একজন বাবার বাবা থাকাটা ম্লান হতে দেখি.. অনুভবও করি। আর সেই পিছু তাড়া করা অনুভব তখন তীব্র হতেই, নিজের একসময়ের চাকরীর সুত্রে এই আশ্রমের সাথে ঝুলে থাকা লিংকের সুবিধাটুকু কাজে লাগিয়ে, নিজের জন্য এই আপাত নিরাপদ জায়গাটিতে ঠাঁই নিয়েছি। এদের গ্রুপে চাকরি করতাম আমি একসময়।

মেয়েদের পাঠানো গিফটের ওপর হাত বুলিয়ে বাবু দুটিকে অনুভব করতে থাকি আমি.. একজন বাবা! দৃষ্টি আমার দেয়ালের আয়নায়.. সেখানে পরিচিত শিহাবের অপরিচিত এক চোখের ভেতরে তাকিয়ে থেকে এক বাবা পেছনে হারাতে থাকেন। সময়ের এক একটি লেয়ার দ্রুত সব অনুভব সমেত বাবার সামনে পলকের তরে থেমে সামনে আগায়! বাবা পিছায়.. বাবা থেকে স্বামী.. স্বামী ব্যাচেলর যুবক.. এভাবে কখন যেন স্কুলের মাঠে বন্ধুদের সামনে দাঁড়ানো সেই বাবুবেলায় ফিরে যায়! সেখানে একজন মহিলা আমার সামনে। মুখোমুখি একই ভূবনে একমাত্র সংগী এমন দুজন মানব-মানবী।

নিজের মনে ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে ডুবে থাকি ষাটোর্ধ একজন আমি। একজন বাবা তার বাবুবেলায় ফিরে গিয়ে, নিজের সাথে কথা বলেন। যে মহিলাটির সামনে মুখোমুখি দাঁড়ানো আমি, সেই মহিলাটি আমার মা ছিলেন!

২.
এক প্রাইমারি স্কুলের মাঠে মুখোমুখি আমি একজন মহিলার। একজন ছেলে তার মায়ের। তখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ি আমি। ক্লাশ ওয়ান পড়ুয়া আমি প্রচন্ড জেদে ফেটে যাচ্ছি ভিতরে ভিতরে। সামনে দাঁড়ানো মহিলাটিকে আমি জ্ঞান হবার পর থেকে বুঝতে যখন শিখেছি, তখন থেকেই কেন জানি ঘৃণা করে আসছি। যদিও এই পৃথিবীতে কেবল এই মা-ই আমার একমাত্র আপনজন। আমার যখন এক বছর বয়স, তখন বাবা অন্য এক মহিলার প্রেমে পড়ে মাকে ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকে মা আজ পর্যন্ত আমাকে আগলে রেখেছেন। আমরা যে বস্তিতে থাকি, আমার স্কুল সেখান থেকে একটু সামনে। বাবা মাকে ছেড়ে চলে যাবার পর, মা এই স্কুলের বোর্ডিং এ থাকা শিক্ষক এবং ছাত্রদের জন্য রান্না করে দেবার কাজ শুরু করেন।

মায়ের একটি চোখ নেই। এজন্য সবাই আমাকে কানার ছেলে বলে ডাকে। সেজন্যই মাকে আমি ঘৃণা করি। কেবল এই একটি সম্বোধনের জন্যই পৃথিবীর সব থেকে প্রিয় মানুষটি আমার কাছে সব চেয়ে ঘৃন্য মানুষে পরিণত হয়েছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার গত দিনের কথা মনে পড়ে। গতকাল ছিল প্যারেন্টস ডে। সবার বাবা-মায়েরা স্কুলে এসেছিলেন। কত আনন্দ। কিন্তু আমি সারাটিক্ষণ আল্লাহ আল্লাহ করেছি, মা যেন এখানে না আসেন। কিন্তু আল্লাহ আমার বাবু মনের প্রার্থনা কেন জানি শুনলেন না। মা এলেন। অন্যদের পাশে গিয়ে বসলেন। একটা ঘোরের মধ্যে সময়গুলি কিভাবে যেন কেটে গেল।

অন্যদের সাথে মা চলে গেলে সেদিন খেলার মাঠে বন্ধুদের একজন বললো, ’এ্যাই, তোর মায়ের এক চোখ নাই। তুই কানা বগীর ছা।‘ তার সাথে অন্যরাও তাল দেয়। সবাই আমাকে ঘিরে গোল হয়ে বলতে থাকে, ‘কানা বগীর ছা’ ‘কানা বগির ছা’। সেই সময়টায় আমার মনে হচ্ছিল মাটি ফাঁক হয়ে যাক। আমি যদি এই মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম! একই সাথে মনে এটাও জাগল, ‘মা কেন অদৃশ্য হয়ে যায় না আমার জীবন থেকে?’

আজ স্কুল মাঠে একা মাকে সামনে পেয়ে সব কিছু মনে পড়ে যায়। একটা নিস্ফল ক্রোধ আমার বাবু মনের এপিঠ-ওপিঠ ঘুরে ঘুরে পাক খেতে থাকে। মায়ের একমাত্র চোখের দিকে তাকিয়ে আমি হিসহিস করে বলি, ‘তুমি সবার সামনে আমাকে জোকার বানাও কেন? তোমাকে দেখে সবাই হাসে.. বুঝ না তুমি? কেন আসো আমার স্কুলে? তুমি মরতে পার না?’

মা চুপচাপ সব শুনলেন। কিছু বললেন না। দীর্ঘশ্বাসও ফেললেন না কিংবা গোপনও করলেন না। শুধু এক চোখে হৃদয়ের সকল মমতাটুকু এনে আমাকে ছুঁয়ে গেলেন! আমি প্রচন্ড রেগে ছিলাম, তাই এইমাত্র মাকে কি বললাম, সেটা আমার বাবু মনের অনুভবে এলো না।

সেদিন থেকে আমার ভেতরে একটা জেদ চাপে। আমি মায়ের জীবন থেকে, যেখানে মাকে সবাই চেনে-জানে, সেই এলাকা থেকে এমনকি মায়ের সাথে যে ঘরটিতে আমি থাকি, সেখান থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাইলাম। একটা তাড়না আমাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কঠোর অধ্যবসায়ে নিমজ্জিত করায়। পড়ালেখা ছাড়া আর কোনো দিকে আমার মনযোগ থাকে না। আর এই সবকিছু কেবলি একজন এক চোখা মা’র ছেলে হিসেবে নিজেকে দেখাতে না চাওয়ার জন্যই.. কারো কাছ থেকে ‘কানা বগীর ছা’ সম্বোধন যাতে শুনতে না হয়, সেজন্যই করি আমি।
পরবর্তী বছরগুলোতে মায়ের সাথে থেকেও যেন একজন ‘আউটসাইডারে’ পরিণত হই আমি। এভাবে স্কুলের গন্ডী পার করে কলেজে পা রাখি। সেখানে অসাধারণ রেজাল্ট করার কারণে স্কলারশিপ পাই।

দেশের বাইরে এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে যাবার দিনটিও একদিন এসে যায়। যাবার দিনেও সেই একচোখা মহিলা আমার পিছু ছাড়েনি। বিমানবন্দরে বিদায় দিতে এসে এক পাশে অন্যদের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি একবারও তার দিকে ফিরে তাকালাম না। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মৃদু স্বরে কথা বলতে বলতে একসময় ডিপারচার লাউঞ্জে ঢুকে গেলাম সেই মহিলার সামনে দিয়ে।

একজন মা বিমানবন্দরে একজন অচ্ছুৎ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ! তাঁকে সচকিত করে যখন বোয়িং ৭৪৭ রানওয়ে ত্যাগ করে, তখনো তার সম্বিত ফিরে না। একজন মা যখন সন্তানের কাছে সামান্য একটি অঙ্গহানির কারণে মায়ের দরজা হারিয়ে ফেলেন, তখন আক্ষরিক অর্থে একজন মা কি আসলেই মা থাকেন?

৩.
দেশের বাইরে আমার সময় কেটে যাচ্ছিল এক অন্য আবহে। আমার নতুন বন্ধু হলো। এদের ভেতরে একজন ‘প্রিয় বন্ধু’ও হলো। আমার জীবনকে নতুন উদ্যমে প্রেরণা দিতে সে আমার হাত ধরলো। আমাদের ভেতর ভালোলাগা গড়ে উঠলো। তা একসময় ভালোবাসায় রুপ নিলো। আর কখন যে ভালোবাসা পুড়ে পুড়ে প্রেম হলো, আমি নিজেই জানলাম না। তবে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে এই মেয়েটি আমার পুরো স্বত্বা জুড়ে রইলো। আমাদের দু’জনের পড়া-লেখা শেষ হলো। দুজনেই ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরতে উদগ্রীব হলাম।

আমি কখনো আমার হবু জীবনসঙ্গিনীকে আমার মা’র সম্পর্কে কিছুই বললাম না। সে একবার আমার রক্তের সম্পর্কের কে কে আছে জানতে চাইলে, আমি বললাম কেউ নেই আমার। আমি একা। তখন ভুলেও আমার এক চোখা মাকে একটুও মনে পড়ল না।

দেশে ফিরলাম দু’জন। আমার প্রিয় বন্ধুর বাবা-মা এয়ারপোর্টে আমাদেরকে রিসিভ করলেন। তাদের বাসায়ই উঠলাম। আমার সম্পর্কে তারাও একই প্রশ্ন জানতে চাইলেন। আমার উত্তরও ছিল একই। আমার হবু শ্বশুরের উচ্চবিত্ত আর চাকচিক্য আমাকে আরো ধাঁধিয়ে দিলো। খুব দ্রুতই আমি একটা ভালো জব অফার গ্রহণ করলাম।

আমাদের দু’জনের বিয়ে হলো। সময় ফুরফুরে মেজাজে বয়ে যেতে লাগল। আমি আমার মা’কে একবারও দেখতে গেলাম না। দু’জনে ভিন্ন দুই শহরে থাকলেও এতটা দূরত্ব ছিল না যে, আমি যেতে পারতাম না। কিন্তু দূরত্ব ছিল আমার মনে। আমার চাওয়া-পাওয়ার প্রাণকেন্দ্রের ইচ্ছেপালকে ধুলো জমেছিল। তাই মনের অগোচরেও আমি সেই মহিলাকে নিয়ে একবারও ভাবলাম না। সময় বয়ে গেলো। আরো ধুলোর আস্তরণ পড়ল আমার মনের আরশিতে একজন এক চোখের গরীব মহিলাকে কেন্দ্র করে।

আমার দুই কন্যা একে একে পৃথিবীতে এলো। তারা বুঝার মত বড়ও হলো। আমার অনেক উন্নতি হলো। আমি একটা চমৎকার বাড়ি বানালাম। গাড়ি কিনলাম। আমার ভূবন একদা’র আমার বসবাসের সেই বস্তি জীবনের তুলনায় যোজন যোজন দূরত্বের ছিল।

একদিন সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে আমি মেয়েদের নিয়ে বাসায় আমার একান্ত মুহুর্তগুলি কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ ডোরবেলের আওয়াজ। সোফায় দুই মেয়েকে পাশে নিয়ে বসে মৃদু খুনসুটিতে ব্যস্ত ছিলাম। বড় মেয়ে দরজা খুলতে গেলে ছোটজনও পিছু নিলো। দরজা খুলেই বড় মেয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে এলো। ওর দেখাদেখি ছোটজনও একই কাজ করতেই, আমি সামনে আগালাম। উন্মুক্ত দরজার ওপাশে আজ এতগুলি বছর পরে আমি সেই মহিলাকে দেখলাম! বয়সের ভারে আরো নুয়ে পড়েছে। তার জীর্ণ মলিন পরিচ্ছদ আরো মলিন হয়েছে। শূন্য চোখের গহ্বরটি তাঁকে আরো ভয়ংকর কদাকার করে তুলেছে। আসলেই হঠাৎ দেখে যে কেউই ভয় পাবে।

তবে কয়েকমুহুর্ত পার হলে, আমার মেয়েরা সাহস করে সামনে এলো এবং এবারে ভয়ের পরিবর্তে তারা সেই কদাকার মহিলার প্রতি উপহাসের হাসি হাসলো। আমার ভেতরে কিছু একটা কি যেন ছিড়ে গেলো। আমি ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে তাঁকে বললাম, ‘তোমার এত বড় সাহস কি করে হলো আমার বাসায় আসার? আমার মেয়েদেরকে তুমি ভয় পাইয়ে দিয়েছে, এখুনি এখান থেকে বের হয়ে যাও!’

সেই মহিলা তার ভালো চোখটি দিয়ে এক পলক আমাকে এবং আমার মেয়েদেরকে দেখলো। এই প্রথম সে আমার মেয়েদেরকে দেখছে। আমাকেও আজ এতগুলি বছর পরে দেখলো। মুখে লজ্জার হাসি ফুটিয়ে সে বললো বড্ড শান্ত স্বরে, ‘ওহ! আমাকে মাফ করবেন, আমি ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছি।‘ এক মুহুর্তও সে আর না দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। একবারও পেছনে ফিরলো না।

আরো কয়েকমাস পরে, আমার সেই ছেলেবেলার স্কুল থেকে একটি চিঠি এলো আমাদের ব্যাচের ‘রি-ইউনিয়নের’ দাওয়াত নিয়ে। আমি কোনো কিছু চিন্তা না করেই সেখানে যাবার ব্যাপারে মনঃস্থির করলাম। আমার বউকে মিথ্যে বললাম যে, অফিসের কাজে আমাকে ‘অমুক’ শহরে যেতে হবে।

নির্দিষ্ট দিনে আমি ‘রি-ইউনিয়নে’ অংশ নিলাম। ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে নিয়ে একটা দিন এবং রাত চমৎকার কেটে গেলো। পুরনো স্মৃতিতে রোমন্থনযোগ্য অনেক কিছু এলেও আশ্চর্যজনকভাবে আমার মা একবারও আমার মনে এলো না। হাতে অনেক সময় আছে ফিরবার। তাই শ্রেফ কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে আমি আমার ছেলেবেলার সেই পুরনো বসবাসের জায়গায় গেলাম। আমাদের প্রতিবেশী কয়েকজন তখনো বেঁচে ছিলেন। ওনারা আমাকে চিনলেন। এদের ভেতর থেকে একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এলেন। আমাকে চিনতে পেরে তিনি আবার তার ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর, একটা মুখবন্ধ খাম হাতে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে চিঠিটি দিয়ে জানালেন যে, গত রাতে আমার মা- সেই এক চোখা মহিলা মারা গেছেন। এলাকার সবাই রাতেই শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছেন। শুনে আমার ভেতরে কোনো ধরণের অনুভূতি জাগলো না। আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রুও বের হলো না।
আমি আমার বর্তমান জীবনের উদ্দেশ্যে ফিরে যেতে আমার রাস্তায় ফিরে চলি হেঁটে হেঁটে। আমার হাতে সেই মহিলা যিনি আমার গর্ভধারিনী ছিলেন, তার লেখা চিঠি! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত খামের মুখ খুললাম। অস্পষ্ট হলেও আমার একদার পরিচিত হস্তাক্ষর মুহুর্তে আমার দৃষ্টিগোচর হলো। সেই মহিলা আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখেছেন-

‘প্রিয় বাবুটা আমার!
আমি সবসময়েই তোমাকে ভেবেছি। প্রতিটা মুহুর্ত তোমার মঙ্গলচিন্তায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি। আমি আবারো দুঃখ প্রকাশ করছি বাবুটা, সেদিন ওভাবে না জানিয়ে তোমার বাড়িতে গিয়ে তোমার মেয়েদেরকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য।

তুমি ‘রি-ইউনিয়নে’ আসবে জেনে আমি খুবই খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু আমি এতটা-ই অসুস্থ ছিলাম যে, ঐ অনুষ্ঠানে গিয়ে তোমার সাথে দেখা করার মত শক্তি আমার শরীরে ছিল না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত বাবুটা যে, সেই ছেলেবেলা থেকে কেবল আমার জন্য তোমাকে অন্যের কাছে হাসির পাত্র হতে হয়েছে।

যে কথা কখনো তোমাকে বলিনি প্রিয় বাবুটা আমার, আজ বলছি শোন। একেবারে বাবু বয়সে এক দুর্ঘটনায় তোমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। একজন মা হিসেবে আমি এটা কল্পনাও করতে পারিনি যে, একটা মাত্র চোখ নিয়ে তুমি বড় হবে! তাই আমার একটা চোখ তোমাকে দিয়েছিলাম তখন।

আমি অত্যন্ত গর্ববোধ করেছিলাম যে, আমার দেয়া চোখ দিয়ে আমার ছেলে আমার জন্য সমগ্র বিশ্বকে দেখবে! আমি যখন থাকবো না, তখনও আমি এই পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখবো-অনুভব করবো! আসলে সেটাই কি হচ্ছে না?

তোমার মেয়ে দুটি খুব সুন্দর! ওদের জন্য অনেক অনেক আদর রইলো। দুঃখ তোমার বউকে দেখতে পেলাম না। ওকেও আমার ভালোবাসা জানিও।
আমার হৃদয়ের সকল ভালোবাসা তোমার জন্য রেখে গেলাম প্রিয় বাবুটা!
তোমার মা।‘

আমি শেষ লাইনটা পড়ার পর যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, রাস্তার মাঝামাঝি সেখানেই স্থাণুর মত অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। রাস্তায় অপেক্ষামান গাড়ির বিকট আওয়াজ আমাকে সরতে বলছিল, আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। শেষে এক পথচারী এসে টেনে আমাকে ফুটপাতে নিয়ে রেখে এলেন।

আমার মন পুড়ে যাচ্ছিল.. কোথায় কোথায় যেন চিরে যাচ্ছিল। হাত থেকে সেই মহিলার লেখা চিঠিখানা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেলেও আমি সেটা ধরার জন্য সামনেও আগাতে পারছিলাম না। এক অবোধ্য অনুভবে বিলীন হতে হতে আমার ভেতরে কেবলি এই কথাটিই বার বার বেজে চলছিল, ‘সেই মহিলা আমার মা ছিলেন!’ একজন এক চোখা মহিলা, যাকে আমি সারাটা জীবন ঘৃণাই করেছি কেবল। অথচ আমার জন্য শেষ সময় পর্যন্তও কেবল ভালোবাসাই রেখে গেছেন তিনি।

মায়েরা কি এমনই হয়?

সময়ের বুক থেকে আবারো নিজের ধুসর বর্তমানে ফিরে আসি আমি শিহাব। সেই বৃদ্ধাশ্রমের নিজের আপাত নিরাপদ কক্ষে। আয়নায় দেখা সেই অচেনা চোখটিকে আজ বড্ড চেনা লাগছে। ঐ চোখটি যে আমার মায়ের! একজন মায়ের চোখ কেমন হয়? অর্ধেক জীবন পার করেও সেটা আমার বুঝে আসেনি। যখন বুঝে এলো, তখন সেই বুঝ আমার কোনো কাজে এলো না।
কথায় বলে, ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি করে থাকে। আজ এক বৃদ্ধাশ্রমে একজন বাবা তার বিগত সময়ের ভুল ভাবনার খেসারত দিচ্ছেন বড্ড তীব্রভাবে। সব কিছু থেকেও আমার কিছুই নেই। অনুভবে রয়েছে, বাস্তবে কেবলি শূণ্যতা! যে শূণ্যতায় কখনো নিঃশেষ হয়েছে একজন এক চোখের মহিলা। জীবনভর ভালোবাসার প্রতিদানে সে কেবলি ঘৃনাই পেয়ে গেছে। তবুও শেষ সময় পর্যন্ত তার প্রিয় বাবুটার জন্য ভালোবাসাই রেখে গেছে সে।

বেলা শেষে কোনো প্রিয়জন ফিরে এসে ডাকবে আমায় কিংবা পাশে এসে নীরবে শুধু চলে যাওয়া প্রহরকে অনুভব করাবে, এমন কোনো অনুভবে আজকাল আমি উদ্দীপ্ত হই না। এ আমার নিজের কর্মফল.. আমি নিজেই অর্জন করেছি এই নিঃসঙ্গতা!

তাই আমাকে এভাবেই থাকতে হবে। আয়নায় দেখা আমার মায়ের চোখ আমার এই দুরবস্থায় কেন জানি ভিজে আসে। তার প্রিয় বাবুটার এই নিঃসঙ্গতা কেন জানি তাঁকে পীড়া দেয়। অসহ্য কষ্টকর মুহুর্তগুলিতে তাই যে চোখটি আমার নয়, সেটি কেঁদে চলে। আমার নিজের চোখটি অনেক আগেই কেন জানি নিষ্প্রাণ পাথরে পরিণত হয়েছে। তাই আমার অনুভূতি-অনুভব সকল ইচ্ছেপালকের নিউক্লিয়াস ইদানিং সেই একচোখা মহিলার আমায় ভালোবেসে দান করা চোখকে ঘিরেই চলতে থাকে…।

মূল গল্পঃ My mom only had one eye ‘র ছায়া অবলম্বনে লেখা।
#আমি_এবং_সেই_মহিলা_মামুনের_ছোটগল্প।

মামুনের অণুগল্প : হারানো শহর

8990_n

প্রচন্ড উচ্চতা ভীতি আছে আমার।
ছেলেবেলায় দেখতাম, বন্ধুরা সবাই কি অবলীলায়
আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে, তরতর করে স্টিলের সিঁড়ি বেয়ে কলোনির পানির ট্যাঙ্ক এর ছাদে চড়ে বসতো! ওদের উপহাসে যদিও কখনওবা উঠতে চাইতাম আমি, একতলা উচ্চতায় উঠতেই, পায়ের তলায় শিরশিরে অনুভবে সারা শরীর আমার অবসন্ন হয়ে যেতো। মনে হতো এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।

ওর সাথে প্রথম পরিচয়ও হয়েছিলো এরকম এক পরিবেশে। একবার পাহাড় দেখার খুব শখ হলো আমার। অনেক সাহস করে লেক সংলগ্ন এক পাহাড়ে (মাটির টিলা ও বলা যায়) অন্যদের পিছু নিয়ে উঠলাম! মাটি কেটে ধাপ ধাপ করে বানানো সিঁড়ি। কোনোদিকে না তাকিয়ে কেবলই উঠে যাচ্ছিলাম।

যাইহোক, চূড়ায় উঠলাম অবশেষে। রেলিং দিয়ে ঘেরা ওই জায়গাটুকু। রেলিং এর এপাশ থেকে নিচের শহরটা দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগলো। এরপর মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে রেলিং এর আরো কাছে গেলাম। এখানটায় পাহাড়ের শরীর থেকে মাটি কেটে নেয়া হয়েছে। ক্ষত বিক্ষত পাহাড়ের শরীর সরাসরি নেমে গেছে প্রায় ৩শো’ ফুট নিচে। কি এক আকর্ষণে একটু ঝুঁকে একদম নিচের খাদ দেখতে চাইলাম। ভুলে গেলাম আমার উচ্চতা ভীতির কথা। মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিলাম রেলিং টপকে প্রায় ৩শো’ ফুট নিচে! কেউ একজন পিছন থেকে আমার হাত আঁকড়ে ধরলো শক্তভাবে। হয়তো কিছু সময়ের জন্য চেতনা হারিয়েছিলাম আমি।

একটু স্বাভাবিক হতেই আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সেই নারী মৃদু হেসে বললো,
– এ্যাক্রোফোবিয়ার পেসেন্ট হয়ে পাহাড়ে উঠলেন কেনো?

এই ছিলো ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। প্রথম দেখা। জলতরঙ্গের মতো ওর ঠোঁট থেকে বের হওয়া কথা শুনা। আসলে কিছুই শুনছিলাম না আমি। ওর ঠোঁটের নড়াচড়াই মুগ্ধ ভাবে দেখছিলাম।

ওর নামটা না-ই বললাম। সে তার কলেজের বান্ধবীদের সাথে এসেছিলো। একটু দূরে দাঁড়ানো তারা মিটিমিটি হাসছে। একটু বিব্রত হলাম। দেখলাম ঘাসের ওপর বসা আমি। সে আমার হাত ধরে আছে। সেদিকে তাকাতেই ও আলতো করে আমার হাত ছেড়ে দিলো।

এরপর যা হলো, একটু সিনেম্যাটিকই বলা যায়। ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো! ক্রমে তার বেগ বাড়বে এটা বুঝে নিচে নেমে যাবার তাড়া অনুভব করলাম। কিন্তু নামার সময় পিচ্ছিল মাটির সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে। ভেবে ভয় পেলাম। সে ও হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝলো। আবারও আমার হাত ধরে বললো,
– একা তো নামতে পারবেন না। একসাথে নামি চলুন।

এরপর আর বলার কিছু থাকে? এক অদ্ভুত বিভ্রমের আবেশে হাঁটছিলাম আমি ওর পাশাপাশি। ঠোঁটে গোপন হাসি আর মৃদু কলরব নিয়ে ওর বান্ধবীরা আমাদের পিছু নেয়। হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম। একপলক উপরে তাকালাম। মেঘবালিকাদের কষ্টে ছেয়ে ছিলো আকাশটা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ইলশেগুঁড়ি ভালোলাগায় আমাদের দু’জনের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভালোলাগা মিশছিলো গিয়ে লেকের জলে! এমনই মনে হলো আমার। এই শহরটাকে তখন মনে হচ্ছিলো কেবলি আমার!

এভাবেই প্রথম পরিচয় আমাদের। এরপর.. অনেক সময় পার হলো। বন্ধু হয় সে আমার। একসময় বন্ধুত্ব হয়ে যায় ভালোবাসা। এক অদেখা ভালোবাসা। যা থাকে শুধু অনুভবে। যদিও আমরা কেউ কাউকে বলতে পারিনি ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসা আমাদের দু’জনকে র‍্যাপিং কাগজে সযত্নে মুড়ে রেখেছিলো। প্রতিটি ভরা বর্ষার দিনে চকচকে পেভমেন্ট ধরে হেঁটে চলতাম আমরা। হাতে হাত রেখে। ওর শরীরের সুরভি মেখে থাকতো সেই পথে। আমাদের দু’জনকে দেখে হয়তো সেই চকচকে পেভমেন্ট আর জন্মে মানুষ হতে চাইতো!

এর পরের গল্প অন্য রকম। বন্ধুত্বের গতি আরো বেড়ে যায়। জীবিকার তাগিদে দু’জন দুই শহরে। মোবাইল তখনো আসেনি। টেলিফোনে কাছেদূরে অনুভবে সময় কাটে। কষ্টের হাহাকার বাড়ে সময়ে না পেলে, কাজে ব্যস্ত থাকলে। অভিমানে দু’পক্ষের-ই মন ভিজে যায়।

তারপর একটা ঝড় নেমে আসে একদিন। রেল লাইন দু’দিকে বেঁকে যায়। শুধু কষ্ট আর অভিমান খেলা করে। ক্ষীন একটা যোগাযোগ ভগ্ন সম্পর্ক হয়ে টিকে থাকে। নিয়তি বলে একটা কথা রয়েছে না? পারিবারিকভাবে ওর বিয়ে ঠিক হয়। আমাকে পছন্দ করেনি ওর অভিভাবকেরা। সে ও সবাইকে কষ্ট দিয়ে একবারে আমার কাছে চলে আসতে চায় না।

আমি শেষবারের মতো ওকে দেখতে চাই।

শেষবার ওর সাথে যখন দেখা হয়, সে মেঘবতী কন্যা হয়ে সমুদ্রের তীর ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিলো। পিছন থেকে ওর এলোচুলের গোছা, কানের পাশে গন্ধরাজ গোঁজা। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সব হারানোর অশ্রুধারা আমার দু’চোখ বেয়ে নেমে এলো। ওর দিকে তাকালাম। এক জোড়া মুগ্ধ চোখ অপেক্ষা করছে দেখতে চাইলাম। মনটা ব্যকুল হলো। ভাবলাম হয়তো ভুল ভেবেছি। ওর চোখে ভালোবাসার আলো জ্বলে উঠতে দেখলাম কি? কিন্তু আমার হাতদুটো ধরে, একটু ছুঁয়ে দিয়ে, নিজের গন্তব্যে সে চলে যেতে চাইলো আবার দেখা হবে বলে।
ট্রেন স্টেশনে বিষন্ন মন নিয়ে পৌঁছালাম। কি এক হারানোর শূন্যতা ছিল মনে। জানতাম এখন ওকে চলে যেতে দিলে, আমি আর কখনোই পাবো না ওকে!! ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্যে, এই প্ল্যাটফরমে আর কোনো ট্রেণ আসবে না।

ট্রেন এসে পৌঁছালো স্টেশনে। ও চলে গেলো…

আমার উচ্চতা ভীতির কারণে আমরা কখনো আর পাহাড়ে উঠিনি। ও বলতো, ‘পাহাড় আর সমুদ্র পাশাপাশি থাকে। উপর থেকে নিচে দেখার দরকার নাই তোমার। তুমি নিচ থেকে উপরে দেখবে। আমি তোমার পাশে হাত ধরে বসে থাকবো। আমরা সোনালী ডানার চিল আর সমুদ্রের ঢেউ দেখবো পাশাপাশি বসে!’

আমি আর কখনোই উপর থেকে নিচে দেখিনি। ও আমাকে ছেড়ে এতটা উপরে চলে গেলো, নিচে থেকে দেখা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় রইলো না!

সেই থেকে একাকি সাগরপাড়ে প্রতীক্ষায় আছি ওর! পাশাপাশি বসে সোনালী ডানার চিল দেখে দেখে সাগরের গর্জণ শুনবো বলে।।

আজ ও নেই
আমারও কোনো শহর নেই।।

.
#হারানো_শহর_মামুনের_অণুগল্প_৫৫১

অণুগল্পঃ তিন শহর

1649171_n

ফ্রাঙ্কফুর্ট। জার্মানি।
ম্যাসেঞ্জারে বন্ধুর ম্যাসেজ। আর এক মহাদেশ পার হয়ে আসতেই হ্যান্ডসেট স্ক্রিনে মৃদু কাঁপন অনুভব করে দূরের বন্ধু। মৃদু হাসি নিয়ে বিছানায় পাশ ফিরে আরাম অনুভব করে সে। ভালো লাগাটুকুও চোখ বন্ধ করে উপভোগ করে।

স্ক্রিনে বন্ধুর মুখ।
‘পারুর সাথে একবার কথা বলতে চাই। আমার ফোনই ধরছে না সে। তোর বুবুকে বল না..।’

সময় যেন থমকে যায়। নিঃশ্বাসগুলো বিশ্বাসের ওপার থেকে এপারে আসতে বাঁধা পায়। সমস্যার গভীরে চিন্তা-ভাবনাকে ঠাঁই দেবার আগেই বেদনারা ঘিরে ধরে দূরের বন্ধুকে। সে মোবাইলের দর্পণে কাছের বন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। উপায় খোঁজে।

মধ্যরাত। পারুর শহর।
একা এক প্রিয়দর্শিনী ঘুমন্ত ওর নিজ শহরের নিমগ্নতা, যোগীর গভীর ধ্যানমগ্নতায় অনুভব করছে। ফ্ল্যাট লাগোয়া ইউক্যালিপটাস গাছের পাতার ফাঁক গলে নেমে আসা চাঁদের আলোয়, ওর দীর্ঘ এলোচুল কেমন মায়াবী! নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে… দর্শকের বুকের গভীরে উষ্ণ রক্তের তান্ডব নৃত্য অনুভব করায়।

কালচে আগুন!
অহর্নিশি পোড়ায়। কাছে টানে। এমনই আগুন।

কি এক রহস্যময়, গোপন আবেশে পারুর অধর কোণে ফুটে ওঠা মৃদু হাসি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই, হ্যান্ডসেটে মৃদু কম্পন।

‘পারু! ফোন ধর… একবার।’

এতটুকুই কথা। কত ব্যথা। কথার ভিতরেও কতটা যে না বলা কথা রয়েই গেল! রেখে গেল কিছু একটা। অনুভবে নাকি কল্পনায়?
বাস্তবে নয় কি? কেন?

পারুর হাসিই পারুর কান্না। সেই কান্না ধীরে ধীরে মৃদু হাসির কম্পনে চোখ স্পর্শ করার আগেই, মধ্যরাতের এক রহস্যময়ী অপ্সরী, নিজের শহরে বসে ভাবে-
‘ওকে যদি আমি ভালোই না বাসি, তবে ওর কষ্ট অনুভব করে, আমারও কষ্ট পাবার কোনো অধিকার নাই।’
রুপালী তরল চাঁদের প্রবল বর্ষণে ভিজে যেতে থাকে পারু…

মধ্যরাত। কাছের বন্ধুর নিজের শহর।
টপ ফ্লোরে নিজের ‘সাময়িক বন্দীশালায়’ বসে এই মহানগরের ভিন্ন এক রুপ দেখছে সে। আলোয় ঝলমলে নগরীর নিচেই কতটা অন্ধকার। অনুভূতিতে খোকলা। বিশাল এক অজগরের মত প্রকাণ্ড হা করে থেকে, সকাল-সন্ধ্যা ওর বুকে বিচরণ করা যান্ত্রিক মানুষগুলোর অনুভূতিকে খেতে থাকে। সেই আলো-অন্ধকারের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে সে ভাবে-
‘পারু ম্যাসেজের উত্তর দিলো না!’ 🙁

হৃদয়ের গভীরে কিছু একটা পুড়ছে। পোড়া গন্ধ পায় সে। কাছের বন্ধুর ভিতরে কোথায় যেন সহস্র জ্বলন্ত মোমবাতি গলে গলে পড়ছে। পুড়ছে। পোড়াচ্ছে!!

‘ওহ! ভালোবাসায় এত কষ্ট কেন?‘
নিজের পারুর কথা ভেবে ভেবে সে উদাস হয়।

একটা আক্ষেপ সারা জীবন থেকেই গেলো। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র না পাওয়ার বেদনাগুলোর এলোমেলো পথ চলার নামই কি জীবন নয়?

এব্যাপারে, কারো কারো ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকতেও পারে। তবে অহংকার যাদের জীবনে অলংকারের মত জড়িয়ে থাকে, তাদের জীবনের বেশীরভাগ পথই এমন এলোমেলো চলতে হয়।

বিস্মরণ_অণুগল্প_৪১৮

শপিং মল থেকে বের হবার পথে পরিচিত হাজারো অচেনা শরীরের ভিড়ে খুব কাছের হারানো একজনের, শরীর ছুঁয়ে ভেসে বেড়ানো পরিচিত সুগন্ধি দূরের কারো কথা মনে করিয়ে দেয়। কখনো কখনো একটা পরিচিত মানুষ কিভাবে একটা পারফিউম হয়ে যায়! ভেবে বিস্মিত হবার পাশাপাশি, একটু কি ব্যথিতও হয় মন? সামনে একটু হেঁটে ডানপাশের ওয়েস্ট পেপার বিনে নিজের গোটা মনটাকে-ই ফেলে বাইরের আলোয় দৃশ্যমান শিহাবের নিজেকে বড্ড নিশ্চিন্ত মনে হয়। তারপরও ঘ্রাণটুকু আরো অনেকক্ষণ সাথে জড়িয়ে থাকে ওর মনে।

পার্কটাকে বামে রেখে, দুই সারি শিরিষ গাছ দু’পাশে রেখে মাঝ দিয়ে পথ। ইটের সলিংয়ের ওপর হাল্কা পলেস্তারা পারেনি যেমন জুতোর শব্দকে আরো মোলায়েম করতে, তেমনি পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলির গোমর বন্ধ রাখতেও। আজকাল সবাই সব জানে। তবে কতটুকু মানে?

পাশাপাশি অনেকগুলি বেঞ্চের একটায় একজন একা। বসে আছে। দৃষ্টি সামনে.. মন হারিয়েছে দূরে কোথায়ও।
কোথায়?
মেয়েটি নিজেও জানে কি?

চমৎকার শাড়ি। স্লিম ফিগারে বেশ মানানসই। কপালের লাল টিপ শেষ বিকেলের আলোকচ্ছটায় চেহারাকে উজ্জ্বল, আরশির চকচকে আভার মত রাঙিয়ে তুলেছে! সামনে দু’পাশ থেকে ছেড়ে দেয়া চুল বাতাসে উড়ছে। খোঁপার সাদা জবা অতিরিক্ত শুভ্রতায় শিহাবকে ধাধিয়ে দেয় পলকের তরে। তবে দ্বিতীয় পলক পরতেই পরবর্তী প্রহর থেমে যায়। নিঃসঙ্গ মেয়ে আপন মনে হাসে। একা একা। একটু বেঁকে থাকা ঠোট অস্ফুট বেদনায় ধীরে ধীরে মেলে যায়। সারিসারি মুক্তোদানার ঝলকে আবারো প্রহর থেমে যায়। হাসছে নীরবে। অথচ ওর দু’চোখে রাজ্যের বিষন্নতা দেখতে পেয়েছে শিহাব। সামনে দিয়ে পাশ কাটানোর সময়। খুব পরিচিত কিন্তু ঠিক কিসের মতো ঘ্রাণ কেন জানি মনে পড়তে চায় না। অথচ শপিং মল থেকে বের হবার সময়ও নামটা মনে ছিল.. পারফিউমটার।

আর পারফিউমটা যার শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে সুগন্ধি হয়ে ভাসতো বাতাসে, সেই মেয়েটির নামও এখন মনে আসছে না।

মনটা যে ওয়েস্ট বিনে ফেলে এসেছে, ভুলে যায় শিহাব।।

বিস্মরণ_অণুগল্প_৪১৮

মামুনের_অণুগল্প: চিত্রার হাতে ত্রিশ টাকা

1452041_n

জীবনে সর্বপ্রথম সৌমিত্রের আয় হয়েছিল জয়েন করার দ্বিতীয় দিনে। তখন স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। শিক্ষক-প্রভাষকগণ এক এক শ্রেণীর ইনভিজিলেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সৌমিত্র নিজেও সেদিন স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব নিয়েছিলো।

পরীক্ষা শেষ হলে শহরের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার আগে হেড ক্লার্ক শরৎ বাবু ওর রুমে আসেন। এবং ত্রিশটি টাকা দিয়ে রেজিস্টারে ওর স্বাক্ষর নিয়ে নেন। কিসের টাকা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন,
– ইনভিজিলেটর হিসেবে আপনার আজকের সম্মানী, স্যার।
একটু অবাক হয়েছিল সৌমিত্র। ভালোও লাগছিল। নিজের প্রথম সলিড আয়! যদিও চট্টগ্রাম থেকে এই প্রতিষ্ঠানে সে এসেছে ঢাকাগামী বাসের ডাইরেক্ট প্যাসেঞ্জার হিসেবে। তখন ভাড়া ছিল একশত পনের টাকা। সেই ১৯৯৮ ইং সালের কথা। আবার ফিরবার পথেও একইভাবে যাওয়া। তখন অবশ্য এতো টাকা লাগে না। কারণ ফিরতি পথে পথের মাঝ থেকে সৌমিত্রকে উঠতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম আর ঢাকার মধ্যবর্তী এক সীমান্ত এলাকায়।

সেদিন বাসায় ফিরে মায়ের হাতে জীবনের প্রথম উপার্জন তুলে দিয়েছিল সৌমিত্র। মা কতটা খুশী হয়েছিলেন? তবে তাঁর ঝলমলে চেহারায় যে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল সে দৃশ্য কি ভুলবার মতো? মা সেই টাকাগুলো খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। নিজের প্রথম সন্তানের প্রথম আয় বলে কথা! হোক না পরিমাণে সেটি খুবই কম।
হঠাৎ করে নিজের মনে বেহায়া ভাবনাগুলো আরো কিছু চিন্তার উদ্রেক করায়!

– আচ্ছা চিত্রা কি এই ত্রিশ টাকা পেলে খুশী হতো?
– মা আর চিত্রা থাকাবস্থায় সে কাকে টাকাটা দিতো?
– মাকে দিলে কি চিত্রা মেনে নিতো? কিংবা চিত্রাকে দিলে মা?
উফফ! অসহ্য।
নিজের রিভলবিং চেয়ার থেকে উঠে পড়ে রুমের ভিতরে পায়চারি করে সৌমিত্র। বেহায়া ভাবনাদের ততোধিক কুচক্রীসুলভ প্রশ্নগুলো থেকে নিস্তার পেতে চায় হয়তো। কিন্তু প্রশ্নগুলোও ওর পিছু পিছু সাথে সাথে থাকে। এদেশের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মতই বিশ্ব-বেহায়া সেগুলোও। তাই এতো সহজে মুক্তি পাওয়া যায় না।

মামুনের অণুগল্প : বালিকা

“পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমের মত সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথম যৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মত সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়।”*

আমাদের এই বালিকাও আজ ক’দিন তীব্র যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাচ্ছ। নিজেও সে সেটা বুঝে কি? তবে কিছু একটা যে হয়েছে, বয়ঃসন্ধিজনিত অনুভূতির প্রগাড় অনুভবে বিদীর্ণ হবার চেয়েও বেশ তীব্র এই নতুন অনুভব। কেমন জ্বালা ধরায়, পোড়ায়। হৃদয় বলতে কিছু একটা যে শরীরের ভেতর ওর অজান্তে ওকে হৃদয়বতী করে তুলছে… একটু একটু… পলকে পলকে, এক গোপন শিহরণ নতুন চরের মত জেগে উঠা হৃদয়ের শূন্য প্রকোষ্ঠে গেড়ে বসছে! যা ওকে দোলায়, ভীত করে, আবার কাছে টানার মত ভদ্রগোছের দূরত্ব ও রেখে যায়।
যেন এক নিষিদ্ধ লোবান!

স্কুল ফেরত বালিকা নির্জন মাঠ ঘেসে বাড়ি ফেরার পথে আজকাল বড্ড নীরব। সাথীদের পথচলতি টুকরো খুনসুটি আর কলরবও কেন জানি বালিকার মৌনতায় ফাটল ধরাতে পারেনা।

নিজের বাসায় ফিরতে প্রথম যে মোড়টি পড়ে, চা’র দোকানটিকে ঘিরে ইদানিং দুষ্টু ছেলেদের বড্ড আড্ডা। এরা নতুন সিগ্রেট ফুঁকতে শিখেছে। আর বালিকাদের স্কুল যাবার এবং ফিরে আসার সময়গুলিই ওদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সময়। ওরা নিজেরাও কি তা জানে?

দলটির সামনে এসে, পথ চলতি বালিকার গতি বুঝি একটু শ্লথ হয়! সে কি থামতে চায়.. এক পলক? এই উঠতি রোমিওদের ভিড়ে সে রয়েছে। এক পাশে বসা। সাধারণ একজন ‘সে’। বালিকার কাছে ইদানিং তাকে কেন জানি ‘অসাধারণ’ কিংবা এর থেকেও ভারী কিছু ভাবতে ইচ্ছে হয়, যা অনুভূতির গভীর থেকে বালিকার নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম হবে।

সবার ভিতরে থেকেও সৌভাগ্যবান বালক, বালিকার শান্ত দীঘির অশান্ত জলরাশির মাঝে জ্বলে ওঠা এক পলকের স্পর্শ পায়। একটু দেখতে ইচ্ছে করে বালিকাকে! মনের সম্পূর্ণ জোর খাটিয়েও সে তাকাতে পারে না।

বালিকা কি একটু আহত হয়? চলার গতি কি তার একটু বেড়ে যায়? হবে হয়ত।

বালকের জীবনও আজ ক’দিন ধরে এমনই এলোমেলো। মায়ের পিছু ঘুরঘুর করা ছোট্ট বাবুটি এখন না থাকলেও, মাকে কেন্দ্র করেই চলে ওর জীবন। কতটুকুই বা? তবুও তো জীবন! হৃদয় আছে তো। বালকও কি হৃদয়বানে পরিণত হওয়া শুরু করল? এরকমই কিছু একটা হবে, বালক অজান্তে অনুভব করে মনের বাইরে থেকে? ভিতরে উকি দিয়েও যে দেখা যায়, সে তো আর তা জানে না।

তবে মায়ের মা মা ঘ্রাণ কে ছাপিয়েও এখন অন্য এক ঘ্রাণে আবিষ্ট এই বালকের মন। বালিকাকে ঘিরে সময়গুলো কাটে তার এখন। কত কি যে ভাবে! অনুভব করে… কিন্তু নিজের অনুভবগুলোকে প্রকাশ না করতে পারার যন্ত্রণায় থেকে থেকে নীল হয়। স্কুল পলাতক এক মেয়ে যেন বালিকা। ওর সামনে এলেই বালকের জগত কেমন নিরব হয়ে যায়। কিন্তু অন্তরে তার নিরন্তর এক ঝড় বয়েই চলে…

‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে’*

বালিকার সামনে নিজের আজকের ভীরু মনোভাব, বালকের পাগল মনকে আরো পাগলা করে দেয়। সবার মাঝে থেকেও সে নিরব চীৎকারে হৃদয়ের অধিপতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘এতো কষ্ট নিয়ে আমি হৃদয়বান হতে চাইনা। তোমার হৃদয় ফিরিয়ে নাও।’

হৃদয়ের অধিপতিও ততোধিক নীরব থাকেন।

বালিকা বাসার সামনে। ফেলে আসা পথের দিকে ফিরে চায়। কাউকে কি দেখা যায়? বালিকার ফেলে আসা পথে কি কারো থাকবার কথা? নিজের মাংসল হৃদয়ের বড্ড কাছে এক নীলখাম… বালিকার হৃদয়ের গোপন কিছু অনুভব রুদ্ধ দুয়ার খুলে, অক্ষরে রুপ নিয়ে বালক হৃদয়ের পরম আরাধ্য জায়গায় সযতনে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায়! কিন্তু হৃদয়ের বহু গভীর থেকে কি এক জ্বালাময় অনুভবে জ্বলছে বালিকা। তাই হৃদয়ের বাহিরের মাংসল হৃদয়কে ছুঁয়ে থাকা নীল খাম, বালিকাকে বাইরে থেকেও অস্থির করে।

ভালোবাসার অনুভবে ক্রমশ: পূর্ণ হতে চলা এক বালিকা, ভেতরে-বাহিরে ভাঙতে থাকে… প্রথম প্রেমের সর্বগ্রাসী আগুন জ্বলে… বালক হৃদয়কে সেই আগুনে অবগাহন করিয়ে, দুই হৃদয়ের কষ্টগুলো ভালোবাসার আগুনে পুড়িয়ে, কাছে থেকে পরখ না করলেই যে নিজেকে সে গড়তে পারবেনা। নিজেকে পুণর্গঠন কি খুবই জরুরী?

তাই দুই হৃদয়ের অধিকারিনী বালিকা মুখ ফিরিয়ে সামনের পানে তাকায়। এক আদিগন্ত রহস্যকে ধারণ করে মুহুর্তে বালিকা যেন বড্ড রমণীয় হয়ে ওঠে! বালিকা কি অপেক্ষা করবে? বালিকারা কি অপেক্ষা করে?

প্রথম প্রেম আস্বাদনকারী আমাদের এই বালিকার কি জানা হয়ে গেছে, সে এক নারী। নদীরা কখন নারী হয়? কিংবা নারীরা নদী?
যখন নদী ও নারী ভালোবাসার কথা বলে, তখন কি?

______________________________
** কোট করা লাইনগুলো কবিগুরু রবি ঠাকুরের।
#বালিকা_মামুনের_অণুগল্প

দর্পণ_মামুনের_অণুগল্প

সময়ের সাথে সাথে নিজের কর্মফলে মানুষ নিজ মনুষ্যত্ব হারায়। আবার কর্মগুনেই মানুষ অমরত্বও পায়।

শিহাব যখন মানুষ ছিলো, সেই সময়ের মুহুর্তগুলো মনে পড়ে। কেমন স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যেত দিন। যেন উদাসী গরম দুপুরে, দিঘীর জলে মাতাল সমীরের মৃদু সন্তরণ!

এখন অমানুষ পর্ব চলছে। সময়ের অসময়ের ফোড়ে, মানুষের সাথে সাথে একজন বাবাও হারিয়ে যায়। অক্ষম মানুষ সক্ষম বাবা হতে পারে কি?

এক জীবনে কেউ কেউ কিছুই হতে পারে না। জলে নিজের ছায়া। সেদিকে তাকিয়ে থাকাকালীন নিজের তিন জীবন শিহাবকে ঘিরে ধরে।

#দর্পণ_মামুনের_অণুগল্প_৫১২

আমার আমি

পাশের ফ্ল্যাটে গান বাজছে। অস্পষ্ট গানের কলিগুলো ইথারে ভেসে আসা, পাতা ঝরার দিনের মৃদু নিরবতার বুকে জমে থাকা- শুকনো পাতাদের মর্মর ধ্বনির মতো ঘুমপাড়ানিয়া আবেশ যেন! শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন পালকের প্রচন্ড মাধ্যাকর্ষণ টানকে উপেক্ষা করে, অসহ্য…অলস…গতিতে ভেসে বেড়ানোর অনু্ভূতিতে, একটু বেশী-ই যেন প্রগলভ আজ আমি!

নিজের ছায়াজীবনে এক রিক্ত প্রচ্ছায়া।
দিগন্তের ওপারে এক প্রচন্ড হাহাকার! নেই হয়ে যাবার অনুভূতি কখন শেষ হয়? আসলেই হয় কী?
কিছু একটা আমাকে ঘিরে ধরে। বোধের আকাশ জুড়ে নি:সঙ্গ এক শংখ চিল! নিরবতার শ্যেণ দৃষ্টির ধারালো ফলা, আমার অনুভূতির মগজে চরম কর্কশ- কেটে ছিড়ে ফালাফালা- পাপবিদ্ধ অনুভবের ইমেজ এনে দেয়।

মহাসাগরের গভীরতম এলাকার তীব্র সাইনাস পেইন কিংবা আগ্নেয়গিরির দীর্ঘ জ্বালামুখ দিয়ে পতন মুহুর্তের নেই হবার অনুভবে স্থবির হওয়া, লাভায় গলে গলে ক্ষয়ে যাওয়া-এর থেকেও তীব্র কষ্টকর এক অনুভব ইদানিং আমাকে দগ্ধ করছে।

জীবনকণার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝিনুকের ভেতর মুক্তো থাকা সত্তেও কেবল অভিমান আর অবহেলায় সব উলুবনে ছড়িয়ে গেছে।
আমার কি সম্পর্কগুলোর আরো একটু বেশী যত্ন নেয়া প্রয়োজন ছিল? সময়ের পালক হয়ে থাকা পুরনো সম্পর্কেরা কি আবার আগের মতো কাছে থাকবে!
নিঃশ্বাস দূরত্বে… বিশ্বাসের অনুরণন বেজে ওঠা দূরত্বে…। কাছে-দূরের অনুভূতির একটুও কি এখনো রয়ে গেছে- পলাতক সময়ের বুকে?

আকাশ যেখানে সবুজ ঘাসের ওড়না হতে দিগন্তে নেমেছে, সেখানে এক রংধনুর নিজের সাত রংয়ের আণবিক বিক্ষেপণ- আমার বোধের গভীর থেকে দুর্বোধ্য কিছু একটা বের করে আনে।

একা
একজন আমি।
অনুভূতির কারিগর। সূক্ষ্ণ ব্যবচ্ছেদকারী। ইচ্ছেমত ভাঙ্গি- গড়ি, বোধের সীমানা পেরিয়ে দুর্বোধ্য জগতে হারাতে চাই।

একজন অনুভূতির কারিগর- চেতনার নীলাকাশে নি:সঙ্গ শংখ চিলের বেদনাপ্লুত অনুভবে বিদীর্ণ হই। নিজের ভিতরে পারু হারানোর বেদনার তীব্রতায় অবাক হই…ক্ষয়ে যাই…গলে যাই… আবার জমাট বরফ হই পুনরায় গলে যাওয়ার জন্য।
নি:শেষ হতে চাই।
কিন্ত পারি কি?

বিষন্ন বাতাসে বেলা শেষের অবেলায়, এক ছায়ামানব তার প্রচ্ছায়া থেকে বের হতে চায়। তার উদাত্ত আওয়াজ বেদনার সুদর্শণ পোকাদের সাথে নিয়ে ভেসে বেড়ায়-

‘আমার চলার পথে কিংবা
বাড়ি ফেরার সময়, কয়েদী বহনকারী
নীল গাড়িটি আমি প্রায়ই দেখি। শিকের ওপারে
একচিলতে আকাশ ছুঁতে চাওয়া
অসহায় কতগুলো হাত।
নিঃস্ব কাব্যকলার এক বোবা ভাস্কর্য!

ইদানিং আরো এক জোড়া হাত
আয়তাকার শিকের উপর অসহায়,
নির্ণিমেষ চেয়ে চেয়ে
আকাশ ছুঁতে না পারার অক্ষমতায় স্থবির!
অতি পরিচিত সেই হাত।’

সেই হাত আমার। এক ছায়ামানবের।

বড় রাস্তাটি কিছুদূর পশ্চিমে গিয়ে ঠিক যেখানটায় ডানে মোড় নিয়েছে, আমি ওখানেই থাকি। একজন নবীন লেখক। নিজের মত করে নিজের অনুভূতির প্রকাশক। কিন্তু সেই সাথে আশেপাশের মানুষের অনুভূতি নিয়েও তাডিত হওয়া- একজন লেখকের হৃদয়ে এক অনুপম চিত্র অংকনের তাড়না কেন জানি আমার থেকেই যায়। বোধের মর্মে নাড়া দেয় এমন অনুভূতিতে প্রলুব্ধ হতে কে না চায়!

দুটো লোহার পাতের আয়তাকার ইন্টারফেসে দৃশ্যমান পাথরজীবন আঁধারেও প্রকট এক দানব যেন।

লিখালিখির জগতের একজন শিক্ষানবীশ আমি একজন লেখককে নিয়ে ভাবনার জগতে ডুব দেই। কেউ একজনকে দেখতে পাই। একজন শান্ত মানুষ কি মায়া নিয়েই না অশান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি সেই ধারালো পথ বেয়ে গভীর শান্ত জলের পরমশীতল অনুভূতিতে শান্ত হতে থাকি… একসময় কোমল হই… চেতনার আরো গভীরে ডুবে যাই। একটা অন্ধকার টানেলের ও মাথার দৃশ্যমান আলো , একসময় আমাকে নিজের সেলে ফিরিয়ে আনে।

একজন লেখককে কতগুলো ভূমিকায় নিজেকে দেখতে হয়? কতগুলো হৃদয় ব্যবচ্ছেদ করে অনুভূতির ‘ফাইন টিউনিং’ করতে হয়?

এই সময়ে একজন লেখক ডিজিটাল জকির ভূমিকা পালন করলে ভালো হবে। পাঠকের ভিতরে অনুভূতি ঠিক কতটুকু ওঠা নামা করবে, এই স্কেল অনুভবকারী দক্ষ এক অনুভূতির কারিগরের মত আচরণ করবেন একজন লেখক।
পাঠক হৃদয় নিয়ে লেখক ভাববেন- পাঠককে ভাবতে হবে প্রথমে এটা শিখাবেন…ক্রমান্বয়ে ভাবের গভীর থেকে গভীরতর অংশে যাবার রাস্তাটিতে কিভাবে পথ চলতে হবে, তা শিখাবেন। এভাবে উভয়পক্ষের মনোজগতে এক যোগাযোগ রয়ে যাবে। লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ ম্যাসেজগুলো পাঠকের মনোজগতে আলোড়ন তুলবে, তাকে ভাবাবে, ইমপ্লিমেন্ট করাতে প্ররোচিত করবে। তবেই না ভালো কিছু একটা হবে।
এদিক দিয়ে একজন লেখক, একজন ম্যাসেঞ্জারও বটে।

বাইরের পৃথিবী আঁধারের ঘোমটায় যেন আরো বেশী অন্ধকার দেখায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়াই আমি। ভাবনাদেরকে কয়েকমুহুর্তের জন্য হলেও নির্বাসনে পাঠাতে ইচ্ছে করছে।
“নির্বাসনে! চলে গেছে সব প্রজাপতি” …
ভাবনারা সব তাহলে প্রজাপতি! নিজের মনে হাসি। নিজেকে ব্যংগ করলাম কি?
একজন লেখক কি নিজেকে কখনো ব্যংগ করেন?

চিন্তাজগতে একজন লেখককে বর্ণীল করায় ঠিক যেখানে রেখে এসেছিলাম, ওখান থেকেই একজন আল মামুন খান একাধারে একজন লেখক এবং একজন পাঠকের দুই ভিন্ন সত্তার অনুভূতিতে প্রবল হয়। একই হৃদয়ে দুই ভিন্ন হৃদয়। বোধের উপরে বোধ…ওপারে বোধ। এক দুর্বোধ্য জগত। আরাধ্য জগত?
একজন লেখকের জগত ঠিক কতোটা বড়? একজন লেখক কত বড়?
ঠিক কতোটা বড় হলে একজন লেখকের মৃত্যু হয়? এক রক্তাক্ত জনপদে নির্বাক পড়ে থাকা এক লেখক নিজের শেষ অণুগল্পটি লিখে যেতে না পারার বেদনায় কি নীল হন?

চিন্তা জগতের সরল রাস্তাটি ধরে একজন পাঠক আল মামুন খান একাই যেন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে, এজন্য লেখক আল মামুন খান হাত ধরে রাস্তা পার করানোর নিমিত্ত হন। এইটুই দরকার পাঠকের। তবেই সে পথের শেষে যেতে পারবে। লেখকের আলোয় পথ চলে পাঠক এক পরিণত স্বত্বায় রুপ নেবে। পাঠক লেখকে পরিণত হবে… তিনি নতুন পাঠক কে হাত ধরে রাস্তা পার করাবেন… সে নতুন অন্যজনকে… …
এভাবেই চেতনার পথগুলো সমৃদ্ধ হবে।

এমন যদি না হয়, তবে চেতনা উন্মেষের এই প্ল্যাটফর্মটি পাঠকমনে নিছকই এক দিবস উদযাপনের মত দায়সারা মনোভাবের জন্ম দিবে। মনের খোরাকই যেখানে নেই, সেই প্ল্যাটফর্মের লেখকেরা কালক্রমে সুবর্ণ অতীত হবেন…হারিয়ে যাবেন! ওখানের বাতাস- বিলুপ্তপ্রায় লেখকদের দীর্ঘশ্বাসে ভারী, গতিতে মন্থর, স্থবির হয়ে থাকবে!

এজন্য পাঠকের মনকে অনুভব করাতে হবে, তার মনের গোপন দরোজাগুলো এখন ধীরে ধীরে খুলে দেবার সময় এসে গেছে। জনপ্রিয়তার লোভের চেয়ে পাঠক প্রীতিতে লেখক হৃদয় পুর্ণ থাকবে।
ভালোবাসা শিখাবেন- পাঠক হৃদয়কে এলোমেলো করবেন, কিভাবে ভালোবাসতে হয়- অনুভব করাবেন নিজের লেখনির সাবলিলতায়- পরম দক্ষতায়।

লেখকের মনোজগতের সিঁড়ি পাঠকের মূল লক্ষ্য। লেখক ওপারে শেষ ধাপে পাঠকের পথের শেষে সফল প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় থাকবেন। একজন দক্ষ গাইডও একজন লেখক। নিজের মনোজগতে বিচরণকারী পাঠকের নিজেকে, সমাজের লক্ষ-কোটি সিংগেল ইউনিট পাঠকের অন্যতম হয়ে সঠিক পথ চলতে হবে। এ যাত্রায় আঁধার কোনো প্রতিবন্ধকতারই সৃষ্টি করতে পারবে না। আঁধারে পথ চলার মত আলো পাঠক ইতোমধ্যেই অর্জন করেছেন।

আলো বিতরণকারী একজন লেখককে আলো হতে হয়। কঠিন সাধনায় নামতে হয়।

আলো হবার সাধনায় নেমে একজন আমি, এই মুহুর্তে নিজের সেলের একচিলতে ইন্টারফেসে আঁধারের পিছু ধাওয়া এক উল্কার পতন দেখতে থাকি… নক্ষত্রগুলোর পতন কেমন? অনুভবে এক নক্ষত্রের পতনের নিম্নগতি উপলব্ধিতে আল মামুন খানকে বিহ্বল করে তোলে।।

#আমার_আমি