জসীম উদ্দীন মুহম্মদ এর সকল পোস্ট

প্রগতির টিয়ে

একদিন মাটিতে বোধের শক্ত দেয়াল ছিলো
সেই দেয়ালে কোনো শেওলা ছিলো না
সচেতন ঘাস, লতাগুল্ম আনমনেই বড় হতো
সেই দেয়ালটি এখন কোথায় গেলো..?

উড়োচিঠিতে যে মেয়েটি ভালোবাসি লিখেছিলো
সামনাসামনি দেখা হতেই সে লজ্জাবতী লতা হলো
তখন সামাজিক দালান বোধ চীনের প্রাচীর ছিলো!

এখন একদিনে প্রেম হয়, দুইদিনে বিয়ে
তিনদিনে ভালোবাসা নিয়ে যায় প্রগতির টিয়ে!!

মৃতনদী অথবা নারী

আজকাল রাতের সাথে কয়জনের কথা হয়?
বড়জোর অন্ধকারের সাথে সন্ধি হয়!
অত:পর ভোর হওয়ার আগেই বিতাড়িত নদী
ফিরে এসে আরেকটি ভোরের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয়!
অতঃপর সেও সন্তর্পনে মন্থর এগিয়ে যায়
কোনোএক মৃতনদী অথবা মৃত নারীর মতোন
অবশ্য এই যুগে কে আর দেবদাস হতে চায়?

অলীক আশ্বাসে যদি ভেঙে যায় দেবতার ঘুম
তবে সে কেমন দেবতা?
উপসর্গের পাঠ অনেক আগেই চুকিয়ে দিয়েছি
বড়ো সস্তায় বিকিয়ে দিয়েছি সভ্যতা
নইলে তুমি যতোই পুজো দাও তারে…আমার
অর্ঘ্য থেকে রেহাই পাবে না কোনো অপদেবতা!

প্রশ্ন করো না কেউ

কেউ প্রশ্ন করো না, এতোদিন কোথায় ছিলেন?
জীবনানন্দের মতো আমিও তাঁরে খুঁজতে গিয়েছিলাম বনলতা সেন!
রোজ রোজ কতো কতো ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া, শিমূল, পলাশ
এতো রঙের আবির মেখেছো গায়ে, কেউ কি করেছো আমার তালাশ!
লজ্জা ঘষে ঘষে আমিও কুড়িয়েছি নীল লোহিত
আশার দোলকে গোলক ধাঁধাঁর মতো ঘুরছি আধা পক্ক কেশী রোহিত!
ক্লান্তি আমাকে ক্লান্ত করে না রুপোলি নদীর ঢেউ
চিলের ডানার মগ্ন আছি শূন্য জলপাত্রে, সঙ্গী হবে নাকি মোর কেউ?

জিবরাইলের ডানা’র চিত্র এবং চিত্রপট

ffh বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অধ্যাপক শাহেদ আলী বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবী। যিনি সারাজীবন অনেকটা নীরবে-নিভৃতে সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। তিনি ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের একজন অন্যতম ভাষাসৈনিক। তিনি একাধারে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, অনুবাদক, গবেষক। তিনি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মে সাবেক সিলেট তথা বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলবী ইসমাইল আলী এবং মাতা আয়েশা খাতুন।

শাহেদ আলীর বাল্য এবং কৈশোরকালও গৌরবময়। তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা, সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্যাচেলার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। অত:পর তিনি ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে বগুড়া আজিজুল হক কলেজেের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত মিরপুর বাংলা কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ ও চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে খেলাফতে রব্বানী পার্টির নমিনেশনে সুনামগঞ্জ থেকে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। অধ্যাপক শাহেদ আলী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (সাবেক ইসলামিক একাডেমী) প্রতিষ্ঠাতা সচিব ছিলেন। এরপর ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ ও সংকলন বিভাগের পরিচালকের হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। চল্লিশের দশক থেকেই শাহেদ আলী সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৪-৪৬ খ্রিস্টাব্দে মাসিক প্রভাতি এবং ১৯৪৮-৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকাদ্বয় সুনামের সাথে সম্পাদনা করেন। ১৯৫৫ সালে দৈনিক বুনিয়াদ সম্পাদনা করেন। ইসলামী ফাউন্ডেশনের বিখ্যাত শিশু মাসিক সবুজ পাতার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক মিল্লাতের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী পত্রিকার সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ইসলামী বিশ্বকোষের সম্পাদনা বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক শাহেদ আলী বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাছাড়া ১৯৪৮-৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সার্বিক কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি তমুদ্দন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

এবার আসা যাক, প্রিয় কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলীর সাহিত্যকর্মের নানাবিধ বৈচিত্র্যময় দিক প্রসঙ্গে। ১৯৪০ খ্রি: সওগাত পত্রিকায় শাহেদ আলীর প্রথম গল্প “অশ্রু” প্রকাশিত হয়। এরপর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ক্রমান্বয়ে গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। শাহেদ আলী ছিলেন একজন জীবনধর্মী লেখক। মানব জীবনের গভীর আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, দর্শন তিনি নিঁখুত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর লেখা :

গল্পগ্রন্থঃ জিবরাইলের ডানা (১৯৫৩), একই সমতলে (১৯৬৩), শা’নযর, (১৯৮৫) অতীত রাতের কাহিনী (১৯৮৬), অমর কাহিনী (১৯৮৭), নতুন জমিদার (১৯৯২), শাহেদ আলীর শ্রেষ্ঠ গল্প, শাহেদ আলীর নির্বাচিত গল্প ইত্যাদি। উপন্যাসঃ হৃদয় নদী (১৯৬৫),

প্রবন্ধ-গবেষণাঃ একমাত্র পথ, তরুণ মুসলিমের ভূমিকা, ফিলিস্তীনে রুশ ভূমিকা, সাম্রাজ্যবাদ ও রাশিয়া, তরুণের সমস্যা, বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান, তাওহীদ, বুদ্ধির ফসল আত্মার আশিষ , ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা, Economics Order Of Islam, জীবন নিরবচ্ছিন্ন, Islam in Bangladesh, জীবনদৃষ্টি বিপর্যয়ের হেতু, অন্যরকম আমেরিকা ইত্যাদি।

শিশুতোষঃ রুহীর প্রথম পাঠ, ছোটদের ইমাম আবু হানিফা, সোনার গাঁয়ের সোনার মানুষ, নাটিকা: বিচার আত্মজীবনী: জীবনকথা অনুবাদ গ্রন্থ: মক্কার পথ, মূল: মুহাম্মাদ আসাদ, ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার মূলনীতি, মূল: আল্লামা আসাদ আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক মানুষ

মূল: কে বি এইচ কোনান্ট ইতিবৃত্ত,
মূলঃ হিরোডাটাস ককেশাসের মহানায়ক
মূলঃ ইমাম শামেলি।
তিনি জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এই যেমন: বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪) ভাষা আন্দোলন পদক (১৯৮১), নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৫), লায়ন ক্লাব পদক(১৯৯২), ইসলামিক ফাউণ্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৯) দুবাই সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২), ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৭) রাগিব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮) কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার, জাসাস স্বর্ণপদক (২০০০) তমদ্দুন মজলিস মাতৃভাষা পদক (২০০০) কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর, ২০০৩) এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পুরস্কার ইত্যাদি। বহুধা প্রতিভার অধিকার শাহেদ আলী ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

এবার তাঁর সবচেয়ে আলোচিত এবং আলোড়িত গ্রন্থ “জিবরাইলের ডানা”র চিত্র এবং চিত্রপট প্রসঙ্গে। পঞ্চাশের দশকের জিব্রাইলের ডানা গল্পের মাধ্যমে যে নামটি সবার মনে আলোড়ন তুলেছিল ,তিনি আর কেহ নন, সুনামগঞ্জের হাওরের গর্ব, কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলী। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে জিব্রাইলের ডানা গল্প পড়তে গিয়ে নামটির সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আলোকিত ও আলোচিত ছোটগল্প জিব্‌রাইলের ডানা, যেটা সবার মনে সাড়া জাগিয়েছিল, যারা পড়েছেন তাদের মনে রেখাপাত করে আছে এখনও, সেই গল্পের লেখক এবং সুনামগঞ্জের আলোচিত ভাষাসংগ্রামীদের একজন অধ্যাপক শাহেদ আলী, যিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কথাশিল্পীই নন, তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল অনুবাদ-সাহিত্যিক এবং আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক।

তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ জিব্‌রাইলের ডানা যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি প্রচুর প্রশান্তি পান আর সেখানে ফুটিয়ে তোলেন দরিদ্র ঘরের একটি সন্তানের আশা ও আশ্বাসের। তাঁর মনে কোনো ক্ষোভ ছিল না, ছিল সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক কোমল মন। জিব্‌রাইলের ডানা গল্প দিয়ে তিনি সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেয়েছেন। এই জিব্‌রাইলের ডানা নিয়ে বিশ্বখ্যাত অনেক পরিচালক ছবি করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোথাও কোনো সমস্যা ছিল বিধায় তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে এ নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপ ছিল না।

গল্পটি আমি ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি কতোবার যে পাঠ করেছি; তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গল্পের নামকরণের ভেতর যেমন একটি ঘোরলাগা ভাব ব্যঞ্জনা আছে, তেমনি ভেতরেও অনন্ত রহস্যের সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। নবী চরিত্রের নিঁখুত বিনির্মাণের মাধ্যমে লেখক গল্পটিকে নিয়ে গেছেন অনন্য এবং অতুলনীয় এক উচ্চতায়। হালিমা এবং নবী মা এবং পুত্র। ক্রমাগত দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে মহান স্রস্টার প্রতি মা হালিমার মন যখন অভিমানী; তখনই পুত্র নবী একদিন দুই ডানা বিশিষ্ট নুরানি চেহারার কাউকে দেখেন। তার ডানাগুলো ছিল ময়ুরের পেখমের চেয়েও সুন্দর। আসল ঘটনা হল, হালিমা এবং নবী একই সাথে বসেছিল। কিন্তু সেই নুরানি ডানা বিশিষ্ট কাউকে কেবল নবী দেখেছে; কিন্তু হালিমা দেখেনি। আর তাই হালিমার ক্ষত বিক্ষত মন সেটা মানতে রাজি হতে চায়নি। কিন্তু হালিমা মানুক…. কিংবা না মানুক.. নবীর দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি নিশ্চয়ই ফেরেশতা জিবরাইল।

অসংখ্যবার গল্পটি পাঠের পর আমার কাছে মনে হয়েছে “জিবরাইলের ডানা” মুলত একটি ছায়া গল্প। লেখক এখানে প্রতীকী ভাবে শিশুনবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) এবং তাঁর দুধমাতা মা হালিমার চরিত্র মাধুর্যের সরাসরি না হলেও প্রতীকী রুপায়নের চেষ্টা করেছেন। যদিও গল্পের ঘটনার সাথে শিশুনবী মুহাম্মদ (সা) এবং মা হালিমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বাস্তবিক অর্থে কোনো মিল নেই। তবুও এর রেশ আছে বলেই আমার বিশ্বাস৷ আর সম্ভবতঃ এখানেই প্রিয় গল্পকার শাহেদ আলীর সার্থকতা। লেখকের প্রিয় রং ছিল নীল। তাই গল্পের নায়িকাকেও তিনি নীল রঙে রঙিন করে তুলেছেন বিভিন্ন গল্পে। তাঁর জিব্‌রাইলের ডানা উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি ও রাশিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। গল্পটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং নিগুঢ় রহস্য, নবী ও তার মা হালিমার কথোপকথনের মাধ্যমে সরল, সহজ এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

গত ২৬ মে ছিল প্রয়াত কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলীর জন্মদিন। কিন্তু একটি জাতীয় পত্রিকাও এ বিষয়ে কোন লেখা প্রকাশ করেনি। যা অত্যন্ত বেদনার এবং হতাশার। এই উপেক্ষা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাছাড়া আমরা মনে করি, শাহেদ আলীর লেখা নিয়ে আরও বেশি গবেষণা হওয়া উচিত। তাতে করে আমরাই লাভবান হবো।।
————–

পাথুরে প্রলাপ

আসুন ভালো কথা বলি অথবা নীরব থাকি
ব্যথা, বেদনা এসব জীবনেরই অংশ
আসুন, এবার পাথর দিয়ে পাথর ঢাকি!

সব ভুল যেমন ভুল নয়
সব ভালো যেমন ভালো নয়
সব জল যেমন জল নয়
তেমনি সব বেদনাও জাতি সাপের বাচ্চা নয়

সড়ক পথও পথ, রেলপথও পথ
তবে এক নয় রাজার মত আর প্রজার মত!
রাজা মশাই যা-ই বলেন তাই সইত্য
কবিরাজ যা বলেন তাই পইথ্য
আর প্রজা যা বলে সেটাই অকইথ্য!!

মধ্যরাত্রির বোবাকাহিনী

2719606

০১
রাত তখন সবেমাত্র পাকতে শুরু করেছে। কয়টা বাজে কি বাজে না, কিছুই আমার ঠাহরে নেই। হাতে কোনো হাতঘড়ি নেই। দেয়ালেও কোনো ওয়ালঘড়িও নেই। আমার চারপাশে কেবল সুনশান কিছু নীরবতা আছে। আমার রুমমেট ফরহাদ, আতাউর, শাহজাহানের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দযোগে অসম প্রতিযোগিতা আছে। আর আছে অকালে যৌবন খোয়ানো আমার এই সময়ের শ্রেষ্ঠ প্রেমিকা নরসুন্ধা। সে ঘুমিয়ে আছে, না জেগে আছে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। উঠতি শীতের রাত্রি হওয়ায় হালকা কুয়াশার ধুয়াশা আছে। আর যাদের কথা না বললেই নয়, উনারা হলেন আকাশের কিছু মিটিমিটি নক্ষত্ররাজি। উনাদের কেউ কেউ হাসছে। আর কেউ কেউ জোনাকির সাথে পাল্লা দিয়ে গাইছে।

ছাত্রাবাসে আমার পড়ার সিস্টেমটা কিছুটা ব্যক্তিক্রম ছিল। আমার রুমমেটরা যখন পড়তো, তখন আমি চুপচাপ শুয়ে থাকতাম। ওরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে জোরে জোরে পড়তে পছন্দ করতো। পড়তে পড়তে ওদের মুখ দিয়ে ফেনা ছুটতো। সেই ফেনা রিডিং টেবিলের আনাচে-কানাচের শোভা বর্ধন করতো! একই লাইন বারবার তোতাপাখির মতোন মুখস্ত করতো। যদিও ওদের পড়তে মোটেই বিরক্ত লাগতো না, তবে শুনতে আমার মাঝেমাঝেই বেশ খারাপ লাগতো। তবুও তখন আমি অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিতাম। অতঃপর ওদের পড়া যেখানে শেষ হতো, সেখান থেকেই আমার পড়া শুরু হতো। আমি একটি বই সামনে নিয়ে বসে বসে অথবা শুয়ে শুয়ে রিডিং পড়তাম। এই পড়ার কোনো সাউন্ড নেই। এমন কি আমার ঠোঁট দুটি পর্যন্ত নড়তো না। আমার চোখ দেখে আর আমার মন পড়ে। অতঃপর পরীক্ষার খাতায় আমি আমার মতো করে নিজের ভাষায় লিখি। এই হলো আমার চিরায়ত প্রথা বিরুদ্ধ পড়ার রীতি।

যে বীজতলা সময়ের কথা বলছি, তখন আমি গুরুদয়াল সরকারী কলেজে একাদশ শ্রেণির সিঁড়ি ডিঙাতে ব্যস্ত। আজ বাদে কাল এগজামিন। কলেজের ওয়াসিমুদ্দিন মুসলিম ছাত্রাবাসের ৫ নং কক্ষে আমরা এই চারজন থাকি। আমার সিটটি একেবারে নরসুন্ধার বুক ঘেষে। আমি আর নুরসন্ধা যখন খুশি ইচ্ছে মতো কথা বলি। সুখ-দুখ ভাগাভাগি করি। এখন রাত ২ টা ২১ মিনিট। হঠাৎ কী মনে করে তিন আঙুল সময় আগে বন্ধ করা জানালাটি খুলে দিলাম। খুলে দিতেই শীতল হওয়া আর নরসুন্ধার চাঁদ মুখ আমাকে ঘিরে ধরল। কেন জানি না একলাফে আমার চোখ নরসুন্ধার বুক বরাবর গিয়ে থামল। এরপর যা দেখলাম, তখন আমি বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস কিছুই করতে পারলাম না। ভয়ে যত দ্রুত পারা যায় জানলাটি নিঃশব্দে বন্ধ করে দিলাম।

০২
আমার চোখকে ছানাবড়া করে দিয়ে নরসুন্ধার ঠিক মাঝ বরাবর থেকে তিন কি চারজন অথবা পাঁচজন মানুষের সমান লম্বা একজন মানুষ নদীর ভেতর থেকে উঠে এলেন। গায়ে জামা আছে কি নেই, চোখ দুটি আগুনের মতো লাল কি কয়লার মতো কালো…এতোটা দেখার মতো সময় আমি পাইনি। কেবল এইটুকু দেখেছি উনি পানির উপর দিয়ে শান্ত পদবিক্ষেপে আমার ছাত্রাবাসের দিকে ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছেন। এই জাতীয় অনেক রমরমা ঘটনা, দূর্ঘটনা এর আগে কেবল লোকমুখে বয়ান শুনেছি। কিন্তু কোনোদিন স্বচক্ষে দেখার মতো সৌভাগ্যি আমার হয়নি। অতঃপর মনকে পাষাণে বেঁধে শপথ নিলাম, হিমালয় পর্বত ভাঙে ভাঙুক, আমি এর শেষ দৃশ্য পর্যন্ত অবলোকন করবো।

তখনো আমার জানা ছিলো না ছাইচাপা করে যেমন আগুন নিভানো যায় না, চোখ বন্ধ করলেই যেমন বিপদ দূর হয়ে যায় না, তেমনি আমি জানলা বন্ধ করেও তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারিনি। তবে আমি তখনো চেয়ারে বসা। সামনে খোলা বই। বুকের ভেতর একটা টোলপড়া ভাব। পড়বো কি পড়বো না, জানলা আবার খুলবো কি খুলবো না.. সিদ্ধান্ত নিতে না নিতেই আমার জানলায় ঠক ঠক করে সাড়ে তিনবার আওয়াজ হলো। এই সাড়ে তিনের ব্যাখ্যা হল, প্রথম তিনটা সমান সমান জোরে আর শেষেরটা একটু কম । কিছু বুঝতে বাকি থাকবে এতোটা গাধা আমি নিজেকে মনে করি না। ভয়ে আমার জীবন নদী শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছিলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আজন্ম পিপাসা। তবুও আমি অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে চেয়ার থেকে একচুলও নড়লাম না।

জানলার বাইরে থেকে আর কোনো সাড়া শব্দ পেলাম না। এতক্ষণ যা দেখেছি, যা শুনেছি… এসব কিছুকে মনের ভুল বা হ্যালোসিনেশন ভেবে উড়িয়ে দিবো বলে যখনই ঠিক করলাম, ঠিক তখনি আমার কাছে মনে হলো কেউ যেনো জানলার পাশ থেকে সরে যাচ্ছে। তবে অবশ্য-ই সে সরে যাওয়া শব্দহীন, নৈঃশব্দের বাতিঘরের মতোন। বুঝা যায় কিন্তু ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। অনুভবের সিঁথিতে সাঁতার কাটা যায়। তবুও আমার মন থেকে আচ্ছন্ন আচ্ছাদন বিদূরিত হলো না। কেবল মনে হতে লাগলো, এখানেই শেষ নয়। খেলা সবে শুরু।

০৩
আমার জানলার পাশ থেকে কয়েকটা রুম ঘুরে দরজায় আসতে মিনিট দুই মতো লাগার কথা। অথচ ঠিক ১১ সেকেণ্ড এর মাথায় রুমের দরজার আবার সেই সাড়ে তিনবার ঠক ঠক শব্দ হল। শব্দের হার্জ একই সমান। জানলায় হওয়া শব্দের চেয়ে একচুল কম বা বেশি নয়। এবার আমার পায়ের তলা থেকে নগদ মাটি সরতে শুরু করেছে। তবে এখন আর আগের মতো বুকের ভেতরের টোলপড়া ভাবের গল্পটি নেই। এই জায়গাটিতে সমস্ত আকাশ-পাতাল এসে ভর করেছে। আমার রুমমেট বন্ধুরা তখনো ঘুমের সাগর পাড়ি দিচ্ছেন। আর আমি একা একা এই শ্বাপদসংকুল পথ পাড়ি দিচ্ছি। তবুও আমি একবার সাহস করে দরজার দিকে তাকালাম। এরপরের দৃশ্য নমরুদের অগ্নিকুণ্ডের চেয়ে কোনোওংশে কম ভয়ংকর নয়। আমি একেবারে হিম হয়ে গেলাম।

আমার রুমের পাকা দেয়াল ভেদ করে একটি হাত অবলীলায় ভেতরে চলে এলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার সামনে জ্বলতে থাকা একমাত্র সোডিয়াম লাইটটি ধপ করে নিভে গেলো। এক লোকমা সময়ের হাজার ভাগের একভাগের চেয়েও কম সময়ে আমার সমস্ত পৃথিবীটা অন্ধকারের অতল গহব্বরে তলিয়ে গেলো। আমি সাথে সাথে ইন্না লিল্লাহহি অইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়া শুরু করে দিলাম। বুকের ভেতরটা আয়লার মতো ধড়পড় করছিলো। বিপদের গন্ধ পেলে আমার বাম চোখ সাধারণত পিটপিট করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এখনো সে পিটপিট করা শুরু করছে না। তবে কি এতোক্ষণ যা ঘটলো তার কিছুই ঘটেনি? সবকিছু আমার পরীক্ষা উৎকণ্ঠিত মনের ভুল? আবার আমি ইন্না লিল্লাহ পড়তে পড়তে সাহসী হয়ে উঠলাম। পুরো হোস্টেল অঘোরে-বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমার রুমমেটদের নাক ডাকার প্রতিযোগিতা এখনও সমান তালে চলছে।

আমি কাউকে ডাক দিলাম না। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে একটি পাতাঝরা সময়ের জন্য কানকাটা আবদ্ধ জানলাটি খুলে দিলাম। কোথাও কেউ নেই। সবকিছু স্বাভাবিকের চেয়েও একটু বেশিই স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। শান্ত সমাহিত নরসুন্ধার টুনটুনি জল। বাইরে থেকে কিছুটা আলো এসে ডাকাতের মতো আমার রুমে ঢুকলো। সে আলোয় যেনো সমস্ত আন্ধার দুনিয়া ক্ষণিকের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। আমি ভয়ে ভয়ে লোমকূপ খাড়া হওয়া সময়ের পোস্টমর্টেম করছিলাম। তদুপরি একপা, একপা করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ওয়ালে কোনো ফোঁকর নেই। লাইটের সুঁইচ ঠিক ঠিক বন্ধ করা। কে বন্ধ করলো—-এই সহজ প্রশ্নটি আমার কাছে এই মুহূর্তে বিশ্বজগতের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন বলে মনে হতে লাগলো। তাহলে কি এতোক্ষণ যা ঘটেছে সব সত্য?

০৪
কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক এই জলজ্যান্ত সত্যকে অস্বীকার করার মতোন বিশ্বাসঘাতক আমি নই। হয়ত কোনোদিন হতেও পারবো না। আমি জানি, এই ঘটনা অস্বীকার করা মানে তো চাঁদ, সূর্যকে অস্বীকার করা। আকাশ, বাতাসকে অস্বীকার করা। তারচেয়েও বড় কথা, এই ঘটনা অস্বীকার করা মানে আমার নিজেকে অস্বীকার করা। আর কিছু সম্ভব হলেও এ আমার পক্ষে কোনোদিন সম্ভবপর নহে। কারণ এই ঘটনার সাক্ষী আমার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। এখনো তারা দাঁড়িয়ে অসংকোচ সাক্ষ্য প্রদান করে যাচ্ছে। কেন জানি আমার মন বলছিল এখানেই শেষ নয়। মূল দৃশ্য এখনো বাকি আছে।

দরজা খোলার মতো সাহস আমার নেই। তবুও ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখার প্রচেষ্টা করলাম পাশের রুমের লাইট জ্বালানো কিনা। অতীব আশ্চর্য কথা ৬ নাম্বার রুম থেকে আলো আসছে। তার মানে কারেন্ট আছে। কেবল আমার রুমে নেই। সুইচটি অন করবো সে সাহসও পাচ্ছি না। অন করলে জ্বলবে কি জ্বলবে না আমার সে বিশ্বাসে মস্তবড় একটি ফাটল ধরেছে। তবুও ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে আমার বিশ্বাসের সহিত আরো বিশ্বাস যুক্ত হল। আমি একবার পড়ার টেবিলের বসি। আরেকবার খাটে আধশোয়া হয়ে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করি। অন্ধকার আমার চিরদিন ভালো লাগে, তবে সেদিনের অন্ধকার মোটেই ভালো লাগছিলো না। একেবারে বিচ্ছিরি, হতচ্ছারি এবং বীভৎস লাগছিলো। এই অজৈব অন্ধকারের সাথে আমার কোনো পরিচিতি নেই অথবা কোনোদিন ছিলোও না।

এমন সময় যেমনটি আমি আশংকা করছিলাম, ঠিক তেমন কিছু ঘটার মহাসংকেত পেলাম। আশেপাশের কোথাও থেকে একটি চরম গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। এমন গোঙানি আমি জীবনে কোনোদিন শুনিনি। কেউ শোনেছে কিনা তাও জানি না। গোঙানিটি এমন যে, কোন মানুষকে গলা কেটে হত্যা করার সময় অথবা কোনো পশুকে জবাই করার সময় যেমন ঘড়ঘড় আওয়াজ বের হয় ঠিক তেমন।

০৫
ভীষণ ভয়ে আমি কুঁকড়ে গেলাম। এবার আর একা একা সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো দুঃসাহস দেখাতে গেলাম না। রুমমেটদের সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। ওরা যে আমার চেয়ে বেশি ভীতু একথা আমার জানা ছিলো না। অসমসাহসী, অকুতোভয় পালোয়ান ফরহাদ বলল,
এ নিশ্চয় কাউকে গলা কেটে হত্যা করা হচ্ছে। দরজা খুলবি না, খবরদার।
ফরহাদকে সাথে সাথে সমর্থন জানিয়ে আতাউর বলল, একদম ঠিক কথা বলেছিস। এই মধ্যরাতে ঝামেলায় জড়ানোর কোনো মানেই হয় না।
কেবল শাহজাহান, যে সাধারণত চুপচাপ থাকে; কারো সাথে কোনো বীরত্ব ফলায় না….সে বলল,
ঘটনা যা-ই হোক না কেন, আমাদের ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা উচিত। মানুষ হলে আমরা তা এড়িয়ে যেতে পারি না।
আমি তখন তাড়াতাড়ি করে বললাম, তুই ঠিক বলেছিস সাজু। সাজু শাহজাহানের ডাক নাম। ভীতুর ডিমগুলো যাক আর না যাক; চল আমরা দু’জন গিয়ে দেখি কোথাকার জল কোথা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
যেই কথা সেই কাজ। শাহজাহান আর আমি দরজা খুলে তাড়াতাড়ি বের হলাম। আমাদের বের হতে দেখে ফরহাদ ও আতাউর আর নিজেদের ধরে রাখতে পারলো না। ওরাও এসে আমাদের সাথে যোগ দিলো। তখন যে আরও রহস্য লুকিয়ে ছিলো কে জানতো?
আমাদের কাছে মনে হতে লাগলো শব্দটি ডানে, বামে, সামনে, পেছনে সবদিক থেকে আসছে। কী মহামুশকিল!
এমন গোঁলক ধাঁ ধাঁ এবং ভোজবাজির বেড়াজালে আমি জীবনে পড়া তো দূরের কথা কোনোদিন কল্পনাও করিনি।

০৬
আমি এবার আয়াতুল কুরশি পড়া শুরু করে দিলাম। মনের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা ভয়টি এখন আর নেই। আমি ওদের পূর্বেকার কোনো কথাই বললাম না। হঠাৎ আমার কাছে মনে হলো গোঙানির আওয়াজটি ৯ নম্বর রুম থেকে আসছে। এই রুমে জুয়েল থাকে। নিকলীতে বাড়ি। আমার বাড়ি থেকে আড়াই মাইল পূর্বদিকে। হাওর এলাকা। জুয়েল ছেলে হিসাবে মন্দ না। তবে সে একটু বেশিই ছনমনে।

কিছুক্ষণ দরজায় ধাক্কাধাক্কি করার পরও না খোলায় শেষ পর্যন্ত আমরা দরজা ভেংগে ফেললাম। ঘটনার নায়ক আসলেই জুয়েল। ওর সমস্ত মুখ থেকে লালা নির্গত হচ্ছে। জবাই করা পশুর মতো হাত-পা ছুড়ছে। একেবারে মারা যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত। এই সময়ে আমরা দরজা না ভাঙলে কি ঘটতো আল্লাহ মালুম। রুমে সে একা। রুমমেটরা কেউ নেই। আমি ওকে ছুঁয়ে দিতেই পানি পানি বলে একটা চিৎকার দিলো। ফরহাদ একজগ পানি এনে দিলো। জুয়েল এমনভাবে পানিটা খেলো যেনো জগে মাত্র একচুমুক পানি ছিলো। আমরা তাজ্জব বনে গেলাম। এক নিশ্বাসে পানিটুকু খেয়েই সে আবার মরার মতো লুটিয়ে পড়লো। রাত তখন অনেকাংশ পেকে গেছে। তিন কী সাড়ে তিন হতে পারে।

কী মনে করে আমি একবার বাইরে থাকালাম। আমাদের ছাত্রাবাসের যে অংশে টি ভি রুম, তার পেছনে একটি বিশাল গাছ। গাছটির নাম আমার জানা নেই। আমার চোখ প্রথমেই সেদিকে গিয়ে চড়ক গাছে পরিণত হলো। কিছুক্ষণ আগে যিনি নরসুন্ধা থেকে উঠে এসেছিলেন, সেই তিনি তিরতির করে গাছটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। কোনোরকম হাতের ব্যবহার ছাড়াই তিনি হেঁটে হেঁটে গাছটিতে উঠে গেলেন। এরপর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি যেনো নিজের চোখকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কাউকে কিছু বললামও না। নীরবে-নিভৃতে সবকিছু বদহজম করলাম।

কিছুক্ষণ পরে জুয়েলের জ্ঞান ফিরে আসলে জানা গেলো তাকে বোবা ধরেছিলো। তালগাছের মতোন লম্বা একটা লোক তার বুকের উপর চেপে বসে ধারালো ছুরি দিয়ে তার গলা কাটছিলো। এই যে সে এতো চিৎকার, চেঁচামেচি করছে গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হচ্ছে না।

০৭
আমার গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারতো। যদি না এ বিষয়ে আমার কোনো পাদটীকা না থাকতো। উদ্ভুত ঘটনাটি শুধু বাস্তবের কাছাকাছিই নয়। একেবারে বাস্তবিক। আমি নিশ্চিত আমার স্মৃতি আমার সাথে কোনো ধরণের প্রতারণা করেনি। বেঈমানি করেনি।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ঘটনাটির ব্যাখ্যা কী? নরসুন্ধা নদ থেকে উনার উঠে আসা, জানলায়, দরজায় ঠকঠক শব্দ করা, লাইট অফ করে দেওয়া পুরোটাই হ্যালোসিনেশন কিংবা আমার ভ্রমদৃষ্টি? নাকি অন্যকিছু? তাছাড়া বোবা ধরা নতুন কিছু নয়। আমিও বেশ কয়েকবার এর শিকার হয়েছি। এ নিয়ে সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা যেমন আছে। তেমনি ভৌতিক ব্যাখ্যাও কম নেই। এই রহস্যের জট কি কোনোদিন খুলবে? হয়ত খুলবে; নয়ত খুলবে না!!

নজরুল সাহিত্যে বিদেশি শব্দের প্রভাব

jasim বলা হয় বাংলা সাহিত্যে ধুমকেতুর মতো যার আবির্ভাব, তিনিই হলেন আমাদের জাতিসত্তার প্রধানতম কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ধুমকেতুর সাথে তুলনাটি মোটেই অমুলক নয়। যখন তাঁর লেখালেখির জীবন সবেমাত্র যৌবন ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছে, তখন তিনি লেখার ক্ষমতা হারালেন, বাকশক্তি হারালেন। ভাগ্যের এই নিষ্ঠুর পরিহাসে ধুমকেতুর মতো আলো জ্বেলে সহসাই সাহিত্য অঙ্গন থেকে বিদায় নেন। আমরা তথা গোটা বাংলা সাহিত্য বঞ্চিত হলাম ধারালো তলোয়ারের মতো ক্ষুরধার লেখনি থেকে। সাহিত্য প্রেমী সকল মানুষ তখন শোকে কাতর, মুহ্যমান। হয়ত নজরুল সারাজীবন লিখতে পারলে বাংলা সাহিত্য রবি ঠাকুরের পর আরও একটি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির গৌরব করতে পারতো, অহংকার করতে পারতো। নজরুল কে ছিলেন, আসুন আমরা তার নিজের মুখেই শুনি- ১৯২৭ সালে এক সাহিত্য সভায় তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভন্ডামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।’

যে কোনো ভাষাতেই অন্য ভাষার শব্দ আত্মীকরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ঔপনিবেশিক কিংবা অন্য কোনো কারণে এই আত্মীকরণের ঘটনা ঘটে যাকে। তবে আত্মীকরণের এই প্রভাব সকল কবি, সাহিত্যিকের বেলায় সমান নয়। কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রভাব কম আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রভাব বেশি। সম্ভবতঃ বাংলা সাহিত্যে যার লেখায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি তিনিই হলেন আমাদের প্রাণের কবি, বিদ্রোহী কবি, দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুল অভিধান শব্দসূত্রে জানা যায়, মুসলিম সংস্কৃতির মন, মনন ও চিন্তনের দিকেই শুধু নয়, হিন্দু সংস্কৃতির গভীর থেকে গভীরতর এবং বাঙালি সংস্কৃতির দ্যোতনার দিকেও সবাইকে যিনি উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন, তিনিই আমাদের প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দেশি-বিদেশি শব্দের নিত্যনতুন বাহারে কিংবা যথার্থ ব্যবহার দিয়ে তিনি সবশ্রেণির পাঠককে বেঁধে রেখেছেন। কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে,হুঙ্কার দিয়েছেন আবার কখনও মানবতার জয়গান গেয়েছেন।

তাঁর সাহিত্যকর্মে আরবি-ফারসি শব্দের বেশ ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। যদিও কবি নজরুলের আগেও অনেক কবি এবং লেখক আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তবে তা ছিল নিতান্তই সীমিত, সীমিত মাত্রায়। এখানেই নজরুল সত্ত্বার স্বাতন্ত্র্য। তিনি পদ্য, গদ্য, কিংবা গান সবক্ষেত্রেই বিদেশি শব্দের ব্যবহার করেছেন অন্যদের তুলনায় ঢের বেশি। তবে কেবল আরবি-ফারসিই নয়, তিনি উর্দু ও হিন্দি শব্দের ব্যবহারও করেছেন সমানতালে। যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল, তার ব্যবহৃত এসব শব্দের অধিকাংশই এখন বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। আবার কিছু শব্দ আছে কোনোভাবেই বাংলার সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে অব্যবহৃতই থেকে গেছে।

এ বিষয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর বলেছেন, “নজরুল মোল্লা-মৌলবীদের মতো ভালো আরবি-ফার্সী না জানলেও কাব্যের রস আস্বাদন করতে পেরেছিলেন। তার ব্যবহৃত অনেক শব্দই বাংলা ভাষায় যুৎসইভাবে ঠাঁই নিয়েছে। আবার কিছু আরবি-ফার্সী শব্দ ‘সুকৌশলে’ ব্যবহার করলেও তা বাংলা হয়ে উঠেনি। বরং আরবি-ফার্সীই রয়ে গেছে। ‘হিম্মত, জাহান্নাম, ঈমান, জানাজা, আসমান, ইনসান, আহাদ, মুর্দা-ইত্যাদি নজরুল ব্যবহৃত শব্দ এখন পুরোদস্তুর বাংলা। অবশ্য বাংলার বাগ্‌বিধিকে নজরুল উপেক্ষা করেননি, বরং সুসামঞ্জস্যভাবে আরবি-ফার্সী শব্দের বিন্যাস ঘটিয়েছেন। তাই লিখেছেন, ‘নীলিম প্রিয়ার নীলা গুলরুখ লাজুক নেকাবে ঢাকা’, ‘ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ।”

তবে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে অধিক সংখ্যক আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও কম হয়নি। বাংলা সাহিত্যে চলিত রীতির প্রথম সার্থক রুপকার প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষার জাতপাত সম্পর্কে বলেছিলেন, “বাংলা সাহিত্য থেকে আরবী-ফার্সী শব্দ বহিষ্কৃত করতে সেই জাতীয় সাহিত্যিকই উৎসুক যারা বাংলা ভাষা জানেন না।” অবশ্য প্রখ্যাত সাহিত্যিক দীনেশচন্দ্র সেন এ বিষয়টি গভীরভাবে অনুধ্যান করে বলেছিলেন “গত পাঁচ, ছয়শত বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষাটা হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের হইয়া গিয়াছে। মুসলমানের ধর্মশাস্ত্র ও সামাজিক আদর্শ অনেকটা আরবী ও ফার্সী সাহিত্যে লিপিবদ্ধ। সেই সাহিত্যের জ্ঞান তাহাদের নিত্যকর্মের জন্য অপরিহার্য। আমাদের যেমন সংস্কৃতের সহিত সম্বন্ধ আছে, আরবী ও ফার্সীর সঙ্গে তাহাদের কতকটা তাই।” দীনেশ চন্দ্রের এই উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আমি মনে করি, তিনি যথার্থ বলেছেন।

আমিও গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আরবি ও ফার্সি শব্দ সমূহে মুসলমানদের ধর্মীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিশ্বাসের সাথে গভীর ঐতিহাসিক ও সমন্বয়ের সূত্রটি কাজী নজরুলের ভেতরে ভেতরে কাজ করেছে। অবশ্য এখানেই নজরুলের বিশেষত্ব। কেননা তিনি একাধারে নিজ ধর্মবিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক চেতনা যেভাবে অন্তরে লালন করেছেন, তেমনিভাবেই তিনি নিজধর্মের বাইরে অন্যান্য সকল ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। নিজের ধর্মের গণ্ডির বাইরে এসে অন্য ধর্মের প্রতি নজরুলের এই যে অসাধারণ উদার মানসিকতা তা এতটা প্রবলভাবে অন্য কোনো কবি সাহিত্যের মাঝে পাওয়া যায় না। এমনকি রবীন্দ্রনাথকে মাঝেও না। নজরুল একাধারে বহুভাষাবিদ, গবেষক ও পণ্ডিত র মতো একদিকে যেমন সংস্কৃত ছন্দ অধ্যয়ন করেছিলেন, তেমনি আরবি-ফারসি ভাষা থেকেও প্রচুর শব্দ ছন্দ ও সুর আনয়ন করে বাংলা কাব্য ও সাহিত্যকে মুসলিম ঢঙ্গে সাজাবার প্রয়াসী হয়েছিলেন।
‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক মিস্টার ওয়ার্ডওয়ার্থ সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেন, “কোন একটা ভাষায় অন্যভাষার শব্দ প্রবেশ করবে কিনা; তা লেখকের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। যে সাহিত্যিকেরা অন্যভাষার শব্দ চয়ন করে নিজের ভাষার মধ্যে মিলিয়ে দিতে পারবেন তিনি ততো বড় শক্তিশালী সাহিত্যিক।” সত্যিকার অর্থেও তাই। কিছু সমালোচক সমালোচনা করলেও আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, নজরুল সাহিত্যে বিদেশি শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে।
————————
.
০২/৬/২০২৩। ইনকিলাব সাহিত্য।

হারপিক

০১
বাজিতপুর রেলস্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার পূর্বদিকে গেলেই ভাগলপুর গ্রাম। অবশ্য এখন আর গ্রাম নয়। আধা শহর। কিছুটা গ্রাম আর কিছুটা শহর। বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের আশেপাশের এলাকায় ঢুকলে যে কেউ আর ভাগলপুরকে এখন গ্রাম বলবে না। একটা কমপ্লিট আধুনিক শহরের মেজাজ নিয়ে সে যেনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সুরম্য পরিকল্পিত বিল্ডিং এর সাথে আছে সুদৃশ্য কারুকাজ মণ্ডিত মসজিদ, ক্যাফেটরিয়া, লন, পাওয়ার হাউজ, নয়নাভিরাম বাগানের পর বাগান। শহরের কী নেই এখানে! মেডিকেলের সামনের রাস্তাটির দুই পাশেই দোকানের সারি। অসংখ্য ফার্মেসি। খাবার হোটেল। বেশ চওড়া দাম। আর হবেই বা না কেনো – এসব হোটেলে যারা খেতে আসেন তাদের প্রায় সবাই রোগীদের আত্নীয় স্বজন। আজ আছে কাল নেই। বিপদে পড়ে হোটেলে খেতে আসেন। সবাই জানে এসব খাবারে জমিতে সার দেওয়ার মতো করে গ্যাস্ট্রিক বাড়ে। তবুও কোনো উপায়ান্তর নেই। আর সেই সুযোগে হোটেল মালিকেরা কাঁচা ঘাস কাটার মতো বেশ নগদ কামাই করে নেন। শহর আর গ্রামের পার্থক্যটা বুঝি এখানেই! শহরে বিভিন্ন প্রজাতির ধান্ধা করা যায়। গ্রামে এতোটা যায় না।

মেডিকেল কলেজের অদূরেই আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাসা। অবশ্য কেউ কেউ বাড়িও বলে থাকেন। আমাদের দেশের একসময় প্রচলিত রেওয়াজ ছিলো শহরে হলে বাসা। আর গ্রামে হলেই বাড়ি। এখন অবশ্য এই সংজ্ঞাটা কিছুটা পাল্টে গেছে। এখন টিনের ঘর, খড়ের ঘর, ছনের ঘর এসব কে লোকে বাড়ি বলে। আর যে বাড়ি গুলো শহরের বাড়ির মতো পাকা, আধাপাকা সে সব কে বাসা বলে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এখন গ্রামেও বাড়ি খুঁজে পাওয়া ভার। আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাড়িটি বনেদি গোছের। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে চারপাশে চারটি ঘর। পূর্ব এবং পশ্চিমের ঘর দুটি আধা পাকা। উত্তরে-দক্ষিণে কাঁচা। অবশ্য এই দুটি ঘর প্রায় সব সময় খালি পড়ে থাকে। কেবল ঈদের সময় ছেলেরা, মেয়েরা সবাই বাড়িতে আসলে ব্যবহৃত হয়। বাড়ির চারপাশে পাকা দেয়াল। সুউচ্চ। পূর্বদিকের ঘরের সামনেই বিশাল আঙ্গিনা। পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের জন্য খুব পয়মন্ত। খেলার মাঠ হিসাবে সারাদিনই জমজমাট থাকে। এরপরেই একটি বিশাল দীঘি। লোকে বলে কুমির দীঘি। জনশ্রুতি আছে, এই দীঘিতে একবার একটি ছেলেকে কুমিরে ধরে। কুমিরটি ছেলেটিকে না খেয়ে মুখের উপর নিয়ে সারা দীঘিতে চক্কর দিচ্ছিলো। ছেলেটির চিৎকারে হাজার হাজার লোক দীঘির পাড়ে জমায়েত হয়। কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য দীঘির জলে ঝাপ দিতে সাহস পায়নি। এরপর লাঠিতে ভর দিয়ে হঠাৎ কোথা থেকে এক বৃদ্ধা আসলেন। তিনি জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন, দীঘির পানিতে দুই মণ দুধ, পাঁচটি মুরগি এবং একটি ছাগল দিলে ছেলেটিকে বাঁচানো সম্ভব। বুড়ির এই কথা কেউ বিশ্বাস করলো। কেউ করলো না।

শিকদার সাহেবের জান্নাতবাসী বাবা বললেন, আর কোনো রাস্তা নেই বুড়ি মা? বুড়ি খট খট করে জানালেন, আছে বাপু। আর একটি রাস্তা আছে। এই ছেলের বদলে অন্য একজন লোককে পুকুরে বিসর্জন দিতে হবে। উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। তা কি করে সম্ভব? অবশেষে অনেক জোগাড় যন্ত্র করে দুই মণ দুধ, পাঁচটি মুরগি এবং একটি ছাগল দিয়ে ছেলেটিকে বাঁচানো হয়।যাওয়ার সময় বুড়িমা বলে গিয়েছিলেন, একটা শানবাঁধানো ঘাট বানিয়ে দাও বড়ে মিয়া। এই ঘাটই আমার সীমানা। গোসল করার সময় কেউ যেনো ভুলেও এই সীমানা লঙ্ঘন না করে। সেই থেকে দীঘির ঘাট শানবাঁধানো। অবশ্য বাড়ির পেছনেও একটি পুকুর আছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এই দুইটিতে গোসল করে। মেয়েরা পশ্চিমের পুকুরে আর পুরুষেরা পূর্ব পাশের দীঘিতে। এটা আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের বাবার করা নিয়ম। তিনি খুব কড়া মানুষ ছিলেন। এখনও গ্রামের বয়স্করা উনার বিষয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তি বলেন।

সেই বাবার একমাত্র সন্তান আঃ রশিদ শিকদার। তিনিও নম্র, ভদ্র অমায়িক মানুষ। পেশায় একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। একজন সাদা মনের সফল মানুষ। পাঁচ সন্তানের জনক। দুই মেয়ে এবং তিন ছেলে। সবাই বড় হয়ে গেছেন। সবাই উচ্চ শিক্ষিত। ভালো চাকুরী করেন। হাই সেলারী পান। এতো কিছু সফলতার মাঝেও একটা বিষয় শিকদার সাহেবের মনের মধ্যে মাঝে খচ খচ করে। গ্রামের কিছু উঠতি পরিবারের লোকজন তাদেরকে প্রতিহিংসার চোখে দেখেন। সুযোগ পেলেই নানাভাবে হেনস্থা করেন। ক্ষতি করার চেষ্টা করেন। শিকদার সাহেব এই সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে মনে মনে যুদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছেন। তিনি তাদের প্রতি কোনো দুর্ব্যবহার করেন না। আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। তবুও তিনি প্রতিহিংসার এই অনল পুরোপুরি নিভাতে পারছেন না।

০২
এই শিকদার বাড়িতে বিগত কয়েকদিন যাবৎ একের পর এক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বাড়ির সব মানুষের মুখের দিকে চাওয়া যায় না। আতংকের পর আতংক। কেউ জানে না কখন কী ঘটে যায়! এই জন্য সবার মুখের মানচিত্রে এক গভীর চিন্তার রেখাপাত। বাড়ির গৃহকর্ত্রী আয়েশা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আজ বড় ছেলে নাফিস শিকদার বউ, ছেলেমেয়েসহ বাড়িতে আসার কথা। সকলেই তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আয়েশা বেগম তরকারিতে লবণ দিবেন এমন সময় ছোট মেয়ে তাজমুন নাহার দীনা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। মা, মা—- ওমা । কি হয়েছে রে? একটু বিরক্ত হয়েই বললেন আয়েশা বেগম বললেন। আজকাল তরকারি রান্না করার সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে উনি খুব ক্ষেপে যান। বয়স হয়েছে। অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না। তেল দিলেন না পানি দিলেন! হলুদ দিলেন না মরিচ দিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মা, আমার মোবাইলটা খুঁজে পাচ্ছি না। দীনা বললো।কী বলছিস? কোথায় রেখেছিলি? কেনো? খাটের উপর।তুই আসার আগের দিন মানে পরশু আমার মোবাইলটাও খাটের উপর থেকে হারিয়ে যায়। কতো খুঁজাখুঁজি করলাম। পেলাম না। আজ আবার তোরটা গেলো। দেখ্‌ তো মা বাথরুমে হারপিকটা ঠিক আছে কিনা? মায়ের আদেশ পালন করার জন্য দীনা দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এই দীনা মেয়েটি খুবই লক্ষ্মী। খুব সুন্দর দেখতে। ছিমছাম গড়ন ।এতো বড় হয়েছে। বি সি এস পাশ করে এখন একটি স্বনাম ধন্য সরকারি কলেজের প্রভাষক। তবুও এতোটুকু অহংকার নেই। শিশুর মতো সহজ-সরল। শিকদার সাহেবের পরিবারে দীনাই একমাত্র অবিবাহিত। বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিনই সম্বন্ধ আসে। ভালো ভালো ঘর। সুপাত্র। তবুও শিকদার সাহেব রাজি হন না। সবাইকে বলেন, মেয়ে মাত্র চাকুরী পেয়েছে। আর কিছুদিন যেতে দিন।

একটু পরে দীনা আবার রান্নাঘরে ছুটে এসে প্রায় চেঁচাতে চেঁচাতে বললো, মা হারপিকের কৌটা আছে; কিন্তু ভেতরে এক ফোঁটা হারপিকও নেই। কি বলিস মা! গতকালই তো আনা হয়েছে। এর আগেও আরও তিনটি হারপিকের একই পরিণতি হয়েছে। আয়েশা বেগম বললেন। দীনা কী বলবে কিছুই ভেবে পেলো না। শেষে বললো, মা ইলা কোথায় গেছে? ইলাকে দেখছি না কেনো? আয়েশা বেগম বললেন, কোথায় আর যাবে? হয়ত দীঘির পাড়ে খেলছে! দীনা আর কথা না বাড়িয়ে দীঘির দিকে হাঁটা দিলো।

এই ইলা দীনার ভাগ্নি। আপন বড় বোনের একমাত্র মেয়ে। খুব আদরের। পুরো বাড়িতে ছোট মানুষ বলতে ওই একজনই। ইলা তার মা-বাবার সাথে নানু বাড়িতেই থাকে। তার মা-বাবা দু’জনেই চাকুরী করে। মা সরকারি প্রাইমারী স্কুলে এবং বাবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। দুজনই সারাদিন অফিসে থাকেন। প্রায় সন্ধ্যায় ফিরেন। নানা-নানীর সাথে তার সারাদিন কাটে। কখনও একলা। জন্মের পর থেকে এভাবেই চলছে ইলার জীবন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। খুব মেধাবী। ওর ক্লাসে বরাবরই প্রথম হয়। দুষ্টুমিতেও একদম পিছিয়ে নেই। সকলের সেরা। অবশ্য গুণীজনেরা হামেশাই বলে থাকেন, মেধাবিরা একটু- আধটু দুষ্টু হবেই। মেধা ছাড়া দুষ্টুমিরা করা যায় না।

দীনা দীঘির পাড়ে এসেই ইলাকে পেয়ে গেলো। ডাকসই চলছে। দীনাও মুহূর্তেই শৈশব ফিরে পেয়েছে। তারও খেলতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন ডাকসই খেলা হয়নি। অনেকদিন—।। ইলাকে বললো, আমাকে খেলতে নিবি? ইলা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। বললো, তুমি খেলবে মানে? তুমি কি আমাদের মতো শিশু নাকি? দীনাও মজা করে বললো, হুম শিশু ইতো। দেখিস, আমি কোনোদিন বুড়ি হবো না। ইলা আর কিছু বললো না। দীনার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। দুজনের মনেই আনন্দ আর ধরে না। একটু পরে ইলার ছোট মামা আসবে।। শহর থেকে। আরশি আসবে। ঐশী আসবে। ইউশা আসবে। কতো গল্প হবে বস্তা বস্তা। খেলা হবে। কবিতা আবৃত্তির আসর হবে। চাঁদনী রাতে কানামাছি হবে। লুকোচুরি খেলা হবে। মজার উপর মজা। আনন্দের উপর আনন্দ। এতো আনন্দ— ইলা রাখবে কোথায়?

০৩
গত কয়েকদিন ধরে ইলা বমি করছে। কিছুক্ষণ পর পর। কেবল বিকেল হলে একটু ভালো থাকে। কিছুদিন ধরে ইলার খাবারের প্রতি খুব অরূচি। কোনো কিছুই খেতে চায় না। এর সাথে যোগ দিয়েছে বমির ভয়। ওর এখন বদ্ধমূল ধারনা জন্মে গেছে কোনোকিছু খেলেই বুঝি বমি হয়ে যাবে। ইলার বাবা জায়েদ করিম নিজেই একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি ঔষধ দিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি। সাথেই ভাগলপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সেখানেও ডাক্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইলা ভালো হচ্ছে না। ইলার বাবা এখন ঠিক করেছেন ইলাকে একটা ফুল চেকআপ করাতে হবে। মেয়েটি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে।

পরের দিন আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ইলার ছোট মামা এবং মামীর মোবাইল দুটিও পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন আরেকটি হারপিক কেনা হয়েছিলো। সেটির পূর্বের দশা হয়েছে। হারপিকের কৌটা আছে; ভেতরে কোনো লিকুইড নেই। এসবের সাথে যোগ দিয়েছে একটি অভিপ্রেত খস খস শব্দ। শব্দটি একেকবার একেক জায়গা থেকে আসে। মাঝে মাঝে আসে না। শব্দ লক্ষ করে গেলেও সেখানে শব্দের উৎসের কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায় না। ইলার ছোট মামি শহুরে মেয়ে। তিনি ঠিক করেছেন এই বাড়িতে আর থাকবেন। মোটামুটি সবারই একটা ধারনা পাকা হয়েছে যে, এই বাড়িতে কোনো দুষ্টু ভূতের আছর পড়েছে। সে-ই এই সব কর্মকাণ্ড গোপনে করে বেড়াচ্ছে। আঃ রশিদ শিকাদার সাহেব প্রবীণ হলেও চিন্তা-চেতনায় একজন কমপ্লিট আধুনিক মানুষ। তিনি কোনো ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তিনিও এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন। গ্রামে দু’একজন যারা চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করে তাদেরকে উনি অনেক প্রেসার দিয়েছেন কেউ মানুষ চুরি করেছে কিনা। কিন্তু তাদের কাছ থেকে তিনি কোনো তথ্যই উদ্ধার করতে পারেননি।

আর ইলার নানীও বসে নেই। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা এইসব কর্মকাণ্ড ভুত-প্রেত ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি তাঁর ছোট ভাইকে দিয়ে ভিন গাঁ থেকে একজন ডাকসাইটে ভূত তাড়ানোর ওঝা কাম কবিরাজ নিয়ে আসলেন। বাড়ি জুড়ে হুলস্থূল কাণ্ড। ওঝা তাঁর সাগরেদদের দিয়ে পুরো বাড়ির চারপাশে তাঁর হাতের আশা দিয়ে রেখা টেনে দিলেন। সবাইকে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করে দিলেন। কেউ যদি তাঁর অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে যান, তাহলে তাঁর রক্ত বমি হবে। সাথে মারা পড়বে। অতঃপর ভেতর বাড়ির উঠানে আগুন জ্বালানো হলো। বেশ বড় আগুনের কুণ্ড। কয়লা আর কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সবাই চারপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন। ওঝা ঘোষণা করে দিয়েছেন কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বাড়িতে থাকা সমস্ত ভূত-প্রেত কে এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পুড়িয়ে মারা হবে। সেই দৃশ্য সবাই সচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। উত্তেজনার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। কেবল আঃ রশিদ শিকদার সাহেবের এসব ভণ্ডামি ভালো লাগছে না। তিনি বারবার গিন্নীকে নিষেধ করেছেন। কিন্তু গিন্নী তাঁর কথা শোনেনি। দীনাও বাবার সাথে সহমত। কিন্তু মা –কে কিছু বলতে সাহস পায়নি।

ওঝা মন্ত্র পড়া শুরু করে দিয়েছেন। আগুনের মধ্যে ধূপ ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধূপের গন্ধে সমস্ত বাড়ি মৌ মৌ করছে। সবার চোখে-মুখে আনন্দ, উত্তেজনা, ভয়, আতংক। ইলা দীনার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি, ঐশী এবং ইউশাও। তিথি, নাবিলা, সিয়াম, সিফাত ওদেরও আজকে বাড়িতে বেড়াতে আসার কথা। বিভিন্ন ধরনের বাদ্য যন্ত্র বাজছে। ওঝাকে এখন অতিমাত্রায় উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে। তিনি ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা বশে আকাশের দিকে লাফ দিচ্ছেন। খামচি দিয়ে একটা একটা করে ভূত ধরে আনছেন। আর চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আগুনে নিক্ষেপ করছেন। আগুনে পোড়ার পর ভূতের আত্মা সাঁই সাঁই করে পালিয়ে যাচ্ছিলো। সেই পালিয়ে যাওয়ার শব্দ সবাই স্বকর্ণে শুনতে পেলেন। এভাবে সমস্ত ভূত মারা যাওয়ার পর ওঝা বাড়ির প্রত্যেক ঘরে, ঘরের সামনে পেছনে, আনাচে কানাচে ধূপের ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলেন। সবশেষে তিনি ঘোষণা করলেন, আপনাদের বাড়ি আজ থেকে সর্ব প্রকার জিন, ভূত-প্রেত মুক্ত হলো। সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া আমি বাড়ি এমন ভাবে বন্ধন করে দিয়েছি যে, ভূত কেনো, ভূতের বাপ-দাদার সাধ্য নেই এই বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে।। অবশেষে তিনি ইলাকে বিশেষ ভাবে ঝাড়ফুঁক দিলেন। বললেন, আর কোনোদিন এই মেয়ের বমি হবে না।

ইলার নানী মনে মনে খুব স্বস্তি পেলেন। দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হলেন। দীনা কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলো। বিশ্বাসও করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মনকে এই বলে প্রবোধ দিলো যে, আচ্ছা দেখাই যাক না কি হয়! সবকিছু ভালো হলেই তো ভালো!!

০৪
কিন্তু ওঝা চলে যাওয়ার ঘণ্টা দুই পড়েই যখন ইলা বমি করতে লাগলো, তখন দীনার সমস্ত বিশ্বাস কর্পূরের মতো উড়ে গেলো। এদিকে দীনার ছুটি শেষ হয়ে গেছে। আগামীকালই সে ময়মনসিংহ ফিরবে। ইলাও দীনার সাথে ময়মনসিংহ আসার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। শুধু অপেক্ষা করছে কখন, কিভাবে কায়দা করে আন্টিকে প্রস্তাবটি দেওয়া যায়। ইলার দৃঢ় বিশ্বাস আন্টি নিশ্চয় না বলতে পারবেন না। ইলার ছোট মামারাও আগামীকাল ঢাকা চলে যাবেন। যাওয়ার আগে ইলার ছোট মামা তাঁর নানীর জন্য একটি সুন্দর মোবাইল হ্যান্ড সেট, কিছু খাবার-দাবার, সাবান-হারপিক সহ সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি জিনিস কিনে এনেছেন।
পরদিন সকাল বেলা দীনা বাথরুমে গিয়ে দেখতে পায়, হারপিকের বোতল শেষ। অথচ গতকালই কিনে আনা হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে খবরটি পরিবারের প্রায় সবার কাছে পৌঁছে যায়। এক ধরনের আতংক এমনিতেই সবার মাঝে বিরাজ করছে। তাঁর উপর এসব ঘটনায় সবাই এখন রীতিমত বিব্রত। চেষ্টা তো আর কম করা হয়নি। কিছুতেই কিছু হলো না। দীনা বাজিতপুর রেলস্টেশন থেকে চট্টগ্রাম হতে ছেড়ে আসা বিজয় এক্সপ্রেসে ময়মনসিংহ আসবে। ইতোমধ্যে টিকেট সংগ্রহ করা হয়েছে। ইলাও দীনার সাথে আসছে। ইলার আম্মু আসতে দিতে চায়নি। আব্বুও। তবুও ইলার জিদের কাছে তারা পেরে উঠেনি। সে আসবেই। তাছাড়া ডাক্তারও বলেছেন ওর বায়ু পরিবর্তন খুব জরুরি। আরও একটি কারণ আছে, অফিস ফেরত দীনা বাসায় একা একা থাকে, সময় কাটতে চায় না। ইলা থাকলে বেশ হয়।

ট্রেনে উঠার আগমুহূর্তে ইলা একবার স্টেশনে বমি করে দিলো। দীনার জন্য এটা খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি। তবুও তাঁর চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আশার কথা বমি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তারা ট্রেন ছাড়ার পূর্বেই উঠতে পেরেছে। পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক দীনার সুপরিচিত। সিনিয়র কলিগ। নাম জনাব কছিম উদ্দিন। দীনার কলেজেরই সহকারি অধ্যাপক। জনপ্রিয় কবি এবং কথা সাহিত্যিক। হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম থেকে মাস্টার্স ১ম পর্বের ভাইভা নিয়ে ফিরছেন। সদালাপী মানুষ। সহজ, সরল প্রকৃতির। দীনাকে দেখে খুব খুশি হলেন। দীনাও খুব খুশি। একটু পরেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে গতি বাড়তে লাগলো। পরিষ্কার আকাশ। কোথাও একরত্তি মেঘও নেই। চমৎকার প্রাকৃতিক আবাহন। সবে বসন্ত উকি দিয়েছে। রেললাইনের দুই পাশে প্রায়ই শিমুলের ফুল দেখা যাচ্ছে। গাছে গাছে নতুন পাতা, ফুল ও কুঁড়ি। বমি করতে করতে ক্লান্ত ইলা একটু পরেই আন্টির শরীরে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কছিম উদ্দিন স্যার দীনাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সাথের মেয়েটি কে?স্যার ও আমার ভাগ্নি। একমাত্র বড় বোনের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটি বুঝি ট্রেনে উঠার আগে বমি করছিলো? জী স্যার। কিছুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে অনেক অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কী রকম? দীনা সবিস্তারে প্রত্যেকটি ঘটনা বর্ণনা করলেন। ইলার বমি করা, মোবাইল হারিয়ে যাওয়া, খসখস, শব্দ করা, ওঝার ভোজবাজি কোনোকিছু বাদ দেয়নি। ট্রেন ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে এসে থেমেছে। কছিম উদ্দিন স্যার প্রত্যেকটি ঘটনা অত্যন্ত মনোযোগের সহিত শ্রবণ করলেন।

ইলা এখনও ঘুমুচ্ছে। দীনা একটু পর পর ইলার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। কছিম উদ্দিন স্যার কী যেনো ভাবছেন। উনি কবি-সাহিত্যিক মানুষ। ভাবাভাবিই উনার কাজ। তাই দীনা উনাকে বেশি ঘাঁটালেন না। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। অবশেষে দীনাই নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, স্যার কি ভাবছেন? কছিম উদ্দিন স্যার সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বললেন, ও তোমার ঘটনাটাই ভাবছিলাম দীনা। কিছু পেয়েছেন স্যার? দীনা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো। হুম, ঘটনাটির এক ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করিয়েছি। তুমি হয়ত মানতে চাইবে না। কারণ তুমি ইলাকে খুব ভালোবাসো। আমি মানবো না কেনো স্যার? আপনি বলুন। যুক্তিসংগত হলে আমি অবশ্যই মানবো। কছিম উদ্দিন স্যার বলা শুরু করলেন, তোমাদের বাড়ির এই সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী হলো এই মেয়েটি। প্রত্যেকটি হারপিক ইলাই খেয়েছে। দীনার মোটেই সহ্য হলো না। সে শুরুতেই প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো। কী বলেন স্যার। আপনার কথা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অসম্ভবের উপর অসম্ভব। এ হতেই পারে না। দীনার সুতীব্র প্রতিবাদ দেখে কছিম উদ্দিন স্যার হাসতে লাগলেন। প্রাণ খোলা হাসি। হাসতে হাসতে শেষে বললেন, আমার কথা যে ১০০% ঠিক আমি সেটা দাবী করছি না। আমি যা বলছি, সেটা আমার একটা হাইপোথিসিস। সাধারণতঃ ভুল হওয়ার কথা নয়। ঠিক আছে তুমি যেহেতু শোনতে প্রস্তুত নও, তাহলে আর আমি বলছি নে। দীনা সাথে সাথে তাঁর অবস্থান থেকে সরে এসে বললো, না স্যার। আপনি বলুন। আমি ধৈর্য ধরে শুনবো।

০৫
কছিম উদ্দিন সাহেব বললেন, প্রথমতঃ ইলা কোনো একদিন কৌতূহল বশত সামান্য পরিমাণ হারপিক ছেঁকে দেখেছে। মুখে নিয়েই ও বুঝতে পারে হারপিকের স্বাদটি তেতো নয়। কিছুটা টক টক। তবে সব মিলিয়ে স্বাদ মন্দ নয়। সেই থেকে শুরু। ও একটু একটু করে হারপিক খেতে শুরু করে দেয়। পরিমাণ সামান্য হওয়ায় এটা ওর শরীরে আস্তে আস্তে মানিয়ে যায়। একটা সময় এটা ওর নেশায় পরিণত হয়। ও হারপিকে আসক্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু যখনই পরিমাণ বেশি হয়ে যাচ্ছে, তখনই ওর লিভার সেটা কাভার করতে পারছে না। ফলে বমি দেখা দেয়। লিভারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার ধারণ ক্ষমতার বাইরে এবং অযোগ্য কোনোকিছু রাখবে না। বমির মাধ্যমে সেটা বের করে দেবে। অবশ্য এখানে মূল অনুঘটক হলো মস্তিষ্ক। সে-ই প্রথম সংকেত দেয়। এজন্য বমি মানুষের জন্য অনেক সময় বিরাট উপকারী হয়ে থাকে। বমি না হলে পাকস্থলী ফুলে যাবে। প্রসাব, পায়খানার নানা জটিলতা দেখা দিবে। এমন কি মৃত্যুও হতে পারে।

আমি কি একটি প্রশ্ন করতে পারি স্যার? দীনা বললো।
হুম। কেনো নয়। অবশ্যই করতে পারো।
হারপিক খেলে তো স্যার ওর মারা যাওয়ার কথা?
একদম খারাপ বলোনি তুমি। কিন্তু হয়েছে কি তুমি যদি পরিমাণের কম বিষও খাও; তোমার শরীরে সামান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কিন্তু তুমি মারা যাবে না। তারপর আস্তে আস্তে বিষের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রায় বাড়িয়ে দাও। একটা সময় দেখবে তোমার শরীর এই মারাত্বক বিষকেই কনজিউম করে নিচ্ছে। কিছুদিন আগের একটি ঘটনা, তুমি হয়ত শোনে থাকবে একটি লোককে কিং কোবরা কামড় দেয়। সবাই অস্থির। চিৎকার, চেঁচামেচি, ডাক্তার এসব চলছিলো। কিন্তু যাকে কামড় দিয়েছে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে হাসছিলো। পরে দেখা গেলো লোকটির কিছুই হয়নি। আসলে কথায় বলে না, শরীরের নাম মহাশয়। যাহা সহাবে সে তাহাই সয়।
দীনা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। স্যার বলতেই থাকলেন, দ্বিতীয়তঃ মোবাইল চুরির বিষয়টি। দীনা তোমাকে বলতে ভয়ই পাচ্ছি। কারণ তুমি খুব রিয়েক্ট করো।

না স্যার। আমি আর রিয়েক্ট করবো না। আপনি বলুন।
স্যার আবার বলা শুরু করলেন। ধন্যবাদ তোমাকে। তুমিই বলেছো ইলার মা-বাবা দুজনেই চাকুরী করেন। উনারা ইলাকে সময় দিতে পারেন না। তোমার মা-বাবাই উনার একমাত্র সঙ্গী। তুমি খেয়াল করলেই দেখবে স্কুলের সময়টা ওর খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাসায় আসলেই ও একদম বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কারণ তোমার মা-বাবা ওকে পর্যাপ্ত দিতে পারছেন না। উনারাও নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। উনাদের দিয়ে ইলার বা-বাবার অভাব পূরণ হচ্ছে না। ইলা অনেক সময় তোমার আম্মুর মোবাইল অথবা তোমার আব্বুর মোবাইল দিয়ে ওর মা বাবাকে কল দিতে চেয়েছে। কিন্তু নানা কারণে দিতে পারেনি। হয়ত মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। কিছু মনে করো না দীনা হয়ত ওর নানা-নানী ওকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেয়নি। অথবা ওর বাবা-মা কল রিসিভ করেনি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কারণে মোবাইল নামক এই যন্ত্রটির প্রতি ইলার মন বিষিয়ে উঠেছে। আসলে বিষণ্ণতার চেয়ে বড় ঘাতক আর নেই। যে বয়সে তার মা-বাবার আদর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন; সেটা সে পাচ্ছে না। তাই ও এখন দিন দিন ক্ষেপে যাচ্ছে এবং একরকম মানসিক সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তুমি একটু খেয়াল করলেই দেখতে ইলা অনেকদিনই তার মাকে চাকুরী ছাড়তে বলেছে। এই কথা শোনে দীনা বললো, স্যার আপনি জানলেন কিভাবে? আমার সামনেই ও অনেকদিন এই কথা বলেছে। স্যার আর একটি প্রশ্ন করি। হুম একটি নয়। তোমার যতো জিজ্ঞাস্য আছে সব বলো।

স্যার মোবাইল গুলো ও কী করেছে? খুব কঠিন প্রশ্ন দীনা। উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে আমার ধারণা, মোবাইল গুলো সে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছে। ওর জিদ একটাই, সে যেহেতু এই মোবাইল দিয়ে কথা বলতে পারবে না। সুতরাং অন্য কাউকেও কথা বলতে দিবে না। হতে পারে স্যার। এখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি।
কছিম উদ্দিন স্যার বললেন, তুমি ওকে হাতে নাতে ধরতে চাও দীনা?
জী স্যার। কিন্তু কিভাবে?
এখন তুমি বাসায় ফেরার সময় ওর সামনেই একটি হারপিক কিনবে। সেটা নিয়ে তোমার টয়লেটে রাখবে। তারপর দেখো কী হয়! এই বলে স্যার হা হা হা হেসে উঠলেন। সেই সুউচ্চ হাসির শব্দে ইলার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ট্রেনও ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের কাছাকাছি এসে পড়েছে। সবুজ বাতি দেখা যাচ্ছে।

০৬
দিন দুই পরে একদিন সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। কলেজ রোড পানিতে সয়লাব। কলেজ রোডের বেশ কিছু সমস্যার মধ্যে এটিও অন্যতম। অবশ্য আশার কথা হলো এই সময়টাতে রিকশার কোনো অভাব হয় না। অসময়ে দুধের মাছের মতো। যেমন খুশি দাম হাঁকানো যায়। ইচ্ছা হলে যাও, না হলে না যাও। দীনা রিকশার ভাড়া ঠিক করছিলো। এমন সময় কছিম উদ্দিন স্যার। তিনি অফিসে যাবেন। কাকতালীয় ভাবে দুজনেরই সকাল নয় টায় ক্লাস। দীনা সালাম দিলো। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কি খবর দীনা?

স্যার বিশ্বাস করবেন না, আপনার কথাই মনে ভাবছিলাম। সেদিন আপনার কথা মতো আমি একটি হারপিক কিনে তবেই বাসায় গিয়েছিলাম। তারপর স্যার আপনার কথাই ঠিক স্যার। আমি হাতেনাতে ধরেছি। ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি ওকে তেমন কিছু বলিনি স্যার।
তুমি ঠিক করেছো। ওকে এখন তুমি সঙ্গ দাও। সব সময় অব্জারভেশনে রাখবে। ওর পছন্দ মতো চকলেট, চুয়িংগাম, চকলেটবার মাঝে মাঝে ওকে খেতে দেবে। মনে রাখবে ও এখন এক প্রকার নেশায় আসক্ত। তুমি ওকে এখানে এনে খুব ভালো করেছো। আমার সাথে একবার আলাপ করিয়ে দিও।
অবশ্যই আলাপ করিয়ে দেবো। স্যার আরও একটি কথা, সবগুলো মোবাইল কুমির দীঘিতে পাওয়া গেছে। কিন্তু স্যার একটি বিষয় বুঝতে পারলাম না।
কছিম উদ্দিন স্যার বললেন, কোন্‌টা?
এই যে স্যার একটা খসখস শব্দ প্রায়ই হতো!!

ওটা কিছু নয়। ইঁদুর, বিড়াল, চিকা ওরা এমন শব্দ করে থাকে। বিশেষ করে ওই সময়টাতে তোমার কেউ স্বাভাবিক চিন্তা করোনি। তাই যে কোনো স্বাভাবিক শব্দ তোমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এই কছিম উদ্দিন স্যার স্বভাব সুলভ হা হা হা করে হেসে উঠলেন। দীনাও সেই হাসিতে যোগ দিলো।।

আসলে গল্পটি এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শেষ হয়েও হইল না শেষ! ইলার হারপিক খাওয়ার এই ঘটনা এক কান, দুই কান করতে করতে সারা গ্রামে সাড়া তুললো। কিছু মানুষ খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিলো এই মেয়েটির মধ্যে একটি সহজাত ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা বলেই সে হারপিকের মতো বিষ খেয়ে হজম করতে পেরেছে। বেশ আর যায় কোথায়? সরল বিশ্বাসে অনেকেই ইলার কাছে পানি পড়া সহ বিভিন্ন কাজে আসতে লাগলো। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে কথা!!
——————-

উড়ুক্কু বেলার গান

বারংবার আরশিতে মুখের মানচিত্র দেখি
সে যেনো এক স্বৈরশাসক!
যদিও চামড়ায় ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে
তবুও কমেনি এতোটুকু তেজ!

পান থেকে চুন খসতে তবুও দেরি হয়
ইগোর পারদ সীমালঙ্ঘন করতে দেরি হয় না
আশেপাশে কতো বৃষ্টি হয় মুষলধার
বলতে পার, ইগোরা কেন এতো বড়সড় চামার?

এই জীবন কি তাহলে নিছকই খেলা
ইগো আর সুপার ইগোর জমজমাট মেলা
তবুও এভাবেই একদিন ফুরিয়ে যাবে
ইস্টিশনের এই উড়ুক্কু কালবেলা…?

কবিতায় নতুন ধারাঃ স্বপ্ন নয় বাস্তবতা

আমার কাছে কবিতার চেয়ে লাবণ্যময় তেমন কিছুই নেই। আমি সুদীর্ঘ দিন যাবত কবিতার সাথে আছি। কবিতা আমাকে হাসায়…. কবিতা আমাকে কাঁদায়… কবিতা আমাকে সজীবতা দেয়, প্রাণের পরশ দেয়।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, এখন কবিতার আগের সেই জৌলুশ আর নেই। পাঠক কবিতা পড়েন না, পড়তে চান না। কেন পড়েন না…. এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন! এর কারণ হল, কিছু কবি আধুনিকতার নাম করে কবিতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। তারা শব্দের জোড়াতালি দিয়ে এমন সব কবিতা লিখেন, যার পাঠোদ্ধার বা মর্ম হয়ত কবি নিজেই জানেন না! আর পাঠক কীভাবে এই কবিতা পড়ে আনন্দ লাভ করবেন? তারচেয়ে বরং কবিতা না পড়াই অনেক অনেক ভালো। এটাই হলো বাস্তবতা। এই যখন অবস্থা তখন প্রিয়কবি ফাহিম ফিরোজ কবিতাকে ভিন্নতর কিছু প্রচেষ্টা করছেন। কবিতাকে আবার সম্মানিত পাঠকের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এই চেষ্টার নাম হল, নতুন ধারা।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। এই ভাষায় আমরা কথা বলি, ভাব প্রকাশ করি। এই ভাষাতেই আমাদের হাসি, আমাদের কান্না, আমাদের সাহিত্য সাধনা। তাই আমরা অত্যন্ত গৌরব এবং অহংকারের সাথে বলি, বাংলা ভাষা আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয়। কারণ এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি। আর আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের অধিক পুরানো। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের পেছনে প্রভাব বিস্তার করে আছে সংস্কৃত, উর্দু, ফার্সি, পুর্তগীজ, আরবি এবং ইংরেজি অনেক শব্দমালা।

সরাসরি অথবা পারিভাষিক ভাবে এই শব্দ কে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। এমনকি এখনও চলছে। মূলত একটি ভাষায় অন্য একটি ভাষার শব্দের এই আত্মীকরণ রোধ করা একটি কঠিন কাজ। ফলশ্রুতিতে চেতনে হোক কিংবা অবচেতনে হোক আমরা তাদের উপস্থিতি মেনে নিয়েছি অথবা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। আলোচনার স্বার্থেই এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছি। অন্যথায় নতুন ধারার আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকবে বলে আমার ধারণা।

জী… আমরা কবিতায় নতুন ধারার কথা বলছি। কবিতায় নতুন ধারা নিঃসন্দেহে একটি আধুনিক চেতনার নাম। একটি বিপ্লবের নাম। স্বাদে, গন্ধে ভরপুর অপূর্ব একটি ব্যঞ্জনার নাম। আর যার হাত ধরে নতুন ধারার সাহিত্য, নতুন ধারার কবিতা আজ কোনো স্বপ্ন নয়; নিতান্ত বাস্তবতা… তিনি হলেন সাহিত্যে নতুন ধারা সৃষ্টির সার্থক রূপকার প্রিয়কবি ফাহিম ফিরোজ।

যার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নতুন ধারার কবিতা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। নতুন ধারার কবিতাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রোগ্রাম করার কথা ভাবছেন। আমরাও বিশ্বাস করি, নতুন ধারার কবিতা নিয়ে যতবেশি সম্ভব আলোচনা হবে, গঠন মূলক সমালোচনা হবে… নতুন ধারাও ততো বেশি সমৃদ্ধ এবং বিকশিত হবে। মূলতঃ নতুন ধারার কবিতার কাঠামোতে থাকবে শিথিলতা বা শৈথিল্য।

এবার আসা যাক, নতুন ধারার কবিতার ইশতেহার প্রসংগে। যে কোনো বিষয়ের সফলতার জন্য দরকার একটি রোড ম্যাপ। যথার্থ নির্দেশনা। নতুন ধারার সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা তার সারথিদের জন্য ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। বলা দরকার যে, বাংলা সাহিত্য জগতে এটাই প্রথম ইশতেহার। এই ইশতেহারে তিনি বলেছেন, “করোনায় যেভাবে বিশ্ব আজ দলিত-মথিত, দ্রুত পরিবর্তিত, মৃত্যু, আর্তনাদ, শোক, একাকিত্ব, সন্দেহ, খাদ্যাভাব, অর্থ সংকট, বেকারত্ব, জন্মহীনতা– অতীত বিশ্বে কখনো এমন ভয়ংকর চিত্রের মুখোমুখি হয়নি মনুষ্য সমাজ। কবে এই অতিমারীর মুন্ড কাটা যাইবো, কেউ নিশ্চিত কইতে পারেনা। চারদিকে জীবাণু হাতিয়ারের ঈংগিত। বিশ্ব জুড়ে লেখককুল তাদের সৃষ্টিতে অতিমারীজনিত বিষয়াদি অগ্রাধিকার দেবেন এডাই সত্য। আধুনিক বিশ্বের মৃত্যু ঘইটছে। নতুন বিশ্ব এখন প্রসারিত। সমস্ত কিছুই দ্রুত আদল বদলাচ্ছে। আধুনিকের মতো অভেদ্য কাব্য নয় এখন, কিঞ্চিত সহজবোধ্য, কবিতার কোনো অংশ কণা লইয়া দীঘল ভাবনার অবসর কম রৈবে। নন্দন তত্ত্ব অনেকাংশে শক্তি হারাবে। শিল্প, ছন্দ, অছন্দ রৈবে। উপমা, রূপকল্পে কাঠিন্য নয়, সহজ স্বাভাবিক রুপ রৈবে বা না থাইকলেও ক্ষতি নাই। কাব্য গঠনে শিথিলতা রৈবে।

যাহা আধুনিকে আছিলোনা। মানুষ মৃত্যু আতংকে কম বেশি ধর্মমুখী হবে। আধুনিকরা যাহা নিষিদ্ধ কৈরছিলো। আস্তিক – নাস্তিক রৈবে। পরিহার্য্য রাজনৈতিক কোন্দল। প্রকৃতি, বিয়ং (রহস্যময়তা), কল্পনা, অলৌকিকতা জরুরি। নতুন শব্দ খেইল, ভোগবিমুখতা, নির্জনতা থাকবে। অসাম্যতার মৃত্যু ঘটিবে। নয়া পৃথিবীর এগিয়ে যাবে প্রগতির চাকা ছুঁয়ে, সবুজ ও মৃত্তিকার মেলবন্ধনে। শুধু ইতিহাস ঐতিহ্য নয়,এবার পুরাকীর্তি গণ্য হবে অধিক। পুরাকীর্তি না থাইকলে সে ইতিহাস মিথ্যাময়।

অথচ আধুনিকতায় ইতিহাসকই কম হৈলেও গুরুত্ব দেয়া হৈছিলো। ১. আত্মীয় আর সম্পর্ক বাচক শব্দের নাম সহ প্রয়োগ অপরিহার্য। ২. জরুরি প্রমিত ভাষার লগে লোকাল ভাষার কোমল মিশ্রণ। এদুটো বৈশিষ্ট্য নতুন পৃথিবীর নতুন ধারায় কবিতায় অনস্বীকার্য। যাহা আধুনিকে দূরের কথা, হাজার বছরের অধিক জীর্ণ বাংলা কবিতায়ও ছিলো না। প্রথমটি কারো কবিতায় থাইকলেও তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। কিন্তু নতুন ধারার কবিতায় সবার জন্য তা পিনাবদ্ধ। বহুরৈখিকতা আবশ্যক। আধুনিকের মতো শুধু মৌল নয়, গৌনদের কথাও কইবে। সমাজ কাঠামো নির্মাণে তাহাদের প্রভূত অবদান। ভালোবাসা, কাম, নারীর সৌন্দর্য ও ক্ষমতায়ন বৈধ। নতুন পৃথিবীতে সব কিছুই নবীকরণ। আধুনিকতার লগে যার দোস্তী ভাব নাই। করোনাকালীন সৃষ্ট সাহিত্যই বিশ্বে ‘নতুন ধারা’। এটা করোনাকালে ধুমকেতুর মত হঠাৎ, দৈবিক সৃষ্টি। কোনো বিবর্তন নয়। বিবর্তন ঘটে ধীরে। জয়তু নতুন ধারা।”

প্রিয় পাঠক, সত্যি কথা বলতে কী, ইশতিহারটি মনোযোগ দিয়ে কয়েকবার পাঠ করুন। আশাকরি তাহলে আপনি নিজেই নতুন ধারার সাহিত্য সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পেয়ে যাবেন। মূলত নতুন ধারা হলো প্রাণ খুলে লেখার একটি ফ্ল্যাটফরম। চাষীরা যেমন মনের সমস্ত মাধুরি মিশিয়ে খেতে-খামারে যেমন খুশি চাষ করে থাকেন, আপনিও আমাদের নতুন ধারার সাহিত্যে যেমন খুশি মজা নিতে নিতে লিখতে পারবেন। স্বাধীন ভাবে শব্দ চয়নের অবারিত সুযোগ পাবেন।

প্রিয়বন্ধুরা, এবার আসুন নতুন ধারার কবিতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিতে চেষ্টা করি। নতুন ধারার মানে নতুন আনন্দ, চিন্তা-চেতনা, ভালো লাগা, মন্দলাগা এককথায় আমাদের নিত্যদিনের জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা থেকে শুরু করে সবধরণের সমস্যা একটি আনন্দঘন ভিন্ন মাত্রার কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করা।

বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলাভাষী কবি এবং লেখকগণকে এই ধারায় ঐক্যবদ্ধ করাই ত আমাদের লক্ষ্য। এই ধারার কবিতার গঠন হবে সংক্ষিপ্ত, রস হবে প্রগাঢ়। যাতে কবিগণ থাকবে স্বাধীন। ইচ্ছেমতো প্রমিত শব্দের সাথে হারিয়ে যেতে থাকা আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার করতে পারবেন। আর পাঠকও সম্পূর্ণ কবিতা পড়ে রস আস্বাদন করতে পারবেন। এতে অহেতুক শব্দের বাড়াবাড়ি নেই। কঠিন কোনো বাক্য বিন্যাস নেই। কবিতার অর্থ বুঝতে পাঠককে গলদঘর্ম হতে হবে না। ডিকশনারি ঘাটতে হবে না। কবির ভালোবাসা ও বিশ্বাসে কবিতা চারাগাছ এর মতো বড় হবে। আসুন এই কথাগুলো মাথায় রেখে আমরা নতুন ধারায় কবিতা লিখি।

সম্মানিত পাঠক, এবার আসুন, নতুন ধারার কিছু কবিতার উদাহরণ দেয়া যাক। তাতে করে আপনারা নতুন ধারার কবিতা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা লাভ করতে পারবেন।

পঞ্চাশ বছর।। চাষা হাবিব

তখনও ধ্রুবাবর্ত জীয়ন কূপে
ঢালছিল বিবস্ত্র জল;
উড়তে উড়তে উড়নচণ্ডী দেহখান কইতে থাকে
হামার বাড়িত আছিলো বড় বড় মোটকা ভর্তি চাল;
আজ সেই চালে মায়ার চাদর বালিশ চাপাকল
উত্তেজনা আর পঞ্চাশ বছরের পুরান একরত্তি
ছিপছিপে বংশাল শাল। এখনো ঢালে ধ্রুবজল
হামরা হাপসাই যাই;
দমের ভিতর শালখানি গন্ধছড়ায়
দাদার বিড়ির গন্ধ–তামুক–খুঁইনি
পঞ্চাশ বছরের পুরান একরত্তি ছিপছিপে শাল।।

ক্ষুধা/ কবির আহাম্মদ রুমী

ক্ষুধা এক অন্ধকার ভাষা—–
যতিচিহ্ন উপড়ে ফেলা খটখটে নিষিদ্ধ নির্দয় কবিতা।
হাড্ডিতে করোটিতে বাজে রে বাজে
তবলার বোল; ক্ষুধা আদিম আন্ধার – যা–
মাইনসের মাথা নুয়ে দ্যায়- ইশ্বরের কাছে–
একদা মিছিল, পিকেটিং, লিফলেট বিলি পাঁচিলে চিকামারার গনগনে উত্তেজনার ফাঁকেও–
গম্ভীর রাইতে
মুখোমুখি হতাম– আমি ও রাত্রি!

.
ভিকটিম/ রেশম লতা

ভিকটিম, হোগলাপাতা!
গাছ সামলান জরুরি ছাদ থেইকে!
এপার ওপার এক সূতার দুই মাথা
গুরুত্বরা সাঁকো
নড়ে আর লাফায়
মুদি দোকানের সদাই বান্ধনের গেরান শুঁইকেই
খালুর শুক্রবার অতিবাহিত।
বেবাকতের অজানা নাওরন্দী খালের কাহিনী।

বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ / উৎপলেন্দু পাল

বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ
কোথাও কি আগুন লেগেছে ?

একফালি বারান্দায় বেশ শান্তি আছিল
সকালে রইদ পড়তো সন্ধ‍্যায় শিশিরের রেশ
দুই পা ছড়াইয়া বসলে ক্লান্তি শেষের তন্দ্রা
ভাজা বাদামের খোসা ছাড়ানোর আওয়াজ

হাচুইন‍্যার মা’য় গৈঠা দিত দেওয়াল জুইড়া
প্রভা বামনি গোবরের ছিটা ভোর রাইতে
হারুণ মুনসির আজানের সুর বাতাসের গায়
মেরি মাসী মোম জ্বালাইতো ক্রুশের তলায়

কাদের জানি রাইতের আন্ধারে ফিসফাস
দাবার বোর্ডে মাথা চুলকায় গম্ভীর মুখ
কাদের পোষাকে যেন গোপন রক্তের দাগ
অচেনা নিঃশ্বাস জুড়ে শুধু বারুদের ঘ্রাণ

ভাবসাবের কালাজ্বর / নটরাজ অধিকারী
.
গাঁওয়ের ভিতরে ঢুইকা গেছে শহুরের স্বভাব।
অতি গোপনে মিয়া ভাই আর মিয়া ভাই নাই
সে অহন ব্রাদার হইছে। চাচি-খালাম্মা অহন
আন্টি হইয়া ঘুইরা বেড়ায়, রোদচশমা চোখে
পরে সবকিছু রঙিলা দ্যাখে। কালাজ্বর যখন
ঝাপ্টাইয়া ধরে ভাবসাব, আধুনিকতা হারায়।
.
মইত্যা দাদার লাল গরুটা, বিকালকে জাবর
কাটে ; সইন্ধ্যা ল্যাদায়। রাইত বিরাইতে বসে –
হুক্কা টানে উত্তর পাড়ার মইজ্যা কাকু, কাশে ;
বাতাসে কালাজ্বর ভেঙে ভেঙে বিহান আসে।
.
হলুদ ফিতার উপর বসে উদাস রোদ পোহায়
করিমন পাগলীর চুলে ভাবসাবের কালাজ্বর।
.
লতা কাহিনী/ উত্তম কুমার দাস

ফোড়ন ওঠার ঝাঁজ দেইখ্যা লতা মুচকি হাসে…..
পরানের পোলার জিভের স্বাদ গ্যাছে…
তাই লতা আজ সাধ বদল করব…..
স্বাদ থেকে সাধ… জিভ থাইক্কা একদম মনে।

শিউলি পর্ব/ আবুল খায়ের বুলবুল

যতই কওনা কেন ভালো আছো তুমি
কেমনে কইমু কিভাবে আছো?
তা কিন্তু জানি, সালেহা নানীও তা বলে
কথাটা আসলে এইডা নয়
তুমি বুদ্ধির প‍্যাঁচ মাইরা সব সময় কথা কও
এইডা আশৈশবেও তোমাকে জানতাম।
দুখের বানে ভাইসা গেলেও তুমি বলতে
সুখের ফোয়ারায় গোছল করে আসছো।
আসলে কি তুমি আইজও সেই অভ‍্যাসটা ছাড়োনি?

সইত‍্যের উপর মিথ‍্যা দিয়ে সুন্দর কিছু অয় না
মিথ‍্যার মইধ‍্যে কখনও সত‍্যকে মিশাইও না,
তাতে জীবনের সৌন্দর্য ক্ষয়ে ক্ষয়ে ম্লান হয়ে যায়।
ও ফুল ও নিষাদ/মুকুল ম্রিয়মাণ
ও ফুল ও নিষাদ,
হরহামেশা জাগিয়ে তুলছো লালিত মেলানিন;
বিপন্ন বালিহাঁসের মিথুন দৃশ্য থেকে
দূরে সরে যাচ্ছে গায়েরী প্রেমিক।
আর আমার গল্পটাও জমজমাট!
গাঁ-গামালের রেশমী মেয়ে রেশমা
এহোন তোমাগোর মন কাইড়া লয়,
শোনো সুদর্শন ছোকরা হাচা কইতাছি-
একদিন আমারও মন কাইড়া নিছিলো-
সে ঘোলাটে চোখের বরকন্দাজ,
ঢুইকা পড়ছিলো এই বুকের জিরাতে

নতুন ধারায় লেখা কী অসাধারণ সব কবিতা। অযথা শব্দ চয়ন যেমন নেই, তেমনি প্রতিটি শব্দ মেদহীন। বাংলা ভাষার প্রমিত শব্দাবলীর সাথে আঞ্চলিক শব্দের কী অসাধারণ মেলবন্ধন। কবিতাগুলো পাঠক করলেই বুঝা যায়, ইহা কবিদের প্রাণের পরশ দিয়ে লেখা। উপমা, অলংকার, অনুপ্রাস এবং রুপকের নামে কবিতাকে দূর্বোধ্য করে তোলা হয়নি। একেবারেই সহজ-সরল এবং সকল শ্রেণির পাঠকের বোধগম্যর সীমার মধ্যে। এই ধরণের কবিতা নিঃসন্দেহে পাঠককে বেঁধে রাখবে বলে আমার গভীর বিশ্বাস।

তাই আমরা বলছি, নতুন ধারা কবিতার জগতে একটি বিপ্লব। দূর্বোধ্যতা এবং কাঠিন্যের জন্য যে পাঠক কবিতা পড়তে ভুলে গেছেন, কবিতার বই পড়তে ভুলে গেছেন…. আমার দৃঢ় বিশ্বাস নতুন ধারার কবিতা আবার সেই পাঠককে ফিরিয়ে আনবে। আর আমরাও ফিরে পাব কবিতার হারানো ঐতিহ্য। জয়তু নতুন ধারা।।

শেষ করছি নতুন ধারায় লেখা আমার একটি কবিতা দিয়ে—-

সুবাসিত আতর// জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
———————
রাইত পোহালেই যে কবিতার প্রসব অইত জ্বর
সে-ই অহন আজিব আন্ধার রাইতের ঘর!
সখিনা তবুও রোজ রাইতে চিল্লাইতে চিল্লাইতে
কয়-” সবাই তরা সব্বাই সুখ নিবার চাস
দুঃখগুলো কেন আমার বাড়িত পড়ে রয়!

জানস, হামারও অনেক অনেক সুখ আছে
এই যেমনঃ দাঁত ব্যথার সুখ
মেরুদণ্ডের হাড্ডি ক্ষয়ে যাওয়ার সুখ
রোজ রাইতে একলা একলা থাকবার সুখ!

হুন, তবুও আমার কোনো দুখ নেই…
একদিন পাহাড় ছিলাম আর অহন পাথর
তোরা চোখ-মুখে মাইখ্যা নে সুবাসিত আতর!

আমরা গভীর ভাবে বিশ্বাস করি, নতুন ধারার মাধ্যমে কবিতার পালাবদল হবে। নিত্য-নতুন ভাবধারা, রহস্যময় আবেদন এবং আঞ্চলিক শব্দের সমন্বয়ে নতুন ধারার কবিতা অবশ্যই পাঠক ফিরিয়ে আনবে এবং কবিতা ফিরে হারানো জৌলুশ এবং প্রাণের স্পন্দন।
————————–

অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় যাকাতের গুরুত্ব

নিঃসন্দেহে ইসলাম একটি বিশ্বজনীন শান্তি ও প্রগতির জীবন ব্যবস্থা। আর এই ইসলাম পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই ভিত্তি সমূহ যথাক্রমে কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব এবং যাকাত। এদের যে কোনো একটি অস্বীকারকারী কাফির এবং যিনি অস্বীকার করেন না; কিন্তু প্রতিপালনও করেন না… তিনি ফাসিক। তাই উপরোক্ত পাঁচটি মৌলিক ইবাদত যথাযথভাবে পালন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ বা অত্যাবশ্যক। ইসলামের এই মৌল ভিত্তির মধ্যে যাকাত অন্যতম। ইসলামে যাকাত প্রদান ফরজ। কারণ যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ দূর হওয়ার পাশাপাশি বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা সম্ভব।

যাকাত আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হলো- পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। যাকাত সম্পদকে পবিত্র করে এবং বিভিন্ন ক্ষতি ও কৃপণতা থেকে মানুষকে হেফাজত করে। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, কোনো ব্যক্তির কাছে যদি সংসারের যাবতীয় খরচাদি মেটানোর পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ বছর শেষে উদ্ধৃত থাকে, তাহলে তাকে উদ্ধৃত সম্পদের শতকরা ২.৫% আল্লাহকে তায়া’লা নির্ধারিত আটটি খাতে প্রদান করাকে যাকাত বলে। বলা বাহুল্য যে, যাকাত একটি আর্থিক ইবাদত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নিসাব পরিমাণ মাল হল, সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অথবা সমপরিমাণ অর্থ।

যাকাতের ইতিহাসঃ সৃষ্টির সূচনা থেকেই ইসলামে যাকাতের বিধান প্রচলিত ছিল। কারণ মহান রাব্বুল আলামীন যখন পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী হিসেবে তৈরি করেন, ঠিক সেই সময় থেকেই দুনিয়াতে ধনী ও দরিদ্র এ দুই শ্রেণির মানুষ বসবাস করে আসছে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি তাদের পরীক্ষার জন্য যাকাত প্রদানে উৎসাহিত করেছেন। তাই যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এ পর্যায়ে বিভিন্ন যুগে যাকাত প্রদানের ইতিহাস সম্পর্কে জানবো, হযরত ইবরাহীম (আ.) এর যুগে যাকাতের বিধান সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আমি তাদের ইমাম (নেতা) বানিয়েছি। যাতে তারা তাঁর নির্দেশনা মতো আমার বিধান অনুযায়ী চলে এবং আমার জন্য ভালো ভালো কাজ স্বরূপ নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করে। বস্তুত তারাই ইবাদতকারী ছিল।” হজরত ইসমাইল আ. সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘স্বরণ করুন, ইসমাইল আ. এর কিতাবের কথা। নিশ্চয়ই তিনি ওয়াদা সত্য প্রমাণকারী ছিল এবং তিনি নবি-রাসুল। তিনি তার জনগণকে নামাজ পড়ার ও যাকাত দেওয়ার নির্দেশ দিতেন। আর তিনি আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত’।

বনী ইসরাইলদের যুগে যাকাতের চুক্তি বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর স্বরণ করুন আমরা যখন বনী ইসরাইলের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলাম এই বলে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবে না। পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে। নামায কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে। হযরত ঈসা (আ.) যাকাত ও নামায সম্পর্কে অসিয়ত করে বলেন, “আল্লাহ তায়ালা আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন নামায ও যাকাত আদায় করতে।

পরবর্তীতে হযরত মোহাম্মদ (স) এর উপর যাকাত প্রদান ফরজ করা হয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ কুরআনের আয়াতসমূহের প্রায় সকল অবস্থায়ই দরিদ্রদের দুঃখ মোচনের আহবান জানানো হয়েছে। আর যারা যাকাত দেয় না তাদের তিরস্কার করা হয়েছে। তবে ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মুসলমানদের উপর যাকাত ফরয ছিল না। তবে পরবর্তীতে তা ফরজ করা হয়। পবিত্র কুরআন মাজিদের মোট ১৮টি সূরার ২৯ আয়াতে যাকাত শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। তন্মধ্যে ৯টি সুরা মাক্কী আর ৯টি মাদানী।

সুরা আল হজ্জ এ আল্লাহ যাকাতকে ফরজ ঘোষণা করে বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে আল্লাহকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। তারা এমন যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে।’

যাকাতের বিধানঃ তবে যাকাত সকলের উপর ফরজ নয়। স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক ও সম্পদশালী মুসলমানদের উপরই কেবল যাকাত ফরয। এক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে-

১. নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা, কিংবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া।
২. মুসলমান হওয়া। কাফেরের উপর যাকাত ফরজ নয়।
৩. বালেগ হওয়া। নাবালেগের উপর যাকাত ফরজ নয়।
৪. জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া। সর্বদা যে পাগল থাকে তার নেসাব পরিমাণ মাল থাকলেও তার উপর যাকাত ফরজ নয়।
৫. নেসাব পরিমাণ মালের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া।
৬. মাল বর্ধনশীল হওয়া।
৭. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া। দাস-দাসীর উপর যাকাত ফরজ নয়।
৮. মালের উপর পূর্ণ মালিকানা সাবিত থাকা। অসম্পূর্ণ মালিকানার উপর যাকাত ফরজ হয় না।
৯. নেসাব পরিমাণ মাল নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া।
যাকাতের খাতঃ নির্ধারিত খাতে যথাযথ ভাবে যাকাত প্রদান না করলে, তা আদায় হয় না। যাকাতের খাত নির্ধারণ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা করেছেন। সূরা তওবায় যাকাতের আটটি খাতের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “যাকাত তো সেসব লোকেরই জন্য- যারা অভাবগ্রস্ত, নিতান্ত নিঃস্ব, যারা তা সংগ্রহ করে আনে, যাদের অন্তরসমূহকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়, ক্রীতদাস মুক্তির ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহ পাক সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”

উক্ত আয়াতের আলোকে আটটি খাতে যাকাত বন্টন করার কথা বলা হয়েছে। তা হলো- ১. ফকির (যার নিতান্ত সামান্য পাথেয় আছে), ২. মিসকিন (যার কিছুই নেই), ৩. যাকাত সংগ্রহের কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তি (তার পারিশ্রমিক অনুযায়ী), ৪. দ্বীন ইসলামের প্রতি চিত্তাকর্ষণে কোনো অমুসলিম কিংবা ইসলামে অটল রাখার্থে নও মুসলিম, ৫. দাসদাসীর মুক্তি, ৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণমুক্তি, ৭. একান্ত ও শরিয়ত সম্মত আল্লাহর পথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে এবং ৮. রিক্তহস্ত মুসাফির।

অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় যাকাতের গুরুত্বঃ
ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। যেকোন সময়ের থেকে রমজান মাসে যাকাত আদায়ের গুরুত্ব আরও বেশি। কেননা এ সময় আল্লাহ বান্দার প্রত্যেকটি নেক আমলের সাওয়াব সত্তর গুণ বা আল্লাহ চাইলে অগণিত হারে বাড়িয়ে দিতে পারেন। আমাদের অনেকের ধারণা, যাকাত গরীবদের জন্য ধনীদের একটি দয়া বা অনুগ্রহ। কিন্তু মোটেই তা নয়। বরং যাকাত গরিবের অধিকার। সূরা আয যারিয়াতে আল্লাহ বলেন: ‘তাদের অর্থাৎ ধনীদের ধন-সম্পদে অবশ্যই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” মূলত যাকাত প্রদান না করলে সম্পদ পবিত্র হবে না, পরিশুদ্ধ হবে না। নিজের সম্পদে অন্যের হক থেকে যাবে। ফলশ্রুতিতে সম্পদ অপবিত্র হবে।

মহান আল্লাহ তায়ালা মানব জাতি কে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য যাকাত প্রদানের তাগিদ দিয়েছেন। কারণ যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজে ধনী এবং গরীবের মধ্যে ভেদাভেদ দূর হবে। যথাযথ ভাবে যাকাত আদায় না করলে ধনী ব্যক্তি আরও ধনী এবং গরীব আরও গরীব হতে থাকবে। ফলে মানুষের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। সমাজে শান্তি ও সম্প্রতি নষ্ট হয়ে বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাবে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস তার এক গবেষণা পত্রে দেখিয়েছেন, যদি বাংলাদেশের মালে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে, এমন সকল ব্যক্তি যথার্থ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যাকাত প্রদান করেন; তাহলে মাত্র সাড়ে সাত বছর পরে এদেশে যাকাত নেওয়ার মতো একজন লোকও অবশিষ্ট থাকবে না।

তাই পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি ও এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় যথাযথভাবে যাকাত আদায় করা জরুরি। একইভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়ের পাশাপাশি অন্যকে যাকাত দানে উৎসাহিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। কারণ যাকাত আদায়ের মাধ্যমেই কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন একটি সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব।
—————-

ছায়াসঙ্গী

০১
তখনো পাখি ডাকা শুরু করেনি। ভাঙেনি রাতের গোঙানি। তবুও প্রতিদিনের অভ্যাস মতো আজকেও ঘুম ছুটে যায় ছায়ার। দিনের আগে দিন শুরু হওয়ার আনন্দটা একেবারেই আলাদা। যে রোজ ভোরের পাখি হয়, সে ছাড়া অন্যকারো পক্ষে এর স্বাদ বুঝতে পারা শুধু কঠিনই নয়; একেবারে দুঃসাধ্য। এই আমেজের কেবল একটি উপমা-ই দেওয়া যায়, যেমনঃ লবণ, কাঁচামরিচ, আদা, খাঁটি সরিষার তেল পরিমাণ মতো চিড়ামুড়ির সাথে মাখিয়ে মচমচে করে খাওয়া। ছায়া জানলার ছিটকিনি খুলে বাইরে একবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়। সেই চোখ কী যেন খোঁজে.. কাকে যেন খুঁজছে…! এখনও ঘুটঘুটে আঁধার। এমন আধাঁর… যে আঁধার বাসি, পঁচা জলের মতোন আসক্তিহীন। তবুও এর একটা ভিন্ন ঘরানার জৌলুশ আছে। আদিমকালের মতো আটকোরা রুপ-যৌবন আছে। এখানেই বোধ করি মানুষের সাথে সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর সবকিছুই এমনি নিখুঁত, এমনি অকৃত্রিম।

ব্রাশ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসে ছায়া। বারান্দা তো নয়, যেনো ইনডোর ক্রিকেট খেলার পিচ। যেমন ইচ্ছে ব্যাটিং, বোলিং করার মতো জায়গা আছে। বল কুঁড়ানোর জন্য ৩/৪ জন ফিল্ডারও দাঁড় করিয়ে দেয়া যাবে অনায়াসেই। যদিও বল বাইরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। গ্রিলের বাঁধা ডিঙিয়ে বাইরে যাবে এমন সাহস কার? ছায়া বারকয়েক পায়চারি দিয়ে মর্নিংওয়াক সেরে নিলো। শরীরটা এখন আগের চেয়ে বেশ হালকা লাগছে। বারান্দার ঠিক মাঝ বরাবর চমতকার ফ্রেমে বাঁধানো একটি আয়না ঝুলছে৷ ছায়ার অনেককিছু না হলেও চলে কিন্তু আয়না ছাড়া চলে না। এজন্য মেয়েবেলায় তাকে মজা করে আয়নামতি বলে খেপানো হতো।
ছায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে আর দেখছে৷ এ দেখা যেনো কিছুতেই শেষ হচ্ছে না৷ নিজেই বুঝতে পারছে না সে কি যুবতী, না কিশোরী৷ দুই তৃতীয়াংশ ফোঁটা একটা গোলাপ যেনো ছায়ার রুপের কাছে কিছুই না৷ নাক, মুখ, চোখ সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর ছায়া কিছু একটা ভাবতে ভাবতে নিচের দিকে নামতে লাগলো।

অবশেষে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, তার মতো সুডৌল বক্ষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কোনো মেয়ের নেই। জান্নাতের হুরদের থাকলেও থাকতে পারে। ছায়া বেশ কিছুক্ষণ নিজের চোখে, মুখে, গালে, থুতনিতে, বাঁশির মতো খাড়া নাকে হাত বুলিয়ে আদর করে। আয়নার সামনে নিজেকে আদর করতে ছায়ার বেশ লাগে। একটা সময় ছায়ার অবাধ্য হাত দুটি নিচে নামতে চায়। ছায়া সাথে সাথে হাত দুটিকে শাসন করে। সরিয়ে নেয়। এসব করতে করতে হঠাৎ ছায়া খেয়াল করে আজও তার অবাধ্য চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ছায়া ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে জল মুছে নেয়। বুঝতে পারে তার মনটা এখন মোটেই ভালো নেই। একে যে করেই হোক ভালো করে তুলতেই হবে।

ছায়া আবার বাইরের দিকে তাকায়। কয়েকটা শেয়াল আর কুকুর একসাথে খেলা করছে। একটা আরেকটার মুখে মুখ ঘষে দিচ্ছে। নাকে নাক ঘাষ দিচ্ছে। লেজের দিকে আলতো কামড় দিচ্ছে। প্রকৃতির এই বিরুপ দৃশ্য দেখে ছায়া রোজকার মতো আজ আবারও আশা বেঁধে রাখে। ছায়া নিজেকে খুব ভালোবাসে। প্রত্যেক মানুষই তাই করে। ছায়া জানে মানুষের স্বভাবের, আচার আচরণের পরিবর্তন হয়। শিয়াল কুকুরের হয় না।
ছায়া বিশ্বাস করে যে মানুষটিকে একদিন সে সুতীব্র ঘৃণা করতো, সেই মানুষটিকে সে এখন সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। এমনকি তার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।

বড়লোক জামাই পেয়ে মা-বাবা একপ্রকার জোর জবরদস্তি করেই মানুষটার সাথে ছায়ার বিয়ে দিয়েছিল। তারপর ছায়ার জীবনেও আসে সেই বাসর ঘর! যে বাসর ঘরে সে তার প্রেমে পাগল পারা স্বামী বেচারাকে এতটুকু শরীর স্পর্শ করতে দেয়নি। লোকটি তাকে কত যে অনুনয় করেছে, কতবার যে তার বিনয়ের বাহু প্রসারিত করেছে, কতবার যে তার নিখাদ ভালোবাসার কসম করেছে… কিন্তু একটিবারের জন্যও জোর করেনি। তবে এতকিছুর পরও ছায়ার মন গলেনি। কেন গলেনি সেই ইতিহাস ছায়া আজও জানে না। অপমানে, ক্ষোভে সেই নিরপরাধ মানুষ টি ভোর ফুটার একটু আগে তার প্রাসাদের মতো বাড়িটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সেই যে গেল… তো গেল… আর ফিরে এলো না!

তারপর থেকেই শুরু হয় ছায়ার নতুন এক জীবন। যে জীবনে ছায়া নিজেই নিজের সঙ্গী। বলা যায়, ছায়াসঙ্গী। রোজ রোজ ভোরের বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আর তার হারিয়ে যাওয়া মানুষটির পথের বাঁকে তাকিয়ে থেকে নিজেকে খোঁজে!!
—————

ঈদের খুশি

ddf

ঈদের খুশি ঈদের খুশি
ঈদ গেলো কই?
এই যে দেখো খোকাখুকি
করছে রে হৈ হৈ!

সবার মুখে হাসি-খুশি
খুশি নদীর ঢেউ
গাছের ডালে পাখপাখালি
বাদ যাবে না কেউ!

খুরমা পোলাও খাবে সবাই
তর কি আর সয়
আরশি মনির বিড়াল ছানা
সেও পিছুপিছু রয়।

ঈদের খুশি ঈদের খুশি
ঈদ গেলো কই
নতুন চাঁদও সেই খুশিতে
হাতে নিলো বই!

কবিতায় নতুন ধারাঃ স্বপ্ন নয় বাস্তবতা

আমার কাছে কবিতার চেয়ে লাবণ্যময় তেমন কিছুই নেই। আমি সুদীর্ঘ দিন যাবত কবিতার সাথে আছি। কবিতা আমাকে হাসায়…. কবিতা আমাকে কাঁদায়… কবিতা আমাকে সজীবতা দেয়, প্রাণের পরশ দেয়।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, এখন কবিতার আগের সেই জৌলুশ আর নেই। পাঠক কবিতা পড়েন না, পড়তে চান না। কেন পড়েন না…. এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন! এর কারণ হল, কিছু কবি আধুনিকতার নাম করে কবিতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। তারা শব্দের জোড়াতালি দিয়ে এমন সব কবিতা লিখেন, যার পাঠোদ্ধার বা মর্ম হয়ত কবি নিজেই জানেন না! আর পাঠক কীভাবে এই কবিতা পড়ে আনন্দ লাভ করবেন? তারচেয়ে বরং কবিতা না পড়াই অনেক অনেক ভালো। এটাই হলো বাস্তবতা। এই যখন অবস্থা তখন প্রিয়কবি ফাহিম ফিরোজ কবিতাকে ভিন্নতর কিছু প্রচেষ্টা করছেন। কবিতাকে আবার সম্মানিত পাঠকের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এই চেষ্টার নাম হল, নতুন ধারা।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। এই ভাষায় আমরা কথা বলি, ভাব প্রকাশ করি। এই ভাষাতেই আমাদের হাসি, আমাদের কান্না, আমাদের সাহিত্য সাধনা। তাই আমরা অত্যন্ত গৌরব এবং অহংকারের সাথে বলি, বাংলা ভাষা আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয়। কারণ এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি। আর আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের অধিক পুরানো। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসের পেছনে প্রভাব বিস্তার করে আছে সংস্কৃত, উর্দু, ফার্সি, পর্তুগীজ, আরবি এবং ইংরেজি অনেক শব্দমালা।

সরাসরি অথবা পারিভাষিক ভাবে এই শব্দ কে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। এমনকি এখনও চলছে। মূলত একটি ভাষায় অন্য একটি ভাষার শব্দের এই আত্মীকরণ রোধ করা একটি কঠিন কাজ। ফলশ্রুতিতে চেতনে হোক কিংবা অবচেতনে হোক আমরা তাদের উপস্থিতি মেনে নিয়েছি অথবা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। আলোচনার স্বার্থেই এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছি। অন্যথায় নতুন ধারার আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকবে বলে আমার ধারণা।

জ্বী… আমরা কবিতায় নতুন ধারার কথা বলছি। কবিতায় নতুন ধারা নিঃসন্দেহে একটি আধুনিক চেতনার নাম। একটি বিপ্লবের নাম। স্বাদে, গন্ধে ভরপুর অপূর্ব একটি ব্যঞ্জনার নাম। আর যার হাত ধরে নতুন ধারার সাহিত্য, নতুন ধারার কবিতা আজ কোনো স্বপ্ন নয়; নিতান্ত বাস্তবতা… তিনি হলেন সাহিত্যে নতুন ধারা সৃষ্টির সার্থক রূপকার প্রিয়কবি ফাহিম ফিরোজ।

যার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নতুন ধারার কবিতা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। নতুন ধারার কবিতাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রোগ্রাম করার কথা ভাবছেন। আমরাও বিশ্বাস করি, নতুন ধারার কবিতা নিয়ে যতবেশি সম্ভব আলোচনা হবে, গঠন মূলক সমালোচনা হবে… নতুন ধারাও ততো বেশি সমৃদ্ধ এবং বিকশিত হবে। মূলতঃ নতুন ধারার কবিতার কাঠামোতে থাকবে শিথিলতা বা শৈথিল্য।

এবার আসা যাক, নতুন ধারার কবিতার ইশতেহার প্রসংগে। যে কোনো বিষয়ের সফলতার জন্য দরকার একটি রোড ম্যাপ। যথার্থ নির্দেশনা। নতুন ধারার সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা কবি ফাহিম ফিরোজ নতুন ধারার সারথিদের জন্য একটি ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। বলা দরকার যে, বাংলা সাহিত্য জগতে এটাই প্রথম ইশতেহার। এই ইশতেহারে তিনি বলেছেন, “করোনায় যেভাবে বিশ্ব আজ দলিত-মথিত, দ্রুত পরিবর্তিত, মৃত্যু, আর্তনাদ, শোক, একাকিত্ব, সন্দেহ, খাদ্যাভাব, অর্থ সংকট, বেকারত্ব, জন্মহীনতা– অতীত বিশ্বে কখনো এমন ভয়ংকর চিত্রের মুখোমুখি হয়নি মনুষ্য সমাজ। কবে এই অতিমারীর মুণ্ড কাটা যাইবো, কেউ নিশ্চিত কইতে পারেনা। চারদিকে জীবাণু হাতিয়ারের ইংগিত। বিশ্ব জুড়ে লেখককুল তাদের সৃষ্টিতে অতিমারীজনিত বিষয়াদি অগ্রাধিকার দেবেন এডাই সত্য। আধুনিক বিশ্বের মৃত্যু ঘইটছে। নতুন বিশ্ব এখন প্রসারিত। সমস্ত কিছুই দ্রুত আদল বদলাচ্ছে। আধূনিকের মতো অভেদ্য কাব্য নয় এখন, কিঞ্চিত সহজবোধ্য, কবিতার কোনো অংশ কণা লইয়া দীঘল ভাবনার অবসর কম রৈবে। নন্দন তত্ত্ব অনেকাংশে শক্তি হারাবে। শিল্প, ছন্দ, অছন্দ রৈবে। উপমা, রুপকল্পে কাঠিন্য নয়, সহজ স্বাভাবিক রুপ রৈবে বা না থাইকলেও ক্ষতি নাই। কাব্য গঠনে শিথিলতা রৈবে।

যাহা আধুনিকে আছিলোনা। মানুষ মৃত্যু আতংকে কম বেশি ধর্মমুখী হবে। আধুনিকরা যাহা নিষিদ্ধ কৈরছিলো। আস্তিক – নাস্তিক রৈবে। পরিহার্য রাজনৈতিক কোন্দল। প্রকৃতি, বিয়ং (রহস্যময়তা), কল্পনা, অলৌকিকতা জরুরি। নতুন শব্দ খেইল, ভোগবিমুখতা, নির্জনতা থাকবে। অসাম্যতার মৃত্যু ঘটিবে। নয়া পৃথিবীর এগিয়ে যাবে প্রগতির চাকা ছুঁয়ে, সবুজ ও মৃত্তিকার মেলবন্ধনে। শুধু ইতিহাস ঐতিহ্য নয়, এবার পুরাকীর্তি গণ্য হবে অধিক। পুরাকীর্তি না থাইকলে সে ইতিহাস মিথ্যাময়।

অথচ আধুনিকতায় ইতিহাসকই কম হৈলেও গুরুত্ব দেয়া হৈছিলো। ১. আত্মীয় আর সম্পর্ক বাচক শব্দের নাম সহ প্রয়োগ অপরিহার্য। ২. জরুরি প্রমিত ভাষার লগে লোকাল ভাষার কোমল মিশ্রণ। এদুটো বৈশিষ্ট্য নতুন পৃথিবীর নতুন ধারায় কবিতায় অনস্বীকার্য। যাহা আধুনিকে দূরের কথা, হাজার বছরের অধিক জীর্ণ বাংলা কবিতায়ও ছিলো না। প্রথমটি কারো কবিতায় থাইকলেও তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। কিন্তু নতুন ধারার কবিতায় সবার জন্য তা পিনাবদ্ধ। বহুরৈখিকতা আবশ্যক। আধুনিকের মতো শুধু মৌল নয়, গৌনদের কথাও কইবে। সমাজ কাঠামো নির্মাণে তাহাদের প্রভূত অবদান। ভালোবাসা, কাম, নারীর সৌন্দর্য ও ক্ষমতায়ন বৈধ। নতুন পৃথিবীতে সব কিছুই নবীকরণ। আধুনিকতার লগে যার দোস্তী ভাব নাই। করোনাকালীন সৃষ্ট সাহিত্যই বিশ্বে ‘নতুন ধারা’। এটা করোনাকালে ধূমকেতুর মত হঠাৎ, দৈবিক সৃষ্টি। কোনো বিবর্তন নয়। বিবর্তন ঘটে ধীরে। জয়তু নতুন ধারা।”

প্রিয় পাঠক, সত্যি কথা বলতে কী, ইশতিহারটি মনোযোগ দিয়ে কয়েকবার পাঠ করুন। আশাকরি তাহলে আপনি নিজেই নতুন ধারার সাহিত্য সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পেয়ে যাবেন। মূলত নতুন ধারা হলো প্রাণ খুলে লেখার একটি প্ল্যাটফরম। চাষীরা যেমন মনের সমস্ত মাধুরি মিশিয়ে খেতে-খামারে যেমন খুশি চাষ করে থাকেন, আপনিও আমাদের নতুন ধারার সাহিত্যে যেমন খুশি মজা নিতে নিতে লিখতে পারবেন। স্বাধীন ভাবে শব্দ চয়নের অবারিত সুযোগ পাবেন।

প্রিয়বন্ধুরা, এবার আসুন নতুন ধারার কবিতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিতে চেষ্টা করি। নতুন ধারার মানে নতুন আনন্দ, চিন্তা-চেতনা, ভালো লাগা, মন্দলাগা এককথায় আমাদের নিত্যদিনের জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা থেকে শুরু করে সবধরণের সমস্যা একটি আনন্দঘন ভিন্ন মাত্রার কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করা।

বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলাভাষী কবি এবং লেখকগণকে এই ধারায় ঐক্যবদ্ধ করাই ত আমাদের লক্ষ্য। এই ধারার কবিতার গঠন হবে সংক্ষিপ্ত, রস হবে প্রগাঢ়। যাতে কবিগণ থাকবে স্বাধীন। ইচ্ছেমতো প্রমিত শব্দের সাথে হারিয়ে যেতে থাকা আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার করতে পারবেন। আর পাঠকও সম্পূর্ণ কবিতা পড়ে রস আস্বাদন করতে পারবেন। এতে অহেতুক শব্দের বাড়াবাড়ি নেই। কঠিন কোনো বাক্য বিন্যাস নেই। কবিতার অর্থ বুঝতে পাঠককে গলদঘর্ম হতে হবে না। ডিকশনারি ঘাটতে হবে না। কবির ভালোবাসা ও বিশ্বাসে কবিতা চারাগাছ এর মতো বড় হবে। আসুন এই কথাগুলো মাথায় রেখে আমরা নতুন ধারায় কবিতা লিখি।

সম্মানিত পাঠক, এবার নতুন ধারার সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতা কবি ফাহিম ফিরোজ এর কবিতা থেকে একটি উদাহরণ দেয়া যাক।

কবিতাঃ কাগজের ঘর/ ফাহিম ফিরোজ

মাথা ঝারা দিলেই কয়লা বের হয় নাকে-মুখে…
পা’র নখে, ঝোঁকে ঢুকে হিমবাদী হাওয়া
কান দিয়ে বের হয়। মাসি, আমি কী আছি রে!
রইছি রইছি ঠিক, টিক্ বিয়াইন?
রেডিমেট খাটের উচ্চতা নিয়ে নভো ছোঁয়া
মিছাই প্রয়াস! কই যামু, পাবো খোয়ানো অতীত? কইল কইল তাই অনীল চাকমা
বুঝোনা শেখ পো? শূন্যে কাগজের ঘরে থাকো
সালান্তর… কালান্তর!

নোট= রইছি- রয়েছি। মিছাই- মিথ্যাই, কইলো- বলল। শেখ পো- শেখের ছেলে। কই যামু- কই যাব।

নতুন ধারায় লেখা কী অসাধারণ একটি কবিতা। অযথা শব্দ চয়ন যেমন নেই, তেমনি প্রতিটি শব্দ মেদহীন। বাংলা ভাষার প্রমিত শব্দাবলীর সাথে আঞ্চলিক শব্দের কী অসাধারণ মেলবন্ধন। কবিতাটি পাঠক করলেই বুঝা যায়, ইহা কবির প্রাণের পরশ দিয়ে লেখা। উপমা, অলংকার, অনুপ্রাস এবং রূপকের নামে কবিতাকে দুর্বোধ্য করে তোলা হয়নি। একেবারেই সহজ-সরল এবং সকল শ্রেণির পাঠকের বোধগম্যর সীমার মধ্যে। এই ধরণের কবিতা নিঃসন্দেহে পাঠককে বেঁধে রাখবে বলে আমার গভীর বিশ্বাস।

তাই আমরা বলছি, নতুন ধারা কবিতার জগতে একটি বিপ্লব। দুর্বোধ্যতা এবং কাঠিন্যের জন্য যে পাঠক কবিতা পড়তে ভুলে গেছেন, কবিতার বই পড়তে ভুলে গেছেন…. আমার দৃঢ় বিশ্বাস নতুন ধারার কবিতা আবার সেই পাঠককে ফিরিয়ে আনবে। আর আমরাও ফিরে পাব কবিতার হারানো ঐতিহ্য। জয়তু নতুন ধারা।।
শেষ করছি নতুন ধারায় লেখা আমার একটি কবিতা দিয়ে—-

সুবাসিত আতর // জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
———————
রাইত পোহালেই যে কবিতার প্রসব অইত জ্বর
সে-ই অহন আজিব আন্ধার রাইতের ঘর!
সখিনা তবুও রোজ রাইতে চিল্লাইতে চিল্লাইতে
কয়- “সবাই তরা সব্বাই সুখ নিবার চাস
দুঃখগুলো কেন আমার বাড়িত পড়ে রয়!

জানস, হামারও অনেক অনেক সুখ আছে
এই যেমনঃ দাঁত ব্যথার সুখ
মেরুদণ্ডের হাড্ডি ক্ষয়ে যাওয়ার সুখ
রোজ রাইতে একলা একলা থাকবার সুখ!

হুন, তবুও আমার কোনো দুখ নেই…
একদিন পাহাড় ছিলাম আর অহন পাথর
তোরা চোখ-মুখে মাইখ্যা নে সুবাসিত আতর!

.
————————–
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ। 01712536755

কানের ভেতরে আঙুল

আরশি কদম আলীর ছোট মেয়ে। তিনজনের মধ্যে তৃতীয়। বয়স মাত্র পাঁচ বছর। বলা চলে একটি সুবাসিত ফুলের কুঁড়ি। মুখে গুটিকয়েক দাঁত উঁকি দিয়েছে। সেই দাঁত মেলে যখন হাসে তখন কদমের ঘর আলোকিত হয়ে উঠে। আর যখন কাঁদে তখন আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো আঁধার নেমে আসে। আরশির মুখে কাবুলিওয়ালার মিনির মতোন অনর্গল কথার খৈ ফুটে। সে ভুতেদের জ্যান্ত ছবি আঁকতে পারে। পুতুলের বিয়েতে কান্নাকাটিও করতে পারে। এভাবেই কদমের কুঁড়েঘরে রোদ-বৃষ্টির খেলা চলে। ওর হাসি, অভিমানী কান্না, হাঁটা-চলা, কথা বলা সবকিছুতে এতো আলো যে, কদম মেঝেতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দিয়ে উড়তে থাকে। মেঘের সাথে কিছুক্ষণ ভাসার পর আরশির আকস্মিক ডাকে মাটিতে ফিরে আসে।

রোজকার মতো আজও আরশি আর কদম একসাথে ঘুমিয়েছে। এই ঘুম যেমন-তেমন ঘুম নয়। রীতিমতো বারো-তেরো হাত লম্বা ঘুম। এই ঘুমের আবার কয়েকটি বিশেষ স্টাইল আছে। এই যেমনঃ প্রথমেই আরশি কদমের বুকের উপর বুক রেখে শুইতে হবে। অতঃপর যতক্ষণ না আরশি ঘুমের রাজ্যে বেড়াতে না যায়, ততক্ষণ চলতে থাকবে কদমের গল্প বলা। অবশ্য এখানেই শেষ নয়, গল্পের বাঁকে বাঁকে চলতে থাকে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন। আর এসব প্রশ্নও যেন-তেন প্রশ্ন নয়। ধারালো তলোয়ারের মতো সুতীক্ষ্ম সেসব প্রশ্ন। কোনোরকম গড়-পরতা উত্তর দেওয়ার জো নেই। তাহলে জরিমানাসহ এর মাসুল গোনতে হয়।

ঘুম ভাঙতেই কদম বুঝতে পারে, সে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। একটি বিশেষ অবস্থা নিজের অজান্তেই অতিক্রম করে চলেছে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই রহস্যের জাল ছিঁড়ে যায়। কদম বুঝতে পারে, তার দুই কানের ভেতর দুটি মিহি আঙুল ঢুকানো আছে। চোখ না মেলেই বুঝতে পারল এ এ নিশ্চয়ই আরশি কাজ। আরও বুঝতে পারল নিশ্চয়ই এর কোনো জবরদস্ত কারণ আছে। কারণ আরশি উদ্দেশ্যহীন কোনো কিছু করে না। কদম কিছুক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করল। আরশি একইভাবে দুই কানে দুই আঙুল ঢুকিয়ে কদমের মাথার পাশে বসে আছে। অবশেষে আরশির ধৈর্যের কছে কদম আলী পরাজিত হল। জিজ্ঞেস করল, আমার কানে আঙুল ঢুকিয়েছ কেন মা?

আরশি বলল, মাম্মা সেলাই মেশিন চালাচ্ছে তো। তাই অনেক শব্দ হচ্ছে। তোমার যাতে ঘুৃৃম ভেঙে না যায়, এজন্য আমি তোমার কানে আঙুল ঢুকিয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ বসে আছি বাবা। বাবা, আমি কি ভালো কাজ করিনি?
আরশির কথা শুনে কদম খুব খুশি হল। এইটুকু মেয়ের এতোটা সুতীক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি! দেখে তার বুক সাত আকাশের সমান বড় হয়ে গেলো আর কেবলই হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর নাম মনে হতে লাগল। কদম আলী আরশির প্রশ্নের কোন জবাব দিল না আরশিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো।