মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট

মোঃ খালিদ উমর সম্পর্কে

কুয়াশা ঢাকা মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা!

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৯

কি ব্যাপার নিশাত ভাই খেতে এসেছেন? জাহাজের নিয়ম কিন্তু এই ডিউটির সময়ের সাথে খাওয়া, এক দল ডিউটিতে যাবার আগে খেয়ে যায় আবার তার পরে আর এক দল ডিউটি শেষ করে খেয়ে ঘুমাতে যায়।

ঠিক আছে সে না হয় বুঝলাম কিন্তু এই এত তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেলে রাতে ক্ষুধা লাগবে না তখন কি হবে?
কেন এই যে দেখেন এখানে ব্রেড, বাটার, জ্যাম, ডিম, দুধ সব কিছু রয়েছে ব্রিজেও থাকে। ক্ষুধা লাগলে যা ইচ্ছা খেয়ে নিবেন, স্যান্ডউইচ বানিয়ে নিতে পারেন এই যে এই ফ্রিজে টমাটো, শসা, লেটুস সব কিছু আছে কোন নিষেধ নেই, কেউ কিচ্ছু বলবে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, খাবার ব্যাপারে জাহাজে যথেষ্ট সাবধানতার সাথে খুব হিসেব করে মেনু তৈরি করে। চিটাগাঙে আর্টিক্যাল সই করেছেন তাতে দেখেননি এক জন মানুষের দৈনিক কি পরিমাণ এবং কোন ধরনের খাবার দিবে তা ওখানে লেখা আছে, দেখবেন এখানে এক খাবার পর পর দুই বার হবে না। প্রতি দিন ভিন্ন ভিন্ন মেনু থাকবে। এটার দায়িত্ব সেকেন্ড অফিসারের। মুকিত ভাই কিছু বলেনি?
না, বলার সময় পেল কোথায়, অন্যান্য কথায় সময় চলে গেল।
দেখবেন আরও অনেক নিয়ম আছে জাহাজে, নেন খেয়ে নেন আপনার আবার ডিউটির সময় হয়ে গেছে।
কি রান্না হয়েছে?
এখন সবজী, মুরগী আর ডাল
আচ্ছা ওই ফিলিপিনোরা কি খাবে? ওরাও কি এই খাবে? তারপর ক্যাপ্টেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওরা?
হ্যাঁ ওরাও এই খাবে, এখানে এমন ভাবে রান্না হয় যা সবাই খেতে পারে তবে ক্যাপ্টেন ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য আলাদা রান্না হয়।
আচ্ছা বেশ ভালোই তো এই নিয়ম, দেন দেখি কি দিবেন, তবে এনাম ভাই আমার কাছে এই বিকেল বেলা রাতের খাবার খেতে একটু কেমন অবাক লাগছে।
তা প্রথম প্রথম একটু লাগবেই, পরে অভ্যাস হয়ে গেলে তখন আর অসুবিধা হবে না।
খাবার খেয়ে নিশাত কেবিনে গিয়ে চিটাগাং থেকে দেয়া ডিউটির পোশাক পড়ে ডেকে মুকিত ভাইর কাছে গেল। মুকিত ভাই ওকে দেখে বলল কি ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি এলে?
তাড়াতাড়িই এলাম দেখি কি হচ্ছে।
বেশ ভালো কথা, হ্যাঁ সব সময় এই ভাবে পাঁচ সাত মিনিট আগে আসবে এতে অফিসাররা তোমাকে সুদৃষ্টিতে দেখবে।

ওদের কথা বলতে বলতে চীফ অফিসার অরুণ এসে হাজির।
কি ব্যাপার নিশাত, বল দেশের খবর কি, তখন একটু কাজ করছিলাম বলে কথা বলতে পারিনি, তোমার শরীরে বাংলাদেশের গন্ধ পাচ্ছি।
না, অরুণ’দা বাংলা দেশের গন্ধ দুবাইতে দামী হোটেলের দামী সাবান দিয়ে গোছল করে ধুয়ে ফেলেছি।
আরে ধুর কি বল! আমি এখনও গন্ধ পাচ্ছি, সাবান দিয়ে কি দেশের গন্ধ ধোয়া যায়? আমার মনে হচ্ছে বাংলাদেশটা বুঝি এসে পরেছে। তা বল দেখি কোন কোন ঘাট ধরে এসেছ?
নিশাত এক এক করে বলছে আর মুকিত, অরুণ ডেকের আর দুই জন শাহিন এবং জয়নুল এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে।
একটু পরে কথা শেষ করে মুকিত বলল তাহলে অরুণ’দা আমি যাই? মুকিত ভাই চলে যাবার পর নিশাত অরুণ’দার সাথে ব্রিজে ঢুকল। অরুণ’দা প্রথমেই সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, ব্রিজ দেখেই নিশাতের খুব ভালো লেগে গেল। মন দিয়ে সব শুনছে। প্রাথমিক ভাবে দেখে যা বোঝা যায় এক নজরে দেখে নিয়েছে। রাডার, স্টিয়ারিং হুইল, কম্পাস, জাইরো কম্পাস, হেল্মস ইন্ডিকেটর, ইঞ্জিন রুম টেলিগ্রাম, ব্যারো মিটার, হাইগ্রো মিটার, ট্রিমিং ইন্ডিকেটর, ইকো সাউন্ডার, স্যাটালাইট ন্যাভিগেটর, ডেকা ন্যাভিগেটর আরও কত কি!
অরুণ’দা ব্রিজের টেবিলের পাশে কফি বার থেকে কফি বানিয়ে কাপ হাতে নিয়ে এলো চার্ট টেবিলের কাছে। অরুণ’দা চার্ট টেবিলে একটা ম্যাপের মত মেলে কি যেন করছে
ভূগোল, ম্যাপ কেমন বুঝ?
একে বারে খারাপ না, ভূগোল আমার প্রিয় সাবজেক্ট,
তাই নাকি! বেশ ভালো হয়েছে, তাহলে ম্যাপ বুঝতে তোমার সুবিধা হবে।
টেবিলের উপর একটা ম্যাপের মত বিছানো রয়েছে। তার পাশে কাটা কম্পাস, দুইটা বড় স্কেলের মত এক সাথে জোড়া লাগান রয়েছে এগুলি দেখিয়ে আবার বলল
দেখ তো এগুলি চিনতে পার কি না?
হ্যাঁ এটা একটা ম্যাপ বুঝতে পারছি এই যে এই হচ্ছে সাগর, আর এই যে আমরা যেখান থেকে এসেছি সেই এলাকা, এই হচ্ছে ল্যাটিচুড মার্ক আর এটা লঙ্গিচুড, আর এই পেন্সিলের লাইনটা মনে হচ্ছে আমাদের রাস্তা, তাই না?
বাহ বেশ!, তুমি তো অনেক জান দেখছি!
তবে এই স্কেলটা এমন কেন?
এটাকে প্যারালাল রোলার বলে, দেখ এটা দিয়ে কি করি
এবার চার্ট টেবিলের পাশে উপরে দেয়ালের সাথে লাগান ডেকা ন্যাভিগেটর কেমন যেন একটা ক্লিক ক্লিক শব্দ করছিল ওটায় কি রিডিং দেখে রোলার দিয়ে মেপে চার্টে একটা দাগ দিয়ে বলল
এই যে আমরা এখানে আছি এখন
ও বুঝেছি এর নাম নেভিগেশন?
হ্যাঁ।

কফি শেষ হয়ে গেছে কাপ ধুয়ে রেখে দিল। রাডার দেখে বলল
আচ্ছা এই যে সাদা দাগ দেখা যাচ্ছে এগুলি কি?
ওগুলি জাহাজ বা অন্য কিছু হতে পারে, সে তুমি লক্ষ্য করে দেখবে এই দাগ মুভ করছে কি না, যদি মুভ করে তা হলে বুঝবে এটা জাহাজ, আর যদি মুভ না করে স্থির থাকে তা হলে বুঝবে ওটা সাগরের কোন বয়া বা কোন স্থির কিছু হবে, ওয়েল রিগও হতে পারে, দেখ আমাদের পিছনে এই স্থল ভাগ কেমন দেখাচ্ছে, আর সাগরের পানি কেমন দেখাচ্ছে। এখানে এই যে এই রাডার এটার রেঞ্জ আরও বেশি। এই ইংলিশ চ্যানেলে আমরা এটা চালাই না। এখানে এই ৫০ মাইল রেঞ্জ যথেষ্ট। আর একটু কফি খাবে?
না আর না আপনি খেলে খান আমি বানিয়ে দিই?
না না আমিই বানিয়ে নিচ্ছি
কি শাহিন তুমি খাবে?
না দাদা।
ওকে আজ এই পর্যন্তই, তুমি স্টিয়ারিং করতে পারবে?
চেষ্টা করে দেখি
শাহিন ওকে একটু দাও তো।
শাহিন স্টিয়ারিং হুইল ছেড়ে টুল থেকে নেমে এলো, নিশাত ওখানে বসে স্টিয়ারিং হাতে নিলো।
শাহিন বলে দিল এটা হচ্ছে হেল্মস ইন্ডিকেটর মানে আপনার স্টিয়ারিং সোজা আছে না কোন দিকে ঘুরছে তা বুঝতে পারবেন আর এই হচ্ছে আপনার কম্পাস। দেখেন আমাদের জাহাজের হেড এখন কত ডিগ্রিতে আছে দেখছেন?
হ্যাঁ দেখলাম,
তাহলে ঠিক এই কোর্সে রেখে চালান।
নিশাত স্টিয়ারিং করছে। অরুণ ব্রিজের বাইরে বের হয়ে পিছনে দেখে এসে বলল তোমার স্টিয়ারিং ঠিক হচ্ছে না।
কি ভাবে বুঝলেন?
কি ভাবে বুঝলাম দেখবে এসো আমার সাথে।
ব্রিজের বাইরে এসে পিছনে প্রপেলারের ঘূর্ণির ফলে পানিতে ফেনা উঠেছে সেদিকে দেখিয়ে বলল
দেখ কেমন জিগ জাগ দেখাচ্ছে না? কারেক্ট স্টিয়ারিং হলে এই লাইনটা সোজা হবে। এই দেখে মিটার না দেখে যে কেউ বলতে পারবে স্টিয়ারিং কেমন হচ্ছে। তবে সে যা হোক তুমি যে সাহস করে হাতে নিয়েছ এতেই আমি খুশি, আস্তে আস্তে শিখে নিও।
দাদা ফরিদা কোথায় আছে একটু দেখবেন?
হ্যাঁ দেখছি,
ফরিদাকে ডেকে পেল না।
আমার মনে হয় ওরা ইউরোপে নেই। কেন, ফরিদাকে কেন?
আমার সাথে আমার এক বন্ধু এসেছে ওকে ফরিদায় দিয়েছে তাই জানতে চাচ্ছিলাম ওরা কোথায় আছে
ও আচ্ছা! তোমার বন্ধু কে?
হাবিব!
হাবিব?
আমি আর হাবিব এক সাথে এসেছি, আমরা এক সাথে একই কলেজে পড়া শুনা করেছি এবং আমাদের বাড়িও এক জায়গায়।
ও, তাই নাকি?

১১।
আজ নিশাত ঘুম থেকে উঠেই লক্ষ করল জাহাজের ইঞ্জিন চলছে না থেমে আছে। কি ব্যাপার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে জাহাজ চলছে না এবং কোন রোলিং হচ্ছে না, নোঙর করে রয়েছে। কাছা কাছি আরও অনেক জাহাজ এমনি নোঙ্গরে রয়েছে। সউদি আরবের সবুজ সাদা পতাকা উড়ছে। কেবিন থেকে বের হয়ে ওই ডেক থেকে নেমে মেইন ডেকে এসে বাইরে দেখে এটা এক নতুন দেশ। সুয়েজ খালের পাশে যেমন দেখেছে অনেকটা ওই রকম। সামনে একটা ডকইয়ার্ড দেখা যাচ্ছে আশে পাশে বেশ কয়েকটা বিশাল বিশাল জাহাজ নোঙ্গর করে আছে। ওইতো দূরে কিনারা দেখা যাচ্ছ। একটু একটু ওগুলি কি মাটির ঘর, না কী ওগুলি? সুয়েজের দুই পাড়ে আরব দেশগুলিতে এমন দেখেছে। অন্যান্য সমুদ্র বন্দর যেমন হয় ছোট ছোট অনেক বোট এবং পালের বোট এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে। ওইতো সমুদ্রের মাঝখানে জেটি দেখা যাচ্ছে, অনেকগুলি জাহাজ ভিড়ে রয়েছে। মনে হয় সবগুলি ট্যাংকার হবে, একটারও মাস্তুল বা ক্রেন নেই। নিশাত অবাক হয়ে শুধু দেখছে। নাস্তা খাবার কথা ভুলে গেছে। মিডল ইস্টের প্রচণ্ড গরমেও ওর খেয়াল নেই। লন্ডন থেকে এখানে আসার পথে এ পর্যন্ত কতগুলি দেশ এবং সাগর দেখে নিয়েছে। মনে মনে শুধু ভাবছে, এ কোথায় এসেছি! কত কি দেখছি! কি আনন্দের চাকরী! তন্ময় হয়ে যখন দেখছে আর ভাবছে তখন ব্রিজ থেকে অরুণ’দা ডাকল ‘এই নিশাত ওখানে কি করছ?’ নিশাতের সম্বিত ফিরে এলো। পিছনে ফিরে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল অরুণ’দা ডাকছে! দেখছি অরুণ’দা! কাপড় বদলে ব্রিজে চলে আস!
আচ্ছা আসছি!
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৮

ভিতরে গিয়ে দেখে এটা ইমিগ্রেশন অফিস। এন্ড্রু ইমিগ্রেশন অফিসারকে দিয়ে সই স্বাক্ষর করিয়ে পাশের ছোট জেটিতে ভিড়ে থাকা একটা ছোট স্পিড বোটের কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বোটের চালককে ডাকল। একটু পরে ভিতর থেকে বোটের ড্রাইভার বের হয়ে এসেই কি কি যেন বলল। এন্ড্রু ওদের দেখিয়ে আবার কি বলল। ড্রাইভার ওদের নামার পথ দেখিয়ে দিল। এন্ড্রু গুডবাই বলে আবার দেখা হবার আশ্বাস দিয়ে চলে গেল।
বোট ছেড়ে দিল। প্রচণ্ড বাতাস বইছে, মাথার চুল এলো মেলো উড়ছে, ভীষণ ঠাণ্ডা গায়ের জ্যাকেটে বাতাস ফর ফর শব্দ তুলছে। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস। ওরা আধ খোলা বোটের বাইরে থেকে ভিতরে গিয়ে ড্রাইভারের পিছনে বেঞ্চে বসল। আর ড্রাইভার দূরের একটা জাহাজ দেখিয়ে বলল ওই যে তোমাদের জাহাজ। প্রায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যে ওই জাহাজের পাশে এসে ভিড়ল। একটু দূরে থেকে দেখতে পেয়েছিল জাহাজের পাশে যেখানে বোট ভিড়বে সেখানে একটা সিঁড়ি নামিয়ে রেখেছে। পাশে কয়েক জন জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বোট ভিড়ার পর ওরা এক এক করে সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে উঠে গেল। নিশাত কোন দিন এমন সিঁড়ি বেয়ে উঠেনি বলে ভয় পাচ্ছিল। তাই দেখে উপর থেকে কে এক জন একটু আগেই হাত বাড়িয়ে নিশাতের কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে ওকে ধরে উঠাল। জাহাজে উঠে দেখে ওর স্কুলে নিশাতের সিনিয়র মুকিত ভাই সবার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সেও অবাক হয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল,
আরে নিশাত তুমি! আমি তো ভাবতেই পারছি না! কাকে দেখছি!
হ্যাঁ মুকিত ভাই আমিও দূর থেকে আপনাকে দেখে ভাবছিলাম চেনা চেনা লাগছে কে হতে পারে? যাক ভালোই হয়েছে আপনাকে পেয়ে।

চল ভিতরে যাই
বোট ড্রাইভার ওদের নামিয়ে দিয়ে ওরা যাদের জায়গায় এসেছে তাদের নিয়ে ফিরে গেল। মুকিত ইউনিফর্ম পরা ছিল কিন্তু নিশাত এই ইউনিফর্মের মানে কি জানে না। এর আগে কখন জাহাজে উঠেনি। জাহাজে উঠেনি বলতে এক বার যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন ওর বন্ধুর সাথে করাচীর মনওয়ারাতে নেভীর সাব মেরিন দেখতে গিয়েছিল। ব্যাস এই পর্যন্তই ওর জাহাজ সম্পর্কে ধারনা। মুকিত ভাই সবাইকে নিয়ে ভিতরে গিয়ে সবার থাকার কেবিন দেখিয়ে দিয়ে যার যার ব্যাগ রেখে নিয়ে গেল ক্যাপ্টেনের রুমে। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ওদের দেখে এগিয়ে এসে ওয়েল কাম জানিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে সৌজন্য মূলক কিছু কথা বার্তা বলে যার যার সিডিসি চেয়ে নিয়ে খুলে সবার চেহারা মিলিয়ে দেখল। এবার ভিতরে দেখছে কে কোথায় কোন কোন জাহাজে কাজ করেছে। সব দেখে নিশাতকে বলল ও তুমি একে বারে নতুন। বেশ, মুকিত তুমি ওকে ভালো করে সব কিছু বুঝিয়ে দিবে। এর পর অন্যান্য যারা ছিল তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এনামুলকে ওর কাজের জায়গা গ্যালিতে নিয়ে চীফ কুক অরবিন্দ সিনহার কাছে বুঝিয়ে দিল। সালেককে সারেং এর কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নিশাতকে নিয়ে চীফ অফিসার অরুণ এর কাছে নিয়ে গেল। এখানে এসে কথায় কথায় বুঝল মুকিত ভাই সেকেন্ড অফিসার। জাহাজে ডেক অফিসার এবং ডেক ক্রু সবাই বাংলাদেশি তবে চীফ কুক সিনহা কোলকাতার। ক্যাপ্টেন ব্রিটিশ, চিফ ইঞ্জিনিয়ার গ্রীক এবং অন্য ইঞ্জিনিয়ার ও ইঞ্জিন ক্রু সবাই ফিলিপাইনের।

মুকিত ভাই স্টোর থেকে ওদের বিছানার চাদর বিছানা পত্র গোছলের সাবান, কাপড় ধোয়ার ডিটার্জেন্ট পাউডার আর যা যা লাগে সব বের করে দিয়ে সব গুছিয়ে ব্রিজে যাবার কথা বলে আবার চীফ অফিসারের কাছে গেল।
নিশাত তার জন্য সুন্দর পরিপাটি করে সাজান কেবিন দেখে অবাক হলো। এই টুক ঘরের মধ্যে বিছানা, মাথার পাশে একটা রিডিং লাইট, পাশের দেয়ালে জাহাজের লে আউট নক্সা, বিছানার নিচে জুতা রাখার বক্স, হাবি জাবি এটা সেটা রাখার ড্রয়ার, কাপড় চোপড় রাখার জন্য পাশে ছোট্ট একটা আলমারি, আলমারির এ পাশে তোয়ালে ঝুলিয়ে রাখার একটা হ্যাঙ্গার, একটা ছোট টেবিল, চেয়ার, টেবিলের উপরে সেলফের মত তাতে সেভিং ক্রিম টুথ ব্রাশ এই জাতিয় জিনিস রাখা যায়, তার উপরে একটা বেশ বড় আয়না, আবার ছোট্ট একটু খানি গোল একটা সিঙকে ঠাণ্ডা গরম পানির ব্যবস্থা, এর উপরেও শেভ হবার জন্য একটা আয়না আবার আয়নার উপরে একটা লাইট। জানালায় মোটা ভারি পর্দা। ফ্লোরে কার্পেট বিছানো, পুরো জাহাজটাই এয়ারকন্ডিশন্ড, গরম বাতাস বের হচ্ছে। এতো কিছু, এতো আয়োজন দেখে নিশাতের বেশ ভালো লাগল। বাহ! কি সুন্দর পরিবেশ। এমন চাকরী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এতো আরামের ব্যবস্থা। এই সব ভাবছে আর বিছানা গোছাচ্ছে, ব্যাগ থেকে বের করে যেখানে যা রাখার সেগুলি গুছিয়ে রাখছে। নিশাত বরাবরই গুছিয়ে ছিম ছাম ভাবে থাকা পছন্দ করে। তার কাছে এমন পরিবেশ ভালো লাগার কথা। এই গুছিয়ে রাখছে আর ভাবছে এমন সময় মুকিত ভাই এসে জানাল নিশাত তোমার ডিউটি কিন্তু সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আবার সকালে ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এখন তোমার ব্রিজে না গেলেও চলবে তবে দেখতে চাইলে যেতে পার এখন আমার ডিউটি চলছে। তুমি অরুণ দাদার সাথে ডিউটি করবে। আমরা এখন মিডল ইস্টে চলে যাব। আচ্ছা ভালো কথা কিছু খাবে, ক্ষুধা লেগেছে?
না মুকিত ভাই হোটেল থেকে খেয়েই বের হয়েছি।
আচ্ছা তা হলে তুমি এগুলি সেরে উপরে এসো আমি যাই, নোঙ্গর তুলতে হবে।
মুকিত ভাই চলে গেল নিশাত একটু পরে সব সেরে ব্রিজে গেল। দেখে জাহাজ চলছে।
কত দিন লাগবে মুকিত ভাই?
কিসের?
না এই যে আমরা মিডল ইস্টে যাচ্ছি সেখানে যেতে
দশ/বার দিন লেগে যাবে যদি সুয়েজে ট্রাফিক না থাকে, এবার যাব সউদি আরবের রাস্তানুরাহ পোর্টে।
কিন্তু আমি যে জাহাজের কিছুই জানি না চিনি না।
তাতে কি, যারা নতুন আসে তারা কেউ কিছু জানে না, সব দেখিয়ে চিনিয়ে দিবো তুমি কিচ্ছু চিন্তা করোনা, আমার সাথে তোমার ডিউটি হলে ভালো হত তবে অরুণ দাদা খুব ভালো মানুষ দেখবে সে তোমাকে সব শিখিয়ে দিবে। আচ্ছা এবার দেশের কথা বল, কি অবস্থা?
বলেই একটু ভেবে বলল
না থাক পরে শুনব এখন ইমিগ্রেশন হবে জেটিতে জাহাজ ভিড়িয়ে নেই, অরুণ দাদাও শুনবে, চা কফি সবই আছে কি খাবে?
কিচেনে যেতে হবে?
না, এখানেই ব্যবস্থা আছে,
হ্যাঁ চা খেতে পারি
তা হলে ওই দেখ ওই ইলেকট্রিক জগে পানি গরম দাও আর দেখ ওখানেই চা পাতা দুধ চিনি সব আছে বানিয়ে নাও, আমাকেও এক কাপ দিও।
নিশাত চা বানাচ্ছে আর মুকিত ভাইর কথা শুনছে,
আর শোন, জাহাজের কিছু ভাষা আলাদা যেমন এখানে কিচেনকে বলে গ্যালি, আমরা যেখানে বসি, টিভি দেখি ওটার নাম সেলুন এরকম আরও অনেক কিছু আছে সে আস্তে আস্তে সব জানবে। আমার কাছে কিছু বই আছে ওগুলি নিয়ে পড়বে। আমি আগামী ভয়েজ শেষ করে ইংল্যান্ডে যাব চীফ মেট পরীক্ষা দেবার জন্য।
মানে অরুণ’দা যা তাই?
হ্যাঁ, তুমিও পারবে কয়েক বৎসর গেলে সরাসরি সেকেন্ড মেট পরীক্ষা দিও, এর মধ্যে যদি ভালো ভাবে সব কিছু শিখে নিতে পার তা হলে দুই এক বৎসরের মধ্যেই ক্যাপ্টেন তোমাকে থার্ড অফিসারে প্রমোশন দিতে পারে। কাজেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু বই গুলি দেখবে। সেলুনেও দেখবে কিছু বই আছে সেগুলিও পড়তে পার। অবসর সময়ে আজে বাজে চিন্তা ভাবনা না করে, সিনেমা না দেখে পড়াশুনা করতে হবে।
কি কি পড়তে হবে?
অনেক কিছু, নেভিগেশন, সিম্যানশিপ, কম্পাস, চার্ট ওয়ার্ক, রুল অফ দা রোড, সিগনালিং, ফার্স্ট এইড আমি বলে দিবো সব। তোমার ভাগ্য ভালো আমার কাছে এসে পৌঁছেছ। কোন চিন্তা করবে না। কাজে মন দিবে কে কখন কি করে সব কিছু মন দিয়ে লক্ষ্য করবে, দেখবে তুমিও পারবে।
হ্যাঁ ঢাকা থেকে আমার মামা বলেছে এখানে নাকি এ ভাবে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হওয়া যায়?
হ্যাঁ। আচ্ছা ঐযে দেখছ পাইলট লঞ্চ আসছে?
হ্যাঁ ওই যে উপরে একটা লাল সাদা ফ্ল্যাগ উড়ছে ওইটা?
হ্যাঁ, ওটায় পাইলট আসছে, ও আমাদের নিয়ে জেটিতে ভিড়িয়ে দিবে।
পাইলট তো শুনেছি প্লেন চালায়
হ্যাঁ আসলে পাইলট মানে পথ প্রদর্শক, কাজেই যে পথ দেখিয়ে নেয় সেই তো পাইলট তাই না?
ও হ্যাঁ তাই, কিন্তু আপনারা একা জেটিতে ভিড়তে পারেন না?
পারি কিন্তু এটা নিয়ম না, কারণ প্রত্যেক দেশের হারবারের নিজস্ব কিছু কিছু নিয়ম থাকে, হারবারে পানির নিচে কোথায় কি আছে তা আমরা জানি না, ওগুলি এই পাইলটেরা জানে, এদেরও আমাদের মত সার্টিফিকেট আছে। এদের বিশেষ ভাবে এই হারবার এলাকার উপর ট্রেনিং দিয়ে পাইলট বানানো হয়। এটা আন্তর্জাতিক আইন।

কথা বলতে বলতে মুকিত ভাই জাহাজের স্পিড কমিয়ে এক সময় থামিয়ে দিল আর ওই পাইলট লঞ্চ এসে জাহাজের পাশে আগে থেকে নামানো সিঁড়ির কাছে ভিড়ল আর সিঁড়ি বেয়ে পাইলট উঠে এলো। পাইলটকে নামিয়ে দিয়ে লঞ্চ চলে গেল। জাহাজের স্পিড বাড়িয়ে দিল। পাইলট উপরে ব্রিজে উঠে এসে মুকিত ভাইর সাথে একটু কথা বলে যে স্টিয়ারিং করছিল তাকে কি সব অর্ডার দিচ্ছে আর সে সেই ভাবে স্টিয়ারিং করে করে এক সময় জাহাজ লন্ডন পোর্ট ইমিগ্রেশন অফিসের জেটিতে ভিড়িয়ে দিল। মুকিত ভাইকেও ইঞ্জিনের গতি সম্পর্কে বলছিল। জাহাজের সামনে পিছনে কোন রশি কখন বাধতে হবে পাইলট তাও বলে দিচ্ছিল। জাহাজ ভিড়ার পর কিছু কাগজ পত্রে ক্যাপ্টেনের সই নিয়ে পাইলট নেমে গেল। একটু পরে জেটির পাশে একটা পিক আপ এসে থামল।
ওটা দেখে জয়নুল বলল স্যার ওই তো ওরা এসে গেছে,
ইমিগ্রেশন অফিসার ও তার সহকারী এবং কাস্টম অফিসার জাহাজে উঠে এলো। মুকিত ভাই এবং পাইলট নিচে নেমে গেল। পাইলট এখান থেকে চলে গেল আর মুকিত ভাই অফিসারদের নিয়ে ক্যাপ্টেনের অফিসে ঢুকল। ওখানে জাহাজের সবার সিডিসি, ক্রু লিস্ট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে দেখে সই স্বাক্ষর দিয়ে চলে গেল। এবার এখান থেকে বের হয়ে ইংলিশ চ্যানেল, বে অফ ভিস্কি এবং জিব্রালটার প্রণালী হয়ে ভূমধ্য সাগর দিয়ে সুয়েজ খাল পাড় হয়ে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে মিডল ইস্টে যেতে হবে। শুনে নিশাত খুব খুশি। একসাথে এত গুলা দেশ দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে! এতদিন যে সব দেশের নাম শুধু ভূগোল বইতে পড়েছে আজ সেগুলি নিজ চোখে দেখতে পাবে! কি আনন্দ!

জাহাজ চলছে। মুকিত ভাই একটু পরে বলল যাও তুমি রেস্ট নাও রাতে তোমার ডিউটি আছে। নিশাত এসে বিছানায় শুয়ে পরল কিন্তু বইতে পড়া এবং গল্পে শোনা ইংলিশ চ্যানেলের বুকে তার জাহাজ সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে এই আনন্দে নিশাতের ঘুম আসছে না সে উঠে কেবিনের জানালা দিয়ে বাইরে খোলা সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু দেশ ছেড়ে আসার পর গত কয়েকদিনের উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা এবং ক্লান্তির জন্য কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি ধরমর করে উঠে আশে পাশে সবকিছু নতুন এবং অচেনা দেখে বোঝার চেষ্টা করল আমি কোথায়? আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। আমি এখন জাহাজে। যে জাহাজে চাকরী করার জন্য দেশ ছেড়ে মা বাবা ভাই বোন ছেড়ে এত দূরে এসেছি গত কয়েকদিন ভরে। বিছানা ছেড়ে উঠে কেবিনের সিংকে মুখ ধুয়ে ব্রিজে চলে এলো। আরে নিশাত এসো এসো। এখনি এসে পড়েছ?
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
তাহলে আর আসার কি দরকার ছিল যাও তুমি রাতের খাবার খেয়ে ইউনিফর্ম পরে রেডি হয়ে এসো।
নিশাত ব্রিজ থেকে সরাসরি গ্যালিতে এসে দেখে এনামুল বসে আছে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৭

দুপুরে খাবার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে, বিশ্রাম আর কি হল রুমে বসে টিভি দেখার পর নিশাত বলল চলেন বাইরে থেকে ঘুরে আসি। আমার একটা ক্যামেরা কেনার শখ অনেক দিনের দেখি যদি পাই নিয়ে আসব।
চলেন ঘরে বসে থেকে কি করবো তার চেয়ে ঘুরে আসি, আমরাও কখনো এই দেশে আসিনি।

আপনারা এর আগে কোথায় কোথায় গেছেন?
আমি বেশি গেছি ইস্টে, অনেক জায়গায় গেছি, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং।
ওদিকে কেমন দেখেছেন?
ওদিকে এরকম শীত নেই, গাছপালা আছে, সবুজ আছে, বিদেশে সব জায়গাই ভালো, মানে আমাদের দেশের মত এত চোর বাটপার পকেট মার নেই তবে দেখতে আমাদের দেশ সুন্দর যদি এই সব না থাকত তাহলে আমাদের দেশই সবচেয়ে ভাল দেশ হতো।
জাহাজে চাকরী করলে এই একটা সুবিধা তাই না? বিভিন্ন দেশ দেখা যায়। এইযে দেখেন এই আমি এখনও জাহাজি উঠিনি অথচ এর মধ্যে দুইটা দেশ দেখা হয়ে গেল!

৯।
ওরে বাব্বা যা ঠাণ্ডা, একটু চা হলে ভালো হতো।
চলেন দেখি হোটেলে যাই ওখানে চা বা কফি পাই কি না।
হ্যাঁ চলেন
তিন জনেই হোটেলে এসে দেখে দুপুরের খাবার খাচ্ছে কেউ কেউ।
তা হলে আমরাও খেয়ে যাই?
হ্যাঁ তা খারাপ হয় না আমি তখন তেমন খেতে পারিনি
ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করল এখানে কি মেনু আছে?
ওয়েটার মেনু এনে দিল।
মেনুতে দেখে সব ইংলিশ খাবার।
তাহলে আমাদের খাবার কি হবে?
নিশাত ভাই এক কাজ করেন ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করেন এশিয়ান খাবার আছে কি না!
আচ্ছা!
নিশাত ওয়েটারকে ডেকে বলল, তখন ওয়েটার বলল
দুঃখিত তেমন কিছু এখানে নেই তবে তোমরা ফিস অথবা চিকেন এন্ড চিপস বা রাইস খেতে পারবে
ওদের সাথে একটু আলাপ করে নিয়ে বলে দিল এখন ফিস এন্ড চিপস দাও রাতে চিকেন এন্ড রাইস খাব
হ্যাঁ আমিও
আমিও
আচ্ছা তা হলে সবার জন্য একই আইটেম
ওয়েটার চলে গেল। একটু পড়ে খাবার নিয়ে আসল তিনটা ডিশ ভরে, বিশাল এক টুকরা ভাজা মাছ, বেশ অনেক গুলো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, অনেক সালাদ।
খেয়ে বেশ ভালই পেট ভরল। তবে নিশাত ভাবল এই শুরু হলো বিদেশের খাবার। এখন আর ইচ্ছে করলেই মায়ের রান্না খাবার পাওয়া যাবে না কিংবা মাকে জ্বালাতনের জন্য বলাও যাবে না যে এটা খাব না ওটা খাব না। এখানে যা পাওয়া যাবে তাই খেতে হবে।
খেয়ে দেয়ে ম্যানেজারের সাথে আলাপ করল কোথা থেকে কি কিনতে হবে। ম্যানেজার বলে দিল এখান থেকে পপলার টিউব স্টেশনে গিয়ে একটা করে রিটার্ন টিকেট নিয়ে হোয়াইট চ্যাপেল চলে যাও ওখানে যেয়ে ব্রিকলেন বা হোয়াইট চ্যেপেল থেকে তোমার যা খুশি কিনে আন।

ওরা হাঁটছে আর কথা বলছে। জিজ্ঞেস করে করে পপলার টিউব স্টেশনে এসে ম্যানেজারের কথা মত তিনটা অল্ডগেট ইস্ট রিটার্ন টিকেট নিয়ে সেন্ট্রাল লাইনের ট্রেনে উঠে পরল। অল্ডগেট ইস্ট নেমে টিউব থেকে বের হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে করে ব্রিকলেনে চলে এলো। কথায় কথায় মার্কেটের নাম দেখার সুযোগ পায়নি। প্রায় সব দোকান সুন্দর ছিম ছাম সাজানো গুছানো। লন্ডন শহরের দোকান পাট! এগুলি কি আর আমাদের ঢাকা শহরের দোকানের সাথে তুলনা করা চলে? কিছু কিছু রাস্তার নাম বাংলায় লেখা, ব্রিকলেন এমনি আরও কিছু। রাস্তায়ও প্রচুর এশিয়ান এবং বাঙালি বলেই মনে হলো যদিও কারো সাথে কথা বলেনি এমনিই চেহারা দেখে যা মনে হয়েছে। দোকান পাট সব বাইরে থেকে দেখছে। বিচিত্র সব মানুষ গিজ গিজ করছে। বিভিন্ন রকমের পোশাক, বিভিন্ন চেহারা। ইংরেজ দেশ বলে যে সবাই ইংরেজ তা নয় অনেক বিদেশী দেখে একটু বিস্মিত হলো। এটা একটা আন্তর্জাতিক শহর বলে নানান জাতের নানান রঙের মানুষ থাকবেই। সবাই পায়ে হেঁটে এসেছে। মার্কেট এলাকায় কোন গাড়ি নেই, সম্ভবত গাড়ি পার্কিং এলাকায় রেখে এসেছে নয়ত টিউবে এসেছে।

নিশাতরা বাইরে থেকে কাচের দেয়াল দিয়ে দেখল একটা দোকানে কিছু ঘড়ি ক্যামেরা সাজানো রয়েছে এই দোকানে ঢুকে পরল। বিভিন্ন ডিজাইনের বিভিন্ন সাইজের সেলফে নানা রকম জিনিস সাজিয়ে রেখেছে। প্রতিটা জিনিসের সাথে কাগজের একটা কার্ডের মত আছে যাতে ওই জিনিসের বিবরণের সাথে দাম লেখা রয়েছে। যেখানে ক্যামেরা রয়েছে ওখানে গেল, ইয়াশিকা, অলিম্পাস, ক্যানন, পেনটেক্স নানা কোম্পানির তৈরি নানা মডেলের ক্যামেরা। এর মধ্যে একটা ইয়াশিকা ক্যামেরা দেখল তাতে যে দাম লেখা রয়েছে তাতে আজ সকালে স্টেনলি যে টাকা দিয়েছে তার চার ভাগের এক ভাগেই হয়ে যায়। ছোট বেলা থেকে একটা ইয়াশিকা ক্যামেরার খুব শখ। মেঝ মামাকে দেখেছে ইয়াশিকা ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে। ভাবনায় পরে গেল এতো টাকা দিয়েছে! কিনব না কি? থাক দেখি আগে জাহাজে যাই আরও কিছু দিন যাক পরে কেনার অনেক সুযোগ পাওয়া যাবে, কোথায় কত টাকা লাগে না লাগে তা না জেনে খরচ করা উচিত হবে না। হঠাৎ কোন প্রয়োজন হলে কে তাকে টাকা দিবে? এখানে তাকে কে চিনে? কার কাছেই বা হাত পাতবে নানা রকম সাত পাঁচ ভেবে কেনার ইচ্ছা বাদ দিল। দেখতে এসেছি দেখি কালই তো আর চলে যাচ্ছি না। দেখতে দেখতে এক জায়গায় দেখে নানা ধরনের অলংকার সুন্দর করে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা আঙ্গিকে নানা ধরনের। দেশে অলংকারের দোকান দেখেছে কিন্তু সে তো এর কাছে কিছুই নয়। এখানে হিরা বসানো, সাদা এবং গোলাপি মুক্তা বসানো কত রকমের ডিজাইনের। আবার একটা দেখল সাদা স্বর্ণ, এটা আবার কি? স্বর্ণ কি সাদা হয় নাকি? আগে তো কখন দেখিনি! এর দাম হলুদ স্বর্ণের চেয়ে অনেক বেশী। প্রতিটির সাথেই স্বর্ণের পরিমাণ, কি পাথর বা কত ক্যারেটের হিরা আছে দাম কত সব লেখা। নিরুর কথা মনে হলো। নিরু কি আমার হবে? আমি কি নিরুর জন্য এসব কিনতে পারব? আমার যদি এগুলি কেনার মত অত টাকা হয় তা হলে সব কিনে এক দিন নিরুকে অবাক করে দিবো, একটা একটা করে পড়িয়ে মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখব। এগুলি পড়লে ওকে কেমন দেখাবে? হঠাৎ করে এক বিদেশীর সাথে ধাক্কা লেগে নিশাতের নিরু স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল, সরি বলে সরে এলো।

কোথায় কেন যেন এসেছে, ও হ্যাঁ এই তো দোকানে। এর পরে গেল ঘড়ির কাছে। ওরে বাব্বা এতো দাম! অবাক হয়ে গেল, এই দাম দিয়ে কারা কিনে এগুলি? তার হাতে আগে কখন ঘড়ি ছিল না যে ঘড়ি রয়েছে সেটা মামা যে টাকা দিয়েছিল সে টাকা দিয়ে চিটাগাং থেকে একশ বিশ টাকায় কিনেছে। কত রঙ বেরঙ্গের ঘড়ি, কোনটা স্বর্ণের সংখ্যা, স্বর্ণের ডায়াল, স্বর্ণের চেইন স্টেনলি যা দিয়েছে তাতে কুলায় না এমন সব দাম আবার ওই টাকা দিয়ে বিশটাও কেনা যায় এমনও আছে। হবেই তো এদের পকেটে আর ব্যাঙ্কে কত টাকা। না বাবা আমার হাতে যা আছে এই যথেষ্ট শুধু সময় দেখা এই তো, আর কি হবে? আমাকে যে নিরুকে পেতেই হবে ওর জন্য আমার অনেক টাকার দরকার হবে। বাড়িতে মা বাবা, ভাই বোন এরা তো আমার পাঠান টাকার পথ চেয়ে রয়েছে। নিরুকে আনতে হলে অনেক টাকা জমাতে হবে, অনেক ত্যাগ করতে হবে, অনেক সহ্য করতে হবে। কাজেই এসব দেখে মন বিভ্রান্ত করা যাবে না। কিছু না বলে চলে যাওয়া নিরুর মুখ কিছুতেই ভুলতে পারছে না। নোমানের কথার খেই ধরে নিরু শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া একটা কথাও বলেনি। পরে এখানে আসার আগে বীণা আপার বাড়িতে শুধু অপেক্ষা করবে বলে বলেছে, কিন্তু এর মধ্যে নিশাত যাবার আগে যদি কিছু হয়ে যায়? তাহলে? অন্য কিছু মানে নিরুর বাবা যদি অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়! তাহলে কি নিরু পারবে তাকে সত্য কথাটা বলতে? না না এ হতে পারে না। নিরু ঢাকা লালমাটিয়া কলেজে যখন ভর্তি হয়েছে তাহলে আর সহসা বিয়ের পরিকল্পনা মাথায় নেই বলেই মনে হয়। তবুও মনে একটা কিন্তু জেগেই রইল। ভুল করেছে মস্ত ভুল! অন্তত বীণা আপাকে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে এলে পারত। এখানেও কিন্তু! কি ইঙ্গিত দিত? কি বলত? ওর এখন কি সঙ্গতি আছে?
চলেন এনাম ভাই, সালেক ভাই চলেন দেখার কোন শেষ নেই, এর চেয়ে বাইরে দেখি। কেনাকাটা যা করার পরে করব!
চলেন, তাই ভাল
চলেন, সিঙ্গাপুরে দেখেছি এখানের চেয়ে অনেক কম দাম
তাই নাকি?
হ্যাঁ, সিঙ্গাপুর ডিউটি ফ্রি দেশ। কেনাকাটা করলে ওখান থেকেই করবেন কিংবা দুবাই থেকেও করতে পারেন এই দুই দেশে কোন ডিউটি নেই একেবারে ট্যাক্স ফ্রি দেশ
ও আচ্ছা, বুঝেছি মানে ওখানে কোন কাস্টম ডিউটি নেই, তাই না?
হ্যাঁ, নিশাত ভাই কিছু খাবেন?
কি খাব, চলেন একটা করে কোক নেই, সবাই হাঁটছে প্রায় সবার হাতেই দেখছি কিসের ক্যান একটা। আমরা আর বাদ থাকি কেন, চলেন ওইতো ওই দোকান ওই যে সামনে বাম দিকে।
কোক কিনে সবাই হাঁটছে আর একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছে। হঠাৎ সালেক বলল
দেখছেন ওই যে সিনেমা হল!

হ্যাঁ তাই তো, হিন্দি সিনেমা চলছে মনে হয়, চলেন তো দেখি, যদি হিন্দি সিনেমা হয় তা হলে দেখবেন?
হ্যাঁ দেখব না মানে, জানেন সিঙ্গাপুরে শোর পাস পেলেই হিন্দি সিনেমা দেখতাম, চলেন।
চলেন, আমি উর্দু হিন্দি সব জানি, আমার কোন অসুবিধা নেই!
একটু এগিয়ে হলের সামনে দেখে হেমা মালিনি আর ধর্মেন্দ্রের ছবি চলছে। টিকেটের দাম খুবই কম, মাত্র এক পাউন্ড। ওরা তিন জনে তিনটা টিকেট নিয়ে দেখে আরও কিছুক্ষণ পরে শো শুরু হবে। এই ফাঁকে বাইরে বের হয়ে আর কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখল। সময় মত ফিরে এসে হলের ভিতর যেয়ে বসল। একে বারে আমাদের দেশের মত ব্যবস্থা। নিশাত কখনো ভারতের হিন্দি সিনেমা দেখেনি। করাচীতে থাকা সময়ে উর্দু সিনেমা দেখেছে। রাত নয়টায় সিনেমা শেষ হলে হল থেকে বের হয়ে আবার টিউবে করে পপলার এসে বাকি পথে হেটে হোটেলে ফিরে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরল। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা!
পরদিন আবার সারা দিন হেঁটে যত দূর যেতে পারে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে নিলো।

১০।
পরদিন সকালে সাড়ে আটটার দিকে রুম সার্ভিস ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল, হ্যাঁ গুড মর্নিং।
ওপাশ থেকে স্টেনলির কণ্ঠে গুড মর্নিং ভেসে এলো। নিশাত, কি খবর তোমাদের, কেমন আছ?
হ্যাঁ ভালো আছি সেদিন সিনেমা দেখলাম এদিক ওদিক বেড়ালাম ভালোই কাটছে।
বেশ ভালো করেছ, জায়গা চিনে নিয়েছ। আচ্ছা শোন তোমাদের জাহাজ চলে এসেছে আজ দুপুর দুইটায় তোমরা রেডি হয়ে থেক এন্ড্রু গিয়ে তোমাদের জাহাজে পৌঁছে দিয়ে আসবে, মনে থাকবে?
হ্যাঁ মনে থাকবে না কেন?
তা হলে এখন রাখি, সময় মত রেডি হয়ে থেক।
ঠিক কাটায় কাটায় দুপুর আড়াইটায় সে দিনের সেই ড্রাইভার এসে হোটেলের গেটে গাড়ি রেখে ভিতরে ওদের দেখে বলল,
ও, তোমরা রেডি হয়ে বসে আছ, বেশ! চল গাড়িতে ওঠ।
সবাই যার যার ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠার পর গাড়ি ছেড়ে দিল। টেমস নদীর পাড় ঘেঁসে যে রাস্তা গেছে ওই রাস্তায় মিনিট পাঁচেকের মধ্যে জেটির পাড়ে একটা ছোট অফিসের মত ঘরের পাশে গাড়ি রেখে ওদের সিডিসি গুলি চেয়ে নিয়ে বলল আমার সাথে মালামাল নিয়ে আস।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৬

এর পর দুপুরে দোতলা থেকে একটার মধ্যে লাঞ্চ করে উপরে রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিল রাতে লন্ডনের ফ্লাইট প্রায় আট ঘণ্টার জার্নি। শেষ বিকেলে সবাই ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে নিচে নেমে রিসিপশনের কাজ সেরে যার যার সিডিসি নিয়ে বসে রইল। ঠিক সাতটায় সেই ড্রাইভার এসে হাজির।
ও, তোমরা রেডি?
হ্যাঁ চল, আমরা রেডি হয়েই আছি।
চল।
গাড়িতে উঠে বসার পর গাড়ি ছেড়ে দিল। সে রাতের মত আজ এত স্পিডে চালাচ্ছে না তবুও কম না, ৮০ মাইলের কাছা কাছি।
দুবাই এয়ারপোর্টে নামিয়ে গালফ এয়ারের চেক ইন ডেস্কের সামনে পৌঁছে দিয়ে ড্রাইভার গুড বাই বলে চলে গেল। একটু পরে প্লেনে উঠে সিট নম্বর দেখে বসে সিট বেল্ট বেধে নিল। লন্ডনে হিথ্রো এয়ারপোর্টে নামবে লন্ডনের সময় রাত নয়টায়। ওখানে নেমে আবার কি হয় কে জানে এ পর্যন্ত ভালোই কেটেছে, হাবিব কোথায় কি ভাবে কোন জাহাজে উঠল কিছু জানতে পারলাম না, কবে জানব কে জানে। ভাবতে ভাবতে বিমান বালার কণ্ঠ শোনা গেল বাহরাইন মোহাররেক বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার বার্তা জানিয়ে দিল। একটু পরে ছোট বোইং 727 প্লেন মটরিং করে বেরিয়ে এসে রান ওয়ে দিয়ে এক দৌড়ে আকাশে উঠে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে এরাবিয়ান গালফের উপর দিয়ে বাহরাইনের পথে এগিয়ে চলল। নিচে নীল সাগরের উপর দিয়ে আরবদের প্রিয় বাজ পাখির ছবি আঁকা গালফ এয়ারের প্লেন উড়ে চলছে। একটু পরে হালকা পানীয় নিয়ে এলো। এর পরে বাহরাইন থেকে টেক অফ করার পর পরিবেশন করবে রাতের খাবার। আধা ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে বাহরাইন বিমান বন্দরে প্লেন নামার পর ওরা বের হয়ে টার্মিনাল ভবনে চলে এলো। এখানে ট্রান্সফার ডেস্কে জিজ্ঞেস করে লন্ডনের প্লেন যে গেট থেকে ফ্লাই করবে তা জেনে নিয়ে ১২ নম্বর গেটে গিয়ে দেখে লোকজন প্লেনে উঠছে। লম্বা কিউ এর পিছনে দাড়াল। এক সময় প্লেনে উঠে বসার পনের বিশ মিনিট পড়েই প্লেন টেক অফ করল। প্লেন আকাশে উঠে যবার পর হালকা পানীয় সার্ভ করল। নিশাত এর আগে কখনও এত লম্বা প্লেন জার্নি করেনি। দুবাই থেকে বাহরাইন হয়ে সরাসরি লন্ডন।

যথা সময়ে লন্ডন হিথরো এয়ারপোর্টে নেমে দেখে মহা যজ্ঞ। কোথায় থেকে কোথায় যাবে কিছুই বোঝা যেত না যদি এখানে কঠিন শৃঙ্খলা না থাকত। এরো দেয়া আছে তাই দেখে দেখে ইমিগ্রেশন ডেস্কে চলে এসেছে এখানেও সেই চিঠি দেখাল আর অমনি সিডিসিতে হিথ্রো এরাইভ্যাল সিল লাগিয়ে ফেরত দিয়ে দিল। এর পর কাস্টম হয়ে বাইরে এসে দেখে নিশাত জামান এন্ড গ্রুপ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে এক মহিলা দাঁড়ান।
ওদের এশিয়ান চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করল নিশাত?
ইয়েস
ওকে, প্লিজ ফলো মি।
বলেই তর তর করে এগিয়ে গিয়ে বাইরে রাখা বিশাল গাড়ির কাছে এসে বলল ওঠ। এয়ারপোর্টের দরজা দিয়ে বের হয়ে ঠাণ্ডার একটা তীব্র ঝাঁকুনি লাগল কিন্তু গাড়িতে উঠে বুঝল হিটার চলছে। কোন কথা বলছে না কেউ। চুপ করে বসে রইল। নিশাতের বিশ্বাস হচ্ছে না সে এখন লন্ডন শহরে গাড়িতে করে ছুটে চলছে কোন এক অচেনা হোটেলের দিকে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নিয়ে এলো পপলারের পাশে হেইচএসবিসি ব্যাঙ্কের হেড কোয়ার্টারের কাছে এক হোটেলে। লন্ডন শহরে মরিসন হোটেলে। এই হোটেল দুবাইর হোটেলের মত কোন নামী হোটেল না মনে হলো। খুবই সাধারণ একটা বাড়ির মত মনে হলো। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সামনের রিসিপশন কাউন্টারে বসে থাকা ম্যানেজারের সাথে ওই মহিলা যার বুকে নেম প্লেটে লেখা দেখেছে ক্যাথরিন যে হিথ্রো থেকে নিয়ে এসেছে, পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল এরা থাকবে। কাল এসে অফিসে নিয়ে যাব। ওদের গুড বাই বলে চলে গেল। ম্যানেজার ওদের সাথে কথা বলছিল, ওদের নিয়ে চারতলায় দুইটা রুম দেখিয়ে দিল একটাতে দুই বেড আর একটাতে এক বেড। নিশাত এক বেড যে রুমে ওই রুমে ওর ব্যাগ রেখে বের হয়ে এলো, ম্যানেজার হোটেলের নিচ তলায় খাবার ঘর দেখিয়ে সময় টময় বলে তার কাউন্টারে চলে গেল।
ওরা নিজেরা একটু গুছিয়ে নিয়ে সবাই নিশাতের ঘরে এসে বসল। কিছুক্ষণ এটা সেটা নিয়ে আলাপ করে নিশাত জানতে চাইল এখানে ওরা কেউ আগে এসেছে কি না। না আমরা আগে আসিনি।

এখানেও দুবাইর মত হোটেল তবে পার্থক্য একটাই আর তা হলো গরম আর শীত। দুবাইতে হোটেলের বাইরে দেখেছে প্রচণ্ড গরম আর এখানে শীত। রাতের খাবার প্লেন থেকেই খাইয়ে দিয়েছে বলে এখানে খাবার ঝামেলা নেই। যার যার রুমে ঢুকে শুয়ে পড়ল। সকালে উঠে দুবাইর মত সবাই নিশাতের রুমে আসল। এখান থেকে এক সাথে নাশতা খেয়ে আসল। দুবাইর মত এখানে ইন্ডিয়ান ডিশ নেই এখানে সব বিলাতি ইংলিশ নাস্তা। দুই তিন রকমের ব্রেড, বাটার, জ্যাম, ডিম, কলা এবং কফি। নাস্তা খেয়ে নিচে রিসিপসন ডেস্কের পাশে হল রুমে বসল ওরা তিনজনে। এখানে দুবাইর মত অত ভিড় নেই লোকজনও তেমন বেশি না। বসে থাকতেই ওদের ফোন এলো। কোম্পানির অফিস থেকে ফোন করেছে। রিসিপসন থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে রবার্ট বলল ‘হু ইস নিশাত’?
ইয়েস আই এম নিশাত
প্লিজ টেক ইয়োর কল
হাই নিশাত গুড মর্নিং, আমি তোমার অফিস থেকে স্টেনলি বলছি
গুড মর্নিং স্টেনলি
কেমন আছ, পথে কোন অসুবিধা হয়েছে কি?
ভালো আছি, না কোন অসুবিধা হয়নি তোমাদের লোক জনেরা বেশ ভালো ভাবেই রিসিভ করেছে, দুবাইতেও যেমন এখানেও তেমন
বেশ, তা হলে তোমরা সবাই অফিসে চলে এসো
অফিসে?
হ্যাঁ এইতো হেঁটে আসলে মিনিট পনের লাগবে
কিন্তু আমরা যে কেউ অফিস চিনি না
ওহ সরি, তোমরা তো নতুন এসেছ, আচ্ছা একটু অপেক্ষা কর আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি
আচ্ছা ঠিক আছে,
কথা শুনে বুঝতে পারলো ইংরেজ নয়। ঠিক আছে একটু পরে তো যাচ্ছি তখন দেখা যাবে কে। মেঝ মামার কথা মত সব সময় ড্রেস আপ হয়েই থাকত, তা ছাড়া এটা বিদেশ, এখানে সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ব্যাপ্টিস্টও বলে দিয়েছিল লন্ডনে যেন কখনও গরম কাপর ছাড়া কোথাও বের হবে না
নিশাত ওদেরকে বলল
চল বাইরে অপেক্ষা করি, অফিসে যেতে হবে গাড়ি পাঠাচ্ছে।
বাইরে বেশ ঠাণ্ডা
চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা নীল রঙের গাড়ি এসে হোটেলের গেটে থেমে যে ড্রাইভ করছিল সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল তুমি কি নিশাত?
হ্যাঁ
আমি অফিস থেকে তোমাদের নিতে এসেছি
ও আচ্ছা, বলে গাড়িতে উঠে পরল।

তিন চার মিনিটের মধ্যে এক বিশাল অফিস বিল্ডিঙের গেট দিয়ে ঢুকে পরল। গেটের বাইরে পুরনো একটা বিরাট নোঙ্গর দাড় করা রয়েছে, গেটের ভিতরে ঢুকে বাম পাশে একটা গার্ডেন ক্লকে সকাল সাড়ে আটটা বাজছে, আসে পাশে অনেক ছোট ছোট গাছ দেখ বুঝে নিল এগুলি ফুল গাছ শীতের জন্য ন্যাড়া হয়ে গেছে হয়ত গরম কালে ফুল ফুটবে। নানা রঙের রকমারি পাথরে সাজানো, সামনের দেয়ালে অফিসের নাম লেখা ‘গ্রে ম্যাকেঞ্জি ম্যারিন সার্ভিসেস ই সি, লন্ডন’। এতো বড় আর এত সুন্দর অফিস দেখে নিশাত অবাক হয়ে গেল, এই এত বড় কোম্পানিতে কাজ করতে এসেছি! গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার নেমে গেল। ওরাও ওর পিছনে নেমে এলো। অটোমেটিক দরজা একা একা খুলে গেল, নিশাত বিসমিল্লা বলে দরজার ভিতরে পা বাড়াল। ড্রাইভার হাতের ইশারায় বাম দিকে যেতে বলে বেরিয়ে গেল। বাম দিকে একটু এগিয়ে যেতেই একটা রুম থেকে এক ভারতীয় চেহারার অল্প বয়েসি এক লোককে বের হতে দেখল কিন্তু ওরা চিনতে পারেনি যে এই স্টেনলি। লোকটা ওদের দেখে বলল
তোমরা এসে পরেছ, বেশ, আমিই স্টেনলি। এসো আমার সাথে
বলে ওদের ক্রু সুপার রামস বটমের রুমে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল। এ আবার ইংরেজ। ওদের বসতে বলল। কেমন লাগছে, কোন অসুবিধা হয়েছে কি না, এর আগে কখনো বিদেশে এসেছে কি না সব জেনে নিলো। নিশাত জানাল
আমি এই প্রথম বিদেশে এসেছি তবে এরা দুই জন আগে জাহাজে কাজ করেছে। এবার রামস বটম ওদের সিডিসি দেখতে চাইল।
সিডিসি দেখে বলল হ্যাঁ তোমার সিডিসি দেখছি একে বারে নতুন। বেশ, আশা করি আমাদের কোম্পানিতে কাজ করতে তোমার ভালোই লাগবে, আচ্ছা স্টেনলি তুমি ওদের কিছু টাকা এডভান্স দিয়ে দাও আর ওদের জাহাজ কবে আসবে সব কিছু বুঝিয়ে দাও।
আচ্ছা,
বলে ওদের নিয়ে আসার আগে রামস বটম উঠে ওদের সাথে হ্যান্ডশেক করে আবার বলল
নতুন এসেছ, কাজেই সাবধানে থাকবে, আর কোন অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গে তোমার জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জানাবে।

ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা স্টেনলির সাথে বের হয়ে স্টেনলির রুমে বসল। স্টেনলি কিছু কাগজ পত্র রেডি করে ওদের সই নিয়ে সবার হাতে কিছু স্টার্লিং পাউন্ড দিয়ে বুঝিয়ে দিল এই এক পাউন্ড সমান এত ডলার এবং তোমাদের বাংলাদেশের টাকায় এত টাকা। নতুন বিদেশে এসেছ ইচ্ছা মত খরচ করবে না। এদেশে কিন্তু টাকা খরচ করার অনেক পথ আছে কাজেই বুঝে শুনে খরচ করবে। নেহায়েত যা একান্ত দরকার তাই কিনবে আর বাকি টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিবে। এক জন বিদেশির মুখে এ কথা শুনে নিশাত অবাক হয়ে গেল।
সত্যিই এই টাকার জন্যই দেশ, বাবা মা, ভাই বোন ছেড়ে এতো দূরে আসা। এতো ত্যাগের টাকা কি আর যেমনে সেমনে খরচ করলে চলবে? এদিকে আবার জীবনের প্রথম বেতন স্টার্লিং পাউন্ডে পেয়ে মনে একটা আনন্দও পেল। স্টেনলির প্রতি মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। রামস বটমই বা কম কি সেও বলেছে সাবধানে থাকবে, কোন অসুবিধা হলে ক্যাপ্টেনকে জানাবে। বিদেশের মানুষ এত ভালো হয়? কাজে জয়েন করার আগেই টাকা! ভাবতেও কেমন অবাক লাগছে। আমাদের দেশে পুরো মাস না গেলে টাকার চিন্তাই করা যায় না। নিশাত মনে করল একবার বাড়ির কাছাকাছি এক ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়েছিল মাস দুয়েক কিন্তু তিনমাস পর সেই টাকা দিয়েছিল। এদের কি দিয়ে বানিয়েছে নিশাতের মাথায় কিছু আসছে না। এদের সভ্যতা কেমন?

স্টেনলি আবার শুরু করল এবারে তোমাদের কাজের কথায় আসি,
তোমাদের জাহাজ এখনো আসেনি, হয়ত আরও ২/১ দিন লেগে যাবে। ওরা ডান্ডি থেকে সেইল করবে, যাই হোক যেদিন আসবে আমি তার আগে তোমাকে ফোন করে জানাব। এ কয় দিন তোমরা ঘোরা ঘুরি করতে পার তবে বেশি দূরে কোথাও যাবে না। ওরা পুরনো মানুষ ওরা জানে ওদের কি কাজ, তুমি কি জান? তুমি চিটাগাঙে যে এপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছিলে ওতে বা যে আর্টিক্যালে সই করে এসেছ তাতে দেখেছ?
হ্যাঁ দেখেছি, আর ওখানে বুড়ো ব্যাপ্টিস্ট বলে দিয়েছে।
ও কে, মাই ফ্রেন্ডস তোমরা এখন যেতে পার, বাই, এখন মনে হয় একা যেতে পারবে তাই না?
হ্যাঁ পারব। কিন্তু,
কি কিন্তু কি?
আচ্ছা আমাদের সাথে যে হাবিব এসেছে যাকে দুবাইতে জাহাজে নিয়ে গেছে ও কোন জাহাজে আছে বলতে পারবে?
হ্যাঁ বস দেখি,
কম্পিউটারে খুঁজে বলল ও আছে ফরিদা নামের জাহাজে।
ওর সাথে যোগাযোগ করার কোন ব্যবস্থা আছে?
হ্যাঁ তুমি চিঠি লিখতে পার কিংবা কখনও কাছাকাছি পোর্টে এলে তখন ভিএইচএফ দিয়ে কথা বলতে পারবে
চিঠি লিখলে খামে ভরে ঠিকানা লিখে জাহাজের মেইল ব্যাগে করে এজেন্টের কাছে দিয়ে দিবে ওরাই ডাকটিকেট লাগিয়ে পোস্ট করে দিবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, অবশ্যই
যাক নিশ্চিন্ত হলাম,
কেন ও কি হয় তোমার?
না এমনি কিছু হয় না তবে আমরা এক সাথে কলেজে পড়েছি আমার বন্ধু, আমাদের বাড়ির কাছেই ওদের বাড়ি।
গুড, তাহলে তোমাদের ভালোই হয়েছে, দুই বন্ধু কাছাকাছি থাকতে পারবে।
হ্যাঁ তাই। তাহলে আমরা উঠি এখন।
বাই বলে হ্যান্ডশেক করে বের হয়ে এলো।
রুমের বাইরে এসে আবার এদিক ওদিকে দেখল কি সুন্দর পরিষ্কার আর সাজানো অফিস, এতো মানুষ কাজ করছে অথচ নীরব, কোন সারা শব্দ নেই, কোথাও একটু খানি কাগজের টুকরো পড়ে নেই সারাটা ফ্লোর চকচক করছে।
গেট থেকে বের হয়ে গাড়ি যেদিক দিয়ে যেভাবে এসেছিল সে পথ ধরে হেঁটে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে এসে ঠিক মরিসন হোটেলে পৌঁছল। হোটেলে পৌঁছে নিজের মনে বেশ একটু আনন্দ পেল। যে পথে কোন দিন আসিনি, সব নতুন রাস্তা ঘাট, নতুন শহর নিজের দেশ থেকে অনেক দূরে ভিন্ন মহাদেশে একা একাই আসতে পারলাম। যে পথে কোন দিন এই পায়ের ছাপ পরেনি সে পথ চিনে এসেছি।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৫

৮।
বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট নির্দিষ্ট সময়ে দুবাই এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করল। নিশাত এবং সঙ্গীরা নেমে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে ইমিগ্রেশন ডেস্কে এসে নিশাত সবার সিডিসি সংগ্রহ করে সবার সামনে কিউতে দাঁড়াল। এক সময় অফিসারের
ডেস্কের উপর চারটা সিডিসি নামিয়ে দিয়ে পিছনে সবাইকে দেখিয়ে দিল। ইমিগ্রেশন অফিসার সিডিসি খুলে এক এক করে সবার চেহারা দেখে দুবাই এরাইভ্যাল সিল লাগিয়ে ওদের ফেরত দিয়ে দিল। সিডিসি নিয়ে নিশাত একটু এগিয়ে এসে এদিক ওদিক দেখল কিন্তু ফিনলে অফিসের বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের কথা মত ওদের এগিয়ে নেবার মত কাউকে দেখতে পেল না। মনে মনে ভাবছে সেই লোক আমাদের চিনবে কি ভাবে বা আমরাই বা ওকে চিনবে কি ভাবে! সবাই এসেছে নিশাতের নেতৃত্বে কাজেই ওর মাথা ব্যথা একটু বেশি। হঠাৎ করেই দেখতে পেল সামনেই কালো পোশাক পরা মোটা এক মহিলা নিশাত জামান এন্ড গ্রুপ লেখা একটা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ওদের দিকে আসছে।
নিশাত এগিয়ে গিয়ে বলল আমি নিশাত জামান আর ওই ওরা আমার সাথের।
বেশ বেশ এসো আমার সাথে।
বলে পিছনে ঘুরে দ্রুত হাটতে লাগল।

এত মোটা মানুষ এত দ্রুত হাঁটছে যে ওরা তার সাথে তাল মিলাতে হিম সিম খাচ্ছে। ৪/৫ মিনিট হেঁটে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে একটু দূরে দাঁড়ান এক লোককে ইশারায় কি যেন বলল। এবার ওদের দিকে ঘুরে বলল তোমাদের মধ্যে হাবিব কে?
এই তো এই হাবিব।
আচ্ছা ঠিক আছে তোমার জাহাজ এখানে আছে আর তোমারা যাবে লন্ডন, তবে এখন না। এখন তোমরা সবাই হোটেলে যাবে ওখান থেকে হাবিব কাল জাহাজে যাবে আর তোমাদের ফ্লাইট কাল রাতে তোমরা কেউ হোটেল থেকে বের হবে না।
মহিলা কথা বলতে বলতেই একটা কাল রঙের বুইক গাড়ি পাশে এসে দাঁড়াল।
নাও গাড়িতে ওঠ।
তুমি যাবে না?
আরে না, আমার এখনো কত কাজ, একটু পরে পাকিস্তান থেকে ফ্লাইটে লোক আসবে ওদের রিসিভ করতে হবে, এই লোক তোমাদের হোটেলে নিয়ে যাবে। গুড নাইট বলে যেমনে এসেছিল অমনিই দৌড়ের মত চলে গেল।

ওরা একে একে গাড়িতে উঠে বসল, মাল পত্র বলতে আর কি, সবার সাথে একটা করে ব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই। বিশ্বের একটা নতুন দরিদ্র দেশের কয়েক জন তরুণ এসেছে নিজেদের ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে। বিলাসিতা করার জন্য তো আর আসেনি। কিই বা থাকবে, দুই একটা সার্ট প্যান্ট, লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা এই তো আর কি। ড্রাইভার সবাইকে দেখে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। জানালার কাচ খোলা ছিল একটু পরেই ওরা দেখল জানালার কাচ একা একাই উঠে বন্ধ হচ্ছে। নিশাত ভাবল সব অটো সিস্টেম। এয়ারপোর্ট এলাকা ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় এসেই আস্তে আস্তে গাড়ীর স্পিড বাড়ছে ৫০, ৬০ থেকে একটু একটু করে ১০০ মাইল বেগে ছুটে চলেছে। নিশাত এর আগে বুইক গাড়ির নাম শুনেছে কিন্তু উঠে দেখার বা গাড়িতে চলার সুযোগ হয়নি। জীবনে এই প্রথম এত স্পিডে চলছে। ভয়ে একটু দম বন্ধ হওয়া ভাব। রাস্তার দুই পাশে সোডিয়াম বাতির আলোতে যতটুকু দেখা যাচ্ছে শুধু ধু ধু বালু আর বালুতে গজানো কিছু ছোট ছোট ঝোপ জাতিয় গাছ। যে গাছের ডাল বা পাতা ভাঙলে সাদা কস বের হয় তেমন কিছু ঝোপ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার মাঝে একটু ফাঁকে ফাঁকে একটা একটা করে লাইট পোস্ট পিছনে চলে যাচ্ছে। সামনে দূরে ডান দিকে লাইন ধরা নানা রঙের বাতির কিছু ঝিলি মিলি দেখা যাচ্ছে। মনে হয় ওটাই শহর এলাকা। গাড়ি উল্কার গতিতে ছুটছে আর ভিতরে বসা কয় জন তরুণ ভাবছে এ কোথায় এলাম, সামনে ভাগ্যে কি আছে, কি হবে, কেমন হবে এই ভাগ্য। সাহস করে কেউ কোন কথা বলছে না চুপ চাপ বসে শুধু ভাবছে। গাড়ি চালাচ্ছে এক আরবি যুবক, তার পরনে সাদা আরবি পোশাক।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর লক্ষ করল স্পিড কমিয়ে আনছে। বুঝতে পারলো হয়ত কাছে এসে পরেছি। আর একটু এগিয়ে বাম দিকে একটু ঘুরে একটা বিশাল আলো ঝলমল সুন্দর কারু কাজ করা এক বিশাল দালানের সামনে গেট দিয়ে ঢুকে দেখল বাগানে নানা দেশের পতাকা উড়ছে। নিয়ন সাইনে লেখা দালানের গায়ে নাম দেখে বুঝল এটা একটা হোটেল। হোটেলের পোর্টিকোর নিচে এসে গাড়ি থেমে গেল। ড্রাইভার ইংরেজিতে বলল তোমরা যার যার মালামাল নিয়ে আমার সাথে চল। সবাই যার যার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্বয়ংক্রিয় দরজা পার হয়ে ভিতরে পা দিতেই একটা সুন্দর নরম সুগন্ধ ওদের স্বাগত জানাল। আহ! ভিতরে কি আরাম! একে বারে ঠাণ্ডায় গা জুড়িয়ে যায় যেন, পায়ের নীচে কার্পেটে পা ফেলতেই মনে হলো পায়ে কোন জুতা নেই। আরবি ড্রাইভারের পিছে পিছে সামনের দিকে এগিয়ে রিসিপশন ডেস্কের পাশে দাঁড়াল সবাই। কাউন্টারে ৩/৪ জন লোক কি কি সব করছিল। ড্রাইভার তাদের এক জনকে ডেকে ওদের দেখিয়ে দিয়ে আরবিতে কি বলল। সুন্দর চেহারার এক লোক ওদের পাসপোর্ট চাইল আর একটা বড় ভারী মোটা খাতা এগিয়ে দিয়ে যার যার নাম পাসপোর্ট নম্বর লিখতে বলল। সবার লেখা হলে নিশাত খাতাটা টেনে নিয়ে নিজের নাম ধাম সব লিখে আবার খাতাটা ওই লোকের দিকে ফিরিয়ে দিল। ড্রাইভার এবার ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গুড নাইট জানিয়ে চলে গেল। কাউন্টারের লোকটা ওদের হাতে একটা একটা করে চাবি ধরিয়ে দিয়ে পাশের লিফট দেখিয়ে সাত তলায় উঠে যেতে বলে দিল। সবাই এক সাথে লিফটে উঠে সাত তলার বোতামে চাপ দিয়ে উপরে উঠে এসে চাবিতে লেখা নম্বর মিলিয়ে যার যার রুম খুঁজে নিলো। সব গুলিই প্রায় পাশা পাশি। যার যার রুমে ঢুকে পরল। নিশাত রুমে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে রুমের চারি পাশে ঘুরে ঘুরে দেখে অবাক হলো। এমন সুন্দর রুমে কি থেকেছে কোন দিন? দেখা শেষ হলে কাপড় বদলে বাথ রুমের কাজ সেরে এসে একে একে সবার রুমে গিয়ে সবাই ঠিক ঠাক মত আছে কিনা দেখে আগামী কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে ওর রুমে আসতে বলে এলো।

হাবিব জিজ্ঞেস করল আমার কি হবে কিছু বুঝেছিস?
কেন ওই মুটকি বলল না কাল সকালে জানাবে, এখন ঘুমিয়ে পর কাল দেখব কি করে। আমি যাই ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
এয়ারকন্ডিশন রুমে ফিরে এসে নরম ধব ধবে বিছানায় শুয়ে কম্বলটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পরল।
প্রায় সবারই সকাল হলো নয়টার দিকে। নিশাত কাল হোটেলের রিসিপশন থেকে দেখে হাতের ঘড়ি মিলিয়ে নিয়েছিল। একে একে সবাই এলো। নিজেরা একটু আলাপ করে নিচে নেমে গেল। নাশতা খাবার কি ব্যবস্থা দেখতে হবে আর কোন ম্যাসেজ আছে কি না তাও জানতে হবে। লিফট বেয়ে নিচে নেমে দেখে, রিসিপশনে কাল যারা ছিল এখন তারা নেই, যারা আছে তাদের এক জনকে জিজ্ঞেস করল
নাশতার কি ব্যবস্থা?
এখনো নাশতা করনি?
না আমরা কাল লেট নাইটে এসেছি এই মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম আর তা ছাড়া ব্রেকফাস্ট কোথায় তাও জানি না।
ও আচ্ছা, ওই দিকে দেখ ডাইনিং রুম আছে ওখানে গিয়ে খেয়ে আস।
আচ্ছা আমাদের কোন ম্যাসেজ আছে?
রুম নম্বর প্লিজ
রুম নম্বর বলল
হ্যাঁ তোমাদের হাবিব কে?
এই যে এই হাবিব।
তোমাকে নেয়ার জন্য গাড়ি আসবে সকাল এগার টায় আর তোমাদের বাকি তিন জনের জন্য গাড়ি আসবে সন্ধ্যা সাতটায়। যাও ব্রেকফাস্ট করে এখানে এসো কথা আছে।
নাশতা সেরে ঘণ্টা খানিকের মধ্যে আবার কাউন্টারে এসে দাঁড়াল,
কি বলবে বলেছিলে
ও হ্যাঁ, তোমরা কিন্তু বাইরে যেয়ো না, এখানে লাউঞ্জে বসে টিভি দেখতে পার বা ও পাশে সর্বক্ষণ সিনেমা চলে তাও দেখতে পার কিন্তু বাইরে যাবে না বাইরে গিয়ে হারিয়ে গেলে তোমাদেরও বিপদ আমাদেরও বিপদ।
না না আমরা কেউ বাইরে যাব না, আমরা নতুন এসেছি কিছু চিনি না কোথায় যাব, কাজেই তোমাদের সে ভয় পেতে হবে না।

যা হাবিব তোর ব্যাগ নিয়ে আয় আমরা এখানেই বসি।
ঘড়িতে দেখে সাড়ে দশটা বেজে গেছে, হ্যাঁ আমি আসছি বলে হাবিব উপরে চলে গেল। ওরা নিচেই সুবিধা মত এক জায়গায় বসে পরল। সামনে টিভি চলছে আরবি চ্যানেল, কিচ্ছু বুঝে না। একটু পরেই হাবিব নেমে এলো।
নিশাত আমার ভয় করছে
আরে ধুর! কিসের ভয়? যেখানে যাচ্ছিস ওখানে নিশ্চয় দুই এক জন বাঙ্গালি পাবি, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই যে এখন চলে যাচ্ছিস তোর সিডিসি নিবি না?
আরে হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই গেছিলাম, চল
রিসিপশনে যেয়ে হাবিব রুমের চাবিটা দিয়ে বলল আমি এখন চলে যাব, কি করতে হবে?
হ্যাঁ দাড়াও, সেই সুন্দর বাধান বড় খাতাটা বের করে ওর সই নিয়ে একটা ভাউচারের মত কাগজ বের করে দিল সই করার জন্য, কোম্পানির কাছে বিল পাঠাবে বলে এটা রাখা হলো। ওগুলি রেখে সিডিসি ফেরত দিয়ে দিল।
দেখবি এটা সাবধানে রাখবি কিন্তু
হ্যাঁ মনে থাকবে।
কবিতাকে একটা চিঠি লিখে পাঠাবি
যাঃ কি যে বলিস
আরও কিছু টুকরা আলাপ হলো, একটু পরেই দেখে গেট দিয়ে সেই কালকের ড্রাইভার আসছে।
ওই যে হাবিব তোর সমন এসে গেছে
হাবিব ঘুরে দেখে উঠে দাঁড়াল। ড্রাইভার সাথে যাবার ইশারা করে বেরিয়ে গেল। হাবিবের সাথে সবাই বের হয়ে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। গাড়ি ছেড়ে যাবার আগে জানালায় মুখ রেখে নিশাত আবার বলে দিল ভয় বা চিন্তা কিছু করবি না। দেখলি তো কি ভাবে সব হচ্ছে।
হাবিবকে নিয়ে গাড়ি হোটেলের সীমানা থেকে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওরা গেটে পোর্টিকোর নিচে রইল। মেইন গেট থেকে বের হয়ে গেলে আবার এসে যেখানে বসে ছিল সেখানে বসে টিভি দেখছে। বিরক্তিকর চ্যানেল। ভালো লাগছে না,
চলেন ভাই একটু হাটা হাটি করি আর নয়ত দেখি ওখানে কি সিনেমা চলছে।
চলেন।

কিছু করার নেই। কোন কাজ নেই। নিশাত ও পাশে সিনেমার সামনে বসে ভাবছে আর চারিদিকে দেখছে। এই যে এত বড় ফাইভ স্টার হোটেলে কি আর নিজের টাকায় থাকতে পারতাম কোন দিন? কত রকমের মানুষ আসছে যাচ্ছে। কেউ সুদৃশ্য বিশাল লাউঞ্জে বসে টিভি দেখছে নয়তো বই পড়ছে, কেউ রিসিপশনের কাউন্টারে হেলান দিয়ে সঙ্গীর সাথে কথা বলছে। তার পরেও সবার মধ্যে একটা চাপা ব্যস্ততা। বিভিন্ন ভাষায় কথা বলছে, বিভিন্ন জাতীর লোক জন। বিচিত্র গুঞ্জন তার মধ্যে আবার অদৃশ্য স্পীকারে মৃদু স্বরে মিউজিক বাজছে যেন একটা ভিন্ন জগতে এসে পরেছে। তার চির চেনা জগত এটা নয়। রাতারাতি এক ভিন্ন গ্রহে চলে এসেছে। মানিয়ে নিতে হবে এই পরিবেশ। নিজের পয়সায় এই হোটেলের গেটের ভিতরেই ঢুকতে পারত না। সে সাধারণ একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান বাবা সাধারণ এক জন সরকারী কর্মচারী। কোম্পানির জোড়ে আজ এই ভিন্ন গ্রহে বসে ভাবতে পারছে। একটু আগে যে নাশতা করে এসেছে তা কি কখনো খেয়েছে? দেশে ঢাকায় এমন সোনার গাও হোটেল, ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল রাস্তা দিয়ে যেতে আসতেই শুধু দেখেছে, কখনো ভিতরে ঢুকতে পারেনি। তবুও মনে হচ্ছে দেশের ওই সব হোটেল এর কাছে কিছুই নয়। ওর চেয়ে এর সৌন্দর্য অনেক বেশি। নিশ্চয়ই এই দুবাইতে এমন আরও অনেক হোটেল আছে হয়ত এর চেয়েও দামী। কোম্পানি কি আর তাদের অত বেশি দামী হোটেলে রাখছে? নিশ্চয় এর চেয়ে অনেক দামী হোটেল আছে। সেখানে কারা থাকে, কত টাকা থাকলে অমন হোটেলে থাকা যায়? নিশ্চয় আর যারা আছে তাদের সবাই ওর মত কোম্পানির টাকায় থাকছে না। হঠাৎ করেই নিশাতের মনে এক প্রশ্ন এলো, আচ্ছা যদি কোম্পানি বলে এই হোটেলে থাকার খরচ তার বেতন থেকে কেটে রাখবে, তা হলে কি উপায় হবে? ওকে বিক্রি করলেও তো এই ভাড়া দেয়া সম্ভব না। তা হলে কি হবে? কত কি সাত পাঁচ ভাবছে মাথা মুণ্ডু কিছু ঠিক নেই। অজানা অচেনা একেকটা নিত্য নতুন ভাবনা মনে আসছে যাচ্ছে। এমন সময় ওদের সাথে যে কুক সে এসে বলল
ভাই এখানে একা একা কি করছেন চলেন ওখানে ভালো একটা হিন্দি সিনেমা হচ্ছে দেখি
চলেন দেখা যায়, এ ছাড়া আর কিই বা করবো।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৪

নিশাত ভিতর বাড়ি গিয়ে দাদিকে সামনে পেয়ে বলল দাদু আমরা কাল চলে যাচ্ছি।
আবার কবে আসবে?
জানি না, আব্বার ছুটি না হলে আসা হবে না,

আচ্ছা ঠিক আছে ভালো ভাবে থাকবে, মন দিয়ে পড়া শুনা করবে।
চাচীরা কোথায়?
দেখ তো রান্না ঘরে না কি?
নিশাত এগিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় নিরু ওর ঘরে থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে যাচ্ছিল। নিশাত ডাকল
নিরু চাচীরা কোথায়?
সবাই রান্না ঘরে। আপনারা তাহলে কালই যাবেন?
হ্যাঁ নিরু, কালই যাচ্ছি, চল চাচীদের একটু বলে যাই।
আসেন। মা, নিশাত ভাই এসেছে তোমাদের সাথে দেখা করতে, উনারা কাল চলে যাবে।
নিরুর চাচী রান্না ঘর থেকে উকি দিয়ে নিশাতকে ডাকল,
এই যে বাবা আমরা এখানে।
চাচী আমরা কাল যাচ্ছি।
আচ্ছা বাবা ভালো ভাবে থাকবে মন দিয়ে পড়া শুনা করবে।
ওখান থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে নিরু জিজ্ঞেস করল
সত্যিই আপনারা কাল যাবেন?
হ্যাঁ নিরু, আমি যেগুলি দেখিয়ে গেলাম সেগুলি মন দিয়ে পড়বে, না বুঝলে যুঁইকে জিজ্ঞেস করবে। আচ্ছা যুঁই কোথায় ওকে দেখছি না।
আপা পুকুরে।
পুকুরে কি করে একটু ডাকবে ?আমি ওকে তোমার পড়া দেখার জন্য বলে যাব।
আপনি যান মেঝ ভাইয়ের কাছে বসুন আমি ডেকে আনছি।
একটু পরেই যুঁই এসে বলল কি রে নিশাত তোরা তা হলে কাল যাচ্ছিস?
হ্যাঁ তাই বলতে এলাম। শোন তুই কিন্তু নিরুর পড়াটা একটু দেখবি, ও তো ভাল ছাত্রী মনে হলো, তা তুই একটু দেখলেই ওর অনেক সাহায্য হবে। দেখবি।
হ্যাঁ তোর বৌকে তো দেখে রাখতেই হবে, আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না। এই নিরু এখন থেকে আমার কাছে নিয়ম করে বসবি। একা পড়বি না, আমার সাথে বসবি। মনে থাকে যেন।
নিশাতের দিকে তাকিয়ে, দেখলি তোর সামনেই কেমন অর্ডার দিয়ে দিলাম?
৭।
এর পরের দিন নিশাতরা ওই অত টুক নিরুর মনে গভীর একটা দাগ দিয়ে চলে গেল। নিরুর মনে যে দাগ কেটে গেল, নিরুর মনের যে জানালা খুলে দিয়ে গেল সে আর কিছুতে বন্ধ হবার নয়। সে তো ভিন্ন জগতের অনুভূতি, ভিন্ন সে ধ্যান, ভিন্ন জ্যোতি, ভিন্ন আকুতি। এত দিন যা ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। এ যে কি এমন এক ব্যথা, এমন এক যাতনা যা কাউকে বলা যায় না, কাউকে দেখান যায় না। নিজের বুকের ভিতর তুষের আগুনের মত জ্বলতেই থাকে। নিতান্ত চেপে রাখা ছাড়া আর কোন পথ নেই। শুধু চোখের জলেই যার সমাধান। আশা পথ চেয়ে দিন যায়, রাত আসে। এক দিন ফিরে আসবে সে আজ হোক বা কাল। ফিরে যে তাকে আসতেই হবে, এই এক সান্ত্বনা বুকের গভীরে পুষে রেখে নিরু নিজেকে নিশাতের জন্য প্রস্তুত করছে।
দিন যায়, মাস যায়, বছরও চলে যায়। নিরুর কাছে মনে হয় যেন একটা যুগ যাচ্ছে। ক্লাসে নিয়মিত হাজিরা, যুঁইয়ের কাছে পড়া, সংসারের কিছু তদারকি এতেই দিন চলে যায়। ভাবে এমন হয় কেন, ও আমার কে? ওর জন্য এমন লাগে কেন? এক জন পুরুষ মানুষের প্রতি এমন টান কেন হয় কিছুতেই এর কোন জবাব খুঁজে পায় না। এই টান কোথা থেকে আসে, এই কি নিয়ম, যদি তাই হয় তা হলে ও কিছু বলে গেল না কেন? আবার ভাবে সেদিন তো বলেছেই “আমি থাকলে তোমার ভালো লাগবে?”এর চেয়ে কি আরও একটু খুলে বলতে পারত না? না, আমিই তো ওকে নিয়ে গেলাম না ও তো পুকুর পাড়ে যেতে চেয়েছিল। ওখানে গেলে কি বলত? না কি আমি যা ভাবছি ও তেমন করে ভাবছে না। তাই বা কি করে হয়, যুঁই আপা যখন অমন করে বলত তখন এত লজ্জা কি জন্! এই নানা ধরনের বিচিত্র প্রশ্ন তার মাথায় ঘুর ঘুর করে কোন ফাঁকে যেন চোখ দুইটা বন্ধ করে দেয়।

দেখতে দেখতে প্রায় দুই বৎসর চলে গেল নিশাতদের আসার কোন নাম গন্ধ নেই। নিরুর মনে যখন নানা ধরনের চিন্তা ভাবনা শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে তার ছোট্ট হৃদয়ের মাঝে নিশাতের জন্য একটা গভীর সাগর বানিয়ে ফেলেছে তখন দেশে শুরু হলো স্বাধীনতার আন্দোলন। তারপর মুক্তি যুদ্ধ। যুদ্ধ চলা কালীন এক দিন সত্যিই নিশাতরা কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশে এসে হাজির।

এক দিন সকালে নিরু বাড়ির দক্ষিণ পাশে কুয়া থেকে পানি তোলার জন্য কুয়ায় মাত্র বালতি ফেলেছে এমন সময় সামনে তাকাতেই দূরে নিশাতদের বাড়ির ওদিক থেকে দুই পাশে ধান ক্ষেতের মাঝে বাধানো উঁচু রাস্তা দিয়ে শার্ট প্যান্ট পরা কে এক জনকে আসতে দেখে একটু থেমে গেল। চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু! হ্যাঁ তাই তো, বুকটা কেপে উঠল। হ্যাঁ সেই, যার জন্য এতো দিন অপেক্ষা, যার জন্য পথ চেয়ে কল্পনার জাল বুনে, দিন রাত যন্ত্রণা সয়ে এক উত্তাল সাগরের উন্মত্ত ঢেউ বুকে নিয়ে এতো গুলো দিন কেটেছে এ সেই। মানুষটা কেমন! একটা খবরও কি দিতে নেই? এমন কেন? আনমনা হয়ে কত কি এলো মেলো ভাবনা এসে জড়িয়ে গেল। হাত পা সব যেন কেমন আড়ষ্ট হয়ে এলো। বালতির রশি হাতেই ধরা রইল।
কি নিরু, কেমন আছ?
কণ্ঠ শুনে নিরুর ভাবনা থেমে গেল। বুকে এক অজানা কাঁপন অনুভব করল, গলা জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

কি নিরু কথা বলছ না কেন?
কোন রকম একটু ঢোক গিলে বলল
কবে এলেন?
কই আমি যে বললাম, কেমন আছ তার কিছু বললে না?
হ্যাঁ ভালোই আছি, আপনি?
হ্যাঁ আমিও ভালো আছি, তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ, প্রায় চেনাই যায় না।
নিরু এতো দিন যার পথ চেয়ে দিন রাত একটা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছে, নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু যার জন্য তৈরি করেছে আজ এই তাকে এমন হঠাৎ দেখে হত বিহ্বল হয়ে গেছে। মনে মনে বলল আমি কেমন আছি সে তুমি বুঝ না? তোমার পথ চেয়ে আমার দিন গুলি কি ভাবে গেছে সে বোঝার শক্তি তোমার কবে হবে, না কি কোন দিন হবে না? একটু স্থির হয়ে বলল
যান, ওই যে বাড়ির পিছনে মেঝ ভাই বাঁশ কাটছে ওখানে যান।
আমি এসেই তোমাকে দেখতে পাব ভাবতেই পারিনি। তোমাদের কি সৌভাগ্য কি সুন্দর পরিবেশে তোমরা থাক। তোমাদের এই কুয়ার পাড়টা কি সুন্দর, ও পাশে পুকুর পাড়ে ঝোপে পাখি ডাকছে, সামনে ধান ক্ষেতের বিশাল সবুজ প্রান্তরে বাতাসে ঢেউ তুলছে। আচ্ছা ওই যে ওটা কি পাখি?
নিরু নিশাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে পাশে তাকিয়ে বলল ওটা মাছ রাঙ্গা।

কি চমৎকার পরিবেশে থাক তোমরা, চারি দিকে উঁচু নিচু ঝোপ ঝাঁর, তাতে নানা রঙের পাতা ফুল কত সুন্দর এ দেশ আর আমরা যেখানে থাকি শহরে সেখানে শুধু ইট লোহা কাঠ পাথরের দালান কোঠা আর তার সাথে মানুষের মনও তেমন হয়ে যায়!
এখানে আসার সময় তাই দেখলাম রাস্তার পাশে কি সুন্দর পানিতে ধানের ক্ষেত গুলি মনে হচ্ছে যেন ভাসছে। এই সবুজের মধ্যে থেকে থেকে তোমার মন কত সরল।
আমার সাথে কখনো ভালো করে কথাই বলেননি কি করে জানলেন আমার মন সরল, এ সব আপনার বানানো কথা।
না নিরু, আমি বানিয়ে কথা বলতে পারি না, যা সত্যি মনে হয় তাই বলি, বানানো কথা আমি কখনো ভাবতে পারি না। এই যদি এখন বলি এ বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগে তোমাকে, এটাও সত্যি এবং মোটেই বানানো নয়। তোমার দুরন্তপনা, তোমার চঞ্চলতা আর তোমার এই হাসি ভরা মুখটা আমি এক দিনের জন্যেও ভুলতে পারিনি, তা কি তুমি জান?
তাই যদি হবে তবে এতদিন পরে আসলেন কেন নাকি যুদ্ধ শুরু না হলে আর আসতেন না?
কি যে বল তুমি!
নিরুর চোখ কুয়োর নিচে একেবারে গহীনে পানির উপরে স্থির হয়ে আছে। ও পাশে রাখালরা আসা যাওয়া করছে এদের মধ্যে যারা নিশাতকে চিনে তারা এসে একটু জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, কবে এসেছে। ফাঁকে ফাঁকে ওদের কথার জবাব দিচ্ছে। নিরুর কানে কে যেন মধু ঢেলে দিচ্ছে, এই টুকু শোনার জন্যই এতো দিন অপেক্ষায় ছিলাম। আজ আমার সাধনা যেন পূর্ণ হতে চলেছে, আমার মনের কথা শুনতে পেয়েছে। নিরু ভিন্ন এক জগতে হারিয়ে গেছে, তন্ময় হয়ে শুধু শুনে যাচ্ছে। হঠাৎ নিশাতের মনে হলো নিরু ওর কথা শুনছে না কি! কি হলো তুমি আমার কথা শুনছ না?
লজ্জায় নিরুর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল। কোন রকম পিছনে ফিরে
ওই যে মা ডাকছে আমি যাই।
বলেই কুয়োয় বালতির রশি ছেড়ে এক দৌড়ে ভিতর বাড়ি। নিরুর যাবার পর নিশাতের মনে হলো তাইতো এটা গ্রাম, এভাবে একটা ছেলে একটা মেয়র সাথে খোলা কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা কারো নজরে এলে ফলাফল নিশ্চয় খুব একটা সুখের হবে না। নেহায়েত তারা গ্রামে থাকে না বলে হয়তো আপাত কেউ কিছু বলবে না তবে এর আগের বারে নিরুর মুখেই এই কথা সে শুনে মনে রেখেছে। কিন্তু নিরু? মুনি ঋষিরাই যেখানে ব্যর্থ সেখানে নিশাত আর কি! নারী হৃদয় বোঝার ক্ষমতা তার নেই। তবুও নিশাত হতভম্বের মত কিছুক্ষণ সেখানে দাড়িয়েই রইল। নিরুর এই হঠাৎ চলে যাওয়া কি শুধুই লোক লজ্জা না কি ভিন্ন কিছু? এমন করে কিছু না বলেই চলে যাবে? কিছুটা বোকার মতই দাঁড়িয়ে রইল। এ কথা কাউকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। কেন, সরাসরি কিছু বলে গেলে কি হতো? কেন এমন হয়? লজ্জা, নাকি অন্য কিছু? তা হলে সে অন্য কিছু কি? আর কি হতে পারে? কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে আস্তে আস্তে নিরুর দেখানো বাড়ির পিছন দিকে যেখান থেকে বাঁশ কাটার শব্দ আসছে সে দিকে চলে গেল।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৩

নিরু তাড়াতাড়ি হাতের জগ গ্লাস টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে পায়রার মত এক পলকের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিশাতও ভাবল হ্যাঁ তাহলে এই সেই যাকে আমি ভাবছি, যাকে আমি খুঁজছি। আমার মনের গোপন ভল্টে যার নাম লিখা আছে। যাকে সেই অনেক দিন আগে দেখেছিলাম বকুল ফুলের মালা গাঁথতে। তাহলে এইই সেই।
এর পর নিশাতরা যত দিন দেশে ছিল দুই এক দিন পরে পরেই ওদের বাড়িতে আসলে প্রায়ই সামনে পরত। দুই চার দিন ওকে দেখেই নিরু মিথ্যে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করত। এভাবে কি আর পালিয়ে থাকা যায়? কতক্ষণ পালিয়ে থাকা সম্ভব? এ তো সৃষ্টির বিধান। কোন আকাশ কুসুম ব্যাপার নয়। মানব জনমের প্রথম সত্য। এক দিন রাতে নিশাত শিহাবের সাথে ওদের বাড়ি এসে দেখে নিরু শিহাবের ঘরে বসে পড়ছে। হারিকেনের আলোতে নিরুর মুখের দিকে চেয়ে দেখল আজ যেন ওকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে।
কি পড়ছ দেখি, ও ভূগোল! বুঝতে পার?
একটু চুপ থেকে বলল, না খুব কঠিন
কি বল! এ তো খুব সহজ বিষয়, দাও আমাকে দাও। এটা আমার খুব প্রিয় বিষয়।
বলেই দেরী না করে সামনে থেকে বইটা হাতে নিয়ে বুঝিয়ে দিল। ভূগোল বোঝার অজুহাতে আজ নিরু অতি কাছে থেকে নিশাতকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেল। বিশ্বচরাচরে যত ঘটনা নিত্য ঘটে থাকে তার মধ্যে যা নিয়তির নির্দিষ্ট বিধান তা খণ্ডাবার কোন উপায় নেই। আজ নিশাতকে নিরুর কাছে আরও বেশি সুপুরুষ বলে মনে হলো। বোঝানো, কথা বলার ভঙ্গী, সবই যেন ভিন্ন। যা বলে তাই একে বারে অন্তরে গেঁথে যায়। আজকের মত ভূগোল শেষ করে নিশাত জিজ্ঞেস করল আর কোনটা?
জ্যামিতি।
দাও দেখি!
নিরু ঘর থেকে বের হয়ে ওর নিজের ঘর থেকে জ্যামিতি বই নিয়ে এলো। নিশাত ওটা নিয়ে যখন আলাপ করছে এমন সময় যুঁই এসে হাজির
কি রে তোর বৌ নাকি, এতো মনোযোগ দিয়ে পড়াচ্ছিস যে?
যুঁইয়ের মুখে কিছুই আটকায় না, ছোট বোন সম্পর্কে যে এই মন্তব্য করতে পারে তাকে আর কি বলবে! নিশাত মনে মনে খুশী হলেও মুখে একটু অবাক হবার ভাণ করে কৃত্রিম একটা বকুনি দিল যুঁইকে।
তুই যে কি, ছোট বোনকে নিয়ে কেউ এমন কথা বলে?

ওদের বন্ধু বান্ধবীর এই কথার ফাঁকে লজ্জায় রাঙ্গা নিরু উঠে বের হয়ে গেল। তাই দেখে নিশাত আবার বলল
দেখলি, ওর পড়াটা দিলিতো মাটি করে। নিজে কখনো একটু বসবি না আমি একটু দেখিয়ে দিচ্ছিলাম তাও দিলি শেষ করে। এর পরে কি ও আর আমার কাছে বসবে ভেবেছিস?
না বসলে না বসবে তাতে তোর কি? একটু ভেবে বলল, আচ্ছা দাড়া আমি ঠিক করে দিচ্ছি।
বলে ঘর থেকে বের হয়ে নিরুকে ধরে নিয়ে এসে যেখানে বসে ছিল ওখানে আবার বসিয়ে একটা মিষ্টি বকুনি দিয়ে নাক টেনে বলল এত লজ্জা কিসের? বসে কি পড়ছিলি পড়।
নিশাতকে বলল নে তোর ছাত্রীকে এনে দিলাম, কি পড়াচ্ছিলি পড়া।
কানে কানে বলল, দেখবি আবার আর কিছু পড়াতে যাবি না কিন্তু।
একটু থামবি নাকি আরও কিছু মুরুব্বি গিরি ফলাবি?
বলেই নিশাত নিরুর জ্যামিতি বই আর একটা খাতা নিয়ে যা পড়াচ্ছিল সেখানে থেকে আবার শুরু করল। কিছু ছবি এঁকে একের পর এক দেখিয়ে গেল, কি ভাবে কি লিখতে হয় মোটামুটি এক দিনে যতটা সম্ভব দেখিয়ে দিয়ে বলল
নাও এবার তুমি দেখ।
যুঁই, আমি আসি তাহলে, শিহাব তো এখন এলো না।
কাল আসবি?
শুনেই নিশাত সামনে বসা নিরুর দিকে তাকাল আর নিরুও নিশাতের দিকে। দুয়ে দুয়ে চার চোখের মিলন হলো। এক মুহূর্ত থেমে নিশাত যুঁইয়ের কথার প্রেক্ষিতে নিরুকে জিজ্ঞেস করল কি, কাল আসতে হবে? বলেই কোন জবাবের অপেক্ষা না করে বলল
হ্যাঁ আসতে পারি, আজ যা দেখিয়ে দিলাম এগুলি তুমি ঠিক করে রেখ কাল আমি এর পরের গুলো দেখিয়ে দিবো।

এই ভাবে বেশ কয়েক দিন গেল। এর মধ্যেই নিশাত আর নিরুর মধ্যে বেশ সুন্দর একটা ভাব জমে উঠেছে। এখন দুই জনেই দুই জনের চোখের ভাষা বুঝতে শিখেছে, মান অভিমান করতে শিখেছে। এক দিন না এলে কৈফিয়ত চাইতে এবং দিতে শিখেছে। দুয়ে দুয়ে চার হয় জ্যামিতির ছলে তাও শিখতে শুরু করেছে। নিশাত অনেক কিছু বলতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। যখনই বলবে ভেবেছে তখনই যেন মনে হতো কোথা থেকে একটা পাহাড় এসে ওর সামনে দাঁড়িয়েছে, এই পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ওর কথা কি নিরুর কানে পৌঁছাবে কোনদিন? কণ্ঠ থেমে যেত গলা দিয়ে স্বর বের হতো না।
কাল কেন এলেন না, আমি আজ পড়ব না।
না পড়লে লোকে তোমাকে মূর্খ বলবে আমার কি হবে?
বলুক মূর্খ তাতে আমার কিছু হবে না।
থাক হয়েছে আর পাকামি করতে হবে না এসো, এখন থেকে যে কয় দিন আছি আর এমন হবে না।

ওদিকে যুঁইয়ের অত্যাচার দিনে দিনে বেরেই চলেছে। নিশাতকে দেখলেই নিরুকে ডেকে বলে এই নিরু ওই দেখ কে এসেছে, যা বরণ করে নিয়ে আয়। আবার নিশাতকেও একই ভাবে বলছে আমি কি জানি তোর বৌকে জিজ্ঞেস কর কিংবা নে এটা খেয়ে দেখ তোর বৌ বানিয়েছে। এদিকে নিশাতদের যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে। নিশাতের বাবার ছুটি প্রায় শেষ। সামনে আর মাত্র পাঁচ ছয় দিন বাকী। তার পরেই আবার চলে যাবে নিশাতের বাবার কর্ম স্থল করাচী শহরে।

নিরু কিছু বলতে চেয়েছিল কি না তা নিশাত কোন দিন বুঝতে পারেনি। তবে নিরুর মনে নিশাত বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে এটা নিশাত বুঝতে পারে কিন্তু কত টুক তা বোঝার মত ক্ষমতা নিশাতের নেই। সে কথা বোঝার মত কোন গুরুর সন্ধান এখনো নিশাত পায়নি। নিরুও বুঝতে পারে নিশাত তার টানেই এ বাড়িতে আসে। কেউ কারো কাছে প্রকাশ হতে পারে না। নারীর লজ্জা ভূষণে পরিবেষ্টিত হয়ে নিরু কোন দিন কিছু বলতে পারে না। শুধু মনে মনে নিশাতকে দোষারোপ করে। এই তো আর কয়েক দিন পরেই চলে যাবে। আগের সেই চঞ্চলতা এখন নিরুর মধ্যে নেই, অনেক কমে গেছে। বাড়ির সব চেয়ে দুরন্ত মেয়ে এই নিরু হঠাৎ করে রাতারাতি নীরব নিস্তব্ধ যেন রাশভারী কোন মহিলা হয়ে গেছে। আগের সে হৈ চৈ নেই, দৌড়া দৌড়ী নেই, আগের সাথীদের এখন নিতান্ত ছেলে মানুষ বলে মনে হয়। আগের চেয়ে অনেক ধীর শান্ত হয়ে গেছে। তবুও হঠাৎ করেই সঙ্গীদের ছেড়ে আসতে পারে না। যারা কোন বিচার সালিশ নিয়ে আসে তাদের বিকেলের কোন সময় দিয়ে দেয়। সময় মত বিচার করে দিয়েই রান্না ঘরে মা চাচীর পাশে বসে থাকে, রান্নার যোগার এগিয়ে দেয়। বারেকের মাকে দিয়ে বাড়ির রাখাল সর্দার জয়নুলকে ডেকে এনে বাড়ির আশে পাশে সবজী লাগাবার নির্দেশ দেয়। বাবার মত কোন জমিতে কিসের চাষ করেছে তার খবর নেয়, কোন জমির নিড়ানি হচ্ছে, আজ কোন রাখাল কোথায় কি কাজ করছে সে খবর রাখে। জয়নুল মিয়া সিরাজ ভাইর এই মেঝ মেয়ের কাছে হিসেব দিতে পছন্দ করে। সিরাজ ভাই কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে দেয় মেঝ মাকে বলে এসেছি, ও জানে। সিরাজ মাতব্বর অবাক হয় নিরু আবার এসব কবে থেকে শুরু করল। মনে মনে তার মায়ের কথা মনে করে স্বস্তি পায়, যাক মেয়েটা তা হলে দাদির মত হবে।

এক দিন নিশাত এসে দেখে যুঁই বা শিহাব ওরা কেউ নেই। শিহাবের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় নিরু সামনে এসেই নিশাতকে দেখে থমকে গেল।
নিশাত অনেক সাহস করে বলে ফেলল তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
কি কথা?
চল ঐ পুকুর পাড়ে যাই।
না এখানেই বলেন।
কেন, চল না ওখানে।
আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
কেন মাথা খারাপের কি হলো?
ওখানে কেউ দেখে ফেললে কি হবে জানেন?
কি হবে?
আপনি কি ছোট মানুষ কিছু বুঝেন না? এটা আপনাদের শহর না, এটা গ্রাম। এখানে সবাই সব কিছু মেনে নিতে পারে না।
ও, হ্যাঁ তা হতে পারে, কিন্তু এ যে কিছু একান্ত কথা যা এখানে বলা যায় না!
তা হলে চলেন ভিতরে চলেন।
হ্যাঁ তাই ভালো।
আগে নিরু শিহাবের ঘরের ভিতরে গেল, পিছনে নিশাত। নিশাত একটা চেয়ার টেনে বসল নিরু একটা খুটিতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইল।
এবার বলেন কি বলবেন।
আচ্ছা নিরু, তোমার মনে আছে, ওই যে তুমি বকুল ফুলের মালা গাঁথছিল আর আমি তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।
কবে?
সে অনেক দিন আগে, ওই তোমাদের ঈদগাহের বকুলতলায়।
না, আমার কিছু মনে পরছে না। দাদু, যুঁই আপা, বড় আপা, মা এরা সবাই বলেছে আমি নাকি আপনাকে ছোট বেলায় দেখেছি কিন্তু ছোট বেলায় আপনাকে কোন দিন দেখেছি বলে আমার কিছুই মনে পরছে না। অনেক চেষ্টা করেছি খুঁজে পাইনি। হঠাৎ আজ এ কথা কেন?
না হঠাৎ না, সেদিন যখন তোমাকে দেখলাম তখন আমার মন বলছিল আমি যেন তোমাকে চিনি, আমার অনেক চেনা তুমি। কিন্তু কোথায় দেখেছিলাম তা কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। বেশ কয়েক দিন ভাবার পর হঠাৎ করেই মনে এলো তোমাদের বাড়ির পিছন দিয়ে যাবার পথে বকুল ফুলের গন্ধ পেয়ে কেন যেন একটু এগিয়ে গেলাম আর ওখানে তোমাকে দেখলাম তুমি কুড়ানো ফুলের মালা গাঁথছ। আমার মনে হয় তুমিই সেই, সময়ের হিসেব করে মিলিয়ে দেখি তুমি ছাড়া আর কেউ নয়।
কি যে বলেন, কত জনে অমন মালা গাথে। আর কিছু দিন থাকলে দেখে যেতে পারতেন। যখন ফুল ফোটে কত জন এসে কুড়িয়ে নিয়ে যায়।

না নিরু, কত জন আর আমার মনে আঁকা ছবির মধ্যে অনেক ব্যবধান সে তোমাকে আমি কেমন করে বোঝাব বল?
এ কথা শুনে নিরু এই বয়সেই যেন সেই সুদূরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কিসের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর সামনে দিয়ে ভবিষ্যৎ হেঁটে যাচ্ছে আর নিরু তাকিয়ে তাই দেখছে। নিশাতকে কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। অবাক হয়ে নিশাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটা কি বলতে চায় কিছু বুঝতে পারে না।
আপনারা কবে যাবেন?
সামনের মঙ্গল বারে।
আবার কবে আসবেন?
কি জানি, আব্বা কবে ছুটি পায়।
আপনি কি এখানে থেকে পড়তে পারেন না? আপনার দাদি আছে তার কাছে থাকবেন।
আমি থাকলে কি তোমার ভালো লাগবে?
এবার আর নিরু জবাব দিতে পারলো না, লজ্জা এসে ঘিরে ধরল। মাথা নিচু হয়ে গেল, হাত দিয়ে অযথাই ওড়নার আঁচল আঙ্গুলে জড়াচ্ছে। নিরু যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছে। মনে মনে ভাবছে সে কি তোমাকে বলে দিতে হবে?
দেখি আব্বা আম্মাকে বলে দেখি যদি উনারা রাজি হয়।
এমন সময় শিহাব এসে পড়ায় ওদের কথা ওখানেই থেমে গেল। ওই দিন বাড়িতে ফিরে রাতে খাবার পর নিশাত বাবাকে তার এখানে থেকে যাবার কথা বলতেই তা সাথে সাথে নাকচ হয়ে গেল। যাবার আগের দিন নিরুর সাথে দেখা করতে এলো। প্রথমে শিহাবের সাথে দেখা হলো। শিহাবের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বলল
চল দাদি আর চাচীদের সাথে একটু দেখা করে যাই।
যা তুই যা আমি আসছি।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১২

প্রায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ঢাকা ডমিস্টিক টার্মিনালে নেমে ভিতর দিয়ে ওরা আন্তর্জাতিক লাউঞ্জে এসে পৌঁছেই দেখে নিশাতের দাদি, মা বাবা সহ সব ভাই বোন এসেছে। নিশাত আরও যেন কাকে খুঁজছিল। এদিক ওদিক তাকাল কিন্তু
না কেউ কোথাও নেই। হাবিবের মা বাবা ভাই বোনদের দেখল। এগিয়ে এসেই দাদিকে সালাম করে নিলো। দাদি মাথায় হাত দিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। এই বয়সে তোকে একা একা বিদেশ যেতে হচ্ছে। দাদির কথা জড়িয়ে জড়িয়ে আসছিল। নিশাত দাদিকে বুকে জড়িয়ে শিশুর মত বোঝাল। যাবার সময় কেঁদে মন দুর্বল করে দিবেন না, মন ভালো আছে তাই থাকুক। শুধু শুধু তাকে কেন দুর্বল করছেন? এমন না যে, না গেলে চলবে, যেতে যখন হবেই তা হলে আর কান্না কাটি করে কি হবে? একে একে মা বাবা সবাইকে সালাম করে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে একটু আদর নিয়ে ছোট ভাই বোন দের বুকে নিয়ে আদর করে এদিক ওদিক কাকে যেন খুঁজে কাওকে না পেয়ে হাবিবকে নিয়ে এগিয়ে গেল চেক ইন কাউন্টারের দিকে। সাথের এনাম আর সালেক একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ওরা সহ চেক ইন কাউন্টারে এসে টিকেট, সিডিসি দেখিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিলো। সাথে মালপত্র কিছু নেই শুধু সবার সাথে একটা করে হাত ব্যাগ। এর আবার কি ওজন হবে তাই মালামাল ওজনের ঝামেলা নেই। শুধু একটা ট্যাগ লাগানো। বোর্ডিং কার্ড নিয়ে আবার ফিরে এলো মা বাবার কাছে। আবার এক দফা সবাই মিলে বিচ্ছেদের গান গেয়ে মাইকে দুবাই যাত্রীদের প্লেনে আরোহণ করার ঘোষণা শুনে এগিয়ে গেল ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। ওখানে জেমস ফিনলে অফিসের ক্রু ডিপার্টমেন্টের বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের দেয়া খাম আর সিডিসি দেখাল। ইমিগ্রেশন অফিসার খাম খুলে চিঠি দেখে সবার সিডিসিতে ঢাকা ডিপার্চার সিল দিয়ে ফেরত দিয়ে দিল। ওরা এগিয়ে বোর্ডিং লাউঞ্জে গেল। একটু পরে প্লেনে উঠে সীট নম্বর দেখে খুঁজে যার যার সীটে বসে পরল। সব যাত্রী ওঠা হলে যাত্রীদের সীট বেল্ট বাধার ঘোষণা। নিশাত এর আগে বাবা মায়ের সাথে অনেক বার ঢাকা করাচী বা করাচী ঢাকা বিমানে ভ্রমণ করেছে কিন্তু হাবিবের এই প্রথম, কাজেই হাবিব নিশাতের কাছে কাছে থাকছে।

একটু পরেই প্লেন ট্যাক্সিং করে রাতের ঝল মল ঢাকা শহরের বাতি গুলি নিচে রেখে নিজের ডানা মেলে পাখির মত আকাশে উড়ে গেল। নানা ভাবনার পর আবার সেই নিরু। প্লেন তো বীণা আপার বাড়ির উপর দিয়েই যাচ্ছে। ওখানে নিরু কি করছে এখন, ঘুমিয়ে পরেছে? হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভাবল এখন কি ও রাত জেগে গল্পের বই পড়ছে নাকি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে? নিরু কি জানে এই প্লেনে কে যাচ্ছে?

৬।
সিরাজ চৌধুরী এক জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। আশে পাশে দশ গ্রামে তার প্রতাপ। বিভিন্ন শালিস দরবার, আচার অনুষ্ঠানে সিরাজ চৌধুরী উপস্থিত না হলে সে অনুষ্ঠানের মান হানী হয়। গ্রামে যথেষ্ট জমি জমা, পাশের বাজারে বিশাল ব্যবসা। দেশ বিভাগের আলামত পেয়ে আগেই কোলকাতায় কাপড়ের যে ব্যবসা ছিল তা গুটিয়ে ভাইকে নিয়ে চলে এসেছিল। চল হাশেম এখন আর আমাদের এখানে থাকা ঠিক হবে না। গ্রামে ফিরে কোলকাতার ব্যবসার টাকা দিয়ে ঢাকায় কিছু জলা ভূমি কিনে রেখেছিল আজ যার দাম কোটি টাকার উপরে। বাকি টাকা দিয়ে স্থানীয় বাজারে একটা দোকান করেছে সেটা ছোট ভাই হাশেম দেখা শুনা করে। পৈতৃক জমিগুলি আগের মতই রাখাল চাকরেরা দেখে। দুই ভাই মিলে একান্নবর্তী সংসার। রাখাল চাকর, দোকানের কর্মচারী মিলে বাড়িটা একটা হাটের মত। বাড়িতে দৈনিক প্রায় এক মন চাউল না হলে চলে না। মাঝে মাঝে বাজারে ছোট ভাইকে সাহায্য করে। আশে পাশের যত দরবার শালিস করা আর বর্ষা এলেই লোহা কাঠের তৈরি জেলেদের মত এক মস্ত মাছ ধরার নৌকায় চেপে পদ্মার ইলিশ পাঙ্গাশ ধরার নেশা। এই নিয়েই তার দিন বেশ সুখে কেটে যায়। মাছ ধরার এমন কোন সামগ্রী নেই যা তার সংগ্রহে নেই। ও পাড়ার সুবল তার মাছ ধরার সঙ্গী বা সহকারীও বলা যায়। নৌকার যত্ন নেয়া, যন্ত্রপাতির যত্ন নেয়া গুছিয়ে রাখা এ গুলি সেই করে। কোথাও যাওয়া আসার পথে এক নজরে জমি জমা যা নজরে আসে তাই যথেষ্ট, বাড়িতে ফিরে বা ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে প্রধান রাখাল জয়নুলকে বলে দেয় কি ব্যাপার জয়নুল মিয়া এই জমিতে কি আগাছার চাষ করেছ না কি বুনেছ কিছু বুঝতে পারছি না, পাশের জমিটা একটু দেখ ওর পিয়াজ গুলি কেমন সুন্দর হয়েছে আর তোমার এ অবস্থা হলে সংসার কোথায় যাবে? তাড়াতাড়ি নিড়ানি দেবার ব্যবস্থা কর।

বড় মেয়ে বীণার বিয়ে দিয়েছে ভাগ্নে কবিরের কাছে, ঢাকায় তার বাড়ি আছে, ভালো চাকরী করে বেশ সুখেই আছে। মেঝ মেয়ে নিরু গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে যায় আসে। পড়াশুনার চেয়ে বাবার মত মাতব্বরি করাতেই তার বেশি আগ্রহ। গ্রামের আর সব সম বয়সীদের নিয়ে তার সমাজ। তাদের মধ্যে বিচার সালিশ করা, ঝগড়া ঝাটির নিষ্পত্তি করা, গাছের মাথায় শালিকের বাসা থেকে বাচ্চা তুলে এনে পেলে পুলে বড় করা, সারা দিন এ গাছের ও গাছের ফল মুল পেড়ে বিলানো তার প্রধান কাজ। ওদের বাড়িটাও বেশ বড়, গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাড়ি বলা যায়। বাড়ির সামনে পিছনে দুই দিকেই রাস্তা। সামনের রাস্তা দিয়ে উঠে ডান পাশে সাবেক আমলের পরিষ্কার টলটলে জলের বিশাল এক ইঁদারা, তার একটু দুরেই পুরনো এক জাম গাছ, বাম দিকে একটু ভিতরে একটা কত বেল গাছ। চারি দিকে ঘিরে নারকেল, খেজুর, সুপারি এবং নানা জাতের ফলমূলের গাছ পালায় ঘেরা বাড়ি। পশ্চিমে চাচাত ভাইয়ের বাড়ি। পূর্ব দিকে পুকুরের পাড়ে ঈদগাহ, তাদেরই পূর্বপুরুষদের ওয়াকফ করে দেয়া। নিরুর গণ্ডি অবশ্য এর মধ্যেই সীমিত। পুকুরে ডুবানো নৌকা তুলে মাছ ধরাও তার বাবার মত এক নেশা।

বাবা পদ্মা থেকে মাছ ধরে ফিরে এসে বাড়ির ঘাটে পৌছার আগেই ডাক ছাড়ে কই রে মা নিরু আয় দেখ কি এনেছি। নিরু এসে দেখে নৌকা তখনো ঘাটে ভিড়েনি। তাতে কি, এক লাফ দিয়ে পানিতে নেমে সাতরে নৌকার কাছে যেয়ে হাত বাড়িয়ে বাবার হাত ধরে নৌকায় উঠে পাটাতন খুলে মাছ দেখে চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে ডেকে অস্থির। ততক্ষণে সুবল ঘাটে ভিড়ে লগির সাথে নৌকা বেধে ফেলেছে। নিরুর চিৎকারে মা চাচী ভাই বোনেরা এসে ধরা ধরি করে মাছ গুলি ভিতরে নিয়ে গেল। এবার ভিতর বাড়ির পালা। নিরুর মা হাঁক ছাড়ল বারেকের মা তাড়াতাড়ি মশলা বাট।
এই নিরু এখন একটু বড় হয়েছে। গ্রামের পাঠশালা ছেড়ে ঝিটকা হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এক দিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে অচেনা এক ছেলে চাচাত ভাই শিহাব আর বোন যুঁই এর সাথে শিহাবের ঘরে বসে সিনেমার নায়কদের মত সুন্দর ভাষায় কথা বলছে। কোঁকড়ানো চুল, সুন্দর চেহারা, পরিপাটি করে শার্ট প্যান্ট পরা। এই চেহারা তো আগে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। মনে একটু বিস্ময় নিয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাড়ির ভিতরে এসে বই খাতা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে দাদির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল
ওই যে ওই ঘরে মেঝ ভাই আর যুঁই আপার সাথে কথা বলছে ও কে?
কেন, তোর পছন্দ হয়েছে, ঘটক পাঠাবো?
তখনো সে এই ইঙ্গিতের পছন্দের মানে বোঝে না, ঘটক কে জানে না। তবে ওর মনে হলো ও যেমন সুন্দর খুঁজছে, যেমন সুন্দরের ছবি ওর মনে আঁকা আছে এ যেন সেই। আজ সেই ছবি যেন নিজের ঘরে খুঁজে পেয়েছে।

এ যে প্রকৃতির নিয়ম, যা একান্তই স্বাভাবিক। যে ভাবে এতো দিন ধরে এই পৃথিবীতে চলে এসেছে। অদৃশ্য ভালবাসা আর প্রেমের বন্ধন। যা কখনো কাউকে জানিয়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে আসে না। একান্ত নীরবে এসে ধরা দেয়। যা এখনো জীব জগতে সকল প্রাণীকে বিহ্বল করে রেখেছে। অদৃশ্য এক সুতার টান। নিরুও তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। নিরুর মাঝে কেমন যেন একটা পরিবর্তন এলো, মনটা কেমন যেন নাড়া দিয়ে উঠল।
আহা দাদু বল না ও কে? আগে তো ওকে কখনো দেখিনি।
দেখেছিস তোর মনে নেই, ওরা গ্রামে থাকে না। ওই পুরনো বাড়ির ফরিদের বড় ছেলে, ওর নাম নিশাত। তুই যখন খুব ছোট তখন দেখেছিস তোর মনে নেই।
ও আচ্ছা।
দাদিকে এ কথা বলে চলে এলো কিন্তু ওর মনে কেমন যেন একটা তৃষ্ণার্ত ভাবের উদয় হলো যা আগে কখনো হয়নি। কেন যেন আবার দেখতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু অবুঝ হলেও নারী মন তাই কোথা থেকে এক পাহাড় লজ্জা নেমে এসে সে ইচ্ছা থামিয়ে দিল। নিরু এই লজ্জার পাহাড় অতিক্রম করবে কি করে? একান্ন বর্তি সংসারে বড় হচ্ছে, বড় বোনদের দেখে আসছে তাদের কাছে এমন কিছু দেখেনি। যদিও এ বাড়ির আর সব মেয়েদের থেকে নিরু একটু ভিন্ন। তারা প্রায় সবাই ভীরু, নরম মেজাজের যেন মোমের পুতুল কিন্তু, নিরু তা নয়। সে তো অস্থির, দুরন্ত, চঞ্চল, দৌড়া দৌড়ী, লাফ ঝাপ হৈ চৈ যার স্বভাব। যেন চৈত্রের তপ্ত সূর্যের প্রখর তাপ। কিন্তু নিমেষের মধ্যেই নিরুর এ কি পরিবর্তন! নিরু দাড়িয়েই আছে। নিশাতের সাথে কথা বলার ফাঁকে যুঁই বেরিয়ে এলো ওর জন্য নারকেলের লাড়ু আর মুড়ি নিতে। বেরিয়ে দেখে দাদির পাশে নিরু দাঁড়িয়ে আছে।
নিরু, এক জগ পানি আর গ্লাস নিয়ে ও ঘরে রেখে আয়, আমি নাড়ু মুড়ি নিয়ে আসছি।

নিরু এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। কোন ভাবে পা টেনে রান্না ঘরে ঢুকে কলস থেকে এক জগ পানি ভরে ভালো করে একটা কাচের গ্লাস ধুয়ে এ ঘরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইল। যুঁই এসে ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
কি রে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন, আয় ভিতরে আয়।
সামনে যুঁই আর তার পিছনে নিরু ঘরে ঢুকতেই নিশাতের চোখে পড়ল। ফর্সা এক কিশোরী হালকা আকাশী নীলের উপর কাল ছাপার ফ্রক পরনে, মাথায় দুই বেণী, তাতে ফুল করে ফিতে বাধা, চুল গুলি কিছুটা কুঞ্চিত মনে হলো। মানুষ এমন সুন্দর হতে পারে? আমি কি এই ছবি আঁকতে চাইছিলাম? এই কি সেই যে ছবি আমি এতো দিন ধরে কোথায় দেখেছি কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে? চোখের দিকে তাকিয়েই নিশাত বুঝতে পারলো এ মেয়ে দুরন্ত। সাধারণ নয়, অসাধারণ কিংবা আরও কিছু। শিহাবের সাথে কথা বলছিল হঠাৎ কথা থেমে গেল। এক পলকে ওর দিকে চেয়ে রইল। কে? ওদের বাড়ির কেউ নিশ্চয়, কিন্তু কে? ওদিকে এক হাতে পানির জগ আর এক হাতে গ্লাস নিয়ে নিরু ঘরে ঢুকে এক নজর নিশাতের দিকে তাকিয়েই নিরুপায় দুটো চোখ মাটিতে নামিয়ে এক ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। অদৃশ্য নিয়তির লীলা ভূমিতে এর মধ্যেই একান্ত নীরবে রোপিত হলো দুটি মনের প্রথম প্রেমের একটা নতুন অংকুর যা ওরা কেউ বুঝতে পারলো না। নিশাতের মনে হলো বিধাতা কি একে আমার জন্য পাঠিয়েছেন? হ্যাঁ, এ তো আমার। ওদের এ ভাবে দেখে যুঁই বলল
কি রে নিশাত কি হলো?
নিশাতের কানে সে কথা গেল না। যে ভাবে কিশোরীকে দেখছিল তেমনিই তাকিয়ে রইল। সে কোন এক অচেনা দূর দেশে চলে গেছে যেখানে প্রবল এক চৌম্বক শক্তি ওর চোখ দুটিকে আটকে রেখেছে। নিশাতের অন্তরাত্মা চিরাচরিত এক সুরের মূর্ছনায় সম্মোহিত হয়ে গেল। নিরুও ঠিক তেমনই একই সুতার এ প্রান্ত আর ও প্রান্ত যেমন তেমনি বিমোহিত হয়ে দাড়িয়েই রইল। পানির জগ গ্লাসের কথা ভুলে গেল। এতো দিন কোথায় ছিল? শিহাব একটু ধাক্কা দিয়ে বলল
কি রে নিশাত কি হলো?
তখন নিশাত সম্বিত পেয়ে জিজ্ঞেস করল কি বললি, এ কে?
জুই বলল আমার চাচাত বোন, বীণা আপার কথা মনে আছে?
কোন বীণা আপা, ওই যে ঢাকায় থাকে? বীণা আপা!
হ্যাঁ।
তার ছোট বোন নিরু, আগে দেখেছিস এখন বড় হয়েছে তাই চিনতে পারছিস না।
ও আচ্ছা।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১১

নিশাত মনে মনে ভাবল আমরা দুই জনে আমাদের ডার্লিং এর সাথে দেখা করেই এসেছি।
ওরা বুড়োকে গুড নাইট জানিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলো। বুড়োর কাছে আসা যাওয়া করে এর মধ্যেই কিছু
ইংরেজি ভাব কায়দা শিখে নিয়েছে।
হাবিব বলল তাহলে আমরা এক জাহাজে থাকছি না?
তাইতো শুনলি।
আমি ভেবেছিলাম এক সাথে থাকব।
আমিও তো তাই ভাবছিলাম, ওই যে ওই লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল তখন আমার সন্দেহ হলো তা হলে কি আমরাও দুই জায়গায় যাচ্ছি, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
চল এখন আর কোথাও যাব না বাসায় যাই।
হ্যাঁ তাই চল, রাত জাগার জন্য কেমন যেন ভালো লাগছে না, ওহ! দর্জির দোকানে যাবি না?
ও, হ্যাঁ তাইতো আমি ভুলেই গেছিলাম। চল, আরে ওইতো সামনেই, দেখেছিস?
আরে হ্যাঁ ওইতো! দেখেছি!
দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে সেদিনের মত সোজা হাবিবের খালার বাড়ি এসে খালার কাছে সারা দিনের বিবরণ দিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে খেয়ে দেয়ে বিছানায়। সকালে উঠে হাবিব নিশাতকে নিয়ে কাছা কাছি যে সব আত্মীয় আছে তাদের সাথে দেখা করতে গেল। ওখান থেকে বিকেল চারটার আগেই এসে বুড়োর কাছে।
ও, তোমরা এসেছ বলেই হাতের ঘড়ির দিকে দেখেই বলল ভেরি গুড একে বারে জাস্ট টাইম। গুড! ভেরি গুড! তোমরা আগামী রবিবার বিকেলে ফ্লাই করছ। এখান থেকে ঢাকা তারপর দুবাই আর তুমি দুবাই থেকে লন্ডন। দুবাইতে হাবিব থেকে যাবে এজেন্ট নিয়ে তাকে জাহাজে পৌঁছে দিবে আর তুমি এবং তোমার সাথে আরও যে দুই জন আছে ওরা সহ গালফ এয়ারে লন্ডন। ওখানে গিয়ে ২/৩ দিন থাকবে পরে জাহাজ এলে তখন জাহাজে যাবে।
কোন দুই জন?
বস, ওরা একটু পরে আসবে। ওহ, তোমাদের ড্রেস কবে দিবে, কাল না পরশু?
কাল দিবে বলেছে।
গুড, তা হলে কাল ড্রেস নিয়ে নিও। এখন ওই জেমস রয়ের কাছে যাও ওখানে আর্টিক্যালে সই করে আবার এখানে এসো।
এই জেমস, শুনছ?
কোণায় বসা হালকা পাতলা খাট মত এক জন বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল
বলেন স্যার শুনছি।
এই যে এই দুই জ্যান্টল ম্যানের আর্টিক্যাল রেডি করেছ?
হ্যাঁ রেডি, আসেন ভাই আপনারা এদিকে আসেন
যাও ওনার কাছে।

জেমস রয়ের সামনে এসে বসল।
আপনাদের বাড়িতে কি মানি অর্ডার পাঠাতে হবে?
মানে কি, আমরা তো নতুন কিছু জানি না, একটু খুলে বলেন প্লিজ।
অফিসে এসে যেখানে যা কথা বলা দরকার হচ্ছে হাবিব নিশাতকে ঠেলে দিচ্ছে, তুই বল। সবার সাথেই নিশাত কথা বলছে, হাবিব শুধু ওর সাথে রয়েছে। এর মধ্যেই নিশাত বুঝে ফেলেছে এখানে সব বিদেশি কাজকর্ম, বিদেশি স্টাইল। সবাই কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ, সরি, প্লিজ এই সব বলছে।
আপনারা যখন জাহাজে থাকবেন তখন আপনাদের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে আমরা সেটা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিবো। ও ভালো কথা, আপনারা কি জানেন, আপনাদের পুরো বেতন কিন্তু জাহাজে পরিশোধ করবে না।
তা হলে?
ওখানে মুল বেতনের ৬০% দিবে আর বাকি ৪০% টাকা এখানে শিপিং অফিসে জমা হবে। আপনারা যখন সাইন অফ করে এখানে আসবেন তখন আমরা সে টাকা শিপিং অফিস থেকে এনে আপনাদের দিবো। এটাই নিয়ম। ওখানে যা পাবেন তা দিয়ে নিজের যা লাগে তা কেনা কাটা করতে পারবেন দরকার হলে ব্যাংক থেকে বাড়িতেও পাঠাতে পারবেন। আর এমনি যদি এখানে কিছু টকা লাগে মনে করেন তা হলে কার নামে কোন ঠিকানায় পাঠাতে হবে তা এই যে এই খাতায় লিখে দিন।
বলে একটা বড় হিসাবের খাতার মত একটা খাতা ওদের দিকে ঠেলে দিল। নিশাত হাবিবের সাথে আলাপ করে নিলো।
তুই কি করবি, তোর কি বাড়িতে টাকা লাগবে?
লাগবে না, তবুও কিছু দিয়ে যাই।
কত দিবি?
কি জানি কত পর্যন্ত দেয়া যায় জিজ্ঞেস কর দেখি কি বলে।
আচ্ছা জেমস সাহেব, কত টাকা পর্যন্ত দেয়া যায়?
৫০০ টাকার বেশি না।
তা হলে আমার দুইশ হলেই হবে।
আমার একটু বেশি দরকার, আমি তিনশ দেই।
ওরা ওই খাতার ছক অনুযায়ী সব পূরণ করে দিল।
এটা হয়ে গেলে জেমস রয় দুই জনের নামে দুইটা ভিন্ন বইয়ের মত বের করে দেখিয়ে দিল এখানে এখানে সই করেন।
নিশাত হাতে নিয়ে দেখল, ওই বইতে ওদের নাম ঠিকানা, আইডি নম্বর, পদ, বেতন, জাহাজের নাম, জাহাজ কোন বন্দরে রেজিস্ট্রি হয়েছে এমন নানা ধরনের তথ্য লেখা। সই স্বাক্ষর হয়ে গেলে জেমস বলল যান এবার ওখানে যান। এবার বুড়োর টেবিলে এসে দেখে অচেনা দুই জন বুড়ো ব্যাপটিস্টের সাথে কথা বলছে। ওরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনেই নিশাত বুঝল এরা ওদের মত নতুন নয়। ব্যাপ্টিস্ট এবার নিশাতকে বলল এই যে এই দুই জন তোমার সাথে যাবে। এ হচ্ছে এনামুল হক, তোমাদের কুক আর এ সালেক মিয়া, টোপাস মানে তোমাদের ক্লিনার। এদের দায়িত্ব কিন্তু তোমার।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন তোমাদের আর কোন কাজ নেই তোমরা পরশু সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে। এখন তাহলে গুড নাইট।
এমন সময় দরজার দিকে দেখে শিকদার সাহেব আসছে।
দাঁড়াও যেয়ো না দেখি শিকদার কোন খবর পেয়েছে কি না জেনে যাও।

শিকদার, এদের কনফার্মেশন পেয়েছ? শিকদার এদিকে এগিয়ে এসে বুড়োর হাতে কয়েকটা কাগজ দিল। বুড়ো সেগুলি দেখে বলল নাও তোমাদের ফ্লাইটের ডিটেইলস নিয়ে যাও। সবার হাতে যার যার একটা ফ্লাইট সিডিউল দিয়ে দিল। নিশাত দেখে আগামী রবিবার বিকেল ৫টায় চিটাগাং থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে রাত ৯টায় দুবাই, দুবাই থেকে পরদিন রাত ৯টায় গালফ এয়ারে বাহরাইন হয়ে লন্ডন।
তা হলে আমরা কি এখন যেতে পারি?
ওকে মাই ডিয়ার, শনিবারে সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে আর ফ্লাইটের দিন দুপুর দুইটার মধ্যে এসে এখানে রিপোর্ট করবে, গুড নাইট।
গুড নাইট।
অফিস থেকে বের হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
নিশাত বলল, হাবিব আজ হলো মাত্র বুধবার তাহলে বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম করে দেই, অন্তত ঢাকা এয়ারপোর্টে ওরা আসলে দেখা হবে।
হ্যাঁ চল টেলিগ্রাম অফিসে, দেখি খোলা আছে কিনা।
একটা রিকশা নিয়ে কাছের আগ্রাবাদ টেলিগ্রাম অফিসে গিয়ে হাবিব এবং নিশাত দুই জনেই নিজ নিজ বাড়িতে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিল, চিটাগাং থেকে আমাদের ফ্লাইট আগামী রবিবার বিকেলে, ঢাকা থেকে টার্মিনাল চেঞ্জ করার সময় কিছুক্ষণের জন্য দেখা হতে পারে, আপনারা সবাই ঢাকা এয়ারপোর্টে আসবেন। টেলিগ্রাম করে আবার আর একটা রিকশা নিয়ে মাদার বাড়ি খালার বাসায় ফেরার পথে বারেক বিল্ডিঙের কাছে এসে হাবিব নিশাতকে জিজ্ঞেস করল
কি রে নিশাত তোর কি হয়েছে আমাকে বলবি না?
নিশাতের কোন সারা নেই।
হাবিব আবার জিজ্ঞেস করল।
এবারেও নিশাত নিরুত্তর দেখে হাবিব নিশাতের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই নিশাত চমকে উঠে বলল
কি হয়েছে?
তুই কি এখনই লন্ডন চলে গেলি?
না।
তাহলে সেদিন থেকেই দেখছি তোর কোন কথা নেই এখনও দুই বার ডাকলাম কোন সারা নেই, কি ব্যাপার কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।

নিশাত মনে মনে বলল না রে হাবিব আমি লন্ডন যাইনি। আমি যেখানে গিয়েছিলাম সে তোকে এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। যেখানে নিরু নামের এক চঞ্চলা দুরন্ত হরিণীর মত এক মেয়ে আছে, সারা দিন ছুটে বেড়ায়, গুন গুন করে গান গায় যার মনের কোন এক গহীনে আমার জন্য একটু খানি জায়গা আছে এবং আমি সে কথা বুঝতে পারি। সেদিন সে আমাকে বলেছে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।
হাবিব আবার তারা দিল, কি রে বলবি না?
না হাবিব কিছু হয়নি এমনিই ভাবছি কোথায় যাচ্ছি, কেমন হবে কি হবে এই সব।
তুই কি ভয় পাচ্ছিস?
আরে না, ভয়ের কি আছে, শুনলি না বুড়ো কি বলল, ওখানে এজেন্ট আছে না?
তাই বলে এমন মন খারাপ করে থাকবি না কি?
না মন খারাপ করলাম কোথায়?
এই যে কোন কথা বলছিস না, ডাকলে তার কোন জবাব দিস না। চল কাল তো কোন কাজ নেই, আলমাস হলে একটা সিনেমা দেখে যাই।
কাল?
হ্যাঁ, কাল দুপুরে বা সন্ধ্যার শো।
চল, দেখা যায়।
কথা বলতে বলতে খালার বাসা এসে গেল। বাসায় ঢুকে গত রাতের মত খালা খালুর সাথে আজ সারা দিনের ফিরিস্তি জানাল। ফ্লাইটের খবর শুনে হাবিবের খালাত ভাই বোনেরা সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। পর দিন সকালে নাশতা খেয়ে আশে পাশে একটু ঘোরাঘুরি করা বাসায় ফিরে এসে দুপুরে খেয়ে আবার বের হলো আলমাস হলের দিকে। সিনেমা দেখে সন্ধ্যায় ফিরে এলো। যাবার আগে এক দিন পতেঙ্গা, ফয়েজ লেক আরও কোথায় কোথায় বেড়াল।

শনি বার সকালে এসে জেমস ফিনলের অফিসে বুড়োর সাথে দেখা করল। ওরা সবাই এসেছে। বুড়ো চা খাচ্ছে। নিশাতকে দেখে হ্যাল্লো ইয়াং ম্যান গুড মর্নিং!
গুড মর্নিং।
বুড়ো টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা একটা করে বড় খাম বের করে তার ভিতরে থাকা ওদের টিকেট, ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসারকে লেখা চিঠি এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র বুঝিয়ে দিয়ে বলল এগুলি সব সাবধানে রাখবে। তোমরা এই প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছ সাবধানে থাকবে, ওয়েল ড্রেসে থাকবে। আর শোন মেয়েদের দিকে কিন্তু ভুলেও তাকাবে না বলে একটু হেসে দিল। কি, বুঝেছ?, অল ক্লিয়ার?
ইয়েস অল ক্লিয়ার।
ও কে, তাহলে কমপ্লিটলি রেডি হয়ে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ নিয়ে কাল ঠিক দুপুর দুইটায় এখানে এসে ওই শিকদার সাহেবের সাথে দেখা করবে। উনি তোমাদেরকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।
হুট করেই শনিবার ফুরিয়ে গেল। রাতে নিশাতের চোখে ঘুম নেই। সারা রাত নিরু তার চোখের পাতা দিয়ে ধীর পায়ে কেমন একটা উদাস ছন্দে হেঁটে বেড়াল। গানের সুরে সুরে যেন কি কি বলেছে কিন্তু নিশাত তার কিছুই বুঝতে পারেনি শুধু কান পেতে দূর পাহাড়ের ঝর্ণাধারার তানের মত একটা সুর ওর কানে বেজেছে। মনে হচ্ছিল তুমি আমার তুমি আমার। চোখে ঘুমের কোন চিহ্ন নেই। সকালে হাবিব ডাকল
নিশাত উঠবি?
আমিতো উঠেই আছি।
উঠ, নাশতা করে সব গুছিয়ে নিই।

নিশাত উঠে হাত মুখ ধুয়ে খালার সাথে নাশতা খেয়ে হাবিবের সাথে এসে ব্যাগ থেকে সব কিছু বের করে আবার ভাজ করে কাপড় চোপর টুকি টাকি এটা সেটা সব গুছিয়ে সবার শেষে ক্রু ডিপার্টমেন্টের বুড়োর দেয়া প্যাকেট বের করে সিডিসি, আইডি কার্ড, টিকেট, চিঠি সব কিছু বুড়ো যে ভাবে বলে দিয়েছে সে ভাবে ভরে ব্যাগের পকেটে রেখে রেডি হয়েই বসে রইল। খালা আজ একটু তাড়াতাড়ি রান্না করে ওদের খাইয়ে দিলেন। বাসা থেকে একটায় বের হয়ে সময় মত অফিসে এসে পৌঁছে দেখে এনামুল আর সালেক মিয়া এখনো আসেনি। একটু অপেক্ষা করার পর ওরা এলো।
দুপুর তিনটা। সবাইকে নিয়ে অফিসের একটা বড় গাড়িতে শিকদার সাহেব চিটাগাং এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালেন। এখানে ডমিস্টিক এয়ারপোর্ট তেমন কিছু দেখল না। শুধু টিকেট দেখে মালামাল চেক করে বোর্ডিং কার্ড দিয়ে দিল। শিকদার সাহেব সবার সাথে হ্যান্ড সেক করে বুড়োর মত মাগনা কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল আর ওরা প্লেনে উঠে বসল। একটু পরেই বিমান বালার ঘোষণা শুনে বুঝল প্লেন টেক অফ করতে যাচ্ছে। ঘোষণা শেষ হবার সাথে সাথেই প্রায় প্লেন রান ওয়ে দিয়ে ট্যাক্সিং করে এক সময় সো করে আকাশে উড়ে গেল। সামনে নিচে বঙ্গোপসাগর পরে রইল। নিশাত আর হাবিব মাত্র সেদিন পতেঙ্গা এসে এই সাগর দেখে গেছে।
[চলবে]

স্বপ্ন তরী

ও কাজল কাল রাত তুমি
বল আমার কৃষ্ণ বরণ সখীরে
ইশারায় সে কেন ডাকে না আর আমাকে।

তার চন্দন টিপে জ্বলে সন্ধ্যাতারা
আমার ডাকে দেয় না আর সারা
ভুলিতে কেন পারি না কেন আর তাকে।

সে যে এমন সখী, বলব কি তার কথা
কখনও সে আমায় ডেকে বলে না আর সখা।

নিশীথে সে ফুলের সাথে কথা বলে চুপি চুপি
নীল যমুনা আছে তার আঁখি জলে
জানি না কেমন করে মনের কথা বলি তাকে।

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১০

নিশাত বেরিয়ে যাবার পর নিরু ভাবতে বসল মানুষটকে কতদিন ধরে দেখছি কিন্তু কখনও এমন পাগলামি করেনি আজ কি হলো? কাল নোমান ভাই না জেনে অমন কথা বললই বা কি করে, একটু ইশারা ইঙ্গিতে রেখে ঢেকে বললেও পারত। যাক যা বলেছে বেশ করেছে তবুও যদি মানুষটার একটু বোধোদয় হয়। এমন পরিস্থিতিতে সবাই কি করে? আশেপাশে কাওকে এমন দেখছি না। কি করি এখন? কি করি? কতদিন ধরেইতো পথ চেয়ে রয়েছি এই বুঝি আজ কিছু বলবে বা কাল কিছু বলবে। কি ভাবছে সে? আমি বলব? কেন প্রথমে কি মেয়েরা বলে? একটু এগিয়ে এলে কি হতো? কিছু না বলে একেবারে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসান? ঈশ বয়েই গেল! হুহ্! এতদিনে তার সময় হলো! ভেবেছিলাম ঢাকায় এলে মাঝে সাঝে দেখা হবে কিন্তু এ কি হলো? যাক যা হবার ভালই হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন। কতদিন পরে আসবে বলল, নয় মাস না? হ্যাঁ তাইতো! এই নয়টা মাস দেখতে পাব না!

দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। আজ রবি বার। সকাল থেকেই বাড়িতে একটা হুলস্থূল ভাব। বাবা আজ ছুটি নিয়েছেন। সকালে নাশতা করেই বাজারে গেলেন নিশাতের প্রিয় ইলিশ পোলাও রান্নার জন্য ইলিশ মাছের সন্ধানে। দুপুরে ইলিশ পোলাও রান্না করলেন মা। ভাই বোন সবাই এক সাথে খাবার সময় আলাপ হলো। বাবা স্টেশনে যাবেন, সাথে মেঝ ভাইও যাবে। তবে হাবিব সহ সবাই এক সাথে যাবে, ওদিকে হাবিবের সাথে ওর মা বোন আর বাবাও যাবে।

রাত আটটায় মাকে সালাম করে ভাই বোনদের কোলে নিয়ে বুকে নিয়ে আদর করে নিশাত বাবা আর মেঝ ভাইয়ের সাথে হেঁটে হাবিবদের বাড়িতে চলে এলো। এসে দেখে ওরা রেডি। হাবিবের বাবা মা বোন সহ সবাই স্টেশনে যাবে। প্রায় সাড়ে নয়টায় কমলা পুর স্টেশনে পৌঁছে সবাই এক জায়গায় দাঁড়ালো। নিশাত আর হাবিব টিকেট নিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে প্লাটফর্মে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকা চিটাগাং মেইলের একটা বগিতে দেখে শুনে সীট নিয়ে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে নেমে এলো। বাবা ভেজা চোখে কিছু উপদেশ দিলেন। নিশাত মনোযোগ দিয়ে শুনল। নিশাত আবার মেঝ ভাইকে কিছু উপদেশ দিল। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, শেষ হুইসল দিয়ে দিয়েছে। প্লাটফর্মে আর দাঁড়াবার সময় নেই। উঠে সীটে বসে জানালা দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্লাটফর্ম থেকে ওরা সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। ট্রেন আস্তে আস্তে কমলাপুর ছেড়ে চিটাগাং এর দিকে যাচ্ছে। এক সময় ওরা সবাই চোখের আড়াল হয়ে গেল। পিছনে রেখে গেল নিরুর সাথে শেষ কথার এক টুকরা উষ্ণ স্মৃতি “দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করব” এইতো আর কি চাই! তবুও মনের ভয় যেতে চায় না! যদি কিছু হয়ে যায়! অন্তত যুঁই অথবা বীণা আপাকে একটু ইঙ্গিত দিয়ে আসলে হতো না? নানা কথা এলোমেলো ভাবে আসছে যাচ্ছে। সারা পথে নিশাতের মুখে কোন কথা নেই। হাবিব বার বার জিজ্ঞেস করছে
কি রে তোর মন খারাপ লাগছে? এমন চুপ চাপ রয়েছিস কোন কথা বলছিস না!
কি বলব, যাচ্ছি তো।
আরে, বিদেশে যাচ্ছি কোথায় একটু আনন্দ উল্লাস করবি তা না মুখ কেমন করে রেখেছিস।
নিশাত মনে মনে বলল তুই জানিস না আমি কি ছেড়ে যাচ্ছি। আমিতো যাচ্ছি কিন্তু প্রাণ যে এখানে রয়ে গেল!

সকালে চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে একটা রিকশা নিয়ে হাবিব মাদারবাড়ি ওর খালার বাড়িতে এলো। এখানে নিশাতকে কেউ চিনে না। হাবিব খালা খালু সবাইকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ওদের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য জানাল। খালা খালু সবাই বেশ খুশি। হাত মুখ ধুয়ে আসার পর খালা তাড়াতাড়ি নাশতা এনে দিলেন। নাশতা খেয়ে আগ্রাবাদ জেমস ফিনলে অফিসে এসে ওদের নিয়োগ পত্র দেখালে বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের টেবিল দেখিয়ে দিল। তার কাছে গিয়ে বলল আমরা এসেছি। বুড়ো কি এক ফাইল দেখছিল। ওদের দিকে তাকিয়ে বসতে বলল। একটু পরে ফাইল রেখে বলল
ইয়েস ইয়াং মেন্স হোয়াট কেন আই ডু?
ওরা আবার এই বুড়োকে নিয়োগ পত্র দেখাতে বুড়ো লাফ দিয়ে বলে উঠল
ওহ! ইউ আর হেয়ার, গুড! ভেরি গুড! তোমরা জান তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
না।
তোমরা লাকি ইয়াং ম্যান, ডাইরেক্ট ব্রিটিশ জাহাজে যেতে পারছ, আপাতত লন্ডন যাবে, ওখান থেকে জাহাজে উঠবে।
কবে যেতে হবে?
দাড়াও, তোমাদের সিডিসি বানাতে হবে, টিকেট করতে হবে এমন আরও কিছু কাজ আছে সেগুলি হলে তখন বলতে পারব। মনে হয় ৩/৪ দিন লেগে যাবে। তোমরা রেডি হয়ে এসেছ?
হ্যাঁ, আমরা বাড়ি থেকে রেডি হয়েই এসেছি।
এখানে কোথায় থাকছ?
হাবিব বলল মাদারবাড়িতে আমার খালার বাড়ি।
দেখ, থাকার কোন অসুবিধা হলে সিম্যান হোস্টেলে থাকতে পার।
না কোন অসুবিধা নেই।
গুড।
তাহলে তোমাদের সাথে ছবি আনতে বলেছিলাম তা এনেছ?
হ্যাঁ এনেছি।
বলে ওরা দুই জনেই পকেট থেকে ছবি বের করে দিল।
না আমাকে সব গুলি দিতে হবে না একটা করে দিলেই হবে শুধু আইডি কার্ড বানাবার জন্য, অবশ্য আইডি কার্ড শিপিং অফিস থেকেও একটা দিবে, তোমদেরকে এখন শিপিং অফিসে পাঠাচ্ছি বাকিগুলি ওখানে লাগবে। আচ্ছা তোমরা একটু বস, আমি শিপিং অফিসের জন্য চিঠি রেডি করে নেই।
আচ্ছা ঠিক আছে।

বুড়ো পাশের এক জনকে ডেকে বলল এদের জন্য দুইটা চিঠি টাইপ করে নিয়ে আস।
আধা ঘণ্টার মধ্যে চিঠি নিয়ে এলে বুড়ো নিয়ে গেল তার বসের কাছে স্বাক্ষরের জন্য। একটু পরেই এসে দুই জনকে খামে ভরা দুইটা চিঠি দিয়ে বলে দিল রাস্তার ওপাশে যে সিজিও বিল্ডিং ওর চার তলায় শিপিং অফিস, তোমরা এই চিঠি নিয়ে ওখানে যাও। ওরা সিডিসি বানিয়ে দিবে।
সিডিসি কি?
পাসপোর্ট চেন?
হ্যাঁ চিনি।
এটাও ওই পাসপোর্টের মত, জাহাজে চাকরীর জন্য পাসপোর্টের পরিবর্তে সিডিসি ব্যবহার হয়। আচ্ছা যাও দেরি করো না তাড়াতাড়ি যাও।
ওরা দুই জনেই অফিস থেকে বের হয়ে ব্যাপ্টিস্টের কথা মত শিপিং অফিসে যেয়ে চিঠি দেবার পর ওরা কয়েকটা কাগজে সই স্বাক্ষর, টিপ, রেখে উচ্চতা ইত্যাদি মেপে বিকেল ৪টায় আসার জন্য বলে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আবার ব্যাপ্টিস্টকে জানাল। ঠিক আছে তোমরা বিকেলে ওটা নিয়ে তারপরে এসো। এর মধ্যে তোমাদের আর কিছু করার নেই।
ওখান থেকে বের হয়ে হাবিব বলল
চল, মামার বাড়ি যাই।
নিশাত চট্টগ্রামের কিছু চিনে না। হাবিবদের বাড়ি চট্টগ্রাম বলে ওর আত্মীয় স্বজনেরা অনেকেই এখানে।
চল।

হাবিবের মামা বাড়ি থেকে সরাসরি বিকেল ৪টার মধ্যে শিপিং অফিসে এসে হাজির। যার সঙ্গে কথা হয়েছিল সে একটা রেজিস্ট্রি বইতে স্বাক্ষর নিয়ে দুই জনকে সিডিসি আর আইডি কার্ড দিয়ে দিল। ওখান থেকে বের হয়ে আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বই খুলে দেখছে এটা কি দিল। আইডি কার্ডে লেখা দেখল বাংলাদেশি নাবিকের পরিচয় পত্র। সিডিসি খুলে দেখে ওদের যাবতীয় বিবরণ লেখা সহ পাসপোর্টের মত একটা বই। ওই বই নিয়ে ব্যাপ্টিস্টের অফিসে এসে বুড়োর হাতে দিল। বুড়ো বলল ওকে মাই ডিয়ার, তোমরা এখন চলে যাও আমি কাল সকালে তোমাদের ফ্লাইট বুকিং করতে দিবো। এই যে এই ঠিকানা নিয়ে যাও এটা একটা টেইলরএর দোকান ওখানে গিয়ে এই চিঠি দিবে ওরা তোমাদের পোশাকের মাপ রাখবে। আগামী কাল বিকেলে এসে আর্টিক্যালে সই করবে আর ফ্লাইটের সময় জেনে পরে কি করতে হবে সে সব ওই যে শিকদার সাহেব বসে আছে তার কাছে জেনে যাবে, উনিই তোমাদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবে।
নিশাত জিজ্ঞেস করল একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
কি কথা?
আমরা দুই জনে কি একই জাহাজে থাকব?
নো নো মাই ডিয়ার, তুমি যাবে লন্ডন আর ও যাবে দুবাই, তবে এখান থেকে তোমরা এক সাথে দুবাই পর্যন্ত যাবে। আরও দুই জন আছে তারাও তোমাদের সাথে যাবে।
ও দুবাই আর আমি লন্ডন কেন?
ওর জাহাজ দুবাইতে রয়েছে আর তোমার জাহাজ ডান্ডি থেকে সেইল করে লন্ডন আসছে মেরামত করার জন্য ওখানে পৌছাতে কয়েক দিন লাগবে, তাই তুমি লন্ডন যাবে। ভয় পেয়ো না ওখানে সব জায়গায় আমাদের এজেন্ট আছে তারাই তোমাদের দেখা শুনা করবে। এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করা থেকে হোটেলে থাকা এবং জাহাজে তুলে দেয়া পর্যন্ত সব তারা করবে। তোমাদের এ নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আর কিছু?
না ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের যোগাযোগ হবে না?
হ্যাঁ তা হবে যদি কখনো তোমাদের জাহাজ এক পোর্টে আসে তখন দেখা হবে না হলে কাছাকাছি থাকলেও ভিএইচএফে কথা বলতে পারবে।
তা হলে এখন যাও ডার্লিং এর সাথে দেখা করগে। আগামী কাল বিকেল ৪টার মধ্যে চলে এসো। মনে থাকে যেন।
হ্যাঁ মনে থাকবে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৯

নিরু ঝিটকা স্কুল থেকে পাশ করে বের হলো। এখন ধানমন্ডিতে বড় বোনের কাছে থেকে লালমাটিয়া কলেজে পড়বে। বাড়ি থেকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিরুর বাবা, বড় বোন আর নিশাতের দাদি আর মা একসাথে ঢাকা আসছিল। গাড়িতে নিরুর চোখের দিকে তাকিয়ে অনেকদিন পরে এই প্রথম নিশাত একটু অবাক হলো। এইতো এই চোখ আমি খুঁজছিলাম এতদিন! নিরু বড় হবার পর এত কাছে থেকে নিরুকে দেখার সুযোগ হয়নি এতদিনেও। আজ কাছে পেয়ে নিরুর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। এতদিন এই চোখ কোথায় ছিল? যে চোখে প্রশান্ত মহা সাগরের গভীরতা! যে চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দেয়া যায় সারাটা জীবন! অবাক হয়ে চেয়ে ছিল পলক হীন। মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের সাথে মানুষের ঋতু পরিবর্তনের সাথে তার মনের অনেক পরিবর্তন হয়। নিশাত এতদিন যেমন ছিল আজ আর তেমনটি নেই। আজ সে চাকরী নিয়ে লন্ডনের যাত্রী। নিরুকে এতদিন মনে মনে ভাল লাগলেও তা কেমন করে যেন কিসে চাপা পড়ে ছিল কিন্তু আজ সে লন্ডনের যাত্রী বলে তার দৃষ্টি ভঙ্গি বদলে গেছে। সে নিরুর চোখের চাওনি বা চোখের গভীরতা নিরূপণ করতে পারছে। মানিকগঞ্জে এসে গাড়ি থামিয়ে কিছু খাবার আর বীণা আপার ছোট বাচ্চার জন্য কি যেন কিনতে হবে বলে বীণা আপা গাড়ি থামতে বলল। নিশাতের মা নিশাতকে পাঠাল, বীণা আপাও বলল নিরু তুই যা ওর সাথে ও চিনতে পারবে না। এমন কি আনবে যে নিশাত চিনে আনতে পারবে না! যে কিনা মাত্র কয়েকদিন পরে একা একা লন্ডন যাচ্ছে সেই ছেলে আনতে পারবে না? নিশাতও নিষেধ করল না। সাথে নিরু আসছে বলে কোন প্রতিবাদ করেনি। নবীন সিনেমা হলের পাশে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল আর গাড়ির সবাই নেমে একটু হাত পায়ের জড়তা ছাড়াচ্ছিল। ওরা রাস্তা পার হয়ে গড়পাড়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাছে যেতেই একটা মোটর সাইকেল হুট করে নিশাতের পাশে এসে ব্রেক করল। আরোহী পিছন থেকে নিশাতের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল
এই বাঙালি, কোথায় যাচ্ছিস?
নিশাত দাঁড়িয়ে পড়ল, নিশাতকে দেখে নিরুও দাঁড়াল। নিরুকে দেখে মটর বাইকের আরোহী নোমান বলল
কিরে তুই বিয়ে করলি কবে?
বিয়ে! কি বলছিস?
ফিসফিস করে বলল তাহলে এ কে?
এই চুপ! আস্তে করে বলল, সর্বনাশ করে ফেলেছিস! এ হলো শিহাবের ছোট বোন নিরু, ও লালমাটিয়া কলেজে ভর্তি হবার জন্য ঢাকা যাচ্ছে, ঐযে গাড়িতে সবাই আছে, আমরা কিছু কেনার জন্য নেমেছি
নোমান ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলল সরি দোস্ত, কিছু মনে করিস না
না কি মনে করব! মনে মনে ভাবল তোর কথা যেন সত্যি হয়!
নোমানকে দেখিয়ে বলল নিরু এ আমাদের বন্ধু নোমান, শিহাব চেনে
নিরু নোমানকে সালাম দিয়ে বলল ভাই আপনার বাড়ি গোপীনাথপুর না?
হ্যাঁ, তুমি আমাকে চেন?
খুব ভাল করেই চিনি, আপনি ঊর্মির ভাই না? আমি ঊর্মির সাথেই পড়েছি, ও কোথায় ভর্তি হবে ভাইয়া?
ও এখানেই দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছে
ও আচ্ছা, আমার কথা বলবেন, আমি ঢাকা যাচ্ছি, বড় আপার কাছে থাকব
নিশাতের লন্ডন যাবার ঘটনা নিয়ে নোমান আরও কিছু আলাপ করে নিশাতের লন্ডন যাত্রা আর জাহাজে চাকরীর কথা জেনে খুশী হয়ে বিদায় নিল।
নোমানকে বিদায় দিয়ে নিশাত বলল শুনেছ ও কি বলেছে?
নিরুর মুখ লাল হয়ে গেল, মাথা নিচু করে দাড়িয়েই রইল
মনে মনে ভাবল এ আবার কেমন মানুষ! এমন কথা কাউকে বলা যায়? না জেনে সে না হয় ভুল করেই ফেলেছ তাই বলে…………।
আচ্ছা দাড়াতে হবে না চলো
এইতো নোমানের এই কথায় মনে হয় এতদিনে ওরা দুই জনে মন দেয়া নেয়ার চিরাচরিত মহান কাজটা ওদের অজান্তে একান্ত নীরবে সেরেই ফেলল তবে নিরু এখনও বুঝতে পেরেছে কি না সে একটা সংশয় হয়ে রইল। সেদিন একটা বেকারিতে খাবার কিনতে কিনতে নিরুই প্রথম কথা বলল,
তাহলে আপনি লন্ডন চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ
আবার কবে ফিরবেন?
নয় মাস পরে, ফিরে আসলে আমাকে চিনতে পারবে?
পারব, আপনাকে এত দিন ধরে চিনি, এই কয় দিনেই ভুলে যাব? কি যে বলেন না!
আর সাধারণ কিছু টুকিটাকি কথাবার্তা হয়েছিল। সেদিন বেশি কিছু বলার সময় পায়নি বা সুযোগও হয়নি। সময় পেয়েছিল ঢাকায় যাবার পরে।

৫।
ঢাকায় পৌঁছে নিশাতদের বাড়ির পাশে ওদের নামিয়ে দিয়ে বীণা আপা নিরু আর চাচাকে নিয়ে চলে গেল। রাস্তায় চাচা নানা কথা জিজ্ঞেস করছিল কি চাকরী কেমন করে কোথায় থাকবে ইত্যাদি নানা কিছু। চাচা বেশ খুশি হয়েই বলেছিল যাক বাবা আমাদের গ্রামের মধ্যে তুমিই প্রথম লন্ডন যাচ্ছ কাজেই বাবার মান সম্মানের দিকে খেয়াল রেখো। ও ছোট বেলা থেকেই অনেক কষ্টে বড় হয়েছে, বাবা মায়ের সুখ শান্তির দিকেও লক্ষ রেখ।

বাড়িতে পৌছার একটু পরেই হাবিব এলো।
কিরে তোকে এমন চিন্তিত মনে হচ্ছে না কি ভুল দেখছি?
না চিন্তার কি আছে, কিছু চিন্তা করছি না। বল তোর কি অবস্থা, সব কিছু গুছিয়েছিস?
হ্যাঁ আমার মোটা মুটি কমপ্লিট, তোর কত দূর?
এই তো পরশু দর্জির কাছে কাপড়ের মাপ দিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম। দাদুর সাথে দেখা করে তাকে নিয়ে এইমাত্র আসলাম তবে এবার গ্রামে যেয়ে…………
এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেল, মুখে আর কোন সারা নেই।
কি, গ্রামে যেয়ে কি?
না কিছু না।
না, কিছু একটা আছে তুই বলতে গিয়েও থেমে গেলি কেন?
না হাবিব কিছু না। আচ্ছা, তুই কবিতার সাথে দেখা করেছিস?
ও! বুঝেছি, তোরও এমন কেউ আছে, এত দিন কিছু বলিসনি কেন?
আমি কি বলি আর তুই কি বলিস?
হ্যাঁ গত কাল দেখা হয়েছে, কিন্তু তোর কথা কি বল।
নারে আমার তেমন কোন কিছু নেই।
আলাপ আর তেমন এগোয়নি। মা এসে গেল।
কি হাবিব, তোমার কি অবস্থা, সব কিছু গুছিয়েছ?
হ্যাঁ খালাম্মা।

সামনে আর মাত্র দুএক দিন বাকি। বাড়িতে ছোট ভাই বোনেরা আনন্দে বিভোর। দাদা বিদেশে যাবে। মা এটা সেটা যা নিশাতের পছন্দ তাই রান্না করছেন। সূর্য তার নিয়ম মত ডুবছে উঠছে। নিশাতের মনের বিষণ্ণ ভাব যাচ্ছে না। মা দেখে ভাবলেন কোন দিন বাড়ির বাইরে থাকেনি এখন হয়ত সবাইকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে মন খারাপ তাই এক দিন সন্ধ্যায় নিশাতকে ডেকে বোঝালেন।
কি করবে বাবা যে বয়সে আর দশটা ছেলে বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে সেই বয়সে তোমাকে রুজির সন্ধানে দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে বলে মন খারাপ করে থেকো না। ওখানে গিয়ে আমাদের জন্য চিন্তা করবে না। মন দিয়ে কাজ করবে, সবার সাথে মিলে মিশে থাকার চেষ্টা করবে,
ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এ সব কথা নিশাতের কানে কিছু ঢুকছে আর বেশির ভাগই পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। মা জানে না নিশাতের কিসের ভাবনা।

পরদিন বিকেলে বীণা আপার বাড়িতে এলো। যাবার আগে দেখা করে যাবার উছিলায়। নোমানের ওই কথা বারবার মনে পরছে। আবার নিরু কি ভাবল জানা হলো না। কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নিরুই দরজা খুলে দিয়েছিল।
আপনি!
হ্যাঁ আমি! চাচা কোথায়?
আমাকে ভর্তি করে দিয়ে তখনই বাবা বাড়ি চলে গেছে
ও আচ্ছ তুমি তাহলে ভর্তি হয়েছ?
হ্যাঁ
সেদিন, এত দিন পরে নিরুর সাথে দেখা হলো কিন্তু তেমন কিছুই আলাপ হলো না। নোমানের ওই কথার পর থেকেই মনে হতে শুরু করেছে যেন নিরু এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। চোখে মুখে কোন এক অচেনা মায়াবী ছাপ পড়েছে দেখতে আরও সুন্দর হয়েছে। এত দিনের চেনা সেই নিরু আর নেই এখন নিরুর চোখ কথা বলতে শিখেছে। চোখে ফুটে উঠেছে প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীরতার ছায়া। এত দিনের নিরু আর আজকের নিরুর মধ্যে অনেক তফাত। আজকের নিরু পরিপূর্ণ এক নারী। তার স্বত্বায় জেগে উঠেছে নারী হৃদয়ের মমতা, প্রেম। এই নিরু কি নিশাতের জন্য অপেক্ষা করবে?
কি হলো! ভিতরে যেতে দিবে না? বলেই ঘরে ঢুকে নিরুর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে সোফায় বসল। ভিতর থেকে বীণা আপা জিজ্ঞেস করল কে রে নিরু? অপ্রত্যাশিত প্রথম স্পর্শের ঘোর কাটিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে ভিতরে যেতে যেতে বলেছিল আপা নিশাত ভাই। মেয়েদের যে ষষ্ট ইন্দ্রিয় থাকে তাই দিয়ে অনুভব করে মনে মনে ভাবছিল হঠাৎ করে এই মানুষ এমন হলো কেন? তবে যাই হোক, এই আকর্ষণে কোন ইতর ইঙ্গিত নেই, কোন লালসা নেই, বরঞ্চ একটু কেমন যেন নির্ভরতার ছোঁয়া আছে। দেখা যাক সামনে কি হয়!
ওকে ভিতরে নিয়ে আয়
বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পিছনে ঘুরে ইশারায় বলল আপা ডাকছে
নিশাত উঠে ওর পিছে পিছে আপার সামনে হাজির হলো। আমি কাল চিটাগাং চলে যাচ্ছি ওখান থেকে কয়েকদিনের মধ্যে চলে যাব হয়ত ঢাকায় আসা নাও হতে পারে আপা, দুলাভাই কোথায়? তোর দুলাভাই এখনও আসেনি
নিরু পাশেই ছিল, সব শুনল।
তাহলে আমি ওই ঘরে বসি?
যা বয় আমি আসছি
নিরু, ওকে চা নাস্তা দে। একটু পরে কাঁপা হাতে ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে নিরু যখন ট্রে নিয়ে বসার ঘরে এলো তখন নিরুর হাত কাপতে দেখে নিশাত উঠে ট্রেটা নামিয়ে নিচ্ছিল কিন্তু নিরু ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাড়াতেই অন্য হাতে ওকে টেনে দাড় করিয়ে হাতের ট্রে নামিয়ে আবার ওকে নিয়ে পাশে বসল।
পালাচ্ছিলে কেন? কাল নোমান কি বলেছিল শুননি?
আমার ভয় করছে, ছেড়ে দেন আপা দেখে ফেলবে
নিরুর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এবার মোটামুটি নিশ্চিত হলো এই আকর্ষণে নিরাপত্তার অভাব নেই, নির্ভরযোগ্য। এতদিন যার অপেক্ষা করেছে এ সেই হাত।
আপা দেখল তো কি হলো? আপারও এমন দিন গেছে, সে জানে
আজই এর একটা সমাধানে পৌছাতে হবে! এ ঘরে নিরুকে একা পেয়ে নিশাত জোর করে পাশে বসিয়ে সেই কথা কানে কানে বলছে। নিরু কি ভাবছে সে কথা বোঝার মত ধৈর্য বা জ্ঞ্যান কোনটাই নিশাতের ছিল না। নিশাতের হাতে বাধা পড়ে নিরু শুধু ভাবছিল এই মানুষটা হঠাৎ করে এমন পাগল হয়ে গেল কেন? যাকে সেই ছোট বেলা দেখে আসছি সেতো কোনদিন এমন ছিল না! শান্ত সৌম্য সহজ সরল একজন সুপুরুষ কিন্তু আজ কি হলো? কাল চলে যাচ্ছে বলে? যতক্ষণ নিশাত নিরুর হাত ধরে রেখেছিল ততক্ষণ বারবার উঠি উঠি করছিল।
আহ! ছাড়ুনতো! আপা এসে দেখে ফেলবে!
না, তুমি বল তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না!
ছাড়ুন না! আপা দেখে ফেললে কি হবে ভেবেছেন?
কিচ্ছু হবে না তুমি বল তুমি অপেক্ষা করবে!
ছাড়া পাবার জন্য মুখে যা আসে নিরু তাই বলে ফেলল,
দরকার হলে সারা জীবন আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব! এবার ছাড়ুন!
আস্বস্ত হয়ে নিশাত এবার নিরুকে ছেড়ে দিল। কোন রকম নিজেকে ছাড়িয়ে নিরু বলল
আজ কি হয়েছে আপনার, এমন ডাকাতের মত করলেন কেন? অমনিই পিছনে আপার পায়ের শব্দ পেয়ে পিছনে ফিরে দেখে আপা পর্দা সরিয়ে ভিতরে আসছে।
আপা, দুলাভাইয়ের আসতে দেরি হবে আমার আবার অনেক জায়গায় যেতে হবে আমি বরং উঠি আপনি দুলাভাইকে বলবেন আমার জন্য দোয়া করতে।
আর একটু বসে দেখ
দুলাভাইকে বলা তেমন জরুরী না। নিশাতের যা জানার তা জেনে ফেলেছে কাজেই
না আপা, আমাকে অনেক জায়গায় যেতে হবে, বলেই উঠে পরল।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৮

খালাম্মা আমি বাড়ি যাই, হাবিব এলে আমাদের বাড়ি যেতে বলবেন
বিকেলে হাবিব এলো। দুই বন্ধু একে অপরকে জড়িয়ে কোলাকুলি করে বলল
আমি সাতার জানি না বলে মা রাজী হচ্ছে না। দেখ তুই একটু বুঝিয়ে দেখ কোন লাভ হয় না কি। তারপর রাতে
আব্বার সাথে কথা বলে দিন ঠিক করতে হবে তুইও খালুর সাথে আলাপ করে কি বলে কাল সকালে এসে জানাবি।
আচ্ছা আমি খালাম্মাকে বুঝাই। দেখি কি বলে।
একটু পরে হাবিব এসে জানাল না রে নিশাত খালাম্মা রাজী হচ্ছে না।
আচ্ছা আব্বা আসুক দেখি সে কি বলে। তুইও দেখ খালু কি বলে। কাল আবার আসবি।

কাল সকালেই হাবিব এসে হাজির।
কিরে খালু কি বলল, খালু কি খুশি হয়েছে?
হ্যাঁ আব্বা আম্মা সবাই খুব খুশি, তোর খবর কি?
মা রাজী হচ্ছিল না আব্বা বুঝিয়ে কোন রকম রাজী করিয়েছে তবে আব্বা খুশি হলেও চিটাগাং গিয়ে কোথায় থাকব সেই চিন্তা করছে।
এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই আমি আমার খালার বাড়ি থাকব, তুইও আমার সাথে থাকবি। তাহলে কবে যাবি ভাবছিস?
কিছু গোছ গাছ করতে হবে তা ছাড়া আব্বা কবে চিটাগাং যাবার ভাড়া যোগার করতে পারে তা ঠিক দেখে নিই আগে। আমার বাবার তো তোর বাবার মত অবস্থা না, তাকে একটু চেষ্টা করতে হবে। তবে আমার মনে হয় মোটা মুটি আগামী রোববারের মেইল ধরে গেলেই হবে। তোর কি মনে হয়?
হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি।
তা হলে দেখি আজ আব্বার সাথে একটা ফাইনাল ডিসিশন নিতে হবে, কি বলে না বলে আমি কাল তোকে জানাব।
ঠিক আছে তা হলে আমি এখন আসি।

সেদিন রাতে খাবার পর বাবা নিজেই জিজ্ঞেস করলেন। কবে গেলে সুবিধা হবে।
ওরা আগামী ২৩ তারিখের মধ্যে যেতে বলেছে কিন্তু আমার মনে হয় একটু আগে যেতে পারলেই ভালো। তাই ভাবছি আগামী ২১ তারিখে রবিবারের রাতের মেইলে যেতে পারলে হয়। হাবিব বলল ও ওর খালার বাড়ি থাকবে আমিও ওখানে ওর সাথে থাকতে পারব।
তা হলে ঠিক আছে তাই কর, দেখি এর মধ্যেই টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
নিশাতের মা বলল
যাবি যখন তোর মেঝ মামার সাথে দেখা করে বলে আয় দেখ ও কি বলে।
তাহলে সকালেই যাই?
যেতে চাইলে যা।
মায়ের মুখে কথাটা শুনে নিরুর কথা মনে হলো। নিরুর সাথে দেখা করতে হলে গ্রামে যেতে হবে কিন্তু গ্রামে যাবার সুযোগ একমাত্র দাদুর সাথে দেখা করা। এছাড়া গ্রামে যাবার কোন অজুহাত নেই!
আম্মা, গ্রামে যেয়ে দাদুর সাথে দেখা করব না?
হ্যাঁ অবশ্যই করবি। চল কাল যেয়ে আম্মার সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসি!
হ্যাঁ আম্মা তাই ভাল হবে
সকালে উঠে নিশাত কাপড় বদলে মতিঝিলে মামার অফিসে চলে গেল। মামা অফিসে কি একটা জরুরী মিটিঙে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মামা এসে নিশাতকে দেখেই জিজ্ঞেস করল
কি রে, কি ব্যাপার এখানে এসেছিস?
মামা একটা ভালো সংবাদ আছে তাই মা বলল তোর মামার সাথে আলাপ করে আয়, তাই এলাম।
কি খবর?
আমি আর আমার বন্ধু হাবিব বিদেশের জাহাজে চাকরী পেয়েছি।
বাহ! বেশ ভালো কথা, তা দুলাভাই আপা কি বলে?
নিশাত এক এক করে সব বলল আর সাথে করে আনা নিয়োগ পত্রটা দেখাল।
মামা নিয়োগ পত্র পড়ে খুব খুশি। চিন্তা করিস না, তোর লেখা পড়া হলো না বলে মন খারাপ করিস না। এখানেও এক দিন জাহাজের ক্যাপ্টেন হতে পারলে অনেক দাম, অনেক বেতন পাবি। আমার বন্ধু আনিসকে মনে আছে? ও কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন। তা কবে যাবি ঠিক করেছিস?
হ্যাঁ, সামনের রবিবার রাতের মেইলে।
কেনা কাটা করেছিস কিছু?
না, কি কিনব, চিটাগাং যাবার টাকা দিতেই আব্বার অবস্থা কাহিল। থাক ওখানে যেয়ে বেতন টেতন পেয়ে যা লাগে কিনে নিবো।
বোকা ছেলে একটা দেশ থেকে বিদেশে যাবি এই ফকিরনির হালে যাবি নাকি? অন্তত কিছু কাপড় চোপর বানিয়ে নে। কি গায়ে দিয়ে যাবি?
বলেই মামা পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে একশ টাকার দশটা নোট নিশাতের হাতে দিয়ে বলল
যা যা লাগে কিনে নিবি, কোন কিপ্টেমি করবি না। তুই এখন আন্তর্জাতিক পথে পা ফেলতে যাচ্ছিস কাজেই সেই ভাবে চলাফেরা করবি। যাবার আগে তোর মামির সাথে দেখা করে যাবি।
আচ্ছা মামা। হ্যাঁ মামির সাথে দেখা না করে কি যাব না কি, শুক্রবারে বাসায় যাব। সবার সাথেই দেখা করে যেতে হবে। তা হলে আমি আসি এখন?
কিছু খেয়ে যা।
না, বাসায় গিয়েই খাব।
দেখিস টাকা গুলি সাবধানে নিবি।
আচ্ছা মামা।

টকাটা পকেটে রেখে মামাকে সালাম করে অফিস থেকে বের হয়ে এসে নিশাতের মনে আনন্দের আর সীমা নেই। এক হাজার টাকা! নিশাত ভাবতেই পারছে না। এই এত টাকা ও কোথায় খরচ করবে? থাক বাবার কাছ থেকে তা হলে আর ওই টাকা নেয়ার দরকার নেই। মামা যা দিয়েছে এতেই চলে যাবে। সোজা বাসায় এসেই মাকে আনন্দ সংবাদটা জানাল। মা মামা আমাকে কেনা কাটা করার জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে ফকিরনির মত বিদেশে যেতে নিষেধ করে দিয়েছে। ভালো জামা কাপড় বানিয়ে নিতে বলেছে।
তুই হলি ওর প্রিয় ভাগ্নে তোকে তো দিবেই। যাক বাবা ভালো হয়েছে, তাহলে ওখান থেকে আসার পথে গুলিস্তান থেকে সার্ট প্যান্টের কাপর কিনে নিয়ে আসলেই পারতি। এক কাজ কর কিছু খেয়ে আবার যা, কাপড় নিয়ে আয় আর তোর তো জুতাও নেই এক জোড়া জুতাও নিয়ে আসবি।
আচ্ছা মা আমি হাবিবকে নিয়ে যাই।
হাবিবকে নিয়ে গুলিস্তান গিয়ে দুইটা সার্ট, দুইটা প্যান্টের কাপড়, একটা ব্যাগ, গেঞ্জি আরও কিছু টুকি টাকি যা মনে পড়ল সে সব কিনে বাটার দোকান থেকে দেখে এক জোড়া জুতা, কিনে বাসায় চলে এলো। পর দিন সকালে মাকে নিয়ে বের হলো। কল্যাণপুরে দর্জির দোকানে আর্জেন্ট ডেলিভারি দেয়ার কথা বলে মাপ দিয়ে মায়ের সাথে গাবতলি গিয়ে ঢাকা আরিচা রুটের বাসে বানিয়া জুরি নেমে গ্রামে চলে গেল।

নিশাত জানে না তার ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। হায়রে মানুষ তুমি জান না আজকে যে পাহাড় সমান সম্পদ পেয়ে তুমি আনন্দে আত্মহারা হয়েছ কালই সামান্য একটা ইঁদুর তার কত বড় ক্ষতি করতে পারে। কিংবা আজ তোমার সামান্য একটা পয়সা না থাকায় দুঃখে মন ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে হয়ত কাল তোমার পকেটে দেখবে সহস্র মুদ্রার ঝলকানি। সবই সেই অদৃশ্য শক্তির কারুকাজ।

গ্রামে এসে প্রথমে নিজেদের বাড়িতে না ঢুকে পথের পাশে শিহাব যুঁইদের বাড়িতে গেল। যাবার সময় মাকে বলে গেল আপনি বাড়ি যান আমি আসছি।
কিরে নিশাত কবে এসেছিস?
এইতো আসছি।
কি খবর বল
শুনেছিস, আমি লন্ডন যাচ্ছি!
শুনে যুঁই আর শিহাব এক সাথে বলে উঠল, কি বললি
হ্যাঁ যা বলেছি সঠিক বলেছি
কবে যাবি?
এইতো এখান থেকে ফিরে রবিবারে চিটাগাং যাব ওখান থেকে দিন তারিখ ঠিক হলেই চলে যাব। এখানে এসেছি তোদের সাথে দেখা করতে।
ওমনিই যুঁই বলল, ঈশ তোর বৌয়ের সাথে দেখা করে যাবি না? ও তো ঢাকা যাবে লালমাটিয়া কলেজে ভর্তি হবে।
কথাটা শুনেই আনন্দ আর লজ্জায় নিশাতের মুখ লাল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কোন কথা বের হলো না। তাহলে? তাহলে কি নিরুকে না দেখেই চলে যেতে হবে? কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। একটু সময় থেমে পরিস্থিতি বুঝে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল নিরু কোথায়?
কেন নিরুর কি দরকার? বৌকে দেখে না গেলে হবে না? ওতো মামার বাড়ি গেছে। আজই আসার কথা। বীণা এসেছে দুই তিন দিন হলো, ওকে নিয়ে যাবে। বীণা সহ ওদের মামা বাড়ি গেছে।
নিশাত উঠে দাঁড়িয়ে বলল তাহলে আমি যাই দাদুর সাথে দেখা হয়নি এখনও
ঢাকা যাবি কবে?
আগামী কাল যাব
তাহলে আবার বিকেলে আসবি?
নিশাত এতক্ষণে নিরুর সাথে দেখা হবার জন্য বিকেলে আবার এখানে আসার সুযোগ খুঁজছিল। যুঁইয়ের কথা শুনে সে সুযোগ পেয়েছে বলে একটু জোরেই বলল হ্যাঁ আবার আসব, শিহাব কোথাও যাবি?
না এখন আর কোথাও যাব না
তাহলে আমার সাথে চলনা মইন চাচার বাড়ি যাব এক সাথেই যাই
চল
দুইজনে এক সাথে নিশাতদের বাড়ি চলে এলো। হাতের ব্যগটা নামিয়ে রেখে দাদির সাথে দেখা করে শিহাবকে নিয়ে চলল মইন চাচার বাড়ি। চাচা বাড়িতে ছিল না, পারাগ্রামের কোন এক জমিতে নিড়ানি দিতে গেছে। একটু বসে মইন চাচার মাকে বলল দাদু আমি একটা খুব ভাল চাকরী পেয়েছি আমাকে লন্ডন চলে যেতে হবে ওখানেই চাকরী। দাদি খুব খুশি হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেকক্ষণ দোয়া করলেন। দাদিকে বলে আসল চাচা এলে আমাদের বাড়ি যেতে বলবেন
আচ্ছা দাদা আমি বলব, তুমি সাবধানে থেকো, শুনেছি বিলাতি মেমসাহেবদের কোন লাজলজ্জা নাই দেখবে আবার অমন কাউকে সাথে করে নিয়ে এসো না।
না দাদু আপনাকে সেজন্যে ভাবতে হবে না।
সন্ধ্যার আগে মইন চাচা এলে তাকে নিয়ে আবার শিহাবদের বাড়ি। বাড়িতে ওঠার আগেই বীণা আপাকে দেখল পুকুর পাড় থেকে বাংলা ঘরের দিকে আসতে। বুঝতে পারল বীণা আপার সাথে নিশ্চয়ই নিরু এসেছে। এখন ওকে দেখার সুযোগ খুঁজতে হবে। নিশাতকে দেখে বীণা আপা কতবেল গাছের নিচে দাঁড়াল।
নিশাত, যুঁই বলল তুই নাকি লন্ডন যাচ্ছিস?
হ্যাঁ আপা, যুঁই ঠিকই বলেছে।
বেশ, খুব ভাল কথা। তা ঢাকায় কবে যাবি?
কালকেই যেতে হবে।
কালই যাবি! তাহলে আমাদের সাথে চল, আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।
আপা আমিতো একা না মাও আছে সাথে আবার দাদুও যাবে।
তাতে কি হলো এ তো আরও ভাল হলো। তারাও যাবে তোদের নামিয়ে দিয়ে আমি নিরু আর বাবা চলে যাব।
এখানে এ কথা সে কথা, নানা গল্পে গল্পে বেশ রাত হয়ে গেল। এখনও নিরুকে দেখার সুযোগ হয়নি। চাচীদের সাথে দেখা করার অছিলায় বীণা আপার সাথে ভিতরে চলে এলো। চাচীদের সাথে কথার ফাঁকে দেখল নিরু ছোট চাচাত বোনকে কোলে নিয়ে খাটের এক কোণায় বসে আছে। হারিকেনের মৃদু আলোতে যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখের দিকে তাকাল কিন্তু কোন সারা নেই দেখে মনটা একটু খারাপ হলো। আবার ভাবল কাল এক সাথে ঢাকা যাবার সময় প্রাণ ভরে দেখে নিবে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৭

৪।
সদ্য স্বাধীন দেশে সব জিনিস পত্রের দাম দিনকে দিন বেড়েই চলছে। প্রকৃতি তার রুদ্র রূপ মেলে দিচ্ছে। জীবন হয়ে উঠছে কঠিন থেকে কঠিনতর। নতুন দেশ, নতুন অর্থনীতি, শূন্য ভাণ্ডার আর তার সাথে অবাধ চাহিদা। চারিদিকে শুধু
ক্ষুধা আর ক্ষুধা। বিরূপ পরিবেশ। এর মধ্যেই আবার প্রকৃতি নিয়ে এলো তার প্রচণ্ড হিংস্র মূর্তি। দেশে দেখা দিল বন্যা। এমনিই মানুষ সামাল দিতে পারছে না তার মধ্যে আবার এই দুর্যোগ। রেশন কার্ড নিয়ে নিশাত রাত তিনটায় রেশন দোকানে লাইনে দাঁড়াত, তবুও গিয়ে দেখত তার আগে আরও কয়েক জন এসে পরেছে। ঘুমে চোখ একা একাই বন্ধ হয়ে আসতে চাইত কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আর ঘুমানো যায়? তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকত কখন সূর্য উঠবে কখন নয়টা বাজবে, কখন দোকান খুলবে! এই রেশন নিয়ে বাড়ি গেলে মা রান্না করবে। ক্ষুধা নামক জীবের অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য প্লাস্টিকের চাউল যা সেদ্ধ হতে জ্বালানী খরচ হত অনেক, পোকা ধরা দুর্গন্ধে ভরা কিছু গম আর কিছু চিনি এই ছিল রেশন কার্ডে বরাদ্দ। তবুও নিরুপায় মানুষকে তাই খেতে হত। শাক সবজি, ডাল, মাছ এসব তো আর রেশনে পাওয়া যায় না। ওগুলি পাবার ব্যবস্থা আছে কিন্তু তা অন্য ভাবে। বাজারে ওসব পাওয়া যায় কিন্তু তা কেনার সামর্থ্য খুব কম লোকের হাতে। বাড়িটা করতে গিয়ে নিশাতের বাবা কিছু ঋণ করেছিল। গ্রামের জমি বিক্রির টাকায় হয়নি। অল্প কিছু ঋণ করতে হয়েছিল। সেই ঋণ শোধ করতে গিয়ে নিশাতের বাবাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তার মধ্যে আবার ওদের পাঁচ ভাই বোনের লেখা পড়া।

ওই দুর্যোগের মধ্যেই মাছ ভাতের বাঙ্গালি তার চিরাচরিত অভ্যাস ছেড়ে খেতে শিখল গমের আটার রুটি। তাও আবার যারা দিচ্ছে তাদের অখাদ্য। আরও শিখল সরষের তেলের পরিবর্তে সয়াবিন তেলে রান্না। বুড়ি গঙ্গা আর তুরাগ নদী দিয়ে অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে মিশেছে আবার সেই পানি সূর্যের তাপে বাষ্পায়িত হয়ে হিমালয়ে কিংবা কাঞ্চনজঙ্ঘা কিংবা মানস সরোবরে এসে জমেছে। এখান থেকে নদী বেয়ে আবার গেছে বঙ্গোপসাগরে। প্রকৃতি থেমে নেই। সে তার আপন গতিতে নিজ রূপে বয়েই চলছে। তার কোন তাড়া নেই, কোন অভাব নেই। আকাশের চন্দ্র সূর্য তারা নক্ষত্র রাজি সবই উদয় হয়েছে আবার অস্তও গেছে। বাতাস বয়ে গেছে সাথে করে কখনও উড়িয়ে নিয়েছে কিছু মেঘমালা, কখন শান্ত বেগে কখন অশান্ত ঝড়ের বেগে, কখন নিস্তব্ধ মৃদু বেগে। এই ভাবেই ক্যালেন্ডারের পাতা একের পর এক উলটে গেছে। ঘড়ির কাটা ঘুরে ঘুরে ঋতুর পরিবর্তন এনেছে। যত্নে সাজানো বাগানের এবং অযত্নে বেড়ে উঠা ঝোপ ঝাঁরে বন ফুলের অনেক কলি ঝরে গেছে আবার তার জায়গায় নতুন কুড়ি এসেছে। এগুলিও কিছু আধো ফোটা অবস্থায় ঝরে গেছে, কিছু ফুটে তার সৌরভ ছড়িয়েছে আবার কিছু ঠাই পেয়েছে কারো সাজানো ঘরের ফুল দানিতে নয়ত কারো প্রিয়ার খোপায় তার হিসেব কে রেখেছে কে জানে! এই ভাবেই বয়ে চলেছে জীবন নদীর শান্ত অশান্ত স্রোত। কোনটা সাগরে মহা মিলনে মিলিত হয়েছে আবার কোনটা মাঝ পথেই শুকিয়ে গেছে। আবার কোনটা কিছু দূর এগিয়ে মাঝ পথে এসে স্তব্ধ হয়ে থমকে গেছে। এই ভাবে চলেছে, চলছে এবং মহাকালের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলতেই থাকবে। তার পর এক দিন হবে সব কিছুর অবসান। কেউ নিজের ইচ্ছে মত নিজের বাগান সাজাতে পারেনি। সব কিছু যেন কোন অদৃশ্য এক ভাগ্য নামের রিমোট কন্ট্রোলের হাতের পুতুল হয়ে ডানে বামে সামনে পিছনে চলছে। কে কার খবর রাখে?

ছোট বেলা থেকে নিশাতের ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে, মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। নিজ হাতে বানাবে নানা রকম ইঞ্জিন যা মানুষের কাজে লাগবে, মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে দিবে। কিন্তু তার সে স্বপ্ন থমকে গেল কলেজে ইলেক্টিভ ম্যাথে এসে। নিশাত বাবার কাছ থেকে সাধারণ গণিত বেশ ভালো বুঝে নিয়েছিল কিন্তু ক্যালকুলাস, স্ট্যাটিস্টিকস, ডাইনামিকসের ধাক্কায় সব থেমে গেল। নিশাত তার মাথায় এগুলি জোড় করেও ঢুকাতে পারলো না। ওদিকে বাবার এমন সামর্থ্য নেই যে এ জন্য তাকে আলাদা প্রাইভেট টিউশনের খরচ যোগায়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বায়োলজি নিয়ে পড়ে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে এমন সিদ্ধান্ত নিলো। এতেও গবেষণার সুযোগ রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু কলেজ শেষ করে আর বেশি দূর এগুতে পারেনি। দেশের ক্রম বর্ধমান দুর্মূল্যের ফলে তার বাবা তাদের এই পাঁচ ভাই বোনের সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল।
মানুষ মুখে যাই বলুক যতই বলুক দেশের জন্য দশের জন্য ভাবছে। আসলে তার কতটা সত্য তা নিশাত জানে না। নিশাত এখন ভাবছে আসলে এগুলি কিছু নয়। মানুষ ভাবে শুধু তার নিজেকে নিয়েই। সে তার নিজের চাহিদা, নিজের খেয়াল অভাব মেটাবে এটাই এক মাত্র উদ্দেশে। তার নিজের চাহিদা বাস্তব রূপ নিবে, মনে আত্ম তৃপ্তি পাবে, সাথে পাবে যশ প্রতিপত্তি, সম্মান আর সুখ। সুন্দরী শিক্ষিতা স্ত্রী, সাজানো বিলাস বহুল বাড়ি তাতে থাকবে ফুলের বাগান। আরাম আয়েশের যাবতীয় ব্যবস্থা। মালী, চাপরাশি ড্রাইভার সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকবে। পাশে সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে দামী গাড়িতে চলাফেরা করবে এমন অনেক কিছু। নিশাতও ভাবে এই যে আমি চাইছি আমাদের সংসারের বর্তমান অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে সংসারের উন্নতি করবো, ভাই বোনদের নামী দামী স্কুল কলেজে পড়িয়ে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলব, তাদের দামী পোশাক পরাব। সমাজে পাড়া প্রতিবেশীদের ঈর্ষার কারণ হবো তাদের চোখ ধাঁদিয়ে দিবো, সমাজের উন্নতি করবো দেশে বিদেশে নিজের খ্যাতি ছড়াবো তার মুলে কিন্তু ওই একই। নিজের স্বার্থ জড়ান রয়েছে।

মানুষ যতই বলুক তার অন্তর্নিহিত সারমর্ম সে নিজেই। নিজের পেটে ক্ষুধা রেখে কে কার জন্য কতটা পরতে পারে, কত দূর যেতে পারে? নিজের চলার শক্তি হারিয়ে কেউ বেশি দূর যেতে পারে না। এই হয়, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের মনের খবর আমরা কতটা রাখতে পারি? এক জন আর এক জনের মনের কথা কতটা জানতে পারি? এক জনের সাথে আর এক জনের কতটা মিল থাকে? হয়তোবা তাই নয়ত কি জানি কেন নিশাতের মনে এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হায়রে নিয়তি তোমার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কি মানুষ তার ইচ্ছে মত কিছুই করতে পারবে না? এই বিশ্ব সংসারে তুমিই কি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে মানব জীবনের স্টিয়ারিং ঘোরাবে?
এই সব ভাবনা নিয়ে যখন নিশাত ক্ষত বিক্ষত তখন এক দিন সহপাঠী পাশে কল্যানপুরের বন্ধু হাবিব এসে জানাল, এই নিশাত, জাহাজে চাকরী করবি?
কি করে?
এই যে দেখ আমি কি নিয়ে এসেছি.
বলে একটা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন বের করে দেখাল। নিশাত সেটা নিয়ে পড়ে দেখল. চট্টগ্রামের এক শিপিং এজেন্ট জেমস ফিনলে জাহাজের জন্য কিছু ডেক ক্যাডেট চেয়েছে। প্রথমে ক্যাডেট হিসেবে জয়েন করবে পরবর্তীতে জাহাজে কাজের অভিজ্ঞতা হলে নির্দিষ্ট সময় পর পর ইংল্যান্ডে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী উন্নত পদে উন্নীত হয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হবার সুযোগ আছে।
দারুণ একটা খবর এনেছিস, বেশ ভালো করেছিস এটা এনে, তা তুই কি এপ্লাই করবি?
হ্যাঁ আমিও করবো।
তাহলে চল দুই জনে এক সাথেই করি। এক মাস যাবত কলেজ বন্ধ থাকবে কাজেই এর মধ্যে আর কোন ঝামেলা নেই।
যা যা কাগজ পত্র চেয়েছে সেগুলি যোগার করে বাবা মাকে না জানিয়ে নিশাত হাবিবের সাথে এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিল। কয়েক দিন পর ইন্টার্ভিউ লেটার এলো বাড়িতে। চট্টগ্রাম যেয়ে ইন্টার্ভিউ দিতে হবে এজন্য টাকার দরকার। এখন আর বাবাকে না জানালে চলছে না। বাবাকে জানাবার আগে মাকে জানাতে হবে। মা নিজেই যেন বাবাকে বলে। ওই দিন মাই জিজ্ঞেস করল তোর নামে এই চিঠি কিসের, কে দিয়েছে? নিশাত মাকে সব খুলে বুঝিয়ে বলল। সবার শেষে বাবাকে বলার জন্য অনুরোধ করল। মা ওই রাতে খাবার সময় বাবার সাথে এ নিয়ে আলাপ করতেই বাবাও রাজী হয়ে গেল। কবে যেতে হবে জানতে চাইলে নিশাত বলল আগামী সোমবার।
আচ্ছা ঠিক আছে।

রবিবার রাতের চিটাগাং মেইলে করে দুই বন্ধু এক সাথে রওয়ানা হয়ে পর দিন আগ্রাবাদে জেমস ফিনলে অফিসে এসে ইন্টার্ভিউ দিল। দুই জনেরই বেশ ভালো ইন্টার্ভিউ হয়েছে। মোটা মুটি যা যা জিজ্ঞেস করেছে সঠিক জবাব দিয়েছে। ইন্টারভিউ দিয়ে আবার রাতের মেইল ট্রেনে ঢাকায় ফিরে এলো। কয়েক দিন পরেই নিশাতের নামে আর এক চিঠি, ওই ফিনলে অফিস থেকে। সেদিন নিশাতের কলেজ বন্ধ বলে কলেজে যায়নি, বাড়িতেই ছিল। পিওন সরা সরি নিশাতের হাতে চিঠিটা দিয়ে গেল। দুরুদুরু বুকে চিঠি খুলে পড়ে দেখে আনন্দে মা বলে এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে মার কাছে এসে মার বুকে মাথা রেখে মাকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ নিশাতের এই কাণ্ড দেখে মা অবাক হয়ে জানতে চাইল
কিরে কি হয়েছে?
আমার চাকরী হয়ে গেছে!
কোথায়?
ওই যে সেদিন ইন্টার্ভিউ দিয়ে এলাম ওখানে।
তা হলে কি চিটাগাং?
না মা একে বারে বিদেশের এক জাহাজে।
কি বললি?
হ্যাঁ মা এই যে দেখেন এই চিঠিতে সব লেখা আছে।
জাহাজের চাকরী?
হ্যাঁ মা!
তুই কি সাতার জানিস যে জাহাজে চাকরী করবি?
জাহাজে চাকরী করতে সাতার জানা লাগবে কেন? জাহাজের মানুষেরা কি জাহাজে থাকে না কি সাগরে ভেসে থাকে?
না বাবা, আমার ও চাকরীর দরকার নেই! আমার দাদাও জাহাজে চাকরী করেছে আমি জানি সব।
কি বলেন মা, এখন দেশের এই অবস্থায় এমন একটা চাকরীর সুযোগ হাত ছাড়া করা কি ঠিক হবে?
না, বললাম তো আমার ও চাকরীর দরকার নেই।
আচ্ছা ঠিক আছে আব্বা আসুক দেখেন আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেন আব্বা কি বলে।
জেমস ফিনলে ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে জানিয়েছে তোমাকে একটা ব্রিটিশ পতাকা বাহী জাহাজে ডেক ক্যাডেট হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। স্থান কাল বেতন সহ সব কিছু উল্লেখ করে নিয়োগ পত্রের শেষ প্যারায় বলেছে তুমি যদি উপরোক্ত প্রস্তাবে রাজী থাক এবং দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে আপত্তি না থাকে তা হলে অপর পাতায় বর্ণিত শর্ত মেনে এই চাকরী করতে চাইলে আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে আমাদের অফিসে সাক্ষাত কর। শর্তাবলী যাই থাক বেতনের কথা আর লন্ডনে যেয়ে জাহাজে জয়েন করার সুযোগ দেখে নিশাতের মাথা খারাপ হবার দশা। খুশীতে আত্মহারা। ইংরেজ জাত যতই সভ্য হোক ওরা কাউকে আপনি বলতে জানে না। সে যাই হোক। চিঠিতে যে সব শর্তাবলী রয়েছে তাতে আপনি আর তুমিতে কিছু যায় আসে না। তারপর এক লাফে দেশের বাইরে এবং সরাসরি লন্ডনে, যাবতীয় খরচ পত্র সবই কোম্পানি বহন করবে। তার উপর লোভনীয় বেতন, বেতনের সাথে আবার বেশ কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা। এমন চাকরী হাত ছাড়া করার মত বোকামি এই মূহুর্তে করা কোন অবস্থায়ই উচিত হবে না। মা যতই নিষেধ করুক তাকে রাজী করাতেই হবে!
নিশাত বলল মা তাহলে আমি একটু হাবিবদের বাড়ি থেকে আসি দেখি ওর কি খবর। হাবিবের বাড়ি গিয়ে দেখে হাবিব বাড়ি নেই। হাবিবের বোন হাসি দরজা খুলেছে। হাবিবের কোন চিঠি এসেছে কি না জিজ্ঞেস করলে হাসি বলল হ্যাঁ দাদার একটা চিঠি এসেছে আজ। দেখি, আমাকে একটু দেখাও। হাসি নিশাতকে বসতে বলে ভিতরে গিয়ে চিঠিটা এনে নিশাতকে দেখাল। সেই একই চিঠি নিশাতের কাছে যেমন এসেছে তেমন। খুলে দেখে এতেও ওই একই কথা লেখা।
হাসি, জান এটা কিসের চিঠি?
না ভাইয়া।
চল ভিতরে খালাম্মার কাছে চল এক সাথেই বলি।
এমন সময় খালাম্মা মানে হাবিবের মা নিজেই এলেন। কি রে নিশাত তোকে এত খুশি লাগছে কেন?
খালাম্মা, শুধু আমি না, শুনলে আপনিও খুশি হবেন।
কি ব্যাপার?
হাবিবের একটা চাকরী হয়েছে বিদেশে, আমারও।
তাই নাকি বলিস কি?
হ্যাঁ খালাম্মা এই যে এই চিঠি দেখেন। এতেই সব লেখা আছে। ঐযে সেদিন যে ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসেছি সেই চাকরী!
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৬

এই গানইতো গত নয় মাস ধরে শুনছে কিন্তু আজ যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে, আজ এই গানের সুরে আলাদা একটা আমেজ, আলাদা এক অনুভূতি। আজ যে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে! সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল তখন সারা জীবনের জন্য একটা সোনালী স্মৃতি সৃষ্টি করে থেমে গেল শুধু গানের রেশটা রয়ে গেল। নিশাত উঠে মইন চাচা সহ বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল পিছন থেকে নিরু একটু জোরেই বলল। খেজুর গাছ কাটার সময় আজ হান্নান ভাইকে দিয়ে হাড়িতে এলাচ দিয়ে রেখেছি কাল সকালে এসে রস খেয়ে যাবেন। কাকে উদ্দেশ্য করে বলা তা নিশাত ভালো করেই বুঝল আর বুঝল যুঁই। পিছন থেকে ডেকে যুঁই বলল শুনেছিস, তোর বৌ কি বলল? নিশাতের কানে আজকের এই রাতে যুঁইয়ের কথাটা সুমধুর হয়ে বাজলো। নিরুর চেহারা কেমন হয়েছিলো তা আর মৃদু চাঁদের আলোতে পিছন ফিরে দেখা হয়নি। তবে নিশাতের অন্ধ-দৃষ্টি তা ঠিক অনুমান করে নিয়েছিল। পরদিন আর রাত পোহায় না, হে যামিনী কেন আজ বিদায় নিচ্ছ না তুমি?

দেশ স্বাধীন হলো। নতুন দেশ। নিশাতের বাবা তার ছুটির কাগজ পত্র নিয়ে ঢাকায় এলেন। সাথে নতুন দেশ, নতুন রাজধানী ঢাকা শহর দেখার জন্য নিশাতও এলো। নিশাতের মামার সেই ধানমন্ডির বাসায় উঠল। পরদিন তার বাবা সেক্রেটারিয়েটে গেলেন কি করা যায় সেই উদ্দেশ্যে। ভাগ্য ভালো সেক্রেটারিয়েটে তার কাগজ পত্র দেখে পর দিন থেকে কাজে জয়েন করতে বলে দিল। বাবার চাকরী হয়ে গেল। নিশাত ২/৪ দিন নতুন দেশের রাজধানী শহরে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাবা ঢাকায় রয়ে গেলেন। ফেরার দিন বাবা বলে দিলেন দুই এক মাসের মধ্যে একটা বাসা পেলে তোমাদের নিয়ে আসব, কলেজে ভর্তি হতে হবে। মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করবে বেশি ঘোরা ঘুরি করবে না।

সময় চলে যায়। আকাশে তারা জ্বলে, চাঁদ ওঠে, জোসনা ছড়ায়। আবার সূর্য ওঠে। শীতের সোনালি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। ইছামতী নদী দিয়ে পানি পদ্মায় গিয়ে মিশে আবার সেই পানি পদ্মা থেকে মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মহা মিলনের জন্য মিশে যায়। গ্রামের মেঠো পথ ধরে ঝাঁকা মাথায় হাটুরেরা হাট থেকে নানা সওদা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে। নিশাত পথের পাশে হালটে বসে বসে চেয়ে দেখে। কলই ক্ষেতে নীল ফুল ফোটে, সিম ধরে আবার সেগুলি ফসল হয়ে উঠে। কৃষকেরা মাথায় করে বাড়ি নিয়ে আসে। সোনালী গম ক্ষেতের আড়ালে আবার সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিগন্তে হারিয়ে যায়। দোয়েল, শালিক, ঘুঘু পাখি ডেকে ডেকে বিষণ্ণ দুপুরের মায়া ছড়িয়ে দেয়। এ ভাবেই প্রকৃতি তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়, আমি আছি। সবাই তার নিজস্ব ভঙ্গিতে চলতে থাকে কিছুই থেমে থাকে না। নিশাতের জীবনও থেমে থাকে না। নিরুর সাথে নিয়মিত না হলেও প্রায়ই দেখা হয়। ক্ষণিকের জন্য চারটি চোখে কি যেন এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা হয়। সে কথার মানে অন্য কেউ বোঝে না। তবে এটুক বোঝে যে কিছু একটা আদান প্রদান হলো। এই আদান প্রদানের রেশ কোথা থেকে কোথায় যাবে দুইজনের কেউ অনুমান করতে পারে না।

এক দিন সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরে নিশাত দেখল বাবা এসেছেন। রাতে খাবার পর বাবা বললেন ঢাকায় বাসা পেয়েছেন। তোমরা সবাই আগামী শুক্রবারে চলে এসো। একটু কাগজ আন আমি ঠিকানা লিখে দিই। নিশাত উঠে তার রাফ খাতা আর একটা কলম এনে বাবার হাতে দিলে বাবা ঠিকানা লিখে নিশাতকে বুঝিয়ে দিলেন গাবতলি বাস স্ট্যান্ডে নেমে কি ভাবে যেতে হবে বুঝিয়ে দিলেন। নিশাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কি চিনে আসতে পারবে না কি আমি আসব?
না, আপনাকে আসতে হবে না, আমি যেতে পারব।

ঢাকায় যাবার দিন ঠিক হবার পর থেকেই নিশাতের মনটা বিষণ্ণ, কি জানি কি এক আশঙ্কা। শীতের শেষে প্রকৃতিও যেন নিশাতের মনের সাথে যোগ দিয়েছে। নিরুর বোন যুঁই এর সাথেও তেমন কথা জমে উঠে না, শিহাবের সাথেও খুব একটা দেখা সাক্ষাত নেই বললেই চলে। গাছের সবুজ পাতা সেই কবেই ঝরে গেছে মাঠ ঘাটের সবুজ তাজা ঘাস গুলিও যেন শুকিয়ে হলুদ বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাঁশ ঝাড়ের পাতা গুলি ঝরে গিয়ে কাঠির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারি দিকেই কেমন যেন একটা শুকনো মলিন ভাব। সূর্য ডোবার আগে দিগন্তের রক্তিম আভার সাথে গরু বাছুরের পায়ের ধুলো, রাখালের পায়ের ধুলো, বাড়িতে বাড়িতে কলই গম মাড়ানোর ধুম। পিঁয়াজ খেতের ফুল গুলি শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে আসছে কখন যেন কৃষক এসে তুলে নিয়ে যাবে। বিলের ধারে সকাল বেলা বক পাখি ধ্যানে মগ্ন থাকছে না। রোদের তেজ যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তাহলে কি ওরাও নিশাতের মনের কথা বুঝতে পেরেছে?

যাবার আগে সন্ধ্যা বেলা শিহাবদের বাড়ি এলো। শিহাব বাড়ি নেই, যুঁই বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল কিরে, তোরা তাহলে কালই চলে যাবি? কখন যাবি, আয় ভিতরে আয়। আজ আমাদের খৈ বানিয়েছে, হাট থেকে বাবা দৈ এনেছে একটু খেয়ে যা। ভিতরে নিয়ে বসতে বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। দরজার পাশে এসে দাঁড়াল নিরু। যুঁই একটু পরে এক হাতে দৈ খৈ এর পেয়ালা আর এক হাতে এক গ্লাস পানি এনে নিশাতের সামনে টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল নে খা। আবার কবে আসবি না আসবি তার ঠিক নেই। তোদের বাড়িতে তাহলে কেউ থাকবে না সবাই চলে যাবি?
আর কে থাকবে বল?
বিষণ্ণ মনে যুঁই বলল বাবা মনে হয় আমাকে মানিকগঞ্জের কলেজে ভর্তি হতে দিবে না, কাজেই আমার পড়া শুনা বন্ধ। তুই কিন্তু বাবাকে বলে যাবি অন্তত তুই ঢাকায় যে কলেজে ভর্তি হবি শিহাবকেও যেন সেখানে ভর্তি হতে দেয়। এসব কথার কিছু নিশাতের কানে ঢুকছে কিছু ঢুকছে না। তার মন রয়েছে দরজার ওপাশে। ও কি একটু ভিতরে আসতে পারছে না। মনে একটা সূক্ষ্ম অভিমান এসে ভর করল। কেন? এখন কি আমার ভিতরে যাওয়া সাজে? তাহলে যুঁই কি বলবে? তুমি একটু এ ঘরে আসতে পারছ না কেন? আর কিছু ভাবতে মন চাইল না। কোন রকম খৈ খেয়ে যুঁইকে বলল শিহাব এলে ওকে রাতে দেখা করতে বলবি। বলেই বের হয়ে বাড়ি চলে গেল।

৩।
পরদিন ওরা ঢাকায় চলে এলো। মিরপুর এলাকায়। বাবা যেভাবে ঠিকানা লিখে বলে দিয়েছিলেন সেই অনুযায়ী ঠিক ভাবে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি। গাবতলি নেমে নতুন শহর বলে একটু ইতস্তত লাগছিল তবুও আসতে পেরেছে। নিশাত কলেজে ভর্তি হলো, ছোট ভাই বোনেরা স্কুলে। কয়েক মাস থাকার পর মা এক দিন নিশাতের সাথে পরামর্শ করলেন, পরের বাড়িতে থেকে মাসে মাসে এত গুলি টাকা ভাড়া দিয়ে সংসার চালান কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবছি যদি নিজেদের একটু জায়গা হত তাহলে যেমন তেমন একটু টিনের চাল বেধে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে এই ভাড়ার টাকা গুলি বেচে যেত।
তা হয় কিন্তু জমি কেনার এত টাকা পাবেন কোথায়?
কেন, গ্রামের বাড়িতে আমাদের এজমালি জমি গুলি আছে সেগুলি থেকে আমরা কি পাই ওগুলি বিক্রি করে দিলে যে টাকা আসবে তা দিয়ে হয়ে যাবে।
বেশ ভালো কথা, আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেন কি বলে।

নিশাতের বাবা বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পর হাত মুখ ধুয়ে চা নাস্তা খাবার সময় নিশাতের মা কথাটা তুললেন। শুনে সেও মোটা মুটি সম্মতি জানাল। এবার গ্রামের ওই সব টুকরা টুকরা জমি, পুকুর, বাগানের অংশ যেখানে যা ছিল সব বিক্রি হয়ে গেল। শুরু হলো ঢাকায় জমি খোজার পালা। এক সময় তাও হয়ে গেল। যেখানে ভাড়া থাকত তার কাছেই ছোট এক টুকরো জমি পেয়ে রেজিস্ট্রি ইত্যাদি যা করার তাও হয়ে গেল। নতুন জমিতে কোন রকম কাচা মাটির একটা দোচালা টিনের ঘর। পাশে বাঁশের বেড়ার চাল দেয়া রান্না ঘড় আর কাচা একটা টয়লেট বানানোর কাজ হয়ে গেল। এবার একটা শুভ দিন শুভ লগ্নে তারা নতুন বাড়িতে উঠে পরল। কাচা পাকা যাই হোক নিজেরতো! মাস শেষে ভাড়ার টাকা গুনতে হবে না। বাইরের দিকে আস্তে আস্তে বাঁশের বেড়া দিয়ে ভিতরে কিছু শাক সবজির বাগান করে নিলো। পাশেই একটু খোয়ারের মত করে কয়েকটা মুরগী। এইতো নিজের বাড়ি আর ভাড়া বাড়ির তফাত। এখন থেকে ভাড়াতো দিতে হয়ই না উপরন্তু কিছু শাক সবজী সহ ডিম মাংসের খরচও কমে গেল। যত ছোটই হোক আর যত সামান্যই হোক ঢাকা শহরে নিজের একটু খানি কুটিরের দাম যে কি তা হারে হারে বোঝা যাচ্ছে।

এক দিন সকালে কলেজে যাবার আগে নিশাত বাগানে সবজির যত্ন করছে এমন সময় একটু দূরে খোলা রাস্তায় নজর গেল। দেখল সবুজ শাড়ি পরা এক জন মহিলা আর তার সাথে বাচ্চা কোলে নীল কামিজ গায়ে এক মেয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ চেনা চেনা মনে হলো। আরও একটু কাছে এলে দেখল নিরু আর তার বড় বোন বীণা আসছে। বীণা মাঝে মাঝেই আসে। কাছেই বাড়ি। পাশে যখন ভাড়া বাড়িতে থাকত তখনও এসেছে কয়েক বার। কিন্তু সেই আসা আর আজকের আসার মধ্যে কোথায় যেন একটু পার্থক্য মনে হলো নিশাতের কাছে। আজ যেন এক ভিন্ন সুর বেজে উঠল নিশাতের মনে।

বিশ্বে প্রতিনিয়ত কত কিছুই ঘটে যাচ্ছে তার সব কিছু মনের চোখে সব সময় ধরা পরে না। আবার অনেক কিছু আজ যে রকম মনে হয় সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথেই ভিন্ন জনের কাছে ভিন্ন ভাবে ধরা দেয়। সময়, কাল, স্থান ভেদে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এ ও ভালো। এক ধরনের বৈচিত্র্য। প্রকৃতি যেমন খেয়াল পাল্টায় ঋতু বদলায় মানুষের মনও তেমন। আজকে যা ভালো লাগছে কাল তা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছে না। শুধু পার্থক্য এ টুক যে ঘড়ির কাটা মহা কালের সাথে মিলনের জন্য বার বার ঘুরেই চলেছে। দক্ষিণ মেরু থেকে অনেক বাতাস উত্তর মেরুর দিকে বয়ে গেছে। পৃথিবীতে অনেক ক্ষুধা তৈরি হয়েছে।

বীণা নিরুকে নিয়ে নিশাতদের বাড়িতে এসেছে। চাচীর সাথে দেখা করার জন্য। গতকাল নিরু এসেছে গ্রামের বাড়ি থেকে। ওকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে। নিরুর স্কুল বন্ধ হলেই একটা দিনও দেরি না করে সোজা বড় বোনের কাছে এসে কাটিয়ে যায়। নিরু গ্রাম থেকে আসার সময় এই এটা ওটা যা গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে আনতে হয়, ক্ষেতের কিছু মটর শাক, ধনে পাতা, কলার মোচা, গাছের কিছু ফল মুল, কাচা আম, কিছু আম সত্ত্ব, নারকেলের লাড়ু, গাছের পাকা কুমড়োর মোরব্বা যা কিনা মা নিজে বানিয়েছে, কয়েকটা গাছ পাকা কত বেল। ঢাকা শহরে কি আর গাছ পাকা কত বেল পাওয়া যায়! যা পায় সব জাগ দেয়া। যা খেয়ে বড় হয়েছে সেই ছোট বেলায় যা নিয়ে মন কষা কষি হয়েছে, যা নিয়ে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে সে দিন গুলির স্মৃতি কি মনে পড়ে না? সেই বাড়ির ঘাটের নয়তো চৌরাস্তার ছবি, সেই গন্ধ আবার পিছনে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে না? তাই আসার আগে মা পোটলা বেধে এগুলিও দিয়ে দেয়। বীণা আবার তাই কিছু চাচীর জন্যে নিয়ে এসেছে। চাচীও ওগুলি পেয়ে বেশ খুশি।
মা সিঙ্গারা বানালেন, রান্না ঘরের পাশে পিঁড়িতে বসেই চা সিঙ্গারার পালা শেষ। মা বায়না ধরলেন নিরুকে নিয়ে এসেছিস আজ দুপুরে এখানে খেয়ে যাবি, কবির আসবে সেই সন্ধ্যায় কাজেই আর চিন্তা কি? বাড়িতে ভাড়াটিয়ারা আছে। অকাট্য যুক্তি দেখালেও প্রথমে বীণা আপা একটু আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেল। নিশাতের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে নিশাতকে একটা মুরগী বের করতে বলে কলেজে যাবার তাগিদ দিলেন। নিশাত আস্তে করে বলল আজ কলেজ বন্ধ।
বন্ধ! তখন যে বললি তাড়াতাড়ি যাবি!

বলেছিলাম না কি! কি জানি ভুলে বলেছি মনে হয়। আচ্ছা থাক কলেজে আজ যেতে হবে না তার চেয়ে মুরগীর খাঁচার বেড়া গুলি জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে গেছে ওগুলি ঠিক করি কাজে লাগবে। মুরগী বেরিয়ে যায় ধরে আনতে আপনার কষ্ট হয়।
মা কি বুঝলেন তা নিশাত জানে না তবে মা আর চাপা চাপি করেননি। নিশাত একটা মুরগী বের করে পাশের বাড়ির কালামকে ডেকে জবাই করে মার হাতে এনে দিয়ে ঘর থেকে সাড়াশি গুনা তার এনে আবার লেগে গেল খোয়ার ঠিক করার জন্য। মন কাজে ছিল না। হাত দুটাই শুধু নেট বাধার কাজে উঠা নামা করছে। এক সময় পিছনে চেনা পায়ের শব্দ শুনে ফিরে দেখে নিরু এসে দাঁড়িয়ে তার মুরগীর খামার দেখছে। নিশাতকে পিছনে তাকাতে দেখে নিরু বলল বাহ্ বেশ সুন্দর! এক এক করে মুরগী গুলি গুনে দেখে বলল পনেরটা! নিশাত পিছনে তাকিয়ে বলল তুমি আবার এখানে কেন, যাও তোমার চাচীর কাছে গিয়ে বস। এ কথা শুনে নিরু আর একটা মুহূর্ত দেরি না করে চলে গেল। মনে বিষাদের করুন সুর বেজে উঠেছিল। সেদিন ঢাকায় আসার সময় একটু দেখা দিয়ে আসতে পারনি আজ আমি নিজে এসেছি কোথায় দুটি কথা বলবে তা না করে বলে কি না যাও চাচীর কাছে যাও। আমি কি চাচীর কাছে এসেছি? আমি এসেছি শুধু তোমাকে একটু দেখতে। তুমি কেন বুঝলে না। নিশাত আবার পিছনে ফিরে ওকে দেখতে না পেয়ে কেমন যেন বিদিশা হয়ে গেল। এ কি করলাম যার জন্য কলেজে গেলাম না তাকে এ কি বললাম! কি হে নিশাত! তুমি কোন ধরনের মানুষ? এ যে তোমার প্রথম প্রেম তা কি বুঝতে পারছ না? ওদিকে নিরু এসে সেই যে চাচীর কাছে বসল যতক্ষণ ও বাড়িতে ছিল ততক্ষণ কারো সাথে আর একটি কথাও বলে নি।
[চলবে]