মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট

মোঃ খালিদ উমর সম্পর্কে

কুয়াশা ঢাকা মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা!

সোনালি দিনের সোনালি ঈদ

জীবনে যে কত দেশের কত শহরে ঈদ করেছি সে অনেকের কাছে বিস্ময় বলে মনে হবে। এর মধ্যে একটা মজার ঘটনা বলি। ঈদের আগের দিন জাহাজ দুবাই এসেছে, গেটের বাইরে এসে দেখি কাছেই ঈদ গাহ। বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলাম কাল তা হলে এখানে ঈদের নামাজ পড়ব। সকালে উঠে যথারীতি গোসল করে কাপড় চোপর পরে চলে এলাম মাঠে কিন্তু কোন প্রাণীর চিহ্ন নেই, নেই, নেই। কি ব্যাপার? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মহসীন বলল চল গেটের সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করে দেখি কখন জামাত হবে। সিকিউরিটি বির দর্পে জানাল আরে তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছ? জামাত তো ফজরের নামাজের পরেই হয়ে গেছে এখানে ঈদের নামাজ পড়তে চাইলে কোরবানির ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে যাও যাও জাহাজে ফিরে যাও। সবাই মনে একটু দুঃখ নিয়ে জাহাজে ফিরে এসেছিলাম। এছাড়া করাচী, বাহরাইন, ইরান, অক্সফোর্ড, গ্লস্টার, বার্মিংহাম, লেস্টার, লন্ডন, কার্ডিফ, নিউক্যাসেল, চট্টগ্রাম, খুলনা, মংলা, ঢাকা অন্তত এই শহর গুলিতে ঈদ করেছি বলে এই মুহূর্তে মনে পরছে।

আমার ছেলেবেলার ঈদ নির্দিষ্ট কোন শহর বা এলাকায় কাটেনি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন বলে তাকে বিভিন্ন সময় দেশে বিদেশের নানা যায়গায় থাকতে হয়েছে বলে সেসব জায়গায় ঈদ করেছি। মানিকগঞ্জের ঝিটকার পাশে আমাদের নিজ গ্রামে নিজ বংশের আত্মীয় স্বজনের সাথে এবং ধামরাইর পাশেই নানা বাড়িতেও কয়েক বার ঈদ করার সুযোগ পেয়েছি।

তখনকার ঈদ এবং আজকালের ঈদের মধ্যে কোথায় যেন একটু ভিন্নতা লক্ষ করি। তখন ছিল নিছক অনাবিল আনন্দের ঈদ আর আজকাল কেমন যেন পোশাকি একটা অনুষ্ঠানের মত মনে হয়। তখন আমরা যে আনন্দ পেয়েছি তা আজ কাল ছেলে মেয়েরা পায় কিনা বলতে পারব না। তবে এমনও হতে পারে যে আজকাল ঈদের বা অন্য যে কোন আনন্দের সংজ্ঞা ও বদলে গেছে যা আমি বুঝতে পারিনি।

তখন আমার বাবা এমন কোন চাকরী করতেন না যে তিনি প্রতি ঈদেই নতুন জামা কাপড় দিতে পেরেছেন। পুরনো যা আছে দেখেছি মা তাই সুন্দর করে ধুয়ে কয়লার ইস্ত্রি দিয়ে ইস্ত্রি করে নামাজ পরতে যাবার সময় গায়ে দেবার জন্য তুলে রাখতেন।এ নিয়ে আমাদের কখনো মাথা ঘামাতে হবে এমন করে ভাবতে শিখিনি। শীত কালে ঈদ হলে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম গোসলের জন্য মা পানি গরম করে রেখেছেন। আগেই কিনে আনা সুগন্ধি সাবান নিয়ে বাবা আমাদের ভাই বোনদের একে একে নিয়ে বাথ রুমে ঢুকতেন আর ডলে ডলে গরম পানি, সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিতেন। গোসল হলে মা আবার ওই সব কাপড় গায়ে দিয়ে আতর মেখে দিতেন।

ওই সময়ে আমাদের ঈদের আনন্দ শুরু হতো রোজার শুরু যেদিন হতো সে দিন থেকেই। বাড়িতে মায়ের কোন সাহায্যকারী ছিল না এমনকি আমার কোন বড় বোনও ছিল না তাই মাকে সাহায্য করতে হতো আমাকেই। অন্যান্য ভাই বোনেরা বেশ ছোটই ছিল।

তখন আবার এখনকার মত চাকুরী জীবী দের উৎসব ভাতা বলে কিছু ছিল না যা দিয়ে ঈদের বাড়তি খরচ মেটাতে পারতেন। তখন যা পেতেন তা হচ্ছে যে মাসে ঈদ হচ্ছে সেই মাসের বা তার পরের মাসের অগ্রিম বেতন। যাই হোক বাবাকে দেখেছি যে বছর আমাদের জন্য নতুন জামা জুতা কিনবেন তখন দাম বেড়ে যাবার আগেই রোজার শুরুতে আমাদের সাথে নিয়ে বাজার থেকে কাপড় কিনে আনতেন আর তাই কেটে মা নিজে সেলাই করে নিতেন। মেশিনে সুতা লাগিয়ে দেয়া বা কোন সেলাই ভুল হলে তা খুলে দেয়ার কাজটা মা আমাকে দিয়েই করাতেন। ফলে যা হবার তাই হল। আমি নিজেও এক সময় মার মত কেমন করে যেন কাপড় চোপর কাটি কুটি থেকে সেলাই করা সব শিখে ফেললাম। মা যখন ফিতা ধরে গায়ের মাপ নিতেন তখন থেকেই নতুন কাপড়ের গন্ধ মাখা একটা রোমাঞ্চ অনুভব করেছি। আবার কিছুটা সেলাই করে গায়ের সাথে মিলিয়ে মা দেখে নিতেন সেই তখন থেকেই অস্থিরতায় থাকতাম কখন সেলাই শেষ হয়ে জামাটা আমার গায়ে লেগে যাবে। যে দিন মায়ের সেলাই, বোতাম লাগান, বোতামের ঘর কাটা সব শেষ করে গায়ে দিয়ে পরখ করতেন ঈশ তখন যে কি আনন্দ পেতাম তা আজ এই বার্ধক্যের প্রথম প্রান্তে এসে এখনও ভুলতে পারি না। সেলাইর প্রতিটা ফোঁড়ে মায়ের স্নেহ আর যত্নের ছোঁয়ার কি কোন তুলনা হয়? মায়ের নিজে সদ্য তৈরি করা জামা বা প্যান্ট ঠিক ভাবে গায়ে লেগে গেছে দেখে মায়ের মুখের মধুর তৃপ্তি মাখা মৃদু হাসিটা আজও ভুলতে পারি না।

মার ঐ শিক্ষা থেকে আমিও আমার মেয়েদের জন্য এই ব্যবস্থা করেছি। আমার স্ত্রীও এমনি করে নিজের সন্তানদের জন্য নিজে হাতে পোশাক বানিয়ে দিত যখন ওরা ছোট ছিল। কাপড় সেলাই হলে তাতে নানা রকম হাতে কাজ করা এমব্রয়ডারি বা ফেব্রিক পেইন্ট দিয়ে আবার এক ধাপ সাজ সজ্জা। দেখতে বেশ লাগত। সেই রেশ ধরে আমার মেয়েরা সেদিন বলছিল আব্বু যতই যা কিনে দাও না কেন সেই যে তুমি আর মা মিলে আমাদের জামা কাপড় বানিয়ে দিতে সে গুলি গায়ে দিয়ে যে আনন্দ পেতাম আজকাল এত দামের এই সব কাপড় গায়ে দিয়েও আর তেমন আনন্দ লাগে না। মেঝ মেয়ের এই কথা শুনে বড় এবং ছোট মেয়ে এক সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠেছিল হ্যাঁ আব্বু মেঝ ঠিক বলেছে!! শুনে কেন যেন আমার চোখ দুটি ভিজে এসেছিল সাথে সাথে ওদের তিন বোনকেই বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম।

আজকাল দেখি যুগের পরিবর্তনে বাবা মা ছেলে মেয়েদের সাথে নিয়ে তৈরি পোশাকের দোকান ঘুরে ঘুরে নামি দামি কোম্পানির লেবেল আটা পছন্দের কাপড় বেছে চড়া দামে কিনছে। এতে আর যাই হোক মায়ের ছোঁয়া মাখা মমতার স্পর্শ কি পায় আজকের এই ছেলে মেয়েরা?আনন্দের প্রথম পশলার ঘাটতি তো এখানেই থেকে যাচ্ছে। এ কথা ভাবার সুযোগ কি হয় যে ঈদের আনন্দের প্রথম অনুভব মায়ের স্পর্শ আমার সাথেই আমার গায়ে লেগে রয়েছে? নাকি দামী ফ্যাশন কোম্পানির লেবেল লাগানো পোশাক মায়ের বিকল্প স্বাদ দিতে পেরেছে জানি না।

এর পর আসছি খাবার দাবারে। রোজার শুরু থেকেই মাকে দেখতাম সামান্য একটু করে ময়দা মেখে হাতে নিয়ে চিমটি কেটে দুই আঙ্গুলে ডলে জিরার আকারে এক রকম সেমাই বানাতেন আমাদের মানিকগঞ্জের ভাষায় এই সেমাইর নাম যব দানা। অবসরে বেশ কয়েক দিন ধরে বানিয়ে জমা করে রোদে শুকিয়ে কাচের বয়াম ভরে রেখে দিতেন। ঈদের দিন সকালে এই যব দানা ঘিয়ে একটু ভেজে সেমাইর মত কি করে যেন রান্না করতেন। আমার খুবই প্রিয় সেমাই ছিল এটা। সারা রোজা ভরে পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়িতে ইফতার বিলি করতেন আর সেই ইফতার সাজান খঞ্চা বা ট্রে মায়ের হাতে সুন্দর কাজ করা একটা পর্দা দিয়ে ঢেকে আমার হাতে দিয়ে বলে দিতেন যা এটা ওদের বাড়ি দিয়ে আয়। এ ভাবে এক এক করে এলাকার প্রতিটা বাড়িতেই দেয়া হত। মাঝে মাঝে এর মধ্যে আমার বিশেষ বন্ধুর বাড়িতে আগে বা একটু বিশেষ আয়োজন করে দেয়ার জন্য আমি আবার বায়না ধরতাম। আবার ওই সব বাড়ি থেকেও একেক দিন বা কোন দিন এক সাথে কয়েক বাড়ি থেকেও ইফতার আসত।

আবার বাবার কলিগ বা আমার বন্ধুদের বন্ধুদের বাবা ইফতার করার জন্য দাওয়াত করতেন তাদের বাড়ি যেতাম। আমাদের বাসায় ও তারা আসতেন। এই দিন গুলিতে ছিল আনন্দের আর এক মাত্রা। তবে একটু দূরে কোথাও হলে তারাবীর নামাজে উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে বাবা দূরে কোথাও যেতে চাইতেন না।

রোজার শেষ দিনে ইফতারি করেই বের হতাম বাসার বাইরে বন্ধুদের সাথে চাঁদ দেখতে। চাঁদ দেখা গেলে সে কি আনন্দ চিৎকার! চিৎকার করতে করতেই বাসায় আসতাম, “মা মা চাঁদ দেখেছি, কাল ঈদ হবে” কই দেখি বলে মা বাবাও বের হতেন। চাঁদ দেখেই বাবা ব্যাগ নিয়ে বের হতেন বাজারে। সাথে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতেন। মাংস, চাউল, সেমাই, বাদাম ইত্যাদি নানা কিছু যা যা মা একটা লিস্টে লিখে দিয়েছেন তাই দেখে লিস্টের সাথে মিলিয়ে বাবা এক এক করে কিনে নিতেন।

ফিরে এসে দেখতাম সারা মহল্লায় নানা জাতির পরিবারে নানা রকম মশলা বাটার ধুম। তখন আবার এখনকার মত ঘরে ঘরে ফ্রিজ নামের ঠাণ্ডা আলমারি ছিল না। আদা, রসুন সহ নানা মশলার গন্ধে বাসায় ঈদ শুরু হয়ে যেত এখন থেকেই। অনেক রাত অবধি মা নানা পদ রান্না করে রাখতেন। আমিও পাশে বসে থাকতাম। মা কে এটা ওটা এগিয়ে দিতাম কিংবা অন্তত ছোট ভাই বোনকে সামলাতাম। সে যে কি আনন্দ তা কি আর শুধু ভাষায় প্রকাশ করা যায়? এ যে শুধুই অনুভবের, একান্ত হৃদয়ের গভীরের অনুভূতি। মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের ঝিলি মিলি মাখা আনন্দ কি আর কিছুতে পাওয়া যায়? সে যে এক স্বর্গীয় আনন্দ।

ঈদের সকালে সেমাই, ক্ষীর বা পায়েস বা ফিরনি আর গরুর মাংস এবং খিচুড়ি খেয়ে নামাজে যেতাম। নামাজ পরে এসে দেখতাম মা সব রান্না বান্না শেষ করে গোসল করে নতুন শাড়ী থাকলে তাই পরে থাকতেন। এসেই আগে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বাবাকে সালাম করতাম পরে বাবার সাথে ভাইয়ের সাথে কোলা কুলি। এবার বাবা কিছু টাকা দিতেন সারা দিন ধরে ইচ্ছে মত খরচ করার জন্য। নামাজের মাঠে সবার সাথেই কোলাকুলি করে এসেছি।

নামাজ সেরে এসে আবার পোলাও মাংস খেয়ে বের হতাম মহল্লায় সব বাসায় চাচিদেরকে সালাম করতে। সেখানেও কিছু খেতে হত। সারাটা দিনই বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি এটা ওটা দেখা। দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে চোখে ঘুমের রেশ নিয়ে বাসায় ফিরে এলে মায়ের এক পশলা মিষ্টি বকুনি হজম করে বাথরুমে ভরা বালতিতে দাঁড়িয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে মায়ের আঁচল দিয়ে হাত মুখ মুছতাম। মা আবার আর এক দফা বকে রাতের খাবার আয়োজন করতেন। রাতে সাধারণত বিরিয়ানি হতো। এটাই ছিল তখনকার আমাদের বাড়িতে আমার মার তৈরী ঈদের মেনু যা আজও আমি টিকিয়ে রেখেছি। তবে আমার মেয়েরা যে এর ব্যতিক্রম কিছু করে না তা কিন্তু নয়। এ ব্যাপারে ওদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছি। ওরা যা করে আনন্দ এবং গর্বের সাথেই তা খাই।

সারা দিন বাসায় কে এলো বা মা বাবা কোথায় গেছেন কিছুই জানতাম না। বাবা, ছোট ভাই বোন সবাই মিলে খেয়ে দেয়ে সাথে সাথেই এত কাঙ্ক্ষিত মহা আনন্দের ঈদের সমাপ্তি ঘটিয়ে বিছানায় শুয়ে পরতাম। সারা দিনের ফিরিস্তি ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরতাম কিছুই টের পেতাম না।

আজ এই এত দিন পরে এসে ভাবি আহা অমন ঈদ যদি আমাদের ছেলে মেয়েরা দেখতে পেত!!

আমরা কি সত্যিই ঈদে পরিপূর্ণ আনন্দ পাই?

ঈদ মানে আনন্দ বা খুশী। নানা ভাবে মানুষ আনন্দ পায়। শুধু মানুষ কেন প্রকৃতির যে কোন প্রাণীই আনন্দ, দুঃখ কষ্ট, ব্যথা বেদনা ইত্যাদি অনুভব করে। এর নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। কে কিসে আনন্দ পাবে তা সে নিজেও সঠিক জানে না। স্থান, কাল, পাত্র, সমাজ, সামাজিক অবস্থান, পরিবেশ বা পরিস্থিতির এদিক ওদিকের কারণে নানা জনের আনন্দের সংজ্ঞা ভিন্নতা পেয়ে থাকে। কেউ আনন্দ পায় ভোগ করে কেউ পায় ত্যাগ করে।

কেউ আনন্দ পেতে চায় একা একা কেউ আবার সবাইকে সাথে নিয়ে। যদিও আনন্দ করতে হয় সবাইকে নিয়ে আর দুঃখ করতে হয় নীরবে বা একা একা।

ঈদের আনন্দ মানে রমজানের শেষে সারা মাস সিয়াম সাধনা করে সবাই মিলে ভাল পোশাক পরে ভাল খাবার খেয়ে সুন্দর পরিবেশে সব শত্রুতা, মারামারি, হিংসা বিদ্বেষ ভুলে আনন্দ করা। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা পারা প্রতিবেশীর সাথে কিছু সময় কাটানো থেকে কার বাড়িতে কি রান্না করেছে মজার সে সব খেয়ে এবং তার তারিফ করে। এই তারিফ করার মধ্যেও কিন্তু একটা মেকী ভাব অনেক সময় থেকে যায় যা আমরা অনেক সময় লক্ষ করিই না।

ইদানীং দেখছি রমজানের শুরুতেই বা এর আগে থেকেই শুরু হয় কে কোন কোন ধরনের পোশাক বানাবে এবং কি কি রান্না করবে তার এক বিশাল ফর্দ তৈরি হয়ে যায়। কাকে নিয়ে কোথায় বেড়াতে যাবে, কি করবে এই সব নিয়েই ব্যস্ততা এবং অনেক সময় মান অভিমানের মহড়া চলতে থাকে। অনেকে আবার দেশের বাইরে কোথাও চলে যান বেড়াতে। যেখানে না হয় ঈদের নামাজ আদায় করা, না পাওয়া যায় নিজ দেশের ঈদের চিরাচরিত সনাতনী আবহ বা নিজের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব পাড়া প্রতিবেশীর দেখা। ঈদের অর্ধেক আনন্দতো এখানেই নেই হয়ে গেল, তা হলে কি আনন্দ করলাম বুঝি না। অথচ পত্রিকায় নানান ট্রাভেল এজেন্সির নানা রকম চমকদার বিজ্ঞাপন দেখি। সিঙ্গাপুর, নেপাল, থাইল্যান্ড ইত্যাদি নানা জায়গায় যাবার আমন্ত্রণ থাকে তাতে। অবশ্যই অনেকে এমন যেয়ে থাকেন বলেই এই সব বিজ্ঞাপন দেখা যায়। আবার এর বিপরীতে অনেকেই বিদেশ থেকেও তার প্রিয় জনের আসার অপেক্ষায় থাকে। বিদেশেও ওই সময় এয়ারলাইন্সের টিকেটের দাম বেড়ে যায়।

অনেক অমুসলিম দেশে দেখেছি যারা উৎসব বলতে পান করে মাতাল হয়ে পরে থাকাকেই বোঝায়। আমি একবার জরিপ করে দেখেছি কে কতটা পান করেছে। তাতে শুনেছি এক জনে এক ক্রিস্টমাসে ৬৩ পাইন্ট (প্রায় ৩০ লিটার) বিয়ার পান করেছিল। ওদের দেশে এমনটাই হয়ে থাকে। সাধারণ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অর্থাৎ শুক্রবার ও শনিবার রাতে মাতাল হয়ে যখন অসুস্থ হয়ে পরে তখন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়। সমস্ত দায় যেন সরকারের। ওই দুই দিন পুলিশ এবং এম্বুলেন্সের ডিউটি বেড়ে যায়। ইদানীং এ ধরনের উল্লাস নিরুৎসাহিত করার জন্য আইন করে মাতালের চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছে বলে শুনেছি। যাই হোক এরা যা ইচ্ছে তাই করুক আমরা যেহেতু ওই ধাঁচের নই কাজেই আমার বক্তব্য ওদের নিয়ে নয়।

এই যে এত কিছু, এতে কি সত্যিকারে আনন্দ পাওয়া যায়? ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। এই মহা বাক্য সামনে রেখে আমরা আনন্দ যাপনের, উৎসব উদযাপনের কোন ভিন্ন সংজ্ঞা রেখে যাতে পারি কি না সেই ভাবনাই ভাবছি। নানা ছল ছুতায় আমার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে দেশের বাইরে। এইতো প্রায় দশ বছর একটানা বিদেশে কাটিয়ে গত বছর দেশে ফিরেছি। আর ফেরার দুই এক মাস পরেই রমজানের ঈদ। দেশের অবস্থা দেখে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সাথে বাজার দরের তারতম্য দেখে মনে একটু দ্বিধা নিয়ে নেহায়েত এত দিন পর নিজের সন্তানদের তাদের বাবার সাথে ঈদের আমেজ নষ্ট করতে না দিয়ে তাদের স্বাভাবিক চাহিদানুযায়ী ঈদের বাজার করতে বাজারে যেয়ে অনেক দিন আগের এক ঈদের কথা মনে পরে গেল। কেনাকাটা বন্ধ রেখে ওখানেই এক পাশে দাঁড়িয়ে সন্তানদের সেই দিনের গল্প বললাম-

বেশ অনেক বছর আগে আমার এক দরিদ্র আত্মীয়ের বাড়িতে তাদের সাথে ঈদ করতে হয়েছিল এবং সেই ঈদে ও বাড়ির সবার তাদের নিজ পছন্দ মত কাপড় চোপর সহ ঈদের দিনের সব রান্নার বাজার আমি করেছিলাম। দুই দিন আগে ওদের নিয়ে ঢাকার এক মার্কেটে এসে ওদের পছন্দের কাপড় কিনেছিলাম। ওরা প্রথমত বুঝতে পারেনি কি হতে যাচ্ছে। ওদের যখন যার যার পোশাক বাছাই করতে বললাম ওরা বেছে বেছে কম দামের কাপড় বাছাই করছিল দেখে ধমক দিয়ে বলেছিলাম ওগুলি দেখছ কেন? তোমার যা ভাল লাগে, যা সুন্দর লাগে তাই দেখ। শুনে ওদের মধ্যে যে বড় সে একটু আমতা আমতা করে বলেছে, এত দাম! দাম তাতে তোমার কি? তোমাদের যার যা পছন্দ হয় তাই দেখ, টাকা আমি দিচ্ছি। মেয়েদের চুলের ফিতা, ক্লিপ, মেক আপ ইত্যাদি সহ জুতা স্যান্ডেল কিছু বাদ দিইনি। সেদিনের সেই ঈদে ওই বাড়ির ছেলে মেয়েদের আনন্দ মাখা চেহারা দেখে আমার মনে এক স্বর্গীয় অনুভূতি এসেছিল যা আমি আমার সারা জীবনে কোন কিছুতেই পাইনি। এই আনন্দ ওরা সমস্ত জীবনেও দেখেনি, ঈদে যে নতুন কাপড় পরতে হয় তা তারা এই প্রথম আবিষ্কার করেছিল এবং ঈদের দিন নিজ বাড়িতে মাংস পোলাও, বিরিয়ানি, সেমাই রান্না করা যায় তাও ওরা ওই প্রথম দেখেছে। প্রায় ১৫/১৬ বছর আগের হলেও আজও সে কথা মনে এলে সেই অনুভূতি চোখ বেয়ে দু’ফোটা হিরের টুকরোর মত ঝরে পরে। আমার এই গল্প যদিও আমার সন্তানেরা জানে তবুও সময়ের ব্যবধানে সেদিন যেন আবার নতুন করে ওরা অনুভব করতে শিখল। দুই মেয়ে এক সাথেই বলে উঠল “আব্বু আমাদের জন্য কিছু লাগবে না। আমাদের অনেক আছে, তুমি ওদের জন্য কেন”। শুনে আমার চোখ বেয়ে আবার সেই অনুভূতি ঝরছিল দেখে আমার ছোট মেয়ে ওড়নার আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে মার্কেটের ভিতরে নিয়ে সেই ওদের জন্য কেনাকাটা করেছিল। নিজ সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পেরেছি দেখে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।

আমাদের মধ্যে যাদের সঙ্গতি আছে সেই আমরা আমাদের জীবনে অন্তত একটিবার কি এমন করতে পারি না? কারো জীবনে যদি অন্তত একটি ঈদের আনন্দ পেতে হাত দুটি বাড়িয়ে দিতে পারি মন্দ কি?

পশুত্ব না কী মনুষত্ব


(কুকুর চরিত্র)
আমাদের চারিদিকে প্রতিটি সেকেন্ডে ঘটে যাচ্ছে অসংখ্য ঘটনা প্রবাহ যা আমাদের পক্ষে নিতান্ত দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা যা সংবাদপত্র, রেডিও, কিংবা টেলিভিশন ছাড়া কিছুই জানা হয় না। কিংবা অগত্যা আমাদের নিজেদের চোখের সামনে ঘটে গেলেই কেবল জানতে পারি। এই বিশাল পৃথিবীর আনাচে কানাচে কত কি রয়েছে।

যেমন, কোন জাতি কি খেয়ে জীবন ধারণ করছে কিংবা কেমন পোশাক পরছে, কেমন ঘরে বসবাস করছে, কে কোন বিচিত্র পেশায় দিন কাটাচ্ছে এগুলির কতটুকু আমরা জানি বা জানতে চাই।

এ ছাড়াও এমন কিছু মানুষ রয়েছে তারা না মানুষ, না রোবট নাকি কোন অবাক করা পূর্বে না দেখা জন্তু তা বোঝা কঠিন। তারপরে কে এক বেলা এক মুঠ ভাতের জন্য দৌড়ে বেড়াচ্ছে আবার কেউ পোলাও বিরিয়ানি ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে সে হিসেব রাখাও কঠিন ব্যাপার। খবরের কাগজ খুললে প্রায়ই দেখা যায়, প্রায়ই বলছি কেন এ তো নিত্য দিনের কথা, দুই টাকার জন্য বা এক কাপ চায়ের জন্য কিংবা সামান্য একটা পেন্সিলের জন্য যুবক বা চাচা খুন। পশুর কাছেও কত কি রয়েছে যা আমরা এখনো শিখতে পারিনি। পশুরা যদি আমাদের ভাষা বুঝতে পারত তাহলে ওরা আমাদের কি ভাবত? আমাদের মধ্যে যারা নিজেদের মানুষের বাইরে বড় লোক, ছোট লোক, ভদ্র লোক, চাষা, বস্তিবাসী নামে বিভিন্ন শ্রেণী করে রেখেছে তারা নিজেরা কি তা কি কখনো ভেবে দেখেছে? শুনে খুশী হবেন যে আমিও ভাবিনি। আমি যে ভাবিনি তা কি বিশ্বাস করেছেন? আরে ধুর তাই কি হয়? আমি যদি নাই ভাবতাম তাহলে এই এত আয়োজন করে কি আর এই লেখা ধারাবাহিক ভাবে লিখতে বসতাম? নিশ্চয়ই ভাবছি এবং নিজে ভেবে ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছি না বলে আপনাদের সাথে নিয়ে জড়াতে চাইছি। সে কথা হয়তোবা এতক্ষণে আপনাদের বুঝতে বাকি নেই।

আমরা নানা সময়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে নানা কিছু প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কত কিই ভেবে থাকি যা বয়ে যাওয়া নদীর স্রোতের মত আসে আবার কোথা দিয়ে চলে যায়। তারই দুই একটা কথা কখন মনে একটু দাগ কেটে যায় আবার কখনো তার কোন প্রভাব পরে না। বা নিতান্ত হেয়ালী ভেবে উড়িয়ে দিই, মনে রাখার চেষ্টা করি না। তাই বলে কি তার মধ্যে কোন গুরুত্ব পূর্ণ ভাবনা থাকে না? অনেক সময় কি অপ্রয়োজনে প্রয়োজনীয় প্রসংগ ত্যাগ করি না? নিজের অজান্তেই কত কি মানিক রতন এভাবেই হারিয়ে ফেলি।

এইতো গেল ভূমিকা। তাহলে এখন বলবেন কি দিয়ে আজ এই প্রবাহ শুরু করি?

আচ্ছা ঠিক আছে আমি বলছি আজ কেন যেন হটাত করে আমার দেখা এক মহান পুরুষের কথা মনে পরে গেল তাই তার কথা দিয়েই শুরু করছি। তবে একটা কথা যা আপনারা ভাবতেও পারছেন না সেটি হচ্ছে এই মহান পুরুষটি কিন্তু কোন মানুষ নয় ইনি একজন কুকুর। হ্যাঁ সত্যিই বলছি আমরা সবাই এদের প্রজাতিকে এই নামেই চিনি।

আজ থেকে প্রায় বছর ১২ আগে ঢাকা থেকে মাত্র ১৭ কিমি দূরে সাভারে আমাদের একটা বিশাল খামার ছিল। ওখানে পশু পাখি সহ নানা জাতের সবজি, ফুল এবং অনেক কিছু উৎপাদন হতো। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে যা অবসিস্ট থাকত তাই আমাদের এবং আমাদের প্রতিবেশীদের জন্য যথেষ্ট ছিল। জানি না কোথা থেকে যেন পাঁচটা কুকুর পালা করে ওখানে থাকত। অর্থাৎ কেউ আসত আবার কেউ চলে যেত কিন্তু তাদের দল থেকে কখনই পাঁচটার কম দেখিনি। তারা রাতে তো পাহারার কাজ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতই এমনকি আমাদের যে রাতের পাহারাদার ছিল তার সাথে সুশৃঙ্খলিত ভাবে যোগাযোগ রেখে কাজ করত। যে রাতে ঘুম আসতে দেরি হত সে রাতে যতক্ষণ জেগে থাকতাম ওদের সাথেই কাটাতাম। ওরা দুই তিন জনে পুরো খামার এলাকা ঘুরে এসে আমার কাছে বসত আবার অন্যরা যারা আমার সাথে ছিল ওরা চলে যেত। এই ভাবে পালা ক্রমে ওদের পাহারার কাজ চলত। কখনো দেখেছি যারা ঘুরে এসেছে তারা এসেই বসে থাকা দলের সাথে কি যেন আলাপ করত। মানে প্রায় নিরব মিটিং এর মত। যার কিছুই আমি বুঝতাম না কিন্তু ওরা নিজেদের কথা কি বুঝত বা বোঝার ভান করত কিনা তা কখনো জানতে পারিনি। ওদের কথা আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না। তবে ওরা যে আমাদের কিছু কথা অন্তত বুঝত তা আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। ওদের যে সর্দার ছিল তাকে আমি ভোলা বলে ডাকতাম। খামার এলাকায় ঢুকে ভোলা বলে হাঁক দিলেই ও কাছে চলে এসে কুই কুই করে পিছনের দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়ে এমন একটা ভাব ধরত জে তখন ওর মুখে কিছু খাবার না দিলে ওর হাত থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন ব্যাপার ছিল। এগুলি আমরা জানতাম বলে আগে থেকেই তেমন প্রস্তুতি থাকত। অগত্যা সাথে কিছু না থাকলে রেস্ট হাউজের কিচেন থেকে কিছু না কিছু এনে দিতে হতো। বিশেষ করে আমার ছোট মেয়ে যেদিন যেত সেদিন হতো ওদের ঈদ। ওহ! এই দেখেন গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই ভুলে গেছি। এই জে ভোলাকে খাবার দেয়া হতো তা কিন্তু কখনোই ও একা খেত না। অন্তত ওর কাছাকাছি যারা থাকত তারা মিলে ভাগাভাগি করে খেত।

আমি এবং আমার স্ত্রীকে প্রায়ই ওখানে থাকতে হতো। তেমনি একদিন সকালে নাশতার পর রেস্ট হাউজের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম। তখন গত কয়েক দিন আগে ভোলার দলবলের মধ্যে এক সঙ্গিনী পাঁচটি বাচ্চা প্রসব করে খুব অসুস্থ হয়ে পরেছিল। এমনকি তার বাচ্চারা মায়ের বুকের দুধ ঠিক ভাবে পাচ্ছিল না। আমাদের খামারের এক কর্মী বুদ্ধি করে বাজার থেকে পাঁচটা ফিডার কিনে এনে ওতে গরুর দুধ ভরে খাওয়াত। যা বলছিলাম, আমি বারান্দায় চা খাচ্ছিলাম যেদিন সেদিন কেন যেন বাচ্চাদের ফিডার খাওয়ান হয়নি এবং দলের সবাই খামারের পশ্চিম পাশে কাজ চলছিল বলে ভোলা বাহিনীর সবাই ওখানে ছিল আর এদিকে বাচ্চারা ক্ষুধায় কুহ কুহ করছিল। শব্দটা আমিও শুনছিলাম কিন্তু আমি এর মানে বুঝতে পারিনি। বুঝব কি করে বলুন। আমি যে মানুষ! তাই নিজের নাশতা চা হয়ে গেছে আর কি? সে যাই হোক, এমন সময় কাছেই কাটা তারের বেড়ার পাশ দিয়ে ভিন্ন সাদা কাল রঙের একটা বেশ বলিষ্ঠ কুকুর যাচ্ছিল। ও ওই বাচ্চাদের কুহ কুহ শুনে থমকে দাঁড়াল। একটু মনযোগ দিয়ে ওদের কান্নার ভাষা বুঝতে পেরে জে পথে এসেছিল সেই পথে চলে গেল। ওই পথেই একটু দূরে এক বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হচ্ছিল সেখানে আমাদেরও নিমন্ত্রণ ছিল তবে ঐ সাদা কালো কুকুরটার নিমন্ত্রণ ছিল কি না জানি না। সেদিন আমার বিশেষ কোন কাজ ছিলনা বলে সেন্টার টেবিলের উপর পা তুলে চেয়ারে বসে ছিলাম।

একটু পরেই ওই কুকুরটাকে ফিরে আসতে দেখলাম। ও এসে কাটা তার ডিঙ্গিয়ে ওই বাচ্চা গুলির পাশে দাঁড়িয়ে বমি করার মত মুখে করে আনা খাবার উগরে দিল। কিছুক্ষণ অদের দেখে বুঝে নিলো যে এরা এতই ছোট যে একা একা খেতে পারছে না। তখন সে ওই খাবার কিছু কিছু করে নিজ মুখে নিয়ে চিবিয়ে এক এক করে ওই বাচ্চাদের খাইয়ে দিল। এই ঘটনা যখন ঘটে তখন আমার স্ত্রী শসা বাগানের মাচা ঠিক করে দিচ্ছিল। আমি তাকে তাড়াতাড়ি ডেকে এনে দেখালাম। আমরা দুই জনেই অবাক হয়ে ওদের কাণ্ড দেখলাম। এমন সময় ভোলা যেন কি ভাবে এসে হাজির। কিন্তু সে আগন্তুক সাদা কালোকে দেখে কোন উচ্চ বাচ্য করল না। সাদা কালো ভোলাকে দেখে চলে গেল আর ভোলা ওই সাদা কালোর আনা খাবার সে যেমন করে খাইয়ে দিচ্ছিল ভোলাও তেমনি করে খাইয়ে দিতে লাগল। আমি আশরাফকে ডেকে তাড়াতাড়ি ফিডার রেডি করে ওদের খাওয়াবার কথা বলে দায় শেষ করে ভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এত বছর পরে হলেও সেই ঘটনা কেন যে আমার চোখের সামনে থেকে যায়না বুঝি না। যখনই একা থাকি তখন মাঝে মাঝে চোখের সামনে দিয়ে সিনেমার মত দেখি।

আপনারা কেউ পারবেন আমার এই সিনেমা দেখা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে?

লেখকের বিড়ম্বনা

আমি কোন লেখক বা সাহিত্যিক হবার জন্য হাতে কলম ধরিনি বা এই বিজ্ঞানের যুগে যেহেতু কলম দিয়ে লেখার প্রচলন উঠেই গেছে তাই বলা যায় কম্পিউটারের কি বোর্ডে হাত দেইনি। তবে মনের গোপন কোণে যে এমন একটা সাধ সুপ্ত নেই সে কথাও জোর দিয়ে বলতে চাই না। নিতান্তই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সময় কাটাবার জন্য বিশেষ করে কারো মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ার চেষ্টা বা দলিল, নোট জাল করা বা কাউকে গুম করে মুক্তিপণ আদায় করা বা ডাহা মিথ্যে সাক্ষী দেয়া কিংবা কারো মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবার চিন্তা কিংবা কি করে মানুষের খাবারের সাথে ইট পাথরের গুড়ি কিংবা কাপড়ে দেয়ার রঙ কিংবা নর্দমার পানি বা নিদেনপক্ষে মানুষের খাবার অযোগ্য পদার্থ মেশানোর চিন্তা গুলি মাথায় এসে ভর না করে আমাকে রাতারাতি কোন বিখ্যাত আধুনিক মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী না করে ফেলতে পারে সেই চেষ্টা করতে চাই।

ফরমালিন এবং কার্বাইড দিয়ে পচা খাবার তাজা রাখা এবং ফলমূল পাকিয়ে মানুষের সামনে তুলে ধরার মহান চেষ্টা থেকে বিরত থাকার জন্যেই এই কাজে হাত দিয়েছি। আটা ময়দা দিয়ে এন্টিবায়োটিক বানানো, খড়ি মাটি দিয়ে স্যালাইন বানাবার প্রক্রিয়া শেখার আগ্রহ যাতে আমার মাথায় চেপে বসতে না পারে সেই অপ চেষ্টা করার জন্যেই এই কাজে রত থাকার চেষ্টা করি। এগুলি নাকি আধুনিকতা। তা ভাই আমি কিন্তু এত আধুনিক হতে চাই না সে কালের মানুষ সেকেলে থাকতে পারলেই ভাল। আমার যুগে আমার চাচাত ভাইকে দেখেছি ঝিটকার হাটে পাঁচ টাকায় একটা আধ মনি খাসি বিক্রি করে আট আনার রসগোল্লা কিনে এনেছিল তখন একশ টাকায় গরু পাওয়া যেত। আমি নিজেও আট আনা কেজি গরুর মাংস কিনেছি। যাক সেসব কথা, ওগুলি বললেতো বিশ্বাস করবেনই না উলটা আমাকে পা কিংবা মাথা গোল মনে করে সন্দেহের চোখে তাকাবেন তাই কি দরকার সেকালের কাহিনী গাইবার? নিজেই লিখি নিজেই পড়ি এসব কিছু করি আর সময় গুলা বেশ তর তর করে চলে যায়। ব্যাস আর কি?

আগে আমরা কলম দিয়েই লিখতাম কিন্তু মেয়েদের দেখতাম ওরা কি সুন্দর করে কি বোর্ড চেপে চেপে নানা কিছু লিখে ফেলছে। তাই দেখে দেখে ভীষণ লোভ হচ্ছিল ইশ আমিও যদি এমনি করে লিখতে পারতাম! ওদিকে লজ্জায় কাওকে বলতেও পারছিলাম না আবার শেখার ইচ্ছেটাকেও দমিয়ে রাখতে পারছিলাম না তাই একদিন নিজের ছোট মেয়েটাকেই বললাম আমাকে একটু এই কি বোর্ড চালানো শিখিয়ে দিতে পার মা? মেয়ে তার মনের মত ছাত্র পেয়ে মহা খুশি।

এসো বাবা আমি তিন দিনেই তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি, তুমি সবই পারবে। তোমাকে প্রথমে কম্পিউটার অন অফ করা থেকে শুরু করব পরে ওয়ার্ডে কাজ করা শেখাব তারপরে ইন্টারনেট ব্যবহার করা, নানা কিছু সার্চ করে ইন্টারনেট থেকে দেখে নেয়া, ই মেইল করা এগুলি আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে দেব।
বাহ! মনের আনন্দ চেপে রাখা কষ্ট হলেও কিছু করার ছিল না তাই চুপচাপই রইলাম। মেয়ে তার কাজ শুরু করে দিল। অনেক কিছুই শেখাল আমিও শিখলাম। ফল যা হল তা একেবারে মন্দ বলার উপায় নেই।
কি বোর্ড চেপে চেপে, ছড়া, পদ্য, গল্প এমনকি উপন্যাস পর্যন্ত লিখতে পারছি। আমার শিক্ষা গুরুও খুশি আমিও মহা খুশি। ক্রমে ক্রমে আমার নিজের ওয়েব সাইট, ব্লগ বানানো শিখে ফেললাম।

এই যে এতক্ষণ ভরে সাতকাহন গীত গাইলাম সে যে কেন গাইলাম তা কি কিছু বুঝতে পেরেছেন? এটা হল মাত্র ভূমিকা এবার শোনেন আসল ঘটনা। একটা কথা কানে কানে বলে যাই, দেখবেন কাওকে বলবেন না, আমি কিন্তু আমার প্রিয়তমা পত্নী দেবীকে মোটেই ভয় পাই না। (সত্য না মিথ্যা জানি না)।

সেদিন এমনি করে কি বোর্ডের বোতাম চেপে চেপে একটা গল্প লিখছি আর প্রিয়তমা এসে বললেন
এই, দোকান থেকে নুডলস নিয়ে এসো বিকেলে রান্না করব। লেখা ছেড়ে উঠে গিয়ে পাশের দোকান থেকে এনে দিলাম। ফিরে আবার বসেছি তখন
এই, যাওতো দেখ রান্না ঘরের জানালাটা খোলা আছে কিনা দেখে এসো খোলা থাকলে বন্ধ করে দিও মাছ ভেজে রেখেছি বিড়াল ঢুকলে সব খেয়ে ফেলবে যাও এক্ষণই যাও।
আমি গল্পের নায়িকাকে নৌকা ডুবি থেকে বাচাতে গিয়ে জানালা বন্ধ করার কথা ভুলে গেলাম আর অমনি একটু পরেই আবার তাড়া
কি হল জানালা বন্ধ করে এসেছ?
না ভুলে গেছিলাম
যাও এক্ষণই যাও। সারাদিন বসে বসে কি কর? তোমাকে দিয়ে কোন কাজ হয় না। তোমার কম্পিউটার বন্ধ করবে নাকি আমাকে উঠতে হবে?
ভয়ে আমার প্রাণ পাখি প্রায় খাঁচা ছেড়ে যাবার উপক্রম হল কিন্তু অনেক সাহস করে বললাম
আহা রাগ করছ কেন অন্তত কিছু অন্ন ধ্বংস তো হচ্ছে
হ্যাঁ শুধু তাই হচ্ছে , যাও কথা না বাড়িয়ে জানালা বন্ধ করে এসো
অগত্যা উঠে গেলাম। জানালা বন্ধ করে দেখি পানির ফিল্টার থেকে পানি লিক করে ডাইনিং স্পেসের মেঝে ভেসে যাচ্ছে। গিন্নিকে বলার সাহস না পেয়ে (বললেও সে আমাকেই মুছতে বলবে) ঘর মোছার ন্যাকরা আর বালতি কোথায় জিজ্ঞেস করলাম আর অমনি তিনি রেগে এক ঝারি দিয়ে বললেন ঘুমটা মাত্র লেগে আসছিল দিলেতো ভেঙ্গে! কি হয়েছে?
কাঁচুমাচু করে ওগুলির ঠিকানা জানতে চাইলাম
এগুলি দিয়ে এখন কি করবে?
কাহিনী শোনালাম।

যাও দেখ রান্না ঘরের সিংকের নিচে ন্যাকরা আর বাথ রুমে কাল বালতি আছে, দেখবে লাল বালতি কিন্তু নিও না।
আমার মনে কিন্তু তখন গল্পের নায়ক নায়িকা এখন কি করবে কোথায় যাবে তাই নিয়ে একটু ভাবনা কাজ করছে আর আমি ভুলে গিয়ে বাথরুম থেকে বিপদ জনক রঙ লাল মনে করে লাল বালতি আর ন্যাকরা নিয়ে ফ্লোর মুছে ওখানেই রেখে চলে এসে আবার মাত্রই কি বোর্ডের সামনে বসেছি আর গিন্নি তখন বাথরুমে যাবার জন্য উঠেছেন। তিনি রুম থেকে বের হয়ে লাল বালতিতে ঘর মোছার ন্যাকড়া দেখে তেলে বেগুনে ঝাঁজ করে উঠলেন
করেছ কি এটা, এই কাপড় ধোয়ার বালতি এখানে কেন?
নিজে ভুল করেছি এখন স্বীকার না করে উপায় নেই। সাহস করে অকপটে (সত্যের নাকি জয় হয়) বললাম ওটায় ফ্লোর মুছে রেখেছি!
সারা দিন কি কর? একটু চোখেও দেখ না যে কাল বালতিতে ঘর মুছে? কর কি? (ঘর মোছার বালতির দিকেও আমাকে নজর দারি করতে হবে কখনও কি ভেবেছিলাম?)
হ্যাঁ তাইতো ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা আবার হলে এমন হবে না এবার একটু থাম। ওদিকে নায়কের যাবার কথা ছিল পার্কে কিন্তু এই হাঙ্গামায় তাকে নিয়ে গেলাম নদীর পাড়ে। যা হবার তাই হল। কাহিনীর বিভ্রাট। আবার সেখান থেকে নতুন করে লিখতে হল।

সন্ধ্যার পর লিখতে বসেছি আর তিনি টিভি দেখছেন। আমি বললাম কি দেখ আমি তোমার এক মাত্র সোয়ামী, আমি একটু আধটু লিখালিখি করে মনের সুখ পাবার চেষ্টা করি, আমি যখন লিখতে বসি তখন দয়া করে আমাকে কিছু বল না। লিখতে লিখতে গল্পের ক্লাইমেক্সে এসে পড়েছি একটু পরেই শেষ হবে এমন সময় খোঁচা দিয়ে বলল
কি হয়েছে চশমাটা চাইছি না?
আচ্ছা চশমাটা এগিয়ে দিলাম। আবার লেখা শুরু করেছি লেখার গভীরে চলে গেছি আবার এক ধমক
কি হল সাউন্ড কমিয়ে দিতে বলছি শুনছ না।
সাউন্ড কমিয়ে দিয়ে এবার মধুর সুরে বললাম ওগো প্রিয়তমা, তুমি হলে আমার ঘরের সু গৃহিণী আমার প্রিয়তমা রমণী, জানত সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে
হুম, বুঝলাম কিন্তু এত মধুর কথা কিসের জন্যে?
দেখ তোমার একমাত্র সোয়ামী একজন লেখক, কত কি লিখছে তুমিতো আর এগুলি পড়ে দেখ না কাজেই বুঝতে পার না কত কি অমূল্য লিখা লিখছি, কাজেই বলছিলাম কি লেখার সময় অন্তত আমাকে বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকলে ভাল বৈ মন্দ হবে না। জান না, মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন লিখতেন তখন তার স্ত্রী ডরোথি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আমার মাইকেলের কাগজ বা কলমের কালি ফুরিয়ে যায় তাহলে কে এনে দিবে? ও যে সারা রাত ধরে সাদা কাগজে লিখে যাবে! ভয়ে বসত না যদি ঘুমিয়ে পড়ে!
হুমায়ুন আহমেদের কুসুম কুমারি শাওন বলেছিল “একজন লেখক লিখছেন, তার থেকে পবিত্র দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না।”

তাই বলছিলাম কি একজন লেখককে একটু সাহায্য কর! বলা যায় না দেখবে আমি হয়ত একদিন হুমায়ুন আহমেদ হয়ে যাব তখন কি হবে? ভেবে দেখেছো? ভাবতো একবার, সবাই যখন আমার প্রশংসা করবে, অটোগ্রাফ নেয়ার জন্যে বাড়িতে লাইন পড়ে যাবে, টিভিতে আমার ইন্টারভিউ নিবে তখন গর্বে অহংকারে তোমার পা মাটিতেই পড়তে চাইবে না!
তোমাকে কত কি কিনে দিব তার কি কোন হিসেব আছে? হুমায়ুন আহমেদ শাওনকে সেন্ট মার্টিনে বাড়ি করে দিয়েছিল আর আমি তোমাকে কাশমীরে বাড়ি করে দিব, তুমি মনের সুখে পায়ের উপরে পা রেখে সামনের ঝুর ঝুর করে ঝরা তুষার দেখবে আর কফি খাবে!
হ্যাঁ বুঝেছি, এখন যাওতো আধা কেজি কাঁচামরিচ নিয়ে এসো।
হাত থেকে চিনামাটির পেয়ালা পাকা মেঝেতে পড়ে যেমন খান খান হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যায় আমার লেখক হবার সাধ বাসনাও তেমনি করে ভেঙ্গে গেলো।
লেখকের এমন বিড়ম্বনা সইবার কোন উপায় আছে কি না তার কোন সন্ধান দিতে পারেন কেও?
এর থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় বলতে পারেন? অন্তত সবাই মিলে একটু চেষ্টা করেই দেখুন না!

ঈদ শপিং

নিউ মার্কেট আর গাউসিয়াতে চলছে কেনা কাটা
দেশটি জুরে কোথাও আর নেই যে কোন ফাকা।
এখান থেকে ওখানেতে চলছে ছোটাছুটি
কোন বাজারে পাবে পোশাক হবে মোটামুটি।

দামে কম লাগবে ভাল দেখতে হবে খাসা
পড়শিরা সব বলবে ভাল এইতো এখন আশা।
চমকে দেব নতুন কাপড় নতুন ডিজাইন
হাল ফ্যাশনের ছড়াছড়ি কোনটা হবে ফাইন।

এখানে নয় ওখানে চল গিন্নী ধরে বায়না
হাটা হাটি ঘোরা ঘুরি আর যে দেহে সয় না।
ভিউ প্যালেসে এসে বধূ শাড়ি নিয়ে হাতে
দাম শুধাল দোকানীরে আমায় নিয়ে সাথে।

ষাট হাজারে দিতে পারি, প্যাকেট করব নাকি
এটাই আসল বেনারসি আর যে সকল মেকি।
দামটি শুনে আঁতকে উঠি, একি হলো হায়
পকেট কখন উবে গেছে প্রাণটা বুঝি যায়!

গিন্নী আমার অতি ভাল সাহস করে বলি তারে
চটপটি আর ফুচকা খেয়ে এবার চল ঘরে।
কালকে তোমায় শাড়ি দেব, আর যা আছে কিছু
কেন তুমি মিছে আমায় মন ভুলিয়ে আনলে পিছু?

কেমন করে বলি তাকে পকেট আমার ফাঁকা
কোথা থেকে পাব এখন এত গুলি টাকা?
চুপটি করে বসে আছি মাথায় দিয়ে হাত
বুঝতে তিনি চায়না মোটে কোন অজুহাত।

চারিদিকে লাল নীল জ্বলছে বাতির বাহার
এবার বুঝি ভাঙবে আমার এত দিনের সংসার।

বিঃদ্রঃ দয়া করিয়া আপা এবং ভাবী সাহেবরা মনে কোন সংশয় রাখিবেননা কিংবা কাওকে এমন করে কষ্টে ফেলিবেননা ইহা কেবল মাত্র হাসির ইন্ধন হিসেবেই মনে করিবেন। ক্ষমা প্রার্থী!

অফিসে বা কলকারখানায় কাজের সময়

can-stock-photo_csp11379154

আমাদের এই বেকারের দেশে নিজের ক্ষুধা নিবারণের জন্য, পরিবারের ভরন পোষণের জন্য, সাময়িক সুখের সন্ধানের জন্য লক্ষ লক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নেয়া বা এক কথায় বলা যায় দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক যুবতী একটি কর্ম সংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। হ্যাঁ এ কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের অভাব রয়েছে বা কেহই এই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী নয়। তারচেয়ে অফিসে বসে কলম ঘষাঘষি করাতেই তৃপ্তি। হাতের কাজ? সেতো ভাবতেও ঘেন্না করে!

আবার আর এক দিকে যারা বিশেষ কোন ভাবে, সে পিতার সম্পত্তির জোরে কিংবা আত্মীয়তার জোরে কিংবা চাটুকারিতার জোর যেভাবেই হোক কর্মক্ষেত্র তৈরি করে নিতে পেরেছে বা অন্যের কর্মক্ষেত্রে বস হয়ে বসেছে তারা নিজেরা না জুটিয়েছে শিক্ষা না পেয়েছে দীক্ষা। এমনকি ভদ্রতা সভ্যতা বা আদব-কায়দা বলতে কি বোঝায় তাই শিখতে পারেনি! কার সঙ্গে কি ভাবে কী কথা বলতে হয় জানে না। তারা উপযুক্ত কাজের জন্য অপ্রাসঙ্গিক জনকে নিয়োগ দিয়ে কাজের বারোটা বাজিয়ে দেন। মালিক বা বস নিজেই জানে না এই কাজের জন্য উপযুক্ত কর্মী কে? তার কি যোগ্যতা প্রয়োজন। যেমন ডাক্তারকে নিয়োগ দিচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারের পদে, ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়োগ দিচ্ছে পরিবহন কাজের এস্টিমেট করার কাজে আবার প্রশাসনিক কাজ দেখার জন্য নিয়োগ দিচ্ছে হিসাব বিজ্ঞান পড়া লোককে আবার ট্রাক মালিকের সুপারভাইজারকে নিয়োগ দিচ্ছে জাহাজ পরিচালনার কাজে। এর ফলাফল কি হচ্ছে তা আমরা চারিদিকেই দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে ব্যাক্তি মালিকানার অফিসগুলিতে মালিক কোন রেকর্ডপত্র রাখা বিপদজনক বা তার নিজের অপকর্ম ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে রাখে না। তাই যখন যা সুবিধা মনে হয় তাই, সত্যকে মিথ্যা বা মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে নেয়ার ইচ্ছা বলেই এমন করে।

একজনকে দিয়ে ৫ জনের কাজ আদায় করে নেয়া একটা যোগ্যতা এবং শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। মালিকের মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষে একজনকে দিয়ে যদি পাঁচ জনের কাজ আদায় করিয়ে নেয়া যায় মন্দ কি? আল্লাহত’আলা কাজকর্ম কিংবা জীবন ধারণ কিংবা খেয়ে পরে জীবন বাঁচাবার জন্য দিনকে নির্ধারণ করেছেন আর বিশ্রামের জন্য রাত। এই বিধান কি জন্য করেছেন? এমনিতেই ধীরে ধীরে মানুষের মন, মানসিকতা, বিবেক, ধৈর্য-সহ্য অর্থাৎ মানবিক গুণের পচন ধরছে। এগুলি দেখার মত বা উপযুক্ত বিচার করার মত ব্যবস্থা থাকলেও তা মানা হয় না। শ্রম দপ্তর নামে একটি দপ্তর নামে থাকলেও কাজে এর কোন অস্তিত্ব নেই সম্ভবত তাহারা সরকারি অর্থের সদ্ব্যবহারে ব্যস্ত থাকেন। প্রতিদিন একজন কর্মচারীকে মাত্র এক ঘন্টা (বাস্তবে এর চেয়েও অনেক বেশি হয়ে থাকে) বেশি কাজ করিয়ে নিলে মাসে ২৬ ঘন্টা আদায় করে নেয়া যায়। অর্থাৎ মাসে ৩ দিনেররও অধিক সময় বিনে পয়সায় কাজ আদায় করে নিচ্ছে এই সব মুনাফা লোভীরা। বিনিময়ে হয়তবা কেও কেও (সবাই না) ৫*২= ১০ টাকার দুইটা সিঙ্গারা খাইয়ে দিলেই হলো। বাহ! কি মজা! তাকধিনা ধিন ধিন!

যিনি কাজ করবেন তাকে দিয়ে কাজ করাতেই থাকবে, লাথি গুঁতা, চোটপাট সবই তার প্রাপ্য কিন্তু প্রমোদে মন ঢালিয়া যারা অফিসে বসে facebook চালাইবেন বা you tube এ সিনেমা দেখিবেন তিনিই উত্তম এবং যোগ্য কর্মচারী বলে বিবেচিত হবেন, সবসময় বাহবা পাবেন, এমনটাই কি রীতি?

সরকার যখন তার কর্মচারীদের পে-স্কেল বাড়িয়ে দিচ্ছেন তার ফলে সারা দেশে সমস্ত কিছুর দাম বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকার শুধুমাত্র ২০/২৫ লক্ষ মানুষের কথা ভেবে অস্থির অথচ বেসরকারি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করে তাদের বেতন স্কেলের কথার কোনও উল্লেখ থাকে না তাহলে কি চাকুরীজীবী বলতে ওই সরকারি কর্মচারীদেরকেই বোঝায়? এমনিতেই বেসরকারি কর্মজীবীরা নিয়মিত ভাবে বেতন তো পায়ই না বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট তো দূরের কথা। ৫/৭ বছর চাকরি করেও ইনক্রিমেন্টের কোন দেখা নেই। তাহলে তারা সরকারি চাকুরেদের সাথে তাল মিলিয়া সংসার কি ভাবে ম্যানেজ করছে? এর জবাব কি কেও কোনদিন ভেবে দেখেছে না ভেবে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেছে?
কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করাটাও যেমন যোগ্যতা আবার সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারাটাও অযোগ্যতা এমন করে কি কেও ভাবেন? দিনে কাজ করবে রাতে বিশ্রাম নিবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু যারা সন্ধ্যার পর অফিসে বাতি জ্বালিয়ে কাজ করে তারা কারা? কেন করে এমন? টেবিলে ফাইল, কাগজপত্র এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে চিঠিপত্র নির্দিষ্ট ফাইলে না রেখে যেখানে খুশী সেখানে রেখে সময়মত খুঁজে না পাওয়াকে মালিক বা বস মনে করে এরাই ব্যস্ত মানুষ, এরাই ভাল কাজ করছে! ইহা কি যথেচ্ছাচারিতা নয়?

অফিসে রাতে বাতি জ্বালিয়ে কাজ করে কে?
১। যারা সময় মত নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করতে পারে না।
২। যার ঘরে শান্তি নেই অর্থাৎ সহজ কথায় স্ত্রীর সাথে বনিবনা নেই।
৩। যারা নিজের কাজ কি এটাই বুঝতে পারে না।
৪। যারা কাজের সময় আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে সময় নষ্ট করে।

সময়মত অফিসের কাজ শেষ করে সময়মত বাড়িতে ফিরে এসে নিজের পরিবারকে সময় দেয়া, তাদের সাথে সুখ দু:খের কিংবা কোন স্বপ্ন দেখা বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া, বাড়ির বাজার বা প্রয়োজনীয় কেনা কাটা করে, চিকিৎস্য করে, প্রয়োজনীয় ওষুধ-পথ্য কিনে এনে পরিবারের স্ত্রী-সন্তানদের ভালবাসা স্নেহ-মমতা নিয়ে রাতে ভাবনা হীন একটা সুখ নিদ্রা দিয়ে ভোরে এক্কেবারে তরতাজা হয়ে উঠতে পারে তাহলে যে সে কতখানি কর্মশক্তি যোগাতে পারে তা কেই এই মহাপন্ডিত জন মালিক বা কথিত এই বস সম্প্রদায়ের রোবটগুলি বুঝতে পারে না সে প্রশ্নের জবাব কে দিতে পারে?

কারাবন্দীর কান্না

একটি নদীকে ভালবেসেছি
দু’পাড়ে ছিল তার সুখের নীড়
সেই নদীর পাড়ে নীল আকাশে
নিঝুম দুপুরে গাং চিলেরা করত ভিড়।

কলসি কাঁখে সন্ধ্যা বেলা সে
শামুকের ঘুঙ্গুর বেধে পায়
জল নিতে আসতো ঘাটে
আঁচল উড়িয়ে দখিনা বায়।

সখীদের সাথে হেসে-খেলে,
দু’গালে টোল ফেলে
মুক্ত বলাকার মত চঞ্চল পায়ে
ফিরে যেত বাঁধানো তুলসী তলে।

সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে ঘরে
আঁচলে জড়িয়ে দেহলতা
প্রণাম সেরে দেবতায় নীরবে
কি বর চাইতো, জানি সে কথা।

সে ছিল আমার মানসী,
শান্ত নদীর বালুকা বেলায়
তারই সাথে বসে দু’জনে
স্বপ্ন সাগরে ভেসেছি কত স্বপ্ন ভেলায়।

চন্দন টিপে আর সিঁদুরে সেজে
শ্বেত-শুভ্র শাখা হাতে
আসবে সে ঘরে পথ খুঁজে।
ভরে দিবে আমার আঙ্গিনা,
মন মাতানো গন্ধ বিধুর ধুপে
বসন্ত বাসর ছুটে আসবে
দুয়ারে রিনিঝিনি সুরে।

মানুষের সাথে মানুষ হয়ে
ঘর বাধবো মানুষের মত
আমি আর মালতী
মুছে দিব দু,জনার বেদনা যত।

সোনালী প্রেমের বাগানে
ফুটবে নতুন কুড়ি,
বনে বাদারে ঘুরে কুড়িয়ে
আনবে ভরে ফুলের ঝুড়ি।

বসন্ত না আসিতে কাল বৈশাখী
এলো জাতের ঝড় তুলে
হিন্দু মুসলিম আর বৌদ্ধ খৃস্টানের
মিথ্যে ভেদাভেদে মানুষের জাত ভুলে।।

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৭

কথা বলতে বলতে বাস ছেড়ে দিল। বুদ্ধি পরামর্শ বা চিন্তা ভাবনা যা করার তা গত রাতে আর আজকে ঝিটকা আসার পথেই নিশাত ভেবে নিয়েছে। বাস মানিকগঞ্জের কাছে আসার পর পাশে বসা নিরুকে জানিয়ে দিয়েছে পরবর্তীতে কি হতে যাচ্ছে। নিরুকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল
কাল যদি বিয়ে হয় তোমার আপত্তি আছে?
নিরু চুপচাপ। কোন উত্তর নেই
কি হলো কিছু বলছ না
কি বলব?
কি করবে তাই বল নয়ত যা বলেছি তার উত্তর দাও
আপনার যা ইচ্ছা তাই করেন তবে কোন পাগলামি করবেন না
পাগলামি কিসের? আমি বুঝতে পারছি না! ব্যপারটাতো আর একদিনের ঘটনা নয়, গত প্রায় সাতটা বছর ধরে চলছে এইটুক মনে পরছে তবে এর আগে কতদিন ছিল তা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। কেউ জানে না বলে কি তুমিও জান না? বাজে কথা রেখে যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দাও!
বললামতো আপনার যা ইচ্ছে তাই করেন!

নিরু জানালার বাইরে মুখ ঘুড়িয়ে বসে রইল। বাসে আর কোন কথা হয়নি। সোবহান বাগ নেমে বীণা আপার বাড়িতে নিরুকে পৌঁছে দিয়ে বাইরে থেকেই চলে এসেছিল। নিজের বাসায় না গিয়ে সেন্ট্রাল রোডে মেঝ মামার বাসায় এসে মামাকে খুঁজছিল। মামা বাসায় নেই। মামির সাথে আলাপ করছিল। মামি জিজ্ঞেস করল হঠাৎ করে চলে এসেছিস, কি ব্যাপার? ইত্যাদি নানা কিছু। অনেকক্ষণ পরে মামা বসায় ফিরেই দেখে নিশাত বসে আছে।
কিরে ব্যাটা কি খবর, কবে এসেছিস?
মামা একটা জরুরী কাজে চলে আসতে হলো তবে আবার সামনের জানুয়ারিতে চলে যাব।
কি এমন জরুরী কাজ?
বাসায় চলেন, মাকে বলেন তার বৌ নিয়ে আসার জন্য
কি বলছিস?
কাজলের কথা থেকে শুরু করে নিরুর কথা সব খুলে বলল মামাকে। বলল মামা আপনি আর মা কাল নিরুর বোনের বাড়িতে যেয়ে নিরুকে দেখবেন এবং ওর দুলাভাইকে বা অন্য কাউকে বাড়ি পাঠাবেন যেন চাচা চাচীকে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় তাদের মেয়ের বিয়ে হবে
দাড়া দাড়া! কি বলছিস তুই, আমি কি স্বপ্নে দেখছি? একটু খুলে বল!
নিরুর সাথের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল এমনকি আজকের ওর দুবাই থেকে এখানে আসার কারণটাও যে নিরু সে কথাও খুলে বলল।
সব শুনে মামা বলল আচ্ছা সবই বুঝলাম কিন্তু একটু সময় দে, এখন রাত বাজে নয়টা এই সময়ের মধ্যে কি করব?
না মামা আপনাকে কিছু করতেই হবে। না হলে এইযে দেখেন আমার পকেটে টিকেট আমি জানুয়ারি মাসে লন্ডন চলে যাব আর কোন দিন ফিরব না! ভেবে দেখেন কি করবেন! বলেই পকেট থেকে টিকেট বের করে মামার সামনে মেলে ধরল।

মামি পাশেই ছিল। মামি নিশাতকে সমর্থন করে বলল তুমি যাও, আপার ওখানে খেয়ে দেয়ে আপা দুলাভাইকে বুঝিয়ে বলে রাজী করিয়ে ছেলে যেমন বলছে তেমন ব্যবস্থা করে আস।
আচ্ছা আপা দুলাভাইকে না হয় রাজী করালাম কিন্তু মেয়ের বাবাকে কে রাজী করাবে?
দুলাভাই যদি প্রস্তাব পাঠায় তাহলে ওরা কেউ অরাজি হবে না! এটা আমার বিশ্বাস। একই গ্রামের ছেলে মেয়ে। তাছাড়া ওদের কি একটা আত্মীয়তাও আছে। কাজেই বাছ বিচারের কি আছে? তাছাড়া তুমি ওই মেয়েকে দেখনি? নিরু! দুই জনে খুব মানাবে, যেমন আমাদের ছেলে তেমন মেয়েটা। কি লক্ষ্মী মেয়ে! দেখতে যেমন সুন্দর তেমন লেখাপড়া, বাধা কোথায়? তুমি এক্ষণি ওকে নিয়ে যাও।
শুধু এক পক্ষ দেখলেইতো হবে না!
আমাদের ছেলে কম কিসে?
দেখি বেটা চল

ড্রাইভার চলে গিয়েছিল বলে মামা নিজেই ড্রাইভ করে মতিঝিলে পৌঁছল। বাসায় যেয়ে এদিকে নিশাত পোশাক বদলাচ্ছিল ওদিকে মামা তার আপার কাছে খাবার চাহিদা জানাল।
কিরে জামিল তুই নিশাতকে কোথায় পেলি?
নাতো কোথাও পাইনি, এইতো তোমাদের সিঁড়িতে দেখা।
ও আচ্ছা,
একটু পরেই নিশাত চলে আসল। টেবিলে ভাত নিয়ে মা অপেক্ষা করছিল। মামা বলল, আপা একটা কথা বলি?
বল
নিশাত যখন এবার এসেছে তাহলে একটা বৌ নিয়ে আস!
হ্যাঁ আমিও বলছিলাম কাল সকালে
কি বলছিলে? মেয়ে দেখেছ? কে?
ওই যে রায়হান ভাইয়ের মেয়ে কাজলের কথা!
না আপা, আমার মনে হয় সোবহান বাগে থাকে তোমাদের ভাতিজি বীণা, ওর বোন আছে না একজন, কি যেন নাম!
কে! নিরুর কথা বলছিস?
হ্যাঁ হ্যাঁ নিরু, আমার মনে হয় নিরুকে মানাবে ভাল তাছাড়া ওরাতো একই এলাকার একই গ্রামের
না, তা কি করে হয়! এত দিন ধরে জানাজানি চলছে যদিও কথা দেয়া নেয়া হয়নি কিন্তু ভাবে সাবে এটা পরিষ্কার যে কাজলই এ বাড়ির বৌ হবে। এমন একটা অলিখিত কথা দুই সংসারে সবাই জানে এমন সময় হুট করে কি কিছু করা উচিত হবে?
দুলাভাই জানে, তার কি মত?
সে জানে, তারও একই মত
ছেলে কিছু বলেছে কখনও?
ও আবার কি বলবে? আমরা যা বলব তাই ওর কথা!
না আপা, এটা হয় না। আজকাল এ কথা তুমি বলতেই পার না। আজকাল সবারই নিজস্ব কোন মতামত অবশ্যই থাকতে পারে আর তোমাদের তা নিয়ে ভাবতেও হবে! সে যুগ আর নেই।
ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ, কি বলে!
আপা, তোমরা রায়হান ভাইদের কিছু বলেছ?
না, আনুষ্ঠানিক ভাবে এমন কিছু বলা হয়নি তবে ঈদে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাজলকে কাপড় চোপর দেয়া বা তেমন করে আদর আহ্লাদ করা যা এত কাল চলে এসেছে সেসব কি ইচ্ছে করলেই বাদ দেয়া যায়? নারে জামিল আমার কেমন যেন লাগছে! তুই হঠাৎ করে নিরুর কথা বলছিস কেমন করে তুইতো ওকে ভাল করে চিনিস না, তাহলে?

কে বলেছে চিনি না? খুব ভাল করেই চিনি! সিরাজ বেয়াইর মেয়ে, ওই যে মুন্নির বিয়েতে এসেছিল সেই মেয়ে। ওকে সেই ছোট বেলা থেকেই চিনি না? বড় হবার পর মুন্নির বিয়েতে দেখলাম, সেদিন দেখেই আমি নিশাতের কথা ভেবে রেখেছি। হ্যাঁ কাজলও ভাল মেয়ে আমি অস্বীকার করছি না কিন্তু নিশাতের জন্য ওর চেয়ে নিরুকেই মানায় ভাল। আমার যতদূর ধারনা মানে ওদের দেখে যা মনে হয়েছে তাতে মনে হয় ওরা উভয়েই উভয়কে পছন্দ করে!
তুই কেমনে জানলি?
আচ্ছা আপা বলতো আমার বয়স কি কম হয়েছে?
ঠিক আছে কিন্তু কাজলের কি হবে? ওর মা বাবার কাছে মুখ দেখাব কেমন করে?
বা রে! তোমরা কেউ কাওকে কোন কথা দাওনি, কারও সাথে এ ব্যাপারে কোন আলাপ হয়নি অথচ তোমরা ভেবে অস্থির হচ্ছ কেন বুঝতে পারছি না!
কি জানি দেখ তোর দুলাভাইয়ের সাথে আলাপ করে
সারারাত ধরেই জাহিদের মামা আর মা বাবার সাথে এই নিয়ে কথা কাটা কাটি চলল। এক সময় মসজিদে আজানের সুর ভেসে এলো। শেষ পর্যন্ত মেঝ মামাই জয়ী হলো।
আমি এত কিছু পারব না। আমি এখন নিশাতকে নিয়ে ওদের বাড়ি যাচ্ছি এবং বৌ নিয়ে আসব যা করার আপনারা করে রাখবেন বলে মামা বের হয়ে গেল যাবার আগে দুলাভাইকে বলে গেল আমি এখনই আসছি আপনারা রেডি হয়ে থাকেন।

সকালে ঠিক সাতটায় মামা এসে হাজির। নিচে গাড়ি রেখে উপরে এসে হৈ চৈ। কি ব্যাপার দুলাভাই আপা আপনারা রেডি হননি কেন? তাড়াতাড়ি করুন। দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হবেন।
অগত্যা মা বাবা নিম রাজি হয়েই মেঝ মামার সাথে গাড়িতে উঠে বসল। সবাইকে নিয়ে বীণা আপার বাড়ি। কবির দুলাভাই সাত সকালে এদের দেখে বেশ অবাক!
ও! মামা! কি ব্যাপার আপনারা এই সকাল বেলা!
বুঝবে বুঝবে একটু পরেই বুঝবে। বীণা কোথায় ওকে বল নাশতা বানাতে আমরা কেউ বাসা থেকে খেয়ে আসিনি।
সে হবে, এ তো ভাল কথা! বীণা দেখ কারা এসেছেন! নাস্তা রেডি কর।
নিশাতের মা ভিতরে যেয়ে হাতে আটা মাখা হাত ধরে নিরুকে বসার ঘরে এনে সোফার মাঝখানে বসিয়ে নিজে তার পাশে বসল। পিছনে বীণা আপাও আসল। মামা বলল আপা দুলাভাই আপনারা মেয়ে দেখেন। বীণা আপা এবং কবির দুলাভাই হতভম্বের মত তাকিয়েই আছে! হচ্ছে কি এসব!
মামা বলল, কবির শোন, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে তুমি বাড়িতে কাউকে পাঠিয়ে দাও তোমার শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে আসবে।
মামা কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না
বুঝবে একটু পরেই বুঝবে, তোমার শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে আস তারপরে সব বুঝবে। আমাদের বৌ নিয়ে তোমার শ্বশুর কোথায় বিয়ে দিচ্ছে? যাক তাদের আনার ব্যবস্থা কর তারা এলে তখন বুঝবে।
দুলাভাই কিছুটা অনুমান করতে পেরে বলল
কাকে পাঠাব! আমাকেই যেতে হবে কিন্তু আমার যে অফিসে খুব জরুরী কাজ আছে!
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি একটা চিঠি লিখে ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দাও, আমার গাড়ি নিয়ে তুমি অফিসের জরুরী কাজ সেরে তাড়াতাড়ি চলে আস, আমরা আজ এখানেই থাকছি। বৌ নিয়ে তবে আজ আমরা এখান থেকে যাব। সাহস কত! আমাদের বৌ নিয়ে তোমরা এদিক ওদিক দেখাচ্ছ! তোমার শ্বশুর পেয়েছে কি?
আচ্ছা মামা! সবই হবে কিন্তু আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন কি হয়েছে, কি করতে চাইছেন? আমি এখনও পরিষ্কার করে বুঝতে পারছি না!
কেন বুঝতে পারছ না? তোমার এই শ্যালিকা নিরুকে আমরা আমাদের নিশাতের জন্য নিতে এসেছি। এত সকালে কোন মিষ্টির দোকান খুলেনি বলে মিষ্টি আনতে পারিনি, একটু পরে আমি যাচ্ছি মিষ্টি আনতে। ও ভাল কথা, গাড়িটা একটু পরে যাক, মিষ্টি পাঠাতে হবে। আর তুমি একটু পরে যাও আমার ড্রাইভার আসবে এখানে। আমরা কেউ কোথাও যাচ্ছি না।

ওইদিন বিকেলে নিরুর বাবা, মা, চাচা, শিহাব, মইন চাচা, তমাল ওরা সবাই আসল। যুঁই মিরপুরে শ্বশুর বাড়িতে ছিল বলে তখন আসতে পারেনি তবে ফোন করে বিকেলে আনান হয়েছিল। নিরুর দুলাভাই দুপুরের মধ্যেই অফিস থেকে ফিরে এলে মামা বীণাকে তার চাচীকে সাথে নিয়ে রান্না বান্নার আয়োজন করতে বলে নিরুকে নিয়ে মতিঝিল গেল। ওখান থেকে নিশাতকে নিয়ে নিউমার্কেটে এসে নিরুর পছন্দমত শাড়ি ব্লাউজ, পাঞ্জাবি শেরওয়ানি এবং অন্যান্য কেনাকাটা করে মতিঝিলের বাসায় নিশাতকে রেডি হবার জন্য নামিয়ে দিল। নিশাত মামাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে বাসায় গিয়ে তারাহুরো করে এতদিন ধরে জমান নিরুর জন্যে কেনা নানান কিছু থেকে যা তখন চোখে পরল একটা সুটকেস ভরে নিচে এনে মামার গাড়িতে তুলে দিল। মামা ওখান থেকে সোজা বীণার বাড়িতে আসল এবং নিরুকে বিয়ের পোশাক পড়িয়ে রেডি করতে বলে আবার মতিঝিলে এসে নিশাতকে বিয়ের পোশাক পড়িয়ে বীণা আপার বাড়ি নিয়ে কবির দুলাভাইকে কাজী আনতে পাঠাল।
নিরুকে সাজাবার সময় যূঁই নিরুর কানে কানে বলছিল তুই খুব ভাগ্যবতী, নিশাতের মত বর পেয়েছিস। নিশাত খুব ভাল ছেলে কত দিন থেকে দেখছি। তোর ছোট বেলা থেকেই কেন যেন আমার মনে হোত তুইই হবি নিশাতের বৌ এই জন্যেই তোকে সবসময় অমন করে বলতাম, এখন বুঝেছিস? নিশাতকে বলবি বৌর জন্য এত কিছু এনে রেখেছে আর আমার ঘটকালির শাড়ি কোথায়?
দুলাভাই কাজী আনতে যাবার পর নিরুর বাবার সাথে মামা আলাপ শুরু করল। নিরুর বাবা সামনের পরীক্ষার জন্য একটু আপত্তি জানিয়েছিল কিন্তু মামার আপত্তির কাছে তার আপত্তি টিকেনি। ওই রাতেই বিয়ে পড়িয়ে বৌ নিয়ে চলে এলো।

আকাশে চন্দ্র সূর্য এবং অগণিত তারকা অসংখ্য বার উদয় হয়ে আবার অস্ত গেছে, অনেক প্রতীক্ষার দুঃসহ লগ্ন পেরিয়ে গেছে দূর মহা সাগরের ওপাড়ে। নিরুর জীবনের অনেক গুলি নির্বাক বসন্ত কাউকে না জানিয়ে নিরুর চোখের নোনা জল বয়ে নিয়ে গেছে সেই কোন অচেনা সুদূর নীল জলের নীল মহাসাগরের অতলে যে সাগরে তার নিশাত ঘুরে বেড়ায়। নিরুর চোখের জলে মহাসাগরের সব জল নোনা হয়ে গেছে, নিরুর একটু খানি ছোট্ট অবুঝ হৃদয়ে যখন নিশাতের জন্য বিশাল হাহাকারের ঢেউ উত্তাল সাগরের উত্তাল তরঙের মত আছড়ে পরেছে এবং নিশাতের অনেক চাওয়া, অনেক সাধনা, অনেক প্রতীক্ষা, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আজ ছোট্ট দুটি অবুঝ মন এক হয়েছে। দুটি মন, দুটি আত্মা, দুটি হাহাকার, দুটি অবুঝ মনের আকুতি এক হয়ে মিশে গেল চির দিনের তরে স্বর্গিয় আবেশ পাওয়ার জন্য। শুরু হলো তাদের নতুন যাত্রা অনন্ত কালের জন্য। এ যাত্রা শুধু সমুখ পানে এগিয়ে যাবার।

সকল আনুষ্ঠানিকতা সেরে যখন নিশাত বাসর ঘরে ঢুকল তখন নিরু বলল’
বান্ধবীরা কেউ জানল না, গায়ে হলুদ নেই হাতে মেহেদি নেই, সারা জীবন মেহেদি পরিনি আমি কত ভেবে রেখেছি বিয়ের দিন হাতে মেহেদি পরব আর তুমি কি করলে এটা? এই ভাবে কারো বিয়ে হয়? সারা জীবন এমন পাগলামি করেছ তুমি!
(যারা নিরু আর নিশাতের বিয়েতে নেমন্তন্ন পাননি তারা কোন আফসোস করবেননা প্লিজ! হঠাত করে বিয়ে হয়ে গেলতো তাই, তবে বিবাহ বার্ষিকীতে মনে করিয়ে দিলে নেমন্তন্ন দেয়ার অনুরোধ করব। সবাই মিলে দারুন মজা করব। কি বলেন?)
আজ এখানেই ইতি টেনে দিলাম। সবাইকে ধন্যবাদ, যারা এতদিন ধরে ধৈর্য ধরে সাথে ছিলেন। আবার দেখা হবে মেগা সিরিয়াল “নক্ষত্রের গোধূলি” এর সাথে।

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৬

১৮।
সেই নিরু এবার এমএসসি ফাইনাল দিচ্ছে, সামনেই পরীক্ষা, কবে শুরু হবে এখনও জানে না। এদিকে নিশাতও ক্যাডেট থেকে চিফ মেট হয়েছে এবং বুঝে নিয়েছে তার অনুমান ভুল নয়। সারা পৃথিবী ঘুরে জাহাজের জটিল এবং ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ জীবন যাপন করে এসে এই প্রশান্ত চোখ যার তার বুকে একটু আশ্রয় পাবে। নিশাত ভেবেছিল আর কিছুদিন পরে চিফ অফিসার হয়ে নিরুকে নিয়ে আসবে। এমনিতে যেমন আছে তেমনি চলছে কিন্তু বিয়ের পর কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কত কি মনে পড়ছে! নিশাত সালোয়ার কামিজ পরা পছন্দ করে না বলে নিরু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরে থেকে শাড়ি পড়ছে। নিশাতের গান শুনতে ভাল লাগে বলে নিরু গান শিখেছে, ছায়ানটে সেকেন্ড হয়েছিল। গাড়িতে পাশাপাশি বসে যাবার সময় বাতাসে নিরুর এলো চুল উড়ে এসে নিশাতের চোখে মুখে লাগবে আর হাতে সরিয়ে দিতে দিতে আরও কাছে আসবে তাই মাথায় তেল দেয়া চুল বাতাসে উড়বে না বলে নিশাতের ভাল লাগার জন্য শ্যাম্পু করা চুলেই নিরু অভ্যাস করে নিয়েছে। মোটামুটি নিরু নিশাতের জন্য নিজেকে সর্বতোভাবে প্রস্তুত করেছে। ওই বুকেই নিশাতের জন্য সঞ্চিত আছে উত্তাল সাগরের মত সীমাহীন সুখ আর নিরাপত্তা, ওই হাত ধরেই এগিয়ে যাবে অনেক দূর! আবার নিশাতকেও অনেক অভ্যাস পরিবর্তন করতে হয়েছে। আগে নিশাত বেশ ড্রিঙ্ক করত কিন্তু নিরুর কাছে প্রতিজ্ঞা করে সে অভ্যাস বাদ দিয়েছে তবে নানা দেশে যাদের চলাচল তাদের বিদেশিদের সাথে চলা ফেরা করতে হয়, তাদের সাথে নানান পার্টিতে যেতে হয়। শুধু পার্টির সময় হালকা কিছু পান করার অনুমতি নিয়ে নিয়েছে এবং তার পরদিন কতটা কি ড্রিঙ্ক করেছে তা বিস্তারিত নিরুকে জানাবার প্রতিজ্ঞা করেছে। নিরু আকাশী রঙ পছন্দ করে তাই নিশাতের অন্তত শার্ট আর টি শার্ট মিলে গোটা ছয়েক আকাশী রঙের জামা আছে। এই অবস্থায় কে কাকে ছাড়া বাঁচবে? নিশাতের আলমারি ভরা নিরুর জন্য মুম্বাই থেকে কেনা শাড়ি, ব্রিটেন জার্মানির কসমেটিকস, শ্যাম্পু, ফ্রান্সের পারফিউম কত কি। কিন্তু নিরু এখনই এসবের কিছুই নিবে না। ওই এক কথা সবাই জিজ্ঞেস করলে কি বলব? বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন ভর্তি হলো সেদিন নিশাতই সঙ্গে গিয়েছিল। নীলা এখনও জিজ্ঞেস করে ওই যে প্রথম যেদিন তোর সাথে দেখলাম সেই কি তোর সৌভাগ্যবান? নিরু আস্তে করে এড়িয়ে যায় কাউকে কিছু বলে না, বলতে পারে না অত্যন্ত চাপা মেয়ে।

কত স্বপ্ন। চিফ মেট হলে নিরুকে সাথে নিয়ে যেতে পারবে তখন দুইজনে একসাথে থাকবে। জাহাজের সাথে সাথে নিরুকে নিয়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে। লন্ডনের কথাই বারবার মনে আসে। বিয়ের পর দুই মাসের ছুটি নিয়ে লন্ডন আসবে। নিরুর হাত ধরে পিকাডেলি সার্কাস দেখবে, বাকিংহাম প্যালেস দেখবে, বিগবেন, মার্বেল আর্চ, লিভারপুল স্ট্রিট, অক্সফোর্ড সার্কাসে কেনাকাটা করবে। সন্ধ্যায় টেমসের পাড়ে নিরুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে টেমসের বয়ে যাওয়া দেখবে। টিউব রেলে করে হোয়াইট সিটিতে গিয়ে বিবিসি বিশ্ব দেখবে, ব্রিটিশ মিউজিয়াম, মাদাম তোশো কত কি দেখবে! ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, বার্লিন আর প্রেমের তীর্থ ইটালির ভেনিসে না গেলে কি হয়? প্রেম নগরী ভেনিসে নৌকায় করে ঘুরবে। শীতের দেশে নাইট নেভিগেশনের সময় নিরু ব্রিজে থাকবে আর দুজনের হাতে থাকবে কাল কফির মগ। সারা দিনে কঠিন ডিউটি করে রাতে নিরুর বুকে আশ্রয় নিয়ে নিশ্চিন্তে পরম শান্তিতে ঘুমাবে! যখন ভাবনার সাগরে ডুবে গেছে তখনই বেরসিক বিমানবালার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল, বিমানের বাঙালি বিমান বালা বলছে, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয় গন আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা বিমান বন্দরে……………………………..।

ভোরে ঢাকায় নেমে প্রথমে বাবার মতিঝিলের বাসায় যেতে হবে। মা বাবা কেউ জানে না যে নিশাত আসছে। তারা হঠাৎ করে নিশাতকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। হিসাব অনুযায়ী আরও প্রায় এক মাস পরে ওর আসার কথা, কাজেই এমন সময় দেখলে অনেকগুলো মিথ্যা বলতে হবে। ওদিকে নিরু এখন কোথায়? হলে নাকি বাড়িতে! ওকে পেতে হলে আগে যেতে হবে বীণা আপার বাড়িতে। ক্লাস না থাকলে ও হলে থাকে না এখানেই চলে আসে। ভোর পাঁচটায় ঢাকা নেমে মতিঝিলের বাসায় আসতে আসতে সকাল আটটা বেজে গেল। মা দেখেই হা করে তাকিয়ে রইল, কি ব্যাপার তুই কোথা থেকে কেমন করে? ভাগ্য ভাল বাবা অফিসে চলে গেছে। বলছি বলছি সবই বলছি। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে মার সাথে নাস্তার টেবিলে বসে আলাপ হলো। জাহাজ আমস্টারডাম যাবার আগে হঠাৎ করে রিলিভার চলে এলো বলে এসেই পরলাম আগামী মাসের শেষ দিকে আবার চলে যাব। ও আচ্ছা, ভাল হয়েছে। ওদিকে তোর বাবা রায়হান ভাইকে বলে রেখেছে সামনের মাসে তুই আসবি। রায়হান চাচাকে আমার আসার কথা জানাবার এমন কি প্রয়োজন?
বারে! তাকে জানাব না তো কাকে জানাব? কি বলছিস তুই? এবারে তুই আসার পরই কাজলকে নিয়ে আসার কথা ভাবছি আমরা সবাই আর তুই কি বলছিস?
কেন কাজল কি কখনও এ বাসায় আসেনি?
সে আসা এ আসা কি এক হলো?
দুই হলো কি করে? মা তোমরা যা ভাবছ তা হবার নয়!
কেন কি হয়েছে? হবে না কেন?
সে অনেক কথা কাজেই এমন করে এখনই কিছু ভাববে না এবং চাচার সাথেও এ ব্যাপারে কিছু আলাপ করবে না। মনে থাকে যেন! আমি এখন একটু বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে।
কোথায় যাবি?
এইতো কাছেই!
তাড়াতাড়ি ফিরবি।
আচ্ছা চেষ্টা করব!

বাসা থেকে বের হয়ে একটা স্কুটার নিয়ে সোজা সোবহান বাগ বাস স্ট্যান্ডের পাশে বীণা আপার বাড়িতে। এখানেও দুলাভাই বাড়ি নেই। এই সময়ে পুরুষ মানুষ কেইবা বাড়ি থাকে!
বীণা আপাও মায়ের মত অবাক, কি ব্যাপার নিশাত কবে আসলি? তুই না বলে গেলি জানুয়ারিতে আসবি!
আজই সকালে আসলাম, হ্যাঁ বলেছিলাম আগামী মাসে আসব কিন্তু চলে আসলাম, কোম্পানির খরচে যাতায়াত কিনা
ও আচ্ছা!
কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর, আচ্ছা আপা নিরু কোথায়?
ওতো বাড়িতে! ক্লাস বন্ধ তাই। এইতো কয়েকদিন আগেই চলে গেল, এ কয়দিন এখানেই ছিল বাবা এসে নিয়ে গেছে!
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আজই মানিকগঞ্জে যেতে হবে। আমি তাহলে চলি আপা!
সে কি?এতদিন পরে আসলি কিছু খেয়ে যা!
না আপা আজই আসলাম তো একটু কাজ আছে, মতিঝিলে যেতে হবে।
বীণা আপা কি বুঝল কে জানে!
বাসায় ফিরে এসে একটা ব্যাগ গুছিয়ে সোজা গুলিস্তান বাস টার্মিনাল। ব্যাগ গোছাবার সময় মা জিজ্ঞেস করেছিল: কিরে কোথায় যাচ্ছিস? এইমাত্র এসেছিস এখনই আবার কোথায় যাবি?
একটু বাড়ি যাব মা
দুই একদিন পরে যা
না আজই যাই
মানিকগঞ্জের শুভ যাত্রা কোচ কোথায় থেকে ছাড়ে নিশাত ভাল করেই জানে। বিকেলের আগেই বাড়ি পৌঁছে গেল।

মইন চাচা দেখেই অবাক,
কিরে নিশাত তুই কবে এসেছিস?
এইতো কাকা আজই এসেছি। শিহাব কি বাড়িতে আছে?
আছে বাড়িতেই আছে, একটু আগে এখান থেকে গেল
চলনা চাচা একটু শিহাবের সাথে দেখা করে আসি
এত ব্যস্ত হবার কি আছে, মাত্র এসেছ বিশ্রাম নাও খাওয়া দাওয়া কর সন্ধ্যার আগে গেলেই হবে
না চাচা তুমি চল ওদের ওখানেই যা আছে খেয়ে নিব
বাড়িতে শিহাবের সাথে দেখা হলেই নিরুকে পাওয়া যাবে।
চল, বলেই হাটা শুরু করল।
শিহাব মইন চাচার ওখান থেকে এসে বাগানের কাজ শুরু করেছে, হাতে একটা প্রুনার। দূর থেকে মইন চাচা আর নিশাতকে দেখে প্রুনার হাতেই এগিয়ে গেল আরে নিশাত কবে এসেছিস? কেমন আছিস?
ভাল আছি! আজ সকালেই এসেছি, তোরা কেমন আছিস?
আমরাও ভাল গত কয়েক দিন একটু ব্যস্ত ছিলাম নিরুকে দেখতে এসেছিল তাই
কথাটা শুনেই নিশাতের বুকে ধক করে উঠল, কি বললি, কাকে দেখতে এসেছিল?
ওইতো নিরুকে
নিশাত এতক্ষণে বুঝতে পারে। সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। স্বপ্নে দেখা, চিঠি এবং ঢাকায় না থাকার সব কিছু এক এক করে নিশাতের চোখার সামনে ভেসে এলো। একই সূত্র। এখনই ওর সাথে দেখা করতে হবে।
আচ্ছা শোন, তুই ভিতরে চাচীদের বল আমার ক্ষুধা পেয়েছে কিছু খেতে দিতে বল।
নিশাত জানে এখন কোন চাচীই ওকে ভাত বেড়ে দিবে না, এখন একমাত্র নিরুই আসবে ওকে ভাত বেড়ে দেয়ার জন্য আর এটাই একমাত্র সুযোগ।
চাচীরা সবাই ব্যস্ত আমি নিরুকে বলছি
যা তাড়াতাড়ি কর
শিহাব বাড়ির ভিতরে গিয়ে সম্ভবত নিরুকে কিছু বলে আসল একটু পরে নিরু এসে শিহাবের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল আসুন ভিতরে আসুন।

নিশাত উঠে নিরুর সাথে খাবার ঘরে গেল
নিরু
সারা রাত জার্নি করে এই সময়ে এখানে আসা এমন কি জরুরী ছিল? কাল আসলে কি হতো?
তুমি এমন করে স্বপ্নে দেখা দিচ্ছ বারবার, চিঠিতে একই কথা লিখছ, আসব নাতো কি করব? সিঙ্গাপুর থেকে যে চিঠি পেয়েছি তাতে যা লিখেছ দুবাই যেয়ে যে চিঠি পেলাম তাতেও ওই একই কথা
আমি আপনার কে হই যে আমাকে এত স্বপ্নে দেখবেন?
না তুমি আমার কিচ্ছু হও না, খুশী হয়েছ এবার?
আমার খুশীতে কার কি আসে যায়?
তুমি জান না কার কি আসে যায়? তুমি সামনে পরীক্ষা রেখে এখানে এসেছ কেন, তাই বল
কেন আবার? এই জন্যেইতো বারবার লিখেছি দুলাভাইকে জানাতে। তাছাড়া আমিতো আসতে বলিনি, আমি বলেছি দুলাভাইয়ের সাথে আলাপ করতে, ফোনে আলাপ করে কথাটা বলে দিলেই হত না? নয়ত চিঠিতে লিখলেই হতো
কথা বলবে নাকি খেতে দিবে? ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে, এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যেয়ে নাস্তা করেছি এর পরে আর কিছু খাইনি
দিচ্ছি, খেয়ে নেন
কি রান্না হয়েছিল?
করল্লা ভাজি, টেংরা মাছ আর ডাল আছে
করল্লা ভাজি!
হ্যাঁ, আমি রান্না করেছি
ও আচ্ছা তাহলে দাও
নিশাত সাধারণত করল্লা ভাজি খায় না কিন্তু নিরু ভাজি করলেই শুধু খেতে পারে। খেতে খেতে কথা হচ্ছিল।
বল দেখি কি ব্যাপার?
ব্যাপার আর কি, যা হবার তাই, ঘিওর থেকে এক ডাক্তারের বাবা লোকজন নিয়ে এসেছিল, ছেলে নাকি হোলি ফ্যামিলিতে ডাক্তারি করে। আগে থেকে দুলাভাইকে বলে রাখলে এসব ঝামেলা হতো? কতবার বলেছি তা আমার কথায় তিনি কানই দিলেন না
তারা কেন এসেছিল?
কেন এসেছিল তাও বলে দিতে হবে?
তুমি কিছু বলনি?
কি বলব? আমি আপনার ভাতিজা নিশাতকে ভালবাসি আর নিশাত আমার সাথে প্রেম করে বলে এ বিয়েতে মত দিতে পারছিনা, তাই বলব?
কি যা তা বলছ, এই শোনার জন্য আমি দুবাই থেকে এসেছি? এক ফাঁকে এদিক ওদিক দেখে নিরুর হাত ধরে
নিরু!
বলেন
ঘটনা জটিল বুঝতে পারছি, কিন্তু তুমি কি বলেছ সত্যি করে বল
আমি বলেছি, পরীক্ষার আগে কিছু ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব নয়
বেশ করেছ, তাহলে এখন কি করতে হবে বল
মা বা চাচী কেউ এসে পরবে আপনি খেয়ে নেন পরে বলছি।
খাবার শেষ করে নিশাত শিহাবের ঘরে এসে বসল। শিহাব তখনও বাগানেই কাজ করছে চাচা পাশে বসে আছে। একটু পরে নিরু খাবার ঘরের সব কিছু গুছিয়ে রেখে এ ঘরে এসে সেই ছোট বেলার মত খুটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
নিশাত আস্তে করে বলল,
তুমি কালই আমার সাথে ঢাকা চলো।
ঢাকা যেয়ে কি হবে?
একটা পথে খুজে পেতে হবে না?
পথ খুজতে হবে না, শুধু দুলা ভাইকে বললেই হবে
তাতেওতো ঢাকা যেতে হবে
আচ্ছা মাকে বলে দেখি

ঝিটকা পর্যন্ত শিহাব এবং নিরুর ছোট ভাই তমাল সাথে এলো। বাসে উঠিয়ে দিয়ে তমাল নিচে দাঁড়িয়ে বোনের সাথে কথা বলছিল। নিশাত নিচে দাঁড়িয়ে শিহাবের সাথে কথা বলছিল
এবারে কতদিন থাকবি?
নারে, বেশিদিন থাকা যাবে না, যাবার টিকেট দিয়ে দিয়েছে সাথে। জানুয়ারির ২৬ তারিখে চলে যাব।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৫

আবার বিদায়, আবার বিরহ। তবে এবারের বিরহ আগের দিন গুলির মত নয়। একটু ভিন্ন রকমের। এতদিন দুজনে ভিন্ন ভাবে দুজনার কথা ভাবত কিন্তু এবার তাদের চলা পথ সম্ভবত একই স্রোতে মিশে যাবার পথ খুঁজে পেয়েছে।

যাবার আগে একদিন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের এক বেঞ্চে বসে নিরুর কাঁধে হাত রেখে বলল নিরু তুমি চিঠি লিখতে পারবে?
কেন?
কেন মানে? মানুষে চিঠি লিখে কেন?
যারা চিঠি লিখে তাদের একটা নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকে কিন্তু আপনার কি তেমন কিছু আছে? এ দেশ থেকে ওই দেশে ঘুরে বেড়ান আপনার কাছে চিঠি লিখব কোথায়? সাগরের ঠিকানায় লিখে পাঠাব আর সে চিঠি সাগর জলে ভেসে বেড়াবে? কোন সাগরের ঠিকানায় লিখব বলে যান
নিশাত এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেল। তাইতো কোন ঠিকানায় চিঠি লিখবে?
আমি কখন কোথায় থাকি সে ঠিকানা জানিয়ে আমি লিখব আর তুমি সেখানে লিখবে। যদিও সে চিঠি আমি কবে পাব তার কোন ঠিক নেই তবুও দেরিতে হলেও আমি তোমার ছোঁয়া মাখা চিঠিটা পাব এবং আবার কিছুদিন চলার শক্তি পাব।
বেশ তাই করবেন কিন্তু আমার কাছে লিখতে কোথায় লিখবেন?
কেন, আপার বাড়িতেই লিখব
আপা কি মনে করবে?
কেন মনে করবে?
আপা আপনাকে খুব স্নেহ করে কিন্তু চিঠি পত্র দেখলে যদি বিরূপ কিছু ভেবে নেয়?
না, আপা সে সুযোগ পাবে না, তার মনে করার মত কোন কাজই আমি করব না। তোমার কাছে যে চিঠি লিখব সে চিঠি ইচ্ছে করলে তুমি আপাকেও দেখাতে পারবে, আমি এমন করেই লিখব।
তাই কি হয়?
হবে, দেখবে এতে ভালই হবে তুমি মাঝে মাঝে তোমার চিঠিগুলি আপাকে পড়তে দিও আর হ্যাঁ আমিও আপা দুলাভাইকে মাঝে মাঝে লিখব।
এমন হলে লিখতে পারেন।

এভাবেই নিশাত কয়েকটা ভয়েজ করে ফেলল। প্রতিটি ভয়েজ শেষে দেশে এসেই আগে নিরুকে চোখে দেখার জন্য ছুটে এসেছে বীণা আপার বাড়ি। আর কেউ কিছু না বুঝলেও হয়ত বীণা আপা কিছু অনুমান করেছে। এখন আর নিরুকে হারাবার ভয় নেই। যখন যে দেশেই গেছে সেখানে বন্দরে পৌছার আগেই চিঠি লিখে খামে ভরে রাখত, মুখ আটকাত না যেন পোস্ট করার আগে সর্বশেষ কথাটা নিরুকে জানান যায়। কবে কোন বন্দরে গেছে সে দেশ কেমন, সে বন্দর বা শহর কেমন, লোকজনের পোশাক আসাক থেকে শুরু করে তাদের খাবার দাবার এবং যাবতীয় বৃত্তান্ত সহ জাহাজে কবে কি করেছে কি খেয়েছে এই সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখতে লিখতে সে চিঠি কখনও বিশ পাতা পর্যন্ত হয়ে যেত। পরের চিঠি কোন ঠিকানায় লিখবে সে এজেন্টের ঠিকানা দিয়ে দিত সাথে। নিরুর চিঠির সাথে আপা বা দুলাভাইকেও কিছু লিখতে কখনই ভুল করত না। আপা বা দুলাভাইকে লিখত নিরুর চিঠিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি ওর চিঠি দেখে নিবেন। দুলাভাইকে কখনও ইউরোপিয়ান মেমসাহেবদের কাহিনী লিখত। আবার মাঝে মাঝে ইয়ার্কিও করত, দুলাভাই আপনি সাথে থাকলে একজন মেমসাহেব কিনে দিতে বলতাম। যখন যেখানে গেছে নিরুর জন্য কিছু না কিছু কেনাকাটা করবেই। কখনও দেখা গেছে নিরুর জন্য যা কিনেছে তাই দিয়েই ওর এয়ার টিকেটে ফ্রি লাগেজ এলাউন্স যা পেত তার অর্ধেক হয়ে গেছে। দেশে এলে নিরুকে সেগুলি দিতে গেলে কখনও নিরু কিছুই নিত না। বলত
কেউ জিজ্ঞেস করলে কাকে কি বলব? এ নিয়ে আমি কাউকে কোন কৈফিয়ত দিতে পারব না।
নিশাত অনেক পিড়াপিড়ি করেছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। নিরুর ওই এক কথা। সেবার প্যারিস থেকে একটা পারফিউম এনে বলেছিল
এটাতো কেউ দেখবে না এটা অন্তত নাও।
আসলেই আপনার মাথা খারাপ।
মাথা খারাপের কি হলো?
বলে নিশাত নিরুর মুখের দিকে চেয়েছিল আর নিরু বলেছিল
এর গন্ধ আমি ঢেকে রাখব কি দিয়ে? এ কথা কবে বুঝবেন আপনি?শুধু শুধু এত খরচ করেন কেন? এসব আজে বাজে খরচ না করে টাকা জমাবেন ভবিষ্যতে কাজে লাগবে, মনে যেন থাকে
নিশাত ও কথায় কান না দিয়ে সেগুলি এনে যত্ন করে তার ওই আলমারিতে তুলে রাখত আর ভাবত নিরু যেদিন নিজে এই আলমারির তালা খুলে এগুলি নিবে সেদিনই ও ব্যবহার করবে এর মধ্যে পচে গলে যা হয় হোক এগুলি নিরুর।

গত কয়েকটা ভয়েজে নিশাতের বেশ উন্নতি হয়েছে। লন্ডনে পরীক্ষা দিয়ে সেকেন্ড অফিসার হয়েছে। পাশ করল যেদিন সেদিন মা বাবা এবং বীণা আপা দুলাভাই সহ নিরুকে একসাথে চিঠি লিখে জানিয়েছিল। বীণা আপার বাসায় ফোন করে নিরুর সাথে কথা বলেছিল। আর মাত্র আড়াই বছর পরেই চিফ মেট পরীক্ষা দিব। নিরু তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করবে যেন আমি সুস্থ থেকে দিনগুলি কাটাতে পারি। আর তুমিও ভাল করে পড়াশুনা করবে। আর হ্যাঁ গানের ব্যাপারে কিন্তু আলসেমি করবেনা। দেখবে একদিন আমি সব পাব। তখন তোমাকে নিয়ে শুধু ঢাকা নয় পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরে বেড়াব। তুমি আমার পাশে থাকবে। তোমার হাত ধরে চলে যাব অনেক দূরে যেখানে চির বসন্ত থাকে সেই দেশে। আমাদের দেখে আকাশের তারারাও হেসে হেসে আমন্ত্রণ জানাবে। যেখানে থাকব শুধু তুমি আর আমি।
এমন করে তোমার কিছু মনে হয় না নিরু?
হয়, আমারও অনেক কিছু মনে হয় কিন্তু আমারযে ভীষণ ভয় করে!
কিসের ভয়? কোন ভিয় নেই। দেখবে একদিন আমাদের সব হবে।

১৬।
এমনি করে সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, মান অভিমান, বিরহ বিরাগ নিয়ে দিন মাস বছর চলে গেল। এর মধ্যে নিশাত চিফ মেট পরীক্ষায় পাশ করেছে কিন্তু কোম্পানির কোন জাহাজে আপাতত চিফ মেটের পদ খালি নেই বলে ওই পদে পোস্টিং পাচ্ছে না তবে চিফ মেট এর বেতন পাচ্ছে। এক সময় সপ্তম ভয়েজের মাঝামাঝি একদিন নিশাতের সারা রাতে ঘুম হয়নি। মাত্র শেষ রাতের দিকে একটু চোখ লেগে আসছিল, এর মধ্যেই কোথা থেকে যেন নিরু এসেছিল। সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আজ সকালে দুবাই থেকে পাওয়া চিঠির মত একই ভাষায় বারবার করে বলে গেল আপনি দুলাভাইকে বলবেন। আমার মনে হয় এখন অন্তত দুলাভাইকে বলার সময় হয়েছে। দুবাই পোর্টে হারবারে জাহাজ ভিড়ার পর এজেন্টের গাড়ি এসে যে মেইল ব্যাগ দিয়ে গিয়েছিল তাতে একটাই চিঠি ছিল আর সেটা নিরুর লেখা নিশাতের চিঠি। এই চিঠিতেও অন্তত পাঁচ বার লিখেছে আপনি তাড়াতাড়ি দুলাভাইর সাথে যোগাযোগ করে কথাটা বলুন নতুবা আমি শেষ হয়ে যাব আর এজন্যে একমাত্র আপনিই দায়ী থাকবেন। কেন এবং কি বলতে হবে তা কিছু লেখেনি। না লিখলেও নিশাত জানে কি বলতে হবে। স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়েই চলে গেল এবার দেশ থেকে আসার আগে যখন নিরুর সাথে নবাব বাড়ির বাগানের এক পাশে বেঞ্চে বসে চিনাবাদাম খাবার সময় কথা হচ্ছিল সেখানে। আগের মত নিরু একটা একটা করে চিনা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছিল।
আপনি কি কোন দিন নিজে ছিলে বাদাম খেতে পারবেন না?
হয়ত পারব যেদিন তুমি করে বলতে পারবে। আসলে হয়েছে কি জান, ওসব দেশে লবণ দিয়ে ভাজা বাদাম প্যাকেট করা থাকে কাজেই দোকান থেকে কিনে অমনিই খেয়ে ফেলা যায়, আবার এখানে আসলে তুমিইতো ছিলে দাও, কাজেই আমাকে আর কোথাও ছিলে খেতে হয় না
ছেলা বাদাম হাতে দেয়ার সময় একটা চিমটি দিয়ে বলেছিল
তাহলে আর আপনার এ দেশে আসার দরকার নেই ওখান থেকেই কোন মেমসাহেব নিয়ে এলেই পারেন আমরাও একজন মেমসাহেব দেখতাম!
উহ কি হলো চিমটি দিলে কেন, লাগেনা? বেশতো আমি না হয় মেমসাহেব আনলাম কিন্তু তুমি কাকে আনবে? তাছাড়া তোমার মেম সাহেব কি বাদাম ছিলে দিবে?
বাদাম ছিলায় মগ্ন হয়ে বলল
আমার কাউকে লাগবে না! যে মেম সাহেব বাদাম ছিলে দিবে তাকেই আনবেন!
আচ্ছা তাকেই আনব।
সেদিন সারা দিন একসাথে ঘুরেছিল। দুপুরে ম্যান্ডারিনে লাঞ্চ করেছিল আবার বিকেলে নবাব বাড়ি থেকে বাদাম তলি এসে নৌকায় করে বুড়িগঙ্গায় ঘুরেছিল। কোথা দিয়ে যে সারাটা দিন চলে গেল টের পায়নি। বুড়িগঙ্গায় সূর্য ডুবতে দেখে নিরু চমকে উঠেছিল। নিশাতের হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিল,
তাড়াতাড়ি চলেন আমাকে সন্ধ্যার আগেই হলে ফিরতে হবে বলে এসেছি।
এমএসসি ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে বলে পরীক্ষা পর্যন্ত হলে থেকে পরীক্ষা দিবে বলে হলে এসে উঠেছে। বিগত দিনগুলিতে দুইজনে ঢাকা শহর এবং এর আশেপাশে এমনি করে অনেক ঘুরেছে। সাভারের স্মৃতিসৌধে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে, সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে, আরিচা ঘাটের কাছে পদ্মা নদীর পাড়ে। সোহরাওয়ার্দি উদ্যান থেকে ফেরার পথে একবার শাহবাগের নিচে সুপর্ণা থেকে একটা পারফিউম কিনে দিয়েছিল। আগের মত নিরু এটাও নিতে চায়নি কিন্তু নিশাতের চাপাচাপিতে নিতে হয়েছিল। এটা কি আর কেউ দেখবে! তোমার হলে রাখবে কেউ দেখবে না। যখন গায়ে মাখবে এর সুগন্ধ আমার কথা মনে করিয়ে দিবে। মনে করবে আমি সারাক্ষণ তোমাকে জড়িয়ে রেখেছি।
এই পারফিউম মেখে আপনাকে মনে করার দরকার হবে না। এমনিই সবসময় আপনি আমার সাথে থাকেন। বলছেন কেউ দেখবে না! জানেন হলের বান্ধবীরা কেমন হয়? ধারনা আছে কিছু? ওরা একেকটা বিচ্ছুর মত বিশেষ করে রোকেয়া আর নীলাতো জোকের মত লেগে থাকবে, বল না কোথায় পেলি! জানেন?
১৭।
দুবাই থেকে জাহাজ আমস্টারডাম যাবার আগে অস্থির হয়ে সাইন অফ করে শুধু নিরুর জন্য দেশে ছুটে এসেছিল চৌকস সেকেন্ড অফিসার নিশাত জামান যে কিনা আর কয়েকদিন পরেই এমনি এক জাহাজের চিফ অফিসার হবে। ক্যাপ্টেন স্টিভ বারবার বলছিল
জামান তুমি আমস্টারডাম যাবার পর সাইন অফ কর!
না, সে কথা মানেনি। তাকে শুধু বলেছিল
দেখ স্টিভ, তুমি প্লিজ আমাকে বাধা দিও না, যে করেই হোক নিরুকে আমার চাই ই চাই ওকে ছাড়া আমার জীবন ভাবতে পারিনি কোনদিন।
ক্যাপ্টেন স্টিভ অবাক হয়েই বলেছিল
‘হু ইজ নিরু?’
ওহ স্টিভ সরি! আমি তোমাকে বেফাঁস বলে ফেলেছি। নিরু ইজ মাই ডার্লিং এন্ড মাই ড্রিম এন্ড আই কেন নট সারভাইভ উইদাউট নিরু! গত কয়েকদিন থেকেই আমি ওকে স্বপ্নে দেখছি আর এখানে আসার পর ওর চিঠিতে জরুরী এক সংবাদ জেনেছি!
আই মিন ইউ আর টেলিং এবাউট ইয়োর লাভ এফেয়ার? যার ছবি তোমার কেবিনে সাজান রয়েছে?
ইয়েস স্টিভ, ইউ আর রাইট!
ও! রিয়েলি সি ইজ এ নাইস লেডি!
বেটার ইউ আসক ফর এনাদার সেকেন্ড অফিসার এন্ড রিলিজ মি। আই উইল জয়েন আফটার এ মন্থ হোয়েন ইউ উইল বি ইন লন্ডন!
ঠিক আছে জামান তুমি যাও আমি তোমার টিকেটের ব্যবস্থা করছি। আর দেখি ইরান বা ইন্ডিয়া থেকে কোন সেকেন্ড অফিসার পেলে তাকে দিয়ে এই এক মাস চালিয়ে নিচ্ছি তবে তুমি জানতো আমস্টারডাম থেকে আমরা মাইনর রিপেয়ারের জন্য লন্ডন যাব এবং তুমি কিন্তু আমরা লন্ডন ছেড়ে যাবার আগেই ফিরে আসবে।
হ্যাঁ ঠিক আছে তুমি দরকার মনে করলে আমার টিকেট ওই ভাবে করিয়ে নিতে পার দুবাই-ঢাকা-লন্ডন।
আচ্ছা জামান ঠিক আছে আমি তাই করছি। উইশ ইয়োর বেস্ট লাক এন্ড হ্যাভ আ নাইস টাইম উইথ নিরু।

সঙ্গে সঙ্গে দুবাইর এজেন্ট ইউসুফ বিন আহমেদ কানুর অফিসে রেডিওতে জানিয়ে দিয়েছিল।
আমাকে জরুরী ভাবে একজন সেকেন্ড অফিসার দাও, এখানে থাকতেই যেন পাই আর নিশাত জামানের জন্য দুবাই- ঢাকা-লন্ডন একটা টিকেট করে দাও ঢাকা ডিপার্চার হবে এক মাস পর।
ওকে ক্যাপ্টেন।
ঠিক তিন দিন পরের একটা তারিখে নিশাতের ঢাকা যাবার টিকেট পাঠিয়ে দিল তার পর দিন এবং তার পর দিন ইন্ডিয়ান এক সেকেন্ড অফিসার এলো নিশাতের জায়গায়। টিকেট হাতে নিয়ে দেখে পরশু রাতে বিমানের ফ্লাইটে ঢাকা যাবে এবং আগামী জানুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে বিমানের ফ্লাইটে আবার দুবাই ট্রানজিট হয়ে গালফ এয়ারে লন্ডন। সময়মত সাইন অফ করে সিডিসিটা নিয়ে সন্ধ্যায় এজেন্টের গাড়িতে দুবাই এয়ারপোর্টে চলে এলো। সারাক্ষণ একটা কথাই মাথায় ঘুরছে, হঠাৎ নিরু এতোটা ব্যস্ত হলো কেন? এমন কি হয়েছে? নিরু ভাল আছেতো? গত দুই বছর ধরেই নিরু বলছে আপনি দুলাভাইকে বলুন। কিন্তু নিশাতই বলতে পারছিল না, ভেবেছিল চিফ অফিসার না হয়ে নিরুকে আনবে না। যতবার ঢাকায় গেছে প্রতিবারেই সিঙ্গাপুর থেকে কেনা ইয়াশিকা ইলেক্ট্রো ৩৫ জিএসএন ক্যামেরা দিয়ে অনেক ছবি তুলেছে এবং তখন দেশে রঙ্গিন ছবি ওয়াস প্রিন্ট হতোনা বলে সিঙ্গাপুর কিংবা মিডল ইস্টের কোথাও থেকে প্রিন্ট করিয়ে নিত। ছবিগুলি নিরুকে দেখাবার পর সব নিশাতের আলমারিতে যত্নে রেখে দিয়েছে। কিছু ছবি নিয়ে যেত সাথে করে। জাহাজে ওর রুম সাজাত নিরুর ছবি দিয়ে। সাত বছরের ছবি গুলো বছর অনুযায়ী ভাগ করে করে সাজাত। বিয়ের পর সবাইকে এই ছবি দেখিয়ে চমকে দিবে বলে দেশে কাউকে এই ছবি দেখাত না।

দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে টেক অফ করার পর রাতের ডিনার সার্ভ করল। তার পরে প্লেনে বসে পাঁচটি ঘণ্টা ধরে এক নিরু ছাড়া আর কোন চিন্তা মাথায় আসেনি। দূর সম্পর্কের চাচার মেয়ে নিরুকে কাছে থেকে দেখার কথা আজও ভুলেনি। নিশাত যখন সবে মাত্র ক্যাডেট হিসেবে জাহাজে জয়েন করতে লন্ডন যাচ্ছে। নিরু তখন কলেজে ভর্তি হবে। দেখা অনেক হয়েছে। একই গ্রামে পাশাপাশি বাড়ি। যদিও নিশাতের বাবা চাকুরী উপলক্ষে করাচী সহ বিভিন্ন শহরে বসবাস করে কিন্তু গ্রামে নিয়মিত যাতায়াত আছে। জমিজমা দেখতে হয়, শীতের খেজুর রস, পিঠা, আম বাগানের আম খেতে হয় তাছাড়া ঈদ পার্বণে গ্রামে আসতেই হয়। তখন অনেক দেখেছে কিন্তু কখনও তেমন করে চোখে পড়েনি।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৪

ওখান থেকে বের হয়ে সোজা চলে এলো সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। কিছুক্ষণ হাটা হাটি করে একটা নির্জন বেঞ্চ দেখিয়ে বলল এখানে বসবে?
না বসলে হয় না?
কেন হবে? আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরব সারাদিন বেড়াব চাইনিজ খাব তারপরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরব
বলেই নিরুর হাত ধরে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল
আপা দুলাভাই কি ভাববে?
যা ইচ্ছা হয় তাই ভাবুক
পাশে দিয়ে এক বাদাম ওয়ালা যাচ্ছিল তাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল বাদাম খাবে? বলে কোন জবাবের অপেক্ষা ন করে ছেলেটাকে ডেকে কিছু বাদাম কিনল। বাদামের ঠোঙ্গা নিরুর হাতে দিয়ে বলল নাও ছিলে দাও
নিরু ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে হতভম্বের মত বসে রইল। বলে কি এই মানুষটা। একটু বসে থেকে আবার কি মনে করে দুই একটা বাদাম ছিলে দিয়ে ঠোঙ্গাটা এগিয়ে দিয়ে বলল
নেন নিজে হাতে বাদাম ছিলে খেতে ভাল লাগবে।
নিশাত একটু অবাক হয়ে বলল
কি হলো, খুব কঠিন নাকি বাদাম ছেলা?
না কঠিন কিছু নয় তবে আমার ভাল লাগছে না
থাক ভাল না লাগল তবুও তুমি ছিলে দাও আমি এই কাজটা মোটেই পারি না বলে আমার বাদাম খাওয়া হয় না
আচ্ছা ঠিক আছে দেন ছিলে দিচ্ছি
ছিলে দিচ্ছি মানে কি! তুমি খাবে না? তুমিও খাও, আমি কি বলেছি শুধু আমাকেই ছিলে দিবে?
আচ্ছা বললামতো দিচ্ছি
হাতের ক্যামেরা দিয়ে নিরুর কয়েকটা ছবি নিয়ে নিল। ছবি তোলা নিয়েও নিরুর আর পশলা বাগরা। কেন ছবি তুলবেন, যদি আপনার কাছে কেউ এই ছবি দেখে ফেলে তাহলে কেমন হবে!
কি বলছ তুমি! আমি কি সবাইকে নিয়ে এই ছবি দেখাব ভেবেছ? এগুলি শুধু আমার কাছেই থাকবে তবে তুমি চাইলে দেখতে পার বা নিতেও পার
না আমার এ ছবি নিতে হবে না
তাহলেতো আর কোন কথাই নেই
বাদাম খেতে খেতে ঘড়ি দেখে বলল একটা বেজে গেছে চল লাঞ্চ করব
না লাঞ্চ করতে হবে না চলেন বাসায় চলেন আপা চিন্তা করবে
কিচ্ছু চিন্তা করবে না, আপা জানে তুমি আমার সাথে রয়েছ এবং এই ঢাকা শহর আমি খুব ভাল করেই চিনি কাজেই তার বোনের হারিয়ে যাবার ভয় নেই, চল ওঠ

নিরু একটু কিন্তু কিন্তু করে শেষ পর্যন্ত নিশাতের পিছে হাটা শুরু করল
সোহরাওয়ার্দি উদ্যান থেকে রমনা পার্কের দিকের গেট দিয়ে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে নিউ মার্কেটের পাশে মিড নাইট সান এ এসে রিকশা থেকে নেমে ভিতরে গিয়ে বসল।
বল কি খাবে
আপনার যা ইচ্ছা
আচ্ছা বলে ওয়েটারকে ডেকে নিশাতই অর্ডার দিয়ে দিল
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলে জিজ্ঞেস করল
বল আজকের এই দিনটা তোমার কেমন লাগছে
জানিনা
বলনা কেমন লাগছে
বললামতো জানিনা
আচ্ছা ঠিক আছে আমার কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করবে না?
বলেন
আমার খুব ভাল লাগছে
কেন?
কেন আবার কি এই যে তুমি সাথে আছ তাই।
আমি সাথে থাকলেই কি ভাল লাগবে?
যেদিন নোমান ওই কথা বলেছিল সেদিন থেকে বুঝতে পারছি আমি তোমার সংস্পর্শে এলে ভাল থাকি মানে আমার ভাল লাগে
থাকেনতো বাইরে বাইরে আমার সংস্পর্শ কোথায় পেলেন?
কেন এই যে এখন তুমি আমার পাশে আছ। কত দিন পরে তোমাকে এই প্রথম একা পেয়েছি! ভুল বললাম আমার মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম তোমাকে একা পেলাম। আমার কি মনে হচ্ছে জান? আমার মনে হচ্ছে আমার আর কিচ্ছু চাই না, শুধু তুমি আমার পাশে থাকলেই হবে।
সেই ছোট বেলা থেকে দেখে আসা সহজ সরল এই মানুষটার এমন আকুতি ভরা কথা শুনে নিরুর মন ভিজে গেল। এখন বুঝি তার এত দিনের অপেক্ষার পালা শেষ হতে চলেছে অনুমান করে চোখ দুটিও কেমন যেন ভিজে এলো এবং একটু পরেই চোখ বেয়ে এক ফোটা জল হাত ধরে রাখা নিশাতের হাতের উপর পরল আর অমনিই নিশাত চমকে উঠে নিরুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল সে কি! তুমি কাঁদছ কেন? কি হলো নিরু! কাঁদছ কেন? রাগ করেছ? বল, নিরু বল কি হয়েছে?
বলেই নিরুর ওড়না দিয়ে চোখ মুছে দিল। আস্তে করে নিরু নিশাতের হাত সরিয়ে বলল
না কিছু হয়নি।
রাগ করেছ?
না
তা হলে!
নিশাতের দিকে তাকিয়ে বলল
আপনার মত মানুষের সাথে কি কেউ রাগ করতে পারে?
তাহলে?
বললামতো কিছু না
বলনা কি হয়েছে
এখন কাঁদছি না, এতদিন কেঁদেছি। জানেন সেই যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছি, সেদিন থেকেই আপনার মুখ থেকে এই কথা শোনার অপেক্ষায় রয়েছি।
তাহলে এতদিন বলনি কেন?
হঠাৎ করেই নিরু মুখ তুলে হেসে দিয়ে বলল সত্যিই আপনি বড়ই সরল মানুষ, কিছুই বোঝেন না। এই কথা কি মেয়েরা বলতে পারে?
মনে মনে বলল আপনি জানেন না আপনার এই সরলতার জন্যই আপনাকে আমার এত ভাল লাগে সারাক্ষণ আপনার জন্য মন এত উতলা থাকে, এতদিন আপনার পথে চেয়ে অপেক্ষায় ছিলাম।
১৫।
এর পরে নিশাত যতদিন দেশে ছিল প্রায় প্রতিদিন নিরুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস কবে শুরু হবে সেই রুটিন জানার জন্য বা ভিন্ন কোন অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে দুই জনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে একসময় নিশাতের যাবার দিন ঠিক হয়ে গেল। কোথা দিয়ে যে দিনগুলি চলে গেল বোঝা গেল না। মনে হলো যেন ঝরের গতিতেই দিন চলে গেল। এত দিনের সঞ্চিত যত কথা সব যেন পাখির মত মুখোমুখি বসে এক এক করে কত কি বলতে চেয়েও সব বলা হলো না কত বাকি রয়ে গেল। একদিন আরিচা ঘাটের কাছে পদ্মা নদীর পাড়ে বসে ঢলে পড়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে নিশাত বলছিল নিরু একটা গান গাও
জানেন না আমি গান জানি না
কেন ওই যে সেদিন তোমাদের বাড়িতে কুয়োর পাড়ে বাসন মাজার সময় গাইছিলে
কবে?
সে অবশ্য অনেকদিন আগের কথা, তুমি তখন স্কুলে পড়
কি জানি আমার মনে নেই, আচ্ছা কোন গান?
নিঝুম সন্ধ্যায় শ্রান্ত পাখিরা……
হ্যাঁ ওটা আমার প্রিয় গান তবে এখন মনে নেই আর তাছাড়া সেই কবে কি গুনগুন করেছিলাম এখনও কি তাই মনে থাকে?
দেখনা চেষ্টা করে, সেদিন কিন্তু আমি তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে গানটা শুনেছিলাম, কি যে ভাল লাগছিল, আমি আজও ভুলিনি। এখনো আমার কানে সেই সুর লেগে আছে।
কি জানি আমার কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না।
আচ্ছা থাক, অনেকদিন আগের কথা মনে না থাকলে নেই। তুমি গান শিখ নিরু আমি ওস্তাদের ব্যবস্থা করে দিব।
গান আপনার এত ভাল লাগে?
হ্যাঁ নিরু, সুর আমাকে পাগল করে দেয়
আমার চেয়েও গান প্রিয়?
নিশাত স্তব্ধ হয়ে নিরুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল
কি হলো এমন করে কি দেখছেন?
তোমাকে দেখছি! কি বললে তুমি?
আমার চেয়েও গান প্রিয়?
শোন, গানের জায়গায় গান আর তোমার জায়গায় তুমি। তোমার সাথে এই পৃথিবীর আর কোন কিছুর সাথে তুলনা করবে না কখনও
আচ্ছা ঠিক আছে আমি নিজেই গান শিখব, সেদিন আপাও বলছিল গান শিখব কিনা তাহলে ছায়া নটে ভর্তি হতে বলেছিল। ছায়া নটের টিচার আফরিন মজুমদার আপার প্রতিবেশি
তাহলে তুমি ছায়ানটে ভর্তি হও, তোমার এত সুন্দর কণ্ঠ তুমি খুব ভাল গান করবে, ছোট বেলায় বেশ গুনগুন করতে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৩

কথার সাথে সাথে শিহাবের নাশতা শেষ হলো, নিরু চা নিয়ে এলো। চা খেতে খেতে বলল এই চলনা আমি হাবিবদের বাড়ি যাব তুইও চল
আমাদের হাবিব?
হ্যাঁ, দুইজনে একসাথে গেলাম অথচ আমি চলে আসলাম ও কিন্তু এখনও আসতে পারেনি তাই চাচা চাচীদের সাথে একটু দেখা করে আসি আর ওর খবরটা জানিয়ে আসি আর তুই যখন এসেই পরেছিস তাহলে হাসির সাথে একটি দৃষ্টি বিনিময় করে যাবিনা?
কি যে বলিস, সে দিন কি আর আছে?
কেন নেই কি হয়েছে?
কি আর হবে, কতদিন হয়ে গেল সব ভুলে গেছি
আরে যাহ! এই কি কেউ ভুলে না ভুলতে পারে? লুকাচ্ছিস কেন, চল দেখা করে আসবি, বেচারি হয়ত তোর পথ চেয়ে আছে
না রে আমার অনেক কাজ আছে সবাইকে দাওয়াত দিতে হবে কিছু কেনাকাটা করতে হবে
আরে চল পরে আমিও তোর সাথে থাকব, যে কয়দিন ঢাকায় থাকবি আমি তোর সাথে থাকব
তাহলে তুই যখন বলছিস চল ঘুরেই আসি, তুই আর হাবিব কি এক সাথেই ছিলি?
না রে, আমি ছিলাম ইউরোপে আর ও ছিল এশিয়ান লাইনে তবে আমরা যখন মিডল ইস্টে আসতাম লোড নেয়ার জন্য তখন মাঝে মাঝে কথা হত। আমি দেশে আসছি জেনে বলে দিয়েছে ওদের বাড়ি যেতে।
চল

শিহাব যতদিন ঢাকায় ছিল নিশাত শিহাবের সাথেই ছিল। এই যাত্রায় সবার সাথে দেখা হলো আর সেই সাথে নানা সময়ে নিরুর সাথেও দেখা হলো।
পরেরদিন আপা জানাল তোর দুলাভাই বিয়ের দিন যাবে আমরা হলুদের দিনেই সকালে চলে যাব তুই কিন্তু এসে পরবি
আচ্ছা আপা, আমি সময়মত চলে আসব
তিনদিন পরে শিহাব আর নিরু চলে গেল।
পরের বুধ বারে সকালে উঠেই নাশতা খাবার সময় মাকে বলল
আমি বাড়ি যাচ্ছি যূঁইয়ের বিয়েতে। আজ হলুদ, বীণা আপা যাচ্ছে তার সাথে যাব আপনারা কি শুক্রবারেই আসবেন নাকি আগে আসবেন?
আগে কেমনে আসব, তোর বাবার অফিস আছে না!
আচ্ছা, তাহলে আপনারা আসেন আমি আজই চললাম।
বিয়ে বাড়িতে নিরুর সাথে সময়ে অসময়ে দেখা, চোখে চোখ আর সবার সাথে হৈ চৈ আমোদ প্রমোদে চলে গেল। নিরুর সাথে দুই একটা সাধারণ কথা ছাড়া একান্তে তেমন আলাপের সময় বা সুযোগ হয়ে উঠেনি। শনি বারে বাবা মা সহ বীণা আপা, দুলাভাই নিরুর সাথে এক সাথে ঢাকায় চলে এল।
১৪।
এবারে মাত্র দেড় মাস ছিল দেশে। এর মধ্যে এমনি করে আসা আর যাওয়ার মধ্যে দুইজনে কিছু টুকি টাকি কথাবার্তা একটু হাতে হাত এভাবেই চলে গেল। এখন নিরু আগের মত হাত ধরলে ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয় না। নিশাত ভাই বলে ডাকে না। এইযে, শুনছেন এমনি করে নিশাতকে ডাকে কিন্তু আপনি ছেড়ে তুমি করে বলতে পারে না। নিশাত কত অনুরোধ করেছে কিন্তু কোন পরিবর্তন হয়নি। নিশাত ভেবেই পায়না নিরু কবে তুমি বলা শিখবে। একদিন নিশাতের যাবার সময় এসে হাজির। আগের মতই নিরু আর বীণা আপার কাছে বিদায় নিয়ে নিশাত চলে গেল।
এই যাত্রায় আবার ফিরে আসতে নিশাতের অনেক সময় লেগে গেল। নিয়ম অনুযায়ী নয় মাস পরে দেশে আসতে পারেনি। বেশ অনেকদিন পরে এসে যখন বীণা আপার বাড়ি গেল তখন শুনল নিরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার অপেক্ষায় রয়েছে। দুলাভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। দুলাভাই বেশ আমুদে মানুষ এটা সেটা নানা কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনল। মাঝে আবার ইয়ার্কিও করল
কোন বিদেশিনী বা মেমসাহেবের দেখা পাওনি এখনও?
কি যে বলেন দুলাভাই! আমি মনে প্রাণে বাঙালি কাজেই আমার পাশে দেখলে বঙ্গ ললনাই দেখবেন। পাশে বীণা আপা এবং নিরু দুইজনেই ছিল। নিরু লজ্জা পেয়ে চা আনার ছল করে উঠে চলে গেল। দুলাভাই জানাল আগামী কাল নিরুর ভর্তি হবার তারিখ কিন্তু আমাকে যশোর যেতে হবে তোমার আপাকেও ওদের নিয়ে স্কুলে যেতে হবে। এর আগে দেখেছে শুধু অয়ন স্কুলে যেত কিন্তু এখন অয়ন রায়ান দুইজনেই যায় এবং রায়ানটা হয়েছে ভীষণ দুষ্ট। কে যাবে নিরুর সাথে তাই নিয়ে একটু চিন্তিত। নিশাত বলল
তাহলে নিরুর সাথে যাবার জন্য আমি আসলে হবে?
বীণা আপা বলল তুই আসবি? তাহলে আয়, সকাল নয়টার মধ্যে চলে আসবি
বলেই আপা নিরুকে বলল
শোন কাল আমি স্কুলে যাবার পর ও আসবে ওর সাথে যেয়ে ভর্তি হয়ে আসবি
আচ্ছা
নিশাত তুই কাল সময়মত চলে আসবি
ঠিক আছে, তাহলে আমি এখন উঠি
আচ্ছা।
নিশাত নিরুর দিকে ঘুরে বলল তুমি কিন্তু এর মধ্যে রেডি হয়ে থেকো।
নিরু মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল সে বুঝতে পেরেছে কি করতে হবে।

পরদিন সকালে যথারীতি নিশাত এসে দেখে নিরু রেডি হয়ে ওর অপেক্ষা করছে। ঘরে ঢোকার পর নিরু জিজ্ঞেস করল একটু চা খেয়ে বের হবেন?
তুমি বানাবে নাকি নার্গিস বানাবে?
নার্গিস বাসায় নেই আমিই বানাব
তাহলে দাও
চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল ছবি কাগজপত্র সব নিয়েছ?
নিয়েছি
কোন সাবজেক্টে ভর্তি হবে?
জিওগ্রাফি
এত সাবজেক্ট থাকতে জিওগ্রাফি কেন? তুমিও কি জাহাজে চাকরী করবে নাকি?
এই সাবজেক্ট আমি এখন ভাল বুঝি তাই
তাই নাকি? তুমিতো একসময় বলতে এটা খুব কঠিন
কেন, সেই যে আপনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর থেকেই আমার কাছে এটা ভাল লাগতে শুরু করেছিল এখন এটাই আমার প্রিয় বিষয়।
কিন্তু সেতো মাত্র কয়েকদিন দেখিয়ে দিয়েছিলাম
হ্যাঁ তারপরে যুঁই আপাকে বলেছিলেন আমাকে পড়াবার জন্য, আপনার মনে নেই
হ্যাঁ মনে আছে কিন্তু যুঁই কি তোমাকে পড়াত?
হ্যাঁ
বেশ ভাল কথা, জেনে খুব ভাল লাগল কিন্তু তুমিতো এতদিন আমাকে কিছু বলনি!
আপনি কি ও কথা বলার কোন সুযোগ দিয়েছেন? নাকি কোনদিন জানতে চেয়েছেন?
হ্যা নিরু সত্যিই ভুল হয়ে গেছে, কথা দিচ্ছি আর এমন হবে না, আচ্ছা আজ চল
চলেন

বাইরে এসে একটা রিকশা ডেকে দুইজনে উঠে চলল বিশ্ববিদ্যালয়ের এডিমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিঙের দিকে। এরপর আর কোন কথা নেই, অনেকক্ষণ চুপচাপ। একটা বছরেরও বেশি সময়ের আগে এমনি এক দিনের কথা উভয়ের মনে পরল কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। মনে হচ্ছিল এই পথ যেন শেষ না হয়। যেন অনন্ত কাল ধরেই চলতে থাকে। কিন্তু এক সময় নিউমার্কেটের সামনে এসে পিছনের আর এক রিকশার ধাক্কায় উভয়েই সম্বিত ফিরে পেল।
শুনছ?
বলেন
আজ কিন্তু আমরা এক সাথে সারাদিন ঘুরব!
তাই কি হয়?
কেন হবে না? তুমি কেমন, কিছুই কি বুঝবে না?
নিরু কোন কথা বলল না।
এইমাত্র না বললে আমি কোনদিন সুযোগ দেইনি তাহলে এখন এমন কথা বলছ কেন?
নিরু চুপচাপ
কি হলো কিছু বলছ না!
কি বলব? আপনার ছেলে মানুষীর কথা ভাবছি, আপনি এখনও সেই অতটুকই রয়ে গেলেন। এত দেশ বিদেশ ঘুরে এলেন তবুও বড় হলেন না!
ঠিকই বলেছ সত্যিই আমি তোমার কাছে এলেই যেন কেমন হয়ে যাই, সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায় গুছিয়ে কিছু বলতেও পারি না কিছু ভাবতেও পারি না। মনে হয়…
কি মনে হয়? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?
মনে হয়………………………
কয়েকবার শুধু মনে হয়, মনে হয় বলল কিন্তু তারপরে কথা থেমে যাচ্ছে, কিছু বলতে পারছে না। তাই শুনে নিরু বলল
কি মনে হয় বলেন, শুধু মনে হয় মনে হয় করছেন কেন?
লজ্জা লাগছে
তাহলে থাক বলার দরকার নেই
কিন্তু তোমাকে যে এ কথা শুনতেই হবে!
তাহলে বলেন!
এবার সাহস করে নিশাত নিরুকে বলল আমার চোখের দিকে তাকাও
নিরু তাকাল আর অমনি নিশাত ওর চোখে চোখ রেখে একটু কাছে এগিয়ে হাত ধরে বলল
মনে হয় আমি তোমার প্রেমে পড়েছি
আস্তে করে একটু ধাক্কা দিয়ে নিরু বলল যাহ! আপনি আগে এত অসভ্য ছিলেন না বিদেশে গিয়ে বুঝি এই হয়েছে? আর এই জন্যেই বুঝি আজ আমার সাথে আসা?
কি বল তুমি, অসভ্যের কি হলো যেটা সত্যি আমি তাই বলেছি। না, নিরু তুমি বুঝতে পারছ না, সেই ছোট বেলা থেকেই আমি লক্ষ করেছি তুমি কাছে এলেই যেন আমি কেমন হয়ে যাই। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। সত্যি করেই আমি তোমার প্রেমে পড়েছি বিশেষ করে সেদিন নোমানের ওই কথা শুনে আমি ভাল করেই বুঝতে পারলাম এত দিন কেন এমন হয়েছে। তার পর থেকেই তোমাকে এই কথাটা বলার সুযোগ খুঁজেছি কিন্তু পাইনি আজ তাই প্রথম সুযগেই বলে ফেললাম।
নিরু নিজের মনে ভাবল এ কথাতো আমারও। আমিও কেমন যেন হয়ে যাই, সব ভুলে যাই। যুঁই আপা যখন আপনাকে বলত তোর বৌ এসেছে তখন মনে হত যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে, ভীষণ খারাপ লাগত কিন্তু আপাকে কিছু বলতে পারতাম না তাই নীরবে শুধু কেঁদেছি সে কি আপনি কিছু বুঝতে চেষ্টা করেছেন কখনও? মুখে বলল
আচ্ছা সে দেখা যাবে এখন রিকশা থেকে নামুন চলুন দেখি আগে ভর্তি হয়ে নিই। পরে বিচার করব সত্যি বলছেন নাকি বানিয়ে বলছেন!
নিশাত সামনে চেয়ে দেখে ওদের গন্তব্যে চলে এসেছে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে নিরুর পিছে পিছে এসে যেখানে টাকা পয়সা দিতে হবে সে সব কাজ সারতে প্রায় ঘণ্টা খানিক লেগে গেল। ভর্তির কাজ সেরে ওই অফিসেই একজনের টেলিফোন থেকে বীণা আপার বাসায় ফোন করে বলল
আপা নিরুর ভর্তি হয়ে গেছে আমরা একটু পরে আসছি
কোথায় যাবি?
না তেমন কোথাও না এখানেই এলাকাটা ওকে চিনিয়ে দেই পরে যাতে কোন অসুবিধা না হয়
আচ্ছা ঠিক আছে বেশি দেরি করবি না তাড়াতাড়ি আসবি।
আচ্ছা আপা তাড়াতাড়িই আসব।
নিরুকে সাথে নিয়ে বাইরে চলে এলো। মেইন রোড।
শুনেছ তোমার আপার কাছে অনুমতি নিয়ে নিয়েছি এবার চল আমরা আজ বেড়াব এবং দুপুরে চাইনিজ খাব।
আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে
তোমার ওই এক কথা, ভয় আর লজ্জা, আপার কাছে অনুমতি নিয়েছি না! তবে আবার কিসের ভয়? ভয়ের কি আছে এটা কি তোমাদের গ্রাম? এটা রীতিমত ঢাকা শহর এখানে কে কার খবর রাখে? তুমি এখন বড় হয়েছ, আজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছ তোমার এত ভয় পেলে চলবে? এখানে লজ্জারই বা কি আছে? তোমার এখন নিজস্ব মতামত দেয়ার সময় হয়েছে
নিরু আমতা আমতা করে বলল চলেন কোথায় যাবেন।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২২

মনে মনে নিশাতের যাবার তারিখ হিসেব করে নিরু দিন গুনছে ও কবে আসবে! কি যেন বলেছিল সেদিন? নয় মাস পরে আসবে! হে খোদা, মাত্র গেল সাত মাস! আর কত? এমনিতেই কতদিন পরে পরে দেখা হয় তার কাছে এই নয় মাস এমন কিছু না কিন্তু কেন যেন মনে হয় এই দুই মাস অনেক মাস। এর আগে কখনও এমন লাগেনি। শুধু ভাবনা আর জল্পনা কল্পনার মধ্যেই সীমিত ছিল কিন্তু এবার যেন একটু অন্যরকম। কেমন যেন বোঝান যায় না বলা যায়না। আর বলবেই বা কাকে! যেখানে হাতে ধরেছিল বারবার সেখানে তাকায়, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিজে একটু আলতো করে ছুঁয়ে দেখে নিশাতের স্পর্শ লেগে আছে কিনা! এই একটু খানি স্পর্শের জন্য আজ কতদিন ধরে অপেক্ষায় আছে সে কথা কি আর কাউকে বলা যায়? না, এ যে একান্তই তার নিজের অনুভব। কাউকেই এ কথা বলা যায় না। মানিকগঞ্জে নোমান ভাইয়ের কথাটা শুনে খুবই মিষ্টি লেগেছিল, মনে হলো তাই যেন হয় নোমান ভাই। মানুষটা এমন বোকা যে নিজে যেন কিছুই বলতে পারে না। কোন আভাস ইঙ্গিতও কি কিছু বুঝতে নেই! আর সেদিন কেমন হঠাৎ করেই হাত টেনে ধরল! অবাক কাণ্ড, ভাবাই যায় না এই মানুষ এমন করে বসবে। তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য মুখে যা আসে তাই বলে দিয়েছে। আসলে এইতো তার মনের কথা। সারা জীবন কেন অনন্তকাল ধরে ওর অপেক্ষায় থাকতে পারি। তখন ভয়েই আর কিছু বলা হয়নি। কত কথা জমে রয়েছে কত কি বলার আছে, কবে সময় হবে? ও কি আর একটু এগিয়ে আসতে পারে না?। তখন মনে ভয় ছিল যদি হঠাৎ করে আপা এসে পরে তাহলে? যখন হাত টেনে ধরেছিল তখন কেমন যেন এক অনুভূতি আবার ওদিকে আপা চলে আসে কিনা সেই ভয়! ভয় আর অজানা এক শিহরণ মিলে কেমন যেন বলতে না পারা একটা ভিন্ন অনুভব। যা শুধু অনুভবেই অনুমান করা যায় কাউকে বলা যায় না। আপা কি কিছু বুঝে ফেলেছে? না! তা কি করে হয়! একটা চিঠিও তো দিতে পারে মানুষটা! কেমন? যুঁই আপার কাছে দিলে কি হয়? না থাক তাহলে জানাজানি হয়ে যাবে। শুধু আমার বুকের মাঝে রয়েছে তাই থাক আর কারো জানার দরকার কি? কিসে থেকে কি হয়ে যাবে সারা জীবনের জন্য সব কিছু ওলট পালট হয়ে যেতে পারে। থাক যেমন আছে তাই থাক। এই আমার ভালো। ওর মনের কথা জানতে পেরেছি তাই বুকে করেই কাটাতে পারব।

নিশাত যাবার পর নিশাতের বাবা অফিস থেকে মতিঝিল কলোনিতে বাসা পেল। নিশাতকে জানিয়েছিল যাবে কিনা। ঢাকা শহরের মুল কেন্দ্রে বলে আশেপাশে অনেক ভাল স্কুল কলেজ আছে তাই নিশাত ছোট ভাই বোনদের ভাল লেখাপড়া হবে বলে বলেছিল এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় উঠে পরুন।

দেখতে দেখতে একদিন নিশাত তার প্রথম সমুদ্রযাত্রা শেষ করে নয় মাস পরে কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে একটা অটোরিকশা নিয়ে মতিঝিলের বাসায় এসে হাজির। বাসায় মা একা ছিল সে দরজায় চেনা নক শুনে একটু অবাক হয়ে ভাবছিল কে এলো এই সময় একেবারে নিশাতের মত নক। দরজা খুলেই মা নিশাতকে দেখে অবাক স্তব্ধ হয়ে তুই! বলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। একটু পরেই সম্বিত ফিরে পেয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল বুকে। বাবা তুই এসেছিস! কোন খবর দিতে পারলি না?
না আম্মা সবাইকে চমকে দিব বলে ইচ্ছে করেই কাউকে খবর দেয়ার চেষ্টা করিনি। প্রথম বলে বিদেশ থেকে যা পেরেছে ছোট ভাই বোন এবং নিরুর জন্য কিছু কেনা কাটা করেছে। খাবার পর বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার পর সবাই যখন একত্রে হলো বাবা মা ভাই বোন সবাই তখন যার জন্য যা এনেছিল সেগুলি একটা একটা করে দিয়ে দিল কিন্তু নিরুর জন্য যা এনেছিল সেগুলি আর বের করা হলো না। সুটকেসের ভিতরেই রয়ে গেল। পরদিন সকালে ফকিরাপুল গিয়ে একটা স্টিলের আলমারির অর্ডার দিয়ে এলো। কয়েকদিন পরে আলমারিটা এনে সুটকেস থেকে বের করে আলমারিতে সাজিয়ে রাখল। নিরু যখন আমার হবে, নিরু যখন এই বাড়িতে আসবে তখন আলমারির চাবিটা নিরুর হাতে দিয়ে বলবে আলমারিটা খুলে দেখ ওখানে যা যা আছে সব তোমার।

পরদিন বীণা আপার বাড়িতে এসে হাজির। দুলাভাই থাকলে বেশিক্ষণ থাকা যাবে মনে করে বিকেলের দিকেই এসেছিল। বাড়ির কাজের মেয়ে নার্গিস দরজা খুলে অচেনা মানুষ দেখে জিজ্ঞেস করল কাকে চান?
সর দেখি ভিতরে যেতে দাও।
একরকম ওকে ঠেলে ভিতরে এসেই দেখে বারান্দা দিয়ে নিরু এগিয়ে আসছে। ওকে দেখে নিরুর চলা থেমে গেল। কিছুটা হতভম্ব হয়ে দাড়িয়েই জিজ্ঞেস করল আপনি! এতো দিন নিশাত ভাই বলে ডাকত কিন্তু আজ কেন যেন আর সেই আগের ডাক ডাকতে পারল না। আপনি! এটুক বলেই থেমে গেল। কোথা থেকে যেন এক রাশ লজ্জা আর সংকোচ এসে পা জড়িয়ে ধরেছিল। নিশাত এগিয়ে এসে পিছনে কাজের মেয়েটার কথা ভুলে গিয়ে নিরুর কাঁধে হাত দেয়ার জন্য হাত তুলতে আসছে বুঝতে পেরে এক পা পিছিয়ে জিজ্ঞেস করল কবে এসেছেন? নিশাত একটু অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল যেদিনই এসে থাকি তাতে তোমার কি? আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পিছনের পর্দা সরিয়ে বীণা আপাকে আসতে দেখে থেমে গেল। বীণা আপাকে দেখেই এগিয়ে এসে নিচু হয়ে বীণা আপার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল আপা আপনারা ভাল আছেন সবাই?
হ্যাঁ কিন্তু তুই কবে এসেছিস?
গতকাল এসেছি আপা! ছেলেরা কোথায় বলে একটা চকলেটের প্যাকেট নিরুর হাতে এগিয়ে দিয়ে বলল ওদের দিও।
ওরা বাইরে খেলতে গেছে একটু পরেই আসবে যা ও ঘরে বস গিয়ে আমি আসছি।
নিরু এসে লাইট জ্বেলে দিয়ে চলে যাচ্ছিল কিন্তু সেদিনের মত আবার নিরুর হাত টেনে ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল তুমি আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না? নিরু আজ হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল না। শুধু বলল কি জিজ্ঞেস করব? মনে মনে বলল আপনি কিছু জিজ্ঞেস করলেই পারেন। হঠাৎ বারান্দায় পায়ের শব্দ পেয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল আপা আসছে আমি যাই! একটু পরেই দুলাভাই এলো। অনেক রাত পর্যন্ত নিশাতের সমুদ্র যাত্রা ও লন্ডন ভ্রমণ নিয়ে গল্প সল্প হলো কিন্তু এর মধ্যে নিরু একবারও এ ঘরে এলো না। আপা দুলাভাই রাতে খাবার জন্য পিড়াপিড়ি করল কিন্তু কিসের এক অব্যক্ত অভিমানে নিশাত সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে চলে এলো।

প্রেম মানুষকে উদাস করে দেয়, উদার হতে শেখায়, ভালবাসতে শেখায় সেই সাথে নিষ্পাপ প্রেম মানুষকে বড়ই অভিমানী করে তোলে। সেই অভিমানের জের ধরে দুলাভাইর সাথে রাতের খাবার খেতে অসম্মতি। নিরু যদি একবারও অন্তত চায়ের ট্রে নিয়েও এ ঘরে আসত তাহলে এমন হতো না। সে রাতে দুলাভাইর কথায় বুঝতে পেরেছিল নিরুর কলেজ বন্ধ। পরদিন সকালে হিসাব করে আপার ছেলেদের স্কুলে চলে এলো। জানে আজ নিরু বাসায় আছে কাজেই আপা তার ছেলেকে নিয়ে স্কুলে আসবে না নিরুই আসবে। সত্যি সত্যি একটু পরেই দেখল একটা রিকশা আসছে তাতে নিরুর সাথে আপার বড় ছেলে অয়ন। রিকসা থামলে ভাড়া দেয়ার জন্য নিরু হাতের ব্যগটা খুলছে এমনি সময় নিশাত সামনে এসে অয়নকে বলল
মামা কাল চকলেট খেয়েছ?
হ্যাঁ মামা খুব মজা
আচ্ছা যাও স্কুলে যাও। নিরুর দিকে তাকিয়ে বলল যাও ওকে ক্লাসে দিয়ে এখানেই আসবে আমি দাঁড়ালাম।

যেন নিরুর উপরে তার কত দাবি। নিরু কেন এখানে আসবে? সে নিরুর কে? নিরু কেন তার কথামত চলবে? তাইতো! নিরু এখানে না এলে কি করব? সাত পাঁচ অনেক ভাবনা আসছে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই দেখল স্কুলের গেটের ভিতরের রাস্তা দিয়ে নিরু বের হয়ে আসছে। মাথায় ওড়না জড়ান হাতে সেই ব্যাগটা। মাথা নিচু করে নিরুর স্বভাব মত আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। নিরু আগের মত চঞ্চল ছটফটে নেই এখন অনেক বদলে গেছে। যে নিরু না হেটে দৌড়াত সেই নিরু এখন ধীর পায়ে হাটে। হতে পারে বয়সের সাথে বদলে গেছে কিংবা মনে কোন পরিবর্তন এসেছ। কি সে পরিবর্তনের কারণ? গেটের বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই নিশাত পাশে গিয়ে বলল আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরব চল রিকশায় ওঠ।
তোমাকে নিয়ে ঘুরব! বললেই হলো!
কেন?
সহজ সরল এই মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিরু কি বলবে একটু ভাবল।
কেন আবার কি, আপনি কি কোনদিনই কিছু বুঝবেন না?
এখানে বোঝার কি আছে?
আমি এসেছি অয়নকে স্কুলে দিতে, আর স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে কতক্ষণ লাগে তা আপা জানে না? সে সময় পেরিয়ে গেলে আপা কি করবে? কি বলব আপাকে? বলব তোমার প্রিয় ভাই নিশাতের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম? বলব এ কথা?
ও, এই কথা! তাহলে বল তোমাকে আমি একা কোথায় কখন পাব?
এত অস্থির হবার কি হলো? একা পাবার এমন কি প্রয়োজন?
অস্থির মানে কি বলছ তুমি! জান আমার এই নয়টা মাস কি করে কেটেছে?
কি করে কেটেছে?
শুধু নিরু আর নিরু, তুমি আর তুমি
কেন আপনার কাজকর্ম কিছু ছিল না?
শোন এত কৈফিয়ত আমি দিতে পারব না
তাহলে কি করবেন? বাসায় যাবেন?
চল বাসায় যাই
তাই চলেন কাল আপনি চলে আসার পরে মেঝ ভাই এসেছে
তাই নাকি?
হ্যাঁ যূঁই আপার বিয়ে ঠিক হয়েছে
কবে বিয়ে?
এই শুক্রবারের পরের শুক্রবারে
বাহ! আমি ভাবতেই পারছি না যূঁইর বিয়েতে আমি থাকতে পারব, শিহাব বাসায় আছে?
আমিতো ঘুমে দেখে এসেছি
একটা রিকশায় উঠে বসল। এই প্রথম নিরু আর নিশাত এক রিকসায় এত কাছা কাছি বসেছে। দুইজনের মনেই এক অপার্থিব সুখস্রোত বয়ে যাচ্ছে। স্বর্গিয় অনুভুতি, অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই শুধু একজন আর একজনের স্পর্শ অনুভব করছে। হঠাৎ করেই নিশাত এই নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করল
আমার কথা তোমার মনে পড়েনি?
পড়েছিল
সবসময়?
সবসময় কেন হবে? মাঝে মাঝে একটু একটু
তাহলে তুমি কাল রাতে একবারও ও ঘরে এলে না কেন?
আবার বোকার মত কথা বলছেন
কেন বোকার মত কেন হবে?
দুলাভাই কি ভাবত? আপা কি ভাবত?
ও আচ্ছা! কিন্তু যেদিন আকাশে সূর্যের উদয় হবে সেদিন কি ভাববে?
আগে উদয়তো হোক, তখন দেখব কে কি ভাবে!
চলনা আজ কোথাও একটু যাই
আমি আপাকে কিছু বলতে পারব না
আচ্ছা ঠিক আছে না বললে
আরও কিছু কথা হলো
বাসায় এলে বীণা আপা দরজা খুলে ওদের দুইজনকে এক সাথে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কিরে তোরা এক সাথে হলি কি করে?
আমি বাসে কল্যাণপুর যাচ্ছিলাম ওকে দেখলাম রিকশায় করে আসছে তাই নেমে ওর সাথে চলে এলাম।
এসে ভাল করেছিস আয় ভিতরে আয়। কাল শিহাব এসেছে যূঁইর বিয়ে ঠিক হয়েছে আগামি সপ্তাহে
হ্যাঁ ওর কাছে তাই শুনলাম, শিহাব কোথায়?
কথা বলতে বলতে ভিতরে এসে দেখে শিহাব নাশতা খাচ্ছে। নিশাতকে দেখে এক লাফ দিয়ে উঠল
কিরে তুই কবে এসেছিস? তুইতো অনেক হ্যান্ডসাম হয়েছিস!
তুইওতো বেশ নাদুশ নুদুস হয়েছিস, এই যূঁইয়ের বিয়ে কবে রে?
এইতো সামনের শুক্রবেরের পরের শুক্রবারে
বাহ! কি আনন্দ! তুই বাড়ি যাবি কবে?
দুই তিন দিন পরে যাব, যাবি আমার সাথে?
একটু ভেবে বলল
তোর সাথে যেতে পারব না তবে আমি হলুদের দিন চলে আসব
বীণা আপার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আপা আপনারা কবে যাবেন?
দেখি তোর দুলাভাইর সাথে আলাপ করিনি এখনও তবে মনে হয় আমিও হলুদের দিন যাব নিরু শিহাবের সাথে চলে যাবে। তুই তাহলে আমাদের সাথেই যাবি, পারবি? শিহাব আজ তোদের বাসায় যাবে চাচা চাচীদের দাওয়াত দিতে।
তাহলে ভালই হবে। ঠিক আছে আপা আমি আপনাদের সাথেই যাব।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২১

১২।
পর দিন সকালে ডিউটিতে যেয়ে দেখে জাহাজ প্রায় অর্ধেকের বেশি লোড হয়ে গেছে। নিশাত সব গুলি ট্যাঙ্ক একে একে ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছে। পাম্প ম্যানের সাথে ঘুরছে। সে কোন ভাল্ব কি ভাবে কোন দিকে ঘুড়িয়ে খুলছে বন্ধ
করছে, গেট ভাল্বের পাশে পাইপ লাইনের সাথে স্পিড মিটারে দেখল ঘণ্টায় ২৪০ টন বেগে তেল আসছে। সব কিছু কৌতূহল নিয়ে দেখছে। অরুণ অফিস রুমে। এর আগে ডিজেল দেখেছে সাধারণ বোতলে ভরা কিন্তু এমন বিশাল ট্যাঙ্কে এত ডিজেল দেখে নিশাত অবাক হচ্ছে। ডিজেলের গন্ধে কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠল বমি বমি ভাব লাগল। এই তেলের এমন গন্ধ! এর আগে তো কখন এমন মনে হয়নি। একটু পরে অরুণ’দা এলে জিজ্ঞেস করল

দাদা, আমাদের দেশে যে ডিজেল দেখেছি সে গন্ধ আর এই গন্ধের মধ্যে এমন তফাত কেন?
গন্ধ একই, পার্থক্য হলো তুমি এই এত বিশাল পরিমাণ তেল কখন এক সাথে দেখনি তাই এমন লাগছে,
আমার কিন্তু বমি এসে গিয়েছিল
তাই না কি?
তা হলে তো সমস্যা। ট্যাংকারে কাজ করলে কত গ্রেডের তেল নিতে হবে, একেক তেলের একেক রকম গন্ধ তোমাকে সহ্য করতে হবে। আচ্ছা শোন তুমি বেশী করে লেবু খাবে, বুঝেছ?
কেন, লেবু খেলে কি হবে?
তেলের যে গ্যাস শ্বাসের সাথে যায় তা কিছুটা ক্ষতি করে। লেবু ওটা একটু কমাতে সাহায্য করে।
ও, আচ্ছা ঠিক আছে খাব।
ওদের ডিউটির মধ্যেও জাহাজের লোড শেষ হয়নি। ওরা চলে গেল আবার মুকিত ভাই তার সঙ্গী সাথী সহ এসে অরুণকে জিজ্ঞেস করল
আর কতক্ষণ লাগবে?
দেরী আছে তোমরা শেষ করতে পারবে মনে হচ্ছে।
বেশ ভালো, তা হলে এই সময়েই শেষ হোক আমি তাই চাইছিলাম।
আচ্ছা ঠিক আছে নাও তুমি যতটা পার কর তার পরে আমরা এসে শেষ করে সেইল করবো, তা হলে থাক আমরা চললাম।

নিশাত এসে গোসল সেরে খেয়েই শুয়ে পরল। ঠিক ৬টায় ডিউটিতে গেল। যেয়ে দেখে এখনো অরুণ বা তার সাথের আর কেউ আসেনি। এখনও শেষ হয়নি?
এইতো কাছা কাছি এসেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ে যাবে!
মুকিত ভাই জিজ্ঞেস করল
কি নিশাত ঘুম হলো?
হ্যাঁ এই একটু, সময়ের সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেছে তো মানিয়ে নিতে একটু সময় নিবে।
কেমন লাগছে এখানে?
খুব ভালো, তবে মা বাবাকে ছাড়া কখন কোথাও এত লম্বা সময়ের জন্য থাকিনি তাই একটু খারাপ লাগে মাঝে মাঝে।
ও কিছু না, দেখবে এক সময় সব অভ্যাস হয়ে যাবে। আমরাও কি থেকেছি, কিন্তু দেখ এখন অভ্যাস হয়ে গেছে, মানুষের জীবনটাই এরকম।
হ্যাঁ মুকিত ভাই তবুও আমার ভাগ্য ভালো যে আপনাকে পেয়েছি আর অরুণ’দাও বেশ ভালো মানুষ। সবাই ভালো। আমি চিন্তা করছি আমার বন্ধু হাবিবের কি অবস্থা
হাবিব কে?
আমার বন্ধু, আমরা এক কলেজে পড়তাম, আমাদের বাড়িও এক জায়গায়, আবার এখানে এসেছিও এক সাথে, ও ফরিদা জাহাজে গেছে।
ও, ফরিদা?
হ্যাঁ
তা হলে কোন চিন্তা করো না ওখানে অনেক বাংলাদেশি আছে। দেখ আজ সেইল করার পর ওদের ডেকে দেখবে ও যদি ব্রিজে থাকে তা হলে কথা বলতে পারবে।
হ্যাঁ অরুণ’দা সেদিন বলেছে। দেখি আজ চেষ্টা করবো।

এমন সময় অরুণ এলে মুকিত ভাই বিদায় নিয়ে চলে গেল। তার সাথে থাকা অন্যান্য লোক জন সবাই গেল। এখন জাহাজের লোডিং প্রায় শেষ পর্যায়ে। অরুণ এবং সবাই ভীষণ দৌড়া দৌড়ীর মধ্যে, এই ট্যাঙ্ক থেকে ওই ট্যাঙ্কে যাচ্ছে দেখছে আর অরুণ নির্দেশ দিচ্ছে কোন ট্যাঙ্কে লোড শেষ হয়েছে ওটা বন্ধ করতে বলছে। প্রায় সব ট্যাঙ্কে লোড হয়ে গেছে এখন সর্ব শেষ ট্যাঙ্কে চলছে। জেটির লোক জনকে ডেকে জেটির পাশে দাড় করিয়ে রেখেছে আর অরুণ ট্যাঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে কখন বন্ধ করতে হবে। নিশাত পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। নিশাত দেখতে পেল নির্দিষ্ট জায়গায় আসার একটু আগেই জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে স্টপ বলে দিল আর সাথে সাথে লোকটাও তার হাতের ওয়াকি টকি দিয়ে স্টপ বলল। তেলের গতি কমে এক সময় বন্ধ হয়ে গেল। জাহাজের পাইপের গেট ভাল্ব বন্ধ করে সব গুলি ট্যাঙ্কের সব মুখ বন্ধ করে আটকিয়ে দিল। একটু পরে যারা পাইপ কানেকশন দিয়েছিল সেই গাড়ি এসে জেটির পাশে দাঁড়াল। এবার অন্য দুই জন লোক ওই আগের লোকদের মত পোশাক পড়নে এসে পাইপ খুলে জেটিতে উঠিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। একটু পরে আবার ভিন্ন এক গাড়ি নিয়ে এলো আরও দুই জন। হাতে কত গুলি বোতল আর মাপার ফিতা নিয়ে। নিশাত শুধু দেখে যাচ্ছে। জাহাজের ট্যাঙ্কের তেল মাপার যে সাউন্ডিং পাইপ সেখানে থেকে তেল তুলে বোতলে ভরে জাহাজের নাম, তেলের নাম, তারিখ এই সব লিখে একটা করে লেবেল বোতলের গায়ে লাগিয়ে নিলো। এর পর কি একটা পেস্টের মত ফিতায় বাধা একটা পেন্ডুলামের গায়ে লাগিয়ে ওই মুখ দিয়ে ট্যাঙ্কের ভিতর ছেড়ে ট্যাঙ্কে কত ফুট তেল আছে তা মেপে একটা খাতায় টুকে রাখল আর পেন্ডুলামে যে গোলাপি রঙের পেস্ট লাগিয়েছিল তার রঙ পরিবর্তন হয়েছে কি না তা দেখছে। ট্যাঙ্কে পানি থাকলে না কি এর রঙ বদলে নীল হয়ে যায়। এর পর প্রতিটি ট্যাঙ্কে থার্মো মিটার নামিয়ে তেলের তাপ দেখে ওই খাতায় লিখে নিয়েছে। এগুলি শেষ হলে ওদের নিয়ে অরুণ’দা তার অফিস রুমে চলে গেল হিসেব করতে। হিসেব নিকেশ সেরে ওরা চলে গেল আর সবাই অপেক্ষায় রইল কখন পাইলট এসে জেটির বাইরে নিয়ে যাবে।

প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিট পর পাইলট এসে জাহাজে উঠে সরাসরি অরুনের সাথে ব্রিজে গেল। জেটি থেকে জাহাজের সিঁড়ি নামিয়ে নেয়া হলো। ওরা ব্রিজে যাবার পর ক্যাপ্টেন জাহাজ ছাড়ার অর্ডার দিয়ে দিল। এক এক করে পিছন থেকে রশি খুলে যে টাগ বোট এসেছিল তারা রশি বেধে টেনে জাহাজ ঘুড়িয়ে নিয়ে জেটি ছেড়ে বের করে দিল। বাইরে এসে সোজা চালিয়ে এক বারে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেল। পাইলটকে নামিয়ে নেয়ার জন্য পিছনে একটা পাইলট লঞ্চ আসছিল, বাইরে এসে জাহাজ থামিয়ে দিলে লঞ্চটা জাহাজের গায়ে এসে ভিড়ল আর পাইলট নেমে গেল। এবার ফুল স্পিডে জাহাজ চালিয়ে দিয়ে নিশাতকে ব্রিজে ডেকে নিয়ে গেল।

ব্রিজে এসে দেখে জাহাজ সামনে এগিয়ে চলছে স্পেনের দিকে। শাহিন স্টিয়ারিং করছে। অরুণ গ্রে বাহরাইনকে ডেকে বাহরাইন ছেড়ে যাবার সংবাদ জানিয়ে দিল। এর একটু পরেই গ্রে বাহরাইনকে ডেকে স্পেনে কখন পৌঁছাবে বলে দিল। প্রায় ঘণ্টা খানিক হয়ে গেছে জাহাজ রাস্তানুরাহ ছেড়ে এসেছে। ফাঁকে ফাঁকে অরুণ রাডারে দেখে নিচ্ছে আশে পাশে কোন জাহাজ আছে কি না। বন্দরের কাছে বলে সব সময় জাহাজ আসা যাওয়া করে এই জন্যে এত সাবধানতা। শ খানিক মাইল দূরে চলে গেলে এত সাবধানতার দরকার হয় না। স্টিয়ারিং হুইলের সামনে একটা লিকুইড ম্যাগনেটিক কম্পাস, উপরে জাইরো কম্পাসের মনিটরে দেখল জাহাজ কত ডিগ্রীতে চলছে।
জগে কফির পানি গরম দিয়ে জিজ্ঞেস করল
কফি খাবে?
হ্যাঁ।
হাবিবকে একটু দেখবেন পাওয়া যায় কিনা!
দাঁড়াও দেখছি।
ভিএইচএফের রিসিভার হাতে নিয়ে আবার ফরিদাকে ডাকল। সাথে সাথে ফরিদা থেকে হান্নান নামের এক জন জবাব দিল।
কি হান্নান, তোমরা কোথায়?
আমরা কুয়েতে
কবে এসেছ?
গত পরশু
যাবে কবে?
কি জানি হয়তো আগামী পরশু হয়ে যাবে আমাদের এখনও লোডিং শেষ হয়নি
কোথায় যাবে?
টোকিও যাব
তোমরা কোথা থেকে এসেছ?
আমরা ডান্ডি থেকে লন্ডন হয়ে এখানে এসেছি, হান্নান শোন, তোমাদের ওখানে হাবিব নামে বাংলাদেশ থেকে একজন নতুন এসেছে?
হ্যাঁ এসেছে, কেন?
ওর এক বন্ধু নিশাত আমাদের এখানে এসেছে। হাবিব কি ব্রিজে আছে?
হ্যাঁ আছে একটু অপেক্ষা কর ডেকে দিচ্ছি।
হ্যাঁলো আমি হাবিব বলছি!
হাবিব, আমাকে তুমি চিনবে না। আমি প্যাসিফিক ম্যারিনারের চিফ অফিসার অরুণ , তোমাদের চিফ অফিসার হান্নান আমার বন্ধু। তোমার বন্ধু নিশাত এইতো আমার সঙ্গে আছে।
ও আচ্ছা, অরুণ’দা নিশাত ভালো আছে?
হ্যাঁ তা মনে হয় ভালোই আছে। আচ্ছা হাবিব তুমি নিরু নামে কাউকে চেন?
নাতো, কেন কি ব্যাপার?
এদিকে অরুণ যখন হাবিবের সাথে এসব কথা বলছে তখন নিশাত অরুণের মুখ থেকে হঠাৎ নিরুর নাম শুনে চমকে উঠল। কি ব্যাপার দাদা এ নাম জানল কি করে? ওহ! ওই যে জেটিতে লিখার সময় দেখেছে তাই মনে করে রেখেছে।
না, তেমন কিছু না তবে তোমার বন্ধু আজ বাহরাইনের সিতরা জেটিতে এই নামটি লিখে রেখে এসেছেতো তাই ভাবলাম তুমি হয়ত চেন। আচ্ছা ঠিক আছে এমনিই একটু ফান করলাম। নাও নিশাতের সাথে কথা বল।
হ্যালো হাবিব
নিশাত তুই কেমন আছিস কবে জাহাজে উঠেছিস কেমন লাগছে ওখানে কি তোরা সবাই বাঙালি?
এক নিশ্বাসে হাবিব অনেক গুলি প্রশ্ন করে একটু থামল। এবার নিশাতের পালা।
থাম থাম, এক সাথে এত গুলি প্রশ্ন করলে জবাব দেব কি করে? যাক তোর সন্ধান যখন পেয়েছি তখন সামনা সামনি কথা হবে যখন তখন সব বলব।
দেখা হবে না কি?
একই লাইনে চলাচল আমাদের কাজেই দেখা অবশ্যই হবে।
১৩।
ইউরোপ এবং এশিয়ার নানা দেশ দেখার আনন্দে এবং চমকে দিন গুলি বেশ কেটে যাচ্ছে। এর মধ্যে জাহাজের সব বাংলাদেশিদের সাথে বিশেষ করে নিশাতের সমবয়সীদের সাথে ভাব জমে উঠেছে। দিন গুলি কেটে যায় কিন্তু যখন একা হয় তখন কোথা থেকে যেন নিরু এসে হাজির হয় ওই যে বীণা আপার বাসায় নিরু যখন বলেছিল “দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার জন্য অপেক্ষা করব” ওই কথা বলার সময়ে নিরুর চেহারা এবং ওই ক্ষণটাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারে না। যখনই নিরুর কথা মনে হয় তখনই সেই চেহারা সেই পরিস্থিতি মনে ভেসে আসে। বীণা আপার বাসার সেই সোফায় বসে ওরা দুইজন, নিরুর ডান হাতটা শক্ত করে ধরা। নিরু বলেছে কিন্তু সিরাজ চাচা! যদি চাচা ওর কথা না মানে তাহলে! এমনিতে চাচা যেমন মেজাজি মানুষ! সে কি নিরুর কথা রাখবে? কি জানি, রাখতেও পারে কারণ চাচা নিরুকে খুব ভালবাসে মা ছাড়া ডাকে না। বড্ড ভুল হয়ে গেছে, আবার ভাবল বীণা আপা বা অন্তত যূঁইকে কিছু একটা বলে আসলে ভাল হতো। এর বেশি আর কিছু ভাবতে পারে না নিশাত। নানা দুশ্চিন্তা এসে মাথায় ভর করে। মাঝে মাঝে একটু অন্যমনস্ক হলে অরুণ’দা এবং মুকিত ভাইয়ের কাছে ধরা পরে যায় কিন্তু তবুও কখনও নিরুর কথা জানতে বা বুঝতে দেয় না। শুধু ওই জেটিতে নাম লিখা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না। নিরু কি আমার হবে? এই এক প্রশ্ন সারা বেলা অবেলায়। কতবার ভেবেছে একটা চিঠি দেই কিন্তু কোথায় কিভাবে কার ঠিকানায় লিখবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। শুধু ভয় যদি অন্য কারও হাতে পরে তাহলে কি হবে! কত বড় কেলেঙ্কারি হবে! এই ভয়ে কত চিঠি লিখে ছিড়ে ফেলেছে আর সেগুলি হয়ত এখনও বিভিন্ন সাগর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে।
[চলবে]

মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২০

এ কি, তুমি এখনও মুখ ধোওনি?
না অরুণ’দা ঘুম থেকে উঠেই দেখার জন্য ডেকে চলে গিয়েছিলাম।
আচ্ছা যাও ডিউটির জন্য রেডি হয়ে এসো, একবারে নাস্তা খেয়ে এসো!
আচ্ছা, বলে নিচে চলে এলো।
দুপুর ১২টা নাগাদ নিশাত ব্রিজেই রইল। কখনও বাইনোকুলার চোখে দিয়ে আবার কখনও রাডারের পর্দায় শুধু দেখছিল। প্রায় দুইটার দিকে সউদি রাস্তানুরাহ পাইলট এসে ওদের জেটিতে নিয়ে গেল। ইমিগ্রেশন, কাস্টম ইত্যাদি ঝামেলা সেরে ছয়টার পরে একটা পিক আপ এসে জাহাজের পাশে দাঁড়াল। পিক আপ থেকে দুই জন লোক নীল রঙের বয়লার স্যুট পড়নে হাতে টুল বক্স নিয়ে জাহাজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো। টুল বক্স রেখে আবার পিক আপে গিয়ে একটা রাবারের মোটা হোস পাইপ এনে জাহাজের পাইপের মুখের সাথে আগে কানেকশন করে পরে আর এক মাথা জেটির পাইপের সাথে কানেকশন করে দিয়ে চলে গেল। নিশাত ওদের কানেকশন দেয়ার ঢং দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কি দক্ষ এরা! কেমন করে এই টুক সময়ের মধ্যে সেরে ফেলল। পাম্প ম্যান গেট ভাল্ব খুলে দিল। ভাল্ব কতটা খুলছে তা বেশ সুন্দর ভাবে একটা কাঠি দিয়ে দেখা যাচ্ছে, নিশাতকে বুঝিয়ে দিল বিষয়টা। একটু পরে দেখতে পেল একোমডেশন ডেক থেকে ক্যাপ্টেন এদিকে এগিয়ে আসছে, পিছনে তার স্ত্রী। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল
লোডিং শুরু হয়েছে?
না এখন হয়নি, এই মাত্র কানেকশন করে গেল
কখন শুরু করবে কিছু বলেছে?
না।
আচ্ছা ঠিক আছে লোড শুরু হলে আমাকে বলবে।
আচ্ছা বলব।
ওরা ডেকের উপরে একোমডেশন ডেক থেকে মেইন ডেকের উপর দিয়ে ফোর ক্যাসেলে যাবার কাঠের ব্রিজ দিয়ে কিছুক্ষণ হাটা হাটি করে চলে গেল।
জাহাজের পাম্প ম্যান গেট ভাল্ব খুলে অপেক্ষা করছে কখন লোডিং শুরু করবে। মুকিত ভাই ডেকে গিয়ে আবার সব ট্যাঙ্ক, কানেকশন, ভাল্ব সব দেখে ডেকের উপরেই হাটা হাটি করছে সাথে নিশাত সব কিছু দেখছে। অরুণ’দা এসে বলল
মুকিত যাও রেস্ট নাও, ও ভালো কথা লোডিং এর ব্যাপারে কিছু বলেছে?
না, ওরা এসে শুধু পাইপ কানেকশন করে গেছে, কখন স্টার্ট করবে তা কিছু বলে নাই।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও, আমি দেখছি।
ওহ ভালো কথা, অরুণ’দা নিশাতকে একটু দেখিয়ে দিবেন।
হ্যাঁ হ্যাঁ যাও সে আর তোমাকে বলতে হবে না।

মুকিত চলে গেল। ডেকে আর দুই জন জিপি ডিউটি করছিল, শাহিন এবং জয়নুল। অরুণ শাহিনকে ডেকে নিশাতকে নিয়ে শুধু ব্রিজ বাদে জাহাজের আগা গোরা সব কিছু দেখিয়ে আনতে বলে দিল। শাহিন নিশাতকে নিয়ে প্রথমে জাহাজের ফোর ক্যাসেলে (জাহাজের সামনের ভাগ, যেখান থেকে নোঙ্গর ফেলা হয়, তোলা হয় এবং জাহাজ সামনের দিকে বাধা হয়) সেখানে নিয়ে গেল। এখানে কোন জিনিসের, কোন অংশের কি নাম কি কাজ এসব দেখিয়ে নিয়ে এলো ফোর ক্যাসেলের নিচে। এখানে নোঙ্গরের চেইন কোথায় থাকে, রঙ ব্রাশের স্টোর, আরও যা যা থাকে সব দেখিয়ে নিয়ে গেল পিছনের ডেকে। ওখানে কি ভাবে জাহাজ বাধা হয় ছাড়া হয় সব কিছু দেখিয়ে দিল। গ্যালিতে গিয়ে দুই জনে চা খেতে খেতে কিছু গল্প করে আবার ডেকে নিয়ে গেল।
কি নিশাত দেখেছ?
হ্যাঁ দেখলাম।
এই মহসিন ওকে ডেকের পাইপ লাইন গুলি বুঝিয়ে দাও, বলেই আবার বলল না ঠিক আছে তুমি থাক নিশাত আমার সাথে এসো।
এখানে জাহাজের কয়টা ট্যাঙ্ক, বিভিন্ন রঙ দিয়ে আলাদা করা পাইপ লাইন তার সাথের ভাল্ব, মেইন গেট, কোন লাইনের তেল কোন ট্যাঙ্কে যায় কি ভাবে লাইন ব্যবস্থা করতে হয়, তেলের প্রেশার মিটার, টেম্পারেচার দেখার থার্মো মিটার সব কিছু দেখিয়ে দিয়ে বলল,
ব্যাস আজ এই পর্যন্তই থাকুক না হলে সব গুলিয়ে ফেলবে, আস্তে আস্তে সব দেখে শুনে বুঝে নিবে, যার কাছে যখন যে সুযোগ পাও দেখবে।
আচ্ছা অরুণ’দা। আপনারা যে ভাবে যা বলবেন সে ভাবেই করবো, ভুল ভ্রান্তি হলে বলবেন। আমি কি ভয়ে ভয়ে এসেছি জানেন, শুধু ভেবেছি কোথায় যাচ্ছি, কারা কারা থাকবে, কাদের সাথে চলতে হবে। ভাবতে পারিনি যে এখানে এসে সব বাঙ্গালি পাব।

একটা কার এসে জাহাজের পাশে জেটিতে দাঁড়াল। এক লোক হাতে ওয়াকি টকি নিয়ে নেমে পাশে এসে জিজ্ঞ্যেস করল
তোমরা কি লোডের জন্য রেডি?
হ্যাঁ আমরা কখন থেকে বসে আছি।
আচ্ছা, তাহলে লোড স্টার্ট করতে বলব?
হ্যাঁ বল, কত স্পীডে আসবে জান?
২৫০ টন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
জেটির পাশে দাঁড়ান লোকটা ওয়াকি টকি দিয়ে কাকে বলল ‘স্টার্ট’
একটু পরে পাইপ লাইন দিয়ে ছিট মিট ,পট পট শব্দ করে তেল আসা শুরু হলো। প্রথমে পিছন দিকের ট্যাঙ্কে নিচ্ছে, ওখানে কিছু নিয়ে পরে অন্যান্য গুলিতে নিবে। অরুণ’দা পিছনের ট্যাঙ্কের মুখের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার সাথে পাম্প ম্যানও আছে। নিশাত কৌতূহল নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্কের নীচে তাকিয়ে আছে। কি ভাবে তেল আসে তাই দেখার জন্য। একটু পরেই ট্যাঙ্কে তেল আসা শুরু হলো। অরুণ’দা আর পাম্প ম্যান ঘুরে ঘুরে সব ভাল্ব, জয়েন্ট চেক করে দেখে নিলো কোথাও লিক হচ্ছে কি না। এবার ঘড়ি দেখে হিসেব করে বলল বিশ ঘণ্টা লাগবে। মানে কাল দুপুর তিনটা বেজে যাবে। আর আমরা সেইল করতে পারব ধর আরও ঘণ্টা খানিক পর। ঠিক আছে চলুক, আমি ভিতর থেকে আসি। চল, যাবে আমার সাথে চা খেয়ে আসি!
হ্যাঁ খেতে পারি অবশ্য আমি এত চা কখনো খাইনি,
কি যে বল, জাহাজে চাকরী করতে এসেছ এখন দেখবে আগের অভ্যাস অনেক বদলে যাবে।

চা খেয়ে এসে নিশাত এবার একটু একা একা জাহাজের ডেকের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখছে। তখন ভাটায় পানি অনেক নিচে নেমে গেছে। যখন এখানে এসেছিল তখন জোয়ার ছিল বলে জাহাজের ডেক জেটির বেশ উপরে ছিল। এখন পানি নিচে নেমে গেছে বলে জাহাজের ডেক জেটির লেভেলে চলে এসেছে। জেটির নিচে চোখ পরতেই দেখল জেটির পাইল এবং বিমে নানা ভাষায় নানা রঙ দিয়ে অনেক কিছু লেখা তার কোনটা সে পড়তে পারলো তবে বেশির ভাগই ভিন্ন ভাষা বলে সেগুলি পড়তে পারলো না। প্রায় লেখা গুলির মাঝে যোগ চিহ্ন দিয়ে এ পাশে ও পাশে কারো নাম লেখা, যা পড়তে পেরেছে তার মধ্যেও এই রকম আবার যা পড়তে পারেনি তাতেও এমন অনেক লেখা। কেউ কেউ আবার বিদঘুটে কিছু ছবিও একে গেছে, কেউ আবার জাহাজের নাম লিখে রেখে গেছে, কবে কে এসেছিল তারিখ লিখে তার নিজের নাম, জাহাজের নাম লিখেছে। নিশাত ভাবল তা হলে সেও পারে এমন করে তার নাম লিখে দিতে। না আমার নাম না নিরুর নাম লিখি, না তাইবা কেন নিরু কি একা? ওর সাথে যে আমিও জড়িয়ে আছি! নিশাত কি পারে না এমন করে একটা যোগ চিহ্ন দিয়ে ওর আর নিরুর নাম লিখে দিতে? না, এখানে নতুন এসেছে, সবার সাথে তেমন কোন ঘনিষ্ঠতা হয়নি এরা দেখলেই বা কি ভাববে? একটা ভ্যাবাচ্যাকার মধ্যে পরে গেল। কি করবে। না লিখেই ফেলি। এই লেখার সূত্র ধরে যদি কোন দিন নিরু আমার হয়ে যায় তা হলে মন্দ কি?
শাহিন ভাই, আপনাদের বোসন্স স্টোরে একটু যাব?
কেন?
আমার একটু রঙ আর ব্রাশ লাগবে।
এখন রঙ ব্রাশ দিয়ে কি করবেন?
কাজ আছে, দেন না একটু
আচ্ছা চলেন দেখিয়ে দিচ্ছি।

স্টোরে ঢুকে রঙ আর একটা ব্রাশ নিয়ে এসে একটা সুবিধা মত জায়গা খুঁজতে লাগল কোথায় লেখা যায়। এমন জায়গায় লিখতে হবে যেন সবার চোখে পড়ে অথচ জেটি মেইনটেনেন্স এর সময় মুছে না যায়। সব জায়গাই ভর্তি। খুঁজতে খুঁজতে একটু খালি জায়গা পেয়ে নাম লেখা শুরু করল। বাংলায় লিখবে না ইংরেজিতে এ আবার আর সমস্যা। ইংরেজিতেই লেখি পৃথিবীর সবাই পড়তে পারবে। নিশাত লিখছে ওর পিছনে শাহিন দেখছে।
লেখা শেষ হলে শাহিন জিজ্ঞেস করল
কি ভাই কার নাম লিখলেন?
দেখছেন তো।
তা দেখছি কিন্তু এ কে?
কি জানি তা জানি না।
ও বুঝেছি
একটু পরে অরুণ’দা এসে বলল
কি নিশাত ওখানে কি করছ?
কাছে এসে সদ্য লেখা এক মেয়ের নাম দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ?
না ডুবে আর খাচ্ছি কোথায়, প্রকাশ্য দিবা লোকেই তো লিখলাম।
হুম তুমি তো বেশ চালাক দেখছি, তা কার নাম লিখলে?
দেখতেই তো পাচ্ছেন।
তা তো পাচ্ছি, কিন্তু এ কে?
জানি না।
ও বুঝেছি। আচ্ছা ঠিক আছে জাহাজ ছাড়তে দাও দেখি।
জাহাজ ছেড়ে দিলে আর দেখবেন কি ভাবে, তার চেয়ে এখনি দেখে নিন, জাহাজ চলে গেলে কিন্তু দেখতে পারবেন না।
কেন?
বা রে, আমি কি জেটিটা সাথে নিয়ে যাব না কি?
ওরে বাব্বা এত দূর! তুমি দেখি সাঙ্ঘাতিক হাবু ডুবু খাচ্ছ! আচ্ছা আচ্ছা তা হলে এই ব্যাপার? তা এই সৌভাগ্যবতীটি কে?
না দাদা প্লিজ আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। যা দেখেছেন ওই পর্যন্তই থাক।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যদি বলতে না চাও তা হলে জিজ্ঞেস করবো না। তবে কাজটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।
নিশাত হেসে দিল।
এই সব নানা হাসি তামাশার মধ্যে জাহাজের লোডিং চলছে এর মধ্যে ওদের ডিউটির সময় শেষ হয়ে এলো। মুকিত ভাই এসে হাজির। কোন ট্যাঙ্কে কতটা লোড হয়েছে তা সব কিছু মুকিত ভাইকে বুঝিয়ে দিয়ে অরুণ বলল
চল নিশাত আমাদের ছুটি। কিছু খাবে, ক্ষুধা লেগেছে?
হ্যাঁ একটু মনে হচ্ছে, বিকেলে রাতের খাবার খাইনি কখনও, তাই অভ্যাস হতে সময় নিচ্ছে।
আচ্ছা চল তাহলে গ্যালিতে যাই দেখি কি আছে।
[চলবে]