রীতা রায় মিঠু এর সকল পোস্ট

ফোনালাপে বঙ্গবন্ধু, স্কাইপালাপে তেঁতুল হুজুর!

ফোনালাপে বঙ্গবন্ধু, স্কাইপালাপে তেঁতুল হুজুর!

আমার বাবার বর্তমান বয়স ৯০ বছর। আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। ২০১৩ সালের ১৩ই জুলাই বাবার সাথে ফোনে কথা শেষ করার পর একটি লেখা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। তখন বাংলাদেশে চলছে শাহবাগ আন্দোলন, শফি হুজুরের উত্থান। আমার মেজো কন্যা সেবার ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এর সাথে সামার প্রোগ্রামে কাজ করার জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিল। তখনই মিশা তার ল্যাপটপে বাবার সাথে আমার স্কাইপে সংযোগ ঘটিয়ে দেয়।

বাবার সাথে কথা বললেই আমার মন ভাল হয়ে যেত তখন। মন ভাল থাকলেই ফেসবুকে কিছু না কিছু লিখতে মন চায়। সেদিনও লিখেছিলাম।

আমার বাবার বর্তমান বয়স ৮৬ বছর। গত বছর আমার মা হঠাৎ করেই যেন মারা গেলেন। ঈশ্বরের কৃপায় বাবা এতকাল বেশ ভালোভাবেই, রীতিমত দাপটের সাথে কাটিয়েছেন, ইদানিং বাবার স্বাভাবিক হুংকারময় জীবনে ভাটা পড়েছে, বিপত্তিটা ঘটেছে গত বছর আমাদের মায়ের মৃত্যুর পর। ঝগড়ার সঙ্গী হারিয়ে যেতেই বাবা চুপ হয়ে গেছেন।

মা বেঁচে থাকতে দুই বুড়োবুড়িতে ঝগড়া লেগেই থাকতো, ঝগড়ার বিষয় ছিল টিভিতে প্রচারিত নাটক, সিনেমার কাহিনী, পাত্র পাত্রীদের চালচলন, অভিনয় সম্পর্কিত। দুজনের কেউই কারো সাথে একমত হতে পারতোনা। একটি ব্যাপারে উনাদের মতের মিল ছিল, সে হলো রাজনীতি। আমার মা ৭৫ বছর বয়সী হলেও রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল স্বচ্ছ, ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন নিয়ে মায়ের দূর্বলতা ছিল, আর বাবা তো আগাগোড়াই রাজনীতি সচেতন, বঙ্গবন্ধু ছিল উনার ধ্যান-জ্ঞান, বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার রাজনীতিতে নানা ভুল ভ্রান্তি থাকা সত্বেও আমার বাবা তা স্বীকার করতে রাজী নন।

আমি মাঝে মাঝে বাবাকে বলি,
“বাবা, আওয়ামী লীগ এখনও টিকে আছে তোমার মত কিছু অন্ধভক্তের অন্ধভক্তির কারণে। এর প্রয়োজন আছে, কেউ মানুক আর না মানুক, আমি তোমার এই অন্ধ আবেগকে মানি”।
আমার মুখে এমন কথা শুনে বাবা বেশ প্রীত হন। আমার মেজ ভাই যদি শেখ হাসিনার দুই একটি ভুল ধরিয়ে দিতে যায়, বাবা একেবারে তেড়ে মেরে যায়। আমার কাছে হয়তো অভিযোগ করে,

“তোর এই মেজ ভাইটা মানুষ না, পুরা গোয়ার গোবিন্দ, ও বুঝতেই চায় না, একটু একগুঁয়ে হলেও শেখ হাসিনার মধ্যে বাপের তেজ আর সাহস কিছুটা হইলেও আছে, শেখ হাসিনার মত এইরকম তেজী নেত্রীই দরকার”।

আমি বুঝিয়ে বলি, “বাবা, শেখ হাসিনা সাহসী ঠিকই আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে বেশী ঠ্যাটামী করে, এইটা কিন্তু ভালো না, মেজদার উপর রাগ করো কেন, ভুল করলে ভুল স্বীকার করা উচিত, শেখ হাসিনা তো মানুষ, ভুল তো করতেই পারে, ভুল স্বীকার করলেই হয়ে যায়”।

বাবা জানে, আমি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত, শেখ হাসিনার ভক্ত, তাই আমি যদি শেখ হাসিনার সমালোচনা করি, বাবা মেনে নেয়, কিন্তু আর কারো কথা মানেনা।

যাই হোক, মায়ের মৃত্যুর পর বাবা নীরব হয়ে গেছে। সপ্তাহে একদিন হয়তো আমি ফোন করি, ফোন ধরে বলে, “আমার মনটা ভালো লাগেনা, খাওয়া দাওয়া করতেও ভালো লাগেনা। সময় পার করি, এখনতো আমার বেঁচে থাকার কোন ঊদ্দেশ্য নাই, তোরা বলিস, তোদের জন্য নাকি বেঁচে থাকতে হবে, তাইলে তোরাই বরং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করিস, আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে, আমি প্রার্থণা করে আয়ু চাইনা।”

এমন কথার কি জবাব দেবো, জানিনা। বলি, “বাবা, তুমি বেঁচে থাকলে তো কারো কোন ক্ষতি হচ্ছেনা, কারো বাড়া ভাতে ছাই পড়ছেনা, বরং তোমার ছেলেমেয়েদের মনে শক্তি থাকে, তারা নিজেদেরকে এতিম ভাবেনা, “আমি এতিম নই’ এই ভাবনাটুকুই অনেক বড় শক্তি।”

আমার মেজো মেয়ে আবার দুই দিনের জন্য দাদুর বাড়ী গেছে। গতকাল মিশা তার ল্যাপটপে স্কাইপ অন করে বাবাকে দিয়েছে, আমার সাথে কথা বলার জন্য। বাবা এখন স্কাইপ বুঝে, মিশা বাড়ীতে আসার সাথে সাথে বাবার চেহারা বদলে গেছে। গলার স্বরও বেশ জোরদার হয়েছে। ল্যাপটপ হাতে নিয়ে বলে,

“মিঠু, তোরে সামনাসামনি তো এত সুন্দর লাগেনা, এইখানে তো অনেক সুন্দর লাগতেছে”।

আমি তো হেসে বাঁচিনা, বলি, “বাবা, আমার রক্তস্বল্পতা আছে, এইজন্য মুখ সাদা দেখা যাচ্ছে।’

বাবা বলে, “তোরে অনেক ছোট দেখা যায়, বাচ্চা মেয়েদের মতো”।

মিশা হাসতে হাসতে দাদুর উপর গড়িয়ে পড়ে, বলে, “দাদু, তোমার মেয়ে ঘরেও সেজেগুজে থাকে, একেবারে ম্যাডাম জিয়ার মত, এইজন্যই ল্যাপটপে সুন্দর দেখা যাচ্ছে”।

আমি বলি, “বাবা, আসল কথা শোন, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আমি চিন্তিত, খাওয়া দাওয়া নেই, ঘুম নেই, ওজন কমে যাচ্ছে তো, তাই ছোট দেখা যাচ্ছে। এখন ত্তুমি বলো, তুমি কি মাল্টিভিটামিন খাচ্ছ? তোমার যে খাওয়ায় রুচী নেই, সেটার কি হবে? একটু ব্যায়াম করো, ব্যায়ামে ক্ষিদে বাড়ে।”

বাবার জবাব, “ব্যায়াম করি, ৮৬ বছর বয়সে আর কত জোয়ান থাকবো?”

-বাবা, তুমি কি বলো? আল্লামা শফি হুজুরের বয়স কতো? ৯৪ বছর, শফি হুজুর ৯৪ বছর বয়সে হেলিকপ্টার চড়ে ঢাকা চট্টগ্রাম যাওয়া আসা করে, হেলিকপ্টার ছাড়া চলেননা বলে উনার নাম ‘হেলিকপ্টার হুজুর! আর তুমি ৮৬ বছরের খোঁটা দিতেছ”।

-শফি হুজুরের কথা বলে লাভ নাই রে মা, শফি হুজুর তো জোয়ান পুরুষ, এখনও চাইর বিয়া করার স্বপ্ন দেখে, শফি হুজুর একটাই হয়, দুইটা হয়না।

মিশা আর আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। মিশা দাদুর সাথে খুব মাই ডিয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে। আমেরিকায় বেড়ে উঠলেও মিশা বাংলাদেশের রাজনীতি, গান ,সিনেমা নাটকের খোঁজ খবর রাখে। দেশপ্রেম যদি বংশ পরম্পরায় রক্তে প্রবাহিত হয়, তাহলে বলবো, মিশার রক্তে মায়ের বাড়ির দিকের দেশপ্রেমের ব্যাপারটা কিছু হলেও আছে।

বাবার কথার উত্তরে মিশা বলে উঠে, “দাদু, শফি হুজুর বলেছে, মাইয়ালোক হইলো পাকা তেঁতুল, দেখলেই নাকি জিভে জল আসে। শফি হুজুরের আরেক নাম কিন্তু ‘তেঁতুল হুজুর।”

নাতনীর কথা শুনে বাবাও হেসে দেয়, বলে, এইটাই ত চিন্তার বিষয়, তোরে তো আর বাংলাদেশে আসতে বলতে পারবোনা, শফি হুজুররা যদি ক্ষমতায় আসে, তাইলে তো সব মাইয়াদের ঘরের ভিতরে থাকতে হইবো। এখন তুই যেইভাবে সারা দেশ চইষা বেড়াইতেছস, তখন আর পারবিনা। কাপড় দিয়া নাক মুখ ঢাইকা থাকতে হইবো, নাইলে তো আবার তেঁতুল দেইখা শফি হুজুরের জিভে জল আসবে। তার চেয়ে তুমি আমেরিকাতেই থাইকো, তেঁতুল হুজুরের দেশে আসার দরকার নাই”।

মিশা বলে, জ্বী না দাদু, আমার হাতে থাকবে ‘আমেরিকান পাসপোর্ট, আমি হচ্ছি আমেরিকান তেঁতুল, শফি দাদু চালাক আছে, কোনটা বাংলাদেশী তেঁতুল, কোনটা আমেরিকান তেঁতুল, ঠিকই বুঝে। আমেরিকান তেঁতুলের দিকে তাকাইলেই ‘চুপ’ মাইরা যাইব। কাজেই চিন্তা করোনা, আমি আবারও আসবো।”

আমার তখন কাজে বেরোবার সময় হয়ে গেছিল, তেঁতুল সংলাপ আর এগোলো না। কথা অসম্পূর্ণ রেখেই কাজে চলে যেতে হলো”

_______________
—১৩ই জুলাই, ২০১৩

ইলিশ কথা!

ইলিশ কথা!

চায়নিজ গ্রসারি শপ থেকে উত্তম ফোন করে জানতে চেয়েছে, “বুঝলে, এখানে মায়ানমারের ইলিশ আছে, আনব?”

বলি,” অবশ্যই আনো।

– কিন্তু বাংলাদেশের ইলিশ না তো, মায়ানমারের ইলিশ! তেমন স্বাদ কি হবে?

-আরে ছাড়ো তো, মায়ানমারের জনগণের একাংশ যেখানে বাংলাদেশি হয়ে গেছে, ইলিশের বাংলাদেশি হতে সমস্যা কি?

– না, মানে, স্বাদ গন্ধ তো পছন্দ হবে না!

– হবে হবে। রোহিঙ্গারা এখন চাল চলনে, কথায় আচরণে, বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের হিসাবে বাংলাদেশি হয়ে গেছে না? রোহিঙাদের কি রোহিঙ্গা বলে বাংলাদেশি জনগণ থেকে আলাদা করা যায়?

– আরে দূর, কাজের কথা বলো।

– আরে, কাজের কথাই তো বলছি। তুমি বললে, মায়ানমারের ইলিশ বাংলাদেশি ইলিশের মত সুস্বাদু হবে কিনা! সেই কথাই বলছিলাম। আমরা এখন মায়ানমারের ইলিশে মানুষে সকলেই বাংলাদেশি হয়ে গেছি।
তুমি মায়ানমারের ইলিশ আনো, রান্নার পর বাংলাদেশি হয়ে যাবে।

– বোকার মত কথা বলো না তো!

-হি হি হি!! দিনে দিনে আমরা বাংলাদেশিরা সকলেই বোকা হয়ে গেছি। তাই তো ইলিশের দেশের মাইয়া হয়েও মায়ানমারের ইলিশের কথা শুনে আনন্দে ফুলিশ হয়ে গেছি।
ফোনালাপ শেষ।

উত্তম দুই হাত ভর্তি করে বাজার এনেছে। তার মধ্যে মায়ানমারের ইলিশ আছে। আরও আছে চায়নিজ কলার মোচা, চায়নিজ করলা, এবং ডাটা দিয়ে ইলিশের ঝোল খাওয়ার জন্য চায়নিজ ডাটা।

মনে মনে কই, সবই দেখি নাক বোঁচাদের প্রডাক্ট। বাংলাদেশের প্রডাক্ট কই?

পরক্ষণেই মনে হইল, বাংলাদেশিরা নিজেদের প্রডাক্ট তৈরি করবে কখন! তারা ব্যস্ত অন্যের গোয়ালে ধুঁয়া দিতে! বিশ্বকাপ ফুটবলে নিজের দেশ নাই তা নিয়ে মাথা ব্যথা নাই। তারা ব্রাজিল আর্জেন্টিনার ফুটবলে বাতাস দিতে ব্যস্ত।

নিজের কথাই ধরি না কেন, আমি কি কম ফুলিশ! আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা করে কম লাফিয়েছি! আর এই যে এখন, মায়ানমারের ইলিশ কোলে নিয়ে বসে আছি।

কই, একবারও তো মনে এলো না, পদ্মার ইলিশ চাই, মায়ানমারের ইলিশ খামুনা। আমি যদি খামুনা কইতাম, উত্তম কি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে অন্য দেশের ইলিশ কিনতো?

আমি সোনামুখ করে মায়ানমারের ইলিশ খাচ্ছি বলেই তো, বাংলাদেশিরা সোনামুখ করে রোহিঙ্গাদের বুকে টেনে নিয়েছে বলেইতো মায়ানমারের ব্যবসায়ীরা ইলিশ রপ্তানি করছে আমেরিকায় থাকা বাংলাদেশীদের কাছে, আর রোহিঙ্গা রপ্তানি করছে বাংলাদেশে।

পৃথিবীতে ফুলিশরাই পরের জন্য দিওয়ানা, বাকি সকলেই নিজের বিষয়ে সেয়ানা।

সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণকলির দিনগুলি!

সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণকলির দিনগুলি!

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বারের শেষে বাংলাদেশে গেছিলাম। বাবা হঠাত করেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো, তাই ছুটে যাওয়া। একই বছরের নভেম্বারের শুরুতে আমার ভাই বাসা বদল করেছে।
১৯৭০ সালের মে জুনের দিকে ভাড়াটে হয়ে এসেছিলাম যে পাকা বাড়িতে, সেই বাড়িতেই কেটেছে ২০১৭ সালের অক্টোবার পর্যন্ত। একটানা সাতচল্লিশ বছর একই বাড়িতে থাকলে যা হয়, সে বাড়ির প্রতিটি ধূলিকণা আপন হয়ে যায়। ঘরের যে দেয়ালে টাটকা নতুন চূনকামের গন্ধ ছিল, সাতচল্লিশ বছর পর সেই দেয়ালে চূনকামের গন্ধ থাকেনা, চূনকামের কোন ছাপ থাকেনা। সেখানে থাকে ভেজা ভেজা গন্ধ, শ্যাওলা না হোক, নোনা ধরা ছাপ। এসবই খুব আপনার জন, আত্মার অংশ। আমাদের প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাসের উঠানামায় দেয়াল জুড়ে এতসব শিল্প কর্ম সৃষ্টি হয়েছে।

এমন আপন বাড়ি পাল্টে যখন নতুন বাড়িতে উঠা হলো, সাতচল্লিশ বছরের জমা স্মৃতিময় থালা বাসন, ঘটি বাটি বালতি, কাঠের চেয়ার, স্মৃতিময় খাট, লেপ তোষক বালিশ, বইয়ের পাহাড় দোতলা বাড়ির কক্ষ, দেয়াল তাক ছুঁয়ে কিছু বারন্দায় ঠাঁই পেলো। পুরনো দিন, পুরনো কথা, পুরনো জিনিসপত্তর ইতিহাসে স্থান পায়, মানুষ ব্যস্ত হয়ে উঠে বর্তমান নিয়ে।
সাতচল্লিশ বছরের স্মৃতিময় ঘরগুলোকে শূন্য করে নতুন দালানের নতুন ঘর পূর্ণ করার কাজে সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

হাসপাতাল থেকে কিছুটা সুস্থ করে বাবাকে তোলা হলো নতুন ভাড়া বাড়ির বারান্দা লাগোয়া ঘরটিতে। বাবার খুব শখ ছিল দোতলার বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসার। সে দিক বিবেচনা করেই বারান্দা লাগোয়া ঘর বাবার জন্য ঠিক করা হয়েছে। শয্যাশায়ী বাবা বিছানা থেকে উঠে বসতে না পারুক, বারান্দার দিকে দরজা খোলা থাকলে বিছানায় শুয়ে থেকেই খোলা বারান্দার কিছু অংশ দেখতে পাবে।

দিন সাতেকের মধ্যেই ছোট ভাইয়ের বউ ঘরবাড়ি সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে। বাপের বাড়িতে আমার কোন কাজ করতে হয়না। বিয়ের পর থেকেই এই নিয়ম, বিয়ের আগে যে আমাকে মায়ের সাথে সব কাজে সাহায্য করতে হতো, সেই আমাকেই বিয়ের পর বাপের বাড়িতে খাটে বসিয়ে খেতে দেয়া হয়। মা বেঁচে থাকতে মা দিত, মায়ের অবর্তমানে ছোট ভাইয়ের বউ আমায় খাটে বসিয়ে খাওয়ায়।

সেদিনও বাবার খাটেই বসেছিলাম, সংসারের কাজ করতে হতোনা বলে অসুস্থ বাবার পাশে বসে ল্যাপটপে লেখালেখি করতাম। বারান্দার দিকের দরজা খোলা, ভাইয়ের ছোট ছেলেটা খোলা দরজা দিয়ে ঘরে বারান্দায় ছুটোছুটি করছে। আমার নজর ওর দিকেও ছিল কারণ ভাতিজার গ্লাস বাটি কাপ গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়ার অভ্যাস আছে । বারন্দায় তখনও অনেক সরঞ্জাম রয়ে গেছে গামলা আর বালতির ভেতর। নানা সাইজের বাসন, পূজোর থালা, ছোট খাটো খেলনা, কিছু বই, দিদিমার আমলের বড় পাটা পুতা, ঠাকুমার আমলের কাহাইল ছিয়া, এমনি অনেক ঐতিহাসিক জিনিস।

আমার ভাতিজাকে দেখলাম একটা গামলা থেকে খুব সুন্দর একটা চকচকে মেটালের গ্লাস টেনে বের করেছে। দেখেই আমি দৌড়ে গেলাম বারান্দায় যাতে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে গ্লাস বাইরে ফেলে না দেয়। না, পিচ্চি গ্লাসটা বাইরে ফেলেনি, আবার গামলার মধ্যেই রেখে দিয়েছে।

গ্লাসটা হাতে নিলাম, রুপোর গ্লাস। ছোট বাচ্চাদের জল খাওয়ার গ্লাস। আমাদের বাড়িতে রুপোর গ্লাস এলো কিভাবে! ভাইবৌ বললো, এই গ্লাসটা আমাদের বড় মামী উপহার হিসেবে দিয়েছিল ভাইয়ের ছেলেকে। গ্লাসটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে গামলার মধ্যে রাখতে যেয়ে আরেকটা পুরনো কালচে হয়ে যাওয়া স্টিলের গ্লাসের দিকে নজর গেলো। ওই গ্লাসটার দিকে নজর যেতেই বুকের মধ্যে কারণ ছাড়াই এক মুহূর্তের জন্য বিদ্যুৎ খেলে গেলো। কেন এটা হলো বুঝিনি। গামলা ভর্তি বাসন কোসন, রুপোর গ্লাসটা একটু ভেতরের দিকে ঢুকিয়ে রাখলাম যেন দুষ্টুটা খুঁজে না পায়।

বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে আসার সময় আবার পেছন ফিরে গামলার দিকে তাকালাম। নজর গেলো সেই কালচে স্টিলের গ্লাসটার দিকেই। আবারও বুকের মধ্যে কিছু একটা অনুভূতি। সমুদ্রের গভীর থেকে যেন জেগে উঠছে কিছু একটা অনুভূতি।

গ্লাসটা কি আমার? এই গ্লাসে কি আমার নাম লেখা আছে? সেই গ্লাসটা? এখনও আছে? দেখবো গ্লাসটা বের করে নাম আছে কিনা! যদি না হয়! সত্যিই কি আমার জল খাওয়ার গ্লাস ছিল? দিদিমা এনে দিয়েছিল না? বেনারস থেকে আমার জন্য একটা গ্লাস এনেছিল দিদিমা! হ্যাঁ, মনে পড়ছে, দিদিমা আমার জন্য একটা গ্লাস এনেছিল। দেখতে রুপার মত চকচকে ছিল, খুব ভারী ছিল।
আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম, দিদিমার একমাত্র নাতনী। দিদিমা খুব বেড়াতো, এখানে ওখানে সবখানে। কাছে পিঠের দূরত্বে দিদিমা আমাকে সাথে নিয়ে যেত। দূরে কোথাও গেলে ফিরে আসার সময় আমার জন্য কিছু না কিছু উপহার আনতোই। স্কুলে পড়ার সময় আমার ঘন চুলের বিনুনিতে যত বাহারি ক্লিপ, ফিতা শোভা পেতো, সব দিদিমার দেয়া।

ইন্ডিয়া ছিল দিদিমার অনেক প্রিয়, বছরে একবার দিদিমা ইন্ডিয়া যেতোই যেত। ফিরে এসে ভ্রমণ নিয়ে কত গল্প শোনাতো। দিদিমার মুখে ইন্ডিয়া বেড়ানোর গল্প শুনে শুনেই হয়তো ছোটবেলা থেকে আমারও ইন্ডিয়া নামটা অনেক আপন হয়ে উঠেছিল।

আমার মেজো মাসির বিয়ে হয়েছিল পাটনা প্রবাসী পাত্রের সাথে। মাসি আর মেসো থাকতো বেনারস। সেজন্যই দিদিমা বেনারস বেড়াতে যেত। বেনারসে স্টিলের জিনিস নাকি খুবই ভাল মানের, একেবারে রুপোর মত। সেই রুপোর মত স্টিলে তৈরী ছোট একখানা গ্লাস দিদিমা আমার জন্য এনেছিল।

ছোটবেলায় আমাদের ভাইবোনদের নিজস্ব কোন সম্পত্তি ছিলনা। ভাইদের ছিলনা নিজস্ব কোন খেলনা কয়েকটা মার্বেল আর সিগারেটের খালি বাক্স ছাড়া, আমারও কোন সম্পত্তি ছিলনা স্টিলের ছোট গ্লাসটা ছাড়া। একটা ‘চোখ ঘুরানো পুতুল’ অবশ্য ছিল, সেটা মুক্তিযুদ্ধের সময় হারিয়ে গেছিল।

আমাদের ছোটবেলায় শপিং মল, শপিং কমপ্লেক্স বলে কিছু ছিলনা। মা দিদিমারা বছরে একবার বৈশাখি মেলায় যেতো, সেখান থেকে শখের জিনিস কিনতো। পূজোর সময় ছিটকাপড়ের দোকান থেকে জামার কাপড় কিনে আনতো, আর হরলাল সাহার দোকান থেকে শাড়ি কিনতো। এর বেশি বিলাসিতা করার কথা কেউ ভাবতোনা। বাকি বাজার সদাই বাবা কাকা ভাইয়েরা নিত্য বাজার থেকেই করতো।

শপিং কমপ্লেক্স, শপিং মল ছিলনা বলে কি মা দিদিমাদের আলতা স্নো পাউডার চুড়ি কেনা বন্ধ ছিল? মোটেও না, জামদানী শাড়ি, তাঁতের শাড়ির গাটরি কাঁধে শাড়িওয়ালা আসতো বাড়িতে। ‘লেইস ফিতা, চুড়ি শাখা চিরুনি সিন্দুর’ নিয়ে আসতো ফেরিওয়ালা। ‘তামা কাঁসার বাসন’, ‘পিতলের কলসি’ নিবেন, ‘শিল পাটা খোদাইবেন’ বলে হাঁক দিত পাটা খোদানেওয়ালা, ‘ছিট কাপড়ড়ড়ড়’ বলে হাঁক দিত কাপড়ওয়ালা, ‘ডাইলপুরি, গরম গরম ডাইলপুরি’ বলে হাঁক দিত ডালপুরিওয়ালা! শপিং কমপ্লেক্স দিয়ে কাজ কি? ঘরে বসেই যেখানে সব পাওয়া যেতো।

সেরকমই একজন হাঁক দিতো, ‘কাঁসার বাসন, হাঁড়ি ডেকচিতে নাম লেখাইবেন’ বলে। আমার মায়ের ছিল দুইটা শখ। বই কেনার শখ, কাঁসার বাসন কেনার শখ। বাসন শুধু কেনা হতোনা, সেই আমলে মা দিদিমারা কাঁসার বাসনে নিজেদের নাম খোদাই করিয়ে রাখতো। কে জানে, কাঁসার গ্লাস, থালা বাটি ঘটি সবার ঘরের যেহেতু কম বেশি আছে, চিহ্ন দেয়া না থাকলে যদি পাল্টাপাল্টি হয়ে যায়! আমার ভালোটা অন্যবাড়িতে চলে যাবে, অন্যের খারাপটা আমার বাড়িতে আসবে, এটা হলেতো সাড়ে সর্বনাশ।

হ্যাঁ, কাঁসার বাসনেরও ভাল মন্দ ছিল। ওজন দিয়ে নির্ধারিত হত কাঁসার বাসনের ভাল মন্দ। যে বাসনের ওজন যত বেশি, সেই বাসন তত ভাল। কন্যার বিয়েতে কন্যার বাপ তামা কাঁসা পেতলের বাসন কোসন দান সামগ্রী হিসেবে কন্যার শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতো। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাসন হাতে তুলে তুলে ওজন পরীক্ষা করে সন্তুষ্টি- অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতো। কার বাপে পাতলা ঠনঠনে গ্লাস বাটি দিয়ে ঠকিয়েছে, কোন বাড়ির ছেলের বউ বাপের বাড়ি থেকে ওজনদার তামা কাঁসার তৈজসপত্র নিয়ে এসেছে, এসবই ছিল ঐ আমলের বউ ঝিদের আলাপের বিষয়বস্তু।

আমার দিদিমা আর মায়ের কাঁসা পিতলের ভান্ডার ছিল বিশাল। নানা সাইজের গ্লাস, থালা, বাটি, ঘটি কত কিছু। প্রতিটি জিনিসের মধ্যে দিদিমা আর মা নাম খোদাই করিয়ে রাখতো। একটা মজার বিষয় ছিল, বাসন কোসনগুলো শখ করে কিনতো মা/দিদিমা, বাসনে তাদের নামই লেখানো উচিত ছিল। অথচ দুজনেই বাসনে লেখাতো যার যার স্বামীর নাম। দিদিমার বাসনে লেখা হতো দাদুর নাম ‘ননী গোপাল’, মায়ের বাসনে লেখা হতো আমার বাবার নাম ‘সুনীল’।

তামা কাসার বাসন খোদাইওয়ালা লোকটা যখন আসতো, মা দিদিমার সাথে আমিও বসে থাকতাম। আমার খুব ভাল লাগতো এই কাজ দেখতে। খুব সাধারণ চেহারার একটা লোক কী সুন্দর করে লোহার একটা কাঠিতে পাথর দিয়ে ঠোকা দিয়ে দিয়ে গ্লাসে বাটিতে থালায় ননীগোপাল লিখছে, সুনীল লিখছে। হাতের লেখাও কী সুন্দর। মনে মনে ভাবতাম, আমি খাতার মধ্যে কলম দিয়ে, পেন্সিল দিয়েও এত সুন্দর করে লিখতে পারিনা, আর লোকটা দুই পায়ের পাতার ভাঁজে গ্লাসটাকে চেপে রেখে এক হাতে লোহার শলা( আমরা বলতাম গজাল) বাসনের গায়ে ধরে, অন্য হাতে ধরা পাথর দিয়ে শলার গায়ে ঠুক ঠুক করে ঠোকা দিয়ে কিছুটা ঢেউ খেলানো ডিজাইনে মানুষের নাম লিখে ফেলতো।

প্রশ্নটা আমিই করেছিলাম। “তোমরা সব বাসনেই দাদুর নাম, আর বাবার নাম লেখাও কেন? আমাদের নামওতো লেখাতে পারো। বাবা যেই গ্লাসে জল খায়, সেই গ্লাসে বাবার নাম থাকবে, আমি যেই গ্লাসে জল খাই সেই গ্লাসেও কেন বাবার নাম থাকবে?”
আমার কথা শুনে মা হেসেছিল, বলেছিল, “তোর বাবা হইল বাড়ির কর্তা। সবকিছুতে বাড়ির কর্তার নাম থাকা ভাল”।

মায়ের উত্তর আমার পছন্দ হয়নি, তবে অন্যায্যও মনে হয়নি। সত্যিইতো বাড়ির আসল মানুষতো বাবা। তাই বাবার নামেই সব।

আমি ভাবি আমার মনে, মাও নিশ্চয়ই ভাবতো মায়ের মনে। আমার গ্লাসে কেন বাবার নাম থাকবে, এই প্রশ্নটা হয়তো মা’কে একটু হলেও বিচলিত করেছিল। অন্য একদিন কাঁসার বাসন খোদাইবেন’ ডাক শুনেই মা লোকটাকে ডাকলো। সেদিন অন্য কোন বাসনে নাম লেখায়নি। আমার যে অমূল্য সম্পত্তি বেনারস থেকে আনা ছোট্ট স্টিলের গ্লাস, শুধু সেই গ্লাসটাতে ‘মিঠু’ নাম লেখানোর জন্য মা লোকটাকে ডেকেছিল। কী যে অবাক হয়েছিলাম, কী যে আনন্দিত হয়েছিলাম, গ্লাসের গায়ে ‘মিঠু’ নাম লিখতে দেখে। মনে হয়েছিল, এক লাফে আমি বাবার সমান হয়ে গেছি। আজ থেকে গ্লাসের গায়ে শুধু ‘সুনীল’ না, ‘মিঠু’ নামও থাকবে।

সমস্যা দেখা দিলো, গ্লাসটা এমনিতে যতখানি মূল্যবান সম্পদ ছিল আমার কাছে, ‘মিঠু নাম খোদাই করার পর হয়ে গেলো অমূল্য সম্পদ। সেই গ্লাস আমি মায়ের আলমারীতে যত্ন করে রেখে দিয়ে ‘সুনীল’ লেখা কাঁসার গ্লাসেই জল খেতাম। এত যত্নে রেখেছিলাম যে বড় হতে হতে নিজস্ব সম্পত্তির তালিকা যখন বড় হতে লাগলো, ‘মিঠু’ নামাঙ্কিত গ্লাসটার অস্তিত্বের কথা ভুলে গেলাম।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পর গামলার ভেতর শৈশবকে উঁকি দিতে দেখলাম। একবার ভাবি গ্লাসটা টেনে বের করে দেখি, এটা সেই ‘মিঠু’ নামাঙ্কিত গ্লাসটা কিনা। আবার ভাবি, এটাতো সম্ভব নয়। মায়ের যে কাঁসা পিতলের বাসন কোসনের সাম্রাজ্য ছিল, বাবা নিজে হাতে সেই সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছে। বাবা ছিল খুব গোছানো স্বভাবের, মা ছিল উলটো। মা খালি স্মৃতির ভাণ্ডার তৈরী করতো কিন্তু গুছিয়ে রাখতোনা। দুই রুমের ভাড়া বাড়িতে মানুষের সঙ্কুলান হয়না যেখানে, সেখানে বইয়ের পাহাড়, কাঁসার বাসনের সাম্রাজ্য গড়ে তোলা বোকামি নয়! বাবা সের দরে কাঁসার বাসনগুলো বেচে দিয়েছিল। তাতে ঘর কিছু ফাঁকা হয়েছিল, সাথে ফাঁকা হয়ে গেছিল মায়ের বুকের গভীরে কিছু অংশ।

গ্লাসটা বের করেই ফেললাম। কালচে হয়ে গেছে, কিন্তু বেশ ওজনদার। কালচে ছোপের ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে ঢেউ খেলানো দাগে লেখা নাম ‘মিঠু’। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি হাতে গ্লাসটা নিয়ে, বুকের ভেতর শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। এটা কি হাউ মাউ করে কান্নার প্রস্তুতি, নাকি একরাশ আনন্দ উচ্ছ্বাস বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি! মা নেই, দিদিমা নেই, কাঁসা পেতলের বাসনের সাম্রাজ্য নেই, কোথাও কিছু নেই, সব নেইয়ের ভাঁজে কেমন করে ‘মিঠু’র গ্লাসটা রয়ে গেলো! গ্লাসটা কি তবে মা তামা কাঁসার সাম্রাজ্যে রাখেনি? কাঁসার বাসনগুলোতো বাবা সব সের দরে বিক্রি করে দিয়েছিল।

ভাইবৌকে ডাকলাম, “অনীতা, এই গ্লাসটা কোথায় ছিল?”
ভাইবৌ জানালো, এই গ্লাসটা মা শোকেসে সিরামিকের বাসন কোসনের সাথে রেখে দিয়েছিল।

আমার খুব অস্থির লাগছিল। গ্লাসটা হাতে ধরে বসে আছি। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, বাসন খোদাইওয়ালাকে ডেকে মা এই গ্লাসটায় আমার নাম লেখাচ্ছে। কারণ আমিই বলেছিলাম, সব বাসনে কেন বাবার নাম লেখা হবে? না, বাবার সাথে আমার আড়াআড়ি ছিলনা, আসলে ঐটুকু বয়সে আমার আলাদা অস্তিত্ব সম্পর্কে যে বোধ তৈরী হয়েছিল, সেই দাবীতেই বলেছিলাম, যার যার বাসনে তার তার নাম লেখা হোক।
মা দিদিমা ঠাকুমাদের সকলেই ছিল সরলা নারীর দল, কখনোও নিজেদের আলাদা অস্তিত্বকে আবিষ্কার করার চেষ্টাই করেনি। কী লাভ হলো, বাবা কি বুঝেছিল প্রতিটি বাসনে বাবার নাম থাকার গুরুত্ব! ঘর ফাঁকা করার জন্য নিজের নামাঙ্কিত ভালোবাসায় কেনা জিনিসগুলো দের দরে বিক্রি করে দিলো তো!

গ্লাসটা একটু ঘষলে মাজলে হয়তো চকচকে হতো। আমি গ্লাসটা মাজলাম না। গ্লাসটা মাজা ঘষা করলেই গ্লাসের গায়ে লেগে থাকা দিদিমার স্পর্শ, মায়ের স্পর্শটুকু ধুয়ে যাবে। গ্লাসটা আমার ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে নিলাম।

প্লেন যখন আকাশে মাঝে মাঝে হাত দিয়ে ব্যাগে থাকা গ্লাসটাকে অনুভব করলাম। দিদিমা গিয়েছিল বেনারস মেজো মাসির কাছে, সেখান থেকে আমার জন্য ছোট্ট একটা গ্লাস এনেছে, মা সেই গ্লাসে আমার নাম লিখিয়ে দিয়েছে, বাবা ঘরের সব তামা কাসা বিক্রি করে দিয়েছিল, মা এই গ্লাসটা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। এত বছর পর আমার জিনিস আমার হাতে ফিরে এসেছে। আজ দিদিমা নেই, মেজো মাসি নেই, আমার মা নেই, রয়ে গেছে তাদের তিনজনের হাত ঘুরে আসা ‘মিঠু’ নামাঙ্কিত আমার গ্লাসটি।

বুকের ভেতর কেমন যেন ‘নেই নেই’ অনুভূতি হচ্ছিল! এতটা পথ এসে আজ মনে হচ্ছে, ” সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা, কৃষ্ণকলির দিনগুলি যদি থাকতো”!

‘৭১ এর এক টুকরো স্মৃতি!

‘৭১ এর এক টুকরো স্মৃতি!

সময়টা ছিল খুব সম্ভব মে মাসের মাঝামাঝি। ঊনিশ’শ একাত্তর সালের কথা বলছি। ২৫শে মার্চের কালো রাতের পর, নারায়ণগঞ্জ শহর ছেড়ে অনেকেই পালাতে শুরু করে। ২৭ শে মার্চ আমরাও শহর থেকে পালিয়ে উদ্ধবগঞ্জ নামের একটি গ্রামে পৌঁছেছিলাম দাদু দিদিমার সাথে। উদ্ধবগঞ্জে দাদুর মুহুরীর বাড়ী। প্রাণভয়ে প্রচুর মানুষ ঐ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। আমার মা বাবা তখনও নারায়ণগঞ্জ শহরেই থেকে গেছিলেন, পরিস্থিতি আঁচ করার জন্য। আমাদের বয়স কম ছিল, একেবারেই শিশু, যুদ্ধের ভয়াবহতা বুঝবার মত বোধ তৈরী হয়নি। শুধু বুঝতাম, পাকিস্তানী মিলিটারীদের সামনে পড়ে গেলেই গুলী করে মেরে ফেলবে। পাকিস্তানী মিলিটারীর ভয়েই সবাই পালিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে গোলাগুলির সংবাদ, পাড়া ছেড়ে সবাইকে পালাতে দেখে, ভয়ের বদলে ছোটদের মনে ছিল ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ খেলার সাময়িক উত্তেজনা। শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে পারছি, সেই ভেবে আনন্দ।

উদ্ধবগঞ্জের পাশের গ্রাম সোনারগাঁও। সেখানে দাদুর আরেক মক্কেল ননীবাবুর বাড়ী। মুহুরীবাবুর বাড়ীতে গাদা গাদা অসহায় মানুষের পাশে উকিল বাবুকে উনি থাকতে দিতে চান নি। দশ বারো দিনের ব্যাপার, সব ঝামেলা চুকে গেলে উকিলবাবু আবার নারায়ণগঞ্জে উনার নিজের বাড়ীতে ফিরে যাবেন, এই কয়টা দিন নিজের বাড়ীতে এনে আদর সমাদর করা উনার বিরাট দায়িত্ব হিসেবে মেনে নিলেন। লাল ইঁটের দোতালা দালানে উনি আমাদেরকে নিয়ে তুললেন। দশ বারোদিনের মধ্যে সব ঝামেলা চুকে যাবে, ননীবাবুর ধারণাটি সঠিক ছিল না। দশ বারোদিনের পরিবর্তে আমরা দুই মাস থেকে গেলাম। এই দুই মাস ছোটদের জন্য ছিল বেশ সুখের সময়। আমাদের দালান থেকে সোনারগাঁও জমিদার বাড়ী দেখা যেত, দালানের পেছনদিকে যে বিশাল বড় মাঠ দেখা যেত, সেই মাঠ পেরোলেই ছিল ‘পানাম’ জমিদার বাড়ি ।

দুইদিকে জমিদার বাড়ী দেখে নিজেদেরকেও জমিদার জমিদার মনে হতো। বাড়ীর সামনেই বিশাল চওড়া দীঘি ছিল, দীঘির জলে প্রচুর মাছ, চারদিকে চার ঘাটলা, রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া শেষে বাসন ধুতে গেলে দেখা যেত, ঘাটের উপরে চিংড়ি মাছ, বড় বড় পুঁটি মাছেরা এসে ভীড় করেছে। আমার দাদুর বাজার করার ব্যাপারে ছিল দারুণ খ্যাতি। প্রতিদিন সকালে বাজারে গিয়ে তিন চার সের দুধ কিনতো, মাছ কিনতো। আসলে তখন সব কিছুই সস্তা দেখে দাদুর যুদ্ধের কথা মাথায় থাকতো না। অনেক বড় হয়ে বুঝেছি, দাদুর মাথায় আইনের ধারা ছাড়া আর কিছু খেলা করতো না। রাজনীতি নিয়ে কখনও মাথা ঘামাতেন না। রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন আমার বাবা। সেজন্যই বাবার কাছে খুব অস্বস্তিকর মনে হতো যখন দাদু বাজার থেকে দুধের কারিয়া হাতে বাসায় ফিরতো।

দাদু সাথে করে যা কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল, সেগুলিই দেদারসে খরচ করে যাচ্ছিল। উনার ধারণা ছিল, আগামী সপ্তাহেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন ধারণা করার কারণও ছিল, উনার মক্কেলরাই উনার কাছে সংবাদ এনে দিত, সামনের সপ্তাহেই সব ঠিক হয়ে যাবে! বাবা মানা করতেন, বাজার করার বহর দেখলে মানুষ ভুল বুঝতেও পারে। ঠিকই মিলেছে বাবার কথা, দাদুর বাজার করার বহর দেখে ‘বাজারে’ কেউ কেউ কুমতলব আঁটতে শুরু করে। দুই দিন পর পর দূরের গ্রামে ডাকাত পরার সংবাদ পাওয়া যায়। হঠাৎ এক রাতে খুব কাছে থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ শোনা যায়। আরেকদিন, সকালের দিকে কেউ এসে বলে, ‘বাজারে মিলিটারী আইছে’, ব্যস, মা আর দিদিমা সাবান, জল নিয়ে মাথার সিঁথিতে থাকা সিঁদুর ঘষে ঘষে তুলে ফেলে। এরপর আমাদের নিয়ে পাশের মুসলমান বাড়ীতে গিয়ে পালিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরে আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।

পরের দিন ননীবাবু এসে দাদুকে বলতে বাধ্য হয়, “বাবু, অবস্থা ভাল ঠেকতেছে না। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের অবস্থা খুব খারাপ। মিলিটারী বাইছা বাইছা হিন্দু ধইরা ধইরা মারতে আছে। হিন্দু মাইয়াগোরে ধইরা লইয়া যাইতাছে। কী করুম! আপনে আমার অতিথি। আপনেরে এইভাবে রাইখা আমি কোথাও যাইতে পারুম না। ছোট ছোট পোলাপান লইয়া আগরতলা চলে গেলে কেমন হয়!”।

আমার দাদু খুব ভীরু প্রকৃতির ছিলেন। ননীবাবুর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, সোনারগাঁও আর থাকা যাবে না। আগরতলা দিয়ে কলকাতা চলে যাবেন। ননীবাবু নিজেও চলে যাবেন। নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে এখানে আমাদের সুখেই দিন কাটছিল। এর মধ্যে দাদু সোনারগাঁও ছেড়ে যেতে চাইছেন শুনে ছোটদের মনে আবার কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিল। নতুন কিছু ঘটার অপেক্ষা, নতুন কিছু শোনার অপেক্ষায় আমাদের প্রহর গোনা শুরু হলো। দুই দিন পরেই বাজারে একদল ডাকাত ধরা পড়ে। পরে জানা যায়, আমাদের অস্থায়ী নিবাসে ডাকাতি করার জন্যই ওরা আসছিল। এই সংবাদ শোনার পরে বড়দের সকলেই একমত হলো, সবকিছু গোছগাছ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে।

আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে হাতব্যাগে যে কয়টা জামাকাপড় আঁটে, তাই নিয়েই চলে এসেছিলাম। এখনতো আর নারায়ণগঞ্জে ফিরে যাওয়া যাবেনা, তাছাড়া আগরতলা যাওয়া ছাড়া আর কোন গতিও ছিল না। হাতে কিছু টাকা পয়সা না নিয়ে এতগুলো বাচ্চা নিয়ে কোথাও বের হওয়াও মুশকিল। মায়ের সোনা গয়নার ছোট পোঁটলা, দিদিমার কিছু গয়না নারায়ণগঞ্জের বাসাতেই ট্রাঙ্কে রয়ে গেছিল। কোন অজানার ঊদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি সবাই, আর কখনও ফিরে আসা হবে কিনা, সেই ভয়ে মা আর দিদিমা নিজেদের গয়নাগুলো নারায়ণগঞ্জের বাসায় ফেলে যাওয়া সমীচীন মনে করেনি। সিদ্ধান্ত হয়, দাদুর মুহুরী হামিদ মিয়ার সাথে মা যাবে শহরে, ঘরবাড়ি তালা মেরে আসতে হবে, কিছু টাকা তুলতে হবে ব্যাঙ্ক থেকে, সাথে গয়নাগুলো নিয়ে আসবে। এভাবে এক কাপড়ে কোথাও যাওয়া যায় না, কিছু কাপড়-চোপর নিয়ে আসতে হবে। ঘরে যখন এগুলো নিয়ে আলাপ হচ্ছিল, আমি চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, সোনা গয়না মাটির নীচে গর্ত করে রেখে দিলেই তো কেউ জানতে পারবে না। নিজের মতামত জানাতেই এক ধমক খেলাম, বড়দের গোপন পরামর্শ শুনে ফেলেছি বলে।

পরের দিন খুব সকালে হামিদ নানা আসবে। মা’কে মুসলমান বৌ সাজিয়ে নেয়া হবে। মুসলমান সাজার একটাই মাত্র উপায়, বোরকায় নিজেকে ঢেকে ফেলা। দুই মাসে সোনারগাঁও এর আশেপাশের মানুষজনের সাথে আমাদের খাতির হয়ে গেছিল। পাশের বাড়ীর সখিনার মায়ের কালো বোরকা আনা হলো। আমার মা খুব সুন্দরী ছিলেন, বয়স কম ছিল, কিন্তু ব্যক্তিত্ব ছিল খুব প্রখর। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জ মায়ের জন্মস্থান, পেশায় শিক্ষক, মনের জোর ছিল আলাদা। তাই মা’কে নিয়ে কেউ দুঃশ্চিন্তা করছিল না। আগের সন্ধ্যায় আমাদের সবার সামনে মা’কে বোরকা পড়িয়ে ট্রেনিং দেয়া হলো। বোরকার মুখের উপর যে পর্দা থাকে, সেই পর্দার ঝিরি ঝিরি ফুটো দিয়ে মা ভাল করে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। তাই এলোমেলোভাবে পা ফেলছিল। তাই দেখে আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিলাম।

পরের দিন খুব সকালে মা তাদের ‘হামিদ চাচা’র সাথে রওনা হয়ে গেলো। পানামের দিকে যেতে যে বিশাল মাঠ, সেই মাঠ পেরিয়ে কালো বোরকা পড়া মা’কে যেতে দেখে আমার বুকটা মুচড়ে উঠেছিল। কেনো জানি মনে হচ্ছিল, মা আর ফিরে আসবে না। সারাদিন বাড়ীতে সবাই চুপ করে বসেছিল। ছোটরা হই হই করছিল না। দিন পার হয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসতেই তিন বছর বয়সী ছোট ভাই কান্না শুরু করে দেয়, মা আসেনা ক্যান, মা আসেনা ক্যান বলে। ঠিক অন্ধকার হওয়ার আগ মুহূর্তে আমার মেজভাইকে দেখা গেল, দূর থেকে দৌড়ে আসছে। মা আইছে, মা আইছে বলে চীৎকার করছিল, মেজদার চীৎকার শোনার সাথে সাথে দিদিমা, ঠাকুমার দেহে প্রাণ ফিরে আসে। দেখা গেল, মায়ের সাথে আমার দুই মামাও চলে আসছে। বলা বাহুল্য, ‘দেখা যাক কী হয়’ ধারণা নিয়ে আমার দুই মামা শহরে তাদের মুসলিম বন্ধুদের সাথেই রয়ে গেছিল। মা যখন ঘরে ফিরে বোরকা খুলেছে, মায়ের চেহারা রক্তশূন্য। আমি তো আর রক্তশূন্য বুঝিনা, দিদিমাকে বলতে শুনেছি, ‘কী হইছিল? তোর চেহারা এমুন দেখা যায় ক্যান? একেবারে রক্তশূইন্য চেহারা”!

হামিদ নানা বলল, “কর্তা, আম্মারে লইয়া আইজ বড় বিপদের মইদ্যে পড়ছিলাম। আর দিন পায় নাই, আইজই আজরাইল আইয়া হাজির অইছে নারায়নগঞ্জ শহরে। আম্মারে বাড়ীর ভিতরে পাঠাইয়া দিয়া আমি গেছি কোর্ট বিল্ডিং এ, গিয়া আধ ঘন্টা দাড়াইতে পারি নাই, ট্রাক ভইরা মিলিটারী আইয়া হাজির। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ি, আমি কলেমা পড়ুম কী, আম্মার কথা মনে অইতেই আমি অস্থির অইয়া গেছি। ক্যামনে ক্যামনে যে আম্মারে আবার আপনের কাছে ফিরাইয়া দিতে পারছি, আমি নিজেই কইতে পারুম না”।

আমরা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি, মা কী বলে! মা হামিদ নানাকে কিছু খেতে দিতে বললো সবার আগে। এরপর মা যা বললেন, তা রীতিমত ভয়াবহ। শহরে আমরা থাকতাম বিরাট বড় এক বাড়ীতে, যেখানে শুধু বাড়ীওয়ালা ছিলেন মুসলমান, ভাড়াটেদের সবাই হিন্দু। কাজেই এই বাড়ী হিন্দু বাড়ী নামেই বাইরে পরিচিত ছিল। দরজার তালা খুলে মা কেবল ঘরে ঢুকেছে, বাড়ীর মালিক, হাজী সাহেবের কাছে সংবাদ চলে এসেছে, নারায়ণগঞ্জে মিলিটারী ভর্তি ট্রাক ঢুকছে। পাড়ায় পাড়ায় বাড়ী বাড়ী সার্চ করতেছে। এই কথা শোনার সাথে সাথেই একটু আগে খুলে রাখা বোরকা পড়ে নিয়ে মা কোনমতে ট্রাঙ্ক খুলে টাকা, গয়না নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। কাপড় চোপর আলনার মধ্যে যা ছিল, তাই টেনে নিয়ে বোঁচকা বাঁধে। মা ভেবেছিল, আমাদের পাড়ার ভেতর ঢোকার আগেই মা হামিদ চাচার সাথে বের হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তা সম্ভব হয় নি। হামিদ চাচা তখনও কোর্ট থেকে এসে পৌঁছেনি, কিন্তু ততক্ষণে আমাদের পাড়ার ভেতর মিলিটারী ঢুকে গেছে। পাড়াটা হিন্দুপ্রধান ছিল বলে মিলিটারীরা প্রতি বাড়ীতে ঢুকে ঢুকে সার্চ করছিল। এই সুযোগে হাজী সাহেব আমার মা’কে দাদুর বৈঠকখানা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দেয়।

বেড়ার ঘরের ভেতর বসে মা ঠকঠক করে কাঁপছিল। বাইরে বুটের আওয়াজ শুনে মা’র গলা শুকিয়ে কাঠ। বেড়ার ঘরের দরজায় একটা ছোট লাথি দিলেই দরজা ভেঙ্গে যাবে। মা তো আর ঊর্দু কথা বুঝেনা, তারপরেও হাজী সাহেবের কথা শুনছিল, “কাফের নেহী হ্যায়, মুসলমান হ্যায়”। এতবড় বাড়ী টহল দিয়ে দেখেছে, লাভ হয় নি, সব বাড়ির দরজা তালাবন্ধ, কেউ কোথাও নেই। মিলিটারীরা চলে গেলো। আমার মামা কোথাও লুকিয়ে ছিল, মিলিটারী সরে যেতেই মামা, হামিদ নানা এসে উপস্থিত। তারা শুনে এসেছে, কাছাকাছি কোথায় নাকি এক বাড়ীতেই দুই জনকে গুলী করে মেরে ফেলেছে। ততক্ষণে আমার মায়ের দেহে প্রাণ ছিল না। ঘরের মজুত খাদ্য বাড়ীওয়ালাকে দিয়ে দিলেন, নিজের সেলাই মেশিন আর ঘরের একটা মাত্র সিলিং ফ্যান মামার বন্ধুর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ব্যস! কিছু টাকা আর গয়না নিয়ে হামিদ চাচার সাথে রওনা হয়ে গেলেন। পথে গাড়ী-রিকশা বন্ধ ছিল বলেই ঘুরপথে, মিলিটারীর চোখ এড়িয়ে ‘হামিদ নানা উনার ‘আম্মারে’ উকিল বাবুর কাছে এনে পৌঁছে দিয়ে যায়। সেদিন থেকে আমরা যারা ছোট ছিলাম, তারা হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেলাম। বুঝে গেলাম, যুদ্ধ কোন খেলা নয়, এর সাথে বাঁচা-মরা জড়িত। মা’ আর একটু হলেই মিলিটারীর কাছে ধরা পড়ে যেতে পারতো, কোনদিন আর ফিরে আসতোনা। এরপর তো সোনারগাঁও থাকার আর কোন যুক্তিই ছিল না। এই ঘটনার সাত দিনের মধ্যেই আমরা ননীবাবুর আশ্রয় ছেড়ে, ননীবাবুর ঠিক করে রাখা দালালের পিছু পিছু রওনা দিয়েছিলাম।

৪ঠা জুলাই, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস

স্কুল জীবনে বইয়ের পাতায় স্ট্যাচু অব লিবার্টির ছবি দেখেছিলাম। কখনও ভাবিনি কোন একদিন স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবো। ২০০১ সালে যেদিন আমেরিকার মাটিতে পা রাখলাম, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমান জে এফ কে বিমানবন্দরের মাথার উপর চক্কর খাচ্ছিলো, দেশ ছেড়ে এসেছি, কান্নাকাটিতে দুই চোখের পাতা ভারী, দুই দিনের প্লেন জার্নিতে দেহ অবসন্ন, সব ভুলে মোটা কাঁচের জানালায় মাথা রেখে খুঁজছিলাম স্ট্যাচু অব লিবার্টি।

বাংলাদেশের মেয়ে আমি, মহান মুক্তিযুদ্ধ আমার অহঙ্কার, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকের সামরিক শাসনের শৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। রক্তে আমার মুক্তির আনন্দ, পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার গান, আমি তো মুক্তির মশালধারী মূর্তিকে দেখতেই চাইবো। স্বদেশের জন্য কান্না, জার্নির ক্লান্তি ছাপিয়ে সেদিন স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখার তীব্র আকুলতা জেগেছিল, উঁচু আকাশ থেকে দিগন্ত বিস্তৃত নিউইয়র্কের মাটিতে মুক্তির মশালধারী নারীকে ঠিকই দেখতে পেয়েছিলাম।

মুক্তির আনন্দ কে না চায়, স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচতে চায়। জগতের প্রতিটি প্রাণী তার নিজের মত করে বাঁচতে চায়, পরাধীনতার শৃঙ্খলে কেউ বাঁধা পড়তে চায়না। ভারতবাসী বৃটিশ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গেছিল, বাঙ্গালী ভেঙ্গেছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের শৃঙ্খল। বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল অনেক দেশ, অনেক জাতি। সকলেই শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। বৃটিশ শৃঙ্খল আমেরিকানরাও ভেঙ্গেছিল, শৃঙ্খল ভেঙ্গে গ্রেট বৃটেনের শাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ নতুন জাতি, ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা’র জন্ম হয়েছিল, ১৭৭৬ সালের ৪ঠা জুলাই তারিখে।

পেছন ফিরে দেখাঃ

গ্রেট বৃটেন নিজেদের আধিপত্য এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে ১৬০৭ সাল থেকে ১৬৩২ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকা’র ইস্ট কোস্ট অঞ্চলে তেরটি কলোনি স্থাপন করে। সর্বপ্রথম ব্রিটিশ কলোনি স্থাপিত হয় ভার্জিনিয়ায়, এবং সর্বশেষ জর্জিয়ায়। বাকী এগারোটি কলোনি হচ্ছে, ম্যাসাচুসেটস, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, মেরিল্যান্ড, কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড, ডেলাওয়ার, সাউথ ক্যারোলাইনা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া। উল্লিখিত কলোনিগুলোর রাজনৈতিক, সাংবিধানিক এবং আইন ব্যবস্থায় যথেষ্ট মিল ছিল।

আমেরিকায় ফ্রেঞ্চ কলোনিও ছিল, গ্রেট বৃটেনের সাথে ফ্রান্সের শত্রুতাও ছিল। তাই আমেরিকা থেকে ফ্রান্সের আধিপত্য হটিয়ে দিতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ কলোনিগুলোকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অনেকবার যুদ্ধ করতে হয়েছে। ১৭৬৩ সালে ফ্রান্স আধিপত্য গুটিয়ে নিয়ে আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হয়।

উত্তর আমেরিকায় স্থাপিত ব্রিটিশ কলোনির সাথে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বাহ্যিক যোগাযোগ ছিল ১৭৫০ সাল পর্যন্ত। যদিও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব ছিলনা, কোনরকম অংশগ্রহণের সুযোগ ছিলনা, কিন্তু তাদেরকে নিয়মিত ট্যাক্স দিতে হতো। ধীরে ধীরে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, এক কলোনির সাথে আরেক কলোনির যোগাযোগ এবং সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন এবং আরও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের উৎসাহ এবং প্রচারণায় ‘আমেরিকান’ হিসেবে নিজেদের আইডেনটিটি সম্পর্কে জনগণ সচেতন হতে শুরু করে। বৃটিশ পার্লামেন্টে অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে ট্যাক্স না দেয়ার দাবীতে সকলের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠে। ব্রিটিশ কলোনিস্ট নয়, আমেরিকান হিসেবে নিজেদের আলাদা স্বীকৃতির দাবীতে ১৭৭৪ সালে গঠিত হয় ‘কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস”, যা ১৭৭৬ সালে গ্রেট বৃটেনের অধীনস্থতা থেকে বেরিয়ে এসে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা করে, আলাদা আলাদা রাজ্য সরকার গঠণ করে, সকল রাজ্যকে সংযুক্ত করে আমেরিকার নতুন নামকরণ হয় ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’।

ভারতবর্ষ যেমনি ইংরেজ শাসকদের অধীনে ছিল দুইশত বছর, পৃথিবীর আরও অন্যান্য দেশের মত আমেরিকার ১৩টি রাজ্য গ্রেট ব্রিটেনের অধীনস্থ কলোনি হিসেবে পরাধীন ছিল। কেউ পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাধা থাকতে চায়না, পরাধীনতার গ্লানি থেকেই প্রতিবাদী চেতনা জাগ্রত হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমেরিকানদের প্রতিনিধিত্ব ছিলনা, কিন্তু প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই আমেরিকানদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করা হতো। বৃটিশ পার্লামেন্টে আমেরিকানদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই বাধ্যতামূলক ট্যাক্স প্রদানকে কেন্দ্র করে বৃটিশরাজের বিরুদ্ধে তের কলোনিতেই অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। তের কলোনিস্টসদের এই অসন্তোষ যেন বিদ্রোহে রূপান্তরিত না হতে পারে, সেজন্য ব্রিটিশরাজ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেয় আমেরিকানদের বিদ্রোহকে দমন করতে। কিন্তু মিলিটারী দিয়ে সেদিন কলোনিস্টদের বিপ্লব দমন করা যায়নি।

আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল, প্রতিবাদ থেকে বিপ্লব, যা ইংরেজীতে বলে ‘রেভুলিউশন। আমেরিকান রেভুলিউশন যখন তুঙ্গে, তখন ১৭৭৬ সালের জুন মাসে ভার্জিনিয়ার কংগ্রেসম্যান রিচার্ড হেনরী লী কংগ্রেসে ‘রেজুলিউশন অব ইনডিপেন্ডেনস’ তৈরীর প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

১৭৭৬ সালের ১১ই জুন ফিলাডেলফিয়াতে কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসের অধিবেশন হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে একটি কমিটি গঠিত্ হয়, কমিটি গঠনের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল গ্রেট বৃটেনের অধীনস্থতা থেকে বেরিয়ে আসার দিকনির্দেশনা সম্বলিত একটি খসড়া দলিল তৈরী করা। কমিটিতে ছিলেন থমাস জেফারসন, বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন, জন অ্যাডামস, রজার শেরমান এবং রবার্ট আর লিভিংস্টোন। থমাস জেফারসন ছিলেন শক্তিমান লেখক, স্বাধীনতা দলিলের খসড়াটি উনিই তৈরী করেন, জেফারসন রচিত দলিলে ৮৬ স্থানে পরিবর্তন করার পর সেকেন্ড কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস ২রা জুলাই, ১৭৭৬ ভোটের মাধ্যমে রেজুলিউশন অব ইন্ডিপেনডেনস বিল পাস করেন, এবং ৪ঠা জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়।

১৭৭৭ সালে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের প্রথম বর্ষ পূর্তিতে তেরটি ফাঁকা গুলী ছুঁড়া হয়েছিল, সকালে একবার, সন্ধ্যায় আরেকবার।
১৭৯১ সালে ৪ঠা জুলাই ইনডিপেনডেন্স ডে হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়।
১৮৭০ সালে ইউ এস কংগ্রেস ফেডারেল এমপ্লয়ীদের জন্য অবৈতনিক ছুটির দিন ঘোষণ আকরা হয়।
১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে ইনডিপেন্ডেন্স ডে মজুরীসহ ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।

গ্রেট বৃটেনের শাসনের শৃঙ্খল ভেঙ্গে ইউনাইটেড স্টেট অফ আমেরিকার জন্ম হয় ১৭৭৬ সালের ৪ঠা জুলাই, ৬ই ডিসেম্বার ১৮৬৫ তারিখে আমেরিকা থেকে ক্রীতদাস প্রথা (অফিসিয়ালি) বিলুপ্ত হয়। ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্তির সাথে সাথে আমেরিকার আকাশে বাতাসে গীত হয় শিকল ভাঙ্গার গান, মুক্তির গান! আমেরিকান জনগণ সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হয়। ফ্রান্সের জনগণের তরফ থেকে ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকার জনগণকে উপহার দেয়া হয় ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’, দ্য ‘সিম্বল অফ ফ্রিডম এন্ড ডেমোক্রেসী’।

১৮৮৪ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির সকল কাজ সম্পন্ন হয়। ১৮৮৫ সালের জুন মাসে মূর্তিটি নিউইয়র্কে এসে পৌঁছায়, ১৮৮৬ সালের ২৮শে অক্টোবার প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’’র পর্দা উন্মোচন করেন।

ফোর্থ অফ জুলাই
আজ ৪ঠা জুলাই, আমেরিকার ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে, মানে আমেরিকার জাতীয় দিবস, দিনটি আমেরিকান জনগণের কাছে ফোর্থ জুলাই অথবা জুলাই ফোর্থ হিসেবে অনেক বেশী উচ্চারিত হয়ে থাকে।

১৭৭৬ সালের ৪ঠা জুলাই গ্রেট বৃটেনের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা’ নামে সম্পূর্ণ নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছিল। ইনডিপেনডেনস ডে আমেরিকান জনগণ যথাযোগ্য মর্যাদা এবং আনন্দ উৎসাহ নিয়ে পালন করে। দিনটি সরকারী ছুটির দিন। এই দিনে প্যারেড হয়, মেলা, বেসবল, কার্নিভ্যাল, পিকনিক, কনসার্ট, ফ্যামিলি রিইউনিয়ন তোঁ হয়ই, সারাদিন শেষে সাঁঝের বেলা থেকে শুরু হয় বাজি পোড়ানো, এই সর্বশেষ আতশ বাজির উৎসব দেখার জন্য আমেরিকানরা ঘর ছেড়ে খোলা মাঠে এসে জড়ো হয়। পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব, চেনা অচেনার মেলায় বসে সকলে আকাশের দিকে চোখ মেলে দেখে যায়, আকাশে উৎক্ষেপিত আতশ বাজির রঙবেরঙের মেলা।

আজ আমেরিকার আকাশে বাতাসে আনন্দ, সকলের বাড়ির আঙিনায় জাতীয় পতাকা উত্তোলিত, খাওয়া-দাওয়া হবে, কনসার্ট হবে, খেলা হবে, সবশেষে সন্ধ্যায় পরে আকাশে আতশবাজির মেলা চলবে।

কাকতালীয়ঃ
আমেরিকার স্বাধীনতার দলিলে যে পাঁচজন স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে জন অ্যাডামস এবং থমাস জেফারসন (উভয়েই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন) ৪ঠা জুলাই ১৮২৬, আমেরিকার পঞ্চাশতম স্বাধীনতা দিবসে মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীনতা দলিলে স্বাক্ষর করেননি কিন্তু ফাউন্ডিং ফাদার জেমস মনরো (উনিও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন) মারা যান ১৮৩১ সালের ৪ঠা জুলাই। আমেরিকার ৩০তম প্রেসিডেন্ট কেলভিন কুলিজ অবশ্য জন্মগ্রহণ করেছেন ৪ঠা জুলাই, ১৮৭২।

ফিরে আসি স্ট্যাচু পফ লিবার্টি’র সেই নারী মূর্তির প্রসঙ্গে।
রোমান দেবী লিবার্তা’র অনুকরণে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, যার এক হাতে আলোকবর্তিকা, অন্যহাতে আইনের বই। বইয়ের কভারে খোদাই করা আছে ৪ঠা জুলাই, ১৭৭৬। স্ট্যাচুর পায়ে ছেঁড়া শেকল, যার মানে ‘মুক্তি, এবং স্বাধীনতা’।

কিছু তথ্যঃ
স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র ডিজাইন করেন, ফ্রেঞ্চ স্কাল্পটর ফ্রেডেরিক অগাস্টি বার্থলডি।
নির্মাণে ছিলেনঃ ফ্রেডেরিক অগাস্টে, গুস্তভ আইফেল, ইগুইন ভায়োলেট, রিচার্ড মরিস হান্ট।
নির্মাণ শুরুঃ সেপ্টেম্বর ১৮৭৫
নির্মাণ শেষঃ অক্টোবার ১৮৮৬
মূর্তি তৈরীতে ব্যবহৃত হয়ঃ কপার, রট আয়রণ, স্টিল
উচ্চতাঃ ৩০৫ ফিট
স্থাপিতঃ লিবার্টি আইল্যান্ড, নিউইয়র্ক।

২০১৫ সালের জুন মাসে গিয়েছিলাম নিউইয়র্ক, বিশাল লঞ্চে চড়ে সরাসরি চলে গেছিলাম লিবার্টি আইল্যান্ড, স্ট্যাচু অফ লিবার্টকে খুব কাছে থেকে দেখতে চেয়েছি। লঞ্চ যত কাছে যায়, মূর্তি ততই বড় দেখায়। লঞ্চ থেকে আইল্যান্ডে নেমে মূর্তির দিকে তাকালাম, মূর্তির বিশালত্বে মুগ্ধ হলাম। স্বাধীনতার মশাল হাতে যিনি দাঁড়াবেন, তিনি অবশ্যই আকাশ ছোঁয়া উচ্চতায় পৌঁছাবেন, নাহলে স্বাধীনতার বিশালত্ব থাকে কি করে! আমার অনুভূতি!

বাংলাদেশে ভাড়া বাড়িতে কেটেছে কাল, তাই জাতীয় দিবসে জাতীয় পতাকা উড়াতে পারিনি কখনও। এই নিয়ে আমার মনে চাপা দুঃখ ছিল। বাংলাদেশে অবশ্য ‘৭৫ এর পর প্রতি বাড়িতে জাতীয় দিবসে জাতীয় পতাকা উড্ডয়নের রেওয়াজ আর নেই। আমেরিকায় প্রতিটি জাতীয় দিবসে প্রতিটি বাড়িতে জাতীয় পতাকা উড্ডয়ন করা হয়।

ধারের টাকায় কিনলেও আমেরিকাতেই নিজেদের নামে জীবনের প্রথম বাড়ি কিনেছি। জাতীয় দিবসে পতাকা উড্ডয়ন করিনি এতকাল, কেমন যেন মনে খুঁত খুঁত করতো। এরপর খুঁতখুঁতুনি চলে গেছে, আমেরিকা আমাদের নাগরিকত্ব দিয়েছে, নিশ্চিন্ত নিরাপদ নিরুপদ্রব জীবন, স্বাধীনভাবে চলার নিশ্চয়তা দিয়েছে। তবে কেন নিজেকে আমেরিকান ভাবতে এত খুঁতখুঁতুনি! গত তিন বছর যাবৎ আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোতে নিজ বাড়িতে আমেরিকান পতাকা উড়াই।

পতাকা হচ্ছে একটি দেশের পরিচয়। কোন দেশের প্রতি নানা কারণে বৈরী মনোভাব থাকতে পারে, তাই বলে কোন দেশের পতাকাকে অসম্মান করতে নেই। যার যার দেশের পতাকা তার তার কাছে সাত রাজার ধন।

ফেসবুকে অনেকেই বিভিন্ন সময় ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের পতাকার ছবি দিয়ে অশ্লীল, কুরুচীপূর্ণ মন্তব্য লিখে ট্রল করে। এটা অন্যায়, তেমন ছবি দেখলেই আমার মন খারাপ হয়।

আমি কখনও কোন দেশের জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করিনি, এমনকি পাকিস্তানের পতাকা দেখলেও অসম্মান করার কথা মনে আসেনা। ঈশ্বর পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মানুষের জীবন শান্তিময় করুন। আজ ৪ঠা জুলাই, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস, আমেরিকান নাগরিক হিসেবে সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা!

মুহূর্তে দেখা মানুষ! [ জীবনের সুখ সুখ গল্প ]

মুহূর্তে দেখা মানুষ! [ জীবনের সুখ সুখ গল্প ]

আগামীকাল আমাদের ওয়ালমার্টে অ্যানুয়াল অডিট হবে। গত পনেরো দিন ধরে ওয়ালমার্টে সকল এসোসিয়েট, ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজার, এসোসিয়েট ম্যানেজারগণ ইনভেন্টরি টিমের জন্য কাজ গুছিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত। আমিও ব্যস্ত ছিলাম, আগামীকাল অডিট হয়ে যাওয়ার পরেই আমাদের কাজের চাপ কিছু কমে যাবে।

আমি স্বভাবে চঞ্চল হলেও কাজের বেলায় খুবই সিরিয়াস। আমি কাজ করতে ভালোবাসি এবং কাজ করিও আন্তরিকতার সাথে। মানুষের সাথে গল্প করার সময়েও আন্তরিকতা নিয়েই করি। ওয়ালমার্টে প্রতিদিন কত মানুষ আসে, তাদের সবার দিকে তাকাই, অনেকের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের ভেতর পড়ার চেষ্টা করি। কাউকে আলাপী মনে হলে তার সাথে গল্প জুড়ে দেই। গত বারো বছরে এমনি কত শত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনের কথা পড়েছি, কত জনের সাথে আলাপ জুড়ে দিয়ে তাদের জীবনের গল্প শুনেছি। সেসব টুকরো জীবনের টুকরো গল্প জড়ো করে ‘মুহূর্তে দেখা মানুষ’ নামে একখানা বইও লিখে ফেলেছি।

ইদানিং আমার কাজের ক্ষেত্র প্রায়ই বদল হচ্ছে। দশ বছর ছিলাম ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে। ফোন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছি। এখন আমাকে দেয়া হচ্ছে ফটো ল্যাবের কাজ, নাহলে ফ্যাব্রিক্স ডিপার্টমেন্টে কাজ। আমাকে যেখানেই কাজ দেয়, কাজ করি। সবই নতুন কাজ, ভাল লাগলে আগ্রহ নিয়ে শিখি। আমি খুব দ্রুত শিখতে পারি, এবং একবার শিখে ফেললে সেই কাজ নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করি। ফটো ল্যাবের কাজ আমার ভাল লাগতে শুরু করেছে। ফ্যাব্রিক্স ডিপার্টমেন্টের কাজ আগেও ভাল লাগতো, চারদিকে এত সুন্দর সুন্দর ফ্যাব্রিক্স! রঙের সমাহার দেখলে মনটাও রঙিন হয়ে ওঠে।

অডিট উপলক্ষে গত ক’দিন ফ্যাব্রিক্স ডিপার্টমেন্টের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এই ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার নাকি খুব খ্যাটখেটে ধরণের, আমাকে এই সতর্কবাণী অনেকেই দিয়েছিল। হ্যাঁ, ম্যানেজার মহিলা একটু পিটপিটে স্বভাবের ঠিকই, তবে আমার সমস্যা হচ্ছেনা। ভদ্রমহিলার বয়স বাষট্টি, খিটখিটে তো হতেই পারে। আমার সাথে সে খিট খিট করেনা কারণ আমি তার মনমত কাজ করি। সে দশবার আমায় থাংক ইউ থ্যাংক ইউ বলে।

আজ আমার কাজের শিডিউল ছিল দুপুর একটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। গত ক’দিনে ওয়ালমার্টে আগত মানুষদের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকানোর ফুরসত পাইনি। আজও সেই সুযোগ ছিলনা আগ বেলায়। কিন্তু রাত সাড়ে ন’টার দিকে আমি যখন লাস্ট টি ব্রেক নিয়ে ফিরছিলাম, মনের মধ্যে ছিল রাজ্যের ক্লান্তি। কতক্ষণে দশটা বাজবে, বাড়ি ফিরবো। আজ আমার শিফট ছিল ফটো ল্যাবে। ফটো ল্যাব বন্ধ হয়ে যায় রাত আটটায়। এরপর হাতে তেমন কাজ থাকেনা তবুও রাত দশটা পর্যন্ত থাকতে হয়, কাজ ছাড়া এক মিনিটও আমার বাড়ির বাইরে থাকতে ভাল লাগেনা।

আমি যাচ্ছিলাম ফ্যাব্রিক্স ডিপার্টমেন্টের দিকে, আমার সামনেই এক মোবাইল শপিং কার্টের সামনে নড়বড়ে চেহারার ছোটখাটো এক বুড়িকে দেখলাম, ভাল করে হাঁটতে পারছেনা। মোবাইল শপিং কার্টে চড়ে ঘুরছিল, কোথাও হয়তো থেমেছিল। এখন আবার কার্টে উঠার জন্য কসরত করছে।

বুড়ি দেখতে দারুণ সুন্দরী, পোশাকেও আভিজাত্যের ছাপ। বুড়ির আশেপাশে কেউ নেই। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“তোমাকে কি হেল্প করতে পারি?”

এই একটা মাত্র প্রশ্ন করতেই যেন সোডার বোতল খুলে গেলো। বুড়ি কোনরকম সাহায্য ছাড়াই ক্যাতরে ক্যাতরে কার্টে উঠে বসলো। এবার বুড়ি হাঁফাতে হাঁফাতে বলতে শুরু করল,

“আমি ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। পা দুটোতে প্রচন্ড ব্যথা, ডাক্তার যে সিবিডি ওষুধ দিয়েছিল ( মেডিসিনাল মারিজুয়ানা), সেটা অনেকদিন খেলে নাকি খারাপ প্রতিক্রিয়া হয়। তাই ওটা বাদ দিয়েছি। আমি এমনিতেও মেডিসিন কম খাই, কিন্তু আমার হাঁটুর রিপ্লেসমেন্ট হওয়ার পর যে ব্যথা, তা সহ্য করা কঠিন। তাই ডাক্তারের কাছে গেছিলাম নতুন কোন ওষুধের জন্য।

-তোমার knee replacement হয়েছে?

-হ্যাঁ। তার জন্যইতো এত ব্যথা। এজন্য ডাক্তারের কাছে গেলাম, বললাম মেডিসিন বদলে দিতে। তা বদলে দিল, আমি এলাম ওয়ালমার্টে। এসে দেখি ফার্মেসি বন্ধ।

-ফার্মেসিতো রাত আটটায় বন্ধ হয়ে যায়, এখন বাজে সাড়ে নয়টা।

-শোনইনা, ফার্মেসি বন্ধ হয়ে গেছে তা যাক। বাড়িতে আমার ওষুধ আছে। সিবিডিও আছে। আসলে আমার পরিচিতরা বলেছে সিবিডির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব খারাপ। তবে আমার মনে হয়না আমার বেলায় তেমন খারাপ হবে।
আমি তো জীবনেও ড্রাগ নেইনি, মারিউয়ানা সেবন করিনি। আর সিবিডি তো মেডিসিনাল মারিউয়ানা, ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা, ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তবু বন্ধুদের কথাও ফেলে দিতে পারিনা।

আমি যেদিন প্রথম ওষুধ (মেডিসিনাল মারিউয়ানা) খেলাম, মনে হচ্ছিলো, আমি পাখির মত উড়ছি। শরীরটা হালকা হয়ে গেলো। আমার স্বামীকে বললাম, জানো মনে হচ্ছে আমি শূন্যে ভাসছি। আমার স্বামী তো ভয়ে আঁতকে উঠেছে।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই বিছানায় চলে গেলাম, সে কী ঘুম! যে আমি রাতের পর রাত ঘুমাতে পারতাম না, সেই আমি বাচ্চাদের মত বেঘোরে ঘুমালাম। ঘুম থেকে উঠেই টের পেলাম, কোথাও ব্যথা নেই।
বেশ ক’দিন খেলাম, ঘুমালাম। পরেই মনে হলো, যদি আসক্ত হয়ে পড়ি! তাই খাওয়া বাদ দিলাম।
আরে কী বলি, শুধু কি অন্যের কথায় বাদ দিয়েছি! আমার নিজের নাতি ডাক্তার, মস্ত বড় ডাক্তার আমার নাতি। ওরাল সার্জন, খুব ভাল ডাক্তার।
অনেক বাচ্চা জন্মায় ঠোঁট কাটা নিয়ে, অথবা মুখের ভেতরে মাড়ি কাটা নিয়ে, আমার নাতি সেসব কেইস খুব ভালোভাবে সার্জারি করে ঠিক করে দেয়। আমার নাতি কেমন ডাক্তার, একটা ঘটনা বলি, তাহলেই বুঝবে।

একদিন আমি আমার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশির সাথে গল্প করছি, রাস্তায় একটা গাড়ি থামলো। সেই গাড়ি থেকে একটি তরুণী নেমে এলো। আমায় জিজ্ঞেস করলো, “ কিছু মনে করবেন না, আপনি কি মিসেস মর্গ্যান?”

-হ্যাঁ, আমি ফে মর্গ্যান।

-আমি আপনার নাতির কাছে আপনার কথা শুনেছি। আপনার নাতি আমার ডাক্তার। আপনার নাতি আমার দেখা সবচে সুদর্শন, সবচে ভাল ডাক্তার।
আমার চোয়ালে ক্যান্সার হয়েছিল, আমার মা, আমার ভাই এই একই রোগে মারা গেছে। সকলেরই চোয়ালে ক্যান্সার। আমারও বাঁচার কথা ছিলনা। কিন্তু আমার চোয়ালের সার্জারী হয়েছে অত্যন্ত দক্ষ একজন সার্জনের হাতে, তাই আমি বেঁচে গেছি। সেই দক্ষ সার্জনটি হচ্ছে আপনার নাতি”।
বলে তরুণী কাঁদতে শুরু করলো।

তরুণীর মুখের অনেকটাই বাঁকা হয়ে গেছে, তবুও সে খুশি যে সে ্ভাল হয়ে গেছে। মেয়েটি এসে আমায় জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। বার বার বলল, আমি যেন আমার নাতিকে তার হয়ে একরাশ কৃতজ্ঞতা জানাই।
তাকে বললাম, আমি আজই ফ্রেডকে ফোন করে বলবো তোমার কথা।

আচ্ছা, এবার তুমিই বলো, গায়ে কাঁটা দেয় কিনা এমন ঘটনায়। আমি তো আমার নাতিকে ভালো বলবোই, সকলেই সকলের নাতিকে ভাল বলবে। কিন্তু যখন অচেনা কেউ এসে আমার বাড়ি বয়ে আমার নাতির প্রশংসা করে যাবে, সেটা একদম অন্যরকম, তাইনা?

-বাহ! তোমার এই অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমারও খুব ভাল লাগছে। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, তুমি যেমনি তোমার নাতিকে ভালোবাসো, নাতির গল্প অন্যের কাছে বলতে ভালোবাসো, তোমার নাতিও তোমাকে তেমনি ভালোবাসে, তোমার গল্প তার রোগীদের কাছে শোনাতে ভালোবাসে। তোমার নাতি সেই মেয়ের কাছে তোমার গল্প করেছে বলেইতো মেয়েটি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।

-ঠিক তাই।

-তোমার নাতির বয়স কত?

-এই তো ৩৪ পূর্ণ হলো। আমার বড় মেয়ের ঘরের নাতি। ছয় ফিট তিন ইঞ্চি হাইট, দেখতে যা সুন্দর।

-বললাম, তুমি নিজেইতো দারুণ সুন্দর, তোমার নাতি তো সুন্দর হবেই।

-আমার কথায় বুড়ি লাজুক হাসি দিলো, এত সুন্দর লাগলো বুড়িকে সেই হাসিতে। এখনও দেখলে বুঝা যায়, বুড়ি তরুণী বয়সে মারদাঙ্গা টাইপ সুন্দরী ছিল।

– জানো তো, আমার নাতি বিয়ে করেছে দুই বছর আগে, ওর বউও ডাক্তার। ওর বউ খুব সুন্দরি। হাফ আমেরিকান, হাফ ইতালিয়ান। ওর নাম ভিভিয়ান, আমার নাতির নাম ফ্রেডেরিক। দুজনের গভীর প্রেম।

ভিভিয়ান খুবই মেধাবী স্টুডেন্ট ছিল, ইউনিভারসিটি অব মিশিগানে নাম্বার ওয়ান স্কলারশিপ পেয়েছে। ওরা দুজন দুজনকে এত ভালোবাসে, দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। মজার কথা বলি, ভিভ আর ফ্রেড প্ল্যান করেছিল, এ বছর ওরা ওয়ার্ল্ড ট্যুর করবে। সব কিছু পাকাপাকি করে ফেলার পর কি হলো জানো, ভিভ জানতে পারলো যে ও মা হতে চলেছে। হা হা হা! মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। আরও মজার কথা, ভিভের বাচ্চা হওয়ার তারিখে ফ্রেডের জন্মদিন। কী মজা না!

-আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বুড়ির গল্প শুনতে ভাল লাগছে, বুড়ি আমার কাছে তার সুখের গল্পগুলো করতে পেরে খুব খুশি। অথচ ওয়ার্কিং আওয়ারে এভাবে কারো সাথে গল্প জমিয়ে বসানোটাও ঠিক নয়। বুড়িকে থামাই কি বলে!

এবার বুড়ি বলল, এই যে আমি তোমার সাথে এত কথা বলছি, তোমাকে দেখেই আমার ভাল লেগেছে। মনে হচ্ছে, তোমার সাথে বসে সারাদিন গল্প করা যায়।

মনে মনে প্রমাদ গুনি, কী বলছে রে! আমার সাথে গল্প করতে ভালো লাগলে আমার চলবে কি করে!

বললাম, তোমার নাতিকে জিজ্ঞেস করে দেখেছো, হাঁটুর ব্যথার জন্য মেডিসিনাল মারিউয়ানা দীর্ঘদিন খাওয়া ঠিক না বেঠিক?

আমার নাতি তো অনেক বড় ডাক্তার হলে কি হবে, গডের উপর অগাধ বিশ্বাস। সে আমায় বলে, জানো তো গ্র্যান্ডমা, যখন ছোট্ট বাচ্চাদের ( ঠোঁট কাটা, মাড়ি কাটা) নিয়ে আসে, অপারেশান টেবিলে বাচ্চাটা শোয়ানো থাকে, সবার প্রথমে আমি বাচ্চার হাতটা ধরি। বাচ্চার হাত ধরে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, ঈশ্বর, আমি যেন পারি। আমি যেন এই ছোট্ট শিশুকে সুন্দর স্বাভাবিক জীবন উপহার দিতে পারি। অপারেশান শেষে দুই সপ্তাহ পর যখন বাবা মায়ের কোলে চড়ে বাচ্চাগুলো আসে পরবর্তি চেক আপে, বাচ্চাগুলো আর সব বাচ্চাদের মত হাসি দেয়, আমি তখন ডাক্তারি ভুলে গিয়ে মোমের মত গলে যেতে থাকি। কতদিন এমন হয়েছে যে সবার সামনে আমি কাঁদছি”।

-বুঝলাম, বুড়ি কথার খেই হারিয়ে ফেলছে। যা জানতে চেয়েছি তা বলতে ভুলে যাচ্ছে। তবে বুড়ির মুখে তার নাতির কথা শুনে খুবই ভাল লাগছে আমার। হয়, এমন অনেক তরুণ তরুণীদের আমি দেখেছি, মনে মননে তারা অতি চমৎকার। এই যে বুড়ির নাতি সার্জারি শুরুর আগে বাচ্চাদের হাত স্পর্শ করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, গল্পের এই অংশটুকু শুনে আমার নিজের চোখেই জল আসার উপক্রম!
জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বয়স কত?

-আমার বয়স ৭৯, আমার স্বামীর বয়স ৮১। জানো তো, আমার মা বাবা দুজনেই জীবিত, দুজনেই নার্সিং হোমে থাকে।

-তাই নাকি? তোমার মা বাবা বেঁচে আছেন? এতো অসাধারণ কথা!

-হ্যাঁ, আমার বাবার বয়স ১০১, মায়ের বয়স গতকাল ৯৯ পূর্ণ হলো।

-উনারা কি একই নার্সিং হোমে থাকেন? দুজনেই হাঁটা চলা করতে পারেন?

-একই নার্সিং হোমে থাকেন। বাবা হাঁটতে পারেন, কিন্তু মা হুইল চেয়ারে চলেন। আরে, ওরা তো আগে রুম মেট ছিল। এখন আলাদা রুমে থাকে। কি হয়েছে জানো!
যখন ওরা রুমমেট ছিল, একদিন আমার আন্টি একটা পুতুল নিয়ে মা’কে দেখতে গেছিল। পুতুলটা দেখে মা খুব খুশি। যখন শুনলো, পুতুলটা মায়ের জন্যই নিয়ে গেছে আন্টি, মা পুতুলটাকে সত্যিকারের বাচ্চা ভেবে কোলে নিয়ে দোল দিল। বিছানায় নিজের পাশে শোয়ালো।
আমার বাবা তো মা’কে খুব ভালোবাসে। সব সময় খেয়াল রাখে। রাতে বাবা বলল, পুতুলটাকে সাইড টেবিলে রেখে দাও। নাহলে ঘুমের মধ্যে তুমি যখন এপাশ ফিরবে, পুতুলটা তোমার হাতের বা পিঠের নীচে চলে গেলে তুমি ব্যথা পাবে। তোমার হাড়গোড় এখন খুব নরম, বলা যায়না পুতুলের চাপে তোমার হাড় ভেঙ্গেও যেতে পারে।

বাবার কথা মা শুনলো না। জেদ করে পুতুল বুকে চেপে ধরে রাখলো। আর বাবা কি করলো, নিজের বিছানা থেকে নেমে এসে পুতুলটাকে হ্যাঁচকা টান দিল। মা ধরে রেখেছিল শক্ত করে, ফলে টাল সামলাতে না পেরে বাবা দুম করে মাটিতে পড়ে যায়। সেই থেকে নার্সেরা দুই জনকে আলাদা করে দেয়। দুজনেই তো অবুঝ। এখন মায়ের রুমমেট যে, সে মায়ের থেকে ১৫ বছরের ছোট, হলে কি হবে, সে কোন কথা বলেনা, ভ্যাবলার মত পড়ে থাকে।

মায়ের সময় কিভাবে কাটে বলো! নার্স বলল, মায়ের নিজস্ব একটা প্যাটার্ন আছে। মা নাকি সারা দিন সারা রাত কথা বলে, ঘুমায়না একবারের জন্যও। এভাবে তিন চার দিন কেটে যায়, এরপর মা ঘুম দেয়। সেই ঘুমও একটানা তিন দিন ঘুমায়। তিন দিনে এক মিনিটের জন্যও জাগেনা। কী অদ্ভুত না?

-হ্যাঁ, অদ্ভুত। এভাবেই মানুষ নিজের নিয়মে বেঁচে থাকে।

-আমরা গতকাল নার্সিং হোমে গেছি মায়ের ৯৯তম জন্মদিন পালন করতে। মা’কে ডাইনিং রুমে বসিয়ে আমরা কত কিছু খাওয়াচ্ছি। এক সময় মা হাত উঁচু করে বলল, আর খাবোনা। বলেই মা ঘাড় হেলিয়ে দিল। মা ঘুমিয়ে পড়লো, আমরা ডেকেও আর সাড়া পেলামনা।

আমার বাবা মায়ের ৮১ বছরের বিবাহিত জীবন। আর আমাদের বিবাহিত জীবন ৫৫ বছর। আমাদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বয়স ৫৭, ছোট মেয়ের বয়স ৪৭। আমার ছোট মেয়ে বিয়ে করেছে ৩৫ বছর বয়সে। তার বর ছিল হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা প্রযোজক। এখন অবশ্য প্রযোজনা করেনা। এখনও পুরনো দিনের আন্তর্জাতিক অনেক চলচ্চিত্রে প্রযোজক হিসেবে তার নাম দেখায়।

আমার মেয়ে সঙ্গিত শিল্পী, সে কান্ট্রি মিউজিক নিয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি করেছে। তার নিজস্ব স্টুডিয়ো আছে। সে গান বাজনা নিয়ে থাকে।
তার স্বামীর হঠাত করেই খেয়াল হয়, সিনেমায় প্রযোজকদের নাম কেউ জানেনা, কেউ চিনেওনা। যত নাম ডাক হয় সিনেমার নায়ক নায়িকাদের, নায়ক নায়িকাদের যারা স্টার বানায়, সেই প্রযোজকদের কথা কেউ জানতেও চায়না। তাই সে সিনেমা লাইন ছেড়ে চলে আসে।
আর বড় মেয়ের কথা কি বলবো। তুমি তো শুনলেই, আমাদের বিয়ের বয়স ৫৫, কিন্তু আমার মেয়ের বয়স ৫৭।

এরপরের বর্ণনা থেকে জানলাম, বুড়ির নাম ফে। ফে প্রথম জীবনে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল যে তরুণকে, বিয়ের কিছুদিন পর সেই তরুণ স্বামী বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে মদ খাওয়া শুরু করে। এবং ধীরে ধীরে অ্যালকোহলিক হয়ে যায়। অ্যালকোহলিক হওয়ার পর সে প্রায়ই স্ত্রীর সাথে দূর্ব্যবহার করতো। তরুণী স্ত্রী স্বামীকে অনেক বুঝিয়েছে, চেষ্টা করেছে অ্যালকোহল থেকে দূরে সরিয়ে আনতে, কিন্তু পারেনি। একদিন স্বামী মদ্যপ অবস্থায় স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছে। সেদিন তরুণী স্ত্রী এতটাই হতভম্ব এবং অপমানিত বোধ করেছে যে তার বাবাকে ফোন করে বলেছে যেন তাকে এসে নিয়ে যায়।

ফে তার বাবা মায়ের আদরের কন্যা, কন্যার এতটুকু অপমান তারা হতে দিবেন কেন। বাবা কথা বলল একজন ল’ইয়ার বন্ধুর সাথে। ল’ইয়ার কথা বলল ফে’র সাথে। ফে বলল, সে ডিভোর্স চায়। হয়ে গেলো ডিভোর্স, এক বছরের কন্যাশিশুকে কোলে নিয়ে ফে চলে এলো বাবার কাছে। তারও এক বছর পর ফে’র দ্বিতীয়বার বিয়ে হয় বর্তমান স্বামীর সাথে, এবং বর্তমান স্বামীই তার প্রথমা কন্যার বায়োলজিক্যাল ড্যাড না হলেও ‘রিয়েল ড্যাড’। ওদের বিয়ের সময় ফে’র মেয়ের বয়স ছিল দুই বছর, বিয়ের পর ফে’র কন্যাটি ফে’র নতুন স্বামীর মাঝেই তার সত্যিকারের পিতাকে খুঁজে পায়।

দ্বিতীয় বিয়ের আট বছর পর ওদের সংসারে আরেকটি কন্যাশিশুর জন্ম হয়। ফে’র স্বামী মেয়েদের পরিচয় দেয়ার সময় সবসময় বলেন, আমার বড় মেয়ে, আমার ছোট মেয়ে।
বুড়ি ব্যাগ থেকে তার ফোন বের করলো। ফোন থেকে সে কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। বুঝলাম, সে তার নাতির ছবি দেখাতে চায়। বুড়ো মানুষ, মেসেজ বক্স হাতড়াচ্ছে, নাতির অফিস রুমের ছবি আছে, আরও হড়ং বড়ং ছবি আছে নাতির ছবি পাচ্ছেনা। বিরক্ত হয়ে বলল, এই টাচ স্ক্রিন ফোন আমার অসহ্য লাগে। কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়না। আমার মেয়ে বলে, এই ফোনের দোষ যদি হয় ১০%, তোমার দোষ ৯০%। তুমিই ফোন ব্যবহার করতে জানোনা। হা হা হা

-তুমি কি ফেসবুক করো?

-আরে সর্বনাশ! ফেসবুক করবো আমি? মরে গেলেওনা। আমার বন্ধুদের সবার ফেসবুক আছে, শুধু আমার নেই। জানো কি হয়েছে, আমার এক বন্ধু দুই সপ্তাহের জন্য ক্রুজে গেছিল, এই কথা ফেসবুকে সে জানিয়েছে। ওমা, ফিরে এসে দেখে , তার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ফেসবুকে বলেছে বলেইতো এটা হয়েছে। আমার মেয়ে বলেছে, ফেসবুক করলে নাকি হ্যাকাররা আমার সমস্ত ইনফরমেশান বের করে ফেলবে। যদিও আমি কোন ইনফরমেশান দেবোনা, তবুও। মেয়ে বলল, কারা নাকি হ্যাক করে দুইশ মিলিয়ন আইডির ইনফরমেশান বের করে ফেলেছে?

-হা হা হা! হতে পারে।

-এইজন্য ফেসবুকে আমি নেই। আমার আত্মীয় বন্ধু সবাই আমার উপর বিরক্ত ফেসবুকে নেই বলে। একবার ভাবি, ফেসবুক খুলি, আবার ভাবি থাক।

-থাক, ফেসবুক একাউন্ট খুলো না। অনেক রাত হলো, তুমি বাড়ি যাবেনা?

-সেই ভাল, কি বলো।
ঠিক এমন সময় বুড়ির ফোন বেজে উঠলো, কিন্তু বুড়ি আমার সাথে ফেসবুকের অপকারিতা নিয়ে বলেই চলেছে।
-বললাম, ফোন বাজছে। দেখো তোমার স্বামী ফোন করেছেন হয়তো।

-হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখছি। ঠিক বলেছো, আমার স্বামী। হাই ডার্লিং, এই তো আমি চলে আসছি। কথা বলছি সুইট একটা মেয়ের সাথে। [ ‘সুইট মেয়ে’ শোনার সাথে সাথে আমার বিষম খাওয়ার অবস্থা। সুইট মহিলা বললে বিষম খেতাম না] বলে ফোন রেখে দিল। ফোন রেখেই বলল, এবার যাব। আমি প্রায়ই ওয়ালমার্টে আসি, এখানে এলে কিছু মানুষের দেখা পাই যাদের সাথে কথা বলতে আমার ভএল লাগে। এই যেমন আজ তোমাকে পেলাম, তোমাকে দেখার সাথে সাথেই গল্প করতে ইচ্ছে করলো।

-মিস ফে, ভাগ্যিস তোমার সাথে দেখা হয়েছে। মানুষের জীবনের সুন্দর গল্প শুনতে আমার খুব ভাল লাগে। জীবনের গল্পগুলো তো এমনি এমনি সুন্দর হয় না, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক কষ্ট সহ্য করে তবেই জীবনের গল্প সুন্দর করে বলা যায়, লেখা যায়, তাইনা?

-বাহ, কী সুন্দর কথা বললে। হ্যাঁ, অনেক কষ্ট করতে হয়, তবেই জীবনের গল্প সুন্দর হয়। আমার এখন সুখের সময়। আমার বড় মেয়ের ঘরে তিন ছেলেমেয়ে, তিনজনই সেরা। আর বড় নাতির গল্প তো করলামই, সে একদিন মস্ত বড় সার্জন হবে।

-নিশ্চয়ই হবে। আজ তাহলে গল্প এখানেই শেষ করি? অনেক রাত হয়ে গেছে, রাত ১০টা বাজে, তোমাকে তো ফিরতে হবে।

-আবার দেখা হবে রিটা, ভালো থেকো।

প্রিয় বাবা, বাবা দিবস ও আগে পিছের বলা না-বলা কথা!

প্রিয় বাবা, বাবা দিবস ও আগে পিছের বলা না-বলা কথা!

ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে চাকরী করার সুবাদে আমেরিকার জনগণ, সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, রাজনীতি থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ে অল্প-বিস্তর ধারণা হয়েছে। বিশেষ করে ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে প্রতিদিন কত বর্ণের, কত জাতের গ্রাহক আসে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করার ছলে তাদের কাছ থেকে জীবনের গল্প শোনার সুযোগ হয়, কত অজানাকে জানা হয়।

ওয়ালমার্টে গত বারো বছরের উপর চাকরী করছি, বারো মাসের মধ্যে এগারো মাসই ওয়ালমার্টে উৎসবের আমেজ থাকে। বছরে কতগুলো যে দিবস পালন করা হয়, একেক দিবসের একেক বার্তা, একেক দিবসে একেক উৎসব, আমেরিকার জনগণ উৎসবপ্রিয়, আড্ডাপ্রিয়, জীবনপ্রিয়।

এরা জীবনকে খুব বেশী ভালোবাসে, ধুঁকে ধুঁকে অনেক লম্বা সময় বেঁচে থাকার চেয়েও হাসতে হাসতে-নাচতে নাচতে দশ বছর কম বাঁচাতেই ওদের সুখ। আনন্দ করতে যে কোন একটা উপলক্ষ হলেই হলো, শুরু হয়ে গেলো পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব মিলে আনন্দোৎসব। এই সকল আনন্দোৎসবে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি অনেক বেশী গুরুত্ব দেয়া হয় উপহার দেয়া-নেয়ার প্রতি। উপহার আদান-প্রদানের স্বতস্ফূর্ত রীতিকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে কর্পোরেট অফিসের কর্তাব্যক্তিগণ মুখিয়ে থাকেন, ফলে ঘরোয়া এবং পারিবারিক ও সামাজিক উৎসবগুলো রূপ পায় বাণিজ্যিক উৎসবে।

এজন্যই আমেরিকায় এত ‘দিবসের’ ছড়াছড়ি। মা-বাবার জন্যও দিবস উৎসব উদযাপিত হয়। অবশ্য বিনা কারণে কোন উৎসবই পালিত হয়না, প্রতিটি উৎসব আয়োজনের পেছনে গল্প আছে। মা দিবস, বাবা দিবস উদযাপনের পেছনেও গল্প আছে।

মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার পালিত হয় মাদার’স ডে, জুন মাসের তৃতীয় রবিবার পালিত হয় ফাদার’স ডে। আমেরিকাতেও মায়েদের কদর বেশী, কারণ আমেরিকাতে সকলেরই যে বাবার ঠিকানা জানা থাকে তা নয়, কিন্তু মায়ের ঠিকানা সকলের জানা। এজন্যই মহা ধুমধামে পালিত হয় মাদার’স ডে, মাদার’স ডে উৎসব ঘিরে সকলের মাঝে কি যে এক স্বর্গীয় আনন্দ, আহ্লাদীপনা, আদিখ্যেতা শুরু হয়, তা চোখে না দেখলে বুঝা যাবেনা। সুপার মার্কেট, শপিং সেন্টারগুলো দেড় মাস আগে থেকে ‘মা’ময় হয়ে উঠে, আমেরিকার সর্বত্র যেন ‘মা’ বিরাজ করে। বাবা দিবসও উদযাপিত হয় ভালোভাবেই তবে মা দিবসের মত হৈ হৈ ভাব থাকেনা।

বাবা’ দিবস পালিত হয় প্রায় খুবই সাদামাটাভাবে। সুপার সেন্টারগুলোতে উপহার সামগ্রীর উপচে পড়া ভাব থাকেনা। সহজবোধ্য কারণটি হচ্ছে, পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ‘মা’ হওয়া যত সহজ, ‘বাবা’ হওয়া ততই কঠিন।

পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সন্তান জন্ম দেয়া যত সহজ, সেই সন্তানের পিতা হওয়া ততই কঠিন। ষোলো সতের বছরের ছেলে আনন্দ এবং খেলাচ্ছলে কোন নারীর গর্ভে সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করতেই পারে কিন্তু কিশোর বয়সে পিতা বা বাবা হওয়ার মানসিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা। এক মুহূর্তের আনন্দের ফলে একটি জ্যান্ত মানবশিশু সৃষ্টির ঘটনায় বেশীর ভাগ জন্মদাতা হয়তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে, নাহলে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়, তারা কখনও নিজ সন্তানের কন্ঠে ‘বাবা’ ডাক শুনতে পায়না। এজন্যই ‘মা’ দিবস আর ‘বাবা’ দিবসের আয়োজনে বৈষম্য দেখা যায়।

মা দিবস নিয়ে যতই হই হই রৈ রৈ থাকুক, আমার ভাল লাগে সত্যিকারের ‘বাবা’দের দেখতে। ‘মা’ তো মা, মায়ের কোন বিকল্প নেই। সত্যিকারের ‘বাবা’দেরও বিকল্প থাকেনা।

গত বছর এক মহিলা এসেছিলেন ফোন সার্ভিস চুক্তি নবায়ন করতে, তার হাতে ধরা ছিল খুব সুন্দর একখানা কার্ড, কার্ডের কভারে লেখা আছে, ‘তুমি পৃথিবী শ্রেষ্ঠ বাবা’। ভদ্রমহিলা একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। উনাকেই জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, মাদার’স ডে নিয়ে চারদিকে এত হই হই, রই রই কান্ড হয়, ফাদারস’ডে নিয়ে কেন কিছুই হয়না?”

ভদ্রমহিলা হেসে ফেললেন, এরপর ধীরে ধীরে বললেন, “কারণ একজন মা’কে যে সকল প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে জীবন পার করতে হয়, বাবাদের তো তার কিঞ্চিৎও পোহাতে হয়না, এইজন্যই বাবাদের নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস হয়না”।
বললাম, “ কিন্তু তুমি তো ঠিকই উচ্ছ্বসিত, তুমি তো ভাবছো, তোমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা”।

মাঝবয়সী মহিলাটি হেসে বললেন, “আমার বাবা পৃথিবী শ্রেষ্ঠ বাবা, আমার মা মারা গেছেন আমাকে অনেক ছোট রেখে, সেই থেকে আমার বাবাটি আমাদের সবাইকে বাবার আদর, মায়ের আদর দিইয়ে মানুষ করেছেন, কয়টা বাবা এমন করে”?

বললাম, “আমেরিকায় খুব বেশী বাবা এমন মহান কাজ করেনা, তবে আমাদের দেশে বাবারা এর চেয়েও অনেক বেশী কষ্ট করে ছেলেমেয়ে মানুষ করে। আমাদের দেশের বাবারা হচ্ছে জগতশ্রেষ্ঠ বাবা”।

হয়তো তোমার কথা ঠিক” বলে হাসতে হাসতে ভদ্রমহিলা বিদায় নিলেন।

ভদ্রমহিলাকে বিদায় করার পর মানসপটে ভেসে উঠলো না-দেখা এক নারীর মুখ, সোনোরা স্মার্ট ডড। ছয়টি নাবালক সন্তানকে ছোট রেখে সোনোরার মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। সোনোরার বিপত্নীক পিতা সিভিল ওয়্যার ভেটেরান উইলিয়াম স্মার্ট স্ত্রী বিয়োগের পর দ্বিতীয় বিবাহ করেননি, মা-হারা ছয়টি সন্তানকে মায়ের স্নেহে বড় করেছেন। বড় হয়ে সোনোরার মনে হতো, তার বাবা যে অসাধ্য সাধন করেছেন, তার স্বীকৃতি পাওয়া উচিত, শুধু মা্ নয়, সংসারে বাবাদের ভূমিকাও অনেক তাৎপর্য্যময়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ! কিন্তু বাবাদেরকে সেই স্বীকৃতি দেয়া হয়না।

১৯০৭ সালের ডিসেম্বার মাসে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া রাজ্যের মননগাহতে এক কয়লাখনি বিস্ফোরণে ৩৬২ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়, যাদের প্রায় সকলেই সংসারের প্রধান ছিল, সন্তানের পিতা ছিল। ঐ দূর্ঘটনায় এক হাজারের উপর শিশু পিতৃহারা হয়। ১৯০৮ সালের ৫ই জুলাই, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া্র একটি চার্চ-এর পক্ষ থেকে ‘কয়লাখনি বিস্ফোরণে নিহত ৩৬২ জনের’ স্মরণে একটি স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল। নিহতদের ঊদ্দেশ্যে স্মরণসভা হলেও ওটা ছিল মুলতঃ নিহত ‘বাবা’দের ঊদ্দেশ্যে আয়োজন, এবং শুধুই বাবাদের ঊদ্দেশ্যে ওটাই ছিল আমেরিকায় প্রথম সম্মাননা অনুষ্ঠান।
সেদিনের ঐ ছোট্ট অনুষ্ঠানের পথ অনুসরণ করে পরের বছর, ওয়াশিংটন রাজ্যের স্পোকেন শহরের অধিবাসী, সোনোরা স্মার্ট ডড, ‘মাদার’স ডে’র অনুকরণে ‘ফাদার’স ডে’ উদযাপণের জন্য উৎসাহিত হন এবং প্রচার শুরু করেন।

আনা জার্ভিস যিনি ‘মাদার’স ডে’র প্রবক্তা, ছিলেন সোনোরার আদর্শ। আনা জার্ভিসের দেখানো পথ অনুসরণ করে, ওয়াশিংটন রাজ্য সরকারের কাছে ‘ফাদার’স ডে’ উদযাপনের দাবীও সর্বপ্রথম সোনোরাই তুলেছিলেন। দাবীর সপক্ষে প্রচারণা চালাতে সোনোরা ওয়াই ডাব্লিউ সি এ, বিভিন্ন চার্চ, সরকারী অফিস, শপিং মল, সর্বত্র ঘুরেছেন, সকলের দ্বারস্থ হয়েছেন। একসময় সোনোরা সফলকাম হন।

১৯১০ সালের তৃতীয় রবিবার, ১৯শে জুন স্পোকেন ‘ওয়াই ডাব্লিউ সি এ’ তে প্রথম ‘ফাদার’স ডে’ উদযাপন করেন, পরে ওয়াশিংটন রাজ্য সরকার জুনের তৃতীয় রবিবার ‘ফাদার’স ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাজ্যের অধিবাসীদের মনেও ফাদার’স ডে উদযাপনের আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে এবং এভাবেই জনপ্রিয়তাও বাড়ে। শেষ পর্যন্ত ‘ফাদার’স ডে’ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় ১৯৭২ সালে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ‘ফাদার’স ডে’ রাষ্ট্রীয় ছুটি হিসেবে বিল পাশ করেন। সেই থেকে আজও জুন মাসের তৃতীয় রবিবার আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে ‘ফাদার’স ডে’ উদযাপিত হয়ে থাকে।

আমি বাংলাদেশের মেয়ে, বাংলাদেশের জল-হাওয়া, সমাজ, সংস্কৃতিতে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে উঠা আমার কাছে জীবনের প্রতিটি দিন বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। আমাদের এই উপ মহাদেশে বাবা দিবস অথবা মা দিবস নামে আলাদা কিছু ছিলনা। আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, বছরের প্রতিটি দিনই বাবা এবং মা’ কে ঘিরে আমাদের সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-কল্পনা, ভালো-মন্দ, হাসি-কান্না জড়িয়ে আছে। আলাদা করে বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে বাবা বা মা’কে নিয়ে সমস্ত কর্মকাণ্ড, হাসি উল্লাসের কথা আমাদের ভাবনাতে ছিলনা।

আমেরিকা আসার পূর্বে বাবা দিবস, মা দিবস সম্পর্কে স্বচ্ছ কোন ধারণা ছিলনা। যদিও অস্ট্রেলিয়াতে থাকার সময় মা দিবস উদযাপনের কথা প্রথম জেনেছি, বলাই বাহুল্য, উপলক্ষটি আমার কাছে মোটেও ভালো লাগেনি। প্রথম প্রতিক্রিয়াতে মনে হয়েছিল, বছরের তিনশত পঁইয়ষট্টি দিনই বাবা-মাকে ঘিরে আবর্তিত হয় যেখানে, সেখানে আলাদা করে মা-বাবা দিবস পালনের যৌক্তিকতা কোথায়।

অনেক আগে ঢাকার রাস্তায়, বিভিন্ন হোর্ডিংয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি শ্লোগান শোভা পেতো, ‘ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী’, শ্লোগানটি আমার খুব পছন্দের ছিল। পৃথিবী ছোট হয়ে আসা মানে তো সত্যি সত্যিই আয়তনে ছোট হয়ে আসা নয়, এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যাতায়াত অনেক সহজ হয়ে এসেছে, সেই সহজ কাজটি আরও সহজ করে দিয়েছে বাংলাদেশ বিমানের এয়ারক্র্যাফটগুলো। চোখের নিমিষে আমাদেরকে পৌঁছে দিচ্ছে ঢাকা থেকে ইউরোপ, আমেরিকা। ইউরোপ, আমেরিকাতে পৌঁছানো যত সহজ হয়েছে, আমেরিকা, ইউরোপের সমাজ, সংস্কৃতি, জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ তত বেশী বেড়েছে।

কুড়ি বছর পূর্বে মাদার’স ডে উদযাপন করাকে অনেক কৃত্রিম মনে হতো, জীবন সহজ হওয়ার ফলে এখন মাদার’স ডে, ফাদার’স ডে উদযাপন করাকে কৃত্রিম মনে হয়না, মনে হয় ভীষণ নান্দনিক এক উৎসব। আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা, আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা দাবীগুলো যদি মনে মনে উচ্চারণ করতে পারি, দাবীগুলোকে সকলের সামনে নিয়ে যেতে সমস্যা কোথায়।

আমি জানি, আমার বাবা আমার জন্য জীবনে কতখানি ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সে জানে তার বাবা তার জন্য কতখানি আত্মত্যাগ করেছেন, বাবাদের এইসব আত্মত্যাগের ফলেই আজ আমরা আলোর সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছি। কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়, শুধুমাত্র সন্তানের মঙ্গল কামনায় যে সকল বাবা-মা নিরন্তর ত্যাগ স্বীকার করে চলেছেন, সন্তান কি পারেনা বছরের একটি দিনকে বর্ণাঢ্য সাজে সাজিয়ে বাবা-মায়ের চরণে সঁপে দিতে!

উৎসবে আদিখ্যেতা থাকতে পারে, আহ্লাদীপনা থাকতে পারে, তা তো থাকবেই, বাবা-মায়ের সাথেই তো সন্তানের যত আহ্লাদীপনা, যত আদিখ্যেতা! বছরের একটা মাত্র দিনে আমাদের তো ইচ্ছে হতেই পারে, বাবার প্রিয় একটি খাবার রান্না করতে, মায়ের পছন্দের একটি ভর্তা বানিয়ে মা’কে খাওয়াতে, এমন হাজার হাজার দিন বাবা-মা পার করেছেন আমাদের জন্য, বাবা-মায়ের ঋণ তো শোধ করার প্রশ্ন উঠেনা, কিন্তু বাবা-মায়ের প্রতি আমাদের নিরন্তর ভালোবাসার একটি টুকরো খসিয়ে তাঁদের হাতে তুলে দেয়া যায়, সন্তানের ভালোবাসা হাতে নিয়ে জীবন ক্লান্ত বাবা-মা একটুক্ষণের জন্য স্বর্গসুখ পেলে, সমাজের ক্ষতি তো হচ্ছেনা।

পৃথিবী কত ছোট হয়ে এসেছে, আমরা সকলেই কত কাছাকাছি চলে এসেছি। সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে প্রায়ই দেখা যায়, বাবাগুলো কি পরম মমতায় সন্তানের কৃতিত্বের সংবাদ সকলের সাথে শেয়ার করছে, দাঁত ফোকলা পুত্রের হাসি দেয়া অনিন্দ্য সুন্দর ছবি আমাদের সাথে শেয়ার করছে, কেউবা তার কন্যার ছবি পোস্ট করে ক্যাপশানে লিখছে, “আমার মা”! আহা, কন্যার মাঝে মা’কে খুঁজে ফিরে। কেউ বা তার বৃদ্ধ পিতা-মাতার সাথে তোলা ছবি পরম আনন্দে সকলের সাথে শেয়ার করছে, কেউ বা অতি দুঃখের সাগরে ভেসে গিয়ে বাবার মৃত্যু সংবাদ শেয়ার করছে, মায়ের স্মৃতি রোমন্থন করছে, এভাবেই আমরা সকলে বাবা-মা-সন্তানের মমতার শেকলে বাঁধা পড়ে যাচ্ছি।

আমার এক বন্ধু কিছু দিন পর পর আদরের কন্যার সাথে নানা ভঙ্গিমায় তোলা ছবিগুলো যখন ফেসবুকে পোস্ট করে, আমার চোখে জল আসে। আমার বাবা বৃদ্ধ হয়েছেন, যদি আমার বাবার বয়স পনেরো বছর কম হতো তাহলে উনিও নিশ্চয়ই আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করে ফেসবুক করতেন, পুত্র-কন্যার সাথে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করতেন। হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সাহেবকে নিয়ে কতজনে কত রকম মন্তব্য করে, কিন্তু একজন মমতাময় ‘বাবা’ এরশাদকে যখন টিভিতে দেখেছিলাম পুত্র এরিকের সাথে, অন্যরকম এক ভালোলাগায় চোখে জল এসেছিল।

আজ বাবা দিবস, বিশ্ব বাবা দিবস, ফাদার’স ডে’ উপলক্ষে পশ্চিমা দেশগুলোতে একমাস আগে থাকতেই সাজ সাজ রব উঠে। কত রকমের উপহার সামগ্রী দিয়ে বিপণী বিতানগুলো সাজানো থাকে। টি শার্টের গায়ে ‘লাভ ইউ ড্যাড’, ‘মাই ড্যাড ইজ মাই হিরো’ কথামালা লেখা থাকে।

বিলিয়ন ডলারের উপহার সামগ্রী ক্রয় বিক্রয় হয়। উপহার দেয়া ছাড়াও এই দিনটিতে ‘বাবা’কে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, মুভী দেখা, ফিশিং করতে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়াসহ আরও কত কিছুর আয়োজন থাকে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নিজ বাবা ছাড়াও স্টেপ ড্যাড, ফস্টার ড্যাড, গডফাদার সকলকেই সম্মান জানানো হয়। মাদার’স ডে বা ফাদার’স ডে উপলক্ষে আমেরিকানদের উচ্ছাস, আনন্দ, আবেগের মধ্যে কোন অভিনয় থাকেনা। ওদের উৎসব আয়োজনে থাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া। দেখে মন ভরে যায়। প্রবাসীদের মনকেও তা ছুঁইয়ে যায়।

আমরা যারা প্রবাসে থাকি, তারাও আবেগাক্রান্ত হই, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে দেশে ফোন করি, পরম মমতাভরা কন্ঠে বাবাকে বলি, ” হ্যাপী ফাদার’স ডে বাবা’। ফোনের অপরপ্রান্তে ‘ফাদার’স ডে’ কালচারে অনভ্যস্ত বাবাটিও আহ্লাদে গদগদ হয়ে উঠেন। কোন উপহারের প্রয়োজন পড়েনা, সন্তানের গলার আওয়াজটি পেয়েই বাবা খুশী হয়ে উঠেন, চাপা গর্বে পাড়ার দোকানে হঠাৎ দেখা প্রতিবেশীকে ডেকে হয়ত বলেন, ” আজকে মেয়ে ফোন করেছিল, ফাদার’স ডে জানালো”। এইই হচ্ছে বাবা। বাবা তো এমনই হয়!

কিশোরীবেলায় শোনা হেমন্ত মুখার্জী ও শ্রাবন্তী মজুমদারের দ্বৈতকন্ঠে গাওয়া গান, ” মনে হয় বাবা যেনো বলছে আমায়, আয় খুকু আয়” এখনও আমাকে কাঁদায়। আমার সত্যি সত্যি মনে হয় আমার বাবা পেছন থেকে ডেকেই চলেছেন, আমার যে কোন প্রয়োজনে বাবা যেনো আমাকে এখনও সাহস দিচ্ছেন, ভরসা দিচ্ছেন। মা’কে নিয়ে কত কাব্য রচিত হয়েছে, কত গীত রচিত হয়েছে বহুকাল আগে থেকে। কিন্তু বাবাকে নিয়ে তেমন করে কাব্যগাঁথা রচিত হয়নি। তাই বলে ‘বাবা’রা কি থেমে আছেন!

গতকাল আমাদের কাউন্টারে এক সুদর্শন ভদ্রলোক এসেছেন একখানা ফোন কিনতে, হাতে ধরে আছেন এক কিশোরীর হাত। কিশোরীও অনিন্দ্য সুন্দর, কী নির্মল, পবিত্র মুখখানি। সে কী টানা টানা চোখ, ঠোঁটে লেগে থাকা মুচকী হাসি দেখে মুগ্ধ আমি স্বগতোক্তি করে ফেললাম, “ বাহ! কী সুন্দর মেয়ে”।
কিশোরীর হাত ধরে থাকা ভদ্রলোক খুব গর্বের কন্ঠে বললেন, “ আমি জানি, আমার মামণি বিশ্বসেরা সুন্দরী”।

কিশোরী আরো বেশী করে জড়িয়ে ধরলো তার বাবা’র হাত। অপূর্ব ছবি, আমার মানসপটে মুদ্রিত হয়ে গেলো। বাবা নামের জীবন নৌকার মাঝিটি কিনতু ঠিক কালকের বাবাটির মত করেই শক্ত হাতে সন্তানের জীবন নৌকার হালটি ধরেই আছেন।

সন্তানের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান, আদর পেয়ে যে বাবাগুলো আজ পৃথিবীর বুকে ‘বাবাময়’ মানচিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছেন, সেই সকল বাবাকে জানাই, অভিনন্দন, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান। সবশেষে ‘বাবাময় দিবস সুখের হোক”! এবং আজকের দিনটি হোক শুধুই ‘বাবাময়’!