ওয়াচডগ এর সকল পোস্ট

বিকেলে ভোরের গল্প… পর্ব ১

2698

ওটাই ছিল আমার শেষ বিলাত যাত্রা। অনেক স্মৃতি, অনেক কাহিনী, অনেক গল্পের শেষ হবে এ গ্রীষ্মের পর। ১৯৭৬ সালে শুরু হওয়া জার্নির ইতি টানবো এ যাত্রায়। মাঝখানে বাল্টিক সাগরের পানি অনেকদূর গড়িয়ে যাবে। দুই পৃথিবীর দুই জীবন খুব কাছ হতে দেখার সুযোগ হবে। দেখা হবে অনেক দেশ। পরিচয় হবে হরেক রকম মানুষের সাথে। কৈশোর অধ্যায়ের ইতি টেনে পা রাখবো যৌবনে। প্রেম, ভালবাসা, বিরহ, সেক্স অনেক কিছুর সাথে দেখা হবে প্রথমবারের মত। সে জীবন হবে স্বপ্নিল প্রতিশ্রুতিতে ভরা বিশাল ক্যানভাসের এক কাহিনী।

প্রতিবছর জুনের শেষদিকে শুরু হয় আমাদের গ্রীষ্মের ছুটি। ক্যাম্পাস জীবন দু’মাসের জন্যে থমকে যায়। রুশ ছাত্ররা চলে যায় নিজ নিজ শহরে। অনেকের ঠিকানা হয় লেবার ক্যাম্পে। সাইবেরিয়ার গহীন অরণ্যে তৈরি হচ্ছে রেললাইন। শ্রমিক সমস্যা মাথায় রেখে দেশটার কম্যুনিস্ট সরকার উৎসাহ দেয় ছাত্রদের। সারা বছর আর্থিক সমস্যায় ভোগা রুশ ছাত্ররা নাম লেখায় নির্মাণ ব্রিগেডে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে ওরা যখন ফিরে আসে পকেটে থাকে খরচ করার মত বেশকিছু রুবেল। আমি নিজেও একবার নাম লিখিয়েছিলাম এমন এক ব্রিগেডে। দু’মাসের কায়িক পরিশ্রমের সে কঠিনতম অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে শেয়ার করেছি পাঠকদের সাথে। ঐ বছরের গ্রীষ্মের ছুটিটা বাদ দিলে বাকি সবকটা ছুটি কাটাতে ছুটে গেছি আরও পশ্চিমে।

১৯৭৭ সালের জুলাই মাসের কোন এক পূর্ণিমা রাতে নেদারল্যান্ডের হোক ভ্যান হল্যান্ড হতে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে চেপে বসি নৈশ ফেরীতে। লম্বা জার্নির এ ছিল শেষ ঠিকানা। শুরুটা ছিল মস্কো হতে ট্রেনে চেপে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ। ওরারশ হতে পাশের দেশ পূর্ব জার্মানির রাজধানী পূর্ব বার্লিন। প্রথমবারের মত বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করে পশ্চিম বার্লিন। এবং ওখানে ট্রেন বদল করে পশ্চিম জার্মানির হ্যানোভার। হ্যানোভারে আরও একবার ট্রেন বদল। এবং সবশেষে নেদারল্যান্ডের রটোড্রাম হয়ে বন্দর শহর হোক ভ্যান হল্যান্ড।

ওভার-নাইট ফেরী জার্নিতেই প্রথম পরিচয় হয় পশ্চিম ইউরোপের খোলামেলা জীবনের সাথে। বিস্মিত না হলেও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক লৌহ বলয়ের সাথে পার্থক্যটা ধরতে খুব একটা সময় লাগেনি। যতটা ভালবাসা নিয়ে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় পা রেখেছিলাম ততটা দ্রুতই এ ভালবাসা উবে গিয়েছিল। সমাজতন্ত্রের নামে ১০০ জাতি ও ভাষার একটা দেশকে কি করে কম্যুনিস্ট রেজিম নিজেদের গিনিপিগ বানিয়ে রেখেছিল তা ধরতে অনেকের অনেক সময় লাগলেও আমার খুব একটা লাগেনি। কারণ আমি খুব দ্রুত সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কথা বলেছিলাম মানুষের সাথে। ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির একজন আর্মেনিয়ান কেন রুশদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিজেদের করে নেবে এ প্রশ্নের উত্তর খোদ আর্মেনিয়ানদের কাছেও ছিলনা। ওদের সাথে কথা বললে বেরিয়ে আসে ভেতরের চাপা ক্ষোভ ও বলশেভিকদের প্রতি জমে থাকা ঘৃণা।

এসব নিয়ে লিখতে গেলে লেখা যাবে বিশাল ক্যানভাসের এক কাহিনী। যার শুরু থাকলেও হয়ত আমার মত কাঁচা হাতের লেখক টেনেটুনে শেষ করতে পারবেনা। তাই উঠিয়ে রাখছি এ গল্প। আপাতত চলুন তল্পি-তল্পা গুটিয়ে রওয়ানা দেই লন্ডনের দিকে। ওখানে জমা আছে অনেক গল্প। এ যাত্রায় আমাকে আর ব্রিটিশ ভিসার জন্যে মস্কো যেতে হবেনা। ইতিমধ্যে এর বিকল্প আবিষ্কার করে নিয়েছি। রওয়ানা দেবো সেন্ট পিটার্সবার্গ হতে। প্রথম স্টপেজ লিথুনিয়ার রাজধানী ভিলনিউস।

চলবে।

একজন অদিতির গল্প!

25167

অদিতির সাথে পরিচয় না হলে ঈশ্বর সৃষ্ট মানুষের যে সংজ্ঞা তার অনেক কিছুই হয়ত অজানা থেকে যেতো। বাইরে দেখা মানুষটার ভেতর যে একই রকম হয়না অদিতি তার ঐশ্বরিক প্রমাণ।

অদিতি ভট্টাচার্য্য। বয়সে আমার চাইতে দুই বছরের বড়। লম্বা চুল আর শাড়িতে খুব সুন্দর লাগে তাকে। আকারে ছোট হওয়ায় প্রথম দেখায় ইননোসেন্ট ইননোসেন্ট মনে হয়। আমার কাছেও তাই মনে হয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গের এই বাঙ্গালী মহিলার সাথে পরিচয় নিউ ইয়র্কে। সদ্য প্যানসেলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়া হতে নিউ ইয়র্কে মুভ করেছি। ট্রান্সফার নিয়ে সেলসম্যানের চাকরিটা ফিরে পেয়েছি এই মেগা শহরে।

ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যা। কনকনে শীত। বিরামহীন তুষারপাতে তলিয়ে গেছে শহরের সবকিছু। চাকরির প্রথম দিন। সেজেগুজে হাজির হয়েছি কর্মক্ষেত্রে। কমিশন ভিত্তিক কাজ। বিক্রি করতে পারলেই কেবল পয়সা। স্টোর ম্যানেজার পরিচয় করিয়ে দিল ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজারের সাথে। লাতিনো এই মহিলা খুব আন্তরিকতার সাথে আমাকে স্বাগত জানালেন ফ্লোরে। বাঁকা হাসি দিয়ে জানালো এই বিভাগে ১২ জন মহিলার বিপরীতে কেবল ১জন পুরুষ সেলসম্যান কাজ করছে।

শীতের রাত, কাস্টমার বলতে কেউ নেই। এমন আবহাওয়ায় আশাও করছেনা কেউ। আমি হাত গুটিয়ে কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরের তুষারপাতে মুগ্ধ হচ্ছি। কর্কশ গলায় চীৎকার করে উঠল কেউ একজন। কাউন্টারের ভেতর হতে বেরিয়ে যাওয়ার কড়া নির্দেশ দিল। আমি অবাক হলাম কারণ ফ্লোর ম্যানেজার আমাকে এখানে রেখে গেছে। ম্যানেজারের উপর আরও কেউ থাকতে পারে তার আন্দাজ ছিলনা। মহিলা আর কেউ নন, অদিতি মুখোপাধ্যায়। খাঁটি ভারতীয় উচ্চারণের ইংরেজীতে বুঝিয়ে দিল কাউন্টারের কাছাকাছি আসার আমার কোন অধিকার নেই।

ম্যানেজার দৌড়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিল বাকি সবার সাথে। আমি এখানকার নতুন আগমন শুনে করোলা তিতার মত মুখ তিতা করে ফেলল অদিতি। মিন মিন করে জানালো চাকরি করি আর না করি, কাউন্টারের পেছনে এভাবে দাঁড়ানো নিয়ম বর্হিভূত। এবং এভাবেই শুরু। প্রতিদিন কিছু একটা নিয়ে খুনসুটি করে। দফায় দফায় উপদেশ দেয়… এভাবে না, ওভাবে। এখানে না, ওখানে।
আমি শুধু শুনি আর চিন্তা করি, হু দ্যা ফাঁ* সী ইজ!

আমি ইচ্ছা করেই কমিশনে ঢুকতে ৭দিন সময় নেই। কটা দিন দরকার প্রোডাক্ট গুলো ভাল করে চেনার। স্টক রুমের কোথায় কোন প্রোডাক্ট সেটা জানাও ছিল জরুরি।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, বীচ, আই উইল পে ইউ ব্যাক!
উপদেশ সেশনের এক পর্যায়ে এই মহিলা জানতে চাইলেন আমি চলার মত ইংরেজি জানি কিনা। ইতিপূর্বে ২/১ জন বাংলাদেশি এখানে চেষ্টা করেও নাকি টিকতে পারেনি দুর্বল ইংরেজির কারণে।
উত্তরে হাসি দিয়ে জানালাম, সময়ই বলে দেবে আমার ইংরেজির দৌড়।

রুশ আমার দ্বিতীয় ভাষা। ইংরেজি তৃতীয়। রেগো পার্কের এই এলাকাটা রুশদের ঘাঁটি। তবে সপ্তাহ খানেক কাজ করার পর বুঝতে পারলাম আমার গ্রাহকদের শতকরা ৫০ ভাগই হিসপানিক। স্প্যানিশ ভাষা এখানে মূল ভাষা। বাকি সব হাতে রেখে বিক্রয় কাজে স্প্যানিশ ভাষার যে সমস্ত বাক্য দরকার তার উপর ক্রাশ তালিম নেয়া শুরু করলাম। খুব জটিল কোন মিশন ছিলনা।

মাস খানেক পর নিজকে তৈরী মনে হলো। এবং আমি বিপুল বিক্রমে নেমে পরলাম কাস্টমার শিকারে। ইতিমধ্যে ধারণা পেয়ে গেছি অদিতি ডিপার্টমেন্টের ২য় সেরা সেলসপার্সন। তার উপর ডমিনিকান রিপাব্লিকান এক মহিলা। ওরা দুই বান্ধবী গেল প্রায় ১২ বছর ধরে এখানে রাজত্ব করছে।

প্রথম যেদিন রুশ ভাষা ব্যবহার করে কাস্টমারের কাছে পণ্য ধরিয়ে দিলাম অদিতির চোখে মুখে প্রচন্ড অবিশ্বাস। চোস্ত উচ্চারণের ইংরেজির ভাণ্ডারটা একটু সময় নিয়ে খুলতে হলো।

ততদিনে অদিতি বুঝে গেছে সাধারণ কোন কো-ওয়ারকার নিয়ে খেলছেনা সে। মাস না ঘুরতে সবাইকে টপকে উঠে গেলাম ১ নাম্বারে। ১২ বছরে এই প্রথম সত্যিকার চ্যালেঞ্জের মুখে পরতে হলো মহিলাকে। আমিও নাছোড়বান্দা। কোন কাস্টোমার ছাড় দিতে রাজি নই।

দুই মাসের মাথায় ফ্লোরের বাকি সবাইকে নিয়ে গোপন মিটিংয়ের আয়োজন করল অদিতি। আমার কারণে নাকি বাকি কেউ কোন আয়-রোজগার করতে পারছেনা।
প্রথম সাড়ির কয়েকজনকে নিয়ে গেল স্টোর ম্যানেজারের কাছে। অভিযোগ দিল আমার বিরুদ্ধে। বিগ বস ডেকে পাঠালেন আমাকে।

আমার বিক্রয় জাস্টিফাই করতে কোন অসুবিধা হলনা। ম্যানেজারকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ফ্লোরের এক্টিভিটি নজর রাখার জন্যে অনুরোধ করলাম।
মহিলা সেলসপার্সনদের প্রায় সবার হয় স্বামী অথবা স্বামীর পাশাপাশি নাগর এসে ভিড় জমায় কাজে। ওখানে সময় ব্যায় করতে হয় ওদের। ফলে সাফার করে কাষ্টমারের দল। আমি ছিলাম এসবের বাইরে।
ধোপে টেকেনি অদিতির অভিযোগ। এসব অভিযোগ আমাকে আরও আগ্রাসী হতে সাহায্য করল।

ইতিমধ্যে বিক্রিতে দুর্বল ২/১জন কো-ওয়ারকার ভিড়িয়ে নিলাম আমার দলে। তাদেরই একজন ছিল ত্রিনিদাদ টোবাগোর শ্যারণ।
কথা প্রসঙ্গে শ্যারণ জানালো প্রতিদিন স্টোরের মুল ফটকে দাঁড়িয়ে অদিতি নাকি তার ভগবানের দরবারে প্রার্থনা করে আমার অসূস্থতার জন্যে।
কিন্তু আমি অসূস্থ হইনা। বরং এই মহিলার এতদিনের হানিমুন কি করে আঁতুর ঘরে নেয়া যায় তা নিশ্চিত করতে থাকি।

থ্যাংক্স গিভিং দিবসে আমরা সবাই একে অপরের সাথে উপহার বিনিময় করি। আমিও করি। সে যাত্রায় অদিতিকে বাংলাদেশি গানের একটা সিডি উপহার দিলাম। পরের দিন সিডিটা ফেরত দিয়ে জানালো এসব গার্বেজ গান নাকি সে শোনানা। রবীন্দ্র সঙ্গিত আর প্রথম ও একমাত্র গান।

অপমানটা হজম করতে একটু কষ্টই হলো। তবে তা ফিরিয়ে দিতে আমাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
অদিতির স্বামী ও তার ১৫ বছরের ছেলে কোলকাতা যাচ্ছে। সবাইকে ঘটাকরে জানালো অদিতি। এসব আমি এক কান দিয়ে শুনি আর অন্য কান দিয়ে বের করে দেই।

স্বামী সন্তান চলে চলে যাওয়ার পরদিনই আমাকে একটা প্রস্তাব দিল। জ্যাক্সন হাইটসের সিনেমা হলে ভাল একটা হিন্দি ছবি এসেছ। আমাকে নিয়ে ছবিটা দেখার প্রস্তাব দিল। মুভির পর তার নাকি পরিচিত ভাল একটা রেস্তোরা আছে, ওখানে ডিনারেরও আমন্ত্রণ।

কো-ওয়ারকারদের বাকি কেউ এমন প্রস্তাব দিলে আমি নিশ্চয় লুফে নিতাম এবং বিছানায় রাত কাটানোর সুযোগও হয়ত হাতছাড়া করতাম না
(ছিলাম ব্যাচেলর)।
কিন্তু এ ছিল অদিতি। ভয়াবহ চরিত্রের ভারতীয় এক মহিলা।
সুযোগটা নিলাম তবে তা ছিলা প্রতিশোধের।

বিনয়ের সাথে জানিয়ে দিলাম হিন্দি আমি কম বুঝি। আর বুঝলেও ওসব বস্তাপঁচা, অবাস্তব, অলীক কাহিনীর ছবি আমি দেখিনা। আমার জন্যে এসব সময়ের অপচয়।
অপমানে লাল হয়ে গেল তার গোলগাল মুখ।

মোট ৬ বছর চলেছিল আমার চাকরি। আমার অত্যাচারে ইতিমধ্যে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অদিতি প্রায়ই অবসরে যাওয়ার কথা বলে। আমি শুনি আর হাসি। হাসি আর মনে মনে কল্পনা করি চাকরির প্রথম রাত!

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চাকরি নিয়ে সান আন্তোনিও চলে যাওয়ার কথা আগেরদিন পর্যন্ত কাউকে জানাইনি কেবল ম্যানেজার ছাড়া।
অদিতিই প্রথম বলল তার চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। সবকিছু ফাইনাল।
শোনার পর আমি বললাম আমার প্রস্থানের সময় ও তারিখ।
অদিতি থ হয়ে গেল।

দু’বছর পর নিউ ইয়র্ক বেড়াতে গিয়ে শুনেছিলাম অদিতির বিদায় পর্ব। চাকরি আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। নতুন করে ফিরে আসার দরখাস্ত গ্রহন করেনি ষ্টোর কর্তৃপক্ষ। কারণ ওরা আর ফুলটাইম এম্পপ্লোয়ি হায়ার করেনা।
আমার চৌদ্দগুষ্টি আর দেশ উদ্ধার করে লম্বা এক ভাষনের মধ্য দিয়ে শেষ করেছিল তার ক্যারিয়ার।

স্মৃতির পাতা হতে!

hqdefault

সাল ফাল মনে নেই। হবে হয়ত ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শ্রেনীতে পড়ি। স্কুলে এই প্রথম বার্ষিক পুরস্কার বিরতনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বলতে গেলে ইউনুস স্যারের একক চেষ্টার ফসল। যাদের সামর্থ আছে তাদের ৫/১০ টাকা করে চাঁদা ধরা হয়েছে। তখনকার দিনে এমন অংক একজন ছাত্রের পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিলনা। বাড়িতে অনেক বুঝিয়ে আমিও আমার অংশ স্যারের হাতে তুলে দিতে সমর্থ হয়েছিলাম।

অনুষ্ঠানের দিন সকাল হতে চারদিকে সাজ সাজ রব। স্কুলে নতুন কিছু ঘটতে যাচ্ছে এমন চিন্তায় আমার মত অনেকেরই আগের রাতে ভাল ঘুম হয়নি। তাছাড়া আমিও একটা পুরস্কার পেতে যাচ্ছি চিন্তাটা মাথা হতে ফেলতে পারছিলাম না।

ঢাকা হতে শিল্পীরা আসার কথা। সবাই আমরা অপেক্ষা করছি। কিন্তু কারও দেখা নেই। বশির আহমেদের মত তারকা শিল্পীর দেখা পাওয়া তখনকার দিনে সহজ ছিলনা। তিনিও ছিলেন শিল্পীদের তালিকায়।

বিকেল তখন ৪টা। ইউনুস স্যার আমাকে সামনে পেয়ে আটকালেন। নির্দেশ দিলেন হেডস্যারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। উনারা সবাই কোথাও যাচ্ছেন কিছুক্ষণের জন্যে। মূল উদ্দেশ্য ঢাকা হতে ইতিমধ্যে কেউ এসে পরলে আমি যেন স্বাগত জানিয়ে স্যারদের ওয়েটিং রুমে বসতে দেই।

তীর্থের কাকের মত আমি দাঁড়িয়ে আছি। কারও দেখা নেই। হতাশ হয়ে ইতিউতি করছি। অপরিচিত একজনকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ছোট খাট কালো মত একজন মানুষ। হাতে একটা ডায়রি। গলায় সাদা একটা চাদর। বুঝতে অসুবিধা হলোনা নিশ্চয় আমন্ত্রিত গায়কদের কেউ।
লম্বা একটা সালাম দিলাম।

কারও পরিচয় জানার কিছু পুথিগত ভাষা আছে, ঐ মুহূর্তে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেল।
যেকোন ভাবেই হোক জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে?
মৃদু একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমি আবদুল আলিম’
পল্লিগীতির সম্রাট আবদুল আলিম আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

আর কারও না হোক, আমাদের বাড়িতে আব্বা ছিলেন এই গায়কের একান্ত ভক্ত। ভাল সময় মন্দ সময়ে তিনি গুন গুন করে গাইতেন এই শিল্পীর মরমী অনেক গান। আব্বাস উদ্দিনও তালিকার বাইরে ছিলেন না।

সময়ের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে যাপিত জীবনের অনেক কিছুই ফিঁকে হয়ে যায়। তবে কিছু স্মৃতি আছে আজীবনের জন্যে মনে গেঁথে যায়। শিল্পী আবদুল আলিমের সাথে দেখা হওয়াটা ছিল তেমনি এক স্মৃতি।

একেক দেশ, একেক জীবন…

কিছু কিছু স্মৃতি সহজে মলিন হয়না। কিছু ঘটনা অবাক করা হলেও স্থায়ী হয়ে যায় মনের গহীনে। তেমনি এক ঘটনা। করোনা তখনও দূরের দেশ চীনের গল্প। আর দশটা উইকএন্ডের মতে সেদিনও পরিবারের সবাইকে নিয়ে দোকানে গেছি। কেনাকাটি সেরে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি কেবল। গিন্নীর হা হা করে উঠল; প্রয়োজনীয় কিছু একটা কেনা হয়নি। বিরক্ত হয়ে দোকানে ফিরে যাওয়ার অনীহা প্রকাশ করলাম। ওরা গেল, আমি গাড়িতে বসে পার্কি লটে ওদের অপেক্ষায় রইলাম…

মধ্যবয়সী চমৎকার শরীরের এক ভদ্রমহিলা এদিক ওদিক তাকিয়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। কথা বলতে ইতস্তত করছেন…
– তোমাকে একা কথা না বললেই নয়। অভয় দিলে বলতে পারি।
– শোনায় আমার কোন আপত্তি নেই তা যদি হয় সংক্ষিপ্ত।
আবারও এদিক ওদিক তাকালো। লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে শুরু করল কথা।
– আমাকে কি কয়েকটা ডলার দিতে পারবে? খুব দরকার ছিল। প্রয়োজনটা বলতে অস্বস্থি লাগছে। দিলে দাও, না দিলে এখুনি চলে যাবো।

একটু অবাক হলাম তার তাড়া দেখে। এদেশে অনেকে অনেক কায়দায় ভিক্ষা চায়। প্রয়োজনটা ঘুরে ফিরে এক জায়গায় এসে থেমে যায়…রাস্তায় আটকে গেছি। গাড়িতে তেল নেই। সাহায্য করলে তেল কিনে ঘরে ফিরতে পারবো। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব কাহিনী মিথ্যা। মূল প্রয়োজন, ড্রাগ কেনার অর্থ যোগান। পার্কিং লটে ভিক্ষুকদের ভিক্ষার সাথে আমি অপরিচিত নই। এর আগেও মুখোমুখি হয়েছি এবং সব ক্ষেত্রে নিজের অপরাগতার কথা জানিয়ে ক্ষমা চেয়েছি। এ যাত্রায় মহিলার চেহারা ও গলার স্বরে এমন কিছু একটা ছিল যা সহজে এড়ানোর মত ছিলনা।
– তোমার প্রয়োজনটা শোনার মত আমার হাতে কয়েক মিনিট সময় আছে। বলে ফেল।
– আমার ব্রেষ্ট ইমপ্লান্ট করাতে হবে। অনেক অর্থের প্রয়োজন। ঘরে যা আছে তা যথেষ্ট নয়।
– তোমার ব্রেষ্ট ইমপ্লান্টের জন্যে আমি ডলার দেব, এমনটা কেমন করে ভাবলে? এতো জরুরি কিছু নয়। বরং কসমেটিক কিছু।
– না, আমার জন্যে খুব জরুরি। আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে অন্য এক মহিলার পিছু নিয়েছে। মুখোমুখি হতে জানাল, আমার ব্রেষ্ট নাকি তাকে ধরা রাখার জন্যে যথেষ্ট নয়।
এবার আমার আকাশ হতে পরার পালা। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রইলাম। এও-কি সম্ভব!
– দেখ, ঘরে আমার দুটো সন্তান। ছোটটার বয়স ১ বছর। বড়টা ৪। হাতে কোন কাজ নেই। পুরোটাই নির্ভর করি স্বামীর উপর। আমাকে ছেড়ে গেলে শুধু আমি নই, দুটো অবুঝ শিশুও না খেয়ে থাকবে।
বাকি কিছু শুনতে ইচ্ছে করছিলো না। হাতে ৫ ডলারের একটা নোট ধরিয়ে দ্রুত এখান হতে চলে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। গিন্নী ফিরে মহিলাকে দেখলে হাজার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

এর আগেও ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে হরেক রকম ব্যানার নিয়ে অনেককে ভিক্ষা করতে দেখেছি। এক মহিলার হাতে ছিল…”আমি এতটাই কুৎসিত, পতিতা হয়েও কোন গ্রাহক যোগাড় করতে পারিনা… সাহায্য কর”
অন্য একজন, “চার ক্যানের এক প্যাকেট বীয়ার না নিয়ে বাড়ি ফিরলে বউ আজ ঘরে ঢুকতে দেবেনা…কিছু সাহায্য কর”। এমন আরও অনেক কিছু।

আজ প্রায় এক বছর পর অংগরাজ্যের রাজধানী সান্তা ফে গেলাম। শহরটার প্রতি আমার অন্য রকম একটা টান আছে। চাকরি জীবনের প্রথম বছরটা ওখানেই কাটিয়েছি। প্রতিদিন ফ্রীওয়ে ধরে ১১০ কিলোমিটার ড্রাইভ করে সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে এসেছি। ভিন্ন ধরণের একটা শহর। রাজধানী, অথচ উঁচু কোন দালান নেই। করার অনুমতি নেই। শহর দেখলে মনে হবে সেন্ট্রাল আমেরিকার কোন শহরে আছি। দেখতে অনেকটা গুয়েতেমালার রাজধানী তেগুছিগাল্পা অথবা কোষ্টারিকার রাজধানী সান হোসের মত দেখায়। হলিউডের ছবিতে সেন্ট্রাল আমেরিকার কোন দৃশ্য চিত্রায়িত করতে এ শহরকেই বেছে নেয়া হয়। খুবই এক্সেপেন্সিভ শহর। সাথে প্রকৃতির লীলাভূমি। হলিউডের এমন কোন সেলিব্রেটি নেই যার এখানে একটা বাড়ি আছে। চেনা শহরকে বিষণ্ণতায় ডুবতে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

শহরের মূল চত্ত্বরটা আজ ছিল ফাঁকা। অথচ স্বাভাবিক সময়ে এদিনে পর্যটকদের ভীড় নামে। নেটিভ আমেরিকানদের চত্ত্বরে বয়স্ক একজন গীটার বাজিয়ে কান্ট্রি গান গাইছিলো। সামনে এক টুকরা কাপড় বিছানো। সেও সাহায্য চাইছে। তবে বিনিময়ে কিছু একটা দিচ্ছে। অনেকক্ষণ তন্ময় শুনলাম তার গান। চারদিকের খোলা প্রকৃতিতে এমন দরদ দেয়া গান যে কারও মন কাড়তে বাধ্য।

আসলে একেক দেশের জীবন একেক রকম হলেও কোথায় যেন একটা সমান্তরাল আছে। আমেরিকার ভিক্ষুক ও ভিক্ষাবৃত্তি দেখলে এ সমীকরণ সহজ হয়ে যায়।

পরকীয়া, আসলেই কি সামাজিক ব্যাধি, না সম্পর্কের বিবর্তন!

21

চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া এক খুনের ঘটনা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মানুষের মৃত্যু এতটা কষ্টের হয় ভাবতেও কষ্ট লাগছিল। যদিও মন খারাপ করার মত ব্যক্তিগত কোন কারণ ছিলনা ঘটনায়। এমন ঘটনা এখন বাংলাদেশে হরহামেশা ঘটছে। মিডিয়ায় আসছে কিছু কিছু, অধিকাংশই হয়ত সামাজিক কারণে ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে।

মাধব দেবনাথ পেশায় স্বর্ণকার। চট্টগ্রামে এক দোকানে কাজ করতো। পিন্টু দেবনাথ তার আত্মীয়। বিথী দেবনাথ পিন্টূর স্ত্রী। পাশাপাশি থাকার কারণে মাধব মাসে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে পিন্টূর বাসায় তিন বেলা খায়। সব চলছিল বাংলাদেশের যে কোন নিম্ন মধ্যবিত্তের পরিবারের জীবনের ছকে। গোল বাধে কিছুদিনের জন্যে মাধবের অসূখ। পিন্টূর স্ত্রী তার দেখভাল করার দায়িত্ব নেয়। এখানেই জন্ম মূল ঘটনার। বিথী ও মাধব জড়িয়ে যায় পরকীয়া সম্পর্কে। এ সম্পর্ক দ্রুত মোড় নেয় শারীরিক সম্পর্কে। বাংলাদেশের আধুনা প্রেম অথবা পরকীয়া সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় মাধব তার মোবাইল ফোনে ধারণ করে শারীরিক সম্পর্কের জীবন্ত ছবি। আর দশটা সম্পর্কের মতই এ সম্পর্কও একসময় তেতো হয়ে আসে, বিশেষকরে গৃহবধূ বিথীর জন্যে। স্বামী সংসারের কথা ভেবে অস্বীকার করে শারীরিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে। রেগে যায় মাধব। এবং প্রতিশোধের অংশ হিসাবে ধারণকৃত ভিডিও পাঠিয়ে দেয় বিথীর স্বামী ও শ্বাশুড়ির কাছে। বিথী দেবনাথ সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যার। কিন্তু বিচক্ষণ বিথী সিদ্ধান্ত নেয় তার মৃত্যুর জন্যে যে দায়ী তাকে আগে এ পৃথিবী হতে বিদায় করার। এখানেই জন্ম নেয় ঘটনার দ্বিতীয় অধ্যায়।

ডিসেম্বরের ২ তারিখ রাত দশটার দিকে এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়। বিথীর শ্বশুরবাড়ির বাকি সবাই ঘরের বাইরে চলে যায়। সুযোগ বুঝে ঘরে ঢুকে মাধব। বিথীও সুযোগটা কাজে লাগায়। মাধবকে প্রস্তাব দেয় ভিন্ন আঙ্গিকের শারীরিক মিলন। মাধব লুফে নেয় সে প্রস্তাব। মিলনের অংশ হিসাবে প্রথমে মুখ সহ দু’পা দু’হাত বেধে ফেলে মাধবের। তারপর তার শরীরের উপর চড়ে বসে গামছা দিয়ে ফাঁস লাগায় গলায়। মাধব দেবনাথের জীবন এভাবেই সমাপ্ত হয়।

গতমাসে আরও এক চমকপ্রদ প্রেমের কাহিনী মিডিয়ায় এসেছে। নবম শ্রেনী পাশ এক ছেলে মোবাইলে মেয়ে মানুষ সেজে পরিচয় করতো অন্য মেয়েদের সাথে। তারপর ওসব মেয়েদের রেফারেন্স দিতো যোগ্য এক ছেলের। এবং ঐ ছেলে ছিল সে নিজে। মেয়েরা তাকে ফোন করতো। দেখা করতো এবং সম্পর্ক এক সময় শরীর পর্যন্ত গড়াতো। এবং এখানেও এক পক্ষ মোবাইলে ধারণ করতো শারীরিক সম্পর্কের লাইভ ভিডিও। এক পর্যায়ে ছেলে তার আসল উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে নামতো। মেয়েদের ব্ল্যাক-মেইল করে অর্থ আদায়ের পাশাপাশি চালিয়ে যেত শারীরিক সম্পর্ক। এ তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রী শুরু করে কলেজের শিক্ষিকা পর্যন্ত ছিল। তালিকার একজন বেঁকে বসলে পুলিশের ফাঁদে ধরা পরে প্রতারক।

পরকীয়া! শব্দটা ভার্চুয়াল দুনিয়ার মতই জনপ্রিয় উঠছে দিন দিন। ধীরে ধীরে এ বাস্তবতা বাংলাদেশের বিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবার ছাড়িয়ে বাসা বাধছে দরিদ্র নিম্নবিত্ত পরিবার সহ সমাজের সর্বস্তরে। পরিবার রেখে যারা প্রবাসে বাস করছেন তাদের সংসারে এর আগ্রাসন এখন করোনা ভাইরাসের চাইতেও ভয়াবহ। অথচ সমস্যাটা নিয়ে কথা বলতে আমরা কেউ আগ্রহী নই।

মানব মানবীর সম্পর্ক চিরন্তন। রাষ্ট্রীয় আইন অথবা সামাজিক মূল্যবোধ দিয়ে এসব সম্পর্ক আটকে রাখা যায়না। মানব সভ্যতা যতদিন বেঁচে থাকবে প্রেম ভালবাসার সম্পর্কও ততদিন লতায় পাতায় প্রসারিত হবে। আমাদের ট্রাডিশনাল ধ্যাণ ধারণায় এসব সম্পর্কের শুরু ও শেষের একটা সীমানা আছে। এ সীমানায় যা ঘটবে তা একটা প্রজন্মের কাছে প্রশ্নবোধক হলেও দিনশেষে সবাই তা মেনে নেয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় শুরু হয়ে মনুষ্য জীবনের নতুন এক অধ্যায়।

জগত সংসারের চার দেয়ালে একজন রক্ত-মাংসের মানুষকে আমরা নির্বাসিত করতে অভ্যস্ত হয়ে পরি। নির্বাসনের বৈধ একটা নাম দিয়ে ইতি টানার চেষ্টাকরি একজন পুরুষ অথবা মহিলার আপন স্বত্তার। সমস্যা দেখা দেয় অন্য জায়গায়। মানুষ বেড়ে উঠে। বয়স বাড়ে। কিন্তু ভেতরের স্বত্তাটা একই গতিতে বেড়ে উঠেনা। শরীরের মত মুটিয়ে গিয়ে বুড়ো হয়না। পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা তাকে খাঁচায় আটকে ফেলে। এক সময় মানুষ মুক্তি চায় তার দমবন্ধ হওয়া বন্ধন হতে। এখানেই বপিত হয় সম্পর্কের নতুন বীজ। যার সামাজিক স্বীকৃতি, পরকীয়া হিসাবে। আধুনা এ বাস্তবতা আসলেই কি পরকীয়া, না মানব সম্পর্কের ন্যাচারাল এভ্যালুয়শন!

একটা সমাজে সংস্কৃতির গতি প্রকৃতি নির্ণয় করে তার অর্থনৈতিক সূচকগুলো, কথাটা আমার নয়, সমাজ বিজ্ঞানীদের। আমাদের সমাজেও অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসছে। তার প্রভাব গড়াছে আমাদের সংস্কৃতিতে। পরিবর্তন হচ্ছে মানব মানবীর সম্পর্কের সংজ্ঞায়। একশ বছর আগে বিয়ে, সংসার মানেই ছিল রক্ত মাংসের একজন নারীকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত করে সামাজিক পরাধীনতায় আটকে রাখা। আজকের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তা আর সম্ভব হচ্ছেনা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সংসার সংজ্ঞায় নারীকে আগের মত আটকে রাখা যাচ্ছেনা বেধে দেয়া পরিসরে। একটা সময় পার হতেই হালকা হয়ে যাচ্ছে নর-নারীর মনোজগতের বন্ধন। শারীরিক সম্পর্ক ঠাঁই নিচ্ছে ইতিহাসে। ফাটল দেখা দিচ্ছে পারিবারিক অবকাঠামোতে। এসব কারণই মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে নতুন সম্পর্কের সন্ধানে। এ সন্ধান কেবল পুরুষদের বেলায় সীমাবদ্ধ থাকছেনা, ছড়িয়ে পরছে বিথী দেবনাথদের মত সংসারের চার দেয়ালে আটকে থাকা মেয়েদের মনেও।

সামাজিক ও ধর্মীয় ফতোয়া দিয়ে পরকীয়া সম্পর্ককেও অপরাধের পর্যায়ে নামিয়ে আনা খুব সহজ কাজ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাতে এ সম্পর্কের যেসব সমস্যা তার দিকে মোটেও চোখ ফেরানো হচ্ছেনা। বস্তবতা হচ্ছে, পরকীয়া থাকার জন্যে এসেছে, নিকট ভবিষতে কোন এক মন্ত্রবলে বিথী ও মাধব দেবনাথদের এ বিপজনক বাঁক হতে সরানো যাবে তার কোন সম্ভাবনা নেই। এখনই আমাদের ভেবে দেখতে হবে কেন বিথী দেবনাথদের মত রক্ষণশীল মেয়েরা সম্পর্কের উষালগ্নে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরে। গবেষণা করে দেখতে হবে কোন বাস্তবতায় একজন নারী তার গোপন সম্পর্কের সদ্য চেনা পুরুষকে তাদের শারীরিক মিলনের জীবন্ত ছবি ধারণ করতে দেয়। এসব জানা থাকলে নিশ্চয় বিথী দেবনাথ খুনের মত ভয়ংকর পথে পা বাড়াতেন না।

আমারে বাঁশ দিলে, আমি মূলা দিমু!

আমি প্রতিবেশী দেশ ভারতের ভক্ত। বিদেশীদের সাথে ফাই-ফুই যাই করুক, নিজ দেশের নাগরিকদের বেলায় কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার গুলো যেভাবে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে তা রীতিমত প্রশংসাযোগ্য। এসব কর্মকাণ্ড অবশ্যই দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। এই যেমন পেঁয়াজ রপ্তানির উপর সদ্য আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। এ বছর ভাল হয়নি পেঁয়াজের ফলন, আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করার মত অবস্থায় নেই প্রতিবেশী দেশ। তাই আটকে দিয়েছে রপ্তানি। প্রতিবেশী বাকি দেশগুলোতে পেঁয়াজ রফতানি হয় কিনা তা জানা নেই, আর করলেও তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা হয়নি। তবে বাংলাদেশের ব্যপারটা ১০০ ভাগ নিশ্চিত। আরোপের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এর প্রতিফলন ঘটছে বাংলাদেশের হাট-বাজারে। ভারতীয়দের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত না জানিয়ে উপায় নেই। হাজার হলেও তা দেশপ্রেম!

এবার চাঁদের অন্য-পীঠে গিয়ে যদি নিজ দেশের দিকে তাকাই, বিশ্বাস করেত ইচ্ছে করে ইলিশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েই বাংলাদেশ ভারতে ইলিশ রফতানি করছে। প্রথম চালানে যাচ্ছে ৫০০ টন। পরবর্তী চালান নিশ্চয় পাইপ লাইনে ভরা হচ্ছে। দেশে যাওয়া হয়না অনেকদিন। তাই সাধারণ মানুষের ইলিশ ক্রয় ক্ষমতা এখন কতটা তার কোন ধারণা নেই। আভ্যন্তরীণ ক্রাইসিসের কারণে ভারত যদি পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করতে পারে, নিশ্চয় আমাদের ইলিশ বাজারে ক্রাইসিস নেই বলেই তা রফতানি করতে পারছি। প্রশ্ন হচ্ছে, একজন সাধারণ কৃষক, শ্রমিক ও চাকরিজীবীর খাবার প্লেটে কি ইলিশ গড়াগড়ি যাচ্ছে? অবশ্য দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্য যদি ইতিমধ্যে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মত দেশগুলোকে অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রকে ধরে ফেলার পর্যায়ে চলে গিয়ে থাকে নিশ্চয় এমন প্রশ্ন করা হবে অবান্তর।

আমারা যখন আমাদের ইলিশ ভর্তি ট্রাক প্রতিবেশীর কাছে হস্তান্তর করছি, একই সময় প্রতিবেশী দেশও কিছু একটা হস্তান্তর করছে আমাদের কাছে। এবং তা হল মনুষ্য লাশ। পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ বেধে গেলে শত্রু পক্ষের লক্ষ্য ভেদ করতে চাই নিখুঁত ট্রেনিং। এই ট্রেনিংটাই ভারতীয়রা ঝালিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তে। আর সে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে আমাদের কন্ট্রিবিউশন হিসাবেই হয়ত আমরা বাড়িয়ে দিচ্ছি আমাদের নাগরিকদের। ভারতীয়দের জন্যে হয়ত এটাও দেশপ্রেমের অংশ। আর আমাদের জন্যে নিশ্চয় তা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদান।

একই কায়দায় ওরা ফারাক্কা বাধের শতাধিক গেইট খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে অতিরিক্ত পানি। সময় হলে তলিয়ে যাবে দেশের হাট-মাঠ-ঘাট। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে আমরা অনেক দেশের সাথে বার্টার চুক্তিতে ব্যবসা করেছি। এই যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ব্যাপারটা এরকম; আমরা পাট রপ্তানি করবো, আর বিনিময়ে সমমূল্যের চিনি পাঠাবে সোভিয়েতরা। নগদের কোন বালাই নেই। পণ্যের এমন বিনিময়কেই বলে বার্টার ব্যবসা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ভারতের সাথেও আমরা বার্টার চুক্তি করেছি। এই যেমন, আমরা দেব ইলিশ, আর ওরা দেবে লাশ অথবা পানি। ভাবতে বেশ ভাল লাগছে!

রেস্টুরেন্ট, বুরিতো ও একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতা

রেস্টুরেন্ট, বুরিতো ও একটি অন্যরকম অভিজ্ঞতা:

মেক্সিকো নামের দেশটার সাথে যাদের পরিচয় আছে তাদের জানা থাকার কথা বুরিতো নামের সুস্বাদু খাবারের কথা। অথবা মেক্সিকান চিলি, যার প্রাধান্য কেবল খাবার টেবিলেই নয়, উপন্যাস ও মুভিতেও এর ব্যাপক ব্যবহার। মোদ্দা কথা, মেক্সিকো মানেই ঝাল! মার্কিন অঙ্গরাজ্য নিউ মেক্সিকো এক সময় মেক্সিকোরই অংশ ছিল। এবং এখানে লাখ লাখ বাসিন্দাদের অরিজিন সীমান্তের ওপারের দেশ মেক্সিকো। বুরিতোর প্রস্তুত প্রণালী খুবই সহজ। চাই একটা আটা রুটি। দেখতে অবিকল আমাদের রুটির মত। আলাদা রান্না করা হয় গ্রাউন্ড বীফ, সাথে ডিম, আলু, চীজ, ক্যাপসিগাম এবং অবশ্যই মরিচ বাটা। অর্ডার করতে গেলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে, রেড না গ্রিন! অর্থাৎ লাল না কাঁচামরিচ বাটা! অর্ডার দেয়ার পর বেশকিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। কারণ প্রায় সব রেস্টুরেন্টেই ফ্রেশ তৈরি করে দেয়।

ব্লেইকস লটাবারগার রেস্টুরেন্ট আমার বিচারে স্বাদে গন্ধে সবার চাইতে ভাল বুরিতো বানায়। আমি সহ কাজের অনেকে এই বুরিতোর ভক্ত। এমন একটা রেস্টুরেন্ট অফিস হতে পাঁচ মিনিটের ড্রাইভ। এক সকালে অর্ডার দিয়ে টেবিলে বসে আছি। সময় যায় কিন্তু আমার বুরিতো আসেনা। আমার পরে এসে অর্ডার করে অনেকে বুরিতো নিয়ে চলে যাচ্ছে অথবা বসে খাচ্ছে। একে-তো ক্ষুধার্ত তার উপর পার করছি অফিসের সময়। অনেকে অনলাইনে অর্ডার করে এবং আসা মাত্র সংগ্রহ করে ফিরে যায়। তাই আমার পরে এসে আগে চলে যাওয়ার অভিযোগ সবসময় সত্য নাও হতে পারে। তাই এ নিয়ে অভিযোগ করাটা যুক্তিযুক্ত মনে করিনি।

চল্লিশ মিনিট পার করার পর অধৈর্য হয়ে কাউন্টারে গেলাম। ভাগ্য ভাল, ওখানে ক্যাশিয়ার নয়, খোদ ম্যানেজার দাঁড়িয়ে গ্রাহকদের সেবা করছিলেন। ক্রয় রশিদ দেখিয়ে জানতে চাইলাম আর কতটা দেরী হবে আমার খাবার তৈরি হতে। রশিদ হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখে চোখ কপালে উঠলো। জানতে চাইলে এতক্ষণ ধরে এখানেই অপেক্ষা করেছি কি-না। উত্তরে হ্যাঁ বলতেই সে ব্যস্ত হয়ে কিচেনে গেল। এবং ওখানকার সবাইকে বাইরে এনে আমার সামনে দাঁড় করলো। আমি অবাক হলাম। একে একে সবাই আমার কাছে ক্ষমা চাইল। ভুলটা কোথায় হয়েছে তা অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। রাগ পুষে রাখার মত আর অবস্থা ছিলনা আমার। মৃদু হাসি দিয়ে আমিও মেনে নিলাম ভুল বুঝাবুঝির পর্ব।

খাবার হাতে নিয়ে ফিরে আসাতে গিয়ে অবাক হলাম। ওরা আমার হাতে একটার বদলে দুটো বুরিতো ধরিয়ে দিয়েছে। সাথে একটার জায়গায় দুটো অরেঞ্জ জুস। দিনটা ছিল বুধবার। ম্যানেজার হাত একটা কাগজ ধরিয়ে বলল সপ্তাহের বাকি দুটো দিন চাইলে বিনা-পয়সায় বুরিতো ও যেকোন একটা ড্রিংক নিতে পারি।

রেস্টুরেন্টের বাইরে পা রাখতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। পৃথিবীটা এখনো ততটা খারাপ হয়ে যায়নি যতটা আমরা ভেবে থাকি।

Breaking Bad শহরের জীবন

Breaking Bad শহরের জীবন

পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক শহর নিয়ে লিখেছি। পাঠকদের সাথে শেয়ার করেছি নগর জীবনের অভিজ্ঞতা। সে তালিকায় যেমন আছে তারুণ্যের দীর্ঘ ১২ বছর কাটানো রুশ দেশের সেন্ট পিটার্সবার্গ, তেমনি আছে পাঁচ বছরের সিডনীর জীবন যুদ্ধ। নিউ ইয়র্কের ছয় বছরই ছিল ভার্চুয়াল দুনিয়ায় স্থায়ী হওয়ার লগ্ন। এ লগ্নেই পাঠকদের পরিচিত করেছি অধুনা বিশ্বের অর্থনৈতিক রাজধানী হিসাবে পরিচিত এ শহরের সাথে। কথার ফাঁকে ফাঁকে নিয়ে গেছি এন্ডিসের দেশ পেরু, বলিভিয়া, কলোম্বিয়া ও ইকুয়েডোরে। কিন্তু গেল ১২ বছর ধরে যে শহরটায় আছি তার দিকে ভাল করে চোখে ফেরানো হয়নি।

আলবুকেরকে, নিউ মেক্সিকো, ইউএসএ। ২০০৭ সালে প্রথম যখন এ শহরটায় পা রাখি মনে হয়েছিল রাজধানী ঢাকা হতে কর্ম উপলক্ষে নওগাঁয় চলে যাওয়ার মত। নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে নওগাঁর প্রথম রাতটা ছিল ঝড় তুফানের রাত। শহরের যে হোটেলটায় ঠাঁই নিয়েছিলাম সারা রাত মনে হয়েছিল তা কাঁপছে এবং যে কোন মুহূর্তে উড়াল দেবে। অবশ্য তেমন কিছু হয়নি। এক সময় পোটলা পুটলি গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হই আরও গভীরে। শেষ গন্তব্য পত্নীতলা, ধামুইরহাট এবং বদলগাছি। জন্মভূমিকে কাছ দেখার ও আবিষ্কার করার এ ছিল সোনালী ২টা বছর।

হিসাবে ভুল হওয়ায় হঠাৎ করেই নিউ ইয়র্ক শহরে নিজকে আবিষ্কার করি বেকার হিসাবে। যদিও তা ছিল জাস্ট ফর ব্রীফ পেরিয়ড অব টাইম। কিন্তু সেই যে মন উঠে গিয়েছিল তা আর ঠিকমত জোড়া লাগেনি। প্রফেশন বদলে পা রাড়ালাম টেলিকমের দিকে। শুরুটা টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের সান আন্তোনিও হলেও ফুল স্কেলে তা প্রস্ফুটিত হয়ে মিউ মেক্সিকোতে।

আলবুকেরকে। শহরের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ দ্যা কুয়েভা দ্যা ডিউক অব আলবুকেরকের নামে নাম রাখা হয় শহরের। স্প্যানিশদের দখল হতেই উত্থান এ শহরের। মার্কিন-মেক্সিকো যুদ্ধের শেষদিকে এ অঞ্চলটা কেড়ে নিয়ে মার্কিনীরা তাদের ইউনিয়নে যুক্ত করে এবং নাম দেয় নোয়াভো মেহিকো। অর্থাৎ নিউ মেক্সিকো। হিস্পানিকদের সংখ্যা এ রাজ্যে আমেরিকার যে কোন রাজ্যের চাইতে বেশী। স্প্যানিশ ভাষার ব্যবহার এখানে সার্বজনীন। অন্যদিকে আলাস্কার পর সংখ্যায় আদিবাসী আমেরিকানদের বাস। মরু এই এলাকা আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমের অংশ। জীবন এখানে খুব একটা সহজ নয়। বেচে থাকার জন্যে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। একদিক রুক্ষ প্রকৃতি, অন্যদিকে সামাজিক সমস্যা। তার অন্যতম হচ্ছে প্রতিবেশী মেক্সিকো হতে পালিয়ে আসা অবৈধ অভিবাসীরা। এবং স্বভাবতই ড্রাগ।

যতটা না প্রকৃতি অথবা রাজনীতি, শহর আলবুকেরকে বেশী পরিচিত করেছে ওয়ালটার হোয়াইট’এর নাম ভূমিকা সহ সফল মার্কিন টিভি সিরিজ ব্রেকিং ব্যাড। ২০০৮ হতে ১৩ পর্যন্ত এই টিভি সিরিজ অনেক ঘরে মার্কিনীদের দম আটকে রাখতো এর ঘটনা প্রবাহ দিয়ে। আমার অফিসটা তখন ডাউন-টাউনে। পাঁচতলার জানালা হতে লক্ষ্য করলে প্রায়ই দেখতাম নীচের রাস্তায় শুটিং হচ্ছে। অফিসের ঠিক উলটো দিকে অবস্থিত পুলিশ ষ্টেশনটাকে নিয়মিত ব্যবহার করা হতো সিরিজের পুলিশ অফিস হিসাবে। পাশের ক্যাফেটেরিয়া, রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন জাঙ্ক ফুডের দোকান, কোন কিছুই বাদ যায়নি তালিকা হতে। গোটা আমেরিকার মত এই পাঁচ বছর আমার শহরও মেতে থাকতো ব্রেকিং ব্যাড’এর এপিসোড নিয়ে। এ টিভি সিরিজ আলবুকেরকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি। এমনকি বাংলাদেশেও আলবুকেরকে অনেকের কাছে এখন পরিচিত একটি নাম।

মরিচের বিশ্ব-রাজধানী হিসাবে ধরা হয় নিউ মেক্সিকোকে। এখানে শিশু বয়স হতে মানুষ ঝাল খাওয়া অভ্যাস করে। মরিচ হচ্ছে অঙ্গরাজ্যের সিম্বল। অবৈধ মেক্সিকান অভিবাসীদের জন্যে এ অঙ্গরাজ্য অভয়ারণ্য। আইন-আদালতের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এ অঙ্গরাজ্যে লুকিয়ে থাকা তাদের জন্যে কোন সমস্যা নয়। অনেকক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারও তাতে উৎসাহ দেয়।

আমার গন্তব্য-হীন চলমান জীবনের অনিশ্চয়তা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। ব্যাপক কোন পরিবর্তন না হলে এ শহরেই বোধহয় কাটাতে হবে জীবনের বাকিটা সময়। মেগা শহরের জীবন নিয়ে আর কোন আগ্রহ নেই। এখন জানালা খুললে চোখে পরে বিশাল আকাশ। তার নীল নীল রঙ। মরু এলাকার উত্তপ্ত বাতাস এসে দোল খায় ঘরের আঙ্গিনায়। এসব ভাল না লেগেই যায়না। দূরের সান্দিয়া পাহাড় আর আদিবাসীদের জীবনের সাথে কখন একাত্ম হয়ে গেছি টেরই পাইনি।

ফিলিস্তিনিদের গল্প … ৩


দামেস্কাস গেইট এবং আমি।

ভারতীয় চরিত্রের এইদিকটা অনেকের মত আমাকেও বিমোহিত করে। ওরা যেখানেই যায় তাদের বেনিয়া-বৃত্তি সাথে নিয়ে যায়। অনেকটা সুঁই হয়ে ঢুকে সাপ হয়ে বের হওয়ার মত। দৃঢ় বিশ্বাস ইসরায়েল হচ্ছে তাদের বাণিজ্য-লক্ষ্মীর নয়া দিগন্ত। তেল আবিব এয়ারপোর্টে নেমেই ব্যপারটা আঁচ করা যায়। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় পাশের বুথে একজন ভারতীয়কে প্রশ্ন করছিল ইসরায়েলই অফিসার। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল সে তেল আবিব ইউনিভার্সিটির ছাত্র এবং ছুটি কাটিয়ে ইসরায়েলে ফিরছে। দেখতে কোষ্ঠকাঠিন্য রুগীর মত হলেও ভারতীয় এই ছাত্রের সাথে কথা বলার সময় মনে হলো অফিসারের সুখ তেলতেলেয়ে মাটিতে পড়ছে। পুরানো জেরুজালেমের মুসলিম কোয়ার্টারে চোখে পরার মতে বিদেশী বলতে ভারতীয়রাই। গায়ে গতরে অগোছালো সাউথ ইন্ডিনিয়ানরাই সংখ্যায় বেশী। সংখ্যায় পশ্চিমা বিশ্বের রাস্তাঘাটে কিলবিল করার মত না হলেও সন্দেহ নেই ইসরায়েলও এদের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ একটা সময় যখন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো তাদের দুয়ার বিদেশী শ্রমিকদের জন্যে উন্মুক্ত করছিল একই ভারত তার দেশের মুসলিম জনসংখ্যাকে পুঁজি বানিয়ে ব্যাপক সুবিধা নিয়েছিল। পাশাপাশি ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক খারাপের অভিনয় করে আরব রাজা-বাদশাহদের আস্থা অর্জন করেছিল।

পৃথিবী এখন বদলে গেছে। ফিলিস্তিনি সমস্যা অনেক পশ্চিমা দেশের মত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্যেও এখন কোন সমস্যা নয়। এতদ অঞ্চলের রাজা-বাদশারা এখন ইসরায়েলের জিগরই দোস্ত। ওরা দেশে-বিদেশে একই পুঁজির যৌথ বিনিয়োগকারী। রাজধানী তেল আবিব আর বন্দর নগরী হাইফা হচ্ছে মদ আর পূর্ব ইউরোপীয় নারী ভোগের লীলাভূমি। ওরা আসে এবং সাথে নিয়ে আসে বস্তা-ভর্তি পেট্রো ডলার। সূরা আর সাকির আসরে বৃষ্টির মত ডলারে সিক্ত করে নারী দেহ। এখানেই ভারতীয়দের পার্থক্য। ওরাও আসে, তবে খরচের মানসে নয়, বরং টু-পাইস কামানোর ধান্ধায়। নিউজিল্যান্ডের গভীরে ছোট জনপদের শহরেও ওদের দেখা যায়। ডেইরি স্টোর বানিয়ে ব্যবসা করছে। অনেক দেশে একই বিনিয়োগ চলে কর্নার শপের নামে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে গুজরাটি ভারতীয়দের দখলে ফ্রীওয়ে সহ শহর-বন্দরের মোটেল ব্যবসা।


এবং কতিপয় ভারতীয়।

ঢালু ও পিচ্ছিল পাথরের রাস্তায় এহেন ধাক্কা সামলে নিতে একটু কষ্টই হলো। সামলে উঠে দাঁড়াতেই দেখি একদল ভারতীয়। তাদের কেউ একজন আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। ধাক্কাটা ইচ্ছাকৃত ছিলনা, কিন্তু এর তীব্রতাই বলে দেয় এলোমেলো ও বেসামাল গতিতে হাঁটছিল মহিলা। ওদের কেউ ফিরেও তাকাল না আমার দিকে। আমিও অবাক হইনি। কারণ ভুলের জন্যে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি এখনো পৌঁছায়নি পৃথিবীর অনেক প্রান্তে। আমাদের উপমহাদেশ তার অন্যতম। ক্ষণিকের জন্যে রক্তের চাপ উছলে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলাম। নিজেকে বুঝালাম, আমি এখন এমন একটা দেশে যে দেশে আমার ধর্মীয় পরিচয় গায়ে গতরে এলোমেলো ভারতীয়দের চাইতে অনেক বেশী ভীতিকর। সাহায্য চাইলেই যে ইসরায়েলই পুলিশ দৌড়ে আসবে এমন সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। এসব মেনে নিয়েই উঠে দাঁড়ালাম এবং ভাণ করলাম যেন কিছুই হয়নি। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করে খুব অবাক হলাম, ওরা ফুটপাথের উপর বসা ভেন্ডরদের কাছ হতে সবজি কিনছে। প্রমাণ করার জন্যে এটাই ছিল যথেষ্ট, ওরা আমার মত পর্যটক নয়। হয়ত জেরুজালেমেই বাস করছে। নিশ্চয় কাজ বলে কিছু একটা করছে এখানে। জানার কৌতূহলটা দমাতে পারলাম না। বেশকিছুটা পথ ওদের অনুসরণ করলাম। যেখানে থামছে, আমিও থামছি। উদ্বার করার চেষ্টা করলাম ওদের কথোপকথন। কিন্তু না, গুটিকয়েক হিন্দি শব্দ বাদে কথাবার্তার সবটাই ছিল দক্ষিণের ভাষায়। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে মিশে গেলাম জনারণ্যে।


আর দশটা দিনের মত একটা দিন।

বেলা গড়াচ্ছিল। আজকের মেনুতে অন্য কোন শহরে ঢুঁ মারার পরিকল্পনা ছিলনা নিরাপত্তার কথা ভেবে। তবে ফিলিস্তিনি আরবদের ঢল নামা Suq Khan El Zeit রাস্তা দেখে তা বুঝার উপায় ছিলনা। জীবন এখানে আর দশটা দিনের মতই। লোকে লোকারণ্য। রাস্তায় দুই ধারে পশরা সাজিয়ে দোকানিরা গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন দোকান হতে ভেসে আসছে ভিন্ন রকমের গান। অনেক দোকানে বাজছে কুরানের আয়াত। এ রাস্তা যানবাহন চলাচলের জন্য নয়। তবে মালামাল পরিবহনের জন্যে ট্রাক্টর জাতীয় এক ধরণের ট্রাক সাপের মত একে-বেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে। জীবনের স্পন্দন অনুভব করতে এখানে কান পাততে হয়না। বরং এ স্পন্দন নিজেই চলে আসে কানের কাছে। শুধু চোখ আর কান দুটো একটু খোলা রাখতে হয়। পুরানো জেরুজালেমের রাস্তার এ জীবন কোনভাবেই দেয়ালের ওপারের ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতিফলন নয়। এখানে আছে ব্যস্ততা, উচ্ছলতা, আছে না পাওয়ার কষ্টকে ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্য। অধুনা ফিলিস্তিনের রাজধানী রামাল্লার চিত্রটা একটু ভিন্ন। ওখানে রাজত্ব করে দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা আর ইসরায়েলিদের প্রতি ঘৃণার আগুন। রামাল্লায় দেয়ালের লিখন পড়লেই আঁচ যায় ওদের বেঁচে থাকার গল্প। বাংলাদেশ হতে চোখ বেঁধে কাউকে পশ্চিম তীরে নামিয়ে দিলে প্রথমেই ভুল করবে এলাকাটা পুরানো ঢাকার কোন অংশ ভেবে। বিশেষ করে বিভক্ত দেয়াল পার হয়ে ফিলিস্তিনে পা রাখা দু’এক মাইলের মধ্যে। এর পর অবশ্য চিত্র কিছুটা হলেও বদলে যাবে। চোখে পড়বে উপরের দিকে ধাবমান স্কাই স্ক্রাপার। ঝকঝকে শপিং মল। বেশকিছু গাড়ির দোকান। যদিও এসবের উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মূল ভূমির ইহুদি। রাস্তার ট্রাফিক অনেকটাই এলোমেলো। পথচারীরা অনেকটা ঢাকার ফ্রি স্টাইলে পার হচ্ছে।


দামেস্কাস গেইট।

দামাস্কাস গেইটে এসে পৌঁছলাম ঠিক মধ্য দুপুরে। জনশূন্য, অনেকটাই খা খা করছে সামনের স্কয়ার। হাতের ডানদিকে ছোট মত একটা ছাউনির নীচে বসা ইসরায়েলই পুলিশ কড়া নজর রাখছে চারদিকে। পুলিশদের বেশীর ভাগই যুবতী। লম্বায় অনেকটাই খাটো। দেখতে আকর্ষণীয়। প্রথম দেখায় হাতে ধরা অস্ত্রের হিংস্রতার চাইতে বেশী দৃষ্টি কাড়বে তাদের চেহারা ও গড়ন। চোখে মুখে উৎকণ্ঠা ও এক ধরণের বিষণ্ণতা। পূর্বাভাষ ছিল আজ এখানে গোলমাল হবে। ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ করবে বিভক্ত দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে উঠা শতাধিক পাকাবাড়ি গুড়িয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে। পশ্চিম তীরে অনেকে বলেছিল, কে জানে, হয়ত আজই শুরু হতে পারে নতুন ইন্তেফাদার গোঁড়া পত্তন। মাঠের চিত্রে তার ছায়া মাত্র ছিলনা। সবকিছু ছিমছাম। চলাফেরার কিছুটা সতর্কতা। সামনের আ-ওয়াদ রোডে ব্যস্ততা বাড়ছে।


ফিলিস্তিনি জনগণ বনাম ইসিরায়েলি পুলিশ।

পাশের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে ড্রাইভাররা প্রতিদিনের মতই আড্ডা দিচ্ছে। অনেকে সিগারেট ফুঁকছ এবং চোখ রাখছে সম্ভাব্য যাত্রীর দিকে। গেইটের সামনেই কলোসিয়ামের মত গ্যালারি। ওখানে সব সময়ই টুরিস্টদের ভীর। আজ অবশ্য তেমন কাউকে দেখা গেলনা। মোবাইল ফোনের ক্যামেরাটা অন করে বসে পরলাম ফাঁকা একটা জায়গায়। আবারও একদল ভারতীয়। ওরা দলবেঁধে ঢুকছে মুসলিম কোয়ার্টারে। আরব কজন যুবক একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করতেই পুলিশ নেমে এলো ছাউনি হতে। হিব্রু ভাষায় কি বললো বুঝতে পারলাম না। তবে আন্দাজ করত পারলাম, এখানে যুবাদের জমায়েত আজ নিষিদ্ধ। ইচ্ছা থাকলেও সামনে যেতে সাহস করলাম না। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলই পুলিশের সংঘর্ষ আমার মত অনেকের কাছে অপরিচিত নয়। আমরা যারা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের উপর দৈনিক পত্রিকা গুলোর হেডলাইন পড়ে বড় হয়েছি তাদের জানা আছে এর আদি ও অকৃত্রিম ইতিহাস।

২০ মিনিটের উপর খোলা আকাশের নীচে বসে থাকা সম্ভব হলোনা। সূর্যতাপের তীব্রতা ততক্ষণে সহনীয় সীমা অতিক্রম করে গেছে। সাথে বাতাসের আর্দ্রতা। শরীরের দিকে তাকাতেই খেয়াল হল, ঘামতে শুরু করেছি আমি। না, আজ আর এমনকিছু ঘটতে যাচ্ছেনা তা বুঝে নিলাম। হঠাৎ করেই রামাল্লায় আমার ট্যুর গাইড আবু আল নাসেরের কথা মনে পরল। জেরিকোর রেস্তোঁরায় বসে সে হর হর করে বলে যাচ্ছিল ফিলিস্তিনি কাহিনী। তার মতে পশ্চিম তীরের অনেককেই ইসরায়েলিরা কিনে নিয়েছে। এমনকি প্যালেষ্টাইনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে পর্যন্ত। ওদের দান-দক্ষিণার উপরই নাকি এরা বেঁচে থাকে। এ অভিযোগ হতে হানান আশরাফিকেও বাদ দেয় হলোনা। ফিলিস্তিনিদের প্রবাদ পুরুষ ইয়াসির আরাফাতের বিদেশী স্ত্রীর দিকেও আঙ্গুল তুলতে পিছপা হলোনা সে। যারা বিক্রি হতে অস্বীকার করে তাদেরই নাকি রাতের অন্ধকারে উঠিয়ে নেয়া হয়। তারপর নিখোঁজ হয়ে ঠাঁই নেয় ইতিহাসের পাতায়। আমি এদেশে এসেছি প্যালেস্টাইনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে নয়। এই এসব চিন্তা মাথা হয়ে ঝেড়ে ফেলে ট্যুরের দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথায় যেন বাংলাদেশীয় রাজনীতির সাথে একটা সমান্তরাল খুঁজে পেলাম এখানে। কেবল ইসরায়েলের জায়গায় প্রতিবেশী ভারতে বসিয়ে দিলেই হিসাব মিলে যাবে।

বেলা বাড়ছিল। উঠে পরলাম এবং পাশেই ট্রাম ষ্টেশনের দিকে রওয়ানা দিলাম। গন্তব্য সেন্ট্রাল বাস ষ্টেশন। ওখান হতে গোলান হাইটসের দিকের বাস ধরার ইচ্ছা।

– চলবে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র: ভেবে দেখুন ব্যপার গুলো

টাইম-মেশিনে চড়ে চলুন ত্রিশ বছর পরের বাংলাদেশ হতে একটু ঘুরে আসি। বৃহত্তর ময়মনসিংহ’এর ছোট গ্রাম আশাগঞ্জই হোক আমাদের গন্তব্য। গ্রামটার মোট কতজন মানুষ বাস করে তার হিসাব কষার মত রকেট সাইন্স এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। যদিও বলা হচ্ছে দেশটার মোট জনসংখ্যা এখন ২০ কোটির উপর। আশাগঞ্জে এক টুকরো খালি জমি বলতে এখন আর কিছু নেই। মানুষ ঘর বাঁধছে জলে, স্থলে এবং অন্তরীক্ষে। জ্বালানি সংকটের কাছে পরাজিত হয়ে গ্রামে তাবৎ গাছপালা অকালে বিদায় নিয়েছে। মাটির তলার গ্যাসও এখন ইতিহাস। অথবা ঠাঁই নিয়েছে শিশুদের ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসির গল্পে। ঘুম ভেঙ্গে কোন এক ভোরে গ্রামের মানুষ দেখলো মাথা হতে চুল খসে খসে পরছে। চোখ জ্বালা-পোড়া করছে। কাশির সাথে রক্ত বের হচ্ছে। গ্রামের অবুঝ শিশুরা জোরে চীৎকার করার আগেই লুটিয়ে পরছে মাটিতে। বৃদ্ধরা শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। ওরা একে একে ঢলে পরছে মৃত্যুর কোলে। আপনার বিশ্বাসী মনের প্রথম জিজ্ঞাসা হবে, কেয়ামত কি তাহলে এসেই গেল!

হ্যাঁ এক অর্থে অবশ্যই কেয়ামত। তবে এ কেয়ামত ধর্মে বর্ণীত সে কেয়ামত নয়। এ কেয়ামত মনুষ্য সৃষ্টি কেয়ামত। এর উৎস উন্নতির হাইওয়েতে জন্ম নেয়া লাভ-চাইল্ড রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আশাগঞ্জের বাসিন্দা আপনি আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা কি ঘটছে। কেন ও কোথায় ঘটছে।

এবার আসুন বাইরের পৃথিবীর দিকে চোখ ফেরাই।

বিশ্ব মিডিয়া ফলাও করে ছাপছে বাংলাদেশের বিপর্যয়। দুর্ঘটনা ঘটেছে এর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। রিয়েক্টর হতে বিকিরণ হচ্ছে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পরছে গ্রাম, গঞ্জ, শহর বন্দরে। মানুষ মরছে হাজারে হাজার। চেহারা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে নাগরিকদের। হাত-পা বেঁকে যাচ্ছে। চোখ কান গলে খসে খসে পরছে। কিন্তু আশাগঞ্জের মানুষ সহ দেশের জনগণ ধারণাই করতে পারছে না সমস্যর উৎসটা কোথায়। কারণ স্থানীয় প্রচার মাধ্যম এ সব প্রচার আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বন্দুকের নলের মুখ বাস করা দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ জান বাঁচাতে ৭’১’এর মত চৌকির তলায় আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছেনা। পারমাণবিক বিকিরণের হাত পা, শরীর বলতে কিছু নেই। সরকারের পেটোয়া বাহিনী দিয়ে একে থামানোর কোন উপায় নেই। এই ত্রিশ বছরেও এ ধরণের দুর্ঘটনা হতে মানুষকে বাঁচানোর কোন উপায় আবিষ্কৃত হয়নি।

চলুন রূপপুরে ফিরে গিয়ে দেখার চেষ্টা করি কি ঘটছে ঐ রাক্ষসপুরীতে।

বিদ্যুৎ তৈরীর বহুমুখী পথ আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। পানি, কয়লা সহ অনেক ধরণের জ্বালানী ব্যবহার করা হয় এই কাজে। ইউরেনিয়াম নামের খনিজ পদার্থ তার অন্যতম। ইউরেনিয়ামের এটমকে বিভক্ত করলে তা হলে এনার্জি রিলিজ হয়। এবং এই বিভক্তি হয় চেইন রি-একশনে। অনেকটা ডমিনো এফেক্টের মত। সোজা বাংলায় বুঝাতে চাইলে বুঝতে হবে, শত শত ইটা একটার পেছনে আরেকটাকে দাঁড় করিয়ে প্রথম ইটায় ধাক্কা দিলে যা হবে ওটাকেই বলতে হবে চেইন রিয়েকশন। ইউরেনিয়ামের এটম একই কায়দায় ভাঙ্গা হয়। প্রচণ্ড তাপমাত্রার এটমের শক্তিকে রূপান্তরিত করা হয় বাষ্পীয় শক্তিতে। ঐ বাষ্প দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জেনারেটরের টারবাইন ঘুরানো হয়। এবং ওখান হতেই বেরিয়ে আসে পরিষ্কার ও এফিসিয়েন্ট বিদ্যুৎ।

কেন ঘটল এই দুর্ঘটনা?
এর আসল কারণ উদঘাটন করতে আমাদের আবারও ফিরে যেতে হবে ত্রিশ বছর আগের বাংলাদেশে। উঠে পরুন টাইম মেশিনে…

মনে আছে দুইশত টাকার বালিশ দালানের আ্ট তলায় উঠাতে ৬০ হাজার টাকা খরচের কেচ্ছা? দলীয় কৃতদাস না হলে এসব ভুলার কথা না। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণকালীন সময়েই ঘটেছিল এ কাহিনী। অথবা মোহম্মদ নাসিম নামের একজন ভূতপূর্ব মন্ত্রীর লুঙ্গি ধরে টানলেই বেরিয়ে আসবে রূপপুর বিপর্যয়ের সার্বিক চিত্র। বাংলাদেশের যে কোন মেঘা প্রকল্পই হচ্ছে সরকারী কোষাগারের চাবি হাতিয়ে নেয়ার একটা উপলক্ষ। তা রূপপুর হোক অথবা মহাশূন্যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হোক। চৌদ্দ পুরুষের আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করতে এই রূপপুর প্রকল্পেও ছয়কে নয় বানিয়ে বিশাল অংকের ভাগ্য হাতিয়ে নিয়েছে সরকারের চেলা-চামুণ্ডরা। ঠাণ্ডা করার পানিতে ভেজাল মিশিয়ে বছরের পর বছর চালিয়ে গেছে মিথ্যার বেসাতি। জাফর ইকবালের মত চৌকির তলায় লুকানো মুক্তিযোদ্ধারা বলবেন, আরে এতো স্বদেশীদের নিয়ন্ত্রণে থাকবেনা, থাকবে নির্মাতা রশদের হাতে। কথা একেবারে মিথ্যা না। অবশ্যই রুশরা দেখভাল করবে রিয়েকটরের সবকিছু।

কথা হচ্ছে কারা এই রাশান? তারা কি ঈশ্বর প্রদত্ত দৈব কোন শক্তি, যাদের হাতে নিরাপদ থাকবে আশাগঞ্জের মানুষের জীবন? এ হচ্ছে অন্য এক অধ্যায়। মানব সভ্যতার অলিখিত কলঙ্কিত অধ্যায়। রুশরা হচ্ছে বাংলাদেশি লুটেরা দলেরই উন্নত সংস্করণ। চেরনোবিল দুর্ঘটনার কথা যারা ভুলে গেছেন তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই আর্কটিক সাগরে গত রোববারের দুর্ঘটনার কথা। ক্রুস মিসাইলে পারমানবিক ফুয়েল চালিত মটর বসানোর গবেষণায় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তাতে প্রাণ হা্রিয়েছে পাঁচজন বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক। চেরনোবিলের মত এখানেও রুশরা ধরে রেখেছে তাদের মিথ্যা ও প্রতারণার রেকর্ড। তারা বলছে কিছুই ঘটেনি, সামান্য ঘটনায় পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছে! সেটা আর এমন কি!!

এবার চলুন ফিরে যাই বাস্তবে…

রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নিয়ে যাদের উচ্ছ্বাসের শেষ নাই, তাদের একবারের জন্যে হলেও অনুরোধ করবো আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে নিতে। দুর্নীতি আর ভেজালের লীলাভূমিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কি ঘটতে যাচ্ছে তার কিছুটা হলেও নমুনা পাওয়া গেছে ২০০ টাকার বালিশ ৬০ হাজার টাকায় আট তলায় উঠানোর ঘটনা হতে। বাকিটা আন্দাজ করে নিতে হবে। মহাশূন্যে নিক্ষিপ্ত স্যাটেলাইট হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পরলে তাৎক্ষণিক কেউ মারা যাবেনা। কিন্তু রূপপুর কেন্দ্রের রিয়েক্টর বিগড়ে গেলে তা দাবানলের মত গ্রাস করে নেবে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট এই দেশ। একশ বছর ধরে চলবে এর রেশ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্ম নেবে পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে।

আশাগঞ্জের মানুষ আশায় ঠিকই বুক বাধবে। সে আশা স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর, সে আশা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থানের আশা। এবং আশায় নিশ্চয় বড় ফ্যাক্টর হবে বিদ্যুৎ। পৃথিবীর অনেক দেশ গুটিয়ে আনছে তাদের পারমাণবিক প্রকল্প। কিন্তু রাজনৈতিক ঘাত-সংঘাতে বিভক্ত বাংলাদেশে কেবল উন্নয়নের লাভ-চাইল্ড জন্ম দেয়ার মানসে বর্তমান সরকার যা করছে তা সর্বগ্রাসী হয়ে ফিরে আসতে পারে। যারা এসব করছে তারা দুর্যোগ মুহূর্তে নিশ্চয় পাড়ি জমাবে নিজ নিজ নিরাপদ আশ্রয়ে। সেটা হবে উন্নত বিশ্বের কোন দেশ, কানাডার বেগম পাড়ার বাড়ি অথবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম। ভেবে দেখুন ব্যপার গুলো…

ফিলিস্তিনিদের গল্প – ২

সব মিলিয়ে দু’ঘণ্টার মত ঘুমিয়েছি কিনা সন্দেহ। আসলে গোটা ট্রিপটাতেই ঘুম এলোমেলো হয়ে গেছে। একে নিউ মেক্সিকোর সাথে নয় ঘণ্টা সময়ের পার্থক্য, তার উপর সকালে ঘুম ভাঙ্গার নেই কোন তাড়া। ফজরের আযানের সাথে ঘুম ভাঙ্গতে সিদ্ধান্ত নিলাম আজ আর ঘুমানোর চেষ্টা করবো না। হোটেলের দরজা খুলতেই ভুতের মত দাঁড়িয়ে থাকা সাদা কটা দেয়াল অভ্যর্থনা জানালো নিঃশব্দের পৃথিবীতে। হোটেল করিডোরে আধাভৌতিক একটা আবহ মনে করিয়ে দিল এখনো ঘুম ভাঙ্গেনি অনেকের। তাই সাবধানী পায়ে আলতো করে ঢুকে গেলাম অপেক্ষমান লিফটায়। এক তলায়ও একই অবস্থা। লবি খা খা করছে। কাউন্টারে কেউ আসেনি। কফি মেশিনটা তখনও চালু ছিল। কাগজের গ্লাসে কড়া এক গ্লাস কফি বানিয়ে ঘাপটি মেরে ফিরে গেলাম রুমে।

পর্দা সরিয়ে রুমের সবকটা জানালা খুলে দিলাম। বাইরের হাল্কা আলোতে জেরুজালেম নগরী আছড়ে পরলো জানালায়। গ্রাস করে নিল আমি ও আমার সত্ত্বা। যতদূর চোখ যায় ইটপাথরের বাড়িঘর। হবে হয়ত হাজার বছরের পুরানো। শহরের দেয়ালে কান পাতলে হয়ত এখনো শোনা যাবে রোমানদের, জর্ডানিয়ানদের, টার্কিস অথবা সাময়িক কালের ইস্রায়েলিদের পায়ের শব্দ। শহরের প্রতিটা কোনা স্বাক্ষী দেবে ইতিহাসের অমোঘ পরিণতির। প্রতিটা রাস্তা কথা বলবে শৌর্য্য, বীর্য, ঐতিহ্যের। বাইরের হাল্কা বাতাস চোখ মুখে শান্তির প্রলাপ এঁকে দেয়। অজান্তেই দৃশ্যপটে ভেসে উঠল এন্ডিসের বুক চিড়ে বলিভিয়া ভ্রমণের প্যানোরমা। পেরুর সীমান্ত শহর পুনের হোটেলে আটকে আছি। অপেক্ষা করছি লা পাসগামী বাসের। দেশটায় ধর্মঘট চলছে। সব ধরণের যানবাহন বন্ধ। অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে আজকের মত সে রাতেও ঘুম আসেনি। খুব সকালে উঠে জানালার পর্দা সরাতেই চোখের সামনে আছড়ে পরেছিল গোটা এন্ডিস। এর বিস্ময়কর প্যানোরমা সহজেই ভুলিয়ে দিয়েছিল অপেক্ষার কষ্ট।

ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা বেরিয়ে আসছে রাতের আশ্রয় হতে। আলো ফুটতে শুরু করেছে শহরে। দূরে দামাস্ক গেইটের কাছে দু’একটা গাড়িও চলতে শুরু করেছে। রামাল্লায় শোনা ভবিষৎবাণী সত্য হলে আজ ওখানে কিছু একটা ঘটার কথা। ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ করবে তাদের শতাধিক বাড়ি গুড়িয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে। আজকের প্রতিবাদ দীর্ঘমেয়াদী প্রতিবাদে রূপ নেয়ার সম্ভবনাও উড়িয়ে দেয়নি সদ্য পরিচয় হওয়া বেথেলহেমের এক ফিলিস্তিনি পরিবার। ওরা সবাই অপেক্ষায় আছে একটা স্ফুলিঙ্গের। বিভক্ত দেয়াল পেরিয়ে জেরুজালেমে প্রবেশের অনুমতি নেই অনেকের। স্বপ্নের শহর নিয়ে ওদের আক্ষেপের শেষ নেই। শেষ করে এ শহরকে দেখেছিল, কোথায় ঘুরেছিল, কি খেয়েছিল এ নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন ঘরে ঘরে। অথচ রামাল্লা, বেথেলহেম অথবা জেরিকো হতে জেরুজালেম চল্লিশ মিনিটের পথ। ছোট মিনিবাস ধরলে আরও আগে পৌঁছানো যায়।

সূর্য উঠার আগে আরও একবার ঢুঁ মারলাম হোটেল কাউন্টারে। আপাদমস্তক ঢাকা সাদা ধবধবে এক মহিলা বসে আছেন কাউন্টারে। সালাম দিয়ে নিজের অবস্থান পরিস্কার করলাম। খুব নীচু গলায় জবাব দিল। জানতে চাইলো এত সকালে এখানে আগমনের হেতু। হোটেলের মূল ফটকটা খুলে দেয়ার অনুরোধ করলাম। আমি বাইরে বের হবো। সকালের সব শহরের চেহারাই অন্যরকম হয়। থাকে ভাল লাগার একটা চিকন অথচ মসৃণ অনুভুতি। এমনকি মনুষ্যভারে ডুবন্ত ঢাকা শহরের সকালেও থাকে হাল্কা এক ধরণের ভাল লাগা। খুব কাছ হতে না দেখলে বুঝা যায়না। মহিলা একটু অবাক হলো। একটু হাসল এবং সাবধান করে খুলে দিল অটোমেটেড দরজা।

বাইরে বেরিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিলাম। মনে হলো বাতাসে অক্সিজেন এখন অনেক বেশী। মধ্যদুপুরের কোলাহলের লেশমাত্র নেই। Suq Khan El Zeit নামের কালো পাথরের রাস্তাটা এখন খাঁ খাঁ করছে। দুএকজন দোকানদার তাদের পণ্য নামাচ্ছে। একটু হেঁটে কাঁচা বাজারের কাছাকাছি আসতে দৃশ্যপট বদলে গেল। সব্জির বাজার রীতিমত জমজমাট। পাশের দুয়েকটা কসাইয়ের দোকানও খোলা। দোকানদারদের অনেকে ফিলিস্তিনি মহিলা। পুরুষদের ব্যস্ততা পণ্য পরিবহনে। আমি দেখছি আর কচ্ছপ গতিতে হাঁটছি। চোখের মত পায়েরও কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই।

ধাক্কাটা ভালভাবেই লাগলো। কালো পাথরের রাস্তাটা এমনিতেই ঢালু, তার উপর পণ্য সাজিয়ে দোকানদারের দল পানি ঢালছে পরিস্কার রাখার জন্যে। পিচ্ছিল পথে প্রায় ছিটকে পরেছিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে চোখ ফেরালাম যে ধাক্কা মারল তার দিকে। ভারতীয়। দক্ষিন ভারতীয় ভাষায় কথা বলছে নিজেদের ভেতর। আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলা দেয়াটা যেন কোন ঘটনাই না। ক্ষমা চাওয়া দূরে থাক, চোখ ঘুরিয়ে একবারও দেখার চেষ্টা করল না কে আমি। পরিচয় পেয়ে আমিও অবাক হইনি এদের ব্যবহারে। অবাক হয়েছি এই ভেবে এর সকালে কি করছে এখানে। সেই তেল আবিব হতে দেখে আসছি ভারতীয়দের উপস্থিতি।

.
ফিলিস্তিনিদের গল্প … ১ম পর্ব
– চলবে

কাশ্মীর কি এবং কেন!

রাজা হর সিং এর নাম কি এর আগে কখনো শুনেছেন? না থাকলে ক্ষতি নেই। লাখো নামের ভীড়ে এমন একটা নাম জানা অথবা মনে রাখা তেমন জরুরি নয়। তবে আজকের কাশ্মীর নিয়ে আপনার ক্ষোভ দুঃখ থাকলে এই মানুষটার সাথে পরিচিত হওয়া আপনার জন্যে জরুরি। আসুন ফিরে যাই আপনার আমার জন্মের অনেক আগে, সেই ১৯৪৭ সালে। এই উপমহাদেশে ২০০ বছর দুধকলা খেয়ে বৃটিশরা যখন বুঝতে পারল দুধ ঘোলা হতে শুরু করেছে, কলায়ও পোকার প্রকোপ দেখা দিয়েছে, তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল, যথেষ্ট হয়েছে, আর না, এবার ঘরে ফেরার পালা। কিন্তু বললেই তো হুট করে চলে যাওয়া যায়না। হাজার হলেও দুইশ বছরের ময়লা!

মোহম্মদ আলী জিন্নাহ্ আর জওহর লাল নেহেরু ততদিনে দুই মেরুর দুই নেতা। এক কথায় পালের গোদা, যাদের নেত্রীত্বে দুধ ঘোলা হচ্ছে। সবার সমর্থন নিয়েই বৃটিশরা সিদ্ধান্ত দিল, দুই ভাগে বিভক্ত হবে এ উপমহাদেশ। এবং নিজেদের পছন্দ মতই রাজ্য গুলো যোগ দেবে প্রস্তাবিত ভারত ও পাকিস্তানে। যদিও নেহেরুর দল কোন মতেই চাইছিল না তাদের অখণ্ড ভারত খণ্ড-বিখণ্ড হোক। ধর্মীয় প্লাটফর্মের ভিত্তিতেই বিভক্ত হয় পাক-ভারত উপমহাদেশ। হিন্দুদের জন্যে হিন্দুস্থান আর মুসলমানদের জন্যে পাকিস্তান।

সমস্যা দেখা দেয় কাশ্মীর নিয়ে। সে রাজ্যে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের রাজা তখন একজন হিন্দু। এবং তিনিই আমাদের হরি সিং। ভারতের চাপ ছিল তাদের সাথে যোগ দেয়ার। কিন্তু মিঃ সিং সময় চাইলেন। কারণ তিনি জানতেন রাজ্যের মুসলমান জনগন তা সহজে মেনে নেবে না। অন্যদিকে পাকিস্তান ছিল আরও মরিয়া। কারণ দেশটার একটা বিরাট অংশের পানি আসে প্রতিবেশী কাশ্মীর হতে। নতুন দেশের কৃষিকাজের অনেকটাই নির্ভর করবে ঐ অঞ্চলের পানির উপর। তারাও চাপ দিল রাজা হরি কে। রাজা তাতে কান দিলেন না। পাকিস্তানের তর সইছিল না, তাই বিনা ঘোষণার জন্মের প্রথম প্রহরেই ঝাঁপিয়ে পরে কাশ্মীরের উপর। দখল করে নেয় বিরাট একটা অংশ। এই অংশটাই আজকে তাদের জন্যে আজাদ কাশ্মীর। রাজা হরি সিং চোখে অন্ধকার দেখেন। দ্রুত যোগযোগ করেন স্বধর্মী ভারতীয়দের সাথে। ভারত বাহু মেলে অপেক্ষায় ছিল এই মাহেন্দ্রক্ষণের। আরও অনেক রাজ্যের মত কাশ্মীরকেও প্রস্তাব দেন এই ইউনিয়নে যোগ দিতে। রাজা রাজী হলেন, কিন্তু কিছু শর্তে। এই যেমন, কাশ্মীর এখনই ভারতের অংশ হবেনা। রাজ্যের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে সময় দিতে হবে। পরিস্থিতি শান্ত হলে তারা সিদ্ধান্ত নিবে ভারত না পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকবে। নাকি স্বাধীন তৃতীয় একটা রাষ্ট্রের দাবি জানাবে।

পাকিস্তানী আগ্রাসনের হাত হতে বাঁচার জন্যে রাজা হরি বিশেষ মর্যাদায় কাশ্মীরের বাকি অংশ নিয়ে ভারতের সাথে যোগ দেন। কথা ছিল, ভারত পরবর্তী সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত কোন দিনই কাশ্মীরকে তাদের অংশ বলে দাবী করতে পারবেনা। বিদেশ ও সামরিক বিষয়ক দপ্তর গুলো বাদে বাকি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে কাশ্মীরি জনগণ। এমনকি তাদের নিজস্ব একটা পতাকা পর্যন্ত থাকবে।

দুদিন আগ পর্যন্ত এই বিশেষ মর্যাদা নিয়েই বেঁচে ছিল কাশ্মীরের জনগণ। কিন্তু গো-মূত্রখোর, নিরেট ধর্মীয় উন্মাদ নরেন্দ্র মোদি তার ‘জয় শ্রীরাম’ উন্মাদনায় আসক্ত ভোটারদের নিজের ক্যাম্পে ধরে রাখার মিশন হিসাবে কেড়ে নিয়েছে সেই বিশেষ মর্যাদা। উস্কে দিয়েছে গৃহযুদ্ধের দামামা। জন্ম দিয়েছে নতুন এক ফিলিস্তিনের।

ফিলিস্তিন সমস্যার মত কাশ্মীর সমস্যায়ও স্বধর্মীয় মুসলমানদের ফেলে ভারতের সাথে যোগ দিয়েছে সৌদি ও আমিরাতি রাজা-বাদশার দল। অনেকের জন্যে ব্যপারটা খটকার হলেও, যারা এই সৌদি ও আমিরাতী রাজপরিবারের ইতিহাসের সাথে পরিচিত তাদের জন্যে মোটেও খটকার ব্যপার না। গোটা ব্যপারটাই লেনাদেনার। বেনিয়া ভারতীয়দের চরিত্র ও লুচ্চা রাজপরিবারের চরিত্রে একবিন্দুতে মিলিত হয় স্বার্থের লেনাদেনায়। এখানে ধর্ম কোন ফ্যাক্টর না।

কাশ্মীরিদের লড়াই কোন ধর্মীয় লড়াই নয়। এটা তাদের অস্তিত্বের লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই। এখানে ভারতের মত পাকিস্তানও তাদের অস্তিত্বের শত্রু। কাশ্মীরের ইতিহাস একটা জাতিকে দলিত মথিত করে বন্দুকের নলের মুখে দাস বানিয়ে রাখার ইতিহাস। এতে ভারতের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি আছে পাকিস্তানের হাত। আছে বৃটিশদের কুটচাল। আছে একজন বিধর্মী রাজার বিশ্বাসঘাতকতা।

কাশ্মীরিদের মুক্তির লড়াই তাদের নিজেদেরই চালিয়ে যেতে হবে। মুসলমান হিসাবে তথাকথিত মুসলিম উম্মার সাহায্য সহযোগীতা আশা করা হবে নেহায়েত বোকামি। তার কিছুটা হলেও লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের বাকি মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা হতে। বাকি বিশ্বের কথা বাদ দিয়ে নিজ ঘরের দিকেই দৃষ্টি ফেরাতে পারে বাংলাদেশের জনগণ। দেশটার ভাড়াটিয়া খুনি বাহিনী র‍্যাব প্রধান সদম্ভে ঘোষণা দিয়েছেন কাশ্মীর প্রশ্নে যারা ভারতের বিরোধীতা করবে তাদের একচুল ছাড় দেয়া হবেনা। স্বদেশীয় এই জল্লাদের আস্ফালন এটাই প্রমাণ করে হরি সিং’রা মরে না… ওরা বার বার ফিরে আসে… ফিরে আসে ভিন্ন নামে… ভিন্ন চেহারায়।

ফিলিস্তিনিদের গল্প

বিশেষ কোন প্লান না থাকায় দিনটা হোটেলে বসে কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছা ছিল। তাই রাতে সকাল সকাল বিছানায় যাওয়ার ইচ্ছাটাও উঠিয়ে রাখতে হল। প্যালেস্টাইনে একদিনের ঝটিকা সফরে এমনি ছিলাম ক্লান্ত, তার উপর দুদিন আগে ইসরায়েলিরা ওয়েস্টার্ন ওয়াল বরাবর ফিলিস্তিনিদের শতাধিক বাড়িঘর গুড়িয়ে দেয়ায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠার সম্ভাবনা ছিল। পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে পা রাখতেই বাতাসে এর গন্ধ পাওয়া গেল। ট্যুর গাইড, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, বাস ড্রাইভার সহ অনেকেই এমন একটা সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিল না। রামাল্লার মূল রাস্তা ধরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। উদ্দেশ্য খুব কাছ হতে ফিলিস্তিনিদের জীবনকে অনুভব করা। ট্যুর গাইড শহরের একটা গোল চত্বরে এসে ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাঁড়াল। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালো এই এখান হতেই শুরু হয়েছিল তাদের বিদ্রোহের গল্প। ফিলিস্তিনিদের ইন্তিফাদা।

রামাল্লা হতে জেরিকো চল্লিশ মিনিটের বাস জার্নি। ছোট মিনিবাস ধরলে আরও আগে পৌঁছানো যায়। এগার হাজার বছর পুরানো এ শহরকে বলা হয় পৃথিবীর সবচাইতে বয়স্ক শহর এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে সবচাইতে নীচে। মধ্য দুপুরে শহরের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী ছুঁইছুঁই করছিল। শহরের আঠার হাজার বাসিন্দাদের বলতে গেলে কাউকেই বাইরে দেখা গেলনা। ট্যুর গাইড জানালো এটাই শহরের জীবন! দিনে সাধারণত কেউ বের হয়না। সন্ধ্যা নামতেই শহরের বাজার বন্দর, ক্লাব, রেস্তোরা সব জেগে উঠে, রাস্তায় কিলবিল করে মানুষ। শহরের ভূতুড়ে রাস্তা ধরে কম করে হলেও পাঁচ কিলোমিটার হাটতে হল গাইডের কারণে। সামনে ভাল একটা রেস্তোরা আছে, এমন লোভ দেখিয়ে আমাকে সে টেনে আনল শহরের কেন্দ্রে। খা খা করছে বিশাল রেস্তোরাটা। খদ্দেরের কোন চিহ্ন নেই। কিন্তু রান্নাঘরের ব্যস্ততায় কোন কমতি নেই। গ্রিলে মুরগী ও আস্ত ভেড়া পোড়ানো হচ্ছে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে বিয়ে বাড়ির মেহমানদারীর প্রস্তুতি চলছে। ট্যুর গাইড জানাল সুর্যাস্তের পর রেস্তোরার চেহারা বদলে যাবে। সহজে সীট পাওয়া যায় না এখানে। খোদ ইয়াসির আরাফাতও এ শহরে বেড়াতে এলে এ রেস্তোরায় ঢুঁ মারতেন। দশজনের লম্বা টেবিলে আমাদের দুজনকে বসানো হল। মেনুর ছবি দেখে আমিই লাঞ্চের অর্ডার দিলাম।

রেস্তোরা হতে বের হয়ে আরও আধাঘণ্টা হাঁটতে হল বেথেলহামগামী বাস ধরার জন্যে। তাপমাত্রা তখনো ঊর্ধ্বগামী। কম করে হলেও ৫২ ডিগ্রী। আমি ঘামছি। বোতলের পর বোতল পানি খাচ্ছি আর হাঁটছি। এ শহর খ্রিষ্টানদেরও ঐতিহাসিক জায়গা। শহরকে ঘিরে জড়িয়ে আছে যীশু খ্রিষ্টের অনেক স্মৃতি। উত্তপ্ত মরু শহরে হাঁটছি আর শুনছি ট্যুর গাইডের বর্ণনা। এক মিনিটের জন্যেও সে ভুলে যায়নি তার কর্তব্য।

বেথেলহাম পৌছতে সূর্যের তাপ অনেকটাই কমে এলো। তাছাড়া উচ্চতাও বেড়েছে। হাল্কা মৃদু বাতাস স্বাগত জানালো যীশু খৃষ্টের জন্মভূমিতে। ন্যাটিভিট চার্চ ঘুরে আসার পর ফিলিস্তিনি একটা পরিবারের সাথে অনেকক্ষণ সময় কাটানো হল অনেকটা বাধ্য হয়ে। হাঁটার জন্যে যে শক্তি প্রয়োজন তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট ছিলনা। বাড়ির বারান্দায় লম্বা একটা সোফার উপর কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নিলাম।

চোখ মেলতেই মনে হল অন্ধকার নামছে পশ্চিম তীরে। পাহাড় গুলোর চূড়া আর দেখা যাচ্ছেনা। মানুষও মনে হয় লম্বা একটা দিনের পর জেগে উঠছে। এবার ফেরার পালা। পথে হেবরন শহরে কিছুক্ষণের যাত্রা বিরতি। ট্যুর গাইডই উপদেশ দিল, জেরুজালেমে ফিরে আমি যেন মুসলিম কোয়ার্টার ছেড়ে ইহুদি কোয়ার্টারে চলে যাই। ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় নামলে লম্বা সময়ের জন্য দামেস্ক গেইট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন ওখান হতে বেরুনো খুব একটা সহজ হবেনা। কিন্তু আমার ইচ্ছা করছিলোনা হঠাৎ করে এভাবে পালানোর। বরং ইচ্ছা করছিল খুব কাছ হতে দেখি ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ। কে জানে, হয়ত এ বিদ্রোহ হতেই শুরু হতে পারে নতুন এক ইন্তিফাদা।

ভোর ৩টার দিকে ঘুমাতে গেলাম। ইচ্ছা ছিল দশটার দিকে উঠে নাস্তা সেরে দামেস্ক গেটের সিঁড়িতে বসে চারদিকের জেরুজালেমকে দেখবো। কোথাও গোলমাল বাধলে ওখানেও যাবো। খুব কাছ হতে কিছু ছবি তুলবো।

ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরে আযানের সুরে। হয়ত পাশের আল আকসা মসজিদ হয়ে ভেসে আসা আযান। জানালার পর্দা খুলে জেরুজালেমের আকাশকে দেখার চেষ্টা করলাম। ভোর হয় হয় করছে। রাস্তায় কিছু বেওয়ারিশ কুকুর এদিক ওদিক হাটতে শুরু করেছে। পাশের বাড়িঘর হতে এক ঝাঁক পায়রা উড়ে গেল আকাশে। কে জানে, হয়ত ওরা উড়ে গেছে পশ্চিম তীরের শহর হেবরন, রামাল্লা অথবা বেথেলহেমে।

– চলবে

এবার আসি আসল কথায়

আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন এই ছবির মাজেজা কি, উত্তরে আমি বলব একদল অতিলোভী মানব সন্তানদের বেঁচে থাকার অদম্য চেষ্টা মাত্র। আমার মত এঁটেল মাটির মগজ সর্বস্ব মানুষ যদি বুঝতে পারে ডেঙ্গু নিধন এ পথে সম্ভব হবেনা, তাহলে দুধালো চেহারায় এইসব আদমদেরও জানা থাকার কথা সত্যটা কি। জেনেও তারা রাস্তায় নেমেছে। সেজেগুজে হাতে ঝাড়ু নিয়েছে। ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়েছে। অন্যএক ছবিতে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নাকে ফিল্টার লাগিয়ে একই কাজ করছেন অনেকটা উৎসবের আমজে। আপনি হয়ত উপলদ্ধি না করতে পারেন, কিন্তু অনেকের জন্যে ডেঙ্গু মহামারী আসলেই এখন উৎসব। সুযোগের সদ্বব্যবহার করার মোক্ষম প্লাটফর্ম।

এবার আসি আসল কথায়।

এই ছবি, এই ঝাড়ু, এই সাজগোজের মাজেজা একটাই… জায়গা মত ম্যাসেজ পাঠানো। অন্তরের অন্তস্থল হতে ওরা চাইছে তিনি দেখুক। এবং মনে রাখুক। এই মনে রাখাই একদিন ভাগ্যলক্ষ্মী হয়ে ফিরে আসবে। এই ঝাড়ুই নিশ্চিত করতে পারে সংরক্ষিত আসনের জিয়ন কাঁঠি, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দেয়ার টিকেট। নিশ্চিত করতে পারে একুশের পদক, নিশ্চিত করতে পারে বাড়ির গৃহপারিচারিকা নির্যাতনের ফ্রী লাইসেন্স, অথবা আসুখে বিসুখে আবাবিল পাখি বনে এয়ার এম্বুলেন্স উড়ে আসার গ্যারান্টি। উন্নয়নের মহাসড়কে শামিল হতে তেনার শুভদৃষ্টি এখন ম্যান্ডেটরি। তাই দেশের গোটা সুযোগ সন্ধানীর দল পথ খুঁজছে তেনার মনোরঞ্জনের। পতিতার দল যেভাবে সেজেগুজে রাস্তায় অথবা নিজের ঢেরায় খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকে, তেমনি ওরাও অপেক্ষায় আছে একজনের। কারণ বাংলাদেশ মানেই তিনি। তিনি মা, তিনিই বাবা, তিনিই পুলিশ, তিনিই আইন, তিনিই আদালত, তিনিই বিচারক। নব্য এসব পতিতাদের নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। আছে একরাশ করুণা। কারণ পতিতা রাজ্যে সব পতিতাই খদ্দের খুঁজে পায়না। দিনশেষে কাউকে না কাউকে হতাশ হয়ে ঘরে ফিরতে হয়।

… মি গর্বাচেভ, টিয়ার ডাউন দ্যাট ওয়াল

ঐতিহাসিক বার্লিন ওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমার কোন ছবি তোলা হয়নি। তবে ঐ দেয়ালটা আমি বহুবার অতিক্রম করেছে। কম করে হলেও ২০ বার। অধিকাংশ সময় পায়ে হেটে, দু’একবার ট্রেনে চড়ে। ঐ দেয়ালেরও একটা ইতিহাস আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন তখনো দাউ দাউ করছে জ্বলছে গোটা ইউরোপ জুড়ে। মিত্র বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমনে ছোট হয়ে আসছিল হিটলারের পৃথিবী। পূর্ব হতে সোভিয়েতরা পশ্চিম হতে মিত্র বাহিনীর মার্কিন ও বৃটিশ অংশ। ১৯৪৫ সাল। হিটলার ম্যাডনেস হতে মুক্ত হয়েছে গোটা বিশ্ব। পোস্টড্যাম চুক্তির আওতায় জার্মানির দখল নেয় মিত্র বাহিনী। লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরী করা হয় কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স নিয়ন্ত্রণ করবে জার্মানী, আনটিল সবার কাছে গ্রহনযোগ্য একটা জার্মান ফরমূলা তৈরী হবে। ১৯৩৭ সালের জার্মান টেরিটরিকে আনফিসিয়ালি আওতাভুক্ত করা হয় পূর্ব জার্মানীতে, যার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সোভিয়েতদের হাতে। বাকি অংশ চারভাগে বিভক্ত করে মিত্র বাহিনীর চার দেশের উপর ন্যস্ত করা হয়। বার্লিনকে আনা হয় এই বিভক্তির আওতায়। চারদিকে পূর্ব জার্মানী, মাঝখানে বার্লিন শহর চারভাগে বিভক্ত। এভাবেই জন্ম নেয় দুই বার্লিনের; পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিন। সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানীর নিয়ন্ত্রণাধীন পূর্ব বার্লিন হতে দলে দলে মানুষ পালাতে শুরু করে ইঙ্গ-মার্কিন নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম বার্লিনে। ১৯৬১ সালে পূর্ব জার্মান সরকার বাধ্য হয় ঐতিহাসিক বার্লিন দেয়াল নির্মাণ করতে। উদ্দেশ্য তার নাগরিকদের পালানো রোধ।

গর্বাচেভের পেরেস্ত্রইকা ও গ্লাসনস্ত বদলে দিয়েছিল ইউরোপের মানচিত্র। খসে পড়তে শুরু করে ওয়ারশ প্যাক্ট অর্ন্তভুক্ত সোভিয়েত এলায়েন্স। খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে জন্ম নেয় পনেরটি দেশের। বার্লিন ওয়াল, যাকে ‘জার্মানরা ওয়াল অব সেইম’ হিসাবে বিবেচনা করত ১৯৮৯ সালে শুরু হয় এর ডেমোলিশন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন গর্বাচেভকে আহবান জানিয়েছিলেন, ‘মি গর্বাচেভ, টিয়ার ডাউন দ্যাট ওয়াল’। সে দেয়াল আজ ঠাঁই নিয়েছে যাদুঘরে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের মূল ভিক্টিম ছিল ইহুদিরা। ইউরোপের দেশে দেশে প্রায় ১ কোটির মত ইহুদিকে হত্যা করেছিল হিটলার বাহিনী। গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা ছিল এর অর্ন্তভুক্ত। এই ইহুদিদের ভবিষৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষেই জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল।

জেরুজালেম পেরিয়ে পশ্চিম তীরের শহর রামাল্লায় প্রবেশের মুখেই চোখে পরবে দেয়ালটা। সলিড এন্ড এক্সট্রিমলি হাই। আমার বাসটা যখন রামাল্লায় ঢুকছিল ইসরাইলি পুলিশের কোন চাঞ্চল্য দেখা যায়নি। কিন্তু উলটো দিকের চিত্রটা ছিল ভিন্ন। লম্বা লাইন। থেমে আছে ট্রাফিক। জলপাই পোশাকের ইসরায়েলি পুলিশ হাতে অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে পরখ করছ সবার পরিচয়। পরে রামাল্লায় ঢুকে স্থানীয়দের কাছ হতে জেনেছি কেবল ইসরায়েলে জন্ম নেয়া আরবদেরই অনুমতি আছে আসা-যাওয়ার। বাকিদের অনুমতি নেই। এক কথায় অবরোধে আছে পশ্চিম তীর। হিটলারের নির্মমতা হতে যে ইহুদিদের রক্ষার জন্যে গোটা বিশ্ব এক হয়েছিল, রক্ত দিয়েছিল, প্রতিষ্ঠা করেছিল ইসরায়েল রাষ্ট্র, সে ইসরায়েল আজ হিটলারের ভূমিকায়।

মানবেতর জীবনে অভ্যস্ত প্যালেষ্টাইনিরাও আজ অপেক্ষায় আছে এমন একজনের, যে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেইগ্যানের মত বুক চেতিয়ে আহবান জানাবে,
‘হে ইসরাইল, টিয়ার ডাউন দ্যাট ফ্রিকিং ওয়াল’।