জাজাফী এর সকল পোস্ট

জাজাফী সম্পর্কে

বাংলাদেশী তরুণ লেখক,গবেষক ও এক্টিভিস্ট।

বিজ্ঞপ্তি: বই প্রকাশ বিষয়ক পোস্ট

Wh

আমার আজকের লেখাটি সেই সব নবীন, প্রবীণ লেখক, কবি বন্ধুদের উদ্দেশ্যে যারা নিজ খরচে বই প্রকাশ করতে আগ্রহী কিংবা নিয়মিত নিজ খরচে বই প্রকাশ করে থাকেন। সম্ভব হলে লেখাটি পড়বেন। ফেসবুকে আমি দেখেছি অনেক প্রকাশনী পাণ্ডুলিপি চেয়ে বিজ্ঞাপন দেয় আর কিছু জানতে চাইলেই ইনবক্সে আসুন বা যোগাযোগ করুন। তারপর যোগাযোগ করা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয় তুলে ধরে।

আমি জানি অনেক সময় নবীন এমনকি কিছু প্রবীণ লেখক তার নিজের লেখা বই প্রকাশ করতে নানা প্রকাশনীতে যোগাযোগ করে থাকেন এবং ভালো মানের প্রকাশনী ছাড়া বাকি সবাই একটাই শর্ত দেয়, সেটা হলো বই প্রকাশের যাবতীয় খরচ লেখক/কবিকেই বহন করতে হবে। আবার ভালো মানের প্রকাশনীও ক্ষেত্র বিশেষে এমনটি করে। তবে তারা ভালো পাণ্ডুলিপি পেলে নিজ খরচেও প্রকাশ করে থাকে। যেমন ভূমি প্রকাশের সাথে একবার এসব নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম বই প্রকাশে আপনাদের নীতিমালা কী? তারা আমাকে বলেছিল পাণ্ডুলিপি পছন্দ হলে তারাই সব খরচ বহন করবেন আবার পাণ্ডুলিপি পছন্দ না হলে লেখক নিজে খরচ বহন করবে।

এই যে নবীন বা প্রবীণ লেখক/কবিদের বই প্রকাশে প্রকাশকগণ লেখক কবির উপর খরচ চাপিয়ে দেন এর জন্য কিন্তু আমি তাদেরকে দোষ দিতে চাই না। কারণ আপনি কোন মানের লেখক,আপনার পাঠক সংখ্যা কত, আপনার বইয়ে লগ্নি করে লাভের বদলে লসে পড়বেন কি না সেসব বিবেচনা করে একজন প্রকাশক অবশ্যই এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটি তার ব্যবসা। এবং প্রত্যেক ব্যবসায়ী চায় তিনি লাভবান হবেন।

কিন্তু আমি দেখেছি নিজ খরচে বই প্রকাশ করতে গিয়েও লেখক, কবিরা অনেক সমস্যায় পড়ে। প্রকাশক কর্তৃক নাজেহাল হয়। সময় মত বই আসে না। বইয়ের বাইন্ডিং ঠিক থাকে না। প্রচ্ছদে সমস্যা থাকে। প্রুফ রিডারের অভাবে ভুল থাকে প্রচুর। কাগজের মান সমস্যা থাকে। আর সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো যত কপি বই প্রকাশ করার কথা ক্ষেত্র বিশেষে সেই পরিমান বই ছাপানো হয় না। যদিও লেখক/কবির কাছ থেকে সেই পরিমান বই ছাপার জন্য টাকা নেওয়া হয়ে থাকে। যেমন আমি নিজে অন্তত একজন প্রকাশককে চিনি যাকে আমি কয়েকজনের সম্মিলিত একটি গল্প সংকলন করতে দিয়েছিলাম আজ থেকে প্রায় ৮ বছর আগে। তারা ৩৫ হাজার টাকাও দিয়েছিল। কিন্তু তিনি কথা রাখেন নি। তিনি ২০০ কপি বই কম দিয়েছেন। সে অনেক কথা সেটা না হয় পরে বলবো কোনো এক সময়ে। আজকের লেখাটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে।

নিজ খরচে বই ছাপানোর পর উপরে বর্ণিত সমস্যার বাইরেও অনেক রকম সমস্যায় পড়ে থাকেন লেখক-কবিগণ। প্রথম বছর ছাপার পর সেই বইয়ের আর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না সেই প্রকাশনীতে। নিজ খরচে বই প্রকাশ করার পর সেই বইটা প্রকাশক অনেক সময় স্টলেও ঠিকমত রাখে না। যা বিক্রি হয় সেটা থেকেও লেখক কবিকে কোনো সম্মানি দেওয়া হয় না। যদিও প্রকাশককে অগ্রিম সব টাকা পরিশোধ করেই বই ছাপানো হয়েছে।

আমি জানি অনেক লেখক কবি নিজ খরচে বই ছাপার পর কখনো তা প্রকাশ করেন না যে তিনি নিজ খরচে বই প্রকাশ করেছেন। লেখক/কবিরা হয়তো মনে করেন নিজ খরচে বই করা হয়েছে এটা জানাজানি হলে তার প্রেস্টিজে লাগবে। আসলেতো তা নয়। আপনিতো চুরি করছেন না যে নিজ খরচে বই প্রকাশ করার কথাটা গোপনে রাখবেন।

এখন আসি মূল কথায়। এই যে যারা নিজ খরচে বই প্রকাশ করেন এবং অনেক রকম সমস্যার সম্মুখীন হন তাদেরকে বলতে চাই আপনারা চাইলে আমি দারুণ একটি উদ্যোগ নিতে পারি। মানে সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রকাশনী শুরু করতে পারি। যে প্রকাশনীর মালিক আমি নই বরং আপনারা সবাই। মানে যাদের বই প্রকাশ হবে তারা প্রত্যেকেই এই প্রকাশনীর মালিক। বাংলা একাডেমীর নিয়ম অনুযায়ী বই মেলায় স্টল পেতে হলে একটি প্রকাশনী থেকে যতগুলো বই প্রকাশ হওয়ার পর তারা স্টল পাবে তা আমার মতে খুব সহজেই পূরণ করা সম্ভব।

এই প্রকাশনী হবে প্রাথমিক ভাবে অলাভজনক। ব্যবসার নিমিত্তে নয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই প্রকাশনীর সব লেখক তাদের বই নিজ খরচেই প্রকাশ করবেন। প্রকাশনী বাবদ খরচ বাদে বাকি সব লেখকরাই পাবেন। যেহেতু বই প্রকাশ বাবদ সব অর্থ লেখক কবি বহন করে থাকেন তাই কোনো লেখকের এক কপি বই বিক্রি হলে তার পুরোটাই অথবা নিজেদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৭৫% বা ৮০% টাকা লেখক পাবেন। বাকি ২৫ বা ২০% ফান্ডে জমা থাকবে। সাধারণত লেখককে প্রকাশনী গুলো ১০% থেকে ২০% পর্যন্ত রয়্যালটি দিয়ে থাকে। এখানে সেরকম কিছু থাকবে না। প্রকাশনী বাবদ যত খরচ তা যেহেতু লেখক পুরোটা বহন করে থাকে তাই বিক্রি হওয়া বইয়ের শতভাগই লেখক পাবেন। আবার তিনি যদি মনে করেন প্রকাশনীতো তারও। সুতরাং প্রকাশনীর একটি ফান্ড তৈরি করতে একটি নির্দিষ্ট অংশ তিনি দিবেন সেটাও দিতে পারবেন।

এটা করলে কী হবে? আপনি ঠকবেন না। কারণ আপনার বই অন্য কোনো প্রকাশক প্রকাশ করছে না বরং আপনি নিজেই প্রকাশ করছেন। আর যে প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশ হচ্ছে সেটাও আপনার নিজের। যদি আপনার মনে হয় আপনি আমার সাথে একমত তবে আমাকে নক দিতে পারেন। আমরা একটা গ্রুপ তৈরি করতে পারি। আমরা টার্গেট করতে পারি আগামী ২০২৪ বই মেলা। কমিটি গঠন থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ এর মাঝে আমরা করতে পারি। যেহেতু প্রত্যেকে তার নিজের বইটি প্রকাশের ব্যয় বহন করবে তাই ফান্ডের সমস্যা হবে না।

যদি ১০০ জন এমনকি ৫০ জন এমন লেখক কবি এক হতে পারেন তবে অনায়াসে একটি চমৎকার প্রকাশনী দাঁড় করানো সম্ভব। একটা বিষয় ভেবে দেখুন আপনি হয়তো এর মধ্যে একাধিক বই প্রকাশ করেছেন নিজ খরচে। কিংবা আগামীতেও একাধিক বই প্রকাশ করবেন নিজ খরচে। তাহলে আমি যে পদ্ধতির কথা বললাম সেটি করলেতো আপনার ক্ষতি নেই। আপনি নিজে তত্ত্বাবধায়ন করতে পারবেন। ফাঁকি দেওয়া বা ফাঁকে পড়ার কোনো সম্ভাবনা এখানে নেই।

উল্লেখ্য যদি আপনার লেখা প্রকাশকগণ তাদের খরচে প্রকাশ করে থাকে তবে এই লেখাটি আপনার জন্য প্রযোজ্য নয়। আমি সেই সব লেখক, কবি বন্ধুদের একত্র করতে চাই যারা নিজ খরচে বই প্রকাশের কথা ভাবছেন। বই প্রকাশে এতো তাড়াহুড়ো না করে আসুন আলোচনা করি। ভিন্ন কিছু করি। উল্লেখ্য এটি কিন্তু প্রকাশকদের বিরুদ্ধে আমার কোনো আন্দোলন নয়। জাস্ট একটি ভিন্ন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

বই প্রকাশ করতে গিয়ে লেখক কবিদের বিড়ম্বনা দেখে আমার খারাপ লাগে। তাছাড়াও প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী থেকে সেরা সব লেখকদের বই প্রকাশ হওয়ায় নবীন লেখকদের বই প্রকাশ হলেও স্টলে জনপ্রিয় লেখকদের পাঠকের চাপে নবীণ লেখকদের বই আড়ালেই পড়ে থাকে। নবীন লেখকের দুই চারজন পাঠক স্টলে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। আমি জানি ওই যে শুরুতেই বলেছি নিজ খরচে বই প্রকাশ করেছি এটা জানাজানি হলে লজ্জা পাবে এটা ভেবে এখনো অনেকেই চুপ থাকবে।

.
ফেসবুক ইনবক্স: জাজাফী
৩০ জানুয়ারি ২০২৩

ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অনিয়ম বিষয়ে আমার কিছু কথা

এই মুহূর্তে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় আবুল মাল আব্দুল মুহিতের কথা বেশ মনে পড়ছে। সামনে পেলে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম। কেন ক্ষমা চাইতাম অলরেডি চিন্তাশীল বন্ধুরা বুঝতে পেরেছেন। যারা কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করার মত সময় বা ধৈর্য পান না তাদের জন্য বলছি। ক্ষমা চাইতাম কারণ তাঁর বলা একটি কথা ‍শুনে আমরা হাসাহাসি করেছিলাম। সেই যে ৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে তিনি বলেছিলেন সামান্য টাকা। তখন আমরা হাসাহাসি করেছিলাম। ছয় হাজার কোটি টাকা নাকি সামান্য টাকা! আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর নিতে নেই প্রবাদটিও আবার প্রমাণিত হলো। আমরা আদার ব্যাপারী তাই জাহাজের খবর নিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছি। আমরা নবগঙ্গা নদীর মাঝি তাই সাগরের ঢেউ বা গভীরতা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। সে কারণেই ৬ হাজার কোটি টাকাকে মাত্র বা সামান্য বলা শুনে আমরা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি তার বলা কথাটা পুরোপুরি সত্য। এই যে কয়েকটি ব্যাংক থেকে একটি মাত্র গ্রুপ ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে এটা দেখেতো তাঁর কথাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ৩০ হাজার কোটি টাকার পাশে ছয় হাজার কোটি টাকা রাখলে তা অবশ্যই সামান্য মনে হবে। এই পরিমান টাকা খরচ করে পুরো পৃথিবীকে বিনোদন দিতে বিশ্বকাপের আয়োজন করেছে কাতার!

শুনতে ৩০ হাজার কোটি টাকা খুব সহজেই শোনা গেলেও বাস্তবে এই পরিমান টাকা একসাথে রাখলে পুুরো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের মত একটা বড় বিল্ডিং ভরে যাবে। এখন কথা হলো ঘরের চালে যে টিন থাকে তাতে ছিদ্র কিন্তু একদিনে বড় হয় না। প্রথমে সুই হয়ে ঢোকে তারপর কুড়াল হয়ে বের হয় বলে যে একটা আঞ্চলিক প্রবাদ আছে ঘটনা কিন্তু সেরকম। এই যে বিরাট অংকের কারসাজি এটিতো একবারে হয়নি। হয়েছে ধীরে ধীরে এবং পরিকল্পিত ভাবে। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া ছিল তা এক অজ্ঞাত কারণে ২০২০ সালে সরিয়ে নেওয়া হয়! জাতির সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হতে পারে কেন এবং কোন যুক্তিতে পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল? যারা সরিয়ে নিয়েছিলেন তাদেরকে এর জবাব দিতে হবে। ঋণ অনিয়ম তো আজকের ঘটনা নয়। এই সন্দেহ তৈরি হয়েছিল আরও এক যুগ আগে। ঋণ অনিয়মের আশঙ্কায় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক (তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ব্যাংকটির বিভিন্ন সভায় অংশ নিতে শুরু করেন।

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেলো বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপের হাতে চলে যায়। প্রথম আলোর ভাসুর হয় বলে সম্ভবত গ্রুপের নাম উল্লেখ করা হয়নি অথবা তাদের কী এক সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী নাম উল্লেখ করেনি। তবে সবাই জানে গ্রুপটির নাম এস আলম গ্রুপ। এরপর ২০২০ সালের মার্চে ওই পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক! বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক (তৎকালীন) গভর্নর ফজলে কবির ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক রাখার পক্ষে ছিলেন না। এই তথ্যটি জেনে আমি সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছি। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনর যদি পক্ষে না থাকেন তাহলে আর কী বলার থাকে। যদিও এখনো অন্য ছয়টি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক নিযুক্ত পর্যবেক্ষক রয়েছে। তাহলে ইসলামী ব্যাংকে থাকলে দোষ কী ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। এর বাইরে নতুন করে আরও কয়েকটি ব্যাংকে সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে। এখন আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে যে মাননীয় গর্ভনর সাহেব কেন এবং কোন যুক্তিতে এর পক্ষে ছিলেন না?

মালিকানা বদলের পর ইসলামী ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন বিবেচনায় পর্যবেক্ষক সরিয়ে নিল, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ এ কথাও বলছেন এখন, অনিয়মের সুযোগ করে দিতেই ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কাগুজে কোম্পানির নামে যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটি থেকে অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আদলেই। ইসলামী ব্যাংকের সাম্প্রতিক ঋণ অনিয়মের ঘটনা সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক, বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়মের চেয়েও ভয়াবহ বলে মনে করছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকটি থেকে কী পরিমাণ অর্থ এখন পর্যন্ত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা অনুসন্ধানে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শন দল। আমার মতে শুধু ওই ব্যাংকে খতিয়ে দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত হবে না বরং গ্রুপের অন্যান্য ব্যাংকেও খোঁজ নিতে হবে পাশাপাশি সেই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা পর্ববেক্ষক সরিয়ে নিয়েছিলেন তাদের বিষয়েও খোঁজ নিতে হবে। এবং এ ক্ষেত্রে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করলে তা কতটা স্বচ্ছ হবে সেটাও ভাবার বিষয়।

ধান ভানতে শীবের গীত বলে যে প্রবাদটি আছে তাও এখানে টেনে আনতে চাই। এই যে খাস বাংলায় বাঁশ খাওয়া বলে যে একটা কথা প্রচলিত আছে আমরা নানা ক্ষেত্রে তা দেখতে পাই। ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে কথাটা কিছুটা প্রযোজ্য কারণ বাঁশখালী,পটিয়া,সাতকানিয়া নামে এলাকাও যে এর সাথে কিছু অংশে যুক্ত। যাদের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হওয়ার যোগ্যতা নেই তারাও বাঁশখালী ও এর আশেপাশের লোক হওয়ায় অনায়াসে ব্যাংকার বনে গেছে। শুধু তাই নয় যতটা জেনেছি তাতে বুঝেছি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় নিজস্ব লোক রাখা আছে এটা মনিটর করার জন্য যে কেউ যেন গ্রুপের বিষয়ে কিছু বললে তা উপর মহলকে জানানো যায়। চাকরি দেওয়ার সময় যোগ্যতা বিবেচনা না করে বাঁশখালী বা নির্দিষ্ট এলাকা বিবেচনা করে চাকরি দেওয়াটাও ব্যাংকের জন্য কাল হয়েছে। ক্ষমা চাইছি নানা ক্ষেত্রে চতুর্থ শ্রেণীর চাকরি যারা করেন তাদের কাছে এবং পটিয়া,সাতকানিয়া, বাঁশখালীর অন্যদের কাছে। আমি তাদেরকে ছোট করতে চাইনি।

সাতকানিয়া,পটিয়া এবং বাঁশখালী এলাকার যত সংখ্যক মানুষ গ্রুপের ব্যাংকে আছে তার বিশ ভাগের একভাগ লোকও অন্যান্য পঞ্চাশটি ব্যাংকে নেই যাদের বাড়ি ওই এলাকায়। যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি না দিয়ে এলাকাভিত্তিক এবং নিজেদের ফায়দা লুটে নেওয়ার জন্য কিছু মানুষকে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে যে কোনো প্রতিষ্ঠান ধ্বসে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে আপনাকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া মানেই আপনার মুখ বন্ধ রেখে আপনাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নেওয়া। হয়েছেও তাই। একটি লোনের আবেদন থেকে শুরু করে পাশ হয়ে গ্রাহকের হাত অব্দি যাওয়া পর্যন্ত কী পরিমান প্রসিডিউর ফলো করতে হয় তা আমি ব্যক্তিগত লোন নিতে গিয়ে দেখেছি এবং স্টাডি করে দেখেছি বড় লোনগুলো আরও কতটা জটিল। এই যে ফিল্টারিং হয় বা স্তরে স্তরে ব্যারিকেড পার হয়ে একটি লোন পাশ হয়। কোথাও না কোথাও ঘাপলা ধরা পড়বেই। কিন্তু প্রতিটি চেক পোস্টে বাংলা সিনেমার মত যদি নিজস্ব চামচা বা পা-চাটা লোক থাকে তবে আপনাকে কোনো চেকপোস্টেই আটকানো হবে না। আপনি অনায়াসেই পার হয়ে যেতে পারবেন। ব্যাড লোনগুলোর ক্ষেত্রে বিষয়টা এমনই ঘটে। আর যখন ক্ষমতাধরদের অন্যায় কেউ আপস করতে রাজি হয় না তখন তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। যার নজির অহরহ।

আবার ফিরে আসি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে।এদিকে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখলাম ইসলামী ব্যাংক থেকে কেন পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তার যথাযথ কোনো উত্তর দিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো মন্তব্য না করার নীতি নিয়েছে। সংস্থাটির মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদের কাছে গতকাল সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক নিয়ে কোনো মন্তব্য করবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেওয়ার পর ব্যাংকটি থেকে কাগুজে কোম্পানি খুলে অর্থ বের করা শুরু হয়। প্রথমে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে এই অনিয়ম শুরু হয়। ফলে পাঁচ বছরে এই শাখার ঋণ ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বের হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা।

চট্টগ্রামে ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকলে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শাখা থেকে একই প্রক্রিয়ায় টাকা বের করা হয়। আর ২০১৭ সাল থেকে খাতুনগঞ্জ শাখার দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের ঋণসংক্রান্ত বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

পাশাপাশি দ্রুত পদোন্নতি পাওয়া প্রধান কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তাও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। এভাবে ২০ থেকে ৩০ কর্মকর্তা মিলে ব্যাংকটিতে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। আর ব্যাংকটির পরিচালকেরা বেশির ভাগ একটি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হওয়ায় তারাও এতে সমর্থন দেয়।

ব্যাংকটির ঋণের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কাগুজে কোম্পানিগুলোর নামে সর্বোচ্চ ঋণের পরিমাণ ছিল দেড় হাজার কোটি টাকার কিছু কম। কারণ, ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণমূলক মূলধন ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এর ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ১ হাজার ৫০৪ কোটি ঋণ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। আর ওই পরিমাণের কম ঋণ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার দরকার হয় না। তাই কাগুজে কোম্পানিগুলোর ঋণের পরিমাণ ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

সাম্প্রতিক একটি ঘটনা উল্লেখ করি। আমার ফেসবুক বন্ধু নুরুল আবসার ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন যার শিরোনাম ছিল “শেষ পযর্ন্ত ইসলামী ব্যাংকেও খেয়ে দিতে হলো”? আমি সেখানে মন্তব্য করেছিলাম এটা কি আজকের ঘটনা? যবে থেকে এস আলম গ্রুপের হাতে গেছে ব্যাংক তবে থেকেই সমস্যা শুরু হয়েছে। এখন আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই এমন এক ভদ্রলোক আমাকে মেসেজ দিয়ে জানতে চেয়েছেন “এস আলম গ্রুপ আপনার কোনো ক্ষতি করেছে?” দেখলাম ভদ্রলোক অফিসার হিসেবে ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত আছেন। আমি বললাম তর্ক করতে চাই না। পত্র পত্রিকায়তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমি যদিও তার সাথে তর্ক করতে তো চাইনি তবে আমি একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে এবং চিন্তক হিসেবে আমার মতামত নিশ্চই বলতে পারি। তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমার কোনো ক্ষতি করেছে কি না। আমার স্পষ্ট জবাব আমার কোনো ক্ষতি করেনি। কিন্তু ক্ষতি করেছে পুরো দেশের,পুরো জাতির! আর সেই জাতির একজনতো আমিও। সুতরাং আমারওতো ক্ষতি করেছে বলতে হয়। কিভাবে করেছে তা নিশ্চই বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। তবুও অল্প কথায় বলি। আর্থিক এই বিরাট অনিয়মের কারণে দেশের মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে এবং দেশের অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উপর প্রেসার বেড়েছে। তাদের মর্যাদাও নষ্ট হচ্ছে। রেপুটেশন খারাপ হচ্ছে। জনমনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে যে সব ব্যাংক এভাবে দেউলিয়া হয়ে যাবে বা গ্রাহকের টাকা হারিয়ে যাবে। এ বিষয়ে আপনারা নিশ্চই জানেন যে কিছুদিন আগেও এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়ে সার্কুলার জারি করে কিছুটা সামাল দিয়েছে। পাশাপাশি আমি দেখেছি আমার লিস্টের ব্যাংকার বন্ধুরাও তাদের টাইমলাইনে সেটা পোস্ট করে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে।

একটি প্রতিষ্ঠানের এই ধরনের নয়ছয় বা খামখেয়ালিতো শুধু ওই প্রতিষ্ঠানকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয় না বরং একই ঘরানার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং পুরো জাতিকেই বিব্রত করে। পুরো জাতির ক্ষতি করে। শুধু তাই নয় হয়তো দেখা যাবে অনেক ব্যক্তির নামেও দুই চার কোটি টাকার লোন হয়ে আছে কিন্তু সে জানেই না! যারা নামে বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে হাজার কোটি টাকা নিয়ে নেয় তারা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কারো ছবি আর নাম ব্যবহার করে দুই চার কোটি নিতে পারে না বা নেয়নি তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। যদি এমন হয়ে থাকে তবে আল্লাহ ভালো জানেন কতজনের কপাল পুড়বে। ধরুন যে অফিসারটি ৬০ হাজার বা এক লাখ টাকা বেতন পান এবং একমাত্র আয়ের মাধ্যম তার ওই বেতন তার নামে দুই চার কোটি টাকা লোন পাশ হয়ে গেছে কিন্তু সে জানেই না। তাহলে পরে যদি এটা সে জানতে পারে তার কি সাধ্য আছে সেটা শোধ করার? আমরা দেখেছি ২০/৩০ হাজার টাকা লোন নিয়ে পরিশোধ করতে পারেনি বলে কত কৃষকের কোমরে দড়ি (রুপক অর্থে অথবা বাস্তবে) বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ রাঘববোয়ালরা সব সময় অধরাই থেকে গেছে। যখন যোগ্য ও মেধাবীদের বদলে অযোগ্য আর সুবিধাবাদীদের নিয়োগ দেওয়া হয় বা দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন ফলাফল ভালো হয় না। সেটা ক্রিকেট খেলা হোক, ফুটবল খেলা হোক, রাজনৈতিক দল হোক বা কোনো চাকরি হোক। সবক্ষেত্রেই অযোগ্যদের দায়িত্ব দিলে সর্বনাশই হয়। আর একদল মানুষ চায় ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বা দেশের ক্ষতি হয় হোক আমার ক্ষতি না হলেই হলো। আর তাইতো কিছু মানুষ লুটেপুটে সুইস ব্যাংক বোঝাই করে। বলির পাঠা হয় দেশ এবং দেশের আপামর খেটে খাওয়া মানুষ। দুর্নামের ভাগিদার হয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। সন্দেহ মাথায় নিয়ে সংসার করতে হয়। উল্লেখ্য এই সব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের সনদ চেক করলে অনেক জাল সনদও পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। কারণ এর আগে যতদূর জানি ইউনিয়ন ব্যাংকে এমন জাল সনদধারীদের ২৭ জনের চাকরি গিয়েছিল। ইউনিয়ন ব্যাংকের যে ঘটনাটি উল্লেখ করলাম তার তথ্যসূত্র আমার কাছে নেই।

লেখকঃ জাজাফী
১ ডিসেম্বর ২০২২

আমি কেন এ আইনের পক্ষে

নিজের গাছ (বড় সাইজ) কাটতেও সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এ মর্মে একটি নিউজ আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন। “বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন আইন ২০২১” এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আইন অনুযায়ি নিজের বাগানের গাছ কাটতেও সরকারের অনুমতি লাগবে।
এই সংবাদে বিস্মিত হয়েছেন সিংহভাগ মানুষ। তবে আমি কিন্তু কম বুঝলেও এই আইনের পক্ষে অবস্থান করছি যদি আইনটাকে হাত করে অসাধুরা সম্রাট নবম হালাকু খা সেজে না বসে। মানে এই আইনকে পুজি করে যেন কর্তৃপক্ষ চাঁদাবাজি করতে না পারে।

#আমি কেন এ আইনের পক্ষে?

বৃক্ষ নিধন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আমরা যে হারে গাছ কাটি সেই হারে লাগাই না। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়ছে, পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, উত্তর মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে পৃথিবী ক্রমাগত ভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ,মালদ্বীপ সেই তালিকায় প্রথম দিকে থাকছে। এ থেকে রক্ষার জন্য অবশ্যই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার নিমিত্তে বৃক্ষনিধন যে কোনো ভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে। নিজের গাছ কাটার আগে সরকারের অনুমতি নেওয়ার বিষয়টি তাই এক দিক থেকে ইতিবাচক।

এটুকু শুনেই ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। বাকিটুকু শুনুন। একজন মানুষ গাছ কেন কাটে? নিশ্চয়ই এর পিছনে কয়েকটি যুক্তি আছে। প্রথমত তার অর্থের প্রয়োজন তাই সে গাছ কাটে, দ্বিতীয়ত তার ফার্নিচার বানানো দরকার ফলে গাছ কাটে। তৃতীয়ত সে ওই স্থানে এমন একটি স্থাপনা নির্মাণ করতে চায় যা ওই গাছ থাকায় সম্ভব নয়। এখন সে গাছ কাটার আগে সরকারের অনুমতি নিতে গেলে সরকার যদি সত্যি সত্যি তার গাছ কাটার মূল কারণ খুঁজে বের করে এবং সেটা নিজ উদ্যোগে সমাধান করে দেয় তবে একই সাথে তার সমস্যাও সমাধান হবে আবার গাছটাও রক্ষা পাবে। তার অর্থের প্রয়োজন হলে সরকার তাকে লোন দিবে, ফার্নিচার কেনার দরকার হলে সে ক্ষেত্রেও সরকার লোন দিবে। স্থাপনা নির্মাণের দরকার হলে ডিজাইনাররা এমন ভাবে ইকো ফ্রেন্ডলি ডিজাইন করে দিবে যেন ওই গাছ না কেটেও স্থাপনা নির্মাণ করা সম্ভব হয়। বিশ্বের অনেক স্থানেই এমন আছে যা আপনি গুগলে সার্চ দিলেই দেখতে পাবেন।

কথা এখনেই শেষ নয়। আমি জানি আপনাদের মনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জেগেছে তা হলো কারো ব্যক্তিগত গাছ কাটায় হস্তক্ষেপ করার আগে সরকারী বনাঞ্চল এবং অন্যান্য স্থান থেকে ব্যপক হারে যেভাবে গাছ কাটা হয় সেগুলো আগে বন্ধ করা উচিত। আপনাদের এই ভাবনার সাথে আমিও একমত। এসব যদি সঠিক ভাবে পালন করা যায় এবং যাকে আপনি নিয়মের বেড়াজালে বাঁধতে চান তার সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন (শুধু মুখে দিলেই হবে না বরং তা বাস্তবায়ন করতে হবে) তাহলে ব্যক্তিগত গাছ কাটার আগে সরকারের অনুমতি নিতে বোধহয় একজনও দ্বিমত হবে না।

যারা এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছেন আমি জানিনা তারা এসব দিক চিন্তা করেছেন কি না। যদি না করে থাকেন তবে আমি তাদের বলবো এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে। আর যদি এসব বিষয়ে সুরাহা সহ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবেই কেবল আমি এই মতের পক্ষে থাকবো।

এর বাইরে আরও কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত গাছ থাকাই যথেষ্ট নয় বরং পাশাপাশি আরও নানা বিষয়ে নজর দিতে হবে। পাতিলে ছিদ্র রেখে পানি যতই ঢালুন পাতিল একসময় খালি হবেই। আপনি যতই গাছ লাগান যদি কলকারখানাকে ইকো ফ্রেন্ডলি না করেন, যানবাহনকে ইকো ফ্রেন্ডলি না করেন তবে কিছুতেই কিছু হবে না।

হুট করে যে কোনো কিছুতে আইন করা শোভনীয় নয় বরং তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা দরকার। আলোচনা হওয়া দরকার। অভিজ্ঞদের মতামত নেওয়া দরকার। এই যেমন এই সিদ্ধান্ত যারা নিলেন এবং যারা এটিকে পাশ করতে চলেছেন তারা কি একবারও আমাদের মতামত নিয়েছেন? একবারও আমাদের সাথে আলোচনা করেছেন? করেননি। হুট করে নিজেদের যখন যা খুশি তাই করে বসেন। যে সব বিষয়ের সাথে সমাজ, পরিবেশ, সাধারণ মানুষের হক ও অধিকার যুক্ত সে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই জনমত জরিপ আবশ্যক এবং পাশাপাশি বিজ্ঞদের পরামর্শ যেমন জরুরী তেমনি গবেষণাও জরুরী। প্রবাদে আছে উঠলো বাই চললো বু দরগার যাই হলে চলবে না। হুটহাট নিয়ম আইন হিতে বিপরীত হয়। আপনারা ঠ্যালা তো সামলান নি তাই বুঝবেন না।

#আমার_কিছু_বলার_আছে

জাজাফী

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

মামলা

লেখকঃ জাজাফী

আহসান সাহেবের বাসা টিকাটুলির শাহ সাহেব লেনে।গায়ে কালো গাউন জড়িয়ে রোজ যখন তিনি বাসা থেকে বের হন তখন একটি ছেলে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।ছেলেটির বয়স বারো বছরের বেশি হবে বলে মনে হয়না।গায়ে নোংরা পোশাক,মাথার চুল এলোমেলা।দেখেই বুঝা যায় রাস্তার মানুষ সে।আহসান সাহেবের তাড়া থাকায় কখনো ছেলেটিকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি ওর নাম কি, কোথায় থাকে, কি করে।তবে ছেলেটি যে টোকাই শ্রেণীর কেউ তা তিনি খুব সহজেই অনুমান করতে পারেন।হাতে একটা বস্তা থাকেই সারাক্ষণ।নিশ্চই সে ওটাতে কুড়িয়ে পাওয়া বোতল এটা সেটা রাখে।আহসান সাহেব মনে মনে ভাবেন কোন এক ছুটির দিনে নিশ্চই সময় করে ছেলেটার সাথে কথা বলবেন।যাওয়া আসার সময় দূর থেকে ছেলেটি তাকে এমন ভাবে কেন দেখে সেটাও জানার খুব আগ্রহ।

সেদিন হঠাৎ সব বদলে গেল।তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা নিবেন বলে অপেক্ষা করছেন এমন সময় ছেলেটি গুটিগুটি পায়ে তার সামনে এসে দাড়ালো।এই প্রথম খুব কাছ থেকে ওকে দেখলেন আহসান সাহেব।যতটা ময়লা মনে হয়েছিল তার থেকেও বেশি ময়লা মনে হলো তবে ওর ভিতরে যে উজ্জল একটি মানুষ লুকিয়ে আছে তাও টের পাওয়া যাচ্ছে।শুধুমাত্র যত্নের অভাবে সেই ঔজ্জল্য দেখা যাচ্ছেনা।ছেলেটি সামনে আসতেই আহসান সাহেব জানতে চাইলেন তোর নাম কিরে?আহসান সাহেব খুব অবাক হয়ে দেখলেন ছেলেটি কোন উত্তর দিলো না।ওর কপালের রেখায় রাগ রাগ ভাব ফুটে উঠেছে।আহসান সাহেব কিছুটা আহত হলেন কিছুটা বিরক্তও হলেন।আবার জানতে চাইলেন কিরে কথা বলিসনা কেন?তোর নাম কি?ছেলেটি উত্তর না দিয়ে হনহন করে চলে গেল।তিনি অবাক হলেন ঠিকই আবার ভাবলেন হতে পারে ছেলেটি কথাই বলতে পারেনা।একটা রিকশা তখন টুংটাং শব্দ করে ওদিক দিয়েই যাচ্ছিল আহসান সাহেব হাত নেড়ে সেটাকে থামালেন তার পর গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন।

দিন শেষে ঘরে ফেরার পথে সেই ছেলেটির সাথে আবার দেখা হলো।সকালে প্রশ্ন করে কোন উত্তর না পেয়ে তাই আহসান সাহেব আর আগ্রহ দেখালেন না।তবে তিনি দেখলেন ছেলেটি এগিয়ে আসছে।কাছে এসে জানতে চাইলো আপনার ছেলে মেয়েকে আপনি কিভাবে ডাকেন?তুমি করে না তুই তুই করে?আহসান সাহেব বললেন অবশ্যই তুমি করে ডাকি।তুই তুই করে ডাকাটা কেমন যেন অসভ্যতামী।ময়লা জামার ছেলেটি বললো আপনার নিজের ছেলে মেয়েকে আপনি তুই বলতে পারেন না, সেটাকে অসভ্যতামী মনে করেন, তাহলে আমাকে কেন তুই তুই করে সম্মোধন করেছিলেন ?আমাকে তুই তুই করে বললে সেটা কি অসভ্যতামী হয় না?

আহসান সাহেব ভীষণরকম শক খেলেন।তিনি কখনোই বিষয়টি এভাবে ভেবে দেখেননি।সত্যিইতো নিজের ছেলে মেয়েকে যদি তুইতোকারি করাটা অসভ্যতামী মনে হয় তাহলে অন্য একটা ছেলেকে একটা মেয়েকে কি করে তুইতোকারি করি ভেবে তিনি কিছুটা লজ্জাও পেলেন।তিনি অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ বিধায় নিজের ভুল সাথে সাথে বুঝতে পেরে ভাবলেন ছোট হোক বড় হোক তাতে কি ক্ষমা চাইতোতো মানসম্মান চলে যাবেনা।নিজের ভুলটুকু না হয় স্বীকার করে নিবেন।এই ভেবে তিনি যখন ওর দিকে চোখ ফেরালেন তখন দেখলেন ছেলেটি নেই।আসলে ছেলেটির চমকপ্রদ কথা শুনে তিনি এতোটাই চমকে গিয়েছিলেন যে ভাবনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিলেন।সম্বিত ফিরে পেতেই দেখলেন ছেলেটি ততোক্ষণে কোথাও চলে গেছে।

রাতে খাবার টেবিলে বসে পরিবারের সবার সাথে ঘটনাটি শেয়ার করলেন।শুনে অন্যরাও খুব বিমোহিত হলো।এমন করেতো কখনো ভেবে দেখা হয়নি।কেন একটি ছেলেকে একটি মেয়েকে তুইতোকারি করা হবে?তার সাথে যদি এমন মধুর কোন সম্পর্ক থাকতো যার টানে তাতে তুই তুই করে বলা যেত তাহলে কোন কথাই ছিলনা কিন্তু আমরা হরহামেশাই রাস্তায় টোকাই ছেলে মেয়েগুলোকে ফুলওয়ালা বাদামওয়ালা ছেলে মেয়েদেরকে তুই তোকারি করি।ঘরের কাজের ছেলে মেয়েদেরকে তুই তোকারী করি।সবাই যখন এসব নিয়ে গল্প করছিল তখন পাশে দাড়িয়ে ছিল ঝুনু।আহসান সাহেবের বাসার কাজের মেয়ে।আহসান সাহেব বললেন ঝুনু তুমি কিচেন থেকে একটা কাচা মরিচ নিয়ে আসোতো। আহসান সাহেব কথা শেষ করতেই বাকিদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।তিনি যাকে রোজ তুই তুই করে সম্বোধন করতেন আজ তাকে তুমি করে বলছেন।ঝুনুরও খুব ভালো লেগেছে।তারও নিশ্চই ইচ্ছে করতো তাকে যেন অন্যদের মত তুমি তুমি করে বলা হয়।

আইন পেশায় জড়িত আহসান সাহেব উকিল হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন তার সততা আর নিষ্ঠার কারণে।তিনি কোন মামলা হাতে নিয়ে যদি যাচাইবাছাই করতে গিয়ে দেখেন তার মক্কেলেরই দোষ তাহলে তিনি সেই মামলা নিয়ে আইনি লড়াই করতে রাজি হন না।যদিও তার মত উকিলের পক্ষে ওই মামলায় জেতাটা খুবই সামান্য ব্যপার কিন্তু তিনি কখনোই চাননা অন্যায়কে ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করতে।আহসান সাহেব ঘুমোতে যাবার আগে ভাবলেন কালকে যদি ছেলেটির সাথে দেখা হয় তাহলে ওর সাথে সুন্দর করে কথা বলবেন এবং দুঃখ প্রকাশ করবেন।পরদিন কোর্টে যাওয়ার পথে তিনি ছেলেটিকে দেখতে পেলেন না এমনকি ফেরার পথেও দেখতে পেলেন না।মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

পথের একটি শিশুর জন্য তার মন খারাপ হচ্ছে জানলে হয়তো অনেকেই হাশিতামাশা করবে কিন্তু তিনি তাতে পরোয়া করেন না।তিনি মনে করেন ভুল হলে দুঃখপ্রকাশ করাটাই উত্তম এবং দুঃখ প্রকাশ না করে যদি মারা যাই তাহলে জীবনটার একাংশ ব্যর্থ বলেই বিবেচিত হবে।তাছাড়া খুব কম মানুষ নিজেরা ভুল করলে সেটা অনুধাবন করে সত্যটা স্বীকার করতে পারে।রাতে খাবার টেবিলে আহসান সাহেবের ছোট ছেলে রিহাম জানতে চাইলো বাবা সেই ছেলেটির সাথে কি তোমার দেখা হয়েছিল।আহসান সাহেব বললেন ছেলেটির সাথে দেখা হয়নি।এভাবে দুই তিনদিন ছেলেটিকে আর দেখা গেলনা।তিনি ভাবলেন পথের ছেলে কখন কোথায় রাত কাটায় তার কি কোন ঠিক ঠিকানা আছে।ওর সাথে আর দেখা হবে কি হবেনা সেটা তার জানা নেই তবে কিছুটা আক্ষেপ থেকেই গেল যে ছেলেটির কাছে দুঃখপ্রকাশ করা হলো না।

এক রবিবার ছুটির দিনে আহসান সাহেব হাটতে বেরিয়েছিলেন।হাটতে হাটতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসেছিলেন এমন সময় দেখলেন সেই ছেলেটি আসছে।তিনি যতটা সম্ভব মিষ্টি করে ছেলেটিকে ডাকলে এই ছেলে তুমিকি একটু আমার কাছে আসবে?তোমার সাথে আমার কথা আছে।ছেলেটি আহসান সাহেবের কথা শুনে এগিয়ে আসলো তার পর বললো বলুন কি বলতে চান।না এমন নয় যে ছেলেটি আমাদের মত প্রমিত বাংলায় কথা বলেছে।সে তার মত করে আঞ্চলিক ভাবে কথা বলেছে কিন্তু ওর ভাষাকে লিখিত ভাষায় রুপ দিতে গেলে ঘটনাটি সেভাবে উল্লেখ করা যাবেনা বলেই আমাদের মত করে বলতে হচ্ছে।

ছেলেটি কাছে এসে দাড়াতেই আহসান সাহেব বললেন আমি খুবই দুঃখিত যে তোমাকে তুমি করে না ডেকে তুই তুই করে ডেকেছি। সে জন্য আমি খুবই লজ্জিত।তুমি ঠিকই বলেছ নিজের ছেলে মেয়েকে যদি তুই তুই করে ডাকা না যায় তাহলে অন্যের ছেলেকে কি করে তুই তুই করে ডাকি।আহসান সাহেবের কথা শুনে ছেলেটির মুখে হাসি ফুটলো না।তিনি জানতে চাইলেন তুমিকি তার পরও আমার উপর রেগে থাকবে?ছেলেটি বললো না আপনার উপর রাগ করিনি।যা রাগ ছিল তা চলে গেছে। তবে অন্য একটা কারণে খুব রাগ হয়েছে।আহসান সাহেব ছেলেটির কাধে হাত রেখে বললেন তোমার সময় থাকলে আমার পাশে বসো এবং বলো কি কারণে তোমার রাগ হচ্ছে।তার আগে বলো তোমার নাম কি।ছেলেটি পাশে বসতে বসতে বললো আমার নাম মিহির।থাকি কমলাপুর রেলস্টেশানে।

আহসান সাহেব দেখলেন মিহির নামের ছেলেটি তার পাশে বসলেও বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে।তিনি বললেন আমার গা ঘেসে বসো এতো দূরে বসেছ কেন?মিহির বললো সেটা হয়না।আমার গায়ে ময়লা আছে সেটাতো আপনার গায়ে লেগে যাবে।ওর কথা শুনে আহসান সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল।নিশ্চই ছেলেটা অন্যদের থেকে এমন আচরণ পেয়েছে যে ও খুব সাবধান হয়ে দূরে বসেছে।তিনি বললেন আমার গায়ে ময়লা লাগলে লাগুক তবুও তুমি কাছে এসে বসো।

কথাগুলো শুনে মিহির যেন ভীষন রকম মু্গ্ধ হলো।আহসান সাহেবের উপর সে মুগ্ধ ছিল অনেক আগে থেকেই।সে জানতো তাকে এবং সে জন্যই তার কাছে কিছু একটা বলবে বলে রোজই আসতে চেষ্টা করতো কিন্তু কখনো কথাটা বলা হতো না।এবার যেহেতু খুব কাছে এসেছে তাই কথাটা সে বলতেই পারে।তার আগে সে বললো মানুষ আমাদেরকে খুব নোংরা মনে করে।আমাদের শরীর যেন বিষে ভরা,যেন শরীরের সাথে ছোয়া লাগলে পচে যাবে।তাই সবাই চায় আমরা যেন দূরে দূরে থাকি।অথচ বাসে যে সিটে বসে যাওয়া আসা করে সেটাতেও অনেক ময়লা থাকে।তখন কিন্তু সেখানে বসলে তাদের শরীরে সমস্যা হয়না শুধু সমস্যা আমাদের বেলাতে।আহসান সাহেব খুব অবাক হন এবং আহতও হন ওর কথা শুনে।মনে মনে ভাবেন সমাজে আমাদের কত সমস্যা।আমরা ওদের কথা মোটেই ভাবিনা।

আহসান সাহেব ওর সাথে একমত পোষণ করলেন এবং জানতে চাইলেন তুমি আজ কেন রেগে আছ আর তুমি কমলাপুর থাকো তাহলে এতো দূরে কেন আসো?মিহির তখন জানালো এক বছর আগে রেল স্টেশানে একটা টোকাই ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছিল।সেদিন একটু দুরে মিহিরও ছিল আর দেখেছিল কেউ যখন এগিয়ে আসেনি তখন আহসান সাহেব ছেলেটিকে কোলে তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।সেদিন থেকেই মিহির আহসান সাহেবকে চেনে এবং খুবই ভালো মানুষ বলে মনে করে।সে মনে করে তারও যদি কখনো বিপদ হয় নিশ্চই আহসান সাহেব তাকে বাঁচাবে। আহসান সাহেবের মনে পড়ে এক বছর আগের সেই ঘটনা।মির্জাপুর থেকে ফিরছিলেন তিনি।ট্রেন থেকে নেমে সবে মাত্র প্লাটফর্মে দাড়িয়েছেন তখন ঘটনাটা ঘটেছিল।এতোদিন ধরে মিহির তার সেই ঘটনাটিকে মনে রেখেছে এবং বিশ্বাস করে বসে আছে যে তারও কোন বিপদ হলে তিনি রক্ষা করবেন এটা ভাবতেই তিনি মুগ্ধ হলেন।ওর মাথার চুলে বিলি কেটে বললেন তা তুমি এখন বলো তোমার কি সেরকম কোন বিপদ?আমার কোন সাহায্য করা লাগবে?

এবার মিহির নড়েচড়ে বসলো।বললো বিপদ ঠিক না তবে সমস্যা।কিছু লোক আছে যারা গায়ে পড়ে ঝামেলা করে তাদের নিয়ে সমস্যা।আমি তাদের বিরুদ্ধে কেস করতে চাই!!আপনি যেহেতু উকিল তাই আপনাকেই কাজটা করতে হবে!তাছাড়া আমিতো খুবই ছোট মানুষ তার উপর রাস্তার ছেলে।এমনিতেই ছোটদের কথাকে আমাদের দেশে কেউ গুরুত্বই দিতে চায় না আর সেখানে সেই ছোট মানুষ যদি পথের ছেলে হয় তাহলেতো কোন কথাই নেই।মিহিরের জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে আইন বিশেষজ্ঞ আহসান সাহেব আরো বেশি চমকে গেলেন।

তিনি জানতে চাইলেন তুমি এতো সুন্দর কথা কি করে শিখলে?কার কাছ থেকে শিখলে?মিহির জানালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো আপু আর একটা ভাইয়া কমলাপুর রেলওয়েস্টিশানে এসে আমাদেরকে পড়ায় অনেক গল্প করে।তাদের থেকেই শিখেছি জেনেছি।তবে তাদেরকেও আমার রাগের কথাটা বলিনি কারণ তারাতো আর উকিল না।ছোট্ট মিহিরের মুখে কেস করার কথা শুনে বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু নিশ্চই হবে ভেবে নিলেন আহসান সাহেব। বেলা বেশ হয়েছে,বাসায় ফেরা দরকার কিন্তু ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।ওর কথাগুলো শোন দরকার।তিনি জানতে চাইলেন কি কারণে তুমি কেস করতে চাও সেটা বিস্তারিত বলো।মিহির তখন যতটা সম্ভব ওর মত করে গুছিয়ে বলতে শুরু করলো।

শুরুটা বেশ আগের।রোজ কারো না কারো সাথে ঝগড়া লাগতো মিহিরের।ঝগড়ার বিষয়বস্তু তেমন কিছু না এই থু থু ফেলা নিয়ে।কেউ একজন থুথু ফেলছে সেটা দেখে মিহির নামের ছেলেটি রেগে উঠতো আর বলতো আপনি এখানে থু থু ফেললেন কেন?যে থুথু ফেলেছে সে অবাক হতো।জানতে চাইতো এখানে থুথু ফেললে সমস্যা কি?মিহির বলতো এটাতো আমার বিছানা এখানে কেন থুথু ফেলছেন?লোকটা তখন চারপাশ ভালো করে দেখেনিতেন।সেখানে কোথাও কোন বালিশ নেই তোশক নেই পাটি নেই।সুতরাং সেটা কি করে বিছানা হয়?মিহিরকে যখন বলা হতো এটাতো প্ল্যাটফর্ম এলাকা এখানে থুথু ফেললে সমস্যারতো কিছু নেই।ছোট্ট মিহিরের একটাই ক্ষোভ আমরাকি আপনার বিছানায় কখনো থুথু ফেলেছি যে আপনি আমাদের বিছানায় থুথু ফেলছেন।লোকটা ক্ষেপে উঠতো।মিহির তখন বলতো জানেন না এখানেই আমরা ঘুমাই তাই এটাই আমাদের বিছানা।

এসব কথা শুনে যে থুথু ফেলেছিল সে রেগে হয়তো একটা চড় বসিয়ে দিয়ে নিজের পথে চলে যেত।এভাবে রোজ চলতো কিন্তু একবার এক লোক যে প্রতিদিন উত্তরা থেকে মতিঝিলে অফিসে আসতো ট্রেনে সেও এসে থুথু ফেলতো।আসার সময় একবার যাওয়ার সময় একবার।তাকে কয়েকবার বলার পরও সে আমলে নেয়নি বরং এসেই ওখানে থু থু ফেলতো।যেন মিহিরের সাথে ইয়ার্কি করে শত্রুতা করেই থুথু ফেলছে।সেই লোকটার বিরুদ্ধেই মিহির মামলা করতে চায়।

ছোট্ট মিহিরের সব কথা শুনে আরো একবার চমকে উঠলেন আইনের সেবক আহসান সাহেব।মিহির যা বলেছে তাতেতো অবশ্যই যুক্তি আছে।ওরাতো সবাই রাস্তায়,ফুটপাথে ঘুমায় সুতরাং ওটাইতো ওদের বিছানা আর আমরা যাওয়া আসার পথে যখন যেখানে যেভাবে পারছি থুথু ছিটাচ্ছি।সুতরাং এক অর্থেতো আমরা মিহিরদের বিছানাতেই থুথু ছিটাচ্ছি।এটা নিয়ে মামলা হতেই পারে।তিনি মিহিরকে কথা দিলেন অবশ্যই তিনি মিহিরের হয়ে মামলা করবেন।তবে তিনি এও জানালেন যে লোকটি থুথু ফেলে শুধু তার নামে মামলা করাটা ঠিক হবে না তাই তিনি নিজের মত করে মামলা করবেন।মিহির খুশি মনে নিজের পথে চলে গেল আর আহসান সাহেব বাসায় ফিরলেন।বাসার সবাই খুব চিন্তিত ছিলো তিনি ফিরছেন না দেখে।

মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় ফোনটাও বন্ধ ছিল তাই সবার চিন্তা আরও বাড়ছিল।গোসল সেরে সকালের নাস্তা দুপুরে করতে হলো।তখনই তিনি মিহিরের কথাটা তুললেন।সবাই সব শুনে বেশ অবাক হলো এবং আহসান সাহেবের মেয়ে আরিয়ানা বললো বাবা ওই ছেলেটি কোনো স্কুলেই পড়েনা তার পরও ওর মাথায় এতো সুন্দর সব চিন্তা কি করে এলো?আহসান সাহেব উত্তর দিতে পারেন না।পরদিন কোর্টে গিয়ে তিনি একটি মামলা করেন।সব শুনে মামলা নিতেই রাজি ছিলনা কেউ কিন্তু আহসান সাহেবের মত মানুষকে দমিয়ে রাখা যায় না।অনেক হাসাহাসি হলো,কথা চালাচালি হলো তবে মামলা নেওয়া হলো এবং শেষ পযর্ন্ত অবশ্য সেই মামলার রায়ও হলো আর সেটা মিহিরের পক্ষেই গেল।স্থানে স্থানে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হলো যত্রতত্র থু থু ছিটানো যাবে না।কেউ থুথু ফেললেই তাকে জরিমানা করা হবে।

একসপ্তাহ পর আবার যখন মিহিরের সাথে দেখা হলো তখনো মিহিরের মুখটা কালো হয়ে আছে।আহসান সাহেব জানতে চাইলেন কি হয়েছে আবার?তোমার মন খারাপ কেন?মিহির বললো মামলা করে লাভ কি হলো?কেউতো শুনছেনা মানছে না।আসলে যাদের পরিবার থেকেই শিক্ষার অভাব আছে তাদেরকে কি আর মামলা দিয়ে আইন করে শেখানো যায়।আহসান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আর ভাবলেন এই পথের শিশুটি যতটা ভাবছে তার কিয়দাংশও যদি আমরা ভাবতে পারতাম দেশটা সোনার বাংলাই হতো,তাতে কোন খাদ থাকতো না।

জাজাফী
২০ এপ্রিল ২০১৮

যে আগুন নেভেনা

জাজাফী

প্লাস্টিকের ত্রিপলে ঢাকা তাবুতে ফিরে যেতে যেতে একটিবারও রাজুমা পিছনে ফিরে তাকায়নি। সে জানে পিছনে ফিরে তাকিয়ে কোন লাভ নেই। সেখানে তার জন্য কেউ অপেক্ষায় নেই।তাকে দেখে কেউ গুটি গুটি পায়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে না। আমরা ভেজা চোখে যদিও তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু এই ভেজা চোখ একটু বাদেই শুকিয়ে যাবে। একটু বাদেই গোটা পৃথিবী ভুলে যাবে রাজুমার কথা। আগুনে পুড়তে থাকা ঘরের আগুন নেভাতে ফায়ারসার্ভিস কর্মীরা প্রাণপন চেষ্টা করে একসময় আগুন নিভিয়ে ফেলে।নেভানো আগুন থেকেও বেশ কিছুটা সময় ধোয়া ওঠে এবং এক সময় সেই ধোয়াটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পোড়া গন্ধও একদিন দুদিন করে করে হারিয়ে যায়।কিন্তু রাজুমার বুকের মধ্যে যে আগুন লেগেছিল তা নেভানোর মত কোন দমকল বাহিনী আজও পৃথিবীতে জন্ম নেয়নি। যে আগুন রাজুমার বুকের মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে তা কোন দিন নিভবে না। অবিরাম জ্বলতে জ্বলতে একদিন হয়তো রাজুমা নামের মেয়েটিও পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। তখনো সে পোড়াগন্ধটুকু বুকের মধ্যে টের পাবে।

তাবুর বাইরে একটি ছোট্ট টুলের উপর বসেছিলাম আমি। সামনে একটি ফাকা টুল পড়ে আছে। একটু আগে সেই টুলে বসে ছিল রাজুমা নামের সাতাশ বছর বয়সী এক নারী। দশমিনিট মত তার সাথে কথা হয়েছিল। সেই দশটা মিনিট আমার কাছে মনে হয়েছিল দশ জনমের সমান। কথা শেষে তাকে বলার মত কোন ভাষাই আমার ছিল না। সে উঠে চলে যাওয়ার পরও তাই আমি ধাতস্ত হতে পারিনি। টুল ছেড়ে ওঠার মত শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে গেছে। নয়তো আমার পা দুটি মাটির সাথে এমন ভাবে আটকে গেছে যে আমি আর উঠতে পারছিনা। কিংবা মনে হচ্ছিল আমার শরীরের ওজন এতো বেড়ে গেছে যেন হিমালয়ের সমান ভারি হয়ে গেছে। সেই ভারিশরীর বয়ে নেবার মত শক্তি তখন আর আমার ছিল না। আরাকানের এক নিভৃত পল্লীতে ছিল রাজুমার ছোট্ট ঘর। সেই ঘর আলো করে রেখেছিল তার দুবছর বয়সী একমাত্র ছেলেটি যে এখন আর নেই। চাদের মত আলো নিয়ে যে ছেলেটি ঘর আলোকিত করতো সে আজীবনের মত হারিয়ে গেছে যেমন করে হারিয়ে গেছে তার সাধের ঘরটি।ঘর চলে গেলে আরো একটি ঘর পাওয়া যায় কিন্তু যে আলোরধারা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেল তাকে সে কি করে ফিরে পাবে। চোখের সামনে দাউদাউ করে আগুনে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে তার ছোট্ট কুটির সেই সাথে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার একমাত্র সন্তান। যে ছোট্ট ছেলেটি তার কোলে রোজ রাতে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকতো। তার বুকের দুধ চুকচুক করে খেতো আর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কত জানা স্বপ্ন দেখতো রাজুমা।

এক সকালে রাখাইন পল্লীতে হানা দিল বুনো হায়েনার দল। দেখতে মানুষ হলেও তারা আসলে মানুষ না। রক্তের নেশায় তারা তখন উন্মাদ হয়ে আছে। রাখাইন পল্লীতে ঢুকে হায়েনারা কোন গরু ছাগল মহিষের উপর হামলা করেনি কারণ তারা তখন মানব রক্তের হোলি খেলায় মত্ত। তারা তখন নারীদেহ নিয়ে মত্ত। সুনামীর মত এসে সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেল। কিন্তু সুনামীর সাথে তাদের ছিল আকাশ পাতাল ব্যবধান। সুনামী যখন আঘাত হানে তখন ঘরবাড়ি নষ্ট হয়, অনেকের জীবন চলে যায় কিন্তু সম্মানটুকু থাকে। কিন্তু রাখাইন পল্লীতে যে বুনো হায়েনার দল হানা দিলো তারা ছিল আরো নিকৃষ্ট। পুব আকাশে হয়তো তখনো ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি তখন তারা দুয়ারে দুয়ারে বুটের আঘাত করতে শুরু করলো। সেই বুটের আঘাতে কেপে উঠলো পুরো ঘর, পুরো রাখাইন পল্লী। অস্ত্রের মুখে বের করে আনলো ঘুমন্ত নারী পুরুষ শিশু কিশোরদের। ছেলে মেয়ে আলাদা করলো তার পর সবার সামনে ছেলেদের গুলি করে হত্যা করলো। ছোট্ট ছেলে মেয়েরা দেখলো তাদের চোখের সামনে তাদের বাবাকে তাতের বড় ভাইকে চাচা দাদাকে হায়েনারা গুলি করে মেরে ফেলছে। প্রিয় মানুষের মৃত্যু দেখেও তারা টু শব্দটি করতে পারছেনা যদিও তাদের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানেই সব শেষ নয়। পুরুষ সদস্যদের মেরে ফেলার পর নারীদেরকে ঘরে নিয়ে পাশবিক নিযার্তন করেছে। কখনো কখনো ছোট্ট ছেলে মেয়ের সামনেই তাদের মাকে বড় বোনকে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে। পৃথিবীর আকাশ বাতাস তখন কেপে উঠলেও বুনো হায়েনাদের একটি পশমও নড়েনি। তারা উন্মত্ততায় খুনের নেশায় মেতে উঠেছে।

পঙ্গপালের মত রাখাইন পল্লী থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে অগণিত নারী পুরুষ শিশু কিশোর। কিন্তু সেই পালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে রাজুমার ঠাই হয়নি। সে সেই সুযোগটুকু যখন পেয়েছে তখন তার নিজের বলে আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই তার ঘরের দরজাতেও বুটের আঘাত পড়েছে। ঘুম ঘুম চোখে তার স্বামী যখন দরজা খুলছে তখন সেই তার দেড় বছরের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে স্বামীর পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছে। ভোরের আলো দেখার আগেই সে দেখেছে তার স্বামীর মৃত্যু। তার পর তাকে টেনেহিচড়ে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল। স্বামীর মৃতদেহ তখন উঠোনের এক কোণায় পড়ে আছে। সেদিকে তাকাবার মত সময়ও রাজুমার হয়নি। চোখের সামনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে কুড়ে ঘরখানা। একটু আগেও স্বামী সন্তান নিয়ে যে ঘরে আরামের ঘুম ঘুমিয়েছিল রাজুমা এখন সেটা জ্বলছে চোখের সামনে। একটু আগে যে মানুষটি তার স্বামী ছিল সে এখন মরে পড়ে আছে। তখন সে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে তার একমাত্র ছেলেটিকে। দুধের শিশুটি জানতেই পারেনি তার জন্মদাতা পিতা চিরকালের মত ঘুমিয়ে গেছে।

একদিকে স্বামীর মৃত দেহ অন্যদিকে চোখের সামনে জ্বলতে থাকা বসতবাড়ি। রাজুমা নামের মেয়েটি যখন বুকের সাথে একমাত্র সন্তানকে জড়িয়ে দিশেহারা হয়ে আছে তখন হায়েনাদের এক সদস্য ওর বুক থেকে একমাত্র সন্তানকে ছিনিয়ে নিল। তার পর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ছুড়ে ফেলে দিল আগুনের মধ্যে। চোখের সামনে কলিজার টুকরো ছেলেটি জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হতে থাকলো কিন্তু রাজুমার কিছু করার থাকলো না। সে তখন মাটিতে শোয়া এবং তার বুকের উপর হায়েনারা পালা করে ওঠানামা করছে। এভাবে কতক্ষণ চলেছে সে জানেনা। পোড়া গন্ধে একসময় সে জেগে উঠলো। পাশবিক নিযার্তনের সে জ্ঞান হারিয়েছিল বলেই স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র সন্তানকে আগুনে পুড়তে থাকা দৃশ্য দেখার কষ্ট থেকে রেহায় পেয়েছে। চোখে মেলে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষন আগেও যেখানে থাকার ঘর ছিল এখন সব শুন্য। সেখানে শুধু কিছু কয়লা ছাই পড়ে আছে। সে তখন দিশেহারা।হঠাৎ তার সন্তানের কথা মনে পড়লো। থেতলে যাওয়া শরীরটাকে কোনমত টেনে ছাইগাদার কাছে নিয়ে সে তার সন্তানকে খুঁজলো। কিন্তু তাকে সে খুঁজে পেলো না। তার বুকের মানিক তখন ছাইভস্ম হয়ে মৃদু বাতাসে উড়ছে দিগন্তে। আশেপাশে তাকিয়ে স্বামীকে খুঁজলো কিন্তু তাকেও পাওয়া গেল না। হয়তো সন্তানের সাথে সাথে সেও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। হায়েনারা হয়তো ওর স্বামীর মৃত দেহ ছুড়ে মেরেছে জ্বলন্ত আগুনে।

স্বামী নেই, একমাত্র সন্তানও নেই সেই সাথে নারীত্বের যে সম্মান, সম্ভ্রম সেটাও কেড়ে নিয়েছে মায়ানমারের নরপিশাচ সেনাসদস্যরা। বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু দরকার সবই সে হারিয়েছে। এ জীবন রেখে আর লাভ কি? একটু দূরে তখনো ঘরের কিছু অংশ দাউদাউ করে জ্বলছিল। শরীরটাকে টেনে সে সেই আগুনে ঝাপিয়ে পড়লো কিন্তু পারলো না। কে যেন তাকে থামিয়ে দিল। তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে সরিয়ে নিল। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো রাহেলার মা। রাখাইন পল্লীতে প্রতিবেশি ছিল।কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো রাজুমা। তাকে শান্তনা দেবার মত ভাষা ছিলনা রাহেলার মায়ের। তারও আপন বলতে আর কেউ জীবিত নেই। সবাইকে মেরে ফেলেছে হায়েনার দল। বয়স হয়ে যাওয়ায় তার উপর পাশবিক নিযার্তন করতে পারেনি ওরা। বুকের সাথে রাজুমার মাথা ঠেকিয়ে তাকে শান্তনা দেবার ভাষা খুঁজতে থাকেন তিনি। কিন্তু বলার মত কোন কথাই তার মূখে আসে না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রাজুমার কান্নাও থেমে যায়। তাকে ধরে পথে বেরিয়ে পড়ে রাহেলার মা। কতশত মাইল পাড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশ সীমানায়।

ছোট্ট তাবুতে একটু আগে যে মেয়েটি ফিরে গেল সেই মেয়েটিই হলো রাজুমা। যার কোল থেকে একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নিয়ে চোখের সামনে ছুড়ে মারা হয়েছিল আগুনে। তার পর স্বামীর মৃতদেহের পাশে মাটিতে চেপে ধরে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তার চোখে তখন অবিরাম শ্রাবণধারা। সামনে দাউদাউ করে জ্বলছে কলিজার টুকরা সন্তান, শরীরের উপর চলছে পাশবিক নির্যাতন, পাশে পড়ে আছে মৃত স্বামী।

আমার সাথে কথা বলে তাবুতে ফিরে যাওয়ার পরও আমি ওই তাবুর দিকে অপলোক তাকিয়ে আছি। গুয়ান্তানামো বে’র অত্যাচারের কথা শুনেছি, আবু গারিবের নিমর্মতার কথাও শুনেছি কিন্তু রাজুমার গল্প সম্পুর্ন আলাদা। আর কোন দিন হয়তো রাজুমার সাথে দেখা হবেনা কারণ ওর সাথে দেখা করার মত সাহস আমার নেই। দেখা হলে কি করে ওকে প্রশ্ন করবো তুমি কেমন আছ? এই প্রশ্ন করতে পারবো না বলেই ভয়ে আর কোন দিন ওর সাথে দেখা হবে না। এখনো ওর বুকে পোড়া গন্ধ, জ্বলতে থাকা আগুনের ধোয়া আরাকানের গোটা আকাশকে ছেয়ে দিয়েছে। হয়তো আরাকানের জ্বলতে থাকা গ্রাম একদিন শান্ত হয়ে যাবে। সব আগুন, ধোয়ার কুন্ডলী থেমে যাবে কিন্তু রাজুমার বুকের আগুন কোন দিন নিভবে না। ওর বুক থেকে যে ধোয়ার কুণ্ডলী বের হতে শুরু করেছে তা কখনো শেষ হবার নয়।

জাজাফী
২৩ অক্টোবর ২০১৭

কনে দেখা নাকি লাউ কেনা

এক্স_ক্যাডেট ফারহানা আপুকে দেখার জন্য ছেলেপক্ষ এলো বাড়িতে। ছেলের ভাই বোন ভাবি দাদা এসেছিল, সাথে ছেলেও ছিল। ফারহানা আপুকে দেখে তাদের পছন্দ হলো। গতানুগতিক ভাবে ওকে প্রশ্নও করা হলো তোমার নাম কি, কয় ভাই বোন, তুমি কত তম, পড়াশোনা কতটুকু করেছ,নামাজ পড়ো কিনা, কালেমা শাহাদাত বলো ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফারহানা আপু বেশ সুন্দর ভাবে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিল, এতে করে ছেলেপক্ষের সবাই ভীষণ খুশি। ছেলেও দু’একটা প্রশ্ন করেছিল। এবার ছেলের দাদা ফারহানা আপুকে বললেন ফারহানা তুমি কি কিছু বলবে আর? এই সুযোগটাই চাইছিল আপু। সে বললো আপনারা দশজন মিলেতো আমাকে নানা প্রশ্ন করলেন আমি সবগুলোর সঠিক জবাবও দিলাম। আমার খুব ইচ্ছা আপনাদের দশজনকে আমি একটা একটা করে প্রশ্ন করি।

ছেলেপক্ষের লোকেরা মোটামুটি আধুনিক ঘরানার ফলে ফারহানা আপুর প্রস্তাবে তারা রাজি হয়ে গেল।ফারহানা আপু তখন ছেলের দাদুকে দিয়েই শুরু করলো। সে বললো আচ্ছা দাদু বলুনতো ক্রসকান্ট্রি_রেস
কি জিনিষ? দাদু মাথা চুলকাতে লাগলেন বাকিরাও একই অবস্থা। দাদু তখন বললেন ও ক্রসকান্ট্রি রেস? এটাতো খুবই সোজা। একটা দেশের সীমানার মধ্যে অন্য একটা দেশের সীমানা ঢুকে গেলে সেটা নিয়ে অফিসে ফাইল চালাচালির সময় যে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় সেটাই ক্রসকান্ট্রি রেস। সবাই তখন দাদুকে সাবাশি দিল।ফারহানা আপুর দিকে তাকিয়ে সম্মতি চাইল আপু কিছু বললো না।

ছেলের বড় বোন ছিল, যে ফারহানা আপুকে প্রশ্ন করেছিল বলোতো মালাইকারি বানানোর সময় কি কি করতে হয়। সেই বড়বোনকে ফারহানা আপু প্রশ্ন করলো আচ্ছা আপু বলুনতো #প্রেপের সময় কি কি করতে হয়? বড় বোন দাদুটার মত মাথা না চুলকে পন্ডিতি করে বললো প্রেপের সময় প্রার্থনা করতে হয়, দোয়া করতে হয়, সে জন্যইতো এর নাম প্রেপ। ফারহানা কিছু বললো না।
ছেলের আরেক বড় ভাই ছিল, আপু তাকে প্রশ্ন করলো আপনি বলুনতো নভিসেস ড্রিল কি? সে উত্তর দিল মাটির দেওয়ালে ফুটো করতে যে ড্রিল ব্যবহার করা হয় সেটা নভিসেস ড্রিল।

ছেলের ছোট ভাই ফারহানা আপুকে প্রশ্ন করেছিল বিপি কি? বিপি মানে যে ব্লাড প্রেসার এটাতো সবাই জানে ফারহানা আপুরতো না জানার কথা নয়। সেই ছোটভাইকে আপু প্রশ্ন করলো বলুনতো সিপি কি? ছোট ভাই ঝটপট উত্তর দিল সিপি হলো একটা ফাস্টফুডের দোকান। যেখানে ফ্রাইড চিকেন, চিকেন উইংস, চিকেন বল, চিকেন নাগেট, চিকেন সসেজ বিক্রি হয়।

সবার শেষে ছেলের পালা। ছেলে ফারহানা আপুকে প্রশ্ন করেছিল উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি কি দিতে বেশি ভালবাসেন? তখন ফারহানা আপু অন্য একটা উত্তর দিয়েছিল।এবার ছেলেকে আপু প্রশ্ন করলো আপনি কখনো ইডি খেয়েছেন? ছেলে বললো না খাইনি। তখন ফারহানা আপু বললো আমি অন্যদেরকে যে উপহারই দেইনা কেন যদি আপনাদের সবাইকে উপহার দিতে বলতেন তাহলে সবাইকে ইডি খাওয়াতাম উপহার হিসেবে। মেহমানরা সবাই মুখ চাওয়া চাউয়ি করতে লাগলেন কারণ তারাতো জানেইনা ইডি আসলে কোন ধরনের খাবার জিনিষ।

ফারহানা আপু প্রশ্ন শেষ করে বললো প্রশ্ন করা খুবই সহজ কিন্তু উত্তর দেওয়া অনেক কঠিন। আপনারা দশজন আমাকে দশটা প্রশ্ন করেছেন আমি সবগুলোর সঠিক জবাব দিয়েছি। যদি দিতে না পারতাম তাহলে বলতেন মেয়েতো অযোগ্য অপদার্থ, কিছুই জানেনা। পক্ষান্তরে আপনাদের প্রত্যেককে আমি একটা করে প্রশ্ন করেছি কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারেন নি। কিন্তু আমাদের কারো পক্ষেই আপনাদেরকে অযোগ্য বলার সুযোগ নেই।
আপনারা আমাকে দেখে পছন্দ করেছেন, ছেলের যোগ্য মনে করেছেন, এখন ভেবে দেখুনতো আপনাদের ছেলে আমার যোগ্য কিনা। দেখুন! মাফ করবেন, আমি আপনাদের আঘাত দিতে চাইনি। মেয়েদেরকে গরুছাগলের মত বাজারে উঠিয়ে দাত ধরে দেখে খুঁত আছে কিনা পরখ করে, তার পর বিয়ের পিড়িতে বসানোর নীতি বন্ধ হওয়া উচিত। মেয়েরা কোন পন্য নয় যে, লাউ কেনার সময় যেমন চিমটি কেটে লাউ কেনে সেভাবে হাটিয়ে, বসিয়ে, প্রশ্ন করে তার পর বউ বাছাই করবেন।

ফারহানা আপুর কথা শুনে সবার মুখ কালো হয়ে গেল। আমাদের পরিবারের সবাইও বেশ লজ্জায় পড়ে গেল। মেহমানদের খাওয়াদাওয়া ভাগ্যিস আগেই হয়ে গিয়েছিল নইলে তারা না খেয়েই বিদায় নিত। সেই ছেলে পক্ষ পরে একদিন চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়েছিল।
তিন বছর পর ফারহানা আপুর সাথে সেই ছেলেটির দেখা হয়েছিল এক পার্টিতে।ততোদিনে আপুর বিয়ে হয়ে গেছে আপুর পছন্দের ছেলের সাথে। যার সাথে দুবছর আগে রিলেশান হয়েছিল। কথায় কথায় সেই ছেলেটি বলেছিল আর যাই হোক ঘরে একজন এক্স ক্যাডেট স্ত্রী থাকলে স্বামীর অবস্থা কাহিল। তার পর ফারহানা আপুর হাজবেন্ডকে বললো ভাই আপনি কিভাবে কোন মন্ত্রবলে টিকে আছেন শুনি।

ফারহানা আপুর হাজবেন্ড তখন হেসে দিয়ে বললো ভাই আপনারা যেটা খাওয়ার সাহস পাননি আমি সেটা ক্লাস সেভেন থেকে খাওয়ার অভ্যাস করেছি ফলে ইডি আমার সহজেই হজম হয়ে যায়। সিপিতে গিয়ে চিকেন বল চিকেন সসেজ খাওয়ার দরকার পড়েনা কারণ কলেজে নিজেইতো সিপি ছিলাম। আমাদের মাটির দেওয়াল নেই তাই নভিসেস ড্রিল নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিনা। আর ক্রসকান্ট্রি রেস? সেটাও সমানে চলছে।
ছেলেটা শুধু বোকার মত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। বুঝে হাসলো এটা আপনি বলতে পারবেন না,সে কোন কিছু না বুঝেই হেসেছে আর সেটা দেখে ফারহানা আপু আর তার হাজবেন্ডও হেসেছে।

—– জাজাফী
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭