ট্যাগ আর্কাইভঃ জাজাফী

ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অনিয়ম বিষয়ে আমার কিছু কথা

এই মুহূর্তে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় আবুল মাল আব্দুল মুহিতের কথা বেশ মনে পড়ছে। সামনে পেলে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম। কেন ক্ষমা চাইতাম অলরেডি চিন্তাশীল বন্ধুরা বুঝতে পেরেছেন। যারা কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করার মত সময় বা ধৈর্য পান না তাদের জন্য বলছি। ক্ষমা চাইতাম কারণ তাঁর বলা একটি কথা ‍শুনে আমরা হাসাহাসি করেছিলাম। সেই যে ৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে তিনি বলেছিলেন সামান্য টাকা। তখন আমরা হাসাহাসি করেছিলাম। ছয় হাজার কোটি টাকা নাকি সামান্য টাকা! আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর নিতে নেই প্রবাদটিও আবার প্রমাণিত হলো। আমরা আদার ব্যাপারী তাই জাহাজের খবর নিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছি। আমরা নবগঙ্গা নদীর মাঝি তাই সাগরের ঢেউ বা গভীরতা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। সে কারণেই ৬ হাজার কোটি টাকাকে মাত্র বা সামান্য বলা শুনে আমরা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি তার বলা কথাটা পুরোপুরি সত্য। এই যে কয়েকটি ব্যাংক থেকে একটি মাত্র গ্রুপ ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে এটা দেখেতো তাঁর কথাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ৩০ হাজার কোটি টাকার পাশে ছয় হাজার কোটি টাকা রাখলে তা অবশ্যই সামান্য মনে হবে। এই পরিমান টাকা খরচ করে পুরো পৃথিবীকে বিনোদন দিতে বিশ্বকাপের আয়োজন করেছে কাতার!

শুনতে ৩০ হাজার কোটি টাকা খুব সহজেই শোনা গেলেও বাস্তবে এই পরিমান টাকা একসাথে রাখলে পুুরো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের মত একটা বড় বিল্ডিং ভরে যাবে। এখন কথা হলো ঘরের চালে যে টিন থাকে তাতে ছিদ্র কিন্তু একদিনে বড় হয় না। প্রথমে সুই হয়ে ঢোকে তারপর কুড়াল হয়ে বের হয় বলে যে একটা আঞ্চলিক প্রবাদ আছে ঘটনা কিন্তু সেরকম। এই যে বিরাট অংকের কারসাজি এটিতো একবারে হয়নি। হয়েছে ধীরে ধীরে এবং পরিকল্পিত ভাবে। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া ছিল তা এক অজ্ঞাত কারণে ২০২০ সালে সরিয়ে নেওয়া হয়! জাতির সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হতে পারে কেন এবং কোন যুক্তিতে পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল? যারা সরিয়ে নিয়েছিলেন তাদেরকে এর জবাব দিতে হবে। ঋণ অনিয়ম তো আজকের ঘটনা নয়। এই সন্দেহ তৈরি হয়েছিল আরও এক যুগ আগে। ঋণ অনিয়মের আশঙ্কায় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক (তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ব্যাংকটির বিভিন্ন সভায় অংশ নিতে শুরু করেন।

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেলো বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপের হাতে চলে যায়। প্রথম আলোর ভাসুর হয় বলে সম্ভবত গ্রুপের নাম উল্লেখ করা হয়নি অথবা তাদের কী এক সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী নাম উল্লেখ করেনি। তবে সবাই জানে গ্রুপটির নাম এস আলম গ্রুপ। এরপর ২০২০ সালের মার্চে ওই পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক! বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক (তৎকালীন) গভর্নর ফজলে কবির ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক রাখার পক্ষে ছিলেন না। এই তথ্যটি জেনে আমি সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছি। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনর যদি পক্ষে না থাকেন তাহলে আর কী বলার থাকে। যদিও এখনো অন্য ছয়টি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক নিযুক্ত পর্যবেক্ষক রয়েছে। তাহলে ইসলামী ব্যাংকে থাকলে দোষ কী ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। এর বাইরে নতুন করে আরও কয়েকটি ব্যাংকে সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে। এখন আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে যে মাননীয় গর্ভনর সাহেব কেন এবং কোন যুক্তিতে এর পক্ষে ছিলেন না?

মালিকানা বদলের পর ইসলামী ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন বিবেচনায় পর্যবেক্ষক সরিয়ে নিল, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ এ কথাও বলছেন এখন, অনিয়মের সুযোগ করে দিতেই ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কাগুজে কোম্পানির নামে যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটি থেকে অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের আদলেই। ইসলামী ব্যাংকের সাম্প্রতিক ঋণ অনিয়মের ঘটনা সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক, বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়মের চেয়েও ভয়াবহ বলে মনে করছেন ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকটি থেকে কী পরিমাণ অর্থ এখন পর্যন্ত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা অনুসন্ধানে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শন দল। আমার মতে শুধু ওই ব্যাংকে খতিয়ে দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত হবে না বরং গ্রুপের অন্যান্য ব্যাংকেও খোঁজ নিতে হবে পাশাপাশি সেই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা পর্ববেক্ষক সরিয়ে নিয়েছিলেন তাদের বিষয়েও খোঁজ নিতে হবে। এবং এ ক্ষেত্রে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করলে তা কতটা স্বচ্ছ হবে সেটাও ভাবার বিষয়।

ধান ভানতে শীবের গীত বলে যে প্রবাদটি আছে তাও এখানে টেনে আনতে চাই। এই যে খাস বাংলায় বাঁশ খাওয়া বলে যে একটা কথা প্রচলিত আছে আমরা নানা ক্ষেত্রে তা দেখতে পাই। ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে কথাটা কিছুটা প্রযোজ্য কারণ বাঁশখালী,পটিয়া,সাতকানিয়া নামে এলাকাও যে এর সাথে কিছু অংশে যুক্ত। যাদের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হওয়ার যোগ্যতা নেই তারাও বাঁশখালী ও এর আশেপাশের লোক হওয়ায় অনায়াসে ব্যাংকার বনে গেছে। শুধু তাই নয় যতটা জেনেছি তাতে বুঝেছি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় নিজস্ব লোক রাখা আছে এটা মনিটর করার জন্য যে কেউ যেন গ্রুপের বিষয়ে কিছু বললে তা উপর মহলকে জানানো যায়। চাকরি দেওয়ার সময় যোগ্যতা বিবেচনা না করে বাঁশখালী বা নির্দিষ্ট এলাকা বিবেচনা করে চাকরি দেওয়াটাও ব্যাংকের জন্য কাল হয়েছে। ক্ষমা চাইছি নানা ক্ষেত্রে চতুর্থ শ্রেণীর চাকরি যারা করেন তাদের কাছে এবং পটিয়া,সাতকানিয়া, বাঁশখালীর অন্যদের কাছে। আমি তাদেরকে ছোট করতে চাইনি।

সাতকানিয়া,পটিয়া এবং বাঁশখালী এলাকার যত সংখ্যক মানুষ গ্রুপের ব্যাংকে আছে তার বিশ ভাগের একভাগ লোকও অন্যান্য পঞ্চাশটি ব্যাংকে নেই যাদের বাড়ি ওই এলাকায়। যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি না দিয়ে এলাকাভিত্তিক এবং নিজেদের ফায়দা লুটে নেওয়ার জন্য কিছু মানুষকে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে যে কোনো প্রতিষ্ঠান ধ্বসে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে আপনাকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া মানেই আপনার মুখ বন্ধ রেখে আপনাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নেওয়া। হয়েছেও তাই। একটি লোনের আবেদন থেকে শুরু করে পাশ হয়ে গ্রাহকের হাত অব্দি যাওয়া পর্যন্ত কী পরিমান প্রসিডিউর ফলো করতে হয় তা আমি ব্যক্তিগত লোন নিতে গিয়ে দেখেছি এবং স্টাডি করে দেখেছি বড় লোনগুলো আরও কতটা জটিল। এই যে ফিল্টারিং হয় বা স্তরে স্তরে ব্যারিকেড পার হয়ে একটি লোন পাশ হয়। কোথাও না কোথাও ঘাপলা ধরা পড়বেই। কিন্তু প্রতিটি চেক পোস্টে বাংলা সিনেমার মত যদি নিজস্ব চামচা বা পা-চাটা লোক থাকে তবে আপনাকে কোনো চেকপোস্টেই আটকানো হবে না। আপনি অনায়াসেই পার হয়ে যেতে পারবেন। ব্যাড লোনগুলোর ক্ষেত্রে বিষয়টা এমনই ঘটে। আর যখন ক্ষমতাধরদের অন্যায় কেউ আপস করতে রাজি হয় না তখন তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। যার নজির অহরহ।

আবার ফিরে আসি প্রথম আলোর প্রতিবেদনে।এদিকে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখলাম ইসলামী ব্যাংক থেকে কেন পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তার যথাযথ কোনো উত্তর দিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো মন্তব্য না করার নীতি নিয়েছে। সংস্থাটির মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদের কাছে গতকাল সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক নিয়ে কোনো মন্তব্য করবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেওয়ার পর ব্যাংকটি থেকে কাগুজে কোম্পানি খুলে অর্থ বের করা শুরু হয়। প্রথমে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে এই অনিয়ম শুরু হয়। ফলে পাঁচ বছরে এই শাখার ঋণ ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বের হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা।

চট্টগ্রামে ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকলে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শাখা থেকে একই প্রক্রিয়ায় টাকা বের করা হয়। আর ২০১৭ সাল থেকে খাতুনগঞ্জ শাখার দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের ঋণসংক্রান্ত বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

পাশাপাশি দ্রুত পদোন্নতি পাওয়া প্রধান কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তাও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। এভাবে ২০ থেকে ৩০ কর্মকর্তা মিলে ব্যাংকটিতে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। আর ব্যাংকটির পরিচালকেরা বেশির ভাগ একটি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হওয়ায় তারাও এতে সমর্থন দেয়।

ব্যাংকটির ঋণের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কাগুজে কোম্পানিগুলোর নামে সর্বোচ্চ ঋণের পরিমাণ ছিল দেড় হাজার কোটি টাকার কিছু কম। কারণ, ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণমূলক মূলধন ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এর ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ১ হাজার ৫০৪ কোটি ঋণ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। আর ওই পরিমাণের কম ঋণ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার দরকার হয় না। তাই কাগুজে কোম্পানিগুলোর ঋণের পরিমাণ ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

সাম্প্রতিক একটি ঘটনা উল্লেখ করি। আমার ফেসবুক বন্ধু নুরুল আবসার ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন যার শিরোনাম ছিল “শেষ পযর্ন্ত ইসলামী ব্যাংকেও খেয়ে দিতে হলো”? আমি সেখানে মন্তব্য করেছিলাম এটা কি আজকের ঘটনা? যবে থেকে এস আলম গ্রুপের হাতে গেছে ব্যাংক তবে থেকেই সমস্যা শুরু হয়েছে। এখন আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই এমন এক ভদ্রলোক আমাকে মেসেজ দিয়ে জানতে চেয়েছেন “এস আলম গ্রুপ আপনার কোনো ক্ষতি করেছে?” দেখলাম ভদ্রলোক অফিসার হিসেবে ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত আছেন। আমি বললাম তর্ক করতে চাই না। পত্র পত্রিকায়তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমি যদিও তার সাথে তর্ক করতে তো চাইনি তবে আমি একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে এবং চিন্তক হিসেবে আমার মতামত নিশ্চই বলতে পারি। তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমার কোনো ক্ষতি করেছে কি না। আমার স্পষ্ট জবাব আমার কোনো ক্ষতি করেনি। কিন্তু ক্ষতি করেছে পুরো দেশের,পুরো জাতির! আর সেই জাতির একজনতো আমিও। সুতরাং আমারওতো ক্ষতি করেছে বলতে হয়। কিভাবে করেছে তা নিশ্চই বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। তবুও অল্প কথায় বলি। আর্থিক এই বিরাট অনিয়মের কারণে দেশের মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে এবং দেশের অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উপর প্রেসার বেড়েছে। তাদের মর্যাদাও নষ্ট হচ্ছে। রেপুটেশন খারাপ হচ্ছে। জনমনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে যে সব ব্যাংক এভাবে দেউলিয়া হয়ে যাবে বা গ্রাহকের টাকা হারিয়ে যাবে। এ বিষয়ে আপনারা নিশ্চই জানেন যে কিছুদিন আগেও এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়ে সার্কুলার জারি করে কিছুটা সামাল দিয়েছে। পাশাপাশি আমি দেখেছি আমার লিস্টের ব্যাংকার বন্ধুরাও তাদের টাইমলাইনে সেটা পোস্ট করে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে।

একটি প্রতিষ্ঠানের এই ধরনের নয়ছয় বা খামখেয়ালিতো শুধু ওই প্রতিষ্ঠানকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয় না বরং একই ঘরানার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং পুরো জাতিকেই বিব্রত করে। পুরো জাতির ক্ষতি করে। শুধু তাই নয় হয়তো দেখা যাবে অনেক ব্যক্তির নামেও দুই চার কোটি টাকার লোন হয়ে আছে কিন্তু সে জানেই না! যারা নামে বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে হাজার কোটি টাকা নিয়ে নেয় তারা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কারো ছবি আর নাম ব্যবহার করে দুই চার কোটি নিতে পারে না বা নেয়নি তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। যদি এমন হয়ে থাকে তবে আল্লাহ ভালো জানেন কতজনের কপাল পুড়বে। ধরুন যে অফিসারটি ৬০ হাজার বা এক লাখ টাকা বেতন পান এবং একমাত্র আয়ের মাধ্যম তার ওই বেতন তার নামে দুই চার কোটি টাকা লোন পাশ হয়ে গেছে কিন্তু সে জানেই না। তাহলে পরে যদি এটা সে জানতে পারে তার কি সাধ্য আছে সেটা শোধ করার? আমরা দেখেছি ২০/৩০ হাজার টাকা লোন নিয়ে পরিশোধ করতে পারেনি বলে কত কৃষকের কোমরে দড়ি (রুপক অর্থে অথবা বাস্তবে) বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ রাঘববোয়ালরা সব সময় অধরাই থেকে গেছে। যখন যোগ্য ও মেধাবীদের বদলে অযোগ্য আর সুবিধাবাদীদের নিয়োগ দেওয়া হয় বা দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন ফলাফল ভালো হয় না। সেটা ক্রিকেট খেলা হোক, ফুটবল খেলা হোক, রাজনৈতিক দল হোক বা কোনো চাকরি হোক। সবক্ষেত্রেই অযোগ্যদের দায়িত্ব দিলে সর্বনাশই হয়। আর একদল মানুষ চায় ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বা দেশের ক্ষতি হয় হোক আমার ক্ষতি না হলেই হলো। আর তাইতো কিছু মানুষ লুটেপুটে সুইস ব্যাংক বোঝাই করে। বলির পাঠা হয় দেশ এবং দেশের আপামর খেটে খাওয়া মানুষ। দুর্নামের ভাগিদার হয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। সন্দেহ মাথায় নিয়ে সংসার করতে হয়। উল্লেখ্য এই সব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের সনদ চেক করলে অনেক জাল সনদও পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। কারণ এর আগে যতদূর জানি ইউনিয়ন ব্যাংকে এমন জাল সনদধারীদের ২৭ জনের চাকরি গিয়েছিল। ইউনিয়ন ব্যাংকের যে ঘটনাটি উল্লেখ করলাম তার তথ্যসূত্র আমার কাছে নেই।

লেখকঃ জাজাফী
১ ডিসেম্বর ২০২২

মামলা

লেখকঃ জাজাফী

আহসান সাহেবের বাসা টিকাটুলির শাহ সাহেব লেনে।গায়ে কালো গাউন জড়িয়ে রোজ যখন তিনি বাসা থেকে বের হন তখন একটি ছেলে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।ছেলেটির বয়স বারো বছরের বেশি হবে বলে মনে হয়না।গায়ে নোংরা পোশাক,মাথার চুল এলোমেলা।দেখেই বুঝা যায় রাস্তার মানুষ সে।আহসান সাহেবের তাড়া থাকায় কখনো ছেলেটিকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি ওর নাম কি, কোথায় থাকে, কি করে।তবে ছেলেটি যে টোকাই শ্রেণীর কেউ তা তিনি খুব সহজেই অনুমান করতে পারেন।হাতে একটা বস্তা থাকেই সারাক্ষণ।নিশ্চই সে ওটাতে কুড়িয়ে পাওয়া বোতল এটা সেটা রাখে।আহসান সাহেব মনে মনে ভাবেন কোন এক ছুটির দিনে নিশ্চই সময় করে ছেলেটার সাথে কথা বলবেন।যাওয়া আসার সময় দূর থেকে ছেলেটি তাকে এমন ভাবে কেন দেখে সেটাও জানার খুব আগ্রহ।

সেদিন হঠাৎ সব বদলে গেল।তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা নিবেন বলে অপেক্ষা করছেন এমন সময় ছেলেটি গুটিগুটি পায়ে তার সামনে এসে দাড়ালো।এই প্রথম খুব কাছ থেকে ওকে দেখলেন আহসান সাহেব।যতটা ময়লা মনে হয়েছিল তার থেকেও বেশি ময়লা মনে হলো তবে ওর ভিতরে যে উজ্জল একটি মানুষ লুকিয়ে আছে তাও টের পাওয়া যাচ্ছে।শুধুমাত্র যত্নের অভাবে সেই ঔজ্জল্য দেখা যাচ্ছেনা।ছেলেটি সামনে আসতেই আহসান সাহেব জানতে চাইলেন তোর নাম কিরে?আহসান সাহেব খুব অবাক হয়ে দেখলেন ছেলেটি কোন উত্তর দিলো না।ওর কপালের রেখায় রাগ রাগ ভাব ফুটে উঠেছে।আহসান সাহেব কিছুটা আহত হলেন কিছুটা বিরক্তও হলেন।আবার জানতে চাইলেন কিরে কথা বলিসনা কেন?তোর নাম কি?ছেলেটি উত্তর না দিয়ে হনহন করে চলে গেল।তিনি অবাক হলেন ঠিকই আবার ভাবলেন হতে পারে ছেলেটি কথাই বলতে পারেনা।একটা রিকশা তখন টুংটাং শব্দ করে ওদিক দিয়েই যাচ্ছিল আহসান সাহেব হাত নেড়ে সেটাকে থামালেন তার পর গন্তব্যের দিকে রওনা দিলেন।

দিন শেষে ঘরে ফেরার পথে সেই ছেলেটির সাথে আবার দেখা হলো।সকালে প্রশ্ন করে কোন উত্তর না পেয়ে তাই আহসান সাহেব আর আগ্রহ দেখালেন না।তবে তিনি দেখলেন ছেলেটি এগিয়ে আসছে।কাছে এসে জানতে চাইলো আপনার ছেলে মেয়েকে আপনি কিভাবে ডাকেন?তুমি করে না তুই তুই করে?আহসান সাহেব বললেন অবশ্যই তুমি করে ডাকি।তুই তুই করে ডাকাটা কেমন যেন অসভ্যতামী।ময়লা জামার ছেলেটি বললো আপনার নিজের ছেলে মেয়েকে আপনি তুই বলতে পারেন না, সেটাকে অসভ্যতামী মনে করেন, তাহলে আমাকে কেন তুই তুই করে সম্মোধন করেছিলেন ?আমাকে তুই তুই করে বললে সেটা কি অসভ্যতামী হয় না?

আহসান সাহেব ভীষণরকম শক খেলেন।তিনি কখনোই বিষয়টি এভাবে ভেবে দেখেননি।সত্যিইতো নিজের ছেলে মেয়েকে যদি তুইতোকারি করাটা অসভ্যতামী মনে হয় তাহলে অন্য একটা ছেলেকে একটা মেয়েকে কি করে তুইতোকারি করি ভেবে তিনি কিছুটা লজ্জাও পেলেন।তিনি অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ বিধায় নিজের ভুল সাথে সাথে বুঝতে পেরে ভাবলেন ছোট হোক বড় হোক তাতে কি ক্ষমা চাইতোতো মানসম্মান চলে যাবেনা।নিজের ভুলটুকু না হয় স্বীকার করে নিবেন।এই ভেবে তিনি যখন ওর দিকে চোখ ফেরালেন তখন দেখলেন ছেলেটি নেই।আসলে ছেলেটির চমকপ্রদ কথা শুনে তিনি এতোটাই চমকে গিয়েছিলেন যে ভাবনার জগতে হারিয়ে গিয়েছিলেন।সম্বিত ফিরে পেতেই দেখলেন ছেলেটি ততোক্ষণে কোথাও চলে গেছে।

রাতে খাবার টেবিলে বসে পরিবারের সবার সাথে ঘটনাটি শেয়ার করলেন।শুনে অন্যরাও খুব বিমোহিত হলো।এমন করেতো কখনো ভেবে দেখা হয়নি।কেন একটি ছেলেকে একটি মেয়েকে তুইতোকারি করা হবে?তার সাথে যদি এমন মধুর কোন সম্পর্ক থাকতো যার টানে তাতে তুই তুই করে বলা যেত তাহলে কোন কথাই ছিলনা কিন্তু আমরা হরহামেশাই রাস্তায় টোকাই ছেলে মেয়েগুলোকে ফুলওয়ালা বাদামওয়ালা ছেলে মেয়েদেরকে তুই তোকারি করি।ঘরের কাজের ছেলে মেয়েদেরকে তুই তোকারী করি।সবাই যখন এসব নিয়ে গল্প করছিল তখন পাশে দাড়িয়ে ছিল ঝুনু।আহসান সাহেবের বাসার কাজের মেয়ে।আহসান সাহেব বললেন ঝুনু তুমি কিচেন থেকে একটা কাচা মরিচ নিয়ে আসোতো। আহসান সাহেব কথা শেষ করতেই বাকিদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।তিনি যাকে রোজ তুই তুই করে সম্বোধন করতেন আজ তাকে তুমি করে বলছেন।ঝুনুরও খুব ভালো লেগেছে।তারও নিশ্চই ইচ্ছে করতো তাকে যেন অন্যদের মত তুমি তুমি করে বলা হয়।

আইন পেশায় জড়িত আহসান সাহেব উকিল হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন তার সততা আর নিষ্ঠার কারণে।তিনি কোন মামলা হাতে নিয়ে যদি যাচাইবাছাই করতে গিয়ে দেখেন তার মক্কেলেরই দোষ তাহলে তিনি সেই মামলা নিয়ে আইনি লড়াই করতে রাজি হন না।যদিও তার মত উকিলের পক্ষে ওই মামলায় জেতাটা খুবই সামান্য ব্যপার কিন্তু তিনি কখনোই চাননা অন্যায়কে ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করতে।আহসান সাহেব ঘুমোতে যাবার আগে ভাবলেন কালকে যদি ছেলেটির সাথে দেখা হয় তাহলে ওর সাথে সুন্দর করে কথা বলবেন এবং দুঃখ প্রকাশ করবেন।পরদিন কোর্টে যাওয়ার পথে তিনি ছেলেটিকে দেখতে পেলেন না এমনকি ফেরার পথেও দেখতে পেলেন না।মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

পথের একটি শিশুর জন্য তার মন খারাপ হচ্ছে জানলে হয়তো অনেকেই হাশিতামাশা করবে কিন্তু তিনি তাতে পরোয়া করেন না।তিনি মনে করেন ভুল হলে দুঃখপ্রকাশ করাটাই উত্তম এবং দুঃখ প্রকাশ না করে যদি মারা যাই তাহলে জীবনটার একাংশ ব্যর্থ বলেই বিবেচিত হবে।তাছাড়া খুব কম মানুষ নিজেরা ভুল করলে সেটা অনুধাবন করে সত্যটা স্বীকার করতে পারে।রাতে খাবার টেবিলে আহসান সাহেবের ছোট ছেলে রিহাম জানতে চাইলো বাবা সেই ছেলেটির সাথে কি তোমার দেখা হয়েছিল।আহসান সাহেব বললেন ছেলেটির সাথে দেখা হয়নি।এভাবে দুই তিনদিন ছেলেটিকে আর দেখা গেলনা।তিনি ভাবলেন পথের ছেলে কখন কোথায় রাত কাটায় তার কি কোন ঠিক ঠিকানা আছে।ওর সাথে আর দেখা হবে কি হবেনা সেটা তার জানা নেই তবে কিছুটা আক্ষেপ থেকেই গেল যে ছেলেটির কাছে দুঃখপ্রকাশ করা হলো না।

এক রবিবার ছুটির দিনে আহসান সাহেব হাটতে বেরিয়েছিলেন।হাটতে হাটতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসেছিলেন এমন সময় দেখলেন সেই ছেলেটি আসছে।তিনি যতটা সম্ভব মিষ্টি করে ছেলেটিকে ডাকলে এই ছেলে তুমিকি একটু আমার কাছে আসবে?তোমার সাথে আমার কথা আছে।ছেলেটি আহসান সাহেবের কথা শুনে এগিয়ে আসলো তার পর বললো বলুন কি বলতে চান।না এমন নয় যে ছেলেটি আমাদের মত প্রমিত বাংলায় কথা বলেছে।সে তার মত করে আঞ্চলিক ভাবে কথা বলেছে কিন্তু ওর ভাষাকে লিখিত ভাষায় রুপ দিতে গেলে ঘটনাটি সেভাবে উল্লেখ করা যাবেনা বলেই আমাদের মত করে বলতে হচ্ছে।

ছেলেটি কাছে এসে দাড়াতেই আহসান সাহেব বললেন আমি খুবই দুঃখিত যে তোমাকে তুমি করে না ডেকে তুই তুই করে ডেকেছি। সে জন্য আমি খুবই লজ্জিত।তুমি ঠিকই বলেছ নিজের ছেলে মেয়েকে যদি তুই তুই করে ডাকা না যায় তাহলে অন্যের ছেলেকে কি করে তুই তুই করে ডাকি।আহসান সাহেবের কথা শুনে ছেলেটির মুখে হাসি ফুটলো না।তিনি জানতে চাইলেন তুমিকি তার পরও আমার উপর রেগে থাকবে?ছেলেটি বললো না আপনার উপর রাগ করিনি।যা রাগ ছিল তা চলে গেছে। তবে অন্য একটা কারণে খুব রাগ হয়েছে।আহসান সাহেব ছেলেটির কাধে হাত রেখে বললেন তোমার সময় থাকলে আমার পাশে বসো এবং বলো কি কারণে তোমার রাগ হচ্ছে।তার আগে বলো তোমার নাম কি।ছেলেটি পাশে বসতে বসতে বললো আমার নাম মিহির।থাকি কমলাপুর রেলস্টেশানে।

আহসান সাহেব দেখলেন মিহির নামের ছেলেটি তার পাশে বসলেও বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে।তিনি বললেন আমার গা ঘেসে বসো এতো দূরে বসেছ কেন?মিহির বললো সেটা হয়না।আমার গায়ে ময়লা আছে সেটাতো আপনার গায়ে লেগে যাবে।ওর কথা শুনে আহসান সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল।নিশ্চই ছেলেটা অন্যদের থেকে এমন আচরণ পেয়েছে যে ও খুব সাবধান হয়ে দূরে বসেছে।তিনি বললেন আমার গায়ে ময়লা লাগলে লাগুক তবুও তুমি কাছে এসে বসো।

কথাগুলো শুনে মিহির যেন ভীষন রকম মু্গ্ধ হলো।আহসান সাহেবের উপর সে মুগ্ধ ছিল অনেক আগে থেকেই।সে জানতো তাকে এবং সে জন্যই তার কাছে কিছু একটা বলবে বলে রোজই আসতে চেষ্টা করতো কিন্তু কখনো কথাটা বলা হতো না।এবার যেহেতু খুব কাছে এসেছে তাই কথাটা সে বলতেই পারে।তার আগে সে বললো মানুষ আমাদেরকে খুব নোংরা মনে করে।আমাদের শরীর যেন বিষে ভরা,যেন শরীরের সাথে ছোয়া লাগলে পচে যাবে।তাই সবাই চায় আমরা যেন দূরে দূরে থাকি।অথচ বাসে যে সিটে বসে যাওয়া আসা করে সেটাতেও অনেক ময়লা থাকে।তখন কিন্তু সেখানে বসলে তাদের শরীরে সমস্যা হয়না শুধু সমস্যা আমাদের বেলাতে।আহসান সাহেব খুব অবাক হন এবং আহতও হন ওর কথা শুনে।মনে মনে ভাবেন সমাজে আমাদের কত সমস্যা।আমরা ওদের কথা মোটেই ভাবিনা।

আহসান সাহেব ওর সাথে একমত পোষণ করলেন এবং জানতে চাইলেন তুমি আজ কেন রেগে আছ আর তুমি কমলাপুর থাকো তাহলে এতো দূরে কেন আসো?মিহির তখন জানালো এক বছর আগে রেল স্টেশানে একটা টোকাই ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছিল।সেদিন একটু দুরে মিহিরও ছিল আর দেখেছিল কেউ যখন এগিয়ে আসেনি তখন আহসান সাহেব ছেলেটিকে কোলে তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।সেদিন থেকেই মিহির আহসান সাহেবকে চেনে এবং খুবই ভালো মানুষ বলে মনে করে।সে মনে করে তারও যদি কখনো বিপদ হয় নিশ্চই আহসান সাহেব তাকে বাঁচাবে। আহসান সাহেবের মনে পড়ে এক বছর আগের সেই ঘটনা।মির্জাপুর থেকে ফিরছিলেন তিনি।ট্রেন থেকে নেমে সবে মাত্র প্লাটফর্মে দাড়িয়েছেন তখন ঘটনাটা ঘটেছিল।এতোদিন ধরে মিহির তার সেই ঘটনাটিকে মনে রেখেছে এবং বিশ্বাস করে বসে আছে যে তারও কোন বিপদ হলে তিনি রক্ষা করবেন এটা ভাবতেই তিনি মুগ্ধ হলেন।ওর মাথার চুলে বিলি কেটে বললেন তা তুমি এখন বলো তোমার কি সেরকম কোন বিপদ?আমার কোন সাহায্য করা লাগবে?

এবার মিহির নড়েচড়ে বসলো।বললো বিপদ ঠিক না তবে সমস্যা।কিছু লোক আছে যারা গায়ে পড়ে ঝামেলা করে তাদের নিয়ে সমস্যা।আমি তাদের বিরুদ্ধে কেস করতে চাই!!আপনি যেহেতু উকিল তাই আপনাকেই কাজটা করতে হবে!তাছাড়া আমিতো খুবই ছোট মানুষ তার উপর রাস্তার ছেলে।এমনিতেই ছোটদের কথাকে আমাদের দেশে কেউ গুরুত্বই দিতে চায় না আর সেখানে সেই ছোট মানুষ যদি পথের ছেলে হয় তাহলেতো কোন কথাই নেই।মিহিরের জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে আইন বিশেষজ্ঞ আহসান সাহেব আরো বেশি চমকে গেলেন।

তিনি জানতে চাইলেন তুমি এতো সুন্দর কথা কি করে শিখলে?কার কাছ থেকে শিখলে?মিহির জানালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো আপু আর একটা ভাইয়া কমলাপুর রেলওয়েস্টিশানে এসে আমাদেরকে পড়ায় অনেক গল্প করে।তাদের থেকেই শিখেছি জেনেছি।তবে তাদেরকেও আমার রাগের কথাটা বলিনি কারণ তারাতো আর উকিল না।ছোট্ট মিহিরের মুখে কেস করার কথা শুনে বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু নিশ্চই হবে ভেবে নিলেন আহসান সাহেব। বেলা বেশ হয়েছে,বাসায় ফেরা দরকার কিন্তু ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।ওর কথাগুলো শোন দরকার।তিনি জানতে চাইলেন কি কারণে তুমি কেস করতে চাও সেটা বিস্তারিত বলো।মিহির তখন যতটা সম্ভব ওর মত করে গুছিয়ে বলতে শুরু করলো।

শুরুটা বেশ আগের।রোজ কারো না কারো সাথে ঝগড়া লাগতো মিহিরের।ঝগড়ার বিষয়বস্তু তেমন কিছু না এই থু থু ফেলা নিয়ে।কেউ একজন থুথু ফেলছে সেটা দেখে মিহির নামের ছেলেটি রেগে উঠতো আর বলতো আপনি এখানে থু থু ফেললেন কেন?যে থুথু ফেলেছে সে অবাক হতো।জানতে চাইতো এখানে থুথু ফেললে সমস্যা কি?মিহির বলতো এটাতো আমার বিছানা এখানে কেন থুথু ফেলছেন?লোকটা তখন চারপাশ ভালো করে দেখেনিতেন।সেখানে কোথাও কোন বালিশ নেই তোশক নেই পাটি নেই।সুতরাং সেটা কি করে বিছানা হয়?মিহিরকে যখন বলা হতো এটাতো প্ল্যাটফর্ম এলাকা এখানে থুথু ফেললে সমস্যারতো কিছু নেই।ছোট্ট মিহিরের একটাই ক্ষোভ আমরাকি আপনার বিছানায় কখনো থুথু ফেলেছি যে আপনি আমাদের বিছানায় থুথু ফেলছেন।লোকটা ক্ষেপে উঠতো।মিহির তখন বলতো জানেন না এখানেই আমরা ঘুমাই তাই এটাই আমাদের বিছানা।

এসব কথা শুনে যে থুথু ফেলেছিল সে রেগে হয়তো একটা চড় বসিয়ে দিয়ে নিজের পথে চলে যেত।এভাবে রোজ চলতো কিন্তু একবার এক লোক যে প্রতিদিন উত্তরা থেকে মতিঝিলে অফিসে আসতো ট্রেনে সেও এসে থুথু ফেলতো।আসার সময় একবার যাওয়ার সময় একবার।তাকে কয়েকবার বলার পরও সে আমলে নেয়নি বরং এসেই ওখানে থু থু ফেলতো।যেন মিহিরের সাথে ইয়ার্কি করে শত্রুতা করেই থুথু ফেলছে।সেই লোকটার বিরুদ্ধেই মিহির মামলা করতে চায়।

ছোট্ট মিহিরের সব কথা শুনে আরো একবার চমকে উঠলেন আইনের সেবক আহসান সাহেব।মিহির যা বলেছে তাতেতো অবশ্যই যুক্তি আছে।ওরাতো সবাই রাস্তায়,ফুটপাথে ঘুমায় সুতরাং ওটাইতো ওদের বিছানা আর আমরা যাওয়া আসার পথে যখন যেখানে যেভাবে পারছি থুথু ছিটাচ্ছি।সুতরাং এক অর্থেতো আমরা মিহিরদের বিছানাতেই থুথু ছিটাচ্ছি।এটা নিয়ে মামলা হতেই পারে।তিনি মিহিরকে কথা দিলেন অবশ্যই তিনি মিহিরের হয়ে মামলা করবেন।তবে তিনি এও জানালেন যে লোকটি থুথু ফেলে শুধু তার নামে মামলা করাটা ঠিক হবে না তাই তিনি নিজের মত করে মামলা করবেন।মিহির খুশি মনে নিজের পথে চলে গেল আর আহসান সাহেব বাসায় ফিরলেন।বাসার সবাই খুব চিন্তিত ছিলো তিনি ফিরছেন না দেখে।

মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় ফোনটাও বন্ধ ছিল তাই সবার চিন্তা আরও বাড়ছিল।গোসল সেরে সকালের নাস্তা দুপুরে করতে হলো।তখনই তিনি মিহিরের কথাটা তুললেন।সবাই সব শুনে বেশ অবাক হলো এবং আহসান সাহেবের মেয়ে আরিয়ানা বললো বাবা ওই ছেলেটি কোনো স্কুলেই পড়েনা তার পরও ওর মাথায় এতো সুন্দর সব চিন্তা কি করে এলো?আহসান সাহেব উত্তর দিতে পারেন না।পরদিন কোর্টে গিয়ে তিনি একটি মামলা করেন।সব শুনে মামলা নিতেই রাজি ছিলনা কেউ কিন্তু আহসান সাহেবের মত মানুষকে দমিয়ে রাখা যায় না।অনেক হাসাহাসি হলো,কথা চালাচালি হলো তবে মামলা নেওয়া হলো এবং শেষ পযর্ন্ত অবশ্য সেই মামলার রায়ও হলো আর সেটা মিহিরের পক্ষেই গেল।স্থানে স্থানে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হলো যত্রতত্র থু থু ছিটানো যাবে না।কেউ থুথু ফেললেই তাকে জরিমানা করা হবে।

একসপ্তাহ পর আবার যখন মিহিরের সাথে দেখা হলো তখনো মিহিরের মুখটা কালো হয়ে আছে।আহসান সাহেব জানতে চাইলেন কি হয়েছে আবার?তোমার মন খারাপ কেন?মিহির বললো মামলা করে লাভ কি হলো?কেউতো শুনছেনা মানছে না।আসলে যাদের পরিবার থেকেই শিক্ষার অভাব আছে তাদেরকে কি আর মামলা দিয়ে আইন করে শেখানো যায়।আহসান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আর ভাবলেন এই পথের শিশুটি যতটা ভাবছে তার কিয়দাংশও যদি আমরা ভাবতে পারতাম দেশটা সোনার বাংলাই হতো,তাতে কোন খাদ থাকতো না।

জাজাফী
২০ এপ্রিল ২০১৮