[প্রতিটা গল্পের পেছনে, না বলা অনেক গল্প থাকে…।]
ভারতের তামিল নাডু রাজ্যের চেন্নাই শহর নিয়ে কয়েকদিন আগে প্রাথমিক একটা রিভিউ লিখেছিলাম। কিন্তু চেন্নাইকে ভালো করে জানতে হলে আজকের বিশদ রিভিউটি আপনাকে পড়তেই হবে….।
১) চেন্নাই শহর মুসলিম অধ্যুষিত শহর নয়, বরং হিন্দু অধ্যুষিত শহর। তবে জুমুআ’র নামাজ পড়ার মত চমৎকার মসজিদ রয়েছে। ধারনা করি তিন-চার কিলো অন্তর অন্তর মসজিদ রয়েছে। সাধারনত স্থানীয় সময় দেড়টায় খুতবা শুরু হয়, তাই জুমুআ’র নামাজের জন্যে আপনাকে আগে ভাগেই প্রস্তুতি নিতে হবে। গুগল ম্যাপে সার্চ করে মসজিদ খুঁজতে পারেন, বা স্থানীয়দের সহায়তাও নিতে পারেন।
২) চেন্নাই শহরে চোখে পড়ার মত ব্যাপার হলো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। এই শহরে প্রচুর পাবলিক বাস রয়েছে। বাসগুলো একই রঙের, একই গঠনের এবং একই কোম্পানির, শুধু বাসের নাম্বার আলাদা। যেমন- 29A, 21G, 23C, 23D ইত্যাদি। সাধারণত তিন ধরনের বাস রয়েছে- লোকাল, ডিলাক্স এবং এসি। বাসগুলোর মডেল আধুনিক নয়, তবে সীটগুলো বাংলাদেশের বিআরটিসি’র মতোই। কোন বাসেই ফ্যান দেখলাম না। ভালোলাগার ব্যপার হলো, নারী-পুরুষের সীট নিয়ে কোন বিবাদ নেই। বাসের এক সাইড জুড়ে পুরুষরা বসবে, অন্য সাইড জুড়ে নারীরা বসবে। কন্ডাক্টরের জন্যে রয়েছে আলাদা সীট। ভাড়া দেবার পর সে তার হাতে থাকা অনলাইন পে যন্ত্রের মাধ্যমে টিকেট কেটে দিবে। স্টপিজ আসলে বাঁশিতে হুঁইসেল দিয়ে বাস থামাবে। এমনকি এক টাকা বাকী থাকলেও আপনাকে ফেরত দিবে। বাস ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, অটো ড্রাইভার সবাই নির্দিষ্ট ড্রেস পড়ে। বাসের ভাড়া অনেকটা সহনীয়। বাসগুলো চক্রাকারে পুরো শহর ক্রমাগত প্রদক্ষিণ করতে থাকে। এই শহরের বাস ব্যবস্থাপনা চমৎকার। এমনকি একই রোডে পরপর ৪-৫ টা স্টপিজ এবং যাত্রী ছাউনিও থাকে। যাত্রীরা ধীরস্থির ভাবে ছাউনিতে অপেক্ষা করে। তারপর একেক বাস একেক স্টপিজে দাঁড়ায়। এতে করে সব বাস একই স্টপিজে এসে জ্যাম বাধায় না।
৩) জ্যামের রাজ্য ঢাকা শহরে থাকতে থাকতে প্রায় জ্যামহীন এই চেন্নাই শহরকে একদম অচেনা লাগে। মাঝে মাঝে সিগন্যালের হালকা দু’এক মিনিট জ্যাম ছাড়া এখানে আর কোন বাঁধা নেই। গাড়িগুলো যেন একটা নির্দিষ্ট রিদমে স্রোতের টানে ভেসে চলছে। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, কিন্তু বেহুদা ওভারটেকিং নেই, বা নেই গাড়ি নিয়ে কোন কুস্তি খেলা। অবৈধ পার্কিং নেই। প্রচুর ওয়ানওয়ে রোড রয়েছে। কোন রিকশা নেই। এখানে প্রায় সব গাড়িরই দাম কম বলে, প্রচুর মানুষ বাইক এবং স্কুটি ব্যবহার করে। স্কুটির দাম ৪০-৫০ হাজারের ভেতর। নারী-পুরুষ সবাই দেদারসে স্কুটি চালায়। পুরো শহরটাই যেন একটা বাইক-স্কুটির নগরী। হুটহাট দু’একটা সাইকেলও দেখতে পাবেন। রাস্তায় প্রচুর অটো (বেবিট্যাক্সি) রয়েছে আপনার জন্যে। আরেকটু বিলাসিতার জন্যে রয়েছে উবার এবং ওলার প্রাইভেট কার, তবে ভাড়া সহনীয়। এদের উন্নয়ন মাটির নীচেও চলে, তাইতো রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেইল। কোথাও কোন ফুটওভার ব্রীজ দেখলাম না। সিগন্যাল পড়লে মানুষ ধীরে সুস্থে রাস্তা পেরুচ্ছে। ফুটপাথ অবৈধ দোকানে ভর্তি নয়, ফুটপাথ বেশিরভাগই পরিস্কার। ফুটপাথে যেন ‘নবাবী বাইকারগন’ না উঠতে পারে তার জন্যে মাঝে মাঝে হাঁটু সমান পিলার দেয়া। খুব বেশী ফ্লাইওভার নেই, নেই ফ্লাইওভারের উপর দ্বিতল জ্যাম। পুরো শহরটাই যেন স্মুথলি রিদম সহকারে একটা ফ্লো মেনটেইন করে চলছে।
৪) সখি! তোমার সাথে দেবো পাড়ি শহর ছেড়ে শহর, রাজ্য ছেড়ে রাজ্য… দূর বহুদূর। আন্তঃশহর, আন্তঃরাজ্য ও দূরের যেকোন যাত্রায় ভারতের ৯৫% মানুষই ট্রেনে পাড়ি দেয়। যেমন কোলকাতা থেকে চেন্নাই ২৮ ঘন্টার জার্নি। ‘এ জার্নি বাই ট্রেন রচনা’ লিখে ফেলার আদর্শ যায়গা। নির্দিষ্ট টাইমে ট্রেন ছেড়ে যায়। তবে ফরেনারদের জন্যে ট্রেনের টিকেট পাওয়া দুস্কর। অনলাইনেই বেশিরভাগ টিকেট বিক্রি হয়। সে জন্যে আপনাকে কোন এজেন্সির মাধ্যমে অতিরিক্ত খরচসহ টিকেট কাটতে হবে। স্টেশনে যেয়ে টিকেট পাওয়াটা সম্ভবত একটু কঠিনই (শিউর না)। ট্রেনের পরিবেশ আমাদের চেয়ে ভালো, তবে খাবার জঘণ্য। ট্রেনে আপনার সাথে নানা বর্ণের, নানা ভাষার মানুষের পরিচয় হবে। তবে ভারতে এত পরিমান ভাষা যে, এই ভাষার কারনে পুরোপুরি ভাব বিনিময়টা আটকে যেতে পারে বন্ধু! ইশারায়ই কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
৫) চেন্নাইতে ফলের দাম আমাদের দেশের চেয়ে অনেক সস্তা। ছোট সাইজের তরমুজ ১২ রুপি, বড়টা ২৪ রুপি। আঙুরের কেজি ১১০ রুপি, আনারের দাম কম-বেশী ১০০ রুপি। আপেলের দাম ১৫০ এর উপরে হবে। তবে শুনেছি হায়াদারাবাদে ফলের দাম আরো সস্তা।
৬) এই শহরে সুলভ মূল্যে ভালো মানের পোষাক পাওয়া যায়। আমাদের দেশের মিডিয়াম কোয়ালিটির ১০০০/- টাকার শার্ট পিস এখানে ২০০ রুপি (মিটার প্রতি ৮০/ ১০০ রুপি)। আর দুই-আড়াই হাজার টাকার শার্ট পিস ৭৫০ রুপি। থ্রি পিস বা ফোর পিস তিন হাজারেরটা এখানে ৭৫০ রুপি। নরমাল থ্রি পিস ৫০০ রুপির নীচে। সাড়ে তিন থেকে চার হাজারেরগুলো এখানে ১৫০০ এর উপরে। বিভিন্ন দোকান ও মেগাশপগুলোতে প্রচুর ডিসকাউন্ট অফার পাওয়া যায়। যেমন- ভালো কোয়ালিটির দুটো জিন্স প্যান্ট ৮৫০ রুপি, ৩টি মিডিয়াম মানের হাফ শার্ট/ টি-শার্ট ৬৯৯ রুপি। আড়াই হাজারের ব্রান্ড শার্ট ৮৫০ রুপি। মিডিয়াম মানের শাড়ি ৫০০ রুপিতেও পাওয়া যায়। এখানকার ২ হাজার রুপির শাড়ির দাম বাংলাদেশে ৫-৬ হাজার টাকা পড়বে। তবে ছেলেদের শর্টসের দাম অন্যান্য পোশাকের তুলনায় বেশী। এই শহরের বিখ্যাত সিল্কের নাম- মাদার শাহ (কেউ বলে মাদারসা) সিল্ক, মুসলিম মেগাশপ। এক নামে এই বিশাল শপ সবাই চেনে। এরা নিজেরা নারী-পুরুষ সবার জন্যে কাপড় উৎপাদন করে, নিজেরাই বিক্রি করে। তবে যতটুকু জানি হায়দারাবাদ শহরে পোষাকের দাম আরো অনেক অনেক কম।
৭) তামিলরা খাবারে প্রচুর মশলা খায়। এ যেন আপনার পাতে মশলার এক জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছুটা ঝালও খায় এরা। প্রায় সব খাবারের সাথেই আপনাকে টকের একটা পদ আলাদাভাবে দেবে। ভেজিটেরিয়ান ও নন-ভেজিটেরিয়ান হোটেল রয়েছে। তবে খাবারের ক্ষেত্রে আমাদের রুচির সাথে প্রায় যাবেই না, মানিয়ে নিতে হবে।
৮) বলা হয়ে থাকে যে, পুরো ভারতের সেরা চিকিৎসা হয় চেন্নাইতে, ভারতীয়রাই বলে। বাংলাদেশের অনেকেই এই শহরে চিকিৎসা নিতে আসেন, তবে খরচ পড়ে প্রচুর। আমাদের দেশের মতোই চিকিৎসা শেষে এক্সট্রা বিল চার্জ করবে, অনেক হিডেন চার্জ থাকবে। তবে চেন্নাইতে চিকিৎসা করাতে হলে, আপনাকে হয় তামিল জানতে হবে, নয়তো ইংরেজীতে মোটামুটি কথা বলতে পারে এমন কাউকে লাগবে। আর আপনি নিজে ইংরেজী বলতে পারলে তো কথাই নেই।
৯) কালো মানুষের মন ভালো। চেন্নাইতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পেয়েছি। এই শহরের মানুষগুলোর ব্যবহার অমায়িক। যেমন আপনি কোথাও যেতে চাইছেন, কিন্তু কোন বাসে যাবেন খুঁজে পাচ্ছেন না? এরা নিজে না জানলেও আরেকজনের সাথে আলোচনা করে বাসে উঠিয়ে দেবে। এমনও হয়েছে যে, আমরা যে বাসে উঠেছি সেটা আমাদের গন্তব্যের পুরোটা যায় না। তখন কন্ডাক্টর সেই গন্তব্যে ফোন করে, শিউর হয়ে, বিস্তারিত জেনে সহজ পথ খুঁজে দিয়েছে। তামিলরা খুব সাধারণভাবে চলাফেরা করে, অহেতুক দেমাগ বা ‘আমি কি হনু রে’- এই ভাবটা এদের মাঝে দেখিনি। কোন কোন আংকেলকে লুঙি পরেও শহরের মাঝে ড্যা ড্যা করে বাইক চালাতে দেখেছি। আরো দেখেছি বুড়ি কে পেছনে বসিয়ে বুড়ো দাদু মহানন্দে স্কুটি চালাচ্ছে। আমরা মুসলিম- এটা জেনে এখানকার মুসলিমদেরকে খুশি হতে দেখেছি, সালাম দিতে দেখেছি। একটু হাসিমুখে কথা বললে বড়োই খুশি হয় এই শহরের সাধারণ লোকেরা।
♣ শেষ কথাঃ ছিমছাম এই শহরটা আমার ভালো লেগেছে, শুধু তামিল মেয়েদের ওরনাবিহীন চলাফেরা ও তরুন-তরুনীদের ফ্রি মিক্সিং ছাড়া। হয়তো এই পরিবেশে, এই সংস্কৃিতেই ওরা বেড়ে উঠেছে। তবে এই শহরেও আমি পূর্ণ হিজাবী-নিক্বাবী দেখেছি। এটা প্রমান করে দেয় যে, ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব। যদি সত্যিই আপনার মনে আল্লাহর বিধান মেনে চলার ইচ্ছে থাকে, Allah will make a way for you.
♥ শেষের পরের কথা…
কে জানে, একদিন হয়তো কোন এক তামিল কালো মায়াবতী নিক্বাবীর বাঁধনে নিজেকে বেঁধে এই শহরেই থেকে যাবো…! তবে নিজ দেশের প্রতি, নিজ মাতৃভূমির প্রতি আলাদা একটা টান সবসময় থেকেই যায়, দেশটা যেমনই হোক না কেনো।
জানুয়ারী ২০১৯,
পুরাসাওয়াকাম, চেন্নাই, তামিল নাডু।
পড়লাম। আপনাকে ধন্যবাদ।
পড়লাম।
ধন্যবাদ।
গত পোস্টে আপনার থেকে আমরা পাঠক কোন সাড়া পাইনি দাদা।
মোবাইল থেকে তেমন একটা সাপোর্ট করে না, আজ পিসিতে ঢুকে জবাব দিলাম
ভালো লাগলো । আপনার চোখে চেন্নাই শহরটা দেখে এলাম । তবে শেষের জায়গায় যেটা বললেন হিজাবি বা নিকাবীর কথা । সেটা তো ব্যক্তিগত অভিরুচি । তাছাড়া সবাই এখানে মুসলিম না । হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা । ডিফ্রেন্ট কালচার এবং ধর্মের লোকদের সহাবস্থানে কারণে ভিন্ন ভিন্ন পোশাক পড়বে এটাই স্বাভাবিক ।
ভালো থাকবেন।
হুম, ব্যক্তিগত অভিরুচির কথাই তো লিখেছি!
পড়ে জেনে নিলাম।
স্বাগতম আপু