ছোটদের গল্প আজকের ভগীরথ

ছোটদের গল্প : আজকের ভগীরথ

চার

কপালজেঠুর পাঁচ টাকা এখনও উশুল হয়নি ঠিকই, কিন্তু একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে মনের মধ্যে। সুপারের সামনেই ফস করে শুদ্ধ বাংলায় আবেদনপত্র লিখে ফেলল কর্তৃপক্ষের কাছে। সুপার সেটা জমা নেননি বটে, তবে খুব খাতির করে নাম-ঠিকানা টুকে নিয়েছেন অভিযোগ-বইতে। আর, রোগিকে অন্য ডাক্তারের কাছে রেফার করে দেওয়ার মতো বলেছেন, এই কাছেই পিএইচই-র অফিস, আপনি একবার ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন না!

কিন্তু কাছে হলেই কি সাততাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায়? রাস্তা জুড়ে অটো-টোটো-ভ্যানরিকশা-টেম্পো-লরি-বাসের শো-রুম! সেসব সাঁতরে যাহোক ক’রে এগনো, হঠাৎ দ্যাখা যায় কয়েকটা ঝকঝকে ছেলেমেয়ে, খুব ড্রেসপত্তর, হাতে বড় বড় ক্যামেরা আর পেছনে এক দঙ্গল জনতা নিয়ে এই দিকেই ধেয়ে আসছে। কপালজেঠু পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে কি, দলের একজন তার পাঞ্জাবির হাতা টেনে ধরল, হাতে গদিতে মোড়া লম্বা সরুপানা মাইক।
— দাদু, আপনি তো এই শহরেরই নাগরিক, এখানকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাস্তাঘাট এসবে সরকারি পরিষেবা কেমন একটু বলুন না!
— কেন বলতে যাব? কে আপনারা!
— আমরা “আশ্চর্য বাংলা” টিভি চ্যানেলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলায় সমীক্ষার কাজ করছি। পুরসভা থেকে নানা স্তর পর্যন্ত এই যে কোটি কোটি টাকার সরকারি পরিকল্পনা…।
— সমীক্ষা করে ঘন্টা হবে! লক্ষ-কোটি ছেড়ে দাও, আজ সকালে যে আমার বেমক্কা পাঁচটাকা বেরিয়ে গেল, তারই উশুল পাচ্ছি না।

কপাল জেঠু গড়গড় করে বলতে শুরু করেছে তার দুঃখ-হয়রানি। মাইক-ধরা মেয়েটা অর্ধেক শুনেই খুব উত্তেজিত —“এই স্বরাজ, সুধীনদাকে এখুনি ওবি ভ্যান ঘোরাতে বল। বিশাখা, পারিজাত — দাদুর সঙ্গে চলো, ডেস্টিনেশান পিএইচই অফিস।

পাঁচ
বিদ্যার্থী সংঘের সবচেয়ে জুনিয়ার মেম্বার ক্লাস ফাইভের তুহিন, সাদা মনে কাদা নেই।
— কপালজেঠু, তুমি আজ রান্না করবে না?

কপালেশ্বর সরখেল লম্বায় সাড়ে পাঁচ আর প্রস্থে তিনফুট তক্তপোষে বসে আছে। পিঠটা বেঁকিয়ে দেয়ালে ঠেসান দেওয়া। শুয়ে পড়লে দু’পা বেরিয়ে থাকে; পা সামলানো যাবে না, তাহলে মাথা ঝুলে পড়বে। তক্তোপোষের ডানদিকের একটা কোনা ভেঙে তুবড়ে গেছে। তার ওপর তোষক-চাদর এমন টানটান করে পাতা যে উদ্ধৃত অংশ “খাটের চোরাবালি” নামে কুখ্যাত। আদতে তক্তোপোষটি কপালজেঠুর দিদিমার, এখন স্মৃতিরক্ষা-অর্থরক্ষা যমজ ভূমিকা পালন করছে।

পাড়ার ছেলেপুলের পেছনে লাগাটা কপালেশ্বর উপভোগই করে, তবে উপদ্রবের খুব বাড়বাড়ন্ত হলে দলের কাউকে সে কায়দা করে চোরাবালিতে বসাবে। শিকার তো লতাপাতা ছিঁড়ে প’ড়ে খাটের গর্তে লটকে গেছে! তখন হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে হাতপা ধ’রে টেনে ওপরে ওঠাও আর কি।

চোরাবালির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিকাশ একটু সাবধানে মুখ খুলল:
— কপালজেঠুর রান্না তো সকাল ছ’টাতেই শেষ। তাছাড়া, উনি তোদের মতো ছ-সাতখানা পদ বানানো পছন্দ করেন না, বড় ক’রে একটা আইটেম তৈরি করে নেন। আজ কী রাঁধলে গো, জেঠু?
— উচ্ছেসেদ্ধ ভাত।
— দেখেছিস! আচ্ছা কাল কি খেয়েছে?
— উচ্ছে ভাজা আর ভাত।
— আগামি কাল তো রবিবার। সেদিনের কী মেনু গো?
কপালেশ্বরের মুখে খুব শান্তিমাখা হাসি ফুটে উঠেছে।
— কাল স্পেশাল ডিশ। ভাত আর আলুউচ্ছেমাখা!

ঘরের মেঝেতে বিদ্যার্থী সংঘের থিকথিকে কালো মাথাগুলো হাসিতে ওলট-পালট খেতে শুরু করেছিল সবে, হঠাৎ শীতলপাটি হয়ে গেল পুরো সমাবেশ। এই চুপ চুপ, কপালজেঠু “নতুন বাংলা”র টিম নিয়ে পিএইচই-এ প্রধান ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে ঢুকে পড়েছে!

ইঞ্জিনিয়ার বিব্রত, আবার একটু খুশিও। সবার জন্যে চায়ের অর্ডার দিচ্ছে। কপালজেঠু বলে উঠল, চা পরে হবে, আগে স্যার এক গেলাস জল খাওয়ান। তার সঙ্গে একটা লিখিত নির্দেশ করে আমার টাকা পাঁচটা ফেরত দিলে বড় বাধিত হই — বলেই অ্যাপলিকেশানটা ধরিয়ে দিল সাহেবের হাতে। সব শুনেটুনে এবার চিফ এঞ্জিনিয়ার তার জুনিয়ারকে ডেকে ধমকাচ্ছেন। সে ওখানে দাঁড়িয়েই এক্ষুনি-চলে-আসুন মর্মে ফোন করছে কন্ট্রাকটরকে।

ওয়র্ক অর্ডার বাগানো পেটমোটা ভ্যাবলা চেহারার লোকটা আশেপাশে কোথাও ছিল বোধ হয়, দুমিনিটের মধ্যে দন্ডায়মান চিফের সামনে।

— শুনুন, আজকের মধ্যে জেলা হাসপাতালের সবকটা ট্যাপে সাপ্লাই চালু করতে হবে। চেক করুন, কোন-কোনটা রি-সিংক হবে আর কতগুলোয় ছোটখাটো মেরামতি। যত রাতই হোক, আমি দেখতে চাই কাজ শেষ হয়েছে। আমাকে রিপোর্ট করবেন কাল ঠিক সকাল দশটায়, এক মিনিট দেরি হলে সরকারি কনট্রাকটরের লিস্ট থেকে আপনার নাম চিরকালের মতো বিদায় নেবে।

টিভির ছবিতে যেমন চটাপট হাততালি পড়ল, তেমনি কপালজেঠুর ঘরেও। কোনও কোনও বিদ্যার্থী সিটি পর্যন্ত দিচ্ছে!

এবার ইঞ্জিনিয়ার তার হাত ধরে বলবে: এই তৎপরতার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ, মিস্টার সরখেল। আজ দেশে আপনার মতো কিছু সচেতন ও সক্রিয় নাগরিক আছে বলেই…। (টিভি ক্যামেরার দিকে ঘুরে) উপস্থিত সবাইকে “আশ্চর্য বাংলা” চ্যানেলের মাধ্যমে অনুরোধ করছি, জেলার কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জলের কল ভেঙে নষ্ট হয়ে আছে দেখলেই খবর করুন আমাদের দপ্তরে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে অ্যাকশান নেওয়া হবে, কথা দিলাম।

শেষে ক্যামেরায় চ্যানেলনেত্রীর মুখ। “আপনারা শুনলেন চিফ ইঞ্জিনিয়ারের বক্তব্য। শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, যে-দেশের মন্ত্রীসভায় কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ পেশ করা হয়, সেখানে দিনের পর দিন গরীব অসুস্থ মানুষের পানের জলটুকু না জুটলেও মন্ত্রী-আমলাদের ঘুম ভাঙে না। আবার সেই দেশেরই একজন সাধারণ মানুষ শুধু পাঁচটা টাকা ফেরত চেয়েই একটা জেলার প্রশাসনে সাড়া ফেলে দিতে পারেন। এ-যেন এক নতুন গান্ধিগিরি। নাকি বলবো, সূর্য বংশের রাজা ভগীরথ শুকনো কলে তেষ্টার জল বইয়ে দিতে আবার ফিরে এলেন আমাদের রাজ্যে। ক্যামেরায় রজতাভের সঙ্গে আমি হৈমন্তী, “আশ্চর্য বাংলা”।

ছয়
অতএব, হইহই করে সবাই উঠে পড়েছে। কাল থেকে দুবার রিপিট টেলিকাস্ট হয়ে গেল প্রোগ্রামটার! “জিও কপালজেঠু, তোমার জন্যে আমাদের পটাশপুর এখন সেলিব্রিটি-পাড়া। এবার চল, সমীর পালকে অ্যাডভান্স না করে রাখলে কাল সকালে দেখবি সবক’টা প্রতিমা বেচে দিয়েছে। কারা কারা ফুলের মার্কেটে যাবে ঠিক করো।”

উঠোনে নামতেই ডানদিকের শিউলিগাছ ঘেঁষে একটা আবছা চেহারা, সড়াৎ করে পিছিয়ে গেল নারকোলগাছের আড়ালে।
— কে ওখানে ভাই? বেরিয়ে এসো। বক্তা সুরথ, বিদ্যার্থী সংঘের সবচেয়ে ঘ্যামা মেম্বার, ক্লাবের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিতও। ক্লাস এইট পাশ করে অল্প কিছুদিন লেদ কারখানায় ঢুকেছে।

দুদ্দাড় করে বারান্দা থেকে নেমে এল কপালজেঠু। আরে, সহদেববাবু না! এদিকে কোথায়?
— বাবু বলে লজ্জা দেবেন না, সার। গতকাল আপনি “আশ্চর্য বাংলা”কে ঘুরিয়ে পিএইচই অফিসে নিয়ে না ফেললে আমরা, হচ্ছে গিয়ে, সুনামি-বৃদ্ধ হয়ে যেতাম। ওদের তো কাল জেলা হাসপাতালই টার্গেট ছিল।

— তা এই সুনামি-বিদ্ধ কথাটা কার মুখ দিয়ে বেরলো?
— কেন সার, সরকার সায়েব — মানে আমাদের সুপার। ওনার গতকাল থেকে খুবই লজ্জা। টেলিফোনে বন্ধুকে বলছিল, বুড়ো বয়েসে লোকটা আমাকে আচ্ছা শিক্ষা দিয়ে গেল।

মাথা নিচু, অ্যাটেনশান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সহদেব। উশখুশ-অন্তে সামনে আনলো ডান হাত, তাতে প্রকাণ্ড এক সন্দেশের বাক্স।
— উনি পাঠিয়েছে। যদি অনুগ্রহ ক’রে গ্রহ…।

ফিনিশিং
এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি বর্ধমানের ঘোষ সুইটসের পঞ্চাশ পিস প্রাণহরার প্যাকেট সুরথের হাতে দোল খেতে খেতে পুজোমণ্ডপ অভিমুখে যাত্রা করেছে। তবে মিষ্টিটা ওদের হাতে তুলে দিতে গিয়ে কপালজেঠুও ঠিক পঞ্চাশ বার বলেছিল: এক পয়সাও চাঁদা ঠেকাতাম না। তোদের ভাগ্যি ভালো পাঁচটা টাকা ফেরত এল সরকার থেকে।

1 thought on “ছোটদের গল্প আজকের ভগীরথ

  1. আপনার লিখনীর প্রাণ হচ্ছে উপস্থাপনা।
    স্বভাব এই ভাবমূর্তি খুব কম মানুষের মধ্যেই আমি দেখেছি।

    শুভ সকাল এবং সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি প্রিয় চন্দন দা। ভালো থাকুন।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।