গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
দশ
আমি এই গদ্যের শুরুতে বলেছিলাম ওরে গৃহবাসী গানটার গণসংগীত হয়ে ওঠার দারুণ সম্ভাবনা ছিল; হাতে পেলে কবীর সুমনই বানিয়ে ফেলতেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আসল-মা কড়ি-মা সব কায়দামতো লাগিয়ে এমন ব্যাপার করে বসলেন যে সঞ্চারী আসতে আসতেই দেখি বসন্তের উদাস হাওয়ার ভেতর মধুর মতো কান্নাবিন্দু জমে গেছে।
বিধির বিধান কাটবে তুমি বা সংকোচের বিহ্বলতা-ও সেই ভাষাগত দক্ষতা নিয়ে জন্মেছিল যা কম্পোজারকে লোভ দেখায় হুকুমের সুর বসাতে। সুরের যে আদিগন্ত মাঠ পড়ে আছে, সেখানে বর্ষার নতুন চারা-জলে আপনি ঘুনসি পাতার মতো এক-ছেলে এক-মেয়ে পাশাপাশি রেখে দিলেন। ফলে যা হল তাকে প্রেমের গান বলে বিশ্বসুদ্ধ সবাই। আবার হতে পারে সন্ধেচাঁদের কেরামতি ফুটতেই ওই মাঠে লম্বা ঘাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সাঁজোয়া গাড়ি আর সৈন্যেরা লাফিয়ে প’ড়ে কুঁজো হয়ে দৌড়ে গেল, পোজিশান নিচ্ছে, গুলি ছুঁড়ল, আবার ছুট। পেছন থেকে হাত-মাইকে ভেসে আসছে সুরকার কম্যান্ডারের নির্দেশ।
গানকে যুদ্ধ হিসেবে নেওয়া এই গণসংগীত স্বরের বিশেষ ওঠাপড়ায় যাবে না, নৌকো বাঁধবে না মন্দ্র সপ্তকে। রাগ সংগীতের কিছু অংশ, রবীন্দ্রনাথ যাকে তিতিবিরক্ত হয়ে বলেছিলেন ওস্তাদি গান, সেখানেও প্রভূত সমরসজ্জা দেখি, সেই সঙ্গে ফটাস, দুড়ুম, গলগল… বোঝা যায় গণসংগীতের সঙ্গে এদের আসন-সমঝোতার সম্ভাবনা কতটা উজ্জ্বল হয়ে আছে।
আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের কোথাও এমন গণগানের সুর কি ভেসে বেড়ায়, ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে’ যেমন? বা, ‘জয় তব বিচিত্র আনন্দ হে কবি’!
আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন, ‘জয় প্রবল বেগবতি সুরেশ্বরি জয়তি জয় গঙ্গে’ গানটা যদুভট্ট রঙ্গনাথ ছদ্মনামে লেখা তার সঙ্গীতমঞ্জরী বইতে নিয়েছিলেন। সেই গঙ্গাস্তোত্রকে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরোপাসনামন্ত্রে পালটে দিলেন; রাগ বৃন্দাবনী সারং, তাল তেওড়া বহাল থাকল।
এই গানের সুরের খাড়া ধাক্কাগুলো আর পর্বতারোহী ভঙ্গি শুরুতে শ্রোতাকে অপ্রস্তুত করতে থাকে কিন্তু বেশিক্ষণ আঘাত করতে পারে না, কেননা রবি ঠাকুরের শ্লোক এসে শুনিয়ের পিঠে হাত রেখেছে — জয় অমৃত তব, জয় মৃত্যু তব, জয় শোক তব, জয় সান্ত্বনা। কথাগুলো যেন সুরের একমুখী অগ্রগতির সম্বিত ফেরাতে তার কানে কানে বলছে: পেছনে তাকিয়ে একবার দ্যাখো, আমি বিনাশেরও জয়ধ্বনি দিয়েছি, সাপোর্ট করেছি সন্তাপকেও। তাই তুমি শমতায়, সাম্যে থাকো। এইভাবে পূজা পর্যায়ের গানটার সুরে যে নিরাশ্রয়তা, তাকে কথা আরও একবার ক্ষতিপূরণ দেয় যখন সে পুজোর শঙ্খশব্দের মধ্যে ভালোবাসার একগুছি ধূপকাঠি জ্বালালো — ‘জয় প্রেমমধুময় মিলন তব’ এবং তার পরেই আবার অনাসক্ত প্রমাময় করে তুলল সেই অনুভবকে: ‘জয় অসহ বিচ্ছেদবেদনা’।
শুনতে শুনতে মনে পড়ে সনমজিৎ তলওয়ার-এর লেখা ডিশকিয়ায়োঁ (Dishkiyaoon) সিনেমার একটা ডুয়েট, পলক মুছাল অরিজিৎ সিং-এর।
প্রথম স্তবক (অরিজিৎ গাইছে)
তূ হী হ্যায় আশিকী তূ হী আওয়ারগী
তূ হী হ্যায় জিন্দগী তূ হী জুদা
[তুই প্রেম, তুই স্বেচ্ছাচারিতা, তুই জীবন, তুই বিচ্ছেদ]।
দ্বিতীয় স্তবক (অরিজিৎ গাইছে)
তূ ইবতেদা মেরী/ তূ ইন্তেহা মেরী/ তূ হী মেরা জাহাঁ/ তূ হী জুদা
[তুই আমার শুরু/ তুই আমার অন্তিম/ তুই আমার পৃথিবী/ তুই বিচ্ছেদ]।
প্রায় কাছাকাছি অর্থের আরও এক পিস অরিজিৎসংগীত “আজ ফির তুম পে-র চতুর্থ স্তবক:
তূ হী মেরী আওয়ারগী/ তূ হী দুয়া হর শাম কী
তূ খামখা তূ লাজমি/ তূ হী রজা, তূ হী কমি
অর তূ হী ওহ ফিরাক হ্যায় জিসকো
হ্যায় সিলসিলোঁনে মেরে পাশ লায়া
[তুই আমার স্বেচ্ছাচারিতা, তুই-ই আমার প্রতি সন্ধ্যার প্রার্থনা। তুই আমার অকারণ, তুই-ই আমার অবশ্যম্ভাবী। তুই আমার ইচ্ছে (Willingness), তুই আমার অসম্পূর্ণতা। আবার তুই সেই বিরহ যাকে ঘটনাক্রম আমার কাছে এনে ফেলেছে]।
এই গানের লেখক আজিজ কাইসি আর অর্কপ্রভ মুখার্জি। শুধু দুটো শব্দের অন্য গভীরতর অর্থের দিকে আমি পাঠকের মুখ ফেরাতে চাইবো। একই নারী থেকে পরিচর্যা পাওয়া দুটো বাচ্চার মধ্যে যে বন্ডিং থাকে, ‘রজা’ হল তাই। আর ‘কমি’ — জাপানি শিন্টো ধর্ম অনুযায়ী দিব্য অস্তিত্ব, ঈশ্বর।
তাহলে ‘জয় তব বিচিত্র আনন্দে’ ছিল ঈশ্বরের সমগ্রতার কথা। উপনিষদের সর্বেশ্বরবাদ মানলে ঈশ্বর বিশ্বের মধ্যেই ক্রিয়াশীল এবং বিশ্বকে ব্যাপ্ত করে আছেন। এই ব্রহ্মই ভুবনের উপাদান, বসুমতীর বিভিন্ন রূপও তিনি, ধরিত্রীর নিমিত্তও সেই ঈশ্বর, আবার পৃথিবীর উদ্দেশ্য কারণও স্বয়ং ব্রহ্মা। এই জগতের প্রতিটি ক্রিয়া তাঁরই অপরিহার্য কাজ। সুতরাং তথাকথিত ভালোটুকু ঈশ্বরের দেওয়া আর তথাকথিত মন্দের দায়িত্ব অন্য কারও এমনটা তো হতে পারে না! তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টি আর তাঁর প্রলয় দুইয়েরই জয়পতাকা ওড়ালেন। অরিজিৎসংগীতেও নীতিগতভাবে ওই কাজটাই করা হল ঈশ্বরকে প্রেমিকা দিয়ে রিপ্লেস করে — যে ভাবমর্ম, আমরা জানি, মানুষের মনে কম প্রাচীনতা লাভ করেনি।
(আরও বাকি)
সরল সমীকরণের বিশ্লেষণ। দুর্বোধ্যতা নেই। যারা নতুন এই খণ্ডের সাথে পরিচিত হবেন; আমার পরামর্শ থাকবে সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিকে পূর্বাপর লিখা গুলোতে চোখ বুলিয়ে নেয়ার। সহজ হবে।
ধন্যবাদ প্রিয় কবি এবং আলোচক চন্দন দা। শুভ সকাল।
দ্বিমত নেই যে, অসাধারণ আলোচনা। বিবিধ ভাবে আমি আপনার সাথে একমত দাদা।