গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
এগারো
কিশোর কুমারের তিরিশ বছরের তিথি (১৯৫৫-১৯৮৫) পার করে আরও তিনদশ অব্দ পরে ২০১৫-য় অরিজিৎসিংগীত উঠে এসেছে। এই মাঝ সময়ে হিন্দি সিনেমার প্রেমের গানে ভাবের জ্যামিতি আস্তে ক’রে ঘুরে যাচ্ছিল। ‘তূ মেরী হ্যায়’ থেকে ‘ম্যায় তেরা হুঁ’ সেই বিবর্তন; যা পুরুষের নিজের বিরুদ্ধে এক বিপজ্জনক কিন্তু ওভারডিউ বিদ্রোহ। নিজের ক্ষমতাসীন আইডেনটিটি ধ্বংস করে এই যে প্রিয় নারীর সামনে হাঁটু নামিয়ে বসা, তাকে ঈশ্বরী মেনে আত্মসমর্পণ — এই দর্শনক্রিয়ার হুইসেল ব্লোয়ার না হলেও প্রধান অগ্নিহোত্রী নিশ্চয়ই অরিজিৎসিংগীত।
এইভাবে এখনকার হিন্দি সিনেমার গানে অহংশূন্য হল পুরুষসত্তা, ভালোবাসার যা প্রথম নিধি। নিশিতানি বলেছিলেন না, আধুনিক মানুষের নিজেকে জানা বিষয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের ইগো-কে জানা? অবশ্য জাপানের অধ্যাপকের কিছুটা আগে দাঁড়িয়ে আছেন সন্ত কবীর:
পীয়া চাহৈ প্রেম রস, রাখা চাহৈ মান
দোয়ে খড়্গ এক ম্যায়ন মে, দেখা শুনা না কান
[হয় তুমি প্রেমের রস পান করো, অথবা নিজের অহংকারকে বাঁচিয়ে রাখো। দুটো খড়্গ একই খাপের মধ্যে বসে আছে — এমন ঘটনা চোখ কখনও দেখেনি, শোনেনি কানও]।
গুছি গুছি উদাহরণ হরণ করে আনা যেতে পারে, কিন্তু আলোচনার সুবিধের জন্যে সুনিধি চৌহান-অরিজিতের ‘দরখাস্ত’ গানটাই আমি বাছব। শুরুতেই সুনিধি বলল: এসো, আমাকে এতোটাই ভালোবাসবে যা আমি কখনো ভুলে যেতে পারব না। উত্তরে অরিজিৎ: অনুরোধ (দরখাস্ত) এই যে, আমার দুবাহুর মধ্যে এসে তুমি বাকি পৃথিবীকে ভুলে যাও।
দেখুন, এখানে নায়িকার নির্দেশমূলক অনুরোধের বদলে নায়ক একটা প্রস্তাবমূলক অনুরোধ পাঠাচ্ছে। সে তৎক্ষণাত “তো আ যা মেরি বাহোঁমে” বলে কিশোর-ভঙ্গিতে নায়িকার চার্জ নিয়ে বসেনি। ‘গুজারিশ জান হ্যায় ইয়ে” ব’লে প্রার্থনা জানাচ্ছে — জীবনে যতটুকু সময় অর্জন করতে পেরেছ, সব আমার নামে লিখে দিও তুমি!
দ্বিতীয়ত, এই গানে যৌনসম্পর্কের মেটাফর — এসো আমরা একে অন্যের শরীরে এমন ক’রে স্পর্শের আলপনা আঁকি যা কোনও বৃষ্টি মুছে দিতে পারবে না — নায়িকা গাইছে, নায়ক নয়। সত্যি বলতে, এই কামনাসিক্ত গানটায় অরিজিতের লিরিকে যৌনতার লেশমাত্র নেই।
তিন নম্বর ব্যাপার: নায়িকা এখানে পরিযায়ী আর ছেলেটি স্থানবন্দী, অপেক্ষারত। সুনিধি বলল,
তুঝসে তো হুঁ ম্যায় ইয়ুঁ বহোত মুতাসির
পর ক্যা করুঁ ম্যায় হুঁ এক মুসাফির
[তুমি তো আমাকে খুবই প্রভাবিত করেছ; কিন্তু কী করি বলো, আমি যে একজন পর্যটক]।
মানে, নায়িকাকে চলে যেতে হবে ভালোবাসার বাঁধন কেটে। ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারোঁ ব’লে কিশোরযুগে ঘুরে বেড়াতে আমরা তো স্বয়ং হিরোকেই দেখতাম। এবং কালাপাত্থর-এর ‘এক রাস্তা হ্যায় জিন্দগি’ গানে (যেখানে হয়তো হিরো হন্ডাও ছিল) দরখাস্ত-এর ঠিক উলটো কাহিনি। বাইক-আরোহীকে লতা ডাক দিয়েছেন,
ও জাতে রাহী ও বাঁকে রাহী, মেরে বাহোঁ কো ইন রাহোঁ কো
তূ ছোড়কে না জা, তূ ওয়াপস আ জা
জবাবে খানিকটা আজকের সুনিধির মতো কিশোর বলেছিলেন,
রূপসৌন্দর্যের দৃশ্যই হোক বা বাসনাময় প্রেমের ডাক
স্বাধীন পাখির উড়ানকে এসব কিছুই থামাতে পারে না।
যদিও দরখাস্ত-এর একদম শেষ স্তবকে নায়ক-নায়িকা একই সমে এসে মিলছে, তবু সাহির লুধায়ানভি-র ১৯৭৯ সালে লেখা মুক্তপুরুষের গানখানা ২০১৬-তে সয়ীদ কাদরি-তে এসে দুই সমকোণ ঘুরে এক মুক্তমনা নারীর সংলাপ হয়ে উঠল। অরিজিৎ শুধু বারবার ‘তু মেরি বাহোঁমে দুনিয়া ভুলা দে’-র গুজারিশকে মধ্যসপ্তকের বীজতলায় একটু নাড়াচাড়া করে একলাফে তারা-র দ্বিগুণ অক্টেভে নিয়ে ফেলতে লাগল; আর ততই আর্তির রক্ত ছিটকে লাগল আমাদের চোখেমুখে!
নারী-পুরুষ সম্পর্কের মধ্যে এই রোল রিভার্সাল অরিজিৎযুগের এক মৌলিক পহচান।
(লেখাটা শেষ হতে ভুলে গেছে)
এমন লিখার শেষ হতে ভুলে যাওয়াই উচিত। আমার মতো যারা সত্তর আশি'র দশকে প্রচুর গান শুনতাম বা শুনতেন; তাদের কাছে এই বিশ্লেষণ এর স্বাদ অসাধারণ লাগবে। যেমন আমার। মুগ্ধ হলাম প্রিয় চন্দন দা। চলুক।
একাদশ শুরু হতেই না হতে শেষ হয়ে গেলো। মন ভরলো না। আরও বড় করে চাই।