সে কাহার জন্য

আমার ঠাকুরদার পরিবার ছিল, খুলনার ভাষায়, ধানী-পানি গিরোস্তো। দক্ষিণ-এ মানে সুন্দরবন এলাকায় তাদের আবাদ বেশ কিছু-ঘর প্রজা সমেত। এ-হেন ফ্যামিলিতে মেধাবী, সুপুরুষ কিন্তু বিবাগী প্রকৃতির ছোট ছেলেটিকে নিয়ে ছিল অগাধ দুশ্চিন্তা। বছর তেরো বয়েসে একবার বাড়ি পালিয়ে ঢাকায় হাজির হয়েছে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সন্নিসি হবে বলে। মাস কয়েক আগে তো কলকাতা পর্যন্ত ছুটেছিল রামকৃষ্ণ মিশনের মঠে গিয়ে থাকার ইচ্ছেয়। কাজেই অল্প বয়েসে সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ উপাধি পেয়ে দৌলতপুর স্কুলে মাস্টারি জুটে যেতেই বাড়ির লোকজন বাবাকে সংসারী করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঘটক খবর নিয়ে আসে — পালটি ঘর, সম্পন্ন পরিবার, সুন্দরী পাত্রী; কিন্তু বাবার সেই এক কথা, সংসার করার জন্যে তার জন্ম হয়নি!

এর মধ্যে এক বর্ষাভোরে সেনহাটির লাগোয়া গ্রাম মহেশ্বরবাসা থেকে বিধবা মহিলাটি এসে খুব করে ধরে বসলেন আমার ঠাকুরদাকে। তার দুই মেয়ের বড়কে যদি একটিবার দেখে আসা হয়। মেয়ের বাবা যাত্রাদলে বাঁশি বাজাত, হঠাৎ করে তিনদিনের জ্বরে মারা গেছে গতবছর। তারা নিতান্ত গরীব, দেওয়া-থোয়ার সামর্থ নেই, মেয়ে যে রূপবতী এমন দাবীও করছেন না (পরে নাতিকে দেখলে মালুম হবে), কিন্তু তবু…।

টালির চাল ফুটো হয়ে বিছানা ভেসে যাচ্ছে, এদিকে ঘরে ডুগি-তবলা, হারমোনিয়াম, ফ্লুটবাঁশি… এককোনে ছেঁড়া চাদরে জড়ানো একটা এস্রাজও। গান জানো, মা?

শ্যামরঙা রোগাসোগা মেয়েটা গাইবে, “দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল…”। শেষ হতে সে মুখ-নিচু ব’সে, আর চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে আমার বাবা, ঠাকুরদা, দুই পিসি…গোটা শ্বশুরবাড়ি টিম।

এরপর থেকে প্রতিদিন সন্ধেবেলা সেনহাটির সেই ভদ্রাসনে হাঁক পড়ত, কী ছোটবৌমা, আজ আর রবি ঘটকের গান শুনতি পাবো না বুঝি!

একা রবীন্দ্রনাথ কেন হতে যাবেন, চৈত্র মাসে জামরুলপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোকিল, সুচিত্রা সেনের একটি অপাঙ্গ, ফিদা হুসেনের ক্যানভাস উপচে পড়া স্টাডি, কিটসের চার লাইন, শ্রাবণের বিস্ফোরণে নিহত কামিনীফুলের টুকরো হওয়া কিন্তু অটুট গন্ধের শবদেহ — এরা সবাই ঘটকালি করে যাচ্ছে সেই কবে থেকে, নারীপুরুষের শাঁসের ভেতর…।

9 thoughts on “সে কাহার জন্য

  1. লিখাটিকে অসাধারণ ই বলা যায়। উপস্থাপনা এতোটাই মনকাড়া যে, অবাক হতে হয়। অভিনন্দন প্রিয় কবি চন্দন দা। :)

  2. এতোটাই ভালো লাগলো যে, কোথা থেকে ভালো লাগা অংশ কোট করবো তার উপায় পেলাম না।  https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

  3. অভূতপূর্ব একটি লিখা পড়লাম চন্দন দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  4. অনুভূতির গাঁথুনী সম্মোহন করার মতো। ভালো লাগ।।   

  5. ভালো লাগার এক কাহিনী। যতই পড়ি, ততই ভালো লাগে। এ যেন ভালো লাগার এক জীবনের গল্প।   

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।