পরপুরুষ

এক
এক দশকে তাদের একবারও দেখা হয়নি! বিশ্বাস হচ্ছে না? আসলে দুজনের কেউ-একটা অনিচ্ছুক হলেই সাক্ষাৎ অগুন্তি কাল ধরে পিছিয়ে যেতে থাকে।

ডিভোর্সের পরের মাসেই অরুণাভ বদলি হয়ে কলকাতা অফিসে চলে এল। শেক্সপিয়ার সরণি থেকে রাসেল স্ট্রিটে অদিতির ব্যাংক কতটুকু? তবু দশ ইন্টু তিনশো পঁয়ষট্টি ইনটু চব্বিশ ঘন্টা লেগে গেছে দুজনের মুখোমুখি হতে!

ফ্লাইট ন’টা দশে, বোর্ডিং টাইম আটটা পঁয়ত্রিশ। সে এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ঘাঁটছিল। হাতে বারো মিনিট, মানে কেএফসি থেকে একটা মুরগির ঠ্যাং সাঁটানোর পক্ষে যথেষ্ট — ভাবতে ভাবতে হাই উঠলো। মুখে হাত চাপা দিয়ে বাঁদিকে ঘাড় ঘুরিয়েছে কি…

অদিতি! ঝপঝপ করে হাঁটছে, সঙ্গে কে, গৌরবই তো। দশ বছর পিছিয়ে গেলে পাঁচ বছরের সংসার ছিল তাদের, তারও আগে তেরো মাসের প্রেম। তখন থেকে অরুণাভর কাছে শ্বেতপাথরের নগ্ন মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সময়; যদিও তার এক্স-বউ, হয়তো অরুণাভর ফিরে আসার সম্ভাবনায় ভয় পেয়েই, দু’বছরের মধ্যে ছোটবেলার বন্ধুকে বিয়ে করে বসেছিল।

আমি এতক্ষণ ধরে দিনমাসের হিসেব দিয়ে যাচ্ছি, তাই না? জীবন আসলে সংখ্যারই খেলা। সবাই বোঝে, সাড়ে দশ বছরের বড় বর তার গিন্নির সঙ্গে কিছুতেই ম্যাচ করতে পারবে না। অরুণাভ সরকার হোন না যতই হিন্দুস্তান লিভারের কমার্শিয়াল ট্যাক্স ম্যানেজার, যতই সারা বছর চরকিপাক মেরে বেড়ান কোম্পানির পনেরোটা ইউনিটে, বর্ধমানের ধ্যাড়ধেড়ে অম্বিকা-কালনায় তার শেকড়, যেখানে পরপুরুষ শব্দটা হচ্ছে মেয়েদের কাছে স্বামী ছাড়া অন্য সব ছেলের এক-কথায়-প্রকাশ!

দুই
অদিতিও তাকে দেখামাত্র চটাং করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আড়াআড়ি পার হয়ে যাওয়ার সময় একবার মেপে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল অবশ্য, কিন্তু হাঁ করে এদিকেই তাকিয়ে আছে শয়তানটা। ওই পাগলের সঙ্গে এ-জন্মে চোখাচোখি করার ইচ্ছে নেই আর।

দা গ্রেট তারকাটা পরিবার তো অরুণাভদের!বাবা বুড়ো বয়েসে কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকতো খাটের পায়ার সঙ্গে, এবং ওর ছোট মাসিকে বিয়ের একমাসের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি কর্তৃক খাট-আলমারিসহ ওয়াপস! সেই বাড়ির মেজোপুত্রের মাথাখারাপের সঙ্গে উপরি পাওনা সন্দেহবাতিক। ইনস্যানিটির দু’কোটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ডিপ নেক ব্লাউজ কোনও কালেও পরতো না অদিতি, অথচ অসভ্য লোকটা অশান্তি শুরু করলো — “ছেলেরা তোমার পিঠের দিকে লোভীর মতো তাকিয়ে থাকে, খুব কষ্ট হয় আমার! তুমি ভিড়টিড়ের মধ্যে আঁচলটা নয় একটু পিঠের ওপর…।”

মানে, স্লো মোশানে দু’চারটে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া ছাড়া বুড়োর আর কোনও গুণ স্নিফার ডগ লাগিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওহ ভালো কথা, গৌরব আজ কটন বাডস আনতে ভুলে যায়নি তো?

তিন
শিলিগুড়ির টিটি-কোচের মেয়ে, প্লেন উথাল আর পাথালের সময়ে তুলোগোঁজা কান শক্ত দুহাতে চেপে রাখতো যে, তার মোস্ট অপছন্দ ছিল রবীন্দ্রগান। তারপর হঠাৎ এক ব্যাঙ্গালোর-কলকাতা উড়ানে ধরিত্রীর সাতশো কোটি মানুষকে হতবাক করে বলে ওঠে, “গান শোনাও প্লিজ; না না অরিজিৎ সিং নয়, অরুণাভ সরকারের”! তাড়াতাড়ি ইউ টিউব থেকে নামিয়ে রাখা নিজের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত চালিয়ে হেড ফোন অদিতির কানে গুঁজে দিলে শান্তিতে চোখ বুজেছিল সে। পরের তিন বছর প্লেনে উঠলে ওটাই নিয়ম।

আজ আবার সেই চেনা পারফিউমের ঝটকা, ঠিক তিন সেকেন্ডের জন্যে ফিরে আসা প্রত্নযুগ। অরুণাভর চোখ শিউরে উঠল অদিতির শিরদাঁড়ার পেছল পুষ্প উপত্যকায়, তৎক্ষণাৎ মুছেও গেল — মেয়েটা পিঠে আঁচল টেনে দিয়েছে!

নিভে যাওয়া চিতার কাঠে খইয়ের মতো আগুনের ফুলকি ফুটেছিল দেখার সঙ্গে সঙ্গে, এবার ওরা উড়তে লাগলো অরুণাভর চোখের তারায়! আমাকে বাতিল করলেও আমার সব আর্তিগুলো তাহলে মুছে দাওনি, সোনা!

তক্ষুনি পিঠোপিঠি ভাইয়ের মতো এল পরের ভাবনাটা। অরুণাভ টের পেল, শাবলের চাড় দিয়ে মাটি থেকে ফুলগাছ উপড়ে তোলা হচ্ছে:

আচ্ছা, অদিতি আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়েই গা ঢেকে নিলে কেন…ওহ, আমিও তো এখন পরপুরুষ! বন্ধু প্রেমিক বর বা ঝগড়ার উপলক্ষ্য কিচ্ছু নই। চোখ নাক ঠোঁট না-থাকা এক মুখ, স্বভাবহীন, নিশ্চিন্ত অচেনা…!

8 thoughts on “পরপুরুষ

  1. চমৎকার পরিচ্ছন্ন অণুগল্প কবি চন্দন দা। অভিনন্দন জানাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।