চটকপুর

এক
যত বিনোদ-অরণ্য পার হলাম… ওপরে
মহাফার্নের উড়োসেতু, নীচে জলখোয়ার শিঞ্জিনী;
ওপরে চিতাবাঘিনীর পা, নীচে ওর ঠাকুরপো
বাঁদরলাঠি ফুল — সবই তোমার সামান্য ধন;
রাতে পাহাড়ের দরজা খোলা রেখে
সকালে জ্বর বাধানো বিজুবন…
হাসপাতালে বাবার শ্বেতমর্মর মুখ মনে এলে
আমি মেঘের গলা জড়িয়ে শুই; ঝুলন্ত দু’পা-র
শতকোটি নীচে খাদের অসীম ডিগবাজি —
সমস্তই তোমা থেকে পাওয়া দেহরূপ;
যত প্রজাপতিডাকা ঘাসের গোছ,
মধ্যে সঞ্চিত জলনিধি, আর ডাকবাক্সের মতো
পুরোনো পাথর
আমাকে অসুস্থ করা এই যে সুন্দর…

দুই
নিস্তব্ধতার ন’মাত্রা ভেতরে বসে আছি
মনের পাঁজর বহু উঁচুতে উঠে গিয়ে হোম স্টে,
সেখানে ওরা দুহাতে ধ’রে টবে বসাল আমাকে —
হায়াসিন্থচারা। পাশে পাশে চড়াইঘুঙুর ,
টাল খেয়ে মাটাল হওয়া জলফোঁটার রেজাই…
করমর্দন করলাম কিছুটা বৃষ্টির সঙ্গে।
সঙ্গীর জন্যে সব সময় খোঁজ, তারই নাম
একাকিত্ব… একটা চেয়ার রেখেছি চিতা
আসে যদি, ক্লান্ত থাকলে পাশের খাটে
লাল ব্ল্যাংকেট; মাথার পেছনে পড়াশুনোর বাতি।
হতে পারে সে বাথরুমের স্কাই লাইট ভেঙে এল
আমার শরীরে যে অরণ্যসিক্ত গন্ধ, যে এলোমেলোতা মাথার চুলে — তার টানে,
একই দাঁতের বন্ধু দেখে কামক্রোধাতুর…

তিন
তার গল্প সব্বার মুখে… চিতওয়া-বাচ্চাদের
কোন হ্রদের কিনারে দ্যাখা গেছে। বড় মেয়ে সোনাদাস্কুলে ভর্তি হয়েছিল, ছুটিতে তার
কালো ছোপ ছোপ মাথা রান্নাঘরে চোখে পড়ে — গেস্টদের বিকেলের চাট বানিয়ে দিচ্ছে
তোমরা পাহাড়ে সারাদিন লোহার টিনে পেরেক ঠুকে দ্বিতীয় পাহাড় তোলো, তাতে সবুজ অ্যাক্রিলিক মেরে গাছপালা। এখনও একজন রোদ আকাশের ব্যালকনিতে ব’সে কাজ করে যাচ্ছে,
আর আমি জীবনপশমিনা থেকে কাঁটা বাছতে গিয়ে ছিঁড়েকুটে ফেললাম, ইচ্ছেগুলোর ফাটলে বটচারা
ঘরে ফিরে শুনছি চিতা মেসেজ করেছে —
যদি কোনওদিন তোমাদের কুকুরের গলাব্যথা করে, আমি ডেকে দেব সারারাত, অল্প খরচায়

চার
ওই দ্যাখো টাটা গোল্ড আর রোগা লম্বা
শেরপা ড্রাইভার। এক-ঝাড় মেঘ দ্যাখো,
গোছা গোছা কুয়াশার পিঠ; এই তাকাও ঘাসলহরী আর ডেকেডুকে নিয়ে আসা পাতাঝরনা জল, বুনো শুয়োরের দাঁতে ওপড়ানো গোবি-র ফসল;
মন থেকে চপ্পল পর্যন্ত তৃণাচ্ছাদিত মানুষেরা।
ওই দ্যাখো খাবারের টাকা দেব না ব’লে বাঙালি ট্যুরিস্টের দিক্‌কত, আর দীর্ঘরোমা বাদামির
ভেতর থেকে পেনিসের লাল মুন্ডু…
আজ তিনমাস চিতা আমার সাথীকে
নীচের হোম-স্টে থেকে তুলে নিয়ে গেছে

পাঁচ
দর্শনমিনার — আমি তার জানলা থেকে সবুজ পতাকা নাড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে তুলছিলাম…
পৃথিবী কীটশান্ত শব্দশান্ত হয়ে এলে মাটিতে চুপচাপ কেউ চারকোনা ধূসর মেশিন নামাল। কোনও তার বাতাসের নাভিতে, কোনওটা গাছের ঠোঁটে গুঁজে দিলেই বিনবিন ঘামের মতো সন্ধে চালু হয়ে যাবে
তখন চিতা কার্তিকঘাসের নীচে জলের হাল্কা স্বেদে
জিভ দিচ্ছে, বুকের ওপর লেজ গুটিয়ে শুয়ে
রবীন্দ্রসংগীত। আমি বিকেলের খাবার মুখে
তুলতে গিয়ে দেখি তালা খুলে ফাঁকা আকাশঅফিসে ঢুকল চাঁদ — ছায়াচোখ,
থ’কে যাওয়া চেহারা। “আগে তুমি নাও” —
তার দিকে বিস্কুটহাত উঁচু করেছি…

2 thoughts on “চটকপুর

  1. কথা কাব্যের মধ্যে যাপিত জীবনের অপূর্ব সম্মিলন উঠে আসে আপনার কবিতায়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।