এক
এগারো শতকের মানুষ কাজী শু’এব ছিলেন কাবুলের এক রাজ-পরিবারের সদস্য। অন্যমত বলে, রাজ-আমাত্য তিনি। আফগানিস্তানে তখন শাহ শারুখের শাসন। কিন্তু গজনীর মামুদ কাবুল দখল করে নিতেই পরিবারটির কপাল পুড়লো। এখনকার পাকিস্তানে চলে এলেন এই কোরান-সাহিত্যে সুপণ্ডিত ভদ্রলোক, আর শেষ পর্যন্ত ডেরা বাঁধলেন লাহোরের কছাকাছি কসুর-এ। শু’এব-এর তিনটি সন্তানের একজন জামাল-উদ-দীন। আর, জামাল-উদ-দীন-এর তিন ছেলের মধ্যমজন ফরিদ মসউদ, জন্ম ১১৭৩ সালে। তিনি চিস্তি-পরম্পরার তৃতীয় প্রমুখ এবং স্বয়ং এক সন্ত। জীবন জুড়ে নানা অলৌকিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় উপাধি পেয়েছিলেন ‘গঞ্জ-এ-শকর’, মানে, মাধুর্যের ভাণ্ডার।
ফরিদের তিন গুরু : নিয়মনিষ্ঠ ধার্মিক মা করসুম বিবি, কোরানের অতি উৎসাহী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি পাঠক বাবা জামাল-উদ-দীন আর প্রখ্যাত সুফী সাধক কুতুব-উদ-দীন বক্তিয়ার কাকী। দিল্লিতে তার সুফী আশ্রম বা ‘খানকাহ’ বানিয়ে কাকী সুফীবাদের প্রচার করতেন। খানকাহগুলোর নিয়ম নিয়ন্ত্রণ ছিলো খুব কঠিন। ফরিদ এখানে অনাহারে তপস্যা শুরু করলেন। সুফীরা ভারতীয় যোগীদের কাছ থেকে নানা প্রক্রিয়া আর অভ্যাসের পাঠ নিয়েছিলেন — যেমন প্রাণায়াম শেখা, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, সংসারে বৈরাগ্য আনার চেষ্টা ও মনকে একাগ্র করার উপায় জেনে নেওয়া ইত্যাদি। শোনা যায়, ফরিদ ‘চিল্লাহ-এ-মাকুস’ পালন করেছিলেন। এতে চল্লিশ দিন একটা কুয়োর মধ্যে উলটো হয়ে ঝুলে আল্লাহ-এর নামে ধ্যানমগ্ন থাকতে হয়। অনেকে সন্দেহ করেন, সত্যিই এমন ঘটেছিল কিনা। বিষয়টা নিয়ে অবশ্য স্বয়ং একটা দোঁহা লিখেছেন ফরিদ :
ফরীদা তনু সুকা পিঞ্জুরু থীআ তলীআঁ খুঁডহি কাগ।
অজৌ সু রবু ন বাহুড়িও দেখু বন্দে কে ভাগ।। (৯০ নম্বর দোঁহা, গুরু গ্রন্থসাহিব)।
[অনুবাদ : ফরিদ, আমার শুষ্ক কায়া কংকালসার হয়ে গেছে। দাঁড়কাকেরা আমার হাত আর পায়ে ঠোক্কর দিয়ে গর্ত করে ফেলেছে। (অথচ) এখনও পর্যন্ত ঈশ্বর আমার সাহায্যে আসেননি। দেখ, তার সেবকের কী দুর্ভাগ্য!]
কাজেই, এমন সাধুচরিত্র, ধর্মপরায়ণতা, কঠোর তপস্যা আর প্রার্থনার ক্ষমতার জন্যে ফরিদের নাম দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে উঠলেন তিনি। ডাকা হতে লাগল বাবা ফরিদ।
পাঞ্জাবি সুফীকাব্যের তিনটে ভাগ। ফরিদ তার প্রথম ধারার কবি। এখানে শরিয়তকেই সবচেয়ে পবিত্র আর গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। ফরিদ শরিয়ত আর চরম আধ্যাত্মিকতার মধ্যে কোনও বিরোধ খুঁজে পাননি, যা পরবর্তী সময়ের সব সুফী কবিরাই অনুভব করেছেন।
সে যাই হোক না, গুরু গ্রন্থসাহিবে তার চারটে গান আর একশো বারোটা দোঁহা পড়লে ফরিদের সন্ত-কবি পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠবে পাঠকের চোখে। ফরিদ লিখতেন মুলতানী পাঞ্জাবিতে।
ফরীদা জঙ্গলু জঙ্গলু কিআ ভবহি বনি কণ্ডা মোড়েহি।
বসী রবু হিআলীএ জঙ্গলু কিআ ঢুধেহি।।
(অর্থাৎ — ফরিদ, পায়ের তলায় কাঁটা দ’লে কেন তুমি বনে বনে ঘুরে মরছো? ঈশ্বর হৃদয়ে বাস করেন, তাঁকে নির্জন ভূপ্রান্তরে খুঁজো না।)
.
[উৎস — বাবা ফরিদ : বলবন্ত সিংহ আনন্দ। সাহিত্য অকাদেমি।]
সাহিত্যের অসামান্য একটি শেয়ার আপনার হাতে উঠে এসেছে। শুভেচ্ছা কবি।