নিমতিতা সরকারি কলোনি

পাঁচ
জ্বর, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? খগবতীর মৃত্তিকা হইতে। মাটি থেকে মানুষের পায়ের আঙুল বেয়ে আস্তে আস্তে উরু, কোমরে উঠে যাই। ওদিকে হাতের তালু থেকে নাক-গলা হয়ে মাথায়। তারপর দুই ঢেউ এক সঙ্গে ভেঙে পড়ি বক্ষতটে।
এই তরঙ্গ উইপোকার, তার আস্তরণে ঢেকে গেছে সমস্ত শরীর। ভেতরে ব’সে বন্ধ-চোখ গাঢ়-শ্বাসের বাল্মীকি।

— তারক ডাক্তাররে একবার খবর দি’, নাদু? আমার কাছে দেড্‌টা টাকা আছে।
— তুমি থোও দিন! সোদ্দি-গাগরোম; রাত্তিরি সাবু খাক, কাল সকালে ঝজ্‌ঝরে হয়ে যাবেনে।

বিকেলবেলা হঠাৎ শরীরে তাত এসে চাঁদের চলাফেরার সংবিধান বদলে দিল। এখন রঘুনাথের মাঠে বালক-বালিকাদের কিট্টু আর গাদি খেলা; রাস্তা দিয়ে ছেলেরা ঢ্যাব-ঢ্যাব ক’রে বল ড্রপ খাইয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চৌরাস্তার মুচির কাছ থেকে সেলাই ক’রে পাম্প দিয়ে মাঠে নামাবে। এখন পড়ন্ত রোদে পাখির ডাক থেকে মনখারাপ খুঁটে নেওয়ার সময় নয়। বরং মা চমকে উঠে জিগ্যেস করবে, আমাদের বাড়ির মাথার ওপর দিয়েই ডেকে গেল নাকি? না না, ফুলিদের বাড়ির ওপর দিয়ে। “বড় বাঁচা বাঁচিছি। মাসের শেষে আসোজন-বসোজন সামলাতি হোলি আর দেখতি হ’তো না!”

জ্বরে ঘুম পায়, ঘুমে দেহতাপ বাড়ে আর আকাশে থইথই করে ফুল্লকুসুমিত অন্ধকার। সেই তমসা কেন্নোর মতো উথলে চাঁদের নাকমুখ দিয়ে ঢুকে যায়, ফুসফুস ভ’রে ওঠে আলকাতরার পাপড়িতে। দিদিমা গল্প করেছে, একবার ঘুমে-কাদা কোনও বাচ্চার কান দিয়ে কেন্নো ঢুকে তার মগজে বংশবিস্তার করেছিল। তারপর পড়া পারেনি ব’লে মাষ্টারমশাই যেই ছেলেটার চুলের মুঠো ধ’রে টান দিয়েছে, চুল সমেত ব্রহ্মতালু, মানে নারকেলের অর্ধেকটা মালা স্যারের হাতে উঠে এল। তখন দেখা যায়, ঘিলুর জায়গায় গিজগিজ করছে শুধু কেন্নো!
সেই থেকে কেউ চুলের মুঠি ধরলে চাঁদ সামান্য চিন্তায় থাকে! কিন্তু এখন যে ত্রস্ত মেয়েলি আঙুল তার মাথার ঢেউয়ে ডুবে গেল… নেমে এল কপালে, গলায়… সে যেন নিজেরই উদ্বিগ্ন হাত :

— ও শিউলি, শিগরির মারে ডাক। ভাইয়ের গা তো পুড়ে যাচ্ছে!

ছয়
প্রথমে জলেচুলে সোহাগ জমবে না, মাথাভর্তি গাঁজানো কেশরাশিতে জল স্লিপ ক’রে বেরিয়ে যাবে। তখন, তিমিরের বাবাকে এতদিন ডাকা হয়নি কেন ব’লে দানা বাঁধবে একটা বিক্ষোভ। ছেলে রেলে গ্যাংম্যানের চাকরি পেলেও আশি-পার বৃদ্ধ এখনও জাত-ব্যবসা ছাড়েনি, হাতে নাপিতের বাক্স দুলিয়ে কুঁজো-হেঁটে চলে আসে কেউ খবর পাঠালেই, আর প্রাণভয়ে ছোটদের কান্না শুরু হয়। ক্লিপ-মেশিনে পটাং পটাং করে ঘাড়ের চুল ছিঁড়তে থাকে অসিত পরামানিক, রক্তকুচি ফোটে সার দিয়ে; তখন স্কন্ধে ফটকিরিপাথর ঘ’ষে একগুচ্ছ জ্বলুনি ফ্রিতে উপহার। এবার সে ময়লা ধুতি গুটিয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে শিশু-মাথা চেপে ধরল — চুলে কাঁচি চালাবে। অপরিচ্ছন্ন উরু ও কুঁচকির গন্ধে সেই জানু মধ্যবর্তী স্থানে হাঁচতে থাকে বাচ্চারা।

রাত যত বাড়ের দিকে, চাঁদের শরীরে ঘুমের বদলে ঘোর জন্ম নিচ্ছিল। বাবা স্কুল ছুটির পরে অপারিশ্রমিকের কোচিং পড়িয়ে ফিরেছে, মা ডাকল : এট্টু জপ ক’রে দিয়ে যান না ছেলেডার মাথায়। নির্মলচন্দ্র নিজের জ্বর-সমান উষ্ণ করতল সন্তানের কপালে রেখে অতি মৃদুস্বরে শ্লোক আওড়ান। উপনয়ন হওয়ার আগে গায়ত্রী-আদি কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করা নিষেধ। কিন্তু অবাধ্য ছেলের কানে একবার পৌঁছোলে সে হাজার কানমলা খেয়েও সারাদিন ওটাই চেঁচিয়ে বেড়াবে।

আসলে, কনিষ্ঠ পুত্র প্রায় বাবার মতো স্মৃতিধর। আজ থেকে অর্ধ শতক আগে খুলনার অন্তঃপাতী সেনহাটি গ্রামে নির্মলের স্মরণশক্তি ছিল সুবিদিত। যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, এমনই এক শীতের দিন স্কুল ইন্সপেক্টর এসেছেন পরিদর্শনে। ক্লাসে ঢুকে প্রথম বেঞ্চে বসা ছোট্টখাট্টো চেহারার ধপধপে সাদা বালকটিকে দাঁড় করালেন : বলো, বর্ণপরিচয় বলো। খোকা বুঝতে পারল না কোন ভাগ তাকে আবৃত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব অ, আ, হ্রস্ব ই, দীর্ঘ ই থেকে শুরু হয়ে ঝরঝরিয়ে রাখালের দুষ্টুমির গল্প পর্যন্ত ব’লে প্রথম ভাগ শেষ করল। পরীক্ষককে তবু অপেক্ষমান দেখে সে ঐক্য-বাক্য-মাণিক্যে মহরত ক’রে দ্বিতীয় ভাগ ধ’রে এগোয়, একদমে মুখস্থ বলতে বলতে শেষ অধ্যায় “চুরি করা উচিত নয়”-এর অন্তিম লাইন “তা-হা ক-র না-ই, এ-জ-ন্য, তো-মা-র এ-ই পু-র-স্কা-র।” উচ্চারণ-শেষে হাঁ ক’রে শ্বাস নিচ্ছে যখন, ইন্সপেক্টর এগিয়ে এলেন কয়েক পা, হাত বাড়িয়ে ছাত্রের কপালে রগের ওপর এক দুই এবং তিন — তিনটে টোকা দিয়ে নিশ্চুপে কক্ষত্যাগ করলেন।

সাত
বাসি বেলিফুলের মতো দুমড়ে গেছে ঠোঁটদুটো, দুই গাল ভস্মে-আগুনে মিশে নিভুনিভু উনুন। জ্বরের তাড়সে কাঁপছে গোটা মুখ। মা ক্রমাগত মাথায় জল ঢেলে যাচ্ছে, ঘটি থেকে ধারানি-করা স্রোত কচুপাতা বেয়ে নীচের বালতিতে প’ড়ে চক্রবৎ ঘটিবাহিত হয়ে উঠছে মাথায়। আর দিদিমা গেলাসের জল থেকে চাঁদের চোখের পাতা, ঠোঁট ভিজিয়ে চলেছে।
— ও ভাই, খুব কষ্ট হচ্ছে? এই অ্যাখোনি তোমার জ্বর নামে যাবেনে। কিছু ক’বা নাকি, ও সোনা?

রোগি জাগন্ত কিনা বোঝা যায় না। ঘরে টিনের চালের নীচে পুরোনো শাড়ির যে নিরাপত্তামূলক পর্দা টাঙানো (টিকটিকির লাদি বা আরশোলার ডিম যাতে বিছানায়-খাবারে না পড়ে), তার চোখ সেখানে স্থির। পর্দায় দেখা যাচ্ছে, জলের শিরা-উপশিরা চাঁদের মুণ্ডটি সমস্ত কোণ থেকে জাপটে ধরল — যেমন বলখেলার মাঠে যাওয়ার রাস্তায় রেলের পরিত্যক্ত ভীমবাহু কেবিনকে একটা ধৃতরাষ্ট্র অশত্থগাছ মরণ-আলিঙ্গনে আঁকড়ে থাকে। চাঁদ লক্ষ করছিল, এই বলশালী জাপটাজাপটি তার পাতলা ঘাড় আর নিতে পারছে না। একটু পরেই জলের তোড়ে চাঁদের মাথা ঘাড় থেকে খুলে বালতিতে পড়ে ডুবে গেল। ওমনি তারও দুচোখ দৃষ্টিহীন…।

বাড়িতে একটা কান্নার কোরাস উঠল কি তখুনি? কেউ কি চেঁচিয়ে বলছে, ওরে বাসু দৌড়ে যা বাবা, তারকডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আয়? বলরাম দাসের বাড়ির রেডিয়োতে এখনও অনুরোধের আসর শুরু হয়নি, আর সাড়ে ন’টার আগে তারক ঘুমোবে না। কিন্তু বুক-ভরা ইচ্ছে থাকলেও বাসু এক-পা নড়তে পারছে না! ডাক্তারের প্লটের ঠিক আগে ডানহাতে যে-বাড়ির দরজায় মরচেপড়া তালা, আগাছা গজিয়ে গেছে উঠোন জুড়ে, যেখানে দিনেদুপুরে চন্দ্রবোড়া সাপের বাচ্চা কিলবিল করে, সুতরাং সন্ধে থেকে রাস্তাটুকু বড়-বড় হাতহালি দিয়ে হাঁটে সবাই, সেই আস্তানার ইতিহাস কীভাবে ভুলবে বাসুদেব? দেবী — তারই-বয়েস ফর্সা সুন্দরী মেয়েটা সুইসাইড করেছিল সরস্বতীর পুজোর দুপুরে। স্কুল থেকে একপেট খিচুড়ি বেগুনভাজা খেয়ে এসে খবরটা শোনে বাসু এবং ছুটে গিয়ে ডেকরনের ফ্রকপরা মেয়ের ভারি সাদা দুই পা, বগলের বাদামি লোম আর মুখ থেকে ডান দিকে বেরিয়ে যাওয়া কালো জিভ… সব অনুপুঙ্খ দেখে ফ্যালে। এখন এই গভীর রাতে বাসু হাততালি দিলে যদি তালাবন্ধ ঘরের ভেতর থেকে পাল্টা ক্ল্যাপিং-এর শব্দ ওঠে! পাড়ায় এমন প্রহেলিকা ঘটে যাচ্ছে বারবার। কেলেকুষ্টি বাপ-মায়ের কালোকোলো শিশুদল জন্ম নিতে নিতে হঠাৎ এক খইসাদা সন্তান প্রকাশ পায়। উপনিবেশের জনতা অবাক হয়ে দ্যাখে, খাওয়ায়-পরায়, তারপর একদিন অপঘাতে বা আচম্বিতে মৃত্যু হয় তার। যেমন বাসন্তীপুজোর তিন দিন পর বলরামের মেয়ে শীলা নাকমুখ দিয়ে কৃমি উঠে চিতেয় উঠল; “আমি পাপী, তাই বিদায় নিলাম” লিখে রেখে দেবী দিল গলায় দড়ি; মনসাবাড়ির রাজপুত্র মানিক ঢলে পড়ল গোখরোর বিষে…।

বলব সেসব কথা, চাঁদের জ্বরটা আগে ফণা নামিয়ে নিক।

(অসমাপ্ত)

1 thought on “নিমতিতা সরকারি কলোনি

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।