শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

দশ
নির্মল সহজে ঘন মেঘস্তর থেকে নেমে বৃষ্টি হয়ে কচুপাতার মৃণাল ঘিরে দাঁড়াতে পারে না। “সরল তরল হও, বিকাশের রীতিনীতি এই” এক কবি লিখেছিলেন; কিন্তু মায়া কখনও দুধ তৈরি করতে বললে সে এত মোটা ক’রে গুলত, খাওয়ালে বাচ্চাদের অবধারিত পেট ছেড়ে দেবে। নির্মল নিজেকে মেলে ধরে শিলাবৃষ্টির মতো; প্রথমে অপ্রবেশ্য, পরে হয়ত গ’লে জল হবে। ছোটদের জবান তার নয়, ভাবও কি বোঝে? সবাই জানে, এ-বংশের যতেক পুরুষ — সন্তানপাগল। রাতে বাচ্চারা নিঃসাড় ঘুমন্ত হলে নির্মল অন্ধকারে আন্দাজে-আন্দাজে ন’বছরের ছেলের হাঁটুর ঘা’য় মলম লাগিয়ে দিচ্ছে, কোমরে দাগ ব’সবে ব’লে ঢিলে ক’রে বাঁধছে তেরো বছরের কন্যার প্যান্টের ফিতে। সঞ্জু সব সময় টের পায় না, শিউলি লজ্জায় কাঠ হয়ে থাকে।

নির্মলের গল্পের ভাষাগাড়ি ছোট্ট শ্রোতাদের নানা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগোচ্ছিল :
— সভায় তখন গুনগুন শুরু। আরে, ‘নির্গুণ আত্মজ্ঞান’ তো পাতঞ্জল-যোগের গোড়ার কথা, সবে দু’এক বছর নবদ্বীপ শান্তিপুর বা গোপালপাড়ার টোলে যাতায়াত করছে এমন ছেলেছোকরাও জানে। জমায়েত ধরতেই পারছে না হলটা কী! হঠাৎ সভায় বসা একটা লোক চট ক’রে উঠে দাঁড়িয়েছে, তারপর দে ছুট ভীমবেগে। ভিড় চেঁচিয়ে উঠল : ব্যাটা অশা, আরে মধুসূদনের বড় শালা পালাচ্ছে… পালিয়ে মুখ বাঁচাবি ভেবেছিস?

ডামাডোল বেশ বড় চেহারা নিল। গাঁয়ের মোড়লরা জোড় হাত উঁচু ক’রে “শান্তি শান্তি” বলেও ম্যানেজ দিতে পারছে না। এমন সময় দেখা গেল, ডবল জোরে দৌড়ে ফিরে আসছে সেই অশ্বিনীচন্দ্র। কিন্তু অশার হাতে ওটা কী, এ-বাবা, কচি বাচ্চাদের তেলচিটে সরষে-বালিশ একখানা। সেটা ফরাসের ওপর পেতে অশ্বিনী জামাইবাবুকে হাত ধ’রে টেনে শোয়াবেই, আর মধুসূদনও শোবেন না। আবার বিরাট হই হই। সব দেখেশুনে দশরথ মিশ্রের ব্যাঁকা হাসি থেকে করুণা ঝরে পড়ছে। তিনি হাত তুলে বললেন, শয্যাগ্রহণ করতে লজ্জা কী, সার্বভৌম মহাশয়? হয়ত তাতে আপনার শরীরটি কিঞ্চিৎ পরিতোষ লাভ করবে।

দশের ও দশরথের অনুরোধে শেষতক শুয়েই পড়লেন তারকনাথ। ওমনি এক আশ্চর্য পরিবর্তন, ঝিমুনিভাব কেটে গিয়ে জ্বলে উঠল চোখদুটো। মুখে মুচকি হাসি টেনে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু গলা খাঁখারি দিলেন :

ধর্ম দুই রকমের, প্রবৃত্তিধর্ম ও নিবৃত্তি বা মোক্ষধর্ম। যার সাহায্যে সুখলাভ, তাই প্রবৃত্তিধর্ম। এটা সারা পৃথিবীতেই প্রচলিত আছে। কিন্তু শান্তিলাভের জন্যে নিবৃত্তিধর্মের অনুশীলন শুধু ভারতেই শুরু হয়েছিল। আত্মজ্ঞানও দু’প্রকার — সগুণ আর নির্গুণ। সগুণ আত্মজ্ঞানের ধারণা দিলেন বাগাম্ভৃণী ঋষি, কপিল ব্যাখ্যা করলেন নির্গুণ আত্মজ্ঞান। মাননীয় নৈয়ায়িক কপিল রাঢ়বঙ্গের সন্তান। আচ্ছা পণ্ডিত দরশরথ মিশ্র, বলুন তো…।

এর পর তর্কসভা মেরেকেটে পনেরো মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। মিথিলার মহামহোপাধ্যায় পক্ষধর মিশ্রের বংশজ টের পেলেন, স্মৃতি, কাব্য, ন্যায়, ব্যাকরণ ও তর্ক বিষয়ে মধুসূদনের জ্ঞানের যে প্রখরতা, তাতে অনায়াসে পঞ্চতীর্থ উপাধিতে ভূষিত হতে পারেন। কাজেই টিকি-কাছা আস্ত রেখে মানে-মানে সরে পড়াই শ্রেয়। বজরায় ওঠার আগে বিমূঢ় দশরথ মধুপণ্ডিতের কাছে এসে নীচু স্বরে প্রশ্ন করলেন, মহাশয়, স্মার্ত রঘুনন্দনের মতে তিনভাবে অধ্যয়ন করা যেতে পারে — বাচিক বা উচ্চকন্ঠে পাঠ, উপাংশু বা অনুচ্চ স্বরে পাঠ এবং মানস বা মনেমনে পড়া। তো, আপনার এই শুয়ে শুয়ে পঠন-টি কোন ধারার অন্তর্গত?

এগারো
ঝড়ের বেগে সুধা ঢুকল ঘরে, রাতে যে কাঁথা নিয়ে ঘুমিয়েছিল সেটাই গায়ে জড়ানো।
— দিদিমা শুনিছ? টিপুদা বিয়ে ক’রে বউ নিয়ে আইছে!
— আমাগো টিপু? ওমা, আমার কী হবে! বউ পালো ক’নে?

সুধা ঠান্ডা মাটিতে ধেবড়ে ব’সে পড়ে। ওরে মুখপুড়ি, হাসবি পরে, আগে ঘটনা বল।

টিপু জলপাইগুড়ি গেছিল বন্ধু অসীমের মামাতো বোনের বিয়েতে। গেছে যদিও, বিয়েবাড়িতে কনের চাপা রঙ নিয়ে মহিলাদের ঠাট্টা-বোটকেরা, ছাদনাতলায় চ্যাংড়াদের মাতন, পাঁঠার মাংস খেয়ে মাটির গেলাসে হাত গোলা — কিছুই তাকে টানে না। সে কোনও রকমে কাঁধের ব্যাগ নামিয়েই আশপাশের বনপাহাড়ে ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। এদিকে বিয়ের আগে পণের পুরো টাকা হাতে না পেয়ে বরপক্ষ পাত্র উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। তখন টিপুকে জঙ্গল থেকে খুঁজে এনে তার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে অসীমের মামা। টিপু অনেক বাধা দিয়েছিল : এ-বিয়ে আমার মা মানবে না। বিশ্বাস করবে না একটা কথাও। বলবে, ওই মেয়ের সঙ্গে তোর আগে থেকেই ভাব ছিল।

তৃপ্তিমামিমার চিৎকার শোনা যাচ্ছে এ-বাড়ি থেকে। সেই শাপশাপান্তকে নতুন বউ দেখার আহ্বান মনে ক’রে ছেলেমেয়েরা ছুটল। এই ফাঁকে চুপ ক’রে ঘরে ঢুকে একটা সবুজ প্যাকেট চাঁদের কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছে দিদিমা।
— প্রত্যেক দিন সকালে-বিকেলে ঠোঁটে লাগাবা। ভাইবোনরা কেউ চালি আঙুলির মাথায় ক’রে এট্টু দিয়ে আবার রাখে দেবা নিজির কাছে।

ননীবালা খেয়াল করেনি তার জাঁদরেল মেয়ে পেছন-পেছন বড়ঘরে উঠে এসেছে।
— কী এডা, দেহি? বোরোলীন! এর তো অনেক দাম। টাকা পালে কোথায়, মা? তোমার পানের ডাবরখান দেখতিছি না দুই-তিন দিন।
— তোরঙ্গে তুলে রাখিছি।
— তোমার মুখ না পাইখানা? ডাবর বের করো, আমি দ্যাখবো।
— ভর সন্ধেকালে মা’র পেছনে না লাগলি কি তোর পেটের ভাত হজম হচ্‌ছে না, নাদু?
— এক ফোঁটা দুধির সর মাখলি ঠোঁটফাটা সারে যায়। সংসার চালাতি যে কী কষ্ট তুমি তার কী বোজ্‌বা? কথায় কয়, চালডাল তোমার ম্যাজমানি আমার। দিদিমা হয়ে নাতির ভবিষ্যত ঝজ্‌ঝরে ক’রে দেচ্‌ছো!

নির্মল সদ্য ‘গাঁদাফুল’ লেখা শেষ করল, কবিতাটা দাঁড়াল মোট আট স্তবক, চব্বিশ লাইন। এবার সে কিছুক্ষণ বউ-শাশুড়ির ঝগড়া শুনল মন দিয়ে। ওদিকে হঠাৎ বলরাম ঘোষের বাড়ির হাত্‌নে থেকে উঠোনে খ্যানখ্যান করে গড়িয়ে পড়েছে কাঁসার থালা আর বারান্দাময় লালচে মোটা মুড়ি — শালী, হারামির বাচ্চা, সারাদিন গাধার খাটনি খাটে আসব আর তুই আমারে এই ব্যাতানো মুড়ি খাওয়াবি! ভাবিছিসডা কী?

প্রদীপ থেকে প্রদীপে যাওয়ার মতো ঝগড়ার শিখা সন্ধের কলোনি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বলরামের মুখখিস্তি ঢেকে গেল পাশের রেখা-রত্নার বাড়ির শাঁখশব্দ, অতি-গৌরাঙ্গী রেখার মায়ের তীব্র উলুতে।

বারো
প্রতিটা মানুষই তর্কে-বিবাদে নিজের মতকে জিতিয়ে আনতে চায়, আর অপরের ধারণাসৌধকে ধসিয়ে দিতে। প্রত্যেকে বিশ্বাস করে ঠিক-টা তার সঙ্গেই আছে, অন্য পক্ষ মিথ্যের রজনীগন্ধা। কলোনির গলাবাজি, কাশ্মীরের সংঘর্ষ বা রাষ্ট্রসংঘের শান্তিআলোচনা সব জায়গাতেই সবাই বোঝাতে রাজি, বুঝতে নয়। তাই শুরু যেখানে আরম্ভ করে, সমাপ্তিও সেখানেই শেষ হয়, একটা বড় গোল্লার ওপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকে মানুষের ভবিষ্যৎ।

আজাদ হিন্দ ক্লাবের মাঠে রামযাত্রার কনসার্ট শেষ হয়ে অভিনয় শুরু হল। সীতা খুব কাকুতিমিনতি করছে — প্রাণনাথ, তোমার সঙ্গে বনবাসে যাব। উত্তরে রাঘব : জীবনে চলার পথে, নারী নাহি নিব সাথে। ভাই লক্ষ্মণ, তোমার কী পরামর্শ? ভ্রাতা, তুমি যা বলিবে, কিন্তু আমারও মত : জীবনে চলার পথে, নারী… নারী নাহি নিব সাথে।

মায়া এসে ঠক করে এক কাপ চা খাটের কোনায় রেখে বলল, ছেলেডা এই নিয়ে দুবার জ্বরে-টানে পড়ল এক শীতে। আজ মাঘের মোটে তেরো দিন। আপনারে কতবার বলিছি, এইসব ছাইভস্ম না লিখে চাঁদের কুষ্টিডা বানান।

নির্মল উত্তর দেয় না, তার মাথায় সমাধানচিন্তা খেলে গেছে। আচ্ছা যদি এমন হয়, প্রতিটা মানুষ যে-কোনও মতবিনিময়ের সময়ে নিজের দোষ বা ভুলগুলো বলবে আর সমর্থন করবে তার বিরোধীর যুক্তিপূর্ণ মন্তব্যকে, তাহলে এই ট্র্যাফিক জ্যাম খুলে বেরিয়ে আসা যায় না? কথা মানেই যদি হয় নিজের বিরুদ্ধে কথা, তাহলে শব্দ ঘিরে যে ক্ষমতার দুর্গ গড়ে উঠেছে তাকে ভেঙে ফেলা সম্ভব। তখন মানুষের অহং নেমে আসবে গ্রীষ্ম-পুকুরের জলস্তরের মতো, অন্যকে ভালোবাসতে বাধা দেওয়া দেয়ালটা সরে যাবে। কিন্তু এই বুঝ মানুষের মাথায় ঢোকাবে কে?

নির্মল তার ছোট্ট শেলফের বইগুলোর দিকে তাকায় — উপনিষদ-সংহিতা, স্তোত্ররত্নাবলী, অ্যান্ড্রু মোশানের নির্বাচিত কবিতা কিটস, এ হিস্ট্রি অফ স্যানসক্রিট লিটারেচার, অমরকোষ, গীতবিতান, ব্রহ্মসূত্র সঞ্চয়ন, দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে…।

— ও গৃহস্থ?
— শুনতিছি।
— কাল সকালে চাঁদরে নিয়ে যাব ইস্কুলে। ভর্তি করে দিয়ে আসব।

মায়া বিপদ আশঙ্কা করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
— এখনও আট মাস বয়েস কম ছেলেডার। তার উপর এই শরীর…।
— বাড়ি রাখলি আবার আমতলার শিশিরে গড়াগড়ি খেয়ে জ্বর বাধাবে। তার চেয়ে ইস্কুলই ভালো।

(শেষ)

1 thought on “শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

  1. সাহিত্যে অসামান্য সংযোজন। অভিনন্দন প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।