আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

এক
যদি একাকিত্বের দিকে তাকিয়ে থাকো, থুতনি ধ’রে মুখ এদিকে ফেরানোর জন্যে বেড়াল রয়েছে। সবচেয়ে ভয়ানকের সবচেয়ে মিষ্টি ভোলবদল সে। শীতের দুপুরে দ্যাখো বেড়াল ফাঁকা রাস্তার বাঁদিক ধ’রে… ও দাদা, কোথায় যাচ্ছেন? — নলেন গুড়ের সন্দেশ কিনতে। দোতলার আলসেয় গা এলিয়ে অবলোকন করছে পৃথিবী, আর চাইছে প্রজাপতি বা লাল পিঁপড়ের মতো নুড়িপাথর গাছের মরা পাতা টিপকলের হ্যান্ডেল অল্প নড়ে উঠুক। তার ঝাঁপাতে সুবিধে হতো। মানুষ পায়েস খেতে চায়, বেড়াল পাখি রোজগার করতে। ঝুপসি, বাঁজা, তাই কুঠার-শাসনের ভয়ে থাকা লিচুগাছটার নীচে একদিন একটা ফিঙে পাখি পাকড়েও ফ্যালে! দৌড়ে গিয়ে বাসুদেব দুহাতে বেড়ালের হাঁমুখ টেনে ধরেছিল ব’লে সেই মোস্ট ফরচুনেট ফিঙে গানের মিড়ের মতো উড়ে উঁচু সজনে গাছে বসে, তার দু’সেকেন্ড পরে নীলাকাশ হয়ে যায়।

বেড়ালদের বৈচিত্র এতদূর ছড়ানো যে ছোটবেলা থেকে কেউ মাথা নীচু শাঁ-শাঁ করে হাঁটে আর সামনে যা থাকবে গিয়ে ধাক্কা খায়; একজন সারাক্ষণ হিন্দিতে কিঁউ-কিঁউ; একজন মাইমশিল্পী; কেউ রূপে তোমায় ভোলাবে বলে নিজের গা চেটেই যাচ্ছে; কেউ কোলে উঠলে আর নামবে না, পা ঝিঁ-ঝিঁ লেগে হস্তীপদ হয়ে গেলেও কী যায় আসে?

এ-বাড়িতে স্বর্গীয় বাহার, পুঁচকু, মহীয়সী, ইমরান, সুন্দরী, নন্দবাবু, সিঙাড়া, ট্যাঙোশ, বোকা-বোকা-লম্বা বা আজকের পাখিধরা কিশমিশ — এমন সব বেড়ালের গুচ্ছে যারা নিশ্বাস নিয়েছে, তাদের ফুসফুসে কি অ্যাজমা আর রক্তে মাইক্রোবসের ঘাঁটি? নাহলে ডাক্তার কেন বলে কুকুর থাকুক, বেড়ালটা কাউকে গিফট করে দিন?

উপহার দিতে লাগবে না, একটু ধৈর্য ধরলে সে মরেই যাবে। এক ড্রপার ঘুম, এক চামচ পাড়াবেড়ানো আর এক খুঁচি মৃত্যু দিয়ে বিল্লিজাতি গড়া। ন’টা নহে, সিকিখানা জীবনবিশিষ্ট মার্জার মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ডিগবাজি খেয়ে যাবে। বেঁচে থাকা নিয়ে তার কোনও সত্তর এমএম অভিমান আছে নিশ্চয়ই। বেড়ালের মা ভালো হয় না, বাবা তো হয়ই না, শীতে জামা হয় না, বৃষ্টিতে ছাতা হয় না, উলটে পুজোয় বাজি মানে বাজে হয়, বাড়িতে অতিথি এলে লুকিয়ে বেড়ানোর জায়গা খোঁজো (অতিথ এসে গিরোস্তো খেদায় — চাঁদের মায়ের সংলাপ)। তবু বিভিন্ন বোঁটায় বিভিন্ন বেড়াল সাজিয়ে একটা টবে বসালেই স্পাইডার ক্রিসানথেমাম।

দুই
মায়া প্রায়ই বলে, ব্রাম্মোনবাড়ির বিড়েলটাও দুপাতা সঙোস্‌কিতো পড়তি পারে। এটা বেড়ালের প্রশংসা নয়, ব্রাহ্মণের আত্মশ্লাঘা। সে কলোনিতে বাস ক’রে মোটেই খুশি নয়; দারিদ্রের চেয়ে অনেক বড় সমস্যা হল, চারিদিকে নীচু জাতের ভিড়। পাকিস্তানে তাদের সিদ্ধান্তপাড়ায় বারো ঘর বাসিন্দার মধ্যে আট ঘরই বামুন ছিল, তিন ঘর কায়েত আর মোটে এক বাড়ি মণ্ডল — নোমোশুদ্দুর। সেই তুলনায় কলোনিতে উঠতে বসতে মালাকার, বিশ্বাস, ভক্ত, হালদারের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেষি।

ঘটিবাটি হারিয়ে একবার মাথা একবার বুক চাপড়াতে চাপড়াতে যারা একসঙ্গে চালডালশাকমাছমাখা একদলা বমির মতো ভিনদেশে এসে সরকারের দয়ায় দরমার বেড়া দেওয়া ঘরে উঠল, যাদের দুপুরে উনুন জ্বলে তো রাত্তিরে জ্বলে না, তাদের আবার জাত-অজাত কী রে! পণ্ডিতমশাইয়ের বউ এমনিতে জ্যান্ত পঞ্জিকা; মুখে মুখে অমাবস্যা-পূর্ণিমা ব্রত-ষষ্ঠী বিয়ে-শ্রাদ্ধের হিসেব রাখে, কিন্তু বামুন ব’লে বড্ড বাড়াবাড়ি! মাঝমাঝে সরকারবাড়ির বাসন্তীমণ্ডপে ব’সে আর এক সরকার সাধু-র মা এসব ক্ষোভের কথা বলে। “পাকিস্তান থে’ পাছার কাপোড়ডাও আনতি পারেনি, কিন্তু গুমোরডা ঠিক নিয়ে আইছে। কালো কুষ্টি গা’র রঙ নিজির, আবার জাত তুলে কথা কয়। আমার বাবায় ক’তো, কালো বামোন আর ধলা চাঁড়াল, এদের কোনও কালে বিশ্বেস কোত্তি নেই”। কথার ঝোঁকে বুড়ি খেয়াল রাখতে পারে না, মণ্ডপে ফকির বিশ্বাসের ছেলেও বসে আছে, তার গায়ের রঙ শুধু কংসাবতী নদীর বালির মতো চিকচিকে নয়, চোখদুটোও বেড়ালাক্ষি।

এভাবে কাহিনিতে আবার বেড়াল ফিরে আসে, থেকে যায়। মানুষের ছেলেমেয়ে বেড়ে ওঠে সুপুরিবৃক্ষ, আর বেড়াল বড় হয় পেয়ারাগাছ — গোড়া থেকেই চারদিকে সন্তানসন্ততির ডাল ছড়াতে ছড়াতে। এই রকম অমিলের মধ্যে প’ড়ে মায়ার অহংকারও মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। শিউলি ব্যাজার মুখ ক’রে বলে, জানো মা, আমাদের বিড়েল কিন্তু আমাদের মতো হয়নি।
— কেন রে!
— ধুর, পড়াশুনো ভালোই বাসে না, এখনি জীববিজ্ঞানের বইয়ের উপোরে বমি ক’রে দিচ্ছিল।
— তোগোও যেমন! আপনি মা খাতি পায় না, শঙ্করারে ডাকে। কালই বাসুরে কয়ে পার ক’রে দেবানে ওটারে। এহ, আবার সোয়াগ ক’রে নাম রাখা হইছে কিস্মিস!

একটা কান কালো, সারা গা চকলেট, শুধু ধবধবে সাদা পেছনের ডান পা, দেখলে মনে হবে ভেঙে গেছে তাই প্লাস্টার করা। কলোনির বাড়িতে তো কোনও পাঁচিল, গেট বা মে আই কামিন স্যার থাকে না, একদিন বাজার করে ফেরা নির্মলের পেছন পেছন এসে কিশমিশ ঢুকে পড়ল। তাকে শিউলি অনেক ট্রেনিং দিয়েছে, কিন্তু লক্ষ্মীর আসনে জল আর বাতাসা দেওয়া থাকলেই সে ফাঁকমতো গ্লাসে মুখ ডুবিয়ে জল খেয়ে নেবে।
শিউলি আবার তেঁতুল দিয়ে গেলাস মাজে।
— ও ভাই, গেলাস তো সকালেই পরিষ্কার কল্লাম।
গলা নামিয়ে তাতে এক ছটাক বিষণ্ণতা মেশায় শিউলি।
— জানো তো দিদ্‌মা, কাল সারা রাত্তির কিস্মিস বাড়ির বাইরি ছিল। এদিকে মা হারমোনিয়াম নিয়ে বসলিই চিৎকার পাড়া শুরু করে। আমাদের বিড়েল এট্টুও আমাদের মতো হয়নি!

তিন
শিউলি তখন খুব ছোট, একটা হুলোর বাচ্চা নিয়ে এসেছিল সেজদা গৌরকিশোর। নাক নেই চোখ নেই বড় তুম্বোপানা মুখ, লেজটা গুলে মাছের মতো ছটফট করে, কিছুটা মুদিখানার দোকানদারের ভাবসাব দেখে মা তার নাম দিয়েছিল নন্দবাবু। কিছুদিনের মধ্যে বাবু পালটে রাক্ষস হয়ে গেল। রান্না মাছে মুখ ঘুরিয়ে নিত, কাঁচা দিলে ঠিক আছে। এদিকে আপনমনে তোমার আঙুল চাটতে চাটতে কচ ক’রে দাঁত বসিয়ে দেবে। এভাবে যখন বাড়ির অর্ধেক লোকের হাতে-পায়ে ন্যাকড়ার ব্যান্ডেজ, অদৃশ্য হয়ে গেল নন্দরাক্ষস। বাড়ির লোকই তাকে বিদেয় ক’রে দিয়েছে সন্দেহে শিউলি সবাইকে ঘুষি পাকিয়ে মারতে লাগল; তার পরও যখন তার কান্না আর হিক্কা ওঠা থামছে না, তখন সত্যি খবরটা দিল টিপুদা :

সেদিন শেষ রাত্তিরে আমি পেচ্ছাপ করতে উঠে দেখি তোদের আমতলা-বাড়ির সামনে একটা বড় গাড়ি এসে থেমেছে। তারপর চারজন পুলিশ, চারজন মিলিটারি আর একজন বেড়ালের ডাক্তার নেমে এল।
— বিড়েলের আবার ডাক্তার হয় নাকি!
— বিড়েল, কুকুর, ছারপোকা, আরশোলা, নিমগাছ, মৌরলা মাছ সবার ডাক্তার হয়।

নন্দরাক্ষস তোদের দিদিমার বিছানায় ঘুমত না? একটা পুলিশ জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ফ্যাঁস করে গ্যাস ছেড়ে দিল ঘরের মধ্যে, নাহলে বুড়ির যা পাতলা ঘুম, আমের সময় কলোনির কেউ একটা আমও চুরি করতে পারে? এদিকে চার পুলিশ নন্দর দুই হাত ধ’রে বাইরে আনল চুপিসাড়ে। ডাক্তারের নির্দেশমতো চারজন মিলিটারি ধরল বেড়ালের দুই পা। ডাক্তার ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জটা একজন মিলিটারির দিকে বাড়িয়ে দিল। সে থতমত খেয়ে বলল, আমি তো দিতে জানি না, স্যার। ওহ, ইয়ে… গলা খাঁখারি দিয়ে ডাক্তার কাঁপা হাতে পুশ ক’রে মন্তব্য করল, নন্দ আসলে বেড়ালও নয়, বাঘও নয়, দুইয়ের মাঝামাঝি।
— মাঝামাঝি কেমন ক’রে হয়?

হয়। শিউলিকে বোঝানো যাবে না, কাওরাপাড়ার একটা ছেলে রাস্তা দিয়ে যায় ছাপা লুঙি প’রে, চুলগুলো বড় বড়, মাথা নামিয়ে ঢং ক’রে হাঁটে। ও ছেলে-মেয়ের মদ্দিখানে আছে। তবে নন্দ যত বড় হবে, বাঘের দিকে যাবে — ডাক্তার অভিমত দিল। এরপর ন’জনে মিলে নন্দকে সাবধানে ধরে গাড়িতে তুলে শোঁ করে চলে গেল।
— কুথায় গেল? আমি নন্দুরে ফেরত নিয়ে আসব।

আনবি কী ক’রে? ওকে সুন্দরবনে বাঘদের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে এসেছে তো!

(আরও আছে)

1 thought on “আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

  1. নিঃসন্দেহে সুখপাঠ্য একটি লিখা উপহার দিয়েছেন প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।