আইসো গাঁজা টানি

একসময় এলুমিনিয়ামের বাজারমূল্য রূপার চেয়েও বেশী ছিলো। কোনো রাজকীয় অনুষ্ঠানে রাজা বা তার পরিবারের লোকজনদেরকে এলুমিনিয়ামের চামচ দেয়া হতো এবং অন্যান্য অতিথিদেরকে দেয়া হতো রূপার চামচ। তখন রাজার টাকশাল থেকে শুরু করে বনেদী ঘরের সুন্দরী রমনীর অলংকারে এই ধাতুটি শোভা পেতো। অথচ এই এলুমিনিয়াম পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায় এমন তিনটি মৌলিক পদার্থের একটি। শুধুমাত্র বক্সাইট থেকে এলুমিনিয়ামের আলাদা করা বেশ কষ্টসাধ্য ও ব্যায় বহুল হবার কারনেই তখন এমন অবস্থা ছিলো।

যদিও ইলেক্ট্রোলাইট পদ্ধতির অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে এলুমিনিয়ামের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন পরবর্তিতে বেশ সহজলভ্য হয়ে যায় তারপরও প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও জার্মানি তাদের এয়ারফোর্সের উন্নয়নের জন্য এলুমিনিয়ামের ব্যাবহার ব্যাপকভাবে শুরু করে। হালকা এবং ক্ষয়রোধী হবার কারনে বেশ প্রচলন ছিলো এখনো। যদিও বিমান তৈরীতে এলুমিনিয়ামের ব্যাবহার কমে গেছে তারপরও গেরস্থ ঘরের পাঁকা রাধুনীর কাছে এলুমিনিয়ামের পাত্রের কদর এতটুকু কমেনি।

মনে পড়ে গ্রামীন ফোনের সিআইসি প্রজেক্ট যখন চালু হয় তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধীর গতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষদের জন্য সেবা দেয়াটা একটু দুস্কর ছিলো। বিশেষ করে খালবিল সংলগ্ন বা সপ্তাহে একবার হাটের সমাগম ঘটে এমন জায়গায় নেটওয়ার্ক নিয়ে বেশ বিপাকে পড়তে হতো। আবার এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্দিষ্ট কোনো দিনে শুধুমাত্র ইন্টারনেটের গতি বাড়াবার জন্য টাওয়ারে অতিরিক্ত রিসোর্স বিনিয়োগ করা সেসময়ে কারো জন্যই সাশ্রয়ী ছিলো না। তখন প্রায় সবার হাতেই নোকিয়ার টিপ মোবাইল। টাচস্ক্রীনের মোবাইলের নামগন্ধটি নেই কোথাও। তখন সমাধান হিসেবে আমি ইয়াগী উডা এন্টেনার একটা মডেল বানিয়ে বললাম কাজ হতে পারে। লম্বা খুটির মাথায় লাগিয়ে কোএক্সিয়াল ক্যাবেল আর হোল্ডার দিয়ে নেটওয়ার্ক দুর্বলতার সাময়িক সমাধান হতে পারে। তখন এই এন্টেনাগুলো বিক্রী হতো ২০০ টাকার মতো। আমার নিজ হাতে যেটা বানিয়েছিলাম সেটার খরচ মাত্র ৭৫ টাকা। এর মধ্যে লোকাল বাসে করে বংশালের মার্কেটে যাওয়া আসাও ছিলো। ইয়াগী উডা এন্টেনা বানানোর প্রধান অনুষঙ্গই ছিলো এলুমিনিয়ামের পাইপ। এটা ২০০৭ এর দিকের কাহিনী হবে।

এমন না যে এগুলো বাজারে ছিলো না বা এগুলো সম্পর্কে মানুষ জানতো না। মানুষের প্রয়োজনই বাধ্য করে নতুন বিষয় নিয়ে ভাবতে এবং পন্থা বের করতে। এর পেছনের গুঢ় রহস্য একটা নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। ধরা যাক মধ্যযুগে ইহুদী আর ইসলামের প্রভাবে এলকোহলের প্রচলন পুরো বন্ধ হয়ে গেলো। আল রাজী নিতান্ত ধার্মিক হয়ে এলকোহলের বিশুদ্ধ সংশ্লেষ প্রক্রিয়া বের না করতেন তাহলে কি হতো?

তার আগে জেনে নেই আসলে এলকোহলটা কি? আমরা যে সুমিস্ট ফল খাই তার মধ্যে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্লুকোজ থাকে। এই গ্লুকোজ যখন ঈস্টের সংশ্পর্শে আসে তখন একধরনের এনজাইম নিঃসৃত হয় এবং বিক্রিয়া করে ইথানলের সৃস্টি হয় এবং তার ওপর কার্বন ডাই অক্সাইডের ফেনার সৃষ্টি হয়। তাই কোনো পচনশীল আম বা ভাতের মাড়ে পঁচে গেলে তার ওপর ফেনার অস্তিত্ব থাকলেই বুঝতে হবে সেখানে ইথানলের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেটা যদি খান তাহলে নেশা ধরবে না কারন এলকোহলের পরিমান তাতে খুব কম পরিমানে আছে। এই ইথানলের পরিমান বাড়ালেই এটা বেশ ভালোমানের মদ হবে।
ইথানলের বেশ কিছু উপকারী গুন আছে। যখন এন্টিবায়োটিক ব্যাপারটার প্রচলন ছিলো না বা যুদ্ধের সময় এর অভাব দেখা যায় তখন ইথানলের প্রয়োজন পড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষত সারাই এবং ডিসইনফেকশনে। এছাড়া ক্যামিস্ট্রির অনেক বিক্রিয়াতে এর অনুঘটক হিসেবে শুরু করে দ্রব্য, দ্রাব্য হিসেবে এর প্রচলন। আমাদের সভ্যতার বিকাশ বিশেষ করে রসায়ন ও চিকিৎসা শাস্ত্রে একটা অন্ধকার সময় এখনো বিরাজ করতো।

তবে নেশাজাতীয় দ্রব্য হিসেবে এ্যালকোহলের ক্ষতির কথা সর্বজনিবেদিত। কিছুদিন আগে গবেষনায় প্রকাশিত যেকোনো পরিমানের এলকোহলই শরীরে জন্য ক্ষতিকর। এবং ইউরোপীয়ানদের গড় আয়ু ঈর্ষনীয় হলেও এটা আরও বেশী হতো যদি তারা এলকোহলের আসক্ত না হতো। এই এ্যালকোহল আসক্তির কারনে তারা স্বাস্থ্য ও সামাজিক দিক দিয়ে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

সেক্ষেত্রে অনেক বড়াই করতে পারেন যেসব দেশে এ্যালকোহল নিষিদ্ধ তারা খুব বুঝি ভালো আছে। এটাও মিথ্যা। ২০১৪ সালের এক মেডিক্যাল সমীক্ষায় দেখা যায় যে পুরো বিশ্বে এমফিটামিনে আসক্ত হয়ে যতজন মানুষ ইমার্জেন্সিতে যায়, তার ত্রিশ ভাগ ঘটে সৌদী আরবে। ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানে মদ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলেও সে দেশের জনসংখ্যার ২.৬ শতাংশ হেরোইন গাজা এমফিটামিন ম্যাথ স হ অনেক মারাত্মক ড্রাগে আসক্ত।

প্রশ্ন আসতে পারে মানুষকে কেনো নেশা করতে হয়। এটা কি জেনেটিক? প্রত্নতত্ববিদরা খুজে বের করেছেন আজ হতে প্রায় ৫০০০ থেকে ৬০০০ বছর আগে চীনারা এলকোহলের সংশ্লেষ করতে পারতো এবং বীয়ার জাতীয় পানীয় নিয়মিত পান করতো। তারও আগে ঈজিপশীয়ানরা, হিসাব করলে ১২০০০ বছর আগের ঘটনা, তারা তাদের শস্যাদী ঘরে তুলে বাড়তি অংশ গেজিয়ে মদসমতুল্য এলকোহল সমৃদ্ধ পানীয় পান করতো। যদিও তাতে এলকোহলের পরিমান বর্তমান সময়ের মতো এত বেশী ছিলো না, কিন্তু তা পান করেই টাল হয়ে থাকতো।

এলকোহল বেশ ক্যালোরী সমৃদ্ধ হওয়ায় এটার পুস্টিগুন আছে বৈকি। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের মধ্যে মেসোমোর্ফিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এদের দেহ ক্যালোরী থেকে গ্লুকোজ সংগ্রহ করে সরাসরি মেটাবোলিজমের কাজে ব্যায় করতে পারে। দেহের গঠনে বেশ শক্তিশালী, স্পার্টান এ্যাথলেট যাকে বলে। অনেক প্রাইমেট আছে যাদের মধ্যে উচ্চ ক্যালোরীর খাবার বেশ কাজে দেয়। উচ্চ মেটাবোলিক হার বজায় রাখতে এ্যালকোহলের বিকল্প আর কি হতে পারে। যদিও মানবদেহে এলকোহলের ক্রিয়া একটু বেশী বিনোদনমূলক, পুষ্টিগত দিকের থেকে একটু কমই বা চলে।

আজ হতে ১২ -১৩ হাজার বছর আগে যখন টিভি ইন্টারনেট ইলেক্ট্রিসিটি কিছুই ছিলো না। তখন গরীব শ্রান্ত কৃষক উদাসী মনে আকাশের তারাদের পানে তাকিয়ে পাত্রের গেজানো তাড়িতে চুমুক দিয়ে নিজের কষ্ট ভুলতো। অথবা নতুন বিয়ে বা নবান্নের আনন্দকে আরেকটু ভিন্ন মাত্রা দিতে সাময়িক উত্তেজনার লোভে একটু মদে চুমুক দিলে দুনিয়া তো উল্টে যাচ্ছে না তাই না!

হয়তো এসব কারনেই আমরা নিয়েনডারথাল থেকে আলাদা হতে পেরেছি, বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ হতে পেরেছি। নইলে বানর হয়ে দেখা যেতো ঐ গাছের শাখা প্রশাখায় ডিগবাজী খেতাম।

প্রয়োজন জিনিসটা এমনই একটা অনুষঙ্গ যেটা কিনা সভ্যতার মোড় ঘুরিয়েছে সবসময়ই। জেনোর ছাত্র লিউসিপিয়াসের দর্শনানুসারে কোনো কিছুই দৈব্যক্রমে ঘটে না কিন্তু সবকিছুই ঘটে কোনো কারনে এবং প্রয়োজনে। এ্যারিস্ট টল এই যৌক্তিক প্রয়োজনীয়তাকে একটু স্পস্টবোধক রূপ দিতে গিয়ে বললেন পারস্পরিক বিপরীতার্থক বক্তব্যের একটি সত্য হলে অপরটি অবশ্যই মিথ্যা হবে। এ থেকে ডিডোরাস ক্রোনাস চারটা ধাঁধাঁর জন্ম দেন।

যদিও এরিস্ট টল সে ধাঁধাঁগুলোকে বেশ ভালোভাবেই খন্ডান সাগরের যুদ্ধের উদাহরন টেনে, কিন্তু সব কথার মধ্যে একটা ব্যাপার খুজে পাওয়া যায় না সেটা হলো যদি ১২০০০ বছর আগে এলকোহলের ব্যাব হার না জানতাম বা এলুমিনিয়ামের সংশ্লেষ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতাম, তাহলে কি হতো?

আকাশে কি প্লেন উড়তো না? যুদ্ধাহতরা চিকিৎসাসেবা না পেয়ে গ্যাংগ্রীনে মারা যেতো? নতুবা কেউ না কেউ পরে সেটা আবিস্কার করতোই?

তার চেয়ে বড় কথা আবিস্কার তো হয়েই গেছে, এখন এটা ভেবেই বা লাভ কি?

ঠিক এ কারনেই কি আমরা জাতি হিসেবে কোনো কিছুর আবিস্কারক হতে পারছি না?

একটার সাথে একটা খুব সূক্ষ্ম সংযোগ আছে বৈকি!

উদাসী স্বপ্ন সম্পর্কে

ছেলেটি নেমেছিলো পথে নীল মায়ার হাতছানিতে। প্রথমে বোঝেনি জোছনা কি চায়! উদাসী স্বপ্নগুলো উজার করে তাই আজ নিঃস্ব হয়ে হিসাবের দেনা গুনে যায়। যদি কোনোদিন হিসাব মেলে, তাহলে প্রমেথিউসের মত ভালোবাসা চুরি করে বিলিয়ে দেবে সর্বহারাদের দলে। নির্মোঘ ঘোরে কাটিয়ে দেয়া ইউটোপিয়া তাই আজ খুব আপন....

11 thoughts on “আইসো গাঁজা টানি

  1. মাননীয় সামু  ব্লগ মোডু,অনেক কিছু জানলাম আপনার এ আর্টিকেল থেকে। সুন্দর করে লিখেছেন।  আমার একটি জানার বিষয় ছিলো আপনার কাছে,রাগ করবেন না। আপনি কি ডারউইনের বির্বতন তত্ত্বে বিশ্বাস রাখেন?

    1.  

      Delete

      বিবর্তন তত্ব কোনো বিশ্বাস না, এটা এখন প্রতিষ্ঠিত তত্ব। এটা এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে আপনা পেট খারাপ মাথা ব্যাথা থেকে শুরু করে নতুন নতুন ফসলের জেনেটিক ও হাইব্রীড উৎপাদন তথা আপনার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্ম ও তার টিকার মধ্যেও বিবর্তনের সফল প্রয়োগ আছে। আপনি যদি বিশ্বাস না করেন সেটা আপনার ব্যাপার তবে সেখানে প্রশ্ন আসতে পারে আপনি যদি বিবর্তন বিশ্বাস নাই করেন তাহলে এ্যামোক্সিলিন ফাইমক্সিল অথবা জ্বর জারীর জন্য প্যারাসিটামলের শরনাপন্ন হোন কেন? আপনার তো ডাকাতের লেখা বই অনুসারে কিছু আয়াত পাঠ বা সুন্নতী উস্টমুত্র বা কালিজিরা বা খেজুর পান করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায় তাই না??

       

      উল্লেখ্য আমি সামুর মডু নই

    2. মি. শাহাদাত হোসাইন এর মন্তব্যে আপনার উত্তর সুন্দর আসেনি। :(

  2. আপনার পোস্ট আমি প্রকাশিত হবার পরপরই দেখেছি। কন্টেন্ট বোঝার চেষ্টাও করেছি। পারিবারিক সমস্যার কারণে হোম গ্রাউণ্ড থেকে বাইরে থাকার কারণে ব্লগে উপস্থিত না থাকায় পুনরায় ফিরে আসতে পারি নি। দুঃখিত।

    সদ্য ফিরলাম। আপনার পোস্ট দেখলাম। আপনার পোস্ট আমার মতো অর্বাচীন কেবল পড়তেই পারে, মন্তব্য করার মতো লড়াই বা যুতসই মতামত রাখা কঠিন। ধন্যবাদ। :)

    1. এই অর্বাচীনের লেখাকে এভাবে বলে শুধু শুধু আমাকে লজ্জিত করছেন। আসলে পোস্টটা একটা বড় টপিকের খন্ডাংশ। ইদানীং যুক্তিবিদ্যার কিছু একাডেমিক বই নিয়ে বসি যেসবের আলোকে সমসাময়িক প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করার চেস্টা করি।

       

      যদিও লেখাটার বক্তব্য আরো জোরালো করা যেতো কিন্তু অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নস্ট করছি বলে পোস্টটাকে যুত্সই করতে পারিনি বলে ক্ষমাপ্রার্থী

  3. বিবর্তন তত্ব কোনো বিশ্বাস না এটা এখন প্রতিষ্ঠিত তত্ব

     

    ডারউইন নিশ্চয়ই বানর ছিলো!! 

    1. বিবর্তনবাদের কোথায় বানর থেকে মানুষ এসেছে একটু জানতে আগ্রহী। আমার পোস্টে মিথ্যাচার না করলে খুশি হবো।

      1. বিবর্তনবাদের কোথায় বানর থেকে মানুষ এসেছে একটু জানতে আগ্রহী। আমার পোস্টে মিথ্যাচার না করলে খুশি হবো।  

         

        তাহলে ডারউইন সম্পর্কে আপনি কোন ধারনাই রাখেন না।আপনি তার দেয়া তত্ত্বগুলো ভালো করে পড়ুন। 

  4. বড় কোন আলোচনার খণ্ডাংশ হলে পাঠক বুঝে কম আসবে এটাই স্বাভাবিক। আশা করবো সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশ করবেন। পড়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করছি। আপনাকে ধন্যবাদ ভাই। 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।