একটা কথা শুনা যাচ্ছে, ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসকে তিন/চার/পাচ বছর কাজ করার সুযোগ দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর /মালয়েশিয়া ইত্যাকার উন্নত রাষ্ট্রের অনুরূপ হয়ে উঠবে।
লি কুয়ান ইউ, জিসিএমজি, সিএইচ, এসপিমেজে (জন্ম: ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২৩ – মৃত্যু: ২৩ মার্চ, ২০১৫) স্ট্রেইট সেটেলম্যান্টসে (ব্রিটিশ আমলের সিঙ্গাপুর) জন্মগ্রহণকারী সিঙ্গাপুরের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ছিলেন। সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে দেশের স্বাধীনতার পর ১৯৬৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করেন। তিন দশকেরও অধিক সময় রাষ্ট্রপরিচালনার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। তাকে ‘সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতার জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে পকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে দেশ স্বাধীন হয়। তার শাসন আমলে দেশে কোন কোন উন্নয়নের সূচনা হয়েছিল বটে কিন্তু তিনি সফল হন নাই। বরং বাংলাদেশের মানুষ আরও গরীব হয়েছে, বিচার ব্যবস্থা ছিল একেবারেই নড়বড়ে। ১৯৭৪ সালে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। কংকালসার মানুষ হয়ে পড়ে বাংলাদেশের সিম্বল।
স্বাধীনতার পর আমরা আগাইনি। বরং আর্মিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা পরস্পর রাজনৈতিক খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়ে পরে।
১৯৭৪ সালে জাসদ তাদের চিন্তাধারা তৈরি হলো, “আন্দোলন মানে সশস্ত্র সংগ্রাম আর সংগঠন মানে সেনাবাহিনী।”
সেজন্য জাসদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠে বিপ্লবী গণবাহিনী। এছাড়া সামরিক বাহিনীর মধ্যে ১৯৭৩ সালে থেকে কাজ করছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দৃশ্যপট বদলে যায়।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ইং হতে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ ইং পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘটে যায় সামরিক বাহিনীর নানা ক্যু পাল্টা ক্যু। অবশেষে মেজর জিয়াউর রহমান চলে আসেন ক্ষমতায়। বাংলাদেশের মানুষের আছে ইসলাম ধর্মের প্রভাব, আছে সমাজতন্ত্রের প্রভাব, আছে হিন্দু সাংস্কৃতিক চর্চা, আছে মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার দ্বন্ধ । এই সকল প্রভাবের মাঝে মেজর জিয়াউর রহমান হয়ে উঠেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। কঠোর সামরিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এমনকি যাদের প্রত্যক্ষ মদদে তিনি ক্ষমতার শীর্ষে আসেন, তাদের তিনি সামরিক কায়দায় নিয়ন্ত্রণ করেন। এবং তিনি স্বৈরাচারী নীতি গ্রহণ না করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাস্ট্র পরিচালনার নীতি গ্রহণ করেন।
সিঙ্গাপুর যেভাবে এগিয়েছে জিয়াউর রহমান সেদিকে যান নি। সামরিক বাহিনীকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন সিভিল সোসাইটির প্রতি তিনি সেই ভাবে আগান নি। তিনি সকল রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত দ্বন্দ্বগুলিকে ঐক্যের ভিত্তিতে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন এবং অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন । তিনি বুঝেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীন হওয়া রাস্ট্রগুলি গণতান্ত্রিক পথে ধরেই রাজনৈতিক খুনাখুনি এড়িয়ে সিভিল প্রসাশনের নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ধারাকে নিয়ে এলেন রাজনীতিতে। এদিন রাস্ট্র ছিল সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার ধারক ও বাহক। বরং শেখ মুজিবর রহমান দেশকে কমিউনিউজমের মতাদর্শের চরম মতামতে দিকে দেশকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন । ১৯৭৫ এর পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা পেয়ে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন। তিনি সকল প্রকার মতাদর্শের মাঝে একটা ঐক্য গড়ার চেষ্টা করতে থাকেন। দেশ পেয়ে যায় গণতান্ত্রিক পথ। কিন্তু তিনিও সামরিক হানাহানির করুন স্বীকারে পরিনত হন। আর ছিটকে যায় দেশ। আবার স্বৈরাচার ঝেপে বসে দেশের নেতৃত্বে।
১৯৯০ সালের ও ২০২৪ সালের পটপরিবর্তনের ইতিহাস আমরা জানি। আমরা জানি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে চক্রকারে ঘুর্নায়মান রাজনীতি। হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও, পুড়াও, রাজপথে গণপরিবহনে পুড়ে যাওয়া মানুষের আর্তনাদ আজও আমাদের কানকে ভারী করে তুলে। কিন্তু যে-ই ক্ষমতায় যায় সেই নির্বাচন পদ্ধতিকে টেম্পারিং করে নিজের গদীকে চিরস্থায়ী করার কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। ১৯৯০ থেকে ২০২৫ সুদীর্ঘ ৩৫ টি বছর রাজনৈতিকভাবে দেশ এগোয়নি এক রত্তি। কিন্তু দেশ থেমে থাকেনি।
১৯৭২-৭৩ সালে তাজউদ্দীন আহমেদ যে বাজেট দেন তার আকার ছিল ৭৮৬ কোটি, ১৯৭৬-৭৭ সালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাজেট দেন তার আকার ছিল ১৯৮৯ কোটি, ১৯৭৭-৭৮ সালে লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান যেই বাজেট দেন তার আকার ছিল ২১৮৪ কোটি টাকা, ২০২৩-২৪ সালে আ হ ম মোস্তফা কামাল যেই বাজেট দেন তার পরিমাণ ছিল ৭ লক্ষ ৬১ হাজর ৭৮৫ কোটি টাকা।
সময়ের চাকা ঘুরছে আর অর্থনীতির আকার বেড়েছে। বাংলাদেশিদের মাথা চক্কর দিয়াছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ডামাডোলে। কি বিশাল কর্মকাণ্ড! আর এর অন্তরালে চলছে দূর্নীতির মহা উৎসব। এমনকি এক পর্যায়েতো দূর্নীতিতে পর পর পাঁচ বার পৃথিবীর সেরা পদ অলংকৃত করেছে। এরপর বাংলাদেশ দেখল মেগা প্রজেক্টের মেগা ডাকাতি, ব্যাংক লুটপাটের কাহিনি। আই ওয়াশ করে দুইটি পরিবারের লুটপাট দেখেছে মানুষ। আর শুনা গেছে উন্নয়নের বাদ্যবাজনা। কখনও এক পরিবার লুট করেছে তাদের স্বার্থরক্ষাকারী সহযোগিতায় আবার কখনও অন্য পরিবার আর তাদের রাজনৈতিক অনুসারীরা।
মানুষ! ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পরবর্তীতে গরীব মানুষ যেই অবস্থায় ছিল আজও সেই অবস্থায় আছে। ধনিক শ্রেণী আর চালাক সুবিধাবাদীরা রাস্ট্রীয় লুটপাতে অংশীদার হয়ে একটা অতি ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। আর গরীব দিন দিন ক্রমে গরীব থেকে গরীব হয়েছে।
অতি উচ্চমাত্রার প্রচার প্রচারনায় বাংলাদেশের এই প্রকৃত চিত্রটি হারিয়ে গিয়াছিল। নব্বুইয়ের দশকেও বাজেট ঘোষিত হলে বলা হত গবীর মারার বাজেট। কিন্তু গত এক দশকে তেমন শ্লোগান শুনেছি বলে মনে করতে পারি না। সবকিছু ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, মুখগুলো ছিল তালাবদ্ধ। অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে কথা বলার লোক ছিল না। ছিল দুই প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের দ্বন্দ্ব। এক পক্ষে লুটের মহোৎসব করেছে, আর এক পক্ষে ছিল হাহাকার। জনগণ বুঝে গিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলির আন্দোলন হল ভাগ না পাওয়ার বা লুটে নেতৃত্ব দিতে না পারার ক্রোধ। তাই সব আন্দোলন ব্যর্থ হচ্ছিল।
কিন্তু যখনই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নামে আন্দোলন হল শুরু, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিল যুব সমাজ আর মরল কাতারে কাতারে। দেশের মানুষ নেমে এলো রাজপথে । শুরু হলো গণ-জোয়ার। হলে গেল গণঅভ্যুত্থান। এক পক্ষ পালাল। অন্যপক্ষ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। অভ্যুত্থানের তিন দিনের মধ্যে তারা নির্বাচন দেয়ার জন্য সভা সমাবেশ করল। কারন তারা জানে এই নির্বাচন ব্যবস্থা তাদের পেশিশক্তি ও অর্থশক্তির উপর নির্ভর। ঢ়েহেতু এক পক্ষ পালাইছে অন্য পক্ষের কাছে নির্বাচনে জয়ী হওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার।
কিন্তু বাধ সাধলো বৈষম্য বিরোধীরা। তারা আন্তর্জাতিক ভাবে গ্রহনযোগ্য নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে এসে সরকার প্রধান করে দিল। সেনাপ্রধানের সমর্থনে সর্বজনীনভাবে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠলেন এই অর্থনীতিবিদ। প্রাথমিক ঝক্কি সামলাতে সামর্থ্য হওয়ার পর তিনি যখন অল্পসময়ে একে একে সফল হতে লাগলেন, তখন নানা মহল থেকে দাবী উঠলো দেশকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বানাতে তাকে রেখে দিতে হবে ক্ষমতায়।
কিন্তু এই সন্মানিত ব্যক্তিত্ব একি করলেন! দেশ বিদেশ থেকে গণ্যমান্য প্রভাবশালী কোম্পানির ডেকে এনে তাদের সামনে বাংলাদেশকে উলঙ্গ করে দিলেন! তিনি কেঁদে উঠলেন! এদেশের গরীব মানুষের কথা স্মরণ করে কেউ কাঁদে! তাও আবার ব্যবসায়িদের মিলনমেলায়। ব্যবসায়ীরা পুজির পুজো করে। প্রফিট করাই যাদের মুল কাজ। তাদেরকে কেঁদে কেঁদে বললেন, আমরা খুবই গরীব। এখানে চার কোটি মানুষ দৈনিক ১০০ টাকায় চলে। তিনি এখানে ইনভেস্ট করার আহ্বান করলেন। তিনি এখানে তার সামাজিক ব্যবসার কথা বললেন। তিনি গরীব মানুষের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরনের।
আর স্পষ্টতই তিনি এদেশ নিয়ে যারা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া হবার স্বপ্ন দেখেন তাদের সেই চাওয়াকে পাশকাটিয়ে সারাজীবন তিনি যা চেয়েছেন গরীবমুক্ত, বেকারমুক্ত পৃথিবী সেই দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
কিন্তু তিনি কিভাবে নির্মাণ করবেন বৈষম্য হীন গরীবমুক্ত, বেকারমুক্ত পৃথিবী! যেখানে তার নিজের দেশে রয়ে গেছে গরীবের অনেক বেশি ছড়াছড়ি। অন্তত একটি দেশেতো তার থিওরির বাস্তবায়ন দেখাতে হবে। সমস্ত পৃথিবীর প্রশ্নতো আসবে পরে। অন্তত একটা দেশতো করে দেখাতে হবে দরিদ্রমুক্ত বেকারমুক্ত।
অনেকে সিঙ্গাপুরের, মালয়েশিয়ার আবদার নিয়ে আসছে, কিন্তু দেশর মানুষ চেয়ে আছে তার দিকে কিভাবে তিনি গরীবমুক্ত, বেকারমুক্ত দেশ করতে চান তার সঠিক পথনির্দেশনার দিকে।
অপেক্ষায় রইলাম।