বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি ‘জাতীয় ঐক্য’র ডাক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপির মূল মোর্চায় এই ঐক্যের ছায়াতলে এসে সমবেত হয়েছেন ড. কামাল হোসেন, ডা. বি চৌধুরী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না। হঠাৎ করে এসে শামিল হয়েছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদও। এই প্রকাশ্যে আসার মাধ্যমে সুলতান মনসুর, আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সম্পর্কের শেষ পেরেকটি ঠুকে দিলেন- তা বলাই যায়।
এই ঐক্যে এখন পর্যন্ত একটি দলকে দেখা যায়নি। তারা জামায়াতে ইসলামী। আসেননি জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকীও। মি. সিদ্দিকী আসবেন কী না, তা পরিষ্কার নয় যদিও কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম সহায়ক শক্তি বিএনপি এই ঐক্যের মূল চালিকাশক্তি। এটা আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি। বিএনপি বলে দিয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার অনুমতি নিয়েই এই ঐক্য হতে যাচ্ছে ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে। আমরা জানি বিএনপির মহাসচিব সম্প্রতি আমেরিকা-ইংল্যান্ড সফর করে গেছেন। তিনি জাতিসংঘে নালিশ জানিয়ে ওয়াশিংটন যান। সেখানে মার্কিন স্টেট ডিপার্টম্যান্টে তিনি অভিযোগ জানান বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। এর পরে লন্ডন গিয়ে জনাব তারেক রহমানের কাছে রিপোর্ট দিয়ে ঢাকায় ফিরেন। এই ঐক্য- সেই সফরেরই অংশ। কারণ মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেই ঐক্যে শামিল হয়েছেন।
এই ঐক্য নিয়ে দুটি প্রশ্ন আসছে প্রথমেই। তা হলো- বিএনপি একা যে আন্দোলনের হুমকি ধমকি দিচ্ছিল, তা কি চুপসে গেল? আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিএনপি’র অন্যতম ভোটব্যাংক জামায়তকে নেপথ্যে রেখে ঐক্যের যে মহড়া হচ্ছে, তার আসল পরিণতি কী?
২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। দুটি মন্ত্রীত্ব জামায়াতকে দেওয়া হয়। এমন দু’জনকে মন্ত্রী করা হয়, যারা ১৯৭১ সালে সরাসরি বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গোলাম আজমকে পুনর্বাসনের পথ ধরে এই মন্ত্রীত্ব দেওয়াটা ছিল ইতিহাসের অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনা। বিএনপি মৌলবাদীদের সঙ্গে নিয়ে দেশে জঙ্গীবাদ কায়েম করেছিল। এই দেশের মানুষ ‘শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইয়ের’ তাণ্ডব ভুলে যাননি। একটি ভবন নিয়ন্ত্রণ করতো সকল ক্ষমতা। এসব কথা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যাননি।
২০০৮ এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের হেরে যাওয়া ছিল সময়ের দাবি। এর পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রপট। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা আনে। নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু করার ঘটনা- বিশ্বসবাসীকে নতুন করে বাংলাদেশকে চিনিয়ে দেয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের আগুয়ান প্রজন্মের হাত দেখে চমকে উঠে দুনিয়ার অনেকেই। এর সবই সম্ভব হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যার সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে এইবারে টানা আট বছর। অথচ বিএনপি ক্ষমতার জন্য মরিয়া। এই টানাপোড়েন থেকেই বিএনপি পথ খুঁজতে থাকে ক্ষমতায় পুনরায় আরোহণ করার।
কি করেনি তারা! জ্বালাও পোড়াও করে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলেন তো এরাই! যোড়ষ সংশোধনীর মাধ্যমে এর বীজ বুনতে থাকে বিএনপি-জামায়াত জোট। এর পরের ঘটনাক্রমে সামনে চলে আসেন সেই সময়ের প্রধান বিচারপতি শ্রী সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। একটা পর্যায়ে বিচারপতি সিনহা দেশত্যাগ করেন। সংসদ ও বিচার বিভাগের যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছিল এর জের ধরেই তিনি ক্ষমতা হারান অথবা পদত্যাগ করেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, এর পরপরই এই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ উঠলো কি করে!
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ উঠেছিল, যার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি বলে তার সহকর্মীরা জানিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলামের স্বাক্ষরে বিবৃতিটি আসার আগে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা আপিল বিভাগ ও হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন।
ছুটি নিয়ে বিচারপতি সিনহা বিদেশে যাওয়ার আগে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তাকে ‘বিভ্রান্তিমূলক’ আখ্যায়িত করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায় নিয়ে সমালোচনার মধ্যে সংসদে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছিল মন্ত্রীদের কাছ থেকে। সেইবারে তার সহকর্মীদের মধ্য থেকেও একই অভিযোগ এসেছিল।
বিষয়টি প্রকাশের পর আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আব্দুল মতিন খসরু সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে বলা হয় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত ৩০ সেপ্টেম্বও ২০১৭ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের ডেকে নিয়ে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ‘১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ’ তুলে ধরেন। বলা হয়- “দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্বলিত দালিলিক তথ্যাদি হস্তান্তর করেন। তন্মধ্যে বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ আরও সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিচারপতি সিনহার ভাইয়ের নামে রাজউকের প্লট নেওয়ায় অনিয়মের কথা সংসদে বলেছিলেন। যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করার কথাও বলেছিলেন তিনি। সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মালিকানাধীন ব্যাংকে বেনামে বিচারপতি সিনহার অর্থ জমা রাখার কথা বলেছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। এমন অনেক অভিযোগ ঝুলন্ত রেখেই সাবেক প্রধান বিচারপতি এখন আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বলে মিডিয়া জানাচ্ছে। তিনি আবার আলোচনায় এসেছেন একটি বই লিখে।
প্রধান বিচারপতির বই -’ এ ব্রোকেন ড্রিম : রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ নিয়ে না না আলোচনা চলছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে এই বই ব্যাপক প্রশ্নের অবতারণা করেছে।
একই সাথে একটি রিপোর্ট ছেপেছে ভারতের একটি জাতীয় ‘দৈনিক যুগশঙ্খ’।পত্রিকাটি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বাংলাদেশে আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রোষানলে দেশত্যাগী প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে রাষ্ট্রপতি করবে খালেদা জিয়ার দল বিএনপি। ইতোমধ্যে সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। দলটির একাধিক শীর্ষনেতা যুগশঙ্খের কাছে বাংলাদেশের প্রথম হিন্দু প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দেশটির ‘প্রথম হিন্দু রাষ্ট্রপতি’ করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন।
যুগশঙ্খের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, এর আগে প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন সুরেন্দ্র কুমারকে বিএনপি তাদের প্রস্তাবিত ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নাম প্রস্তাবের কথা বলেছিল। বিএনপির একাধিক নেতা ওই সময় বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ‘ঐক্যমতের রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। পত্রিকাটি আরো লিখেছে, বিচারপতি সিনহাকে রাষ্ট্রপতি করার আলোচনা নিয়ে বাংলাদেশের একাধিক বুদ্ধিজীবীর কথায়, বাংলাদেশে বর্তমানে যে হারে ভারতবিরোধীতা বাড়ছে; সেটা কমাতে বিএনপির এই সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও কাজে দেবে। একই সঙ্গে দিল্লির তরফ থেকেও বিএনপির এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাবে।
সব মিলিয়ে একটি ঐক্য এবং এটি ব্রোকেন ড্রিম এখন বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন দেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী। এসব নিয়ে তাঁকেও বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ইতিবাচক রাজনৈতিক ঐক্য হতেই পারে। কিন্তু সেই ঐক্য যদি হয় জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার নেপথ্য হাতিয়ার তবে তা কি বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেবে?
বিচারপতি সিনহা যা বলছেন, এর জবাব অনেকেই দিতে পারবেন। সবচেয়ে ভালো পারবেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা। যিনি মিস্টার সিনহা বিদেশে চলে আসার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমরা দেখছি, একটি মহল বিদেশে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। এরা খুবই চিহ্নিত শক্তি। এদের অর্থ কোথা থেকে আসছে, তাও
বাংলাদেশ সরকারের অজানা নয়। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই এগুতে হবে। মনে রাখতে হবে, জাতির জনকের স্বপ্নের বিরোধীরা তাদের মুখোশ খুলতে শুরু করেছে। এবার তাদের ভালো করে চেনার পালা।
ফকির ইলিয়াস: কলামিস্ট।
জাতির জনকের স্বপ্নের বিরোধীরা তাদের মুখোশ খুলতে শুরু করেছে। এবার তাদের ভালো করে চেনার পালা।
বাংলাদেশে সুখ আর সমৃদ্ধি বজায় থাক।