মিনি বিলাই

আমার বালক বয়সে আমাদের বাসায় বিড়াল ছিল। জন্মের পর থেকেই আমি দেইখা আসছি এইগুলাকে। আমরা ‘বিড়াল’ বলতাম না, আমরা বলতাম ‘বিলাই’। আমার আম্মা ডাকত মিনি। বস্তুত আম্মার লাইতেই মিনি বিলাই আমাদের বাসায় থাকত আর বছর বছর তিন চাইরটা কইরা বাচ্চা দিত। তারপর বাচ্চাগুলা বড় হইতে হইতে অন্যান্য বাসায়ে ছড়ায়ে যাইত। আমাদের উঠান বাগান বাসা মিলায়ে প্রায় তিন চারটা বিলাই ঘুইরা বেড়াইত। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টা, যেইটারে আমার আম্মা মিনি বইলা ডাকত, থাকত আমাদের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি কইরা। বাথরুম করত খাটের তলায়। আর সেই বাথরুম করা নিয়া আব্বার সাথে আম্মার মাঝে মাঝে ঝগড়া হইলেও আম্মার কারনে আব্বা বেশী বেইল পাইত না। কাজের লোক, যাদেরকে আমরা খালা বইলা ডাকতাম, তারা কখনোই বিলাইয়ের গু সাফ করতে চাইত না। কাজটা আম্মারেই করতে হইত। এইটা নিয়া আম্মার কখনো বিরক্তি দেখি নাই।

তো, তখন আমরা, মানে আমি আর আমার বোন ক্লাস থ্রি তে পড়ি মনে হয়, কিংবা ওয়ানে। আমাদের বাংলা বইয়ে একটা গল্প ছিল বিলাই নিয়া। সেইখানে লেখা ছিল, ‘মিনির দুধ খাওয়ার বাটি আছে। মিনি দুধ খায় চুকচুক।’ এইটা পইড়া আমাদের মনে হইল আমাদের মিনির তো আলাদা কোনো বাটি নাই। মিনিরে আমরা যখন যেইখানে পারি মাছের কাটা, বাইচা যাওয়া ভাত খাইতে দেই। তো, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের মিনির জন্য আলাদা বাটি রাখব। বাসার বাটি দিয়া হবে না কারন আমরা বললেই সেইটা মিনির হইয়া যাবে না। অনুমতির ব্যাপার আছে। সংসারে তখন আমাদের কথা কিংবা মতামতের মূল্য নাই। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম দিলবাহারওয়ালার কাছ থেকে দুই টাকা দিয়া একটা প্লাস্টিকের বাটি কিনবো। দিলবাহার হইল কটকটি। সারা দেশে যেই জিনিসের নাম কটকটি সেইটারে আমাদের এলাকায় বলত দিলবাহার। এইটা কেন হইল আল্লাহ মালুম। দুই তিন দিন খোঁজ খবর কইরা আমি আর আমার বোন এক টাকা কইরা চাদা দিয়া হলুদ রঙের একটা বাটি কিইনা ফালাইলাম। বাসায় আইসা ঘোষনা দিলাম এইটা মিনির বাটি। এই বাটি বাদে অন্য বাটতে যেন মিনিরে খাবার দেয়া না হয়। শুধু তাই না, সকাল বিকাল খেয়াল রাখতে লাগলাম কেউ যেন এর ব্যত্যয় না ঘটায়। এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমি আর আমার বোন খেয়াল করলাম বইতে লেখা থাকলেও আমরা মিনিরে দুধ খাইতে দেই না। আমরা গিয়া আম্মারে ধরলাম। আম্মা হাইসা দিয়া মিনিরে মাঝে মাঝে আধা বাটি কইরা দুধ বরাদ্দ দিল। সময় যাইতে থাকল আর আমরাও মিনি আর তার বাটি নিয়া উৎসাহ হারাইয়া ফেললাম। আগের মতই মিনি আর অন্যান্য বিলাই আমাদের বাসায় চইরা বেড়াইতে লাগল।

এরও প্রায় বছর দুইয়েক পরে এক চমৎকার শীতের সিজনে আমরা লক্ষ করলাম আমাদের বাসায় বিলাইয়ের সংখ্যা অত্যধিক বাইড়া গেছে। যখন তখন যেকোন খাবারে মুখ দেয়া, টেবিল থেকে কাচের জিনিসপত্র ফালায়া ভাইংগা ফালানো তাদের প্রাত্যহিক কাজে পরিণত হইল। আমার বড় আপা আর তার বান্ধবীরা মিইলা সিদ্ধান্ত নিল তিনটা বাদে অন্য বিলাইগুলা দূরে গিয়া ফালাইয়া দিয়া আসবে। দূর বলতে প্রায় তিন চার কিলো দূরে খালপাড়ে ফালাইয়া দিয়া আসবে। আমাদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা আইসা ভর করল। তো এক সকালে ছোট বড় প্রায় চাইর পাঁচটা বিলাই আমরা বস্তায় ভইরা রওনা হইলাম। আমরা বলতে আপা তার বান্ধবীরা আর সাথে আমরা এলাকার গুরাগারা চার পাঁচজন। রাস্তা দিয়া যাইতেছি, মাঝে মাঝে বিলাইগুলা বস্তার ভিতর থেকে মিঁউমিঁউ কইরা ডাকতেছে। ডাক শুইনা পথচারিরা অবাক হইয়া তাকাইতেছে আর সেইটা দেইখা আপা আর তার বান্ধবীরা মুখে ওড়না দিয়া খিল খিল কইরা হাসতেছে। পিছন থেইকা আমরাও মজা পাইতেছি। প্রায় ঘন্টাদেড়েক হাঁটার পর একটা ফাঁকা এলাকায়, নদীর চরের কাছাকাছি আইসা আমরা বস্তা ফাঁকা কইরা বিলাইগুলারে ফালাইয়া দৌড় দিলাম। করুণ সুরে ডাকতে ডাকতে বিলাইগুলা আমাদের পিছন পিছন কিছুদূর আইসা আস্তে আস্তে পিছায়া পড়ল। আমরা তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় আইসা পড়লাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হইল না। আমরা ফিইরা আসার দুই ঘন্টার মধ্যে সবগুলা বিলাই আমাদের বাসায় আইসা হাজির। যেন কিছুই হয় নাই, এমন ভাব নিয়া তারা হেলতে দুলতে আবার চইরা বেড়াইতে লাগল। আপা আর তার বান্ধবীরা ভাবতে বসল, সমস্যাটা কোথায় ছিল!

তারপর আরো প্রায় এক সপ্তাহ গবেষণা কইরা, এর ওর কাছে আলাপ পাইড়া বোঝা গেল বিলাই ডিরেকশন বুঝতে পারে। এইজন্য যেইটা করতে হবে তা হইল, বস্তার ভিতর ভরার পর বস্তাটারে কয়েকবার ঘুরাইতে হবে। এই কাজ কয়েকবার করতে হবে। বস্তা থেইকা ফালানির আগে একটা রাম ঘুল্লি দিতে হবে। আর সম্ভব হইলে যেই রাস্তা দিয়া নিয়া যাব, ফেরার সময় অন্য রাস্তা দিয়া আসতে হবে।
তো আমরা প্ল্যান মোতাবেক আবার এক শীতের সকালে বিলাইগুলারে বস্তায় ভইরা রওনা হইলাম। এবার আরো দূরে, প্রায় নদীর ধারে এক নির্জন মাটির রাস্তায় বিলাইগুলারে ফালায়া দিয়া আসলাম। আসার সময় ভিন্ন রাস্তা ধইরা ফিরলাম যেন তারা কনফিউজড হইয়া যায়। বাসায় আইসা একটু খেলাধুলা কইরা দুপুরে ভাত খাইতে বসছি, দেখলাম তারা আবারো হাজির। আমাদের চাইরপাশে ঘুইরা বেড়াইতেছে। আম্মা এর মধ্যে লক্ষ করল সব বিলাই আসছে কেবল ছোটোটা ছাড়া। ভাত খাওয়ার পর আমার বোন আইসা আমারে জানাইল, যেই বিলাইটা আসে নাই সেইটা এমনিতেই একটু আদুরে আর অলস। আর ছোট বইলা হয়ত অন্যগুলার সাথে তাল মিলাইতে পারে নাই। কে জানে, সব বিলাই যখন আমাদের মাছের কাঁটা আর ভাত খাইতেছে তখন ওইটা হয়ত এখনো কাইন্দা কাইন্দা মায়েরে খুঁজতেছে। কোথায় যাবে বিলাইটা? একা একা ঘুরতেছে বেচারা। শুইনা আমার কেমন জানি লাগল। এইভাবে তো আমি ভাবি নাই! যেইখানে ফালায়া দিয়া আসছি সেইখানের আশেপাশে কোনো জনমানব নাই। আর ছোট বইলা ও ত নিজের খাবারও জোগাড় করতে পারবে না। ভাত খাইয়া আমি আর দেরি করলাম না। আমার বন্ধু রাজুরে নিয়া সেই সাদার উপর কালো ফোটাঁওয়ালা বিলাইরে খুঁজতে বাইর হইয়া গেলাম। যাইতে যাইতে খুঁজতেছি আর মাঝে মাঝে মানুষরে জিজ্ঞাসা করতেছি। এইরকম করতে করতে বিকাল নাগাদ যেইখানে ফালায়া দিয়া আসছিলাম সেইখানে পৌঁছায়া গেলাম। গিয়া ওইটারে আর পাই না। আশেপাশে খুজলাম। ওইখান থেকে বেশ দূরে জাইল্যাদের গ্রামেও খুঁইজা আসলাম। পাইলাম না। খুইজা আবার, যেইখানে ফালায়া দিয়া আসছিলাম সেখানে গেলাম। রাস্তার ধারে একটা নাম না জানা বড় গাছের নিচে ফালায়া দিছিলাম সেইটার আশেপাশে অনেক খুঁজলাম। শীতের সময়, দ্রুত অন্ধকার হইয়া আসতেছে। সামনেই কিছুদূর পর নদী। তার আশে পাশে শুকায়া থাকা ঘের। ঝোপঝাড়ও নাই যে লুকায়া থাকবে। কিছুক্ষনের মধ্যে অন্ধকার ঘনায়া আসল। পাইলাম না। বিলাইটার কোনো নামও নাই যে ডাক দিব। তবু কয়েকবার মিনি বিলাই মিনি বিলাই কইয়া ডাক দিতে গিয়া দেখলাম গলার কাছে আইসা আটকাইয়া যাইতেছে। অন্ধকার হইয়া যাওয়া সেই সন্ধ্যায় আমার বন্ধু রাজু আমার ঘাড়ে হাত দিয়া বলল, ‘কাইন্দো না মুরাদ, কাইন্দো না’। আমি চোখ মুছতে মুছতে চারদিক অন্ধকার হইয়া গেল। মিনি বিলাইরে আর খুঁইজা পাইলাম না। কিন্তু সেই বালক বয়সে মনের মধ্যে ছাপ রইয়া গেল। বাসায় আইসা আমার বোনরে সব খুইলা বললাম। তার কোনো প্রতিক্রিয়া পাইলাম না। অন্য সবার মত তার কাছেও বিষয়টা গুরুত্ব হারাইছে। কিন্তু আমি মিনি বিলাইরে ভুলতে পারি নাই।

এরপর বিশ বছরেরও অধিক পার হইয়া গেছে। বিস্ময়কর হইলেও সত্য, আমি এখনো হঠাৎ হঠাৎ স্বপ্ন দেখি, সন্ধ্যা নাইমা আসতেছে। লোকালয়হীন নির্জন এক মেঠোপথের এক প্রকান্ড গাছের নিচে বালক বয়সের আমি দাড়ায়া আছি। পশুর নদী গিলা ফেলতেছে সূর্য। আমার গলা অবধি কান্না। চারদিক অন্ধকার হয়া যাইতেছে। আমি কি মিনি বিলাই ছাড়াই ফিইরা যাব? আজতক কোন স্বপ্নেই আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি নাই। মাঝে মাঝে মনে হয়, স্বপ্নে অন্তত যদি একবার সেই সাদার উপর কালো ফোঁটাওয়ালা আমার মিনি বিলাইরে খুঁইজা পাইতাম, তাইলে আত্মাটা একটু শান্ত হইত।

2 thoughts on “মিনি বিলাই

  1. অসাধারণ কিছু পড়লাম। কথ্য ভাষার ব্যবহার থাকায় মনে হচ্ছিলো কেউ কানের কাছে বসে জীবনের গল্প বলে চলেছে। আর আমি তন্ময় হয়ে শুনছি।
    … চোখের সামনে ভেসে উঠছে চিত্রপট।

    অসংখ্য ধন্যবাদ মি. মুরাদ কিবরিয়া। শব্দনীড় এ আপনাকে স্বাগতম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  2. বিলাই উপাখ্যান পড়ে আনন্দ পাইলাম। বহুদিন শব্দনীড়ে এমন লিখা পড়িনি। শব্দনীড় ব্লগারদের অনেক শেখার আছে এই লিখা থেকে। 

    লেখককে শব্দনীড়ে স্বাগত জানাইhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।