কিশোর উপন্যাস : বাঘিনীর কোলে মানব শিশু
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার মানুষদের প্রতিনিয়ত সিডর বা জলোচ্ছ্বাসের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। প্রায় প্রতিনিয়ত সিডরের নির্মম অাঘাতে অকালে কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার তাজা প্রাণ। ১৯৭০, ১৯৮৮ এবং ১৯৯১ সালে সিডরের নিষ্ঠুর ছোবলে হারিয়ে গেছে কয়েক লক্ষ তাজা প্রাণ।
১৯৯৮ সালের মাঝামাঝিতে হিরণ পয়েন্ট -এর অদূরে এবং সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত দুবলার চরে জেলে পাড়ার অধিবাসী সন্তান সম্ভাবনা কমলার জীবনে ঘটে গেছে এক লোমহর্ষক হৃদয় বিদারক অভাবনীয় দূর্ঘটনা। সেদিন সকালে অাকাশ ছিল ঘন কালো মেঘে ঢাকা। সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। প্রকৃতিতে থমথমে ভাব বিরাজ করছিল অার সিগনাল নং চলছিল দশ। কমলার স্বামী আব্বাস মিয়া গত সাত দিন আগে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গেছে। বেতার ও টেলিভিশনে একটু পর পর সতর্কবাণী প্রচার করা হচ্ছে। — সতর্কবাণী শুনে অনেকেই বাড়ি-ঘরের মায়া ছেড়ে শেল্টার স্টেশনে অাশ্রয় নিল।
এদিকে কমলা তার নিজের কথা না ভেবে ভাবছে তার প্রাণ প্রিয় স্বামীর কথা। সে তো এখনও ফিরলো না। সে সমুদ্রে ডুবে মরবে অার অামি স্বার্থপরের মতো পালিয়ে যেয়ে নিজের জীবন রক্ষা করব? না, না এমন জীবন আমি চাই না। বাঁচতে হয় দু’জন এক সঙ্গেই বাঁচব।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল অার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সময় যত পার হতে লাগল বৃষ্টি ও বাতাসের বেগ ততই বাড়তে লাগল। কুপি জ্বেলে কমলা ঘরে খাটের উপর বসে নানান কথা ভাবছে। ক্লান্ত শরীরে ভাবতে ভাবতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। গভীর রাতে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ এবং অসহায় মানুষের অার্তচিৎকারে হঠাৎ কমলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে জেগে সে সর্বগ্রাসী পানির শোঁ শোঁ শব্দ আর বাঁচাও বাঁচাও বলে মানুষের কান্নার শব্দ শুনতে পেল। কমলার মনে হল, এই বুঝি সর্বগ্রাসী জলোচ্ছ্বাস পাহাড় সমান উঁচু হয়ে দূর্বার গতিতে ছুটে অাসছে সব কিছু ভাসিয়ে নেওয়ার জন্য।
এতক্ষণে তার স্বামী কি বেঁচে আছে? নাকি মরে গেছে? সে এখন কি করবে? তার স্বামী যদি জীবিত থাকে তাহলে তার কাছে অবশ্যই ফিরে অাসবে। তাছাড়া তার পেটের সন্তান ও দুই এক দিনের মধ্যেই ভূমিষ্ঠ হবে। সে এসব কথা ভাবছে অার অাল্লাহকে স্মরণ করছে। দেখতে দেখতেই ঘরের ভিতর এক হাঁটু পানি ঢুকে পড়ল। পেটের বাচ্চার কথা মনে করে কমলার মনে বেঁচে থাকার সাধ জাগল। সে ভাবল, অামি তো একা নই।পেটে অামার বাচ্চা আছে। না, না আমি মরতে পারি না। আমাকে অামার বাচ্চার জন্য বেঁচে থাকতে হবে। কিন্ত এখন সে কোথায় যাবে? কি ভাবে বাঁচবে?
এসব ভাবছে অার ভয়ে তার বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভাবতে না ভাবতেই একটা উঁচু ঢেউ- এর অাঘাতে কমলার ঘরটি ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেল। অার কমলা খাটের উপর ভাসতে লাগল। কমলা শেষ বারের মতো বাঁচার জন্য তার শাড়ির অাঁচল দিয়ে নিজেকে খাটের সাথে বেঁধে ফেলল।
এক পর্যায়ে কমলা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে খাটটি তখন ভাসতে ভাসতে সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে ঢুকে গাছের সাথে আঁটকে গেল। ভোরে ঝড় থেমে গেল এবং পানিও কমতে থাকল। পানি কমার সাথে সাথে খাটটি কাদা মাটির সাথে ঠেকে গেল। অাস্তে আস্তে কমলার জ্ঞান ফিরে এলে সে দেখল গভীর জঙ্গলে খাটের উপর শুয়ে আছে। চারদিকে থমথমে ভাব। কোথাও কোন জন মানবের সাড়া নেই। তার ভীষণ ভয় করছে। এই বুঝি বাঘ, সিংহ এসে তাকে খেয়ে ফেলবে। এসব ভাবনা আর টেনশনে তার প্রসব বেদনা শুরু হয়ে গেল।
— ধীরে ধীরে ব্যথাটা প্রচণ্ড আকার ধারণ করল। কমলা ব্যাথায় চিৎকার করতে করতে একটি কন্যা সন্তান প্রসব করল এবং এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে মারা গেল মা কমলা।
কষ্টের ভয়ঙ্কর কালো রাতটা পার হয়ে ভোর হয়েছে। কিন্তু তখনো চারদিকে অন্ধকার। ঠিক সেই ভোরে এক বাঘিনী ছুটে এসেছে নদীর কূলে জঙ্গলের কাছে। গত রাতে ঝড়ের কবলে পড়ে বাঘিনীর একটি বাচ্চা ভেসে গেছে পানির স্রোতে। বাঘিনীর মনটা খুবই খারাপ। দু’টো বাচ্চার মধ্যে একটা বাচ্চাকে হারিয়ে বাঘিনী উন্মাদ
হয়ে গেছে।
মানব শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েই কয়েকবার ওয়া…ওয়া… করে কেঁদে উঠল। বাঘিনী তার আশ-পাশে মানব শিশুর কান্না শুনে খুঁজতে লাগল। একটু পরেই ফর্সা হয়ে গেল। বাঘিনী দেখতে পেল অদূরেই একটি মানব দেহ পড়ে আছে।
— বাঘিনী ছুটে এসে মানব দেহের ওপর অাক্রমণ করতে গেল। ঠিক তখন মহান আল্লাহ পাকের ইশারায় বাঘিনীর দুধ পড়ল মানব শিশুটির মুখে। শিশুটি ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিল। অমনি শিশুটি বাঘিনীর দুধ পান করতে লাগল। বাঘিনী তখন কৌতুহল বশতঃ থমকে দাঁড়াল। লুকিয়ে লুকিয়ে কে তার দুধ পান করছে সেটা দেখার জন্য।
বাঘিনী তখন দেখল এক আশ্চর্য ব্যাপার। এত এক মানব শিশু। মুহুর্তে বাঘিনী গর্জে উঠে হাঁ করে মানব শিশুটিকে খেতে যায়। ঠিক তখন শিশুটি হেসে ওঠে। ——– আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের ইশারায় শিশুটির জন্য বাঘিনীর মনে মায়া মমতার উদয় হল। বাঘিনীর ভেতরের বোধোদয় বিস্মৃত হল। ঠিক নিজেকে তখন বিশ্বাস করতে পারছে না। এ অনাহুত মানব শিশুটির আগন্তুকের কষ্টটা। বাঘিনী সচকিত চোখে তাকাল মানব শিশুটির দিকে। নিমিষেই বাঘিনীর বুকের মাঝে বাচ্চা হারানোর ব্যথাটা হুহু করে জেগে উঠল। বাঘিনী মনে মনে বলল না, আমি তোমাকে খেতে পারি না। তুমি আমার দুধ পান করেছ। সুতরাং তুমি আমার হারিয়ে যাওয়া বাচ্চা প্লাবন টাইগারের মত। গত রাতের নিষ্ঠুর ঝড় ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বাঘিনীর একটা বাচ্চা। বাঘিনী তার বাচ্চা হারিয়ে যাওয়ায় ব্যথিত। তার হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাকে খুঁজতে এসে অাল্লাহর ইশারায় দেখা হল এক অাশ্চর্য মানব শিশুর সঙ্গে। বাঘিনী তার হারানো বাচ্চার কষ্টটা ভুলে থাকার জন্য পরম স্নেহে বুকে তুলে নিল মানব শিশু কন্যাটিকে। অার বলল, তুমি অামার হারিয়ে যাওয়া কন্যা শিশু প্লাবন হয়েই বেঁচে থাকবে।
—-বাঘিনী মানব শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল এবং তার পাশে পড়ে থাকা মানব দেহটাকে খেতে সে ভুলে গেল। তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা মায়ের মনটা কেঁদে উঠল। সে ভাবল অাহারে! গভীর জঙ্গলে বাচ্চাটাকে জন্ম দিয়েই মা মারা গেল। সেই মাকে অামি খেতে পারিনা। বাঘিনী শিশুটিকে মুখে তুলে নিয়ে চলে গেল তার অাস্তানায়। – বাঘিনী গুহায় ঢুকল এবং চারিদিকে খুব সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল। রাতের ঝড় বৃষ্টির তান্ডব মুছে যেয়ে সকালে নরম মোমের মত আলো ছড়িয়েছে। নিষ্ঠুর ঝড় লন্ড ভন্ড করে দিয়ে গেছে পুরো বন।
— হঠাৎ সামনের দিকে তাকিয়ে বাঘিনীর মনে হল কোন ছদ্মবেশী বাঘ, সিংহের মত কোন প্রাণী বাঘিনীকে অনুসরণ করছে নাকি এটা নেহাত বাঘিনীর মনের কুহুক? বাঘিনী দেখল তখনও তার বাচ্চা প্লাটন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
— আর তার বাঘ জেগে আছে। বাঘ আনন্দে নেচে উঠে বলল, বাঘিনী তুই এই মানব শিশুকে কোথায় পেলি? ওটা তুই নিজে না খেয়ে আমার জন্য নিয়ে এসেছিস বুঝি? খুব ভাল করেছিস। দে দে ওটা আমাকে দে। খুব ভাল খাবার। অতি উত্তম খাবার। খাব, খাব আমি খাব। বাঘ খুশিতে নাচতে লাগল। বাঘের আনন্দ উল্লাস দেখে বাঘিনীর ভীষণ কষ্ট হল।
——– বাঘিনী বলল, এ তুমি কি বলছ? এই শিশুকে তুমি কেন খাবে? ও একটা ছোট্ট শিশু। ও আমার গত রাতে হারিয়ে যাওয়া শিশু কন্যা প্লাবনের মত। দোহাই তোমার-ওকে তুমি খেও না। বাঘিনীর সত্যিকার মায়ের মনটা কেঁদে উঠল। বাঘিনীর অনুনয় বিনয়ের কাছে বাঘ পরাজয় স্বীকার করল এবং বাঘ খাদ্যের সন্ধানে শিকারে বেরিয়ে পড়ল। — বাঘিনী মানব শিশুকে মাটিতে রাখার সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে উঠল। সেই কান্নার শব্দে বাঘিনীর বাচ্চা প্লাটনের ঘুমের ভ্রম কেটে গেল। এবং অপার এক বিস্ময়ভরা কৌতুহল নিয়ে মাকে প্রশ্ন করল এটা অাবার কি? আমি কখনও এমন আশ্চর্য প্রাণী দেখিনি তো ? মা, ও মা এ তুমি কাকে এনেছো ?
—— মা বাঘিনীর গলায় উৎকণ্ঠা।
সে তার বাচ্চাকে বুঝিয়ে বলল, বাবা প্লাটন —— ও মানব শিশু। শিশুটা বিপদগ্রস্থ। আর একজন বিপদগ্রস্থকে সাহায্য করতে হয় বাবা। এটাই নিয়ম। আমরা পশু তাতে কি? আমাদেরও এই নিয়ম মেনে চলা উচিত। ও আমার দুধ পান করেছে।— আজ থেকে ও তোমার হারিয়ে যাওয়া বোন প্লাবন হয়েই আমাদের কাছে থাকবে। খবরদার বাবা! ভুলেও তুই ওকে কখনও আঘাত করবি না। খাবি না। আর কোন ভাই কি বোনকে খেতে পারে? এভাবে অনেক বুঝিয়ে রাখল বাঘিনী তার বাচ্চা প্লাটনকে। —–ঠিক তখন বাঘিনীর গুহার পাশ দিয়ে শিকারে যাচ্ছিল এক ক্ষুধার্ত সিংহরাজ। চলার পথে বাঘিনী এবং তার বাচ্চা প্লাটন টাইগারের মধ্যে কিছু কথোপকথন সিংহরাজের কানে ভেসে আসে। সিংহরাজ থমকে দাঁড়ায়। ভাবে, বাঘিনী তার বাচ্চাকে কাকে খেতে বারণ করছে দেখে আসি তো একবার। ——– বনের মহারাজ সিংহ বাঘিনীর গুহায় ঢোকে। চশমাটা চোখে দিয়ে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, আরে এটা তো দেখছি মানব শিশু। কোথায় পেলি ওকে? তুই আমার মনের আশা পূরণ করেছিস রে বাঘিনী। —- দে-ওটাকে এখন আমাকে দে। আমি খাব। আর দেরি করিস না। ক্ষুধায় আমার পেট চো চো করছে। ক্ষুধার যন্ত্রণা বড় যন্ত্রণা রে। যদিও এটা খুব ছোট তবুও অতি উত্তম খাবার। কতো দিন মানুষের মাংস খাওয়া হয়নি রে।
হাও মাও খাও………..
মানুষের গন্ধ পাও………….
তোর আস্তানায় আমি মানুষের গন্ধ পেয়েই তো ছুটে এসেছি।
তুই মস্ত বড় একটা অন্যায় করেছিস। আমাকে না জানিয়ে তুই নিজেই এটা খেয়ে ফেলতিস তাই না? বাঘিনী আমাকে একটা সংবাদ পাঠাস নি কেন? কথাটা ঠোঁটে রেখেই দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়ল সিংহটা মানব শিশুর ওপর। ——– অমনি সিংহের গর্জনে মানব শিশুটা কেঁদে উঠল। বাঘিনী তখন বুঝতে পারল কি ঘটতে যাচ্ছে। সে ভয়ে কেঁপে উঠল, সে বুঝি বাচ্চাটাকে হিংস্র সিংহের ভয়ঙ্কর থাবা থেকে রক্ষা করতে পারল না। — বাঘিনী কেঁদে উঠে বলল, কিরে খুকি? কি হয়েছে? অমন করে কাঁদছিস কেন? আল্লাহকে ডাক। তিনিই তোকে রক্ষা করবেন।
——- বাঘিনী কাঁদছে আর প্রলাপ বকছে। সিংহরাজ বলে কিনা সে তোকে খেয়ে ফেলবে। বাঘিনী চালাকি করে বলে, আমাকে ক্ষমা করবেন মহারাজ। এই মানব শিশুটাকে আপনি খেতে পারেন না। এটা আমার বাঘের আমানত। আমি আপনাকে কি করে দিই বলুন? সেতো শিশুটাকে খাবে বলে গোসল করতে চলে গেল। এতক্ষণে তার আসার সময় হয়ে গেছে। আপনি চলে যান।
— সিংহরাজ দাঁত, মুখ খিচিয়ে বলল, একি কথা বলছিস রে বাঘিনী? তোর কি একটুও ভয় ডর নেই? ক্ষুধায় আমার পেট চো চো করছে।
——- বাঘিনী বলল, আমার বাঘ এই মানব শিশুটাকে খাবে। আর আপনি তার খাবার কেড়ে খেতে চাচ্ছেন? এটা অন্যায়। আপনি আমার বাঘের কাছে যেয়ে অনুমতি নিয়ে আসুন। বাঘিনী তীব্র প্রতিবাদ করে বলে, এক প্রচ্ছন্ন অভিমানে এতদিন তুমি মুখ ফিরিয়ে রেখেছ আমাদের এলাকা থেকে। — তোমার স্থান দখল করেছে আমার বাঘ। এখন তুমি যদি এই মানব শিশুটিকে খেয়ে ফেল তাহলে আমি তাকে কি বলব ? এক্ষুনি আমার বাঘ হয়তো চলে আসবে। সে এসে তোমাকে দেখে খুব রেগে যাবে। প্লিজ… তুমি চলে যাও। রাগে গিড় গিড় করে উঠল সিংহরাজ! কি এত বড় সাহস তোর বাঘের ? কোথায় তোর বাঘ ? আমাকে নিয়ে চল বাঘিনী।আজ ওকে মেরেই ফেলবো। – বাঘিনী আমতা আমতা করে বলে, মহারাজ একটু বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে না? তোমাদের দু’জনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া
হওয়া দরকার। কে শিশুটাকে খাবে ? দুজন তো আরএকটা শিশুকে খেতে পার না । যে কোন একজন খেতে পারবে।
——শেষ সংলাপের রেশটা এখনও সিংহরাজের কানে বাজছে। বাঘিনী আরও একটু বুদ্ধি করে উষ্কে দিয়ে সিংহরাজকে বলল, আমি জানি তুমি কখনোই
আমার বাঘের সাথে শক্তিতে পারবে না। তাহলে তুমি কেন অন্যের খাবার কেড়ে খেতে চাও? জানতে পারলে সে কি তোমাকে আস্ত রাখবে?
——-ছিঃ ছিঃ
তোমার লজ্জা করে না? অন্যের খাবার কেড়ে খেতে চাও—। সাহস থাকলে তার সামনে দাঁড়িয়ে মোকাবেলা করো। যদি তাকে পরাজিত করতে পার,তবেই শিশুটিকে খেতে পারবে। নচেৎ নয়।
— সিংহরাজ হুঙ্কার ছেড়ে রাগে গুজরাতে থাকে। একটু দম নিয়ে বলে, ঠিক আছে কোন পুকুরে গেছে সে, আমাকে নিয়ে চল। আনন্দে হাসি ফুটে ওঠে বাঘিনীর চোখে-মুখে। বলে, মহারাজ খুব বেশি দূরে নয়। পাশের প্রাচীন পুকুরে।
——- ধুরন্ধর বাঘিনী ভাবলো, পুকুরটা অনেক পুরাতন এবং হাজামজা পুকুরের ঘাট চারিদিক থেকে ক্ষয়ে গেছে ভিতরে। শুধু একবার যদি পুকুরের ভেতরে সিংহরাজকে ফেলা যায় তাহলে কেল্লাফতে ।
—–নির্ঘাত ওর মৃত্যু হবে। বোকা সিংহ বাঘিনীর সাথে এগিয়ে গেল পুকুর ঘাটে। পুকুরের চারিধার জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে গোলপাতা আর কেওড়া গাছ।
——জায়গাটা দিনের বেলাতেও ভীষণ অন্ধকার। সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছায়না। বোকা সিংহরাজ একজোড়া গোলপাতা গাছের ফাঁক দিয়ে পুকুরের নিচে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। সে দেখল আর একটা মস্ত বড় সিংহরাজ চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে পুকুরের নিচ থেকে তার দিকে।
—– তখন টর্চের আলো ফেলে দিল পুকুরের মধ্যে ধুরন্ধর বাঘিনী। ভেজা আলোয় পানির নিচ থেকে কুল কুল করে হেসে উঠল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা আরেক ঝলমলে সিংহরাজ।
—ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা সিংহরাজ বলে,হা,হা বাঘিনী আমি দেখতে পাচ্ছি তোর বাঘ পুকুরে গোসল করছে। সিংহ রাজের কাছে মনে হল অন্য আর এক কেশর ফোলানো ঝলমলে সিংহরাজ হেসে হেসে নেচে গোসল করছে ক্ষীর্ণ জলরাশির ওপর।
——- রাগে গিড় গিড় করে উঠল উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সিংহরাজ। বলল,তোর এত বড় সাহস? তুই আমার মুখের খাবার কেড়ে খেতে চাস? আগে তোকে আমি চিবিয়ে খাব। দাঁড়া তুই – আমি আসছি-। বলেই সিংহ ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রাচীন পুকুরটার মধ্যে। —- একবারও বোকা সিংহরাজ ভাবল না পুকুরের কালো টলমলে পানিতে তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। কিছুক্ষণ পর সিংহরাজ ভাবল পুকুরের মধ্যে থাকা সিংহরাজকে সে মেরে ফেলেছে। এক শীতল স্নিগ্ধতায় জুড়িয়ে গেল তার দেহ। গভীর আনন্দে একটা রুপালী মাছের মত সাঁতার কাটতে লাগল বোকা সিংহরাজ হাত-পা ছুঁড়ে। কিন্তু এক সময় সিংহরাজ ঠিকই টের পেল গভীর জলের তলে তলিয়ে যাচ্ছে তার ভারী দেহটা। সে চিৎকার করে ওঠে…… বাঘিনী দেখ, দেখ আমি তোর বাঘকে মেরে ফেলেছি। আমি তলিয়ে যাচ্ছি, আমাকে বাঁচা……।
—– হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে বাঘিনী বলল, তোকে বাঁচাব আমি? তুই মর। তোর অতি লোভ। তুই অতটুকু মানব শিশুকে খেতে চাস? আরে তোর কি একটুও মায়া হয় না অতটুকু শিশুর প্রতি? তোর মরা উচিত। আরে বোকা সিংহ আমি তোকে মারার জন্যই এখানে এনেছি। তুই কি কিছুই বুঝিসনি ?
——- পুকুরের টলমলে পানিতে আমার বাঘ ছিল না। তোর প্রতিচ্ছবিই দেখা যাচ্ছিল। বোকা সিংহ। সিংহরাজের ভয়ঙ্কর থাবা থেকে মানব শিশুকে বাঁচানোর অপার আনন্দে চনমনিয়ে উঠল বাঘিনীর মন-প্রাণ। এ এক আশ্চর্য অনুভূতি। শ্বাস রুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল বাঘিনী। — অবশেষে জয়ী হয়ে অাস্তানায় ফিরে এল। মস্ত বড় একটা মেঘ কেটে গেল তার মাথার উপর থেকে। বাঘিনী মানব শিশুটির মায়ের ভূমিকায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শিশুটি বাঘিনীর দুধ পান করে অাস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে লাগল। একদিকে বাঘিনীর বাচ্চা প্লাটন টাইগার অপর দিকে মানব শিশু দু’জনই একসাথে দিনে দিনে বেড়ে উঠছে মা বাঘিনীর কোলে।
—— এভাবে দীর্ঘ দিন কেটে গেছে। মানব শিশুটির বয়স এখন আট বছর। পিতা-মাতা বা কোন মানুষের সংস্পর্শে না এসে যদি কোন শিশু বনের মাঝে অন্য পশুদের মত করে বেড়ে ওঠে তখন তার সত্যিকার রুপ কেমন হতে পারে? ——- সে বন্য পশুদের মত অাচরণ করে। জীবনের এক চরম নিষ্ঠুর নিয়তির কারণে শিশুটিকে বনের মাঝে অন্য সব পশুদের মত করে বেড়ে উঠতে হয়েছে। কারণ ভাগ্য তাকে টেনে এনেছে সুন্দর বনের মত বৈরী পরিবেশে। সেখানে শিশুটি বেড়ে উঠছে সব বিচিত্র পশু,পাখিদের মাঝে।তার জানা ছিল না মানব সমাজ নামের কোন সভ্য সমাজ অাছে। বা সেই সমাজে সভ্য মানুষ বসবাস করে। —- পরীক্ষা শেষে অবসর সময় কাটানোর জন্য খুলনা অাজম খান কমার্স কলেজের এ্যাকাউন্টিং-এর অনার্স ফাইনাল ইয়ারের বিশ/বাইশ বছরের একদল তরুণ সুন্দরবন
ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করল। মংলাবন্দর থেকে নৌ-পথে স্পীড বোটে করে ওরা সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে প্রবেশ করল।
——- ওদের চোখে ভেসে ওঠে সুন্দরবনের সবুজ বেষ্টনী। ওরা, কেওড়া, গরান, সুন্দরী, পশুর অার গোলপাতার বাগান দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেল কচিখালী হীরণ পয়েন্ট থেকে কটকা। ওদের কাছে অারও অাকষর্ণীয় হয়ে উঠেছে সুন্দরবন। কটকায় ওরা নেমে খুব সহজেই জঙ্গলের গভীরে ঢুকে গেল। প্রথমেই ওরা ঝাঁক ঝাঁক হরিণ দেখতে পেল। বানরসহ বিরল প্রজাতির পাখিও দেখল। ওরা কিছুটা সময় থমকে দাঁড়াল বানর অার হরিণের অদ্ভুত মিতালী দেখে। বানর গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলছে, হরিণ নিচে বসে অনায়াসে খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছে। বাঘ বা কোন প্রাণী অাসতে দেখলেই বানর সজাগ হয়েই অাগে ভাগেই হরিণকে সংকেত দিচ্ছে।
——- কটকায় রয়েছে বন বিভাগের ওয়াচ টাওয়ার। বড় বড় গাছ সমান উঁচু ঐ টাওয়ারে ওরা ছয় বন্ধু অনায়াসে উঠে পড়ল। সুন্দরবনকে উপর থেকে ঘুরে ফিরে দেখতে লাগল। কটকা ভ্রমণের জন্য কিছুটা ঝুঁকিও অাছে। চারিদিকে বাঘের হুঙ্কার শোনা যায়-। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়লে বাগানে প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে ঝুকিপূর্ণ। তখন সেখানে বাঘ আর বন্য পশু রাজত্ব গেড়ে বসে। ——— কটকার অদূরেই বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগর। সেখানে ছোট্ট সুন্দর বিচ রয়েছে। টুয়েলের বন্ধুরা, মনা, বাবুল, বিন্দু,মনোজ ও সুমন, সবাই এই বিচে নেমে খুব মজা করে গোসল এবং সাঁতার কাটল। হঠাৎ বন্ধু মনোজ বলল, তোদের মনে অাছে… -২০০৪ সালে এই বিচে নেমে সাঁতার কাটতে যেয়ে জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারিয়েছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন মেধাবী ছাত্র/ছাত্রী।
—- তোরা শিঘ্রীই ওঠ। এই বিচে চোরাবালীর ফাঁদ অাছে। অামরা যদি এই ফাঁদে পড়ে যাই ? অামাদের জীবনও ১৪ জনের মতই হবে। তাছাড়া হঠাৎ বাঘ এসে অাক্রমণ করতে পারে। অারও অাছে জলদস্যুদের উৎপাত। ভয়ে মনা কেঁপে ওঠে বলল,চারদিনের ভ্রমণে অামরা বেড়াতে এসেছি। কোথায় একটু ঘুরে ফিরে এনজয় করব। তা না মনোজ তুই শুধু ভয়ের গল্প বলে ইমেজটা নষ্ট করে দিচ্ছিস। ঠিক অাছে কাল যখন অামরা গভীর জঙ্গলে যাব তখন এসব বন্য হিংস্র প্রাণীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঢাইনমারী বিট অফিস থেকে অস্ত্র ও পোশাকধারী দু’তিন জন বনরক্ষীকে অামাদের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে করে নিয়ে আসব।
—— এবার হলতো? এখন তোরা সবাই গেস্ট হাউসে চল।সুমন মন খারাপ করে বলল, এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাব?অাজ বাঘ মামার সাথে কি অামাদের দর্শন মিলবে না? চেঁচিয়ে উঠল টুয়েল। অারে বাঘ মামার দর্শন পেতে চাস তোরা? মামা যদি সত্যিই এখানে চলে অাসে, তখন বুঝবি ঠেলা?
— ভাগ্নেরা তখন কোথায় পালাবে? মনা বলল, কেন তোরা জানিস না-। একটা প্রবাদ বাক্য অাছে ‘মামা-ভাগ্নে যেখানে অাপদ নেই সেখানে।” “অারে মামা-অারে ভাগ্নে। “মামা যদি সত্যিই এসেই পড়ে। তখন ভাগ্নেরা তাকে এই গানটা শোনাবে। টুয়েল বলল, কোন কাজ হবে না। বাঘ তো বাঘই। কিসের অাবার মামা-ভাগ্নে। মামা তার ছ’ভাগ্নেকে সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলবে এবার বলতো ভাগ্নেরা -কোন ভাগ্নেকে আগে খাওয়া যায়? তখন অবস্থাটা কি হবে একবার ভেবে দেখেছিস? — তারচেয়ে ফিরে চল গেস্ট হাউসে। কাল সকালে এসে গাছের মাথায় ওৎপেতে বসে থাকব মামার দর্শন পাওয়ার জন্য। অাজ অাসার সময় তোরা শুনলি না -ঢাইনমারী বিট অফিস থেকে বনরক্ষীরা অামাদের সতর্ক করে বললেন, অাপনারা দয়া করে কখনও জঙ্গলের গভীরে বাঘ দেখার উদ্দেশ্যে যাবেন না। কারণ অপনারা কখনও বাঘ দেখতে পারবেন না। তিন দিনের জন্য গভীর অরণ্যে গাছের উঁচু মাচায় ডেরা বেঁধে যদি প্রস্তুতি নিয়ে যান তাহলে হয়ত বা বাঘ দেখলেও দেখতে পারেন। এমনি ভ্রমণ বা পিকনিকের ছলে সুন্দরবনে এলে শুধুই অপরুপ নদী বন-বনানীই দেখা হবে সার।
—- সেখানে বাঘ দূরের কথা হরিণ দেখতেও যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। তবে বানর, পাখি, কুমির ও সুন্দরবনের বিরল দৃশ্য হয়ে উঠেছে।
–টুয়েল বলল, এক সময় সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ প্রোগ্রামের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার পর ন্যাশনাল জিওগ্রাাফিক সংস্থার একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানী মাস তিনেক বনের ভেতরে ডেরা বেঁধে থেকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একটি পরিবারের উপর প্রামাণ্য ছবি তৈরি করেন। — যে ছবিটা মাঝে মধ্যে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে প্রদর্শিত হয়। ছবিটা দেখলেই বোঝা যায়, প্রকৃতিবিদ অনুসন্ধানী রিপোর্টাররা অাফ্রিকায় সাফারিতে গেলে কত ধরণের সুযোগ সুবিধা পায়।
—- যে গুলো অামাদের দেশের বৃহৎ সুন্দরবন অঞ্চলে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বন বিভাগও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এদিকে কোন লক্ষ রাখেন না। ফলে প্রতিদিন বন উজাড় করে নির্মূল করা হচ্ছে মূল্যবান গাছ। অন্যদিকে কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী এ বন থেকে বাঘ, হরিণ, হাতি, মহিষ, ময়ূর অবলীলায় শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে এবং অবাধে তারা বিক্রিও করছে। — বন্য পশু ও মূল্যবান গাছ সংরক্ষণের জন্য নানা রকম পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সে গুলো অনুসরণ করলে সুন্দরবনকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। ফ্রান্সের এক কালের চলচ্চিত্র জগতের লাস্যময়ী অভিনেত্রী ব্রিজিত বার্দ্রো সাংঘাতিক রকমের পশুপ্রেমী ছিলেন। অামাদের ও পশুপ্রেমী হতে হবে। পশুপ্রেমীদের অান্দোলনের সঙ্গে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারটি জড়িয়ে অাছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে বৃক্ষপ্রেম যেমন একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, ঠিক তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ পশুপ্রেমও।
—– নাইট্রিক সাইকেলের পুরো ব্যাপারটিই হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার প্রচেষ্টা। বাবুলের কপালে তিনটা ভাঁজ পড়ল। সে কিছুটা চিন্তিত হয়েই বলল, কিন্তু সম্প্রতি আমাদের ফালু সাহেবরা বেকুব ছিলেন নাকি? তাঁরা তো ঠিকই অবৈধ ভাবে চিত্রা হরিণ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণী পালতে শুরু করেছিলেন।
— এটা কি নিছক পশুপ্রেম? না-কি সম্পত্তি প্রেম ছিল সেটি বোঝা দায় ছিল। কারণ ফালু সাহেব যেখানে এ সুদর্শন চিত্রল হরিণগুলো পালতে শুরু করেছিলেন সেটিও ছিল সরকারি জায়গায়। ——- যা তিনি ক্ষমতার জোরে দখল করেছিলেন বলে জানা গেছে। কেন শুধু কি ফালু সাহেবরা? —না, আরও আছে ফলনা উদ্দিন এবং সম্প্রতি ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা আরও কিছু আলাউদ্দিনও যে আছে। তারা নাকি বিত্ত বাড়ার সাথে সাথে পশু, পাখি ও সরীসৃপ প্রজাতির প্রতি আলগা প্রেম দেখাতে শুরু করেছিলেন। এ কথা ঠিক যে, বিত্তের সঙ্গে ভালবাসার সম্প্রসারণের একটি যোগসূত্র আছে। আর এ ক্ষেত্রে, পশ্চিমাদের সুবিধা হল তাদের মানুষ কম, উপার্জন বেশি। তাই তারা ভালভাবেই পশু পালনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ করতে পারে। আবার সে কুকুর ও বিড়ালকে যখন বিদেশী সাদা মেম সাহেবরা চুমু দিচ্ছেন আদর করছেন সেটা কিভাবে সম্ভব? তাদের কি ঘৃণা করে না? আসলে আমরাই জানি না যে ঐ মেম সাহেবদের চুমু প্রাপ্ত ওই সব ভাগ্যবান কুকুর বিড়ালকে ডেইলি তিন চার বার করে স্নান করিয়ে থাকে। তাদের লোমে দামি দামি জীবাণু নাশক ছিটানো হয়ে থাকে। হয়ত ক্ষেত্র বিশেষে তারা মানব সন্তানের চেয়েও পবিত্রতর হয়ে থাকে এবং আদর যত্নও পেয়ে থাকে।
——- সুমন বলল, আবার আমাদের দেশেও কি কুকুর বিড়ালদেরকে ভালবাসা হয় না? তাদেরকে আমরা আদর করে এটোটি কাটাটি খেতে দেই। মাঝে মধ্যে আদর করি স্পর্শও করি। তারপরও তোরা একটা ব্যাপার দেখ এদেশের কুকুর বিড়ালের অবস্থান কিন্তু মানুষের পায়ের কাছে। অর্থাৎ বাঙালী নিম্নবিত্ত স্বামীরা কিন্তু তার বউকে লাথি মারার কায়দাটা প্রাকটিস করে প্রথমে কুকুর বিড়ালকে লাথি মেরে। সুমনের কথার জের ধরে বন্ধুদের মাঝে সম্মিলিত ভাবে হাসির একটা রোল উঠল। —– ওরা হাঁটতে হাঁটতে পাশের একটি চরে এলো এবং ছয় বন্ধুর মাঝে এ রকম বিভিন্ন ধরনের আলোচনা উঠে আসছিল।
পড়ন্ত বিকেল বেলা। ওরা সবাই ক্লান্ত। সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিম প্রান্তে। ওদের অদূরেই একটা হরিণ। বিন্দু কৌশলে হরিণটা ধরতে গেল। কিন্তু চঞ্চলা, চপলা হরিণীটা তার উপস্থিতি টের পেয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। হঠাৎ শোরগোলে ভাবনায় ছেদ পড়ল টুয়েলের। সবাই হরিণীটাকে ধরতে না পেরে জোরে জোরে কথা বলছিল। হাসা-হাসি করছিল। আনন্দ উল্লাস করছিল। তবে একটু ব্যতিক্রম টুয়েল। গম্ভীর চেহারা হয় ওর।
হঠাৎ ওর দৃষ্টি আটকে যায় দূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে। গাছের ডালে বন্য শিশুর মত কোন অাজব প্রাণী দেখে কেঁপে উঠল টুয়েলের বুক। ও তখন বুঝতে পারে সে যে বন্য শিশুটিকে দেখছে সেটি একটি মানব শিশু হতে পারে। টুয়েল তখন বাকি পাঁচ সদস্যদের ডেকে বন্য শিশুটিকে দেখায়। টুয়েল কোন ভূমিকা ছাড়াই বলল, এই মানব বন্য শিশুটিকে কি আমাদের গভীর জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা উচিত নয়?
——অব্শ্যই এবং শিশুটিকে আমাদের সভ্য সমাজে নিয়ে যাওয়া উচিত। বাকি সদস্যরা বলল,শিশুটিকে আমাদের বাঁচাতে হবে, এই বন্য পশুদের হাত থেকে।
পরবর্তী তিন দিন অনেক চেষ্টা করেও এই ছয় সদস্যের টিমটা গভীর জঙ্গল থেকে এই বন্য মানব শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারল না। চতুর্থ দিনও ব্যর্থ হয়ে টুয়েলের দল ফিরে এলো খুলনায়। কিন্তু কেন যেন টুয়েলের দু’চোখে ঘুম নেই। ঘুম পালিয়ে বেড়াচ্ছে এক অজানা রহস্য অাবিষ্কারের নেশায়। টুয়েল বন্য শিশুটির ব্যাপারটা তার ভাগ্নে অাবীরকে সব খুলে বলল। অাবীর ক্লাস ফাইভের একজন মেধাবী ছাত্র। অাবীর ব্যাপারটা ওর ক্লাসের কয়েকজন মেধাবী ছাত্রকে বলল, অাবীরের বন্ধুরা ব্যাপারটি শুনে এক প্রকার হৈ চৈ করে উঠল। বন্ধুদের মধ্যে তৌহিদ,শফিকুল, সোজাউল, রাফি, অাশিক, পিকাসো, সাকুর একটা অলোচনা করে অাবীরকে বলল, অামরা তোর টুয়েল মামার সাথে কথা বলতে চাই। পরদিন বিকালে টুয়েল মামার সঙ্গে সবার দেখা হল এবং কথাও হল।তৌহিদ, অাবীর, রাফি, অাশিক টুয়েল মামাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করালো।
—— ওদের ১২ সদস্যের একটা টিম তৈরি হল। ওরা ১২ জন বন্ধুরা মিলে সুন্দরবনে অপারেশনে যেতে চাইল। কিন্ত টুয়েল মামা রাজি হয়েও হয় না। বলল, ভাগ্নেরা এখানে অনেক ঝুঁকি অাছে। অামরা হয়ত সাকসেসফুল হতে পারব না। তখন বিপদ অনিবার্য। ১২ সদস্যের মধ্যে তৌহিদ বলল,কিন্ত মামা বিপদ জেনেও কি অামরা একটি মানব শিশুকে সভ্যতার অালোকে অানব না ?
—— এ রীতি মত অন্যায় মামা। অসহায় বন্য মানব শিশুর প্রতি কি অামাদের কোন দায়িত্ব নেই? অার কোন কথা নয় মামা। অামরা যাব। অাপনি তৈরি হন।
——- অাবীর বলল, ছোট মামা তুমি কি দ্বীপু নাম্বার টু এই কিশোর চলচ্চিত্রটা দেখনি? সেখানে কি শেষ পর্যন্ত দ্বীপুর গোয়েন্দা বাহিনী পুরাতন কীর্তি মূর্তি গুলোকে জয় করে ছিনিয়ে অানেনি? অবশ্যই এনেছে মামা। ইনশাল্লাহ অামরা ও পারব। অাল্লাহ অামাদের সাথে অাছেন। এদের কথা শুনে টুয়েল রাজি হল। ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনীর উপর একটানা তিনদিন ট্রেনিং দিল। ট্রেনিং পর্বটা প্রায় কমপ্লিট হয়ে গেল। ——– এবার যাত্রার পালা। প্রত্যেক ছাত্রের অবিভাবকরা টুয়েলের হাতে তাদের ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনীদের ছেড়ে দিল। সবাই প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠল। —– টুয়েলের ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনী যাত্রা শুরু করল সুন্দরবনের বন্য মানব শিশুটিকে আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে। কোন এক মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া এ শিশুটিকে বনের মাঝে আর দশটা বন্য পশুর মত সংগ্রাম করে বড় হতে হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককার ঘটনা এটা। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বৃহদাংশ জুড়ে এই বনাঞ্চল অবস্থিত। সেখানে একদল তরুণ মানব শিশুটিকে বনের মাঝে আবিষ্কার করে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা ধরতে ব্যর্থ হয়। শিশুটি ছিল উলঙ্গ। সারা শরীরে ময়লা কাদা, হাতে পায়ে বড় বড় নখ। মাথার চুলগুলো উসখো খুসকো ময়লা এবং জট পাকানো। তার সারা শরীরে ছিল আঘাতের চিহ্ন। বয়স আনুমানিক সাত আট বছর হবে।
——– টুয়েলের ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনীর দলটি সুকৌশলে ঢুকে যায় গভীর জঙ্গলে। সকাল থেকে একটানা অভিযান চালায় ওরা। কিন্তু ব্যর্থ হয়। বিকেল হয়ে গেছে। ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনীও জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বন অরণ্যে কখন যেন ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে পড়েছে সেটা কেউ টের পায়নি। ব্যর্থ হয়ে ওদের ফিরতে হল গেস্ট হাউসে। পরদিনও একটানা ঝটিকা অভিযান চলল। কিন্তু ওরা ব্যর্থ হল। তৃতীয় দিন একটানা অভিযান চলছে। মানব শিশুটিকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত ঘুম
নেই কারও চোখে। ব্যাপারটা এ রকম দাঁড়িয়েছে সবার কাছে-।
——- বিকেল বেলা সবাই পরামর্শ করছে কি করা যায়। হঠাৎ দলের মধ্যে কেউ একজন মানুষ রুপি বন্য শিশুটিকে একটি গাছের ডালে দেখতে পেল। সে তখন গাছের শিকড়, বাকড় অার ফল-মূল পাতা খাচ্ছিল। আশ-পাশের কোন শব্দের প্রতি তার কোন রকম ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সে নিজেও কোন শব্দ করত না।বন্য মেয়েটি তার আশ-পাশের চারপাশকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে নিত। কোন মানুষ- দেখা মাত্র সে দৌঁড়ে পালাত। অার কেউ তাকে ধরে ফেললেই তাকে পশুদের মত করে অাছাড় দিত এবং কামড়াত। টুয়েলের গোয়েন্দা বাহিনীর দলটি বাঘের ডোরা কাটা পোশাক পরে বন্য মেয়েটিকে অাশ-পাশে থেকে বাঘের মত করে হাঁটার চেষ্টা করে। সে জন্য বোধ হয় এই গোয়েন্দা বাহিনীদের মানুষ হিসেবে কল্পনা করার কোন অবকাশ পায়নি বন্য মেয়েটি।
—— কিন্ত সমস্যাটা হল সে গাছ থেকে কোন ক্রমে নিচে নামছে না। টুয়েলের গোয়েন্দা বাহিনী কৌশলে গাছের ডালে জাল ফেলে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। বাঘের ডোরা কাটা পোশাকে টুয়েল অাস্তে আস্তে গাছে উঠতে থাকে। ঠিক তখন বন্য শিশুটি কিছু একটা টের পেয়ে পশুদের মত চিৎকার শুরু করে। হঠাৎ সে গাছের পিছন দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল টুয়েলের কাঁধে এবং প্রতিবাদ করে উঠল। বন্য শিশুটি তখন টুয়েলের গলায় দু’পাশ চেপে ধরে কামড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। নিচে থেকে গোয়েন্দা বাহিনী ব্যাপারটি টের পেয়ে জাল নিয়ে গাছে উঠার চেষ্টা করে।ব্যাপারটা তখন বন্য শিশুটা টের পায়।
—— যেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারে। ঠিক তখন বন্য শিশুটি টুয়েলকে ছেড়ে দিয়ে ঝুপ করে পাশের একটি গাছে এক লাফে চলে যায়। টুয়েল এবং তার দল এ যাত্রায় বন্য শিশুটিকে হাতের নাগালে পেয়েও ধরতে ব্যর্থ হল। শিশুটি তখন এ গাছ থেকে ও গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে অনেক দূরে চলে যায়। —— গোয়েন্দা বাহিনীর দল ও অাশা ছাড়েনি। ওরাও তখন শিশুটিকে লক্ষ করে এগিয়ে যেতে লাগল। মেয়েটির অাশ-পাশে থেকে প্রাণ নাশের ভয় অাছে জেনেও বাঘের মত কিছু কিছু অাচরণ করতে লাগল। বন্য মেয়েটি তখন গাছ ছেড়ে এক লাফে মাটিতে নেমে এসে সামনের দিকে এগুতে থাকল। ক্ষুদে বাহিনী ও মেয়েটির পিছু নিল।এক সময় গোয়েন্দা বাহিনী অাবিষ্কার করল মেয়েটি এগুতে এগুতে গোলপাতায় ঘেরা একটি গুহার মধ্যে ঢুকে গেছে। ওরা তখন বুঝতে পারল এটিই বন্য মেয়েটির অাস্তানা।
—— এই গোয়েন্দা বাহিনী তখন সুকৌশলে গুহার অদূরেই অবস্থান নিল এবং গুহার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখল। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর গুহার ভিতর থেকে এক বাঘিনী অার এক বাঘ ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে পাশের একটি খাল পার হয়ে সম্ভবতই শিকারের উদ্দেশ্যে গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল। ক্ষুদে বাহিনীর মনে যে ভয়টা কাজ করছিল সেটা কেটে গেল। তারা মনে করল বন্য মেয়েটিকে ধরার এটাই উপযুক্ত সময়-।
——- ওরা অার কাল বিলম্ব না করে গুহার কাছে গেল।গুহার মুখটি জাল দিয়ে ঘিরে ফেলল। টুয়েল মশাল জ্বালিয়ে ৫/৬ জন সদস্যকে নিয়ে ঢুকে গেল গুহার ভিতরে। বন্য শিশুটি ওদের উপস্থিতি টের পেয়ে দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করল এবং গুহার মুখে জালে অাঁটকে গেল।
—— উপরে থাকা বাকি ক্ষুদে বাহিনীর সদস্যরা বন্য শিশুটিকে ধরে ফেলল। এবং খুব সতর্কতার সাথে বন্য শিশুটিকে জালে জড়িয়ে শক্ত করে কয়েকটি গিট দিল। যেন বন্য শিশুটি পালিয়ে যেতে না পারে। শিশুটি তখন বুঝতে পারে তাকে ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সে ভয়ঙ্কর চিৎকার শুরু করল। বনের ভেতরে তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। —- অচেনা পোকাদের ক্যাঁক ক্যাঁক শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভূতুড়ে এক ধরণের কুহু-উ কুহু -উ আওয়াজ ভেসে আসছে। বন্য শিশুটির চিৎকারের ফলে খালের ওপারের বন থেকে বাঘিনীর হুঙ্কার শোনা গেল। ক্ষুদে বাহিনী আর কালবিলম্ব না করে দ্রুত পায়ে হেঁটে স্পীড বোটের কাছে চলে এল এবং দ্রুত বোটটি ছেড়ে দিল। বোটটি বেশ দূরে চলে এসেছে। হঠাৎ কেঁপে উঠে টুয়েলের হৃদপিণ্ড। ও তাকিয়ে দেখল খাল পাড়ে দাঁড়িয়ে বাঘিনী হুঙ্কার ছাড়ছে। টুয়েল বুঝতে পারলো বাচ্চা হারানোর বেদনায় বাঘিনী কাঁদছে। এ মানব বন্য শিশুটিকে বাঘিনী নিজের বাচ্চার মত লালন-পালন করেছে। ——- বন্য শিশুটিও কাঁদছে এবং পশুদের মত আচরণ করছে। সুযোগ পেলে কামড়ানোর চেষ্টাও করছে। টুয়েলদের বোটটা এখন বিপদ মুক্ত। টুয়েল বলল, ভাগ্নেরা তোমরা কি দেখেছ কত বড় রিক্স নিয়ে আমরা মানব শিশুটিকে ভয়ঙ্কর জঙ্গল থেকে উদ্ধার করলাম। যে কোন মূহুর্তে বাঘ আর বাঘিনী আমাদের আক্রমণ করতে পারত।
——– বন্য শিশুটির চিৎকার কি করে যেন বাঘিনীর কানে পৌঁছে গেল। সে বুঝতে পেরেছে তার বাচ্চা ( বন্য শিশুটি) কোন বিপদে পড়েছে। হাজার হলেও তো মায়ের মন। বাচ্চা বিপদে পড়লে মায়ের মন আগেই কি করে যেন টের পেয়ে যায়। উত্তেজনায় বাঘিনীর চোখ দিয়ে আগুনের হল্কা বের হয়। রাগে, ক্ষোভে গর্জে ওঠে বাঘিনীর কন্ঠস্বর। হুঙ্কার দিয়ে ঘাড় এদিক ওদিক ঘুরাতে থাকে। গোয়েন্দা বাহিনী এখন সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত। তবুও একটা ভয়ানক ভয় ওদেরকে গ্রাস করছে। কিন্ত অন্য দিকে বন্য শিশুটিকে উদ্ধার করতে পেরে ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনীর মনে আনন্দের ঝর্ণাধারা তির তির করে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। ওদের যেন পিছনে ফেরার অার কোন অবকাশ নেই।
——- ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনী এ বন্য শিশুটিকে শহরে নিয়ে আসে। তাকে খুলনার বোবা বধির শিশুদের একটি প্রতিষ্ঠানে রাখা হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রধান চিকিৎসক বন্য শিশুটিকে দেখেই বলেন,কোন ভাবেই এই শিশুটিকে একজন পরিপূর্ণ সভ্য মানুষ হিসেবে তৈরি করা যাবে না।তার অনেক গুলো কারণ অাছে।এই বন্য শিশুটির বুদ্ধির এতটাই ঘাটতি অাছে যে সে একদিকে বধির অন্যদিকে মুক।
—— সুতরাং কোন অাশাই নেই।কিন্ত এ ব্যর্থতা ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনীর মেধাবী ১২ সদস্যের টিম কোন ভাবেই মানতে রাজি হলো না। ওরা বলল, অনেক পরিশ্রম করে আমরা এ বন্য শিশুটিকে জঙ্গল থেকে সভ্য সমাজে এনেছি। এখন কোন ব্যর্থতা অামরা মানতে রাজি নই। কেন একটি মানব শিশু বন্য পশুদের মত অাচরণ করবে? কেন সে সমাজের অার দশজন সুস্থ স্বাভাবিক মানব শিশুর মত হতে পারবে না? আমরা তাকে অন্য চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাব। সুতরাং ক্ষুদে বাহিনী হাল ছাড়লো না।
——- খবরটা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। দু’দিন পরে তারা একজন মুক ও বধির এক তরুণী চিকিৎসকের সন্ধান পেল। তারা বন্য শিশুটির ব্যাপারে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করল। এ তরুণী চিকিৎসক হার্ট-বার্ন এ অাশাহীন শিশুকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একজন পরিপূর্ণ সভ্য মানুষ হিসেবে তৈরি করার চ্যালেঞ্জ নেন। যেহেতু তিনি একজন নারী। আর এই বন্য শিশুটিও একটি সাত আট বছরের শিশু। সে জন্য বোধ হয় বাচ্চা মেয়েটির জন্য তরুণী চিকিৎসকের অাগ্রহটা বেশি। ——– তিনি বন্য শিশুটাকে তাঁর বাসায় নিয়ে অাসেন ট্রিটমেন্টের জন্য। প্রাথমিক পর্যায়ে এ বন্য শিশুটিকে প্রথমে শেখাতে হবে কিভাবে সে একজন স্বাভাবিক শিশুর মত আচরণ করবে। বন্য পশুর মত নয়। একজন সুস্থ স্বাভাবিক শিশুর মত। চিকিৎসক হার্ট-বার্ন এ বন্য শিশুটিকে ট্রিটমেন্টর জন্য শহরে তার ভাড়ার বাসায় অানলে বেশ সমস্যার সন্মুখিন হলেন।সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভিড় বাড়তে লাগল। সে জন্য শিশুটির ট্রিটমেন্টের ব্যঘাত ঘটছিল। চিকিৎসক তখন একটি উপায় বের করলেন। তাঁর স্বামী এডাম স্মীথ ও একজন মুখ ও বধির বিশেষজ্ঞ। স্বামী,স্ত্রী দু’জন একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। চিকিৎসক হার্ট-বার্ন স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে শিশুটিকে নিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া গড়াই নদীর পাড়ে চলে গেলেন।সেখানে তিনি নতুন পরিবেশে এ শিশুটির নতুন নাম রাখলেন মুগলী। ——– তিনি একটানা ছ’মাস ধরে কঠোর পরিশ্রম করলেন বন্য শিশুটির হাঁটা,চলা,কথা বলা শেখানোর জন্য। বন্য শিশুটি তখন একটু একটু হাঁটা,চলা করতে পারে। কেন না পূর্বে সে তার চার হাত পা দিয়ে পশুদের মত করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলাফেরা করত। বন্য শিশুটিকে সভ্য মানুষের নানান অাচার, অাচরণ শেখানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করলেন।তিনি প্রথমেই লক্ষ্য করলেন মুগলী অাসলেই বধির নয়।
—— তিনি অনেকটা অাশার অালো বুকে বাঁধলেন মুগলীকে কিছু কিছু কথা শেখানো যাবে এই ভেবে। এ বন্য শিশুটিকে সভ্য করার শিক্ষণে হার্ট-বার্ন পুরষ্কৃত করণ সাইকোলজিক্যাল পদ্ধতির বিশেষ ব্যবহার প্রয়োগ করেন। এভাবে আস্তে আস্তে মুগলীকে খাবার খাওয়ানো, পোশাক পরানো শেখানো হল। মুগলী ছাড়া ছাড়া দুই একটি অক্ষর বলতে পারে। অ ক,ম,ব,ল এ জাতীয় কিছু শব্দ মুগলী আয়াত্ত্ব করে। কিন্ত মুগলীর পক্ষে দু’টো তিনটে অক্ষর জোড়া দিয়ে একটি শব্দ উচ্চরণ করা সম্ভব হয় না। তবুও চিকিৎসক হার্ট-বার্ন পিছপা হলেন না। তিনি ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। ——- তিনি আরও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলেন। ধীরে ধীরে মুগলী এখন নিজে নিজে হাঁটতে পারে (কোন কিছুর সাহায্য ছাড়া)। খাবার খেতে পারে। পোশাক পরতে পারে। মুগলী মানব সমাজের অন্য মানবদের সহজ ভাবে দেখা এসব শিখতে সক্ষম হয়। ক্রমে ক্রমে মুগলীর ভিতরে ভাষার বুৎপত্তি ও ঘটতে শুরু করে। সে এখন কিছু কিছু শব্দ বলতে পারে। কলা, পানি, ভাত, মাছ, দুধ, ডিম, কলম, মা এ জাতীয় কিছু শব্দ সে শেখে।
—- হার্টবার্ন মুগলীকে প্লাস্টিকের অক্ষর জোড়া লাগিয়ে শব্দ শেখানোর চেষ্টা করেন। অনেক চেষ্টার ফলে মুগলী একসময় বাংলা ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করে। বিশিষ্ট চিকিৎসক হার্টবার্নের এত পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে এই বন্য শিশু থেকে মানব কিশোরী মুগলীকে এই সুস্থ স্বাভাবিক সমাজের সভ্য মানুষের মত
করে সম্পূর্ণরূপে গোড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কিছুটা এ্যাবনর্মাল থেকেই যায় বন্য কিশোরী মুগলীর মাঝে। এর পেছনে কি রহস্য ছিল তা কোন বধির ও মুক বিশেষজ্ঞের পক্ষে উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। চারদিকে এখন বিজ্ঞানের জয় জয়কার ধ্বনি। এখন ডিজিটাল যুগ। তারপরও মুগলীকে সভ্য মানুষের মত করে
গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
—— বড় বড় বধির বিশেষজ্ঞরা বলেন, মুগলীর মস্তিষ্কে বড় ধরনের কোন আঘাত লেগেছে হয়তো বা। বনের মাঝে হিংস্র সব পশুদের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে ছিল শিশুটি। আবার কোন হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে যেয়ে এ জাতীয় আঘাতের স্বীকার হতে পারে মেয়েটি। হয়তো বা বনের মাঝে হিংস্র পশুদের আক্রমণ শৈশবের এ দুঃসহ চাপ তাকে অনেকটা উন্মাদগ্রস্ত করে তুলেছিল। এটাও একটি বড় কারণ হতে পারে। তবে এই মুগলীর সভ্যকরণ কেস হিস্টিরির ধরন পর্যালোচনা করতে যেয়ে অনেক আধুনিক সাইকোলজিস্টদের মাঝে বিভিন্ন মন্তব্য পরিলক্ষিত হয়েছে। কেউ কেউ মন্তব্য করে বলেন, আসলে পৃথিবীর সব শিশুরই জীবন নাকি শিশু মুগলীর মত হয়েই শুরু হয়।
——- কিন্তু সে সব শিশু ভূমিষ্ট হয়েই সামাজিক মিথস্ত্রিয়তায় এবং মা-বাবার বদৌলতে শিশু তখন সুসভ্য ও শিক্ষিত হয়ে উঠে। কিন্তু এখানে শিশু মুগলীর কেসটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। খুব শৈশব কাল থেকে বন্য শিশু মুগলী বন্য পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। সেখানে সে দেখেছে বন্য পশুদের হিংস্রতার হিংসাত্মক ছোবল। মুগলীর সমস্ত শরীরে অনেক ক্ষতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। কাজেই এই সব আঘাতের চিহ্ন বলে দেয় বনের মাঝে মুগলীর জীবন কতটা নিরাপদে থাকতে পারে।
——- তবে আর যেন কোন মানব শিশুকে নিয়তির নিষ্ঠুর বিধানে বন্য শিশু মুগলীর মত হতে না হয়। বন্য শিশু মুগলী বন্য পশু বাঘিনীর আশ্রয় হারিয়েও চিকিৎসক হার্টবার্নের আশ্রয়ে বড় হচ্ছে। — হার্টবার্ন মুগলীকে নিজের কন্যা সন্তানের স্নেহেই লালন পালন করছেন। অর্থাৎ তিনি মুগলীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন।
—– ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনী বন্য শিশু মুগলীকে আংশিক সভ্য করার প্রয়াসে তরুণী চিকিৎসক হার্টবার্নকে একডালি ফুলেল শুভেচ্ছা উপহার দিল। এই উপহার
পেয়ে চিকিৎসক হার্টবার্ন অসম্ভব খুশি হলেন।
——- তিনি ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের আদর করলেন এবং তিনি মুগলীকেও জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। কিশোরী মুগলীও তরুণী চিকিৎসককে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। সে কিছুক্ষণ সময় নীরব থেকে চোখের জল মুছে খুব উচ্চ শব্দে হিঃ হিঃ করে হেসে উঠল। মুগলীর হঠাৎ আবেগ প্রবণ হয়ে এই কান্না সবাইকে বিস্মিত করল। কিছুক্ষণ পর এই হাসির অর্থ সবাইকে বুঝিয়ে দিল বন্য কিশোরী মুগলী মানব সমাজে এসে সভ্যতার আলোকে সে ভীষণ আনন্দিত হয়েছে। ক্ষুদে গোয়েন্দা বাহিনীর মেধাবী দল বন্য কিশোরী মুগলীর মুখে হাসি ফোটাতে পেরে ভীষণ আনন্দিত হল। ওদের কাছে যেন মনে হল পৃথিবীর বড় কোন বাধাকে অতিক্রম করে ওরা বড় কোন জয়কে ছিনিয়ে এনেছে। এ জয় বিজয়ের। এ জয় গৌরবের! ক্ষুদে বাহিনী মুগলীকে ঘিরে কিছুক্ষণ আনন্দ উল্লাস করল। ——- মুগলীকে নিয়ে অনেক ছবিও তুলল। কিশোরী মুগলীও ক্ষুদে বাহিনীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে আনন্দ উল্লাস করল। কিশোরী মুগলীকে তরুণী চিকিৎসক হার্টবার্ন তাঁর শহুরে ভাড়া বাড়িতে নিয়ে আসেন। হঠাৎ টুয়েল মামা বলল, মুগলী তুমি কি এখনও আমাদেরকে ভয় করছ? কিশোরী মুগলী কিছুটা সময় নিল। তারপর হিঃ হিঃ করে হেসে উঠে বলল না, না এখন আর আমি তোমাদের ভয় করি না। আমরা সবাই মানুষ। এ ক্ষুদে বাহিনী কিশোরী মুগলীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় বলল, মুগলী বাই-বাই! মুগলীও তখন ওদের দেখাদেখি বলল, বাই-বাই!
কিশোরী মুগলীর এই বাই-বাই বলার ধরণ ও হাতের মুদ্রা দেখে সবাই সম্মিলিত ভাবে হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল।
শব্দনীড় এ সাধারণত উপন্যাসের খণ্ডাংশ, গল্প, ছোট গল্প বা অণুগল্প প্রকাশিত হয়। বড় লিখা পাঠক সাধারণত পড়েন না। না পড়েই ভালো হয়েছে বা দারুণ হয়েছে বলে পাশ কাটিয়ে যায়।
সত্য বলতে কিশোর উপন্যাস এর এই সুবিশাল আয়োজন উপহারে আপনার প্রসংশাই করবো আমি। অসম্ভব সাহসিকতা। ধন্যবাদ কবি এবং গল্পকার।
হা, আপনি ঠিক বলেছেন প্রিয় কবি বন্ধু। কিন্তু কিশোর উপন্যাসটা একবারই দিলাম এই জন্য পুরো কাহিনীটা পাঠক পড়ে উপলব্ধি করতে পারবেন।আর খন্ড খন্ড আকারে লেখা দিলে অনেক সময় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে যায়।
আজাদ ভাইয়া, সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে ও ধন্যবাদ
। শুভ কামনা ।
অনেক বড় লেখা। পড়তে পড়তে বারবার চোখ সরে গেলেও সবশেষে থিমটি ঠিকই ধরে নিয়েছি।
শুভেচ্ছা কবি গল্পকার প্রিয় দিদি ভাই।
প্রিয় দি'ভাই , গল্প টা পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
অনেক অনেক শুভ কামনা কবি দি' ভাই রিয়া।
ইন্টারেস্টিং তো বটেই। তবে লিখাটি অতিরিক্ত বড় হয়ে গেছে। একবারে পূর্ণাঙ্গ দিলেও জ্বালা আবার খণ্ড করে দিলেও সমস্যা। লেখকদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে বোন।
তারপরও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় কবি সৌমিত্র দাদা। শুভেচ্ছা সতত।
অফলাইনে পড়ে লগিন করলাম আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে।
ধন্যবাদ নতুন বন্ধু শাকিলা তুবা । আমার ব্লগে স্বাগতম প্রিয় কবি বন্ধু আপনাকে। শুভ কামনা রইলো ।