কানার হাটে আলো বিক্রি

গোধূলি

কানার হাটে আমি আলো বিক্রি করি।
আলো—যা তারা দেখতে পায় না, বুঝতেও চায় না।
তবু আমি দাঁড়িয়ে থাকি। প্রতিদিন। প্রতিক্ষণ।
হাতের ঝোলায় কিছু সূর্যরশ্মি, পকেটে মুঠো মুঠো ভোরের আলো,
আর চোখে এক বিন্দু নির্ভার দৃঢ়তা।

এই হাটের মানুষ অন্ধ। শুধু চোখে নয়—
চিন্তায়, চেতনায়, অনুভবে অন্ধ।
তাদের জন্য আলো মানে বৈদ্যুতিক বাল্ব,
আর আমার আলো মানে—
ভেতরের জানালা খুলে দেয় যে আলো,
যা দেখে মানুষ তার নিজের ছায়াকেও ভালোবাসতে শেখে।

তারা বলে, “আলো? আমাদের লাগে না!
আমরা তো দিব্যি বেঁচে আছি এই অন্ধকারেই।
এখানে প্রশ্ন নেই, ব্যথা নেই, দায় নেই—
তোমার আলো এনে এসব জাগিয়ে দেবে কেন?”

আমি শুনি। শুনে থাকি।
কারণ জানি—
আলো কখনো জোর করে ঢুকে না কারো চোখে,
সে অপেক্ষা করে।
যেন কোনো প্রাচীন প্রেমিক—
যার হাতে গোলাপ নেই, তবু হৃদয়ে এক অমল চৈত্র।

কখনো কখনো,
এই হাটের এক কোণে বসে থাকা ছোট্ট ছেলেটি আসে—
সে দেখে না, তবু হাত বাড়ায়।
আমি তার হাতে রাখি এক টুকরো ভোর।
সে হাসে। আর সেই হাসির আলোর ছায়ায়
পড়ে যায় একটা চুপচাপ কান্নার রেখা।

তখন মনে হয়,
এই বিক্রির পণ্য বুঝি বিকোবে না কখনোই—
কারণ আলো কিনতে হলে দেখতে হয় নিজের অন্ধকার।
তবু আমি বিক্রি করি।
দিনশেষে হয়তো বিক্রি হয় না একটিও আলো,
তবু সন্ধ্যার আগে আগে
আমি আমার নিজের চোখে কিছু নতুন রোদ খুঁজে পাই।

এই হাটে আসা মানুষগুলো নিজেরাই জানে না,
তারা কী বিক্রি করে, কী খোঁজে—
আমি শুধু জানি, আলো বিক্রি করি মানেই আলো ছড়াই।
কারণ আমারও একদিন কেউ
কানার হাটে এসে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল এক বিন্দু দীপ্তি,
যা দিয়ে আমি আজো হেঁটে চলি।

তাই প্রতিদিন, প্রতিরাত,
আমি কানার হাটে আলো বিক্রি করি—
ভাঙা মণির মতো কিছু আলো,
যা হয়তো তারা আজ নেবে না,
কিন্তু একদিন,
যখন অন্ধকারও ক্লান্ত হয়ে যাবে,
তারা ঠিক খুঁজে নেবে সেই আলো,
যা আমি ফেলে রেখে গিয়েছিলাম
তাদের অদেখা চোখের ঠিক পেছনে।

ইকরামুল শামীম সম্পর্কে

ইকরামুল হক ( শামীম ) পেশা : সমাজকর্মী, লেখক ও আইনজীবী । জন্মস্থানঃ ফেনী বর্তমানঃ ঢাকা, বাংলাদেশ স্ট্যাডি ব্যাকগ্রাউন্ডঃ ১.মাস্টার্স ইন ভিক্টিমলজি & রেস্টোরেটিভ জাস্টিস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২. মাস্টার্স ইন পলিটিক্যাল সাইন্স। ৩. ব্যাচেলর ডিগ্রী অব সোশ্যাল সাইন্স। ৪. ব্যাচেলর অব 'ল'। কর্মঃ ১. ফাউন্ডার, বাংলাদেশ রেস্টোরেটিভ জাস্টিস সোসাইটি. ২. জুনিয়র ল'ইয়ার, জেলা জজ কোর্ট। ৩. এক্স এ্যাস্ট. কো-অর্ডিনেটর, বিশ্ব সন্ত্রাস ও জঙ্গী বিরোধী সংস্থা, বাংলাদেশ। ৪. এক্স- ট্রেইনার(HIV & DOWRY), টালফ অর্গানাইজশন, বিডি। বর্তমানে তিনি " ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা এবং অপরাধীদের সংশোধন" নিয়ে কাজ করছেন। রাজনীতিঃ দেশপ্রেম। প্রিয় লেখকঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুন। সখঃ ভ্রমণ করা, কবিতা পড়া এবং দাবা খেলা।

1 thought on “কানার হাটে আলো বিক্রি

  1. “কানার হাটে আলো বিক্রি”—শিরোনামটি নিজেই এক অনবদ্য উপমা। কবিতাটি যেন সমাজের এক গভীর ব্যঙ্গচিত্র, যেখানে অন্ধত্ব কেবল চোখের নয়, বিবেকেরও। আলো এখানে জ্ঞানের, সচেতনতার, ন্যায়ের প্রতীক—আর সেই আলোরই যেন সবচেয়ে কম দাম, কিংবা কেউ তা চাইছে না। কবি নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন এক এমন বাস্তবতা, যেখানে মূর্খতা, অজ্ঞতা ও স্বার্থান্ধতা শাসন করে বোধ, মানবতা ও যুক্তিকে। কাব্যিক ভাষা ও প্রতীক ব্যবহারে কবিতাটি পাঠকের মনে নাড়া দেয়—এটি শুধু একটি কবিতা নয়, একধরনের প্রতিবাদও।

    কবিকে ধন্যবাদ!

মন্তব্য করুন