পার্শ্বচরিত্র

সিমুলেশন ল্যাবে বসে আছি। টিচার তখনো আসেনি। সবাই যার যার ইনস্ট্রুমেন্টস নিয়ে ব্যস্ত। ল্যাব এসিস্টেন্ট এসে পাওয়ার পয়েন্টে ডাটা টেবিল, ডায়াগ্রাম ওপেন করে দিয়ে গেছে। সবাই ব্যাগ থেকে ল্যাব রিপোর্ট বের করে একেক করে টেবিলের উপরে স্তূপ করে রাখছে। একজন আমার সামনে রিপোর্ট এটেন্ডডেন্স সীট পাস করে দিলো, আমার ঠিক উপরের ঘরে কোনও সিগনেচার নেই। কলম বামে টেনে একঘর উপরে যেতে নামটা পড়লাম, মালিহা মাইশা।
আমার ঠিক উপরেই যেহেতু নাম, তার মানে আমার ডান পাশের টেবিলেই থাকার কথা। আশ্চর্য প্রায় সাত মাস এই ল্যাবে দুইটা ল্যাব করছি, অথচ আমার ডান পাশের টেবিলে কে বা কারা ছিল সেটাই জানি না। আমি কি এতটাই আনমনা থাকি ! থাম্ব আঙ্গুল দিয়ে ক্লিক পেন বারবার ওঠা-নামা করছি। এটেন্ডডেন্স সীটে সিগনেচার করছি দেখে পাশ থেকে নাইম বলে উঠলো,
– কি রে নিজের নাম ভুলে গেছিস নাকি? সই টা দে, পাস কর!

এই গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। মালিহা মাইশা নামের কাউকে আমি চিনিই না, তাকে ভাবনায় নিয়ে আসা একদম উচিত না। আমার এখন উচিত ল্যাব এক্সপেরিমেন্টে ফোকাস করা। এই ল্যাবগুলো খুব বিচ্ছিরি। পিন আউট ডায়াগ্রাম দেখে দেখে সার্কিট বানিয়ে বসে থাকতে হয়, কখন টিচার এসে দেখবে- গ্র্যান্ড করবে তারপর পাওয়ার কানেকশন দিতে হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ডাটা টেবিলে ভেল্যু তুলে তারপর আবার টিচারের সিগনেচার নিয়ে ল্যাব থেকে বের হতে হবে। কম্পোনেন্টগুলোও মারাত্মক খবিশ। সিরিয়াল নাম্বার দেখে নিতে হয়, সিরিয়াল নাম্বার থাকে পিন আউটের বিপরীত পিঠে। এত ছোট ছোট করে লেখা থাকে যে পড়তে গেলে রীতিমত চোখ খুলে হাতে নিয়ে পড়তে হয়।

নিজেকে অনেকবার কমান্ড দিয়েছি অলরেডি, ফোকাস জাহিদ! ফোকাস! এই বুড়ো সাদা মাথার টিচার মোটেও ভালো গ্রেড দেয় না, ফোকাস! ফোকাস।
কিন্তু কিছুতেই ফোকাসটা ল্যাবে দিতে পারছি না। সব ফোকাস চলে গেছে মালিহা মাইশার দিকে।

ল্যাব সীট হাতে নিয়ে হয়ত ভাবতে বসে গেছি, মালিহা’টা কে? তাকে আমি আগে দেখেছি কী?
সে আমাকে দেখেছে? নাকি সেও আমার মত বেখেয়ালি!
আমি কী আজ ল্যাব থেকে বের হয়ে তাকে খুঁজে বের করব? নাকি ফেসবুকে খুঁজব?
নক দেব? কী বলব নক দিয়ে? ল্যাবে আসেনি কেন? সুস্থ আছে কিনা, এসব?
বেশি বেশি হয়ে যাবে না? সব ছেলেই একইরকম, গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে, এসব ভাববে না তো!
দেখা যাবে সে হয়ত ইঞ্জিনিয়ারিং আর পড়বে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে হয়ত চীনে যাচ্ছে মেডিকেল পড়তে!
আরও অনেক অনেক সম্ভাব্যতা আছে। হতে পারে তার জ্বর কিংবা গাড়িতে করে আসছিল, গাড়ি এক্সিডেন্ট করে ঠ্যাং ভেঙে গেছে! হতেই পারে। একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

ল্যাব থেকে যখন বের হলাম, তখন সন্ধ্যা ৬ টা। বুধবারের এই ল্যাবটা একদম সন্ধ্যা বানিয়ে দেয়। চারদিকে এত রোদ ঝলমল পরিবেশ দেখে ল্যাবে যাই আর যখন বের হই মনে হয় এক আকাশ অন্ধকার সাথে করে বের হয়েছি। ক্যাম্পাসের লাল দেয়াল পেরিয়ে আইডি-কার্ড পাঞ্চ করে যখন বাইরে বের হই, শীত কিছুটা লাগে লাগে যেন। দু’চারজন যাদেরকে চিনি কোনমতে হাই হ্যালো বলে পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে বাঁশের বেঞ্চের উপরে বসি। অনেকক্ষণ ল্যাবে বসে থাকতে থাকতে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে, বের হয়েই একটা কফি-টাচ আর ব্যানসন না ধরাতে পারলে যেন প্রাণ উশখুশ করে।
সিগারেটে টান দিতেও দিতেও সেই যেন মালিহা মাইশা’র কথাই ভাবছি। কিন্তু কী কী ভাবছি সেগুলো ঠিক সুনির্দিষ্ট নয়। হয়ত, ল্যাব থেকে বের হয়ে এরকম সন্ধ্যায় সে কী কী করে বা করতে পারে সেগুলো ভাবছি। নিশ্চয়ই বাসায় চলে যাবে। বাসা দূরে হলে দ্রুতই ক্যাম্পাস ত্যাগ করবে আর যদি কাছে হয় তাহলে হয়ত বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেবে।
মেয়েরা সাধারণত বাইরের টং দোকানগুলোতে কম আসে। তারা ভেতরের গ্রাউন্ড ফ্লোরের ক্যাফেটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। সেখানে ওয়াইফাই আছে, যদিও খুব স্লো। আমি দুই তিনবার ইউজ করেছি।
এসব ভাবতে ভাবতে একটা সিগারেট শেষ হয়ে গেল। কফিও শেষ। এই গল্প শেষ করে এবার আমাকেও বাসায় যেতে হবে।

একটা গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠা চাট্টেখানি কথা না, মূল চরিত্র হতে গেলে সব সময়ের লেখকের সাথে সাথে থাকতে হয়। লেখক যেভাবে ভাবে নিজেকে সেভাবে ভাবনায় মানিয়ে নিতে হয়। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করতে হয়। আমি নিজে কখনো কোনো গল্প লিখে উঠতে পারিনি। গল্প লিখতে গেলে মনে হয় এখুনি সবকিছু গুলিয়ে ফেলব। গল্পের অনেক চরিত্র, অনেক দুশ্চরিত্র, অনেক পার্শ্বচরিত্র।
এত চরিত্রের ভীড়ে পাঠকের চোখ কীভাবে কেবলমাত্র মূল চরিত্রের দিকে আটকে রাখতে হয় সেই আঠা রেসিপি আমার জানা নেই, আর তাই গল্প লেখা হয় না আমার।
আজ অবচেতনভাবে একটা জিনিস খেয়াল করে যাচ্ছি, সেই প্রায় ল্যাবে যাওয়া থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মালিহা মাইশা বেশ ভালোকরেই আমার অলিখিত গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে বসে আছে, অথচ গল্পটা আমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে আমাররই থাকার কথা।

আমি যদি, এই-সবকিছু টাইপ করে মালিহাকে একটা ইমেইল করে দেই কেমন হবে? নিশ্চয়ই সে খুব বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে যাবে! সে কি ভাববে? আমি তার প্রেমে পড়ে গেছি? সে কী আমাকে মেইলের রিপ্লাই দেবে?
সে কী ব্যাপারটা বন্ধুদের জানাবে? আমাকে দেখে সবাই হাসাহাসি করবে? শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কী কেবল গল্পের মধ্যেই থাকবে, নাকি বাস্তবে রূপ নেবে? গল্প সত্যি হয়ে গেলে সেটা আবার কেমন গল্প!

————————————————-

জাহিদ অনিক
ছবিঃ গুগল
২২ শে নভেম্বর, ২০১৮

10 thoughts on “পার্শ্বচরিত্র

  1. একটা গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠা চাট্টেখানি কথা না, মূল চরিত্র হতে গেলে সব সময়ের লেখকের সাথে সাথে থাকতে হয়। লেখক যেভাবে ভাবে নিজেকে সেভাবে ভাবনায় মানিয়ে নিতে হয়। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করতে হয়। গল্পের অনেক চরিত্র, অনেক দুশ্চরিত্র, অনেক পার্শ্বচরিত্র।

    এক অর্থে কথা সত্য কবি জাহিদ অনিক। পড়ে গেলাম চটজলদি। 

    1.  

       

      পছন্দের অংশটুকু উদ্ধত করে অনুপ্রাণিত করলেন দিদি ভাই। 

      শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা রইলো। 
      ভালো থাকুন সতত 

  2. ভিন্ন ধাঁচের লিখা জাহিদ দা। পার্শ্বচরিত্র অলওয়েজ আনফোকাসড। এটাই নিয়ম।  

    1.  

       

      ঠিক গল্পের মত করে লিখিনি, গল্প আমি লিখতে পারি না। নিজের মত করে কিছু একটা লিখেছি। হ্যাঁ ঠিক বলেছেন আপনি সৌমিত্র দা, পার্শ্বচরিত্র অলওয়েজ আনফোকাসড। এটাই নিয়ম।  

       অনেক অনেক ধন্যবাদ ভালো থাকুন 
      কৃতজ্ঞতা জানবেন 

  3. ছোট পরিসরে লিখন বক্তব্যের স্বতন্ত্রতা ধরে রাখতে পেরেছেন মি. জাহিদ অনিক।

    1.  বক্তব্যের স্বতন্ত্রতা ধরে রাখতে পেরেছেন মি. জাহিদ অনিক।  আপনার মন্তব্যে আশ্বস্ত হলাম মুরুব্বী। 

      অনেক অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা 

  4. গল্প সত্যি হয়ে গেলে সেটা আবার কেমন গল্প!

     

    * সেতো ইতিহাস….

    শুভ কামনা নিরন্তর। 

     

  5. নতুন স্বাদের গল্প  পড়লাম। সব মিলিয়েই ভালো লেগেছে। শুধু ভালো নয়; চমৎকার লেগেছে।

    আরও  একবার পড়লে হয়ত আমার মত করে সিদ্ধান্তে পৌঁঁছতে পারতাম, এটা অণু নাকি ছোট গল্প। কারণ স্বল্পায়তন অণুর প্রথম শর্ত নয়; বেশ পরের শর্ত।

    আপাতত এটাকে আমি ছোট গল্প হিসেবে পড়ে অনুভূতি জানাচ্ছি, অসাধারণ এক ভিন্ন স্বাদের ছোট গল্প পড়লাম!

    1. আপনার মন্তব্য বেশ গুরুত্বসহকারে নিচ্ছি মিঃ মিড ডে ডেজারট
      আপাতত এটাকে আমি ছোট গল্প হিসেবে পড়ে অনুভূতি জানাচ্ছি রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের সংজ্ঞা থেকে, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ; এই অনুভূতি যদি সত্যিই আমার এই লেখা আপনাকে দিয়ে থাকে তাহলে আমি নিশ্চয়ই আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। 

       

      অনেক অনেক ভালো থাকুন 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।