জাহিদ অনিক এর সকল পোস্ট

জাহিদ অনিক সম্পর্কে

ঝাঁপ দাও হে নক্ষত্র, জাহিদ অনিক ভাল নেই ।

অন্ধকার শুনে শুনে

পৃথিবীর কোমল হৃদয়ে চাঁদ যেন জেগে রয় –
মানুষের বুকের গহীন ক্ষত হয়ে;
জেগে রয় প্রকাণ্ড আসমান –
আমার নির্বাক চাহনি হয়ে।

সন্ধ্যার গাঢ়তর রঙে গ্রহ ছুটে যায় নক্ষত্রের পানে-
সমুদ্রে ঝিনুক হেঁটে যায় জলের দিকে।
পেলব অন্ধকারে – মানুষ কেবল আসে না
মানুষের কাছেপিঠে।

এ অভিশাপ
এ শাপ
এ শঙ্খ
এ সখ-
এই আমার বাঁচিবার অথবা
মরিবার সুতীব্র শখ।

যদিওবা রাত আর আসমান চিনেছে মানুষ –
কবে কোন নৈঃশব্দকে শুনে-
কার বুকে কে রেখে পা-
শব্দকে নাম দিয়েছে ‘অন্ধকার’;
কে গেছে মরে ঐ অন্ধকার শুনে।

জানে না সে কথা-
কবে কোন মানুষ এক, একা-
ভেঙেছিল পাহাড়।
দুর্দান্ত অন্ধকার রাত্রে-
মানুষের মনে পড়ে পাহাড়-
মানুষ এক পাহাড় – যদি বুক খুলে দ্যাখো।

শঙ্খসখ

মুহুর্মুহু ভালোবাসা যখন বুকের মধ্যে আঘাত হানবে আমার – তখন আছড়ে পড়া ঢেউএর মতন;
তোমার ও’সব ভাবলেশহীন পা ফেলে চলে যাওয়ার কথাই মনে পড়বে। মনে পড়বে সবুজ দিন – সবুজ ঘাসের কথা।

বাহান্ন পৃষ্ঠার বইএর মাঝখানে আঙ্গুল ‘এসে দুই ভাগ হয়ে মিশেছে তোমার সিঁথির মতন। সিঁথি ধরে চলে পৌঁছে যাব নিরুন্তর বয়ে চলা অথর্ব এক জীবনের কাছে; যে জীবন আমার ||

আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল এসব ধ্বনিপ্রধান গণ্ডী থেকে বেরিয়ে, শঙ্কা থেকে বের হয়ে শঙ্খসখ করে হেঁটে যাওয়া আনুমানিক বৃহস্পতির বলয়ে ||

[শঙ্খসখ]

ঋণঋণায়মান

ঋণঋণায়মান
এই যে বেঁচে থাকা তারই ডাকসাইটে নাম জীবন।
তবুও তো নানাভাবে চিঠি লিখে জীবনকে বোঝাতে হবে-
ভালোবাসি।
যে জীবন অস্বীকার করে –
প্রেম, ভালোবাসা আর চুমকুড়ি যত্ন আত্তি।।

আমি কবিতা

আমি কবিতা;
আমার ডান হাতে রয়েছে প্রেম বাম হাতে রয়েছে বিদ্রোহ !
পায়ে আছে হতাশার শিকল চোখে আছে অপূর্ণতার অগ্নি
উত্তাল খোলা চুলে বইছে অবাধ স্বাধীনতা !
ঠোঁটে রয়েছে কামনার নীলচে শিখা
জিহ্বার অগ্র-মূলে লালসার লালারস !
আমি; আমিই কবিতা।

জন্মটা আমার হয়েছিল অন্ধকার আস্তাবলের খুপরি ঘরে
বর্বর কোন এক কবি টেনে হিঁচড়ে বের করেছিল মায়ের জরায়ু থেকে
তারপর চ্যাংদোলা করে ছুড়ে ফেলে দিল
সন্তানের মুখ দেখতে আর সে আসে নি;
আমি, আমিই মুখপোড়া কবিতা।

প্রথম দিনেই আজন্মের মত বুঝে গিয়েছিলাম জন্মের মানে
অধিকার কেড়ে নিতে গগন কাঁপিয়ে দিয়েছিলাম হুংকার !
ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসে,
শরীর থেকে খসে পড়েছিল ঝাঁকে ঝাঁকে শব্দ;
সেদিন থেকেই বুঝে নিয়েছি;
আমি, আমিই কবিতা।

আমি:

আমি:
সেইসব ভ্রম, যা তুমি দেখতে পাও আধো আলোতে
আমি:
সেই নুড়ি পাথর,
তুলবে তুলবে করেও কুড়াও নি যা’কে
চুলে ঠেলে উদম পিঠে হেঁটে গেছ বেসামাল বাতাসে।
আমি:
সেই বালুকাবেলা-
যেখানে ডুবেছে সূর্য-চাঁদ রোজ-
মৈথুন হয়েছে ফেনীল মোহনার!
কেবল ডুবে নি টিপে টিপে হাঁটা বুড়ো আঙুল।
আমি:
এতটাই ছোটলোক
নিজের মত ছোটলোক কক্ষনও দেখনি আগে।
26/2/2020

আজ একাদশী তিথি

বুধ থেকে শুক্র, রবি থেকে মঙ্গল-
আজ দেখা পাইনি তোমার।
আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা খাইনি কিছু;
আজ দেখা পাইনি তোমার
আজ শনি, আজ একাদশী তিথি।

ঘুমুচ্ছো তুমি-
রেগে নেই, ক্রোধে নেই-
অল্প একটু ভালো নেই,
ঘুমন্ত মানুষের উপর রেগে থাকতে নেই।

বুকের মধ্যে মাটি-
যার বুকে মাটি তার বুকে কথা গাছ।
আমি মরে যাব কথা না বলে-
আমি মরে যাব তোমাকে না দেখে-
আজ দেখা পাইনি তোমার
আজ শনি, আজ নির্জলা একাদশী তিথি।

অটোপসি

যে পাহাড়ে যাব যাব করে মনে মনে ব্যাগ গুছিয়েছি অন্তত চব্বিশবার-
একবার অটোপসি টেবিলে শুয়ে নেই-
পাহার, ঝর্ণা, জংগলের গাছ, গাছের বুড়ো শিকড়- শেকড়ের কোটরে পাখির বাসা;
সবকিছু বেরিয়ে আসবে শরীরের ভেতর থেকে,
বুকের মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসবে হামিংবার্ড আর রক্তে সাঁতরে বেড়াবে ডলফিন পরিবার।

একবার অটোপসি টেবিলে শুয়ে নেই –
গলগল করে পেট থেকে-
গলার নালী পুড়ে পুড়ে মুখ দিয়ে
বেরিয়ে আসবেঃ
অতি সতর্ক থিসিস পেপার, যত্নের প্রেমিকাকে লেখা চিঠিপত্র, দুমড়ে যাওয়া বাজারের ফর্দ, কবিতার খসড়া, পুণ্যবতী চাঁদ, পায়ে না লাগানো সমুদ্রের জল-বেলাভূমি, আর সতেরো ডিজিটের জাতীয় পরিচয়পত্র।

একবার আসুক অটোপসি রিপোর্ট-
মর্গের ডোম জানবে নিশ্চয়ই;
হৃদপিণ্ডের কোণ প্রকোষ্ঠে সঞ্চিত রক্ত আর কোণ প্রকোষ্ঠে ভালোবাসা!
ভালোবাসা ব্যাপারটা ও’ বুঝেছে, অলিন্দ নিলয় কেটে-কুটে।
কারণটা জানা দরকার খুব,
ঠিক কীভাবে মরবো সে ব্যাপারে কিছুই ভেবে উঠতে পারি নাই এখনো।

পরবর্তী প্রেমিকা আমার

পরবর্তী প্রেমিকা আমার,
খুব সৌভাগ্যবতী, খুব কপালী আর পয়মন্ত হবে।
পরবর্তী প্রেমিকা’কে খুব করব নিপীড়ন আর স্বৈরশাসন –
নির্যাতন করব – শাসন করব
বারণ করব – হরণ করব।

মারাঠি নথ আর ঘুঙুর বেঁধে
বন্দি করব রুদ্ধ প্রেমে;
মেদ গলা দুপুর গরমে-
তক্কে তক্কে তাকে শেখাবো রক্তক্ষরণ।

পরবর্তী প্রেমিকা’কে খুব জ্বালাবো- খুব কাঁদাবো,
বুকের মধ্যে হূল হুল ফোটাবো –
চোখের মধ্যে সুই ফোটাবো;
প্যারাফিন মোম ঢালব নাসারন্ধ্রে
পেট্রোলিয়াম জেলি ঢালব অন্তঃকর্ণে ,
পায়ের তলায় ফোটাবো সেফটিপিন।

তাকে বলব-
রক্ত হও- ক্ষার হও
লবণ হও- ঘাম হও
জল হও- জ্বর হও।
তাকে বলব,
দগ্ধ হও- শুদ্ধ হও
আরাধ্য হও- ঋদ্ধ হও।

পোড়ামুখী,
তোকে দেব কাটা-ছেঁড়া, রক্ত মাংস প্রেম
তোকে দেব গজ ব্যান্ডেজ আর সেলাই প্রেম
তোকে দেব ভায়োডিন আর ন্যাপথালিন প্রেম।

দুপুরের মতন চোখ তুলে তাকিয়ে থাকা পথে-
বুধবার বলে আসব না শনিবারেও,
ভুলে যাব জন্মদিন, চন্দ্র-দিন।
চিঠি লিখব না, পাঠাবো না পত্র –
লিখব না স্মারকলিপি, লিখব না কবিতা।

পরবর্তী প্রেমিকা,
তোমাকে দেব দুঃখ কষ্ট আর অনাদর প্রেম-
তোমাকে দেব এক মুঠো চাল- দো’চালা ঘর
তোমাকে দেব পোড়া মরিচ, পিঁয়াজ সানকির প্রেম।
তোমাকে দেব শাপ- অভিসম্পাত;
তোমাকে অভিশাপ নারী,
পরবর্তী প্রেমিক তোমার কবি’ই হোক।

মানচিত্রের মতন- পৃথিবী আমার

বরফ দেশের পেঙ্গুইন বাচ্চাদের উচ্ছ্বাসের মতন-
তোমার কপালের ‘পর
সকালে প্রথম চুমু খায় এন্টার্কটিকা।
পেটের উপর ভূ-মধ্যসাগর, আল্পস আন্দিজ;
সূতা ভিজে যাওয়া লবণ ঘামে-
আফ্রিকা-ব্রাজিল রেইন ফরেস্ট।
দুপুরের ডিহাইড্রেশনে-
বুকের উপর মিশরীয় সভ্যতা।

তপ্ত রোদে- হৃদয়ে যখন রক্তারক্তি
তুমি তখন, ক্ষত বিক্ষত ইরাক সিরিয়া-
প্যালেস্টাইন- জেরুজালেম।

সকালে আটলান্টিক, কুইন্সল্যান্ড-
বিকেলে উত্তর কোলকাতা, শিলং – দার্জিলিং।
পাহাড়িয়া রাস্তা, সাঁওতাল গাঁ-
ঠিক যেন, কপালের দু’পাশ থেকে বেয়ে নামা আসা পার্সি নারীদের জুলফি।

সন্ধ্যায় –
পায়ের উপর জল এসে চুমু খেতে খেতে
নখের ডগা বদলে গেছে প্রবাল প্রাচীরে।
লোমকূপে জমা সামুদ্রিক লবণ
চুল উড়ে যাওয়া বেতাল বাতাসে-
তুমি তখন
উত্তর আমেরিকান ওশেনগার্ল কিংবা বাংলাদেশে ‘সমুদ্রকন্যা’।

দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে –
আন্দামান নিকোবর- ধন-মানিক দ্বীপপুঞ্জে
গলদা চিংড়ির লার্ভার মতন থলথলে
কখনওবা ইলিশ ডিমের মতন দাঁতের নিচে ঝুড়ি-ভাঙা জীবন।

স্বাধীনের আগে – পরে
পাক-মোটর – বাংলামোটর
স্থল বন্দর, সমুদ্র বন্দর-
মংলা- ভেনিস- বিশাখাপত্তনম- চিটাগাং;
এত বৈচিত্র্য
এত জীবন
পৃথিবীর মতন –
প্রেমিকার মতন,
ক্ষত চিহ্নের মতন
করে যাচ্ছ ধারণ শরীরে তোমার,
জন্ম দাগের মতন তেতিয়ে ওঠা সীমান্ত রেখা।

শরীর মানচিত্রের মতন-
ছোট বড় অসংখ্য দাগে সয়লাব;
বিভাজন রেখা জমে জমে সাত সাতটি মহাদেশ নিয়ে
তুমি হয়ে গেছ দ্বাবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী আমার।

প্রেমিকার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী প্রেমিকের প্রতি–

শোনো ছেলে, শোনো গুম হয়ে যাওয়া প্রেমিক- তোমাকেই বলছি,
আমার প্রেমিকাটিকে বড্ড ভালোবাসি আমি
– কীভাবে বুঝাই কতটা ভালোবাসি!
পার্থিব দুনিয়ার অপার্থিব কিছু উদাহরণ দেই- যদি বুঝতে পারো!

একজন বাবা যেরকম ভালোবাসে তার কন্যাসন্তান’কে,
কিংবা ধরো একজন কবি যেভাবে ভালোবাসে কবিতা,
ধরো এতটা ভালোবাসি যে, কখনো কখনো মন চায়-
একটা ‘নিষিদ্ধ আপেল’ ভাগাভাগি করে খেয়ে নিতে পারলে ভাল হত।

শোনো-
পূর্ববর্তী প্রেমিক-
আমার প্রেমিকা’কে তুমি ভালোবাসা দিতে পেরেছিলে অল্প বিস্তর কিছু-
তোমার নাম এখনো রূপকথার মত শুনতে পাই তার মুখে মুখে,
যেন তুমি ছিলে সিন্ধু’র বুকে হরোপ্পা মহেঞ্জোদারো’র মতন।

তুমি তাকে যৎকিঞ্চিত আদর আর আহ্লাদ দিয়েছিলে-
কিন্তু বুকের উপরে ঢেউ হয়ে যেতে পারো নি।
তুমি ভালো প্রেমিক ছিলে না, প্রেমিক হিসেবে বড্ড আনাড়ি ছিলে তুমি।
তুমি জানবে,
আনাড়ি ছিলে বলেই একজন ‘নারী’ তোমাকে ভালোবেসেছিল।

যেসব চিঠিপত্র তুমি লিখেছিলে আমার বর্তমান প্রেমিকাকে-
আমি আজও সেসব চিঠি পড়তে পারি আমার বর্তমান প্রেমিকার চোখে।
বুঝতেই পারছ – আমি সাটলিপি জানি, ব্রেইল জানি।

থাক-
তোমার প্রেমের আর মাহাত্ম্য বাড়িয়ে কাজ নেই
অতটা ভালো প্রেমিক তুমি ছিলে না।
বরং তোমার প্রতি আমার কথা বলি,

তুমি তোমার প্রেমিকাকে যে নামটা দিয়েছিলে-
তুমি কি জানো সেই নামটা কত প্রিয় তার?
তাই আমিও সে নামেই তাকে ডাকি-
যদিও কষ্ট হয় আমার, খুব কষ্ট হয়।

তোমার মত এত গভীরে আমি যেতে পারব না আমি জানি,
বড্ড কাচা বয়সের প্রেমিক ছিলে তুমি-
বড্ড ভুল করা প্রেমিক ছিলে-
জানবে ছেলে,
এসব ভুল ভ্রান্তি করেছিলে বলেই তোমাকে ভালোবেসেছিল একজন ‘অ-নারী’।

যতই তোমাকে আমার ঈর্ষা হোক-
তোমার কথা শুনলে যতই আমার বুকে মেঘ জমুক-
তুমি জানবে,
তোমার প্রতি রয়ে গেছে আমার দুঃসম্পর্কের ঋণ-
তোমার প্রতি রয়ে গেছে আমার না চুকানো দায়।

আমার অবর্তমানে –
আমার বালিকা প্রেমিকাটিকে বড্ড যত্নে রেখেছিলে তুমি-
কিছুটা ভালো রাখার দায়িত্ব তুমিও নিয়েছিলে।

কষ্টগুলোও তাকে তুমি দিয়েছিলে বড্ড আদরে আদরে-
তোমার দেয়া কষ্টগুলো আমাকে বলতে গেলে আজও সে তুলোর মতন নুইয়ে পড়ে-
আমি আজও তোমার পুরুষত্বের জল পিইয়ে খাই ও’র চোখ থেকে।

তাই!
হে পুরুষ –
তুমি জানবে ইহ-জাগতিক এই ঋণ আমি শোধ করব না,
তোমার কাছে এইটুকু ঋণী আমি থেকে যাব;
তবুও পালিয়ে যাব না, ঋণখেলাপী হব না।

শোনো পরবর্তী প্রেমিক- শোনো দুধ-দাঁতের ছেলে,
যে মেয়েটিকে তুমি ভালোবাসতে চাইছ-
যা’কে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছ- তাকে চাইবার আগে-
এসো বাঁধো তোমার টাই নট বাঁধন,
হালকা মদ্যপান করতে করতে দু’জন সভ্য মানুষ যেভাবে খোলামেলা আলোচনা করে-
ঠিক সেরকম পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত দ্বিপক্ষীয় একটা মিটিং করে নেই।

যে নারীটিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ আকাশ খোলা রাস্তায়
সানরুফ গাড়িতে করে ভেসে বেড়াচ্ছ চাঁদের জ্যোৎস্নায়-
তাকে নিয়ে কিছু কথা আমাকে জানিয়ে যাও।

আমাকে বলে দাও –
এই মেয়েটিকে তুমি এতটা ভালোবাসা দেবে যে
আমাকে সে ভুলে যাবে,
বলও, তুমি এতটা প্রেম তাকে দেখাবে-
যাতে সে আমাকে ভাবতে পারে প্রতারক!
বল,
তাকে ভালোবাসবে কারণ, তুমি ভালোবাসা জানো সেটা নয়।
তাকে তুমি ভালোবাসবে কারণ,
তুমি জানবে- ভালোবাসা পাওয়ার মত কিছু নয়।
তাকে তুমি ক্ষমা করে দেবে অসীম অক্ষমতায়ও- কারণ, তুমি মহত্তম নয়
কারণ তুমি জানবে,
তুমিও আমার মতন এই মেয়েটির প্রেমিক-পিতা হতে চাইছ।

বলো এসব ভালোবাসা তাকে তুমি দেবে?
কেবল তাকে তুমি ভালোবাসাই দেবে, দুঃখ দেবে না।
কেননা, দুঃখ সবাই দিতে পারে-
সমান্তরালে ভালোবাসা দিতে অনেকেই পারে না।

এসব প্রতিজ্ঞা আমায় তুমি দেবে বলো?
তোমাকে তার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিতে হবে না-
তোমাকে ভাবতে হবে না – সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা-
শুধু বলো? যা যা বলেছি তার জন্য, এটুকু তুমি করবে?

সত্যি বলতে-
আমার প্রেমিকাকে ভালোবাসার জন্য আমার অনুমতি তোমার নিতে হবে না,
বুঝতেই পারছ এতক্ষণে –
আমি কেবল তাকে প্রেমিকের মতই ভালোবাসিনি-
ভালোবেসেছি পিতার মত।
তাই তাকে তোমার হাতে তুলে দিতে কিছুটা দুশ্চিন্তা হচ্ছে,
ঠিক কন্যা বিদায় দেয়া পিতার মত আমার বুকেও করুন সুর বাজবে।

শোনো,
প্রিয়তম! মাই লাভ!
আমার আশীর্বাদ লেপ্টে আছে তোমার কপালে চুম্বনের মতন-
তোমার পরবর্তী প্রেমিক শুদ্ধ হবে, ঋদ্ধ হবে।
তবু,
তোমার পরবর্তী প্রেমিক’কে আমার কথা বলো না।
পরবর্তী প্রেমিক’টি তোমার কবি না হোক-
আমি নিয়েছি সয়ে শ’য়ে শ’য়ে; সেও কি পারবে?
একজন পুরুষ হৃদয়ের অনুকম্পন একজন সমমনা পুরুষ ছাড়া খোদাও বুঝেন না।

চিঠি কাব্য

কেউ একজন একটা চিঠি লিখুক
একটা পৃষ্ঠা নিক সে টেনে-
যেভাবে কেউ খুব কাছে টানে; হ্যাঁচকা-টানে আপনজনকে,
ভাঁজ করুক ডানে বামে,
যেমন ভাঁজে বই’এ জন্মে ময়ূর পালক।

তাথাপি,
যদি কিছু লেখবার না থাকে
তবে যেন খালি রেখেই সমাপ্ত করে চিঠি।
ও’টা আমা পর্যন্ত পৌঁছলে ছোটবেলায় শেখা খালিঘর পূরণের মত
কিছু শব্দ ও’তে আমি দিয়ে দেব,
খালি ঘর পূরণে জুড়ি আমার নেই।
কখনো কারও ঘরের চালা ফুটো হয়ে জল গড়ালে
ছন হয়ে কাটিয়েছি রাত,
কারওবা রাত্রি বেলায় অসুখ হলে ওম হয়েছি জ্বরের ঘোরে
ডাক্তারের মতন গলায় বুকে আঙুল ডুবিয়ে মেপেছি জ্বরের মাত্রা
বুকে কান পেতে শুনেছি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস;
তারপর, তালুর মধ্যে আঙুল রেখে পেন্সিলের মত ক’রে লিখেছি ব্যবস্থাপত্র।

পরীক্ষার হলে ঢোকা তড়িঘড়ি ছাত্রের মত বইয়ের পাতায় শেষবারের মতন চোখ বুলিয়ে-
প্রশ্নপত্র পাওয়ার পর যেভাবে লেখে ১ নম্বর প্রশ্নের উত্তর (ক);
তারপর ভুল করে লিখে বসে পেছনের পাতা থেকে ৬ নম্বর প্রশ্নের শেষ উত্তর,
সেভাবে কেউ লিখুক এপিঠ ওপিঠ উল্টেপাল্টে – ভুলে-ভালে;
ভুল করা বানানে, ভুল ভাবা কথায়
আর
ভুল মানুষের কথা শুনে বড্ড অভ্যস্ত আমি।

দাপ্তরিক চিঠিপত্র যেরকম হয়,
কার কাছে লিখছি –
কেন লিখছি-
কখন লিখছি-
তারিখ –
স্মারক নাম্বার-
কম-মূল্যের ডাকটিকিট –
চিঠির শেষে সদয় অবগতির জন্য সংযুক্তি;
সেরকম সরকারি নীল খামে হলেও কেউ লিখুক অন্তত কিছু আদেশ – বিধিনিষেধ
অথবা তাৎক্ষণিক বদলি কিংবা স্থগিত অর্ডার।

এমন চিঠি কে লিখবে আমায়?
যেরকম চিঠি-
প্রেমিকা লেখে প্রেমিক’কে-
বাবা লেখে সন্তানের কাছে
স্ত্রী লেখে স্বামীর কাছে
বন্ধু লেখে বন্ধুর কাছে
শত্রু লেখে শত্রুর কাছে
মেঘ লেখে বৃষ্টির কাছে
পাহাড় লেখে সমুদ্রের কাছে
প্রদীপ লেখে শিখার কাছে
মংলা লেখে ভেনিসের কাছে।

আমার জন্য কে লিখবে এমন চিঠি –
যে চিঠিতে আমি থাকব না!
কে লিখবে এমন চিঠি?
যে চিঠিতে সে থাকবে না!
কে লিখবে এমন চিঠি-
যে চিঠিতে শব্দের বদলে জলছাপ থাকবে-
নিত্য এমন পুরানো চিঠি কে লিখবে আমার কাছে?
যে চিঠিতে সমুদ্র-গন্ধী বাতাস থাকবে।

পরাধীনতা?

একই ভুলে;
একই কারণে
বিধিনিষেধ মেনে চলে-
থেকে যাওয়া আজীবন যেভাবে ছিলাম।

তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল প্রেমিকা,
দর-কষাকষি করে কতটা প্রেম তুমি নিজে পাবে
আমাকেই বা কী দেবে?

সংগ্রামে না হয় স্বাধীনতা আদায় করে নেয়া যায়,
কিন্তু পরাধীনতা? তা’কে কীভাবে করব আদায়?

অছিয়তনামা

মৃত্যু শব্দটিকে নিয়ে মানুষ ও ঈশ্বর দু’জনেই এত বেশী বালখিল্যপণা করেছে যে মানুষ আর এখন মরতে ভয় পায় না। মৃত্যুর মত এরকম আরও একটা শব্দ আছে, “ভালোবাসা”। ভালোবাসাকেও আজকাল সবাই এড়িয়ে চলে, যেন সেটা এমন একটা কিছু যা ছিল, শুনেছি অনেক আগে— এখন বিলুপ্ত। শুনতে ভালো লাগে কেউ কাউকে ভালোবাসে, অথচ নিজের সেই হিম্মত নেই পরখ করে দেখবার! তাই, আজকে দু’টি শব্দ’কে স্বেচ্ছায় এড়িয়ে চলছি—

প্রিয় কবি সাহিত্যিক ও বোদ্ধাগণ,
আপনাদের অনেকের লেখা আমার ভালো লাগে না। ভালো লাগে না মানে এই নয় যে আপনাদের লেখার সাথে আমার মতের ঐক্য নেই; আমরা নিশ্চয়ই সম্মিলিত ঐক্যজোট করতে আসিনি।
একজন কবি’র জীবন অতটা কাব্যিক নয়; অথচ কবিতার নামে আপনারা কেউ কেউ যে দাঁত ভাঙ্গা এবং হৃদয়-ভাঙা নেতানো মুড়ির ঠোঙা লিখে যাচ্ছেন, সেসব আমার বড্ড অপছন্দ।
ক্ষমা করবেন, আমি বিপ্লবী হতে পারিনি বলে, সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি। কিছু একটা ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়ায় রোজ রাত্রে, সকালে, বিকালে। বিপ্লব আমি করতে পারিনি। তবে, দেখেছি কোনো বিপ্লবী মারা গেলে তার পোষ্টার ছাপানো হয়, সেখানে তার সাদাকালো ছবি থাকে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা থাকে, তারপর দুপুরটা গড়িয়ে দেলেই কুকুর গিয়ে পোস্টারের সামনে সঙ্গম করে। শুনেছি, তাদের শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থার এজেন্ডার কথা; বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা আমিও পেতে চেয়েছি, অথচ বিপ্লব করার জন্য আমার পকেটেও কোনো টাকা ছিল না।


প্রিয় কবি সমাজ,

আপনারা কীভাবে সমাজবদ্ধ হয়ে উঠলেন? এরিস্টটল পড়েছেন বলে? পশু না হয় না’ই হতেন, দেবতাও তো হতে পারতেন! অথচ আপনারা সাহিত্য সংঘ করলেন, সাহিত্য সমাজ করলেন! আপনাদের এই মেলবন্ধন কীভাবে হলো আর আমি’ই বা কীভাবে এর বাইরে রয়ে গেলাম!
আমি মূলত প্রেমের কবি, প্রেম ছাড়া কোথাও কিছু দেখি না। দেশপ্রেম, মানব-প্রেম, প্রেমিকার প্রেম, আত্ম-প্রেম— এরকম কয়েক হাজার প্রেমের প্রেমিকা আমি। যে ‘পরম’ থেকে প্রেমের সৃষ্টি; সে সত্তার প্রেমিক আমি; কবিতা কেবল’ই বহিঃপ্রকাশ!

প্রিয় বন্ধু,
বন্ধু’র কথা উঠলে আমি শত্রু খুঁজে পাই না, কখনো কাউকে শত্রুর মত পাইনি। সবাই যেন কীভাবে কীভাবে এসে বন্ধু হয়ে গেছে। শত্রু হতে গেলে যতটা যোগ্যতা লাগে বন্ধু তাতটাই সহজে হয়ে যাওয়া যায়। কাকে শত্রু ভাববো? প্রিয় বন্ধু, তুমি আমার শত্রু হবে? এই প্রপোজাল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি বন্ধুত্বের দ্বারে দ্বারে—কেউ শত্রুত্ব গ্রহণ করেনি।


প্রিয় দেশ, প্রিয় স্বদেশ–

তুমি স্বাধীন, তুমি সেই নারীর মত স্বাধীন; যে নিজেকে পেঁচিয়ে রাখে শাড়ির ভেতরে। তুমিও নিজেকে বেঁধে রেখেছ কাঁটাতারে। তোমাকে ভালোবেসেছি প্রেমিকার চাইতেও বেশী, প্রেমিকার অবহেলা তাও সওয়া যায়, রাষ্ট্রের নয়।
একটি রাষ্ট্রীয় আদেশের অপেক্ষায় আমি জেগে ছিলাম সারারাত, সারা মাস – সারা বছর, এমনকি আমি জেগে ছিলাম সারা জীবন। শেষ পর্যন্ত বেসরকারি মানুষ বলেই ফিরে যেতে হল।


প্রিয়তমা প্রেমিকা আমার,

আপনাকে দেখে এসেছি দেবীর মত। মত বললে ভুল হবে, দেবী’কে দেখেছি আপনার মত। প্রেমিকার পায়ে চুমু খেতে চেয়েছি জলের মত। ভালোবেসে নিষিদ্ধ শব্দগুলো বৈধ করতে চেয়েছি, অসম্ভবকে চেয়েছি সম্ভব করতে; অথচ কেউ আমাকে ভালোবাসা তো দূরের কথা অবহেলা পর্যন্ত দেয়নি।


প্রিয় শিল্পী- চিত্রকর,

বহু দিনের ইচ্ছে কেউ আমার একটা ছবি আঁকুক, যেখানে আমি নিজেকে দেখতে পাব। ছবির গভীর মাহাত্ম্য আমি বুঝি না, রঙ এর খেলা বুঝি না। আমাকে একটা ছবি এঁকে দিও- ঠিক যেমন আমাকে ভাবো তুমি। আমার চুলগুলো পেকে গেলে সাদা না হয়ে আমের মত হলুদ হয়ে যাক, আমার ভালোবাসাকে কষ্টের মত নীল না দেখে, সাদা দিয়ে শুভ্রতায় এঁকো। আমার প্রাপ্তবয়স্কতা দেখাতে গিয়ে আমাকে নগ্ন করে ফেলো না যেন, আমি যৌনতাকে অবাধ ভাবি, শিল্পকে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবি— কেবল নিজের কাপড় কেউ টান দিয়ে খুলে ফেলছে; কল্পনাও করতে পারি না।

প্রিয় সুরকার- গায়ক,
আমার আফসোস হয়, নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়; সংগীতের মত এত ধ্রুপদী একটা শিল্প আমি আত্মস্থ করতে পারিনি বলে। গানের কথা আমি আঊরে দেখেছি—সুর গুণগুনিয়ে দেখেছি—আমার গলায় কোনো সুর নেই। আমার আঙুলে বাঁশি বাজে না, আমি ঠোঁট দিয়ে বাঁশিতে বাতাস ভরে দিতে পারি না, আমার ফুসফুসে দম নেই—- নিজেকে বড্ড তুচ্ছ মনে হয়।
আমার একটা গানে সুর দিয়ে গেয়ে দিবে কেউ? নিচু স্বরে—কাহারবা, দাদরা, ভৈরবী—মালশ্রী—
যে কোনো রাগে—অনুরাগে!

প্রিয় আবৃত্তিকার,
কতটা অসহায় লাগে নিজেকে আপনাকে বুঝাই কী করে? ইচ্ছে করে নিজের হাত আমি নিজে চিবিয়ে খাই, আমার লেখা কবিতা আমি পাঠ করতে পারি না! আমি গলায় কম্পন উঠিয়ে, স্পন্দন তুলে ভাব ও ভাষার প্রয়োগ ঘটাতে পারি না। আমাকে দ্বারস্থ হতে হয় একজন আবৃত্তিকারের! তার মুখে যখন আমার কবিতা শুনি— নিজেকে বোবা মনে হয়। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই মনে মনে, ‘আমাকে কথা বলার শক্তি দাও’- ‘আমাকে বলতে দাও’, ‘আমার বাকযন্ত্রে সক্রিয়তা দাও’!

প্রিয় ধার্মিক এবং অধার্মিক,
মূলত আমরা ঘুরে ফিরে একই সত্তা ধারণ করি। একজন এমন কাউকে বিশ্বাস করি, সর্বশক্তিমান ভেবে নিজেকে সমর্পণ করি যা’কে কখনো দেখিনি, জানিনি। অন্যজন এমন কাউকে মানি না যাকে জানিও না। পার্থক্য কিছুই দেখি না।
আমি সেই জীবন ধারণ করি যেখানে কিছু একটা অস্তিত্ব টের পাই, যেখানে নাড়ীর স্পন্দন আছে। আমার ধর্ম আমার অস্তিত্বে, আমার আচরণে আমার মানবিকতায়, মানসিকতায়। আমার ঘরে বাইবেল, কুরআন, গীতা, ত্রিপিটক নেই; আমি মানুষের চোখে তাকিয়ে পড়ে নেই ঐশিবানী।

প্রিয় প্রকাশক,
সবচেয়ে গুরুতর দায়িত্ব আপনার; আমাকে প্রকাশ করবেন নাকি অপ্রকাশিত রাখবেন সে দায় আপনার কাঁধে। আমি চাইব এই অছিয়তনামা আমার মৃত্যুর পরেই প্রকাশ পাক। যদি মনে হয় আজ এখুনি এই লেখা প্রকাশ করতে হবে, তবে জেনে নিব এখন এই মাত্রই আমার মৃত্যু হলো। যদি মনে হয় এই লেখা প্রকাশ অযোগ্য, তবে যেন কখনোই আমার মৃত্যু না হয়।

জাহিদ অনিক
কবি ও ব্লগার

সাক্ষাৎ – ২য় ও শেষ পর্ব

প্রথম পর্ব এখানে

রেস্টুরেন্ট থেকে যখন বের হয়েছি, বাইরে তখন বেশ কম গাড়িঘোড়া। কেবল সন্ধ্যা হয়ে এসেছে বলেই হয়ত সবাই যার যার মত ঘরে ছুটে গেছে, আর যার ঘর নেই সে গেছে অপরের কাছে৷
আমার আর অমিত কারও কোনো তাড়া ছিল না। তুলনামূলক কম গাড়ি, কম ট্রাফিক দেখে বেশ ভালোই লাগছিল। যেন গল্পের মত পরিবেশ। উইকেন্ড বলেই হয়ত ফাঁকা ফাঁকা।

হাঁটছি পাশাপাশি৷ পাশাপাশি হাটার কারণে অমিতকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না, ইচ্ছে করেই দু’পা পিছিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য ও’কে দেখে নেয়া। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা নয়, যতদূর দেখলে পরবর্তীতে ও’কে মনে রাখতে সুবিধে হয় ততটা।
অমিত একটা কালোমতো জামা পরেছে, সাথে হালকা জিন্সের প্যান্ট। পায়ে কেজ্যুয়াল জুতো৷ জামা জুতো সবকিছুই একেকটা একেক রঙের। ভেবেচিন্তে পরেছে বলে মনে হয় না। ভেবেছিলাম পাঞ্জাবী পরবে অন্তত! এতটুকু রোমান্টিসিজম সে দেখাতেই পারতো।

যেসব ছেলেদের বাড়ি পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান তারা তো সারাদিনই পাঞ্জাবী পরে থাকে। সেসব স্থানের নারীদের কাছে তাদের পুরুষগণ কি সবসময়েই রোমান্টিক? নয় নিশ্চয়! এসব ভাবতেই মনে হল পাঞ্জাবি না পরে আসাটা বোধহয় তাহলে তেমন কোন অপরাধ না, এবারের মত মাফ করে দেয়া হলো। কিন্তু আমি তো শাড়ি পরেছি, সেটাই হয়েছে অস্বস্তি।

রেস্টুরেন্টে খাবারের মেন্যুটা প্রথমে অমিত আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। তারপর নিজে অর্ডার করেছে। সি ফুড আমার পছন্দ। ডেজার্টের মধ্যে কাস্টার্ড। এ-দুটোই দিলাম। অমিত শুধুমাত্র একটা কফি। আর যেচে আমার জন্যও একটা কফি দিল, তাও আবার অনুমতি নিয়ে তবে৷ সবচেয়ে বড় কাণ্ডটি করেছে বিল দেয়ার সময়। আমার হাতটা টেবিলের উপরেই ছিল, ওয়েটার এসে বিল বুকটা রেখে যাওয়া মাত্রই ও’র বাম হাতে আমার ডান হাতটা ঈষৎ চেপে ধরে বললে,

• এলাউ মি প্লিজ!

বলেই এমনভাবে তাকালো যেন চোখ দিয়ে কিছু একটা চাইছে, করুন আকুতি সে চাহনিতে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছু মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে-গিয়েছিলাম। অমিত হাত ধরবে সেটা যেন জানাই ছিল, কিন্তু ভাবতেই পারিনি এভাবে বিল দেবার বাহানায় হাত চেপে ধরবে।
যখন হাতটা ছেড়ে দিলো, মৃদু একটা চাপ দিয়ে কী বুঝাতে চাইলো? ‘আমি আছি, নির্ভরতা!? কী জানি এমনও হতে পারে বেচারা কিছু না বুঝেই হাত ধরে ফেলেছে। আমিই হয়ত ছয় লাইন বেশি ভেবে ফেলছি।

ফুটপাত ধরে হাঁটছি, সামনের পা’দুটো অমিতের, পেছনের দু’টো আমার। কিছু কথাবার্তা হচ্ছে।
এই যেমন,

• আজকের আবহাওয়া বেশ গরম।
• বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই মনে হয়।
• সাবধানে হাঁটুন, দেখে।
• রাস্তা পার হই?

রাস্তা ক্রস করলাম ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে। ওভারব্রিজে লাইটগুলো টিমটিমে৷ মৃদু আলোতে ইচ্ছে করছিলো ব্রিজের উপরে দাড়িয়ে থাকি৷ মৃদু বাতাস আসিছিলো উত্তর থেকে। খুবই মিহি বাতাস। এই ধরনের বাতাস’কে ইংরেজরা খুব কদর করে। আদর করে ওরা নাম দিয়েছে ‘জেন্টেল ব্রিজ’।
কিন্তু আমার যে এই স্টিলের ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে খুব জেন্টেল ব্রিজ খেতে ইচ্ছে করছিলো সেকথা সাথে থাকা জেন্টলম্যানকে কিকরে বুঝাই!
হঠাতই খেয়াল করলাম হাটার সময় আমি যে ইচ্ছে করেই দুইপা পিছিয়ে গিয়েছিলাম সেটা কেমন করে যেন এক লেভেলে এসে গেছে৷ রাস্তা পার হয়ে রিক্সা নিলাম। নিলাম বলতে আমিই নিলাম। অমিতকে দিয়ে কিছু হবে না। সে হয়ত সারা রাত আমাকে রাস্তায় হাঁটিয়েই রাখবে।

অমিতকে আমি কিভাবে কি মূল্যায়ন করব বুঝতে পারছি না। রিক্সা ডাকা মাত্রই সে এমনভাবে হাসি দিল যেন সেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যেন সেও আর হাঁটতে চাইছিল না। তাহলে বাবা রিক্সা ডাকলে না কেন! এই গাধা-গিরির কোনো মানে হয়?

যখন রিক্সায় উঠতে যাব, সে গিয়ে ঘুরে হাত ধরে সাহায্য করলো৷ শাড়ি পরে যে রিক্সায় ওঠা একটু ঝামেলার অমিত কী করে জানে সে কথা!

রিক্সা চলছে কোনদিকে কেউ জানি না। অমিতকে মনে হলো বেশ চিন্তিত,
কিছু সমস্যা? জিজ্ঞেস করতেই উত্তর দিল,

• রাস্তাটা বেশ এবড়োখেবড়ো – শক্ত করে ধ’রে রাখবেন।

আচ্ছা! এই চিন্তা তাহলে? অমিত কি আমাকে খুকি ভাবে? রিক্সা থেকে পড়ে যাব? নিজেকে এতটা স্মার্ট ভাববার কি আছে!
পরক্ষণেই একটা স্পিড ব্রেকারের সাথে একটু জোরেই ধাক্কা খেল রিক্সা, পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে দেখি অমিত অতি ইতস্ততভাবে আমার হাত ধরে আছে।
মনে মনে হেসে নিলাম। একটু গুছিয়ে বসে এবার অমিতের দিকে তাকালাম। এবার নিজেই অমিতের হাতটা টেনে ওর আঙ্গুলগুলোর সাথে আমার আঙুল গুলো জড়িয়ে বললাম,

• দেখবেন, যেন আবার পড়ে না যাই।

রিক্সা এগিয়ে চললো।

অমিতের সাথে রিক্সায় চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমার চেনাজানা শহরে। এই রাস্তা, এই বাতিগুলো সবই আমার চেনা। তবুও যেন মনে হচ্ছে সবকিছু অচেনা। যেন অচেনা পথে সামনের মোড়টা পার হয়ে কী আসবে দোকান না সিনেমা হল সেটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে এগুচ্ছি।
রিক্সায় আর কারও কোনো কথা হলো না। যেন কথা হচ্ছে সব মনে মনে ইথারে ইথারে। পাশাপাশি হাত ধরে বসে এভাবে চুপচাপ থাকাকে কি বলব? মৌন দ্যোতনা? নাকি গভীরতা? নাকি যাতনা!
রিক্সা এসে থামল ঈদগা মাঠের কোনায়। রোজা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। লাইট জ্বালিয়ে ঈদগা তৈরির প্রস্তুতি চলছে। রিক্সা থেকে নেমে অমিত নীরবতা ভাঙল।
বলল,
• আপনার কি ঘরে ফেরার তাড়া আছে?
সন্ধ্যা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অমিত’ই বলল,
• ন’টা কুড়ি৷

ঘরে ফেরার তাড়া যে নেই তা নয়। দেরী করে ফিরলেও সমস্যা কিছু হবে না। দুইটা বড় বড় অজুহাত প্রস্তুত করাই আছে।
তবুও পালটা প্রশ্ন করলাম,

• তাড়া থাকলে কী করবেন?

সময় ও আবেগের গ্রাভিটি কাটিয়ে উঠে অমিত কোনো উত্তর দিতে পারলো না। একটু দূরত্বে দাঁড়িয়েছিলাম, এবার অমিত দুইপা সামনে এগিয়ে আসলো। আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
অমিত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, কী বলতে চাইছে সে? আমি কি সত্যিই জানি না কী বলার থাকতে পারে অমিতের! তবুও কেন ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মুখের বলুক সে। নিজেকে সে প্রকাশ করুক।

মুহূর্তের পর মুহূর্ত অমিত নিবিড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। দাঁড়িয়ে রইলাম আমিও। ভালোবাসা শব্দটিকে আজকাল এত তাচ্ছিল্য-ভরে দেখা হয়, যেন এর থেকে হাস্যকর শব্দ বাংলা ভাষায় আর নেই। অমিত সেই হাসির পাত্র হতে চাইলো না কেন? সে কেন বলল না, ‘ভালোবাসি’।

অমিত এবং আমার দুজনেরই মূলত একই সমস্যা, দুজনেই ভাবছি আমরা অন্যদের থেকে আলাদা, একটু মৌলিকত্ব আছে দুজনের মধ্যেই। কথাটা একেবারেও মিথ্যে নয়। তাই বলে সর্বসাধারণের সাথে মিশে যাওয়া যাবে না এমন কোনো বৈরিতাও তো নেই আমাদের অন্যদের সাথে।
মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, অমিত যদি ভালোবাসার কথা জানায় জিজ্ঞেস করবো, কেন ভালোবাসে?

আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারে নাই। কেউ কেউ বলে মানুষ অন্যকে ভালোবাসে নিজেকে ভালোবাসে বলে, কেউ বলে নিজে ভালো থাকবে বলে অন্যকে ভালোবাসে। কেউ বলে একজন অন্যকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়, তাই ভালোবাসা। সত্যি বলতে আমিও জানি না এর সঠিক জবাব কী হতে পারে?
সত্যিই, কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে ভালোবাসে। মানুষ কি সত্যিই পারে ভালোবাসোতে? সেটা কী আবেগ নয়? মোহ নয়—নেশা নয়?
যদি ধরেও নেই একজন মানুষ সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে আরেকজনকে, তাহলেও বা কে দেবে এই জবাব, কেন সে বেসেছে ভালো!
অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও অমিত কিছু বলছে না দেখে আমিই বলে ফেললাম,

– অমিত, কেন আমাকে ভালোবাসো?

অমিতের চোখমুখ দেখে মনে হলো না যে সে এই প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হয়েছে। এত কনফিডেন্স মানুষ কোথায় থেকে পায়? উলটো কি আমিই অবাক হচ্ছি, বিস্মিত হচ্ছি অমিতের এই নির্লিপ্ত ভাব দেখে! অথচ আমার তো কোনোকিছুতেই বিস্মিত হবার কথা ছিল না। আজ সেভাবেই মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে বের হয়েছি।

অমিত এই প্রশ্নের যে উত্তর দিলো যার বিষয়বস্তু এই যে,
ভালোবাসাকে একটা বইএর সাথে সাথে তুলনা করলে মনে হয় একটু স্পষ্ট হয়। একটা বই যখন পড়া শেষ হয়, এবং যখন মনে হয় লেখক আমার কথাগুলোই বলেছেন, তিনি আমার হয়েই লিখেছেন- তার পুরো বইটা পড়তে পড়তে যখন একই ধরনের চিন্তা হতে থাকে তখন সে’ই বইটিকে ভালোবেসে ফেলা যায়। লেখক’কেও ভালোবেসে ফেলা যায় তবে সেটা অতটা প্রকট নয়।
এই যে বইএর মধ্যে আমি আমাকে খুঁজে পেলাম, এই আমি’টা খুঁজে পাওয়াকেই আমার কাছে মনে হয় ভালোবাসা। কেউ যদি কারও মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায় সেটাই ভালোবাসা।
কথাটা ঠিক কিছুটা, একজন অন্যকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়; এমনটা মনে হলেও কিছুটা যেন আলাদা, কোথায় যেন একটু বৈচিত্রতা আছে। যাক! একটা অন্যরকম উত্তর তো পাওয়া গেল অমিতের থেকে। এই বা কম কিসে!

রাত বেড়ে যাচ্ছে, আমাকে সত্যিই এবার ঘরে ফিরতে হবে। অমিতকেও ফিরতে হবে অনেক দূরে। আমার সাথে ঘুরতে ঘুরতে বেচারা অনেক দূরে চলে এসেছে। বিদায় কীভাবে নেব এসব চিন্তা করতে করতেই হঠাত অমিত বলল,

– ফ্লোরা, একটা জায়গায় যাবেন !

পুরোটা দিন শেষে এই প্রথম অমিত আমার নাম ধরে ডাকল, ওর মুখে নিজের নাম শুনে একটা হার্ট-বিট যেন মিস হয়ে গেল। নিজেকে সামলে বললাম,
– কোথায়?

আমার দিকে তাকিয়ে অমিত এমনভাবে হাসল যেন, নিশ্চিত না হয়ে যাওয়া যাবে না কোথাও! আগে থেকেই ঠিকানা যেনে নিতে হবে; কে বলবে এ ছেলে ছেলেধরা নয়!

অমিতের এমন হাসি দেখে, আমিও হেসে দিলাম। ভুলে গেলাম বাড়ি ফেরার কথা। অমিতের সাথে যেতে থাকলাম কিছুটা দূরে, আরও কিছুটা দূরে— তখনো জানি না কোন জায়গায় যাচ্ছি আমি, কোথায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অমিত!

সাক্ষাৎ – ১

সোজাসুজিই বলি, একজন মানুষকে ভালবাসতাম। খুব বেশী ভালো বাসতাম। কীভাবে বললে বুঝবেন খুব, খুব এর গভীরতা কীভাবে বুঝাই? সবাই বলে প্রেমিকার চোখে গভীরতা থাকে, আমি নিজেকে আয়নায় দেখেছি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, আমার চোখে কোনো গভীরতা নাই। চোখের পাপড়ি এলোমেলো, চোখ দেখলে কেউ প্রেমে পড়ত না।

তাহলে কীভাবে বুঝাই গভীরতা? এতটাই গভীর ছিল সে অনুভূতিগুলো যে আমি কখনোই তাকে ছুঁতে পারতাম না, যত ভাবতাম এই বুঝি ধরে ফেলেছি তার শব্দ, আওয়াজ- ঠিক তক্ষুনি সে চলে গেছে আরও আরও গভীরে, যেন একটা নোঙ্গর শিকল ছিঁড়ে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রে।
যখন প্রথম অমিতের চোখের দিকে তাকাই, কিছুক্ষণ তাকিয়েই ছিলাম। ওর ভালোবাসা যতটা গভীর ছিল, চোখ ততটাই সমতল ছিল। যেন গভীর থেকে উঠে আসা ঢেউ এসে এখানেই মিলিয়ে যাচ্ছে, এই বেলাভূমিতে।

চোখ সম্পর্কে অমিত বলতো, ‘মানুষের চোখের গভীরতা এমন হতে পারে যে, সেখানে এসে নোঙ্গর করতে পারে এথেন্স-গামী বাণিজ্য জাহাজ।’

অমিতের চোখ অতটা গভীর নয়, তবুও তাকিয়েছিলাম অমিতের ভাসা ভাসা চোখের দিকে, ওর চোখের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মুগ্ধকর বিষয় ছিল ওর চোখে যেন সবসময়য় এক ফোটা জল এসে চিকচিক করত। যেন সূর্যের আলো এসে এইমাত্র পবিত্রতায় ভরিয়ে দিয়ে গেল দুটি চোখ, এখন যা দেখবে সবই মনে হবে শুদ্ধ, সবই মনে হবে পবিত্র। পরে জেনেছিলাম, ওটা ওর চোখের অসুখ। ওর চোখ দিয়ে প্রায়ই জল পড়ত। কি জানি ওর ঐ অসুখটাই আমার কাছে সুখের কারণ হতে লাগলো।

ছেলেদের সাধারণত বেশী ফর্সা হতে নেই, বেশী ফর্সা হলে কেমন একটা গাধা টাইপের মনে হয়। অমিত ছিল এই গাধা লেভেল ফর্সার থেকে একটু উপরে। ওকে দেখে ঠিক গাধা টাইপ ফর্সা মনে হয়ত না। তবে কখনো ভাবিনি কোনো ফর্সা ছেলের সাথে প্রেম করবো। এমনিতে আমি নিজেই ফর্সা, তাই সবসময়েই একটু কালো ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ ছিল। কিন্তু ওর চোখদুটো দেখে দেখতেই থাকলাম! অমিতের সব রহস্য যেন সব ওর চোখে। চোখের নিচ দিকটায় কালো কালো দাগ, ডার্ক সাইকেল। কতদিন ঘুমায়-নি এই মানুষটা? এত রাত সে কেন জাগে? তার কি অনেক দুঃখ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতাম ওর চোখে।

সত্যি বলতে ভালোবাসা, প্রেম এই শব্দগুলোর সাথে আমার কখনোই কোনো বিরোধ ছিল না। আমার কাছে ভালোবাসা মানে খারাপ কিছু না। যখন যে আমাকে ভালবেসেছে আমিও তখন চেষ্টা করেছি তাকে তার প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিতে। ভালোবাসা একটা অদ্ভুত মাদকতা, অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয় আপনা আপনিই।
এমন কোনো মহৎ ভালোবাসার অপেক্ষায় কখনো থাকিনি যা এসে আমাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়ে যাবে। মনে হত, জীবনে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য খেতে হয় ভালোবাসাও তেমন পেতে হয়, দিতে হয়। কখনো কখনো দুঃখ পেতে হয়, আবার দুঃখ দিতেও হয়। হৃদয়ের এই দাবীকে কখনোই অস্বীকার করতে পারিনি।

অমিতের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল একটা খোলা রাস্তায়। এমন না যে সে’ই আমাদের প্রথম পরিচয়। পরিচয় হয়েছিল অনেক আগেই। আমাদের কথা হত টেলিফোনে, চিঠিতে ভাবের আদান প্রদান হয়ত। অমিত বলত, ‘ওর কোনো ভাব নেই, আছে কেবল অভাব।’ অমিতের সবগুলো কথাকে আমি নোট করতাম, যেগুলো মনে হয়ত টুকে রাখা দরকার, টুকে রাখতাম। জন্মদিন, বিশেষ বিশেষ দিন তারিখ, বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত সবকিছুই টুকে রাখতাম।

রাস্তা থেকে আমরা চলে গেলাম পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে অমিতের ধারণা তেমন ছিল না। আমারও তেমন ভালো জানাশোনা কোনো রেস্তোরা ছিল না। তাই অমিত যেখানে নিয়ে যায় সেখানেই যাব বলে স্থির করলাম। অমিত যা যা অর্ডার করবে সেগুলোই তৃপ্তি নিয়ে খাব, আমি আজ শুধু অমিতের কথা শুনব; মোটামুটি কোনো অতিরিক্ত আশা রাখব না, কোনো প্রত্যাশা রাখব না- বাসা থেকে বের হবার সময় এমনভাবেই নিজেকেই মাইন্ড সেটআপ করে বের হয়েছি।

যদিও কথাবার্তায়, চিঠিতে খুব ভদ্র ও মার্জিত, তবুও হয়ত মানুষ চিঠিতে এক রকম আর বাস্তবিক আরেক রকম। অমিত’কে তাই বেশী মানবীয় ভাবতে ইচ্ছে করছে না। অমিত’কে ভাবছি নিজের জানাশোনা মানুষদের দিয়েই। তাদের দিয়েই অমিতের মানসিকতা মাপছি। অথচ চেয়েছিলাম কোনো মাপজোক করব না, একদম বিচারবুদ্ধি সব বাসায় রেখে বের হব। কিন্তু পারছি কই?

রেস্টুরেন্টে যখন পৌঁছলাম, সন্ধ্যা প্রায় হবে হবে। অমিতের কাছে শুনেছি সন্ধ্যা সময়টা বেশ পবিত্র। রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে সে কাচের দরজার হাতল ধরে দরজা খুলে, আমাকে সম্ভাষণের মত করে হাত বাড়িয়ে কুর্নিশ করে আগে যেতে বইলো। আমি ভেতরে যাওয়া মাত্র একটা টেবিল বেছে নিয়ে টেবিলের থেকে চেয়ারটা টেনে আমাকে বসতে বললো। তারপর আমার থেকে সামনে গিয়ে চেয়ারের হাতল ধরে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ নম্র স্বরে জানতে চাইলো,
– মে আই হ্যাভ এ সিট?
আমি এই অদ্ভুত আতিথেয়তার কি উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না, ফিক করে হেসে দিলাম।

(চলবে )